নাটক



বিচার

র থী ন্দ্র না থ রা য়

 চরিত্রলিপি
রতন: শিক্ষক
সত্যব্রত: রাজনৈতিক নেতা
অজয়, ভীম: অনুচর
বন্যা: ছাত্রী
জনতা

(স্কুলড্রেসে বন্যা আসে। বয়স আন্দাজ চোদ্দো-পনেরো। উদ্বিগ্ন। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আসে।)

বন্যা-- কি যে করি। বন্ধুরাও কেউ এলোনা। টিউশন আছে বলে বাজারের দিকে চলে গেল। বাজারে কিছু কেনাকাটা করে স্যারের বাড়ি যাবে। আজ সাইকেলটাও আনা হয়নি। মাঠের ওপর দিয়ে একা একা যেতে হবে। প্রতিদিনই যাই। ভয় পাইনা। কিন্তু আজ ওই শয়তান দুটো মনে হচ্ছে আমার পিছু নিয়েছে। রাস্তায় একজনও লোক নেই। কি যে হবে, কে জানে? এখন তাড়াতাড়ি পা চালাই। 

(চলতে থাকে। পিছনে কারা যেন কথা বলে।)  

নেপথ্যে 

অজয়-- শালার মালটা খাসা দেখতে। উঠতি মাল। জমবে ভালো । এই ভীম, শালার নাদুস নুদুস, ওই ঝোপটার আড়ালে লুকিয়ে থাক। আমি শিস দিলেই বেরিয়ে আসবি। 

(অজয় আসে। বখাটে মার্কা চেহারা। ডানহাতের কব্জিতে লাল সুতো বাঁধা। পরণে ট্রাকস্যুট ও গায়ে লাল গেঞ্জি।)

অজয়-- (স্বগতোক্তি ) মেয়েটার কাছে আমাকে ভালো সাজতে হবে। তারপর ভাব জমিয়ে ওই বাগানের ফাঁকা ঘরে গিয়ে... ভোজ, ভোজ হবে... হা হা হা... এই পথ যদি না শেষ হয়! ধুত্তোর, আজ আবার বাইকটাও আনা হয়নি। তাহলে ওকে নিয়ে পথ আর শেষ হতোনা। ওই তো মেয়েটা চলেছে। কি যেন নামটা... বন্যা। এই যে বন্যা একটু দাঁড়াও না মাইরী! 

(বন্যা প্রায় ছুটতে থাকে।)

অজয়-- (কাছাকাছি এসে) ডার্লিং একটু দাঁড়াও না। চলোনা, ওই ঝোপের আড়ালে একটু বসি। টুকচেন গল্প করি। 

বন্যা-- দাদা, আমি আপনার বোনের মতো। তাহলে আমাকে বিরক্ত না করে যেতে দিন। 

অজয়-- হাঁ, তুমি তো আমার বোনের মতোই। সেজন্যই তো বলছি; (সুর করে) চলোনা, দোহাই তোমার... একটু আধটু গল্প করি। 

বন্যা-- (যাবার চেষ্টা করে) প্লীজ, আমাকে যেতে দিন। 

অজয়-- (পথ আটকে) যাবেই তো, অতো তাড়া কিসের? আগে তোমার শরীরটাকে... হা হা হা; একটু দলাইমলাই... হে হে হে, মানে একটু ম্যাসাজ, মানে একটু আদর... তারপর যেও, হাঁ যেও আমি বাধা দিব না। 

বন্যা-- (কাঁদতে কাঁদতে) দোহাই দাদা, আপনার দুটি পায়ে পড়ি;  প্লীজ! আপনারও ঘরে বোন আছে। তার মুখটা মনে করুন; ঠিক আমারই মতো দেখতে। প্লীজ আমাকে যেতে দিন। 

অজয়-- দিব তো। আগে আমার সঙ্গে চল। ঝোপের আড়ালে... বেশিক্ষণ না। জানিস তো আমি কার লোক? আমার গুরু কে? যার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায় -- আমি সেই সত্যব্রত মণ্ডলের লোক। এই দীঘনগর এলাকায় আমার গুরুই শেষ কথা। যে শালা আমাদের বিরুদ্ধে কথা কইবেন -- সুটিয়ে লাল করে দিব।

(বন্যা হঠাৎ পাশ কাটিয়ে ছুটতে থাকে।
একবার পড়ে যায়। আবার দৌড়ায়।) 
মালটার তেজ আছে। সোজা কথায় কাজ হবেনা। (সেও ছুটতে থাকে) 
(বন্যা বইয়ের ব্যাগটা ছুঁড়ে দেয় ওর দিকে।)
দাঁড়া, দাঁড়া বলছি। (ছুটতে ছুটতে ওর নীল ওড়নাটা ধরে ফেলে।) 

বন্যা-- কে আছো, বাঁচাও।

অজয়-- হা হা হা, মা মনি কেউ নাই গ ,  শুধু আমি আছি বটে। তোর ডবকা শরীরটাকে আজ... হা হা হা, চেটেপুটে... 

বন্যা-- (সজোরে একটা থাপ্পর কষিয়ে) শয়তান, লজ্জাশরমও নেই তোর! 

অজয়-- (গালে হাত দিয়ে) তুই আমার গায়ে হাত দিয়েছিস! আজ আর কোনো বাবা তোকে বাঁচাতে পারবেনা। 
(শিস দেয়। ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে ভীম। মোটাসোটা।‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ মাথার চুলগুলো সোনালী। বখাটেদের মতো পোশাক।) 

ভীম-- বেশি ছটফট করিসনা বন্যা। মরবি তুই। জানিসতো, এ গাঁয়ে আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলার লোক একটিও নাই। যে কথা কইবে, আমাদের গুরু তাকে গাঁজার কেস দিয়ে লক আপে ভরে দেবে। তারপর পুলিশের কেলানি খেয়ে মায়ের ভোগে চলে যাবে বাছাধন। 
(দুজনে দুদিক থেকে এগিয়ে আসে। 
বন্যা হঠাৎ পাশে পড়ে থাকা একটা গাছের ডাল নিয়ে সজোরে ভীমকে মারে।) 

ভীম-- বাবাগো! (মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।)

অজয়-- (বন্যাকে ধরে ফেলে) এবার তোর ডানাদুটো ভেঙে দিয়ে... চল ওই ঝোপের আড়ালে। 

বন্যা-- বাঁচাও! 

অজয়-- কেউ আসবেনা। (ওর মুখে কিছু একটা গুঁজে দেয় অজয়। গোঙাতে থাকে বন্যা। একটা একটা করে ঝোপের আড়াল থেকে বন্যার স্কুলের ইউনিফর্মগুলো মঞ্চে এসে পড়ে।

ভীম-- (ওর মাথা থেকে তখনো রক্ত গড়াচ্ছে) অজয় ছাড়িসনা। ওর সর্বনাশ করে দে। ও আমার রক্ত ঝরিয়েছে। 

বন্যা-- আ - আ - (চীৎকার করে ককিয়ে ওঠে)

অজয়-- (প্যান্টের চেন আঁটতে আঁটতে মঞ্চে আসে) এবার চল ভীম। আমাদের কাজ শেষ। শোন বন্যা, তুই যদি আমাদের নাম বলিস, তাহলে তুই এবং তোর ফ্যামিলির কেউ বাঁচবেক নাই। কথাটো মনে রাখলেই ভালো। 
(অজয় ও ভীম চলে যায়।)

নেপথ্যে  সাইকেলের বেল বাজে। রতন আসে। সে সাইকেলটাকে দাঁড় করিয়ে রাখে। 

রতন-- কি ব্যাপার, একটা গোঙানির মতো আওয়াজ আসছেনা? (কান পেতে শোনার চেষ্টা করে)

বন্যা-- (ঝোপের আড়াল থেকে গোঙাতে, গোঙাতে) বাঁচান, বাঁচান, বাঁচান -- একটু জল...

রতন-- কে, কে ওখানে? 

বন্যা-- এ খা নে আসবে ন না স্যার। ওরা আ মা র ক্ষতি করে দিয়েছে। 

রতন-- তুই তো বন্যা, আমারই স্কুলের ছাত্রী। 

বন্যা-- (ছেঁড়া অন্তর্বাস, হাত দিয়ে নিজেকে আড়াল করে সামনে আসে) মাস্টারম শা ই (কাঁদতে থাকে)

রতন-- একি! (অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে, নিজের জামাটা খুলে ওর দিকে তুলে ধরে) এটা আগে পড়ে নে মা। 

বন্যা-- (জামাটা পড়ে নেয়) মাস্টারমশাই, ওরা আমার...

রতন-- বুঝতে পেরেছি মা। এ আমরা কোন্ অন্ধকারের রাজত্বে বাস করছি জানিনা। চল মা, আগে তোর চিকিৎসার ব্যবস্থা করি, তারপর থানায় যাবো। এর বিচার চাইব। 

(বিধ্বস্ত বন্যা কোনও  ভাবে চলার চেষ্টা করে) নেপথ্যে একটা গাড়ির শব্দ হয়। মঞ্চে আসে সত্যব্রত সঙ্গে ওর সাগরেদ পল্টু।

সত্য-- আরে ম্যাস্টর যে! কোথায় যেছো বটে? 

রতন-- কোথায় আর যাবো এই অন্ধকারের রাজত্ব ছেড়ে? 

সত্য-- অন্ধকারের রাজত্ব? হাঁ ম্যাস্টর দিব্যি সুখে মাস্টারি করছ, আর বলছ অন্ধকারের রাজত্ব!

রতন-- নয় তো কি? দেখোনা এই মেয়েটার অবস্থা! স্কুল থেকে ফিরছিল। পথে ঝোপের আড়ালে কারা যেন ওর সম্ভ্রম...

সত্য-- আহারে... এই মেয়ে তুই চিনিস তাদের?

বন্যা-- চিনি বটে। কিন্তু আপনিই তো ওদের নাটের গুরু! আপনি করবেন ওদের বিচার?

সত্য-- এই মেয়ে, বড্ড মুখ তো তোর। বলি নাম বলতো তাদের।

বন্যা-- অজয়...

সত্য-- না, না... এ হতেই পারেনা। তুই ভুল দেখেছিস। কোথায় কার সঙ্গে কি করে এখন অজয়ের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছিস? এই মেয়ে তোর সাহস তো মন্দ নয়। যা, যা... বাড়ি যা। ম্যাস্টর ওরে বাড়ি নে যাও দোষটা অজয়ের নয়, দোষটা ওই মেয়ের... তা আগে বিচার করতে হবে। যেও, আমার অফিসে যেও আজ সাঁঝবেলায়। এসব কেলেঙ্কারির খবর পাঁচকান না হওয়াই ভালো। 

রতন-- থামো, তোমাদের মতো নেতারাই ওদের আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলেছে। যার জন্য একটা স্কুল পড়ুয়া মেয়ে ওর লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচতে পারলোনা। পথ ছাড়ো, আগে এই মেয়েটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। তারপর...

সত্য-- তারপর কি করবে গো ম্যাস্টর? গাঁজা, গাঁজার কেস দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেব। লক আপে পেটানি খেলে বাপের নাম ভুলে যাবে ম্যাস্টর। তার থেকে যা বলি, শোনো। ওসব দুষ্টু ছেলেমেয়েদের ব্যাপার। তুমি ম্যাস্টর হয়ে কেন ওসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ? করছ করো, কিন্তু আমার ব্যাপারে নাক গলাতে এলে সুটিয়ে লাল করে দেব। 

রতন-- সত্য, দেখা যাবে কে কাকে সুটিয়ে লাল করে। বন্যা, আয় মা। এরা অন্ধকারের কারবারি, আলোর মহিমা এরা বুঝবে কিভাবে?

পল্টু--  অনেকক্ষণ ধরে এ ব্যাটা ম্যাস্টরের বক্তিমে শুনচি। গুরু একবার হুকুম দাও ও ব্যাটা ম্যাস্টরকে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিই। 

সত্য-- (স্বগতোক্তি) এখন বেশি বাড়াবাড়ি করলে ফল খারাপ হতে পারে। সামনে পঞ্চায়েত ইলেকশন... যদি পাশার ছক উল্টে যায়? যদি ভোটবাক্সে ভুতুড়ে ভোটের আমদানি না হয়... তাহলে গদিটাই টলমল হয়ে পড়বে। তার চেয়ে (প্রকাশ্যে) শোনো ম্যাস্টর, তুমি ম্যাস্টর... তোমার একটা সম্মান আছে। ছাত্রীর সঙ্গে এসব কি ভালো দেখায় ? তার চেয়ে চেপে যাও। তাতে তোমারও কিছু নগদ লক্ষীলাভ হবে... সঙ্গে আমাদেরও। এসব ছোটোখাটো ঘটনায় মাথা গরম করা কি উচিত বলো। 

রতন-- থামো, অনেক লেকচার দিয়েছ। তোমার লেকচারবাজিতে আমি ভয় পাইনা। ছাত্র ছাত্রীরা আমার সন্তানতুল্য। তাদের বিপদে আমি প্রাণ দিয়ে লড়ব। যতোই গাঁজার কেসের ভয় দেখাও, পিছিয়ে আমি আসবনা। 

বন্যা-- স্যার এই জল্লাদের কথা বিশ্বাস করবেননা। এরা শয়তান, এরা পারেনা এমন কোনো কাজ নেই। 

সত্য-- এই মেয়ে বড্ড মুখ তো তোর! তোর শিক্ষে  হয়নি এখনো। এটা আমার গড়। এখানে আমিই ভগবান। আমার মুখের কথাই এখানে আইন। 

রতন-- দেখা যাবে কে ভগবান? আর কার মুখের কথাই আইন? চলে আয় মা। 
(রতন ও বন্যা চলে যায়।)

সত্য-- ব্যাটা ম্যাস্টরের বড্ড বাড় বেড়েছে। গাঁজার কেসে ওকে লক আপে ভরতেই হবে। নাহলে আমার সম্মান থাকবেনা। 

পল্টু-- গুরু,বলতো একটা পেটো ঝেড়ে দিই। 

সত্য-- না, ওতে লোক জানাজানিটা বেশি হবে। তার চেয়ে... দাঁড়া একটা ফোন করি। (পকেট থেকে মোবাইল বের করে নাম্বার টেপে) 

অপরপ্রান্ত-- হ্যালো, গুরু কোনো খবর আছে ?

সত্য-- আছে। এই মাত্র রতন ম্যাস্টর হারু মাঝির মেয়ে বন্যাকে নিয়ে হাসপাতালে যাবে মেডিকেল টেস্ট করাতে। তারপর যাবে থানায়। দুজায়গাতেই যে একটু বলে দিতে হবে। 

অপরপ্রান্ত-- ও আপনি চিন্তে করবেননা। আমি বলে দিচ্ছি। গুরু, এতো কথায় কাজ কি, বলো তো ও দুটোকে খরচের খাতায়-- 

সত্য-- মোটেই না। সামনে পঞ্চায়েত ভোট। তাই রিস্ক নেওয়া যাবেনা। যা করব সাবধানে... এখন রাখছি। (মোবাইল রেখে দেয়) 

নেপথ্যে অসংখ্য লোকের চীৎকার-- ধর ধর, মার মার, মেরে তক্তা বানিয়ে দে। 

সত্য-- একিরে পল্টা... ওরা কারা? ওরা তো এদিকেই আসছে। 

পল্টু-- তাইতো, এদিকেই আসছে। ওদের হাতে তীর ধনুক, লাঠি, বল্লম... ঝাঁটা হাতে মেয়েরাও আছে গুরু। অবস্থা বেগতিক। (রক্তাক্ত অবস্থায় অজয় ও ভীম আসে) 

অজয়-- গুরু বাঁচাও। ওরা আমাদের মেরে ফেলবে। গোটা গ্রামের লোক এককাট্টা হয়ে ছুটে আসছে। প্রচুর মেরেছে আমাদের। কোনোরকমে পালিয়ে এসেছি। 

ভীম-- চারদিক থেকে লোক আসছে গুরু। এবার আর রক্ষে নেই। 

সত্য-- পল্টা, পেটো... পেটো ঝার। 

পল্টু-- পেটো তো ডেরায় আছে। 

সত্য-- তাহলে... রক্ষে নেই। পালাতে হবে। 
(পালাবার উপক্রম করে।) 

নেপথ্যে অনেক কণ্ঠে-- মার মার, শালারা আমাদের মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে...
(জনতা আসে। তাদের হাতে তীর ধনুক,লাঠি, বল্লম... সত্য, পল্টু, অজয়, ভীম... জনতার সামনে জোড়হাতে হাঁটু গেড়ে বসে) 

সত্য-- দোহাই তোমাদের। কথা দিচ্ছি, অজয় যে অন্যায় করেছে তার বিচার হবে। তোমরা শান্ত হও। 

১ম জনতা-- শান্ত হবো শুয়োরের বাচ্চা, গাঁ ষোলো আনা তোদের বিচের করবে। গৌড় নিতাইয়ের মতো চল আমাদের সঙ্গে। 
(সত্য, পল্টু, অজয়, ভীম -- ওরা হাত তুলে চলতে থাকে। পিছনে জনতা। যবনিকা নেমে আসে।) 

(সমাপ্ত)








মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪