গল্প



জ্যোৎস্নার মুখ কিংবা অল্টোর চোখ

গী ত শ্রী  সি ন হা 

বসন্তের সোহাগী মুহূর্তে বেহাগ অস্থিরভাবে অপেক্ষারত। কথা দিয়েছে হর্ষাকে আজ দেখা হবে তাদের! পথেঘাটে হামাগুড়ি  খাচ্ছে  বসন্তের ঝরা পাতা, ফুলের পাপড়ি... মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে অশোক, হিমঝুরি, ইউক্যালিপটাস, রক্তকাঞ্চন, দেবদারু, পলাশ, মহুয়া, শাল - শিমুলের দল--- সাথে ক্যামেলিয়ার হাতছানি... 
ফোনে কথা হতো কখনওবা। সেই দেখা হয়েছিল ইউনিভার্সিটির শেষ দিনে। 

বেহাগ কলেজে পড়ায়, হর্ষা বিখ্যাত খ্যাতিমান বাবার ব্যবসার অংশীদার। 

দ্রুত পায়ে পায়চারি করতে থাকে হর্ষার জন্য বেহাগ। ফোনে বেজে ওঠে রবীন্দ্রসংগীতের প্রেমের সুর---
------- তুমি পথে আছো বলে ফোন করছিলাম না হর্ষা! প্লিজ বলো, আর কতোক্ষণ!
------- এ-ই তো বেহাগ, আমি এসে গেছি গো!
একটা ঢিল তুলে ছুঁড়ে মারে অনেক দূরে পুকুরের মাঝ বরাবর ---- দুই হাত প্রসারিত করে চিৎকার করতে থাকে "ভালোবাসি হর্ষা! খুব ভালোবাসি তোমায়"!
 সুন্দরী সুসজ্জিত সাজে হর্ষা দূর থেকে কাছে আসতে থাকে, আরও কাছে--- তাকিয়ে থাকে পরস্পর পরস্পরের মুখোমুখি...   অনেক না বলা কথা নীরবে বলতে থাকে! দু'জনের চোখেই বিস্ময়! 
প্রকৃতি উজাড় করা জায়গা দেখে আপ্লুত হর্ষা, বলে 
------- তুমি তো বলো নি বেহাগ তোমার কাছে এতো সুন্দর জায়গা আছে!
------- তোমার কথা ভেবেই জ্যোৎস্না রাতের বসন্তের আকাশ দেখবো আমরা... হর্ষা আজকের জ্যোৎস্না  রাত শুধু তোমায় দিলাম!
------- না না আমরা দু'জনে ভাগাভাগি করে নিলাম... 
------- একটা নদীর নাম বলো হর্ষা? 
------- কুন্তি!
------- একটা পাখির নাম বলো? 
------- নীলকন্ঠ!
------- একটা দ্বীপের নাম বলো এবার? 
------- হুঁ হুঁ সবুজদ্বীপ!
------ না না হলো না...  অন্য কোনো নাম বলো 
       প্লিজ!
------ কেন? বাবুর মনে ধরলো না বুঝি নামটা?
------ না, তা ঠিক না!  দ্বীপ তো সবুজ হয়... অন্য কোনো নাম বলো? 
------- আমার মনে আসছে না যে! তুমি বলো!
-------  ধরো যদি হয়...  মানস দ্বীপ! কেমন নাম?  চলবে তো?
------- উফ চলবে মানে! দৌঁড়োবে গো! নাইস নাম। ফাটাফাটি গো!
------- দু'জনে হাঁটছে, মেঠো পথ ধরে, পাশাপাশি, মাথার উপর গোল চাঁদ প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে,  আঁকাবাঁকা পথ সরু হয়ে গেছে...  কাছাকাছি দু'জনে... 
------- চাঁদটা দেখেছো? হর্ষা চাঁদটা দেখায়। 
------- হুঁ! 
------- শুধু হুঁ! আর কিছু না! কিছু তো বলো!
------- বারে...  কি বলব? 
------- চাঁদটার কথা! ভালো না?
------- ভালো। তবে যদি ফুলতে ফুলতে ফেটে যায়, তখন? 
------- তাহলে আরও ভালো! জ্যোৎস্নার প্লাবনে ভেসে যাবে সব! আর আমরাও... 
-------- হর্ষার গলায় গাঢ আবেশ! স্বপ্ন ভাসছে দু'চোখের পাতায়। বেহাগ টের পায়। বেহাগের অন্যরকম লাগে হর্ষা কে। বেহাগের খুব মিষ্টি লাগে এই মুহূর্তে  হর্ষা কে, যেন সুগার ফ্রি কিউবের মতো মিষ্টি, বলতে ইচ্ছে হয়, হর্ষা তুমি চাতক তৃষ্ণায় কাতর মাটির বুকে প্রথম বৃষ্টি। ভেজা মাটি ঘ্রাণের মতো তুমি সুন্দর। 

------- কথা বলো কিছু! চুপ কেন বেহাগ! হর্ষা তাকিয়ে থাকে বেহাগের দিকে। লম্বা ফর্সা বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, মাথায় একরাশ ঘন কালো চুল...  কপালে নেমে এসেছে, পাজামা পাঞ্জাবি, কাঁধে ঢাউস ব্যাগ। 
------- ভাবছি, কোথা থেকে শুরু করি!
------- তোমার তো কখনো কথার অসুখ হয় না বেহাগ! ঝর্ণার মতো ঝরঝর করে বয়ে যাও! তুমি ঝর্ণা হও বেহাগ!
------- যথা আজ্ঞা দেবী। তাহলে সেইভাবেই শুরু করি হর্ষা... 
------- বলো? 
------- তুমি তো আমার কাছে কিছু চাইলে না?
------- বলো কি চাইবো?  
------- ঐ তিনটি জিনিসের মধ্যে একটা... নীলকন্ঠ পাখি, কুন্তি নদী কিংবা মানস দ্বীপ। 
------- চাইলে দেবে?
------- আলবাৎ! চেয়েই দেখো!
------- সত্যি দেবে? ধরো যদি চাই মানস দ্বীপ?
------- নাও দিলাম! বেহাগ এমনভাবে বললো যেন দ্বীপের রাজা সে।  
------- রিনরিন করে হাসতে থাকে হর্ষা, বেহাগের বলার ধরণ দেখে। হাসির শব্দে ফিরে তাকায় বেহাগ। খুব কাছটিতে হর্ষা। শ্যামলা একটা মিষ্টি মেয়ে, চুলের ঢল নেমেছে পিঠ বেয়ে নদীর মতো। কপালের টিপে লেগে আছে যেন শিল্পচ্ছটা। দু'চোখে ভাসে স্বপ্ন, সারা মুখে জ্যোৎস্না ছড়ানো। বসন্তের পড়ন্ত বিকেলে মাথায় আলতো করে ঘোমটার মতো আঁচলের অন্যমনস্ক আবরণ... বেহাগের চোখে আইডিয়াল বাঙালি বউ।  
-------- এই রে একটা ভুল হয়ে গেল! হর্ষার চাহুনিতে প্রশ্ন চিহ্ন। গলায় উৎকন্ঠা!
-------- কি আবার ভুল হলো?
-------- দ্বীপটা তো নিলাম! জানা হলো না তো দ্বীপটা কেমন?
------- ভয় নেই তোমার হর্ষা, ভারি সুন্দর দ্বীপ। সবুজ... অনেক গাছ, প্রচুর আলো, টাটকা বাতাস, পাখিদের গুঞ্জন, ফুলে ফলে গন্ধমাখা হাজারো  প্রজাপতির ঘর উঠান, খেলার বন্ধু হবো আমরাও। দ্বীপের নদীর জলে ভাসানোর জন্য আছে একটা শালতি। 
------- আর? আর কিছু নেই? 
------- আছে, অনেক কিছু আছে সেই দ্বীপে, মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বেহাগ বলে আলতো করে, খুঁজে নিতে হবে আমাদের। পারবে না? পারবে তো হর্ষা?  
------- যদি খুঁজে কিছুই না পাই? গলায় বরফগলা হতাশা। 
------- ফিরে আসবো! 
------- কোথায়? 
হঠাৎ দূরে কোথাও একটা পাখি ডেকে ওঠে। ডাকটা শোনে। এই ডাকের মধ্যে ফিরে পায় তার স্বপ্নের ছবি। যা শোনার জন্য হর্ষা তাকিয়ে আছে চোখের আকাশ মেলে। 
-------- হর্ষা--
------- হুঁ... 
------- তোমাকে দ্বীপটা সম্বন্ধে সব বলা হয় নি। 
------- আরও কথা আছে...?  গলায় অভিমানের গাঢ কুয়াশা। 
আছে হর্ষা আছে। সেই দ্বীপে থাকবে আমাদের বাড়ি। নীল রঙের, আকাঙ্ক্ষার রঙ, আমরা ভেসে চলবো, ভাসতে ভাসতে আমরা রক্তের ঋণ শোধ করবো। তুমি আমি ছাড়া আমরা হয়তো দুই থেকে তিন বা চার হবো। তাদের জন্য আমার মা শীতের কথা ভেবে পশমের পোশাক বানাবে। আর আমার বাবা! তাদের কথা ভেবে গাছ ফুল আর পাখিদের নিয়ে গানের সুর তুলবে। 
------- না না, না, একদম হবে না। 
------- কি হবে না?  
-------- জায়গা হবে না। আরও জায়গা চাই। অনেক বড় জায়গা। 
------- তুমি খুব জোরে ছুটতে চাও হর্ষা, আমি চাই না গো। 
ওরা পাশাপাশি কাছাকাছি হাঁটছে। বেহাগ আর হর্ষা। ওদের শরীর বেয়ে নামছে জ্যোৎস্না। কেমন যেন শীত শীত করে। শরীরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্নার টুকরো ক্রমশ হাল্কা হতে থাকে... ওরা হারিয়ে ফেলে জীবনের সুখের চিহ্ন। বেহাগ ভাবে, বেহালার সুমধুর সুর কেটে গেল... আর হর্ষা! যার নামে লুকানো আছে পরম আনন্দ সুখ। 
কথা হারিয়ে গ্যাছে ওদের ---- 

এই দীর্ঘপথে অস্বাভাবিক চুপ করে থাকার পর অধৈর্য হর্ষা প্রথম কথা বলে।
-------- কি ঠিক করলে ?  
-------- কিসের ঠিক ? 
-------- দায়িত্ব নেবার আগে সব পুরুষই ওরকম ন্যাকামার্কা কথা বলে। 
-------- আমি তো দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছি না, যেটা ঠিক করেছি সেটাই হবে। 
-------- শেষমেশ বিয়ের পর ধ্যাড়ধ্যাড়ে বৈকন্ঠপুর। জলা জঞ্জাল। লম্বা টালির বাড়ি। নিকোনো উঠোন। তুলসী মঞ্চ। হেঁপো শ্বশুর। হাজারো ব্রত মানা বুড়ি শাশুড়ি, ডিসগ্যাসটিং... জাস্ট ডিসগ্যাসটিং। হাল্কা রঙিন চুল ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলতে থাকে হর্ষা। 
------- কি হবে তবে? 
------- আমার বাবা ফ্ল্যাট বুক করে রেখেছে, দক্ষিণ খোলা বিশাল সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটে তুমি রাজা আর আমি তোমার... টাকাটা বাবা-ই দিয়ে দেবে। দামি আসবাবপত্রের মধ্যে আমরা সুখ খুঁজে পাবো গো ! 
কথা হারায় বেহাগ ! 
-------- আর কিছু বলবে বলো?  নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির মতো সরু চোখে তাকায় হর্ষা। 
------- না ।  একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেলে বেহাগ।  
------- ওকে ! সো উই আর গোয়িং টু বি সেটেল্ড।
কথাটা বেহাগের কানে এলার্ম-ঘড়ির মতো ঝংকার তোলে। বেহাগ হর্ষার কথায় উত্তর দিতে গিয়েও চুপ থাকে। পিছন থেকে ছুটে আসা দু'চোখ জ্বালিয়ে অলটো পাশে এসে দাঁড়ায়। পারফিউমের উগ্র গন্ধ রেখে হর্ষা অলটোর কোলে গিয়ে বসে। ধোঁয়া উড়িয়ে জ্যোৎস্নার পেট চিরে বেরিয়ে যায় দামী গাড়ি...  
চেয়ে থাকে বেহাগ ...
অস্ফুটস্বরে শুধু বলে চলে ---- হর্ষা, তুমি ভালোবাসাকে ভালোবাসো নি, সুখ কে ভালোবেসে গ্যাছো...
পায়ে পায়ে ঢিল মারা দূরত্বের জলাশয়ের সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে দেখতে পায় বেহাগ জলের উপর ফ্ল্যাশব্যাকে আজকের এতোক্ষণের মূল্যহীন সময়ের ছবি!






দস্যু

হে ম ন্ত  স র খে ল
          
কিগরী'র মুঠো থেকে ঠক্ করে পড়ে টল দৌঁড় লাগালো কাটা গম খেতের মধ্যে। জমিটা বাঁধের গায়ে। অন্য পাশে মহুয়া তার বাস গেঁড়েছে। শেষ সময়ের রস শুষে নিতে নিতে গম ধাত্রী ফাটিয়ে ফেলেছে। অজস্র ফাটল। কোথায় যে লুকোবে এবার কিসমিসের দানার মতো গুলিটা! শরীর কেঁপে উঠল আধরত্তিটার। দানবের মতো আচরণ করে নখড়ু। পান থেকে চুন খসলেই চুলের মুঠি ধরে আছড়ে ফ্যালে মাটিতে। লাথি মারে ক্যাত্ ক্যাত্। যখন মারে, তখন বুক পিঠ মুখের হিসেব রাখে না। কেউ ছাড়াতে আসে না। কিগরী শুধু দু'হাতের তালুতে মুখটা ঢেকে নেয়। প্রত্যেক লাথিতে আওয়াজ ছিটকোয় ঢাকা মুখ দিয়ে, 'ওক্…'

নখড়ু ওদের কেউ না। ও ও নখড়ু'র কেউ হয় না। শুধু রাতের বাসি রুটি, আমচুর, বৈগন ভর্তা গামছার খুঁটে বেঁধে আনে রোজ সকালে। দতমন করতে করতে ভেরেণ্ডা গাছের বেড়ার ওপাশ থেকে গুরুগম্ভীর আওয়াজে বলে, 'জিন্দা ছি ন্ গে!'

আওয়াজটা সে যৎপরোনাস্তি গম্ভীর রাখার চেষ্টা করে। এটা সামনের জন বুঝুক, ওকে তার কথাই মান্য করতে হবে। এই রৌরবে তিরতির কাঁপে কিগরী'র ডালিম গাছ। দৌড়ে লোটায় জল নিয়ে আসে। হাতে ধরিয়ে দেয়। সশব্দে কুলকুচি করে নখড়ু। তারপর লোটা ফিরিয়ে দিয়ে রুটি ছেঁড়ে দু টুকরোয়। একটু আমচুর রুটির বুকে রেখে বাকিটা কিরগীর হাতে ধরিয়ে এগিয়ে যায় 'খলিহানদিশ'। রাক্ষসের মতো রুটি চেবায়। পেছন ফিরে তাকায়ও না একবার।

এত যে কাণ্ড ঘটে, এর মাঝে কোথাও সমাজ নেই। নেই ওদের বাড়ির কোন সদস্যের দখলদারি। অমিত গাজোয়ারি যেন স্থির করে দিয়েছে এইই নিত্য, আবহমান। এ ছায়া মায়া আনে। আনে নির্ভরতা। তৈজসে দাগের মতো লেগে থাকে যাপনে। কিছু টল রাখতে দিয়েছিল ওকে। ওগুলো দিয়ে নখড়ু হিসেব রাখে 'উলটমাইটের'। যেখানের মাটি কোদালে উল্টে গেছে সেখানে, ভেরেণ্ডার পাতার ওপরে একটা করে 'গুল্লি' রেখে দ্যায়, যাতে আবার সময় মতো সেটা উল্টে দেওয়া যায়।'সিপেজ' শুকাতে সময় লাগে। এ না শুকালে বীজ ফাটতে সময় লাগে। 'গিল্লা মিট্টি' বীজ পচিয়ে দ্যায়। 

সেই টল, গুল্লি, মার্বেল যে নামেই তাদের সম্বোধন থাক না কেন, একটা পড়ে গেছে হাত থেকে। অসার হয়ে এল কিরগী। উঁবু হয়ে বসে দেখতে চাইলো কোথায় লুকিয়েছে। চোখ পড়ল একটা ফাটল'এ। মাটি কাটছে তার মধ্যে বসে নখড়ু। ফুলে ফুলে উঠছে বাহু। দ্রুত নড়ছে পেশী। ঘামে ভেজা শরীর আরও ঘামছে ঘামে। চোখ তুলে তাকাতেই দৌড় লাগালো কিরগী। আমরুলীপাতার 'ঢেঙ' মারিয়ে, গাজরের খেত পেরিয়ে, পুদিনা চটকে দিয়ে, হাতের মুঠোয় গুল্লি ধরে দৌড় লাগালো। শীশম বাগান পেরিয়ে গোইতজীর পাঁচিলে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল তনিক। উঁকি মেরে দেখলো, পেছন পেছন আসছে কি না। একটা সাদা বক উড়ে আসছে ওর দিকে। মুখে কিছু ধরা। গুল্লি! ও জানে না। চোখ বুজে আসছে। ঘুম পাচ্ছে। কেউ কি ডাকছে!
'কত্যা ছি! জিন্দা ছি ন গে!'
               
বুধনদের পাড়ার শেষ প্রান্তে মহুয়ার জঙ্গল। জানুয়ারির শেষ থেকেই নদীর বুক থেকে হাঁপরের টান নিয়ে সোঁ সোঁ করে নিজস্ব ধ্বনিতে পাখোয়াজের মতো বইতে থাকে পছিয়া হাওয়া আর, নতুন গজিয়ে ওঠা পাতার বুক থেকে খসে পড়তে শুরু করে কচিকলাপাতা রঙের মহুয়া ফুলের অবশ অংশ। এই সময়টায় মাটিতে জলের কঠিন টান। কেনালের জলের ওপর ভরসা করে নখড়ু। খেত-দর-খেত রুঁয়ে যায় ভুট্টা, গম। বালিকে পিষে জল দিয়ে ময়ম এনে বহুদিনে বহুকষ্টে চাষযোগ্য করে তোলা হয়েছে এই অঞ্চলের জমি। শুধু নখড়ুই নয়, বুধন, সুরেশ, গোপাল, ঘণশ্যাম ওদের সকলেরই তাকিয়ে থাকা এই খেতের দিকে। সারা বছরের খুঁদ-কুড়োর আয়োজনের কাল এটা। রোদে শীতের মৌতাত আর নেই। তাপ বাড়ে ধীরে ধীরে। বাড়ে শরীরের ঘাম, ক্লান্তি। জলের টান হয় শরীরে। এই সময় যদি মহুয়ার ফলগুলো পেকে উঠতো! 

মহুয়ার জঙ্গলটা পেয়ে যায় নখড়ু ওর খেতের আলটা পেরুলেই। গাছের কচি পাতারা অবোধ বালিকার মতো ঢলো ঢলো। যেন তারা ভোরের নিমন্ত্রণ নিয়ে ডাকে নখড়ুকে। উদাসী হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে ফেলে ওর মন। উটের কুঁজের মতো জেগে থাকা শেকড়ের ওপর বসে শ্রান্তি দূর করে। একবার মুখ তুলে সেজে ওঠা ডালের দিকে চায়। ওর এখানে বসায় কোন প্রতিক্রিয়া নেই তো গাছের! গমের আর ভুট্টার মাথার সবুজ মনে তৃপ্তি আনে। পরিশ্রমের রঙ। ভাবনার রঙ। খিদের রঙ। এটুকু না করলে বর্ষা মাথায় পাঞ্জাব-হরিয়ানা ছুটতে হবে মাস চারেক পর লেবারের কাজ করতে। পরের খেত পরেরই হয়, যতই যত্ন করো, তোমার অধিকার শুধু মজুরীতেই। বিগত পাঁচ বছরের তেমনই অক্লান্ত শ্রমে এই তিন বিঘে কিনতে পেরেছে সে। এটুকু ছাড়া আর তো তার নিজের বলতে কিছু নেই! আছে। ঘরটুকু আর কিরগী। কিরগী? ওর ওপর অধিকার কোথায়? কীসের অধিকার ফলায় ও? নেহাত দীনদরিদ্র, নইলে কি আর ও ঘর থেকে প্রতিবাদ আসতো না? 

এই হাওয়ার একটা গন্ধ তৈরী হবে আর কিছুদিন পর। তখন গমে শীষ খুলে যাবে, ভুট্টা ধ্যারধেরে লম্বা হবে। তখন যখন এসে আবার বসবে আরও রৌদ্রতপ্ত ক্লান্ত এই শিকড়ে, চাপা চঞ্চলতায় টুপটাপ মউল ফেলবে মহুয়া ওর কাঁধে মাথায় কপালে গেঞ্জিতে। শরীরে লেগে যাবে রস, ও আঙুলে করে জিভে নিয়ে দেখবে তার স্বাদ। তেমন সময়ে ও মনে মনে দাগরাজি হয়, কলঙ্কিত হয়, মাথা হেঁট হয়ে আসে ওর ফেলে আসা অক্ষমতায়, ওর বৌ রসভরী'র বিনা চিকিৎসায় চলে যাওয়ার স্মৃতিতে। খুব ভালোবাসতো সে এই ছড়িয়ে ফেটে পড়া মহুয়া ফল মাটি থেকে তুলে তুলে খেতে। ফলের গা থেকে নোংরা পরিস্কার করতে নখড়ু'র ছেঁড়া গেঞ্জিতে মুছে খিলখিল করে হাসতো। হাসির শব্দে গাছ থেকে উড়ে যেত টিয়ার দল। যেতে যেতে যেন ধমক দিয়ে যেত। হেসে ফেলতো নখড়ু। আদুরী রসভরী গায়ে ঢলে পড়তো। তখনের তীব্র অভাবেও সুখ ছিল, মায়া ছিল, মোহ ছিল। আজ নেই। নেই সে কৈশোরের প্রেমালাপ। আজ যেন স্মৃতির মোড়ক খুললেই বর্ণহীন বুদবুদের মতো পোয়াতির পেট খসা হাহাকারে ফাটতে থাকে নখড়ু'র বুক। কী এক অসহ্য জ্বালায় চট করে উঠে পায়চারি শুরু করে। বসন্তের এই হাওয়ায় স্মৃতির গন্ধ ভেসে আসতে শুরু করলে ও যন্ত্রণায় ডোবে। তবু কেন মহুয়ার মাতাল করা গন্ধ বারবার ওকে টেনে আনে এ জঙ্গলে!
 
ওর মনে হয় যেন এই ঠাঁ ঠাঁ রোদ, বাতাসে ভেসে আসা রাশ রাশ চিকন বালি, বীভৎস গ্রীষ্ম রসভরীর ইশারায় বসন্ত জমিয়ে রেখেছে ওরই জন্যে। যেন অনুভবের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ওর পৌরুষ প্রগাঢ় মধু চিনতে শেখে। যেন কাকতাড়ুয়ার মতো পাহারা দিতে শেখে আপনজনকে। যেভাবে পাহারা দেয় ও আজকের ফসল, সে যত্নের খানিকটাও যদি সেদিন দেখাতে চাইতো, যদি শ্বশুরের ওপর রাগ না করে ‘অস্পতাল'-এ নিয়ে যেত রসভরী'কে…! আহ্! কী করেছে সে! কেন সে মাথা হেঁট রাখবে না! তার তো মাথা ‘উঁচা’ করবারই অধিকার নেই! তাই হয়তো রসভরী আহুতি চায়, তার মিথ্যে, খেলো দম্ভের আহুতি। তাই হয়তো কোন অদৃশ্য তাড়না মহুয়ার কোলে বারবার আসে নখড়ু’কে। নেশায় বুঁদ হতে, পাগল হতে, উন্মত্ত হাতির মতো খেতের পর খেত চষে ফেলার প্রতিজ্ঞা সঞ্চিত করতে। কোথাও তো জমে থাকা ব্যর্থ ওজ খালি করে রিক্ত হতে হবে! পুরুষের সব সয়, অসহায়তার ঘৃণ্য রাগ, শোক, দুঃখ, নৈরাশ্য নির্গমনের পথ না খুঁজে পেলে সে প্রলম্বিত অন্ধকার সহ্য হয় না।

                বসন্তের ঝরা পাতার ওপর দিয়ে কেউ যেন হেঁটে আসছে। নখড়ু মুখ ঘোরালো। কিরগী এক হাতে  কাপড় দিয়ে বাঁধা থালি আর অন্য টালমাটাল হাতে লোটা নিয়ে দাঁড়িয়ে। স্মৃতির আবেশে বিভোর নখড়ু আগে টের পায়নি ওর আসা। যদিও অন্যদিন হলে মাথার ওপরের সূর্য দেখে ও বুঝে ফেলতো, দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। আজ একটু বেশিই হাওয়া দিচ্ছে, বালিতে ভরে যাচ্ছে চারদিক। কিরগী প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কাপড়ের ঢাকনাটাকে স্থির রাখতে। একরত্তি মেয়ে, কতটুকুই আর সম্ভব! নখড়ু ইশারায় কাছে ডাকলো ওকে। যখন তখন কারণে-অকারণে মার খেতে খেতে নখড়ুর ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে মেয়েটা। মুহূর্ত ইতস্তত করে এগিয়ে এলো। নখড়ু ওর হাত থেকে খাবার আর জলের লোটা নিয়ে রাখলো মহুয়ার চওড়া শেকড়ের আড়ালে। বললো,
– বৈঠ। এগো বাত ছ্যে।
– কহ।
– তু হমার সঙ্গ রহবি? হমার ডেরা ম্যে?
– নঃ! তু বড্ মারইছ্য। জানবর জোখা।
– নই মারবে। বেটি জোখা রহিয়। হম তোহর বাপ দাখিল রহবে।
– বাপু স্য পুছে পড়তে ন্য? 
– হম বাত ক্যা লেবে তোহর বাপু স্য। তোহরা দিক্কত নই ন ছ্য?
– তখইন রহবে।
খাবার খেতে বসে রুটির টুকরো আমের আচার মাখিয়ে কিরগী'র মুখে গুঁজে দিলো নখড়ু। মুখ ধুইয়ে দিলো হাতে জল নিয়ে। খাওয়া শেষ হলে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলে খালি বাসন আর লোটা নিয়ে ফিরে গেল কিরগী। তর আজ আর নখড়ু'রও সইছে না, দু কেয়ারীর ঘাস তোলা বাকি ভুট্টার। মেয়েটা চোখের আড়াল হলে মহুয়া গাছের মগডালের দিকে তাকালো নখড়ু। হয়তো ওখান থেকেই রসভরী ওকে দেখছে।
– খুশ? অব খুশ ভেলি ন তু? রহতে উঁ হমরা সঙ্গ, বচন দেলিও। যতন করবে ওকার, খুব, খুব…
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো নখড়ু। উন্মত্ত বসন্তের পছিয়া বাতাস ছিটকে এসে আশরীর ভরিয়ে দিল ওকে। যেন আবার ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে রসভরী নখড়ু'র বুকের ওপরে, সোহাগে।







কোন কাননে

ম য়ূ রী  মি ত্র

পাহাড়ে সেদিন অনেক মেঘ। পাথুরে রাস্তায়ও মেঘের হালকা নাচানাচি। একটি খাঁজ চেয়ারের মতো হয়ে আছে। বোকা মানুষগুলো মাঝে মাঝে এত ওপরে ওঠার বায়না করে যে পাহাড় নিজেকে কেটে বেশ কয়েকটি চেয়ার, সোফা কাম বেড বানিয়ে রেখেছে কালো পাথরের শরীরটায়। সেইরকমই একটি পাথরের সোফা কাম বেডে দাঁড়িয়ে মালিঙ্গা গাছটায় জল দিচ্ছে নাদিম। আমি অবশ্যি বেশ কিছুক্ষণ পরে তার নাম জেনেছিলাম ৷ ছেলেটার এই অদ্ভুত কাজটা আমাকে টেনে এনেছিল ৷ প্রথম কথা--- জলটা দিচ্ছিল সে মা মাসীদের মতো করে। ঠিক যেমন করে তাঁরা পোয়াতি বউকে থালায় নানা মাছ তরকারী সাজিয়ে খেতে দেন--- তেমন করে অনেক সাদা বেগনে লাল ফুল কন্ট্রাস্ট মালিঙ্গার চারপাশে ছড়িয়ে দিয়েছিল ৷ মালিঙ্গা গাছ তার হাতে ঝকমকে মালা পড়েছিল--- জল খাচ্ছিল। নাদিমের কাছে যাওয়ার--- কি পিছন থেকে তার ধপধপে পাঞ্জাবিটি ছোঁয়ার দ্বিতীয় কারণ ছিল--- একটি নির্দিষ্ট দিনে মালিঙ্গা বা ছোট বাঁশ গাছের পুজো করাটা একেবারেই পার্বত্য হিন্দুদের রীতি। অথচ মেঘলা ঈদের দিনে নাদিম তন্ময় বাঁশ গাছের পুজোয়!

পিঠে দুটো টোকা দিলাম ৷ কোনোদিনও চেনা অচেনা মানি না। দেখলাম এ ছেলেটিও মানে না। বাহ্ রে! কথা ফোটার  আগেই আমার ছেলের সঙ্গে ভাব! নাদিম ইশারায় আমায় অপেক্ষা করতে বলে জল দেওয়া শেষ করল। তারপর---
         --এই যে! এত সময় লাগালে কথা বলতে! যাওয়ারই সময় হয়ে গেল আমার। শিশু নিয়ে কাজ করতে এসেছি। এসব কাজে তাড়া থাকে বোঝ না। গাছ পুজো করছ কেন?

পাখির শিষের মতো উত্তর --গাছেরও শিশুর মতো ব্রেকফাস্টের তাড়া থাকে। না সাজালে গাছও শিশুর মতো রাগী হয়ে যায়। দেখছেন না--- গাছটা রাগ দেখাতে গিয়ে খড় হয়ে যাচ্ছে!
 
--তা বলে পুজো।
--পুজো নয়--- আমার বাচ্চা সাজিয়েছি।
--কী আশ্চর্য! তুমি তো ঈদের পোশাক পরেছ--- চোখে কত সুর্মার নিখুঁত দাঁড়ি টেনেছ!
 নাদিম বললে--- নিজেকে সাজিয়েছি। হক আছে আমার।

গ্রামের স্কুলের বাচ্চাগুলো হয়ত না খেয়ে বসে আছে আমার জন্য।

কথা শেষ করার জন্য বললাম --শুভ দিন হোক। আমার ঈশ্বর তোমার, তোমার আল্লাহ আমার।

আমার গাড়ির দরজা বন্ধ করতে করতে পাহাড় কোলের নিরাসক্ত সক্রেটিস বলল--- আমার আল্লাহও নেই--- আপনার ঈশ্বরও ঘন্টা আছে। কেবল পরস্পরের  নয়--- সবার ভালগুলো নিয়ে ভাবি আমরা--- তারপর একে অপরের মধ্যে ভালগুলো যোগান দি।

নাভী টনটন করছিল। নাভিতে কি ময়লা জমল আমার! নাকি সে সন্তান দর্শনে রক্তে টুসটুসে হচ্ছিল! ঈদ নয়- অষ্টমীও নয়- প্রতিদিন আমার নাভি ছিঁড়ে পৃথিবীতে ছেয়ে যা নাদিম। দৈত্য হয়ে যা--- তবে তো গান্ধারীকে  হারিয়ে দেব আমি! আমারও  মানবজন্মের শোধবোধ।

এই লেখা দেশের সেই সব মানুষকে উৎসর্গ করলাম--- যাঁরা সম্প্রীতি বলতে কেবল হিন্দু মুসলমানের একটি superficial  মিলন বোঝেন না। যাঁদের কাছে সম্প্রীতির অর্থ  সব জীবের মাঝে ভালোবাসার অমোঘ বিস্তার।






মায়া

স র্বা ণী  রি ঙ্কু  গো স্বা মী

ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলেই আজকাল মৌয়ের পেটের ভেতরটা কেমন গুরগুর করতে থাকে ভয়ে। মাত্র দুমাস হলো তার বিয়ে হয়েছে মফস্বলের এই যৌথ পরিবারে, বাগাল কামিন গরু বাছুর মিলিয়ে সদস্যসংখ্যা মোট বাইশ জন। সৌম যখন আলাপের পর বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো, এতো তলিয়ে ভাবে নি মৌ। সৌম মানুষটাকে সে ততদিনে ভালোবেসে ফেলেছে, সে বুঝেছে সৌম ছাড়া তার চলবে না। সে মনে মনে ভেবে নিয়েছে সৌমর জন্য সে সব করতে পারে... সব।

সব বলতে যৌথ পরিবারের হট্টগোল মফস্বলে বাস করা আর কলকাতায় মা বাবার কাছে কচিৎ আসতে পারা... এইসব। খুব বেশি হলে পরিবারের সকলের সঙ্গে মানিয়ে চলা, সারাক্ষণ ঘোমটা দিয়ে থাকা কিম্বা হঠাৎ করে কলকাতার মতো রাস্তাঘাটে না বেরিয়ে পড়া... এর বেশি নিশ্চয়ই কিছু নয়। না হয় আরো খানিকটা শর্ত জুড়লো সঙ্গে, উনুনে অনভ্যস্ত হাতে এক দু পদ রান্না অথবা শিলপাটায় মশলা পেষা। কিন্তু এই কাজটা তার ওপর দিয়েছেন স্বয়ং দিদিশাশুড়ি, বৃন্দাবন যাওয়ার আগে যে সেই তিনদিন এসেছিলেন... তখন।

কাজটা আর কিছু নয়, কমলা আর নন্দলালকে সকালে নিজের হাতে জাবনা দেওয়া! শ্বশুরবাড়িতে আসার আগে মৌ গরু দেখেনি এমন নয় তবে তা রাস্তায় বা ছবিটবিতে। তাদের কাছে গিয়ে নিজের হাতে খাওয়ানোর সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই বলো কোনোটাই কখনো হয়নি। কমলা গরু হিসেবে খুব শান্ত, তার ছোটখাটো চেহারা ধবধবে সাদা রঙ আর টানাটানা চোখ কিন্তু মুশকিল হলো মৌকে দেখলেই উঠে দাঁড়ায়। ওর বাঁকানো শিঙদুটো দেখলেই মৌয়ের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে, পশু মনস্তত্ত্ব কি বোঝা যায়? ও ভাব করতে এসেছে বলেই যে কমলাও ভাব করতে চাইবে এমনটা তো নাও হতে পারে! তাই বিশুকাকা যতোই বলুক, "ও কিছু করবে না কো বৌদিমণি "কমলার ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাস মৌয়ের হাত পা ঠাণ্ডা করে দেয়।

 নন্দলালা তো আরো এক কাঠি ওপরে, তার মৌকে দেখলেই তিড়িং বিড়িং পায়। মৌ যতো সিঁটিয়ে যায় তার ততো উল্লাস বাড়ে। দু দিক থেকে মা ছেলের কান্ড দেখে বিশুকাকা হাসে আর মৌয়ের রাগ হয়। বিশুকাকার বাড়িটা আরেকটু কাছে হলেই তো তার ওপর এই কাজটা চাপতো না। বিশুকাকার মেয়ে ভোরবেলায় বর্ধমান যাওয়ার বাস ধরে, ওকে বাসে চাপিয়ে সাইকেল নিয়ে বিশুকাকা সরাসরি এখানে আসে। ততক্ষণে খিদেয় হাম্বা হাম্বা ডাকতে থাকে মা ছেলে, সে সব দেখেশুনেই দিদিশাশুড়ির নিদান, "নতুন নাতবউ বরং গো সেবা করে সংসারের কাজে হাত পাকিয়ে নিক।" 

ব্যস্, যো বোল দিয়ে সো বোল দিয়া! মৌ তাও মিনমিন করে শাশুড়ি মায়ের কাছে একটু আপত্তি যে জানায় নি তা নয়, শাশুড়ি মা মিষ্টি হেসে সেটুকু নাকচ করেছেন। "ওমা, কমলা যে ভারি শান্ত মেয়ে গো বৌমা! তুমি ওর গলা জড়িয়ে আদর করে দিও, দেখো কেমন বন্ধু হয়ে যাবে দু দিনেই। আর নন্দলালা তো দুধের শিশু, ওর শিং কোথায় যে ভয় পাচ্ছো?" তাঁর কথা অস্বীকার করার উপায়ও নেই, তবে নন্দলালার লাফালাফিতে ভয় পেয়ে মৌ যে সেদিন একতাল গোবরের ওপর থেবড়ে বসে পড়েছিলো এ কথা এরপর আর বলেইনি কাউকে।

জাবনার খড় কুচিয়ে খৈল মিশিয়ে সব হাঁড়িতে ঢেলে রেখে যায় বিশুকাকা আগেরদিন। খালি ডাবায় ঢেলে জল দিয়ে আর খানিকটা ভেলিগুড় দিতে হয় তারমধ্যে, এইটুকুনিই কাজ মৌয়ের। প্রথম তিন চার দিন সৌম বা কেউ সঙ্গে আসতো গোয়ালে আসার সময়, আজকাল বৌ পুরোনো হচ্ছে কাজেই একাই আসতে হয় মৌকে। গরম পড়ে গেছে বলে আকাশ ফরসা হয়ে যায় এই সাড়ে পাঁচটায়, কিচিরমিচির করছে পাখিরা... বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে আরামদায়ক। হাঁড়ি থেকে সব কিছু ডাবায় ঢালে মৌ, জল আনতে হবে কুয়ো থেকে। বালতিতে বাসি জল তোলা থাকলে কুটোকাটা কালো পিঁপড়ে পড়ে বলে তোলা থাকে না। তাছাড়া শাশুড়ি মা বলেন বাসি জল ভালো নয়, কমলা হলো বাড়ির লক্ষ্মী।

টুং টুং করে আওয়াজ হচ্ছে কমলার গলায় বাঁধা ঘন্টাতে, মাথা নাড়িয়ে মাছি তাড়াচ্ছে ও। নন্দলালা যথারীতি তিড়িংবিড়িং করছে মৌকে দেখেই, বুঝেছে খাবার আসছে। মৌ ভয় পায় বলে আজকাল বিশুকাকা ওদের দড়িটা ছোট করে রাখে, যাতে বেশি কাছে আসতে না পারে। খাবার দিতেই ছেলে আগে মুখ ডোবালো ডাবায়, মা দেখছে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। ওর চোখে কি কৃতজ্ঞতা নাকি বন্ধুত্ব... ভয়ে ভয়ে ওর গলার ঘন্টা লাগানো পুঁতির মালাটায় হাত দিলো মৌ, ফোঁস করে আওয়াজ করলো কমলা।

"তোর সারাদিন এই রকম  এক জায়গায় বাঁধা থাকতে ভালো লাগে?" ফিসফিস করে প্রশ্ন করলো মৌ, ভয়টা আজ ততো লাগছে না আর। ওর দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কমলা, মৌয়ের মনে হলো ও নিঃশব্দে বলছে... "মায়া হে মেয়ে, ঐ মায়াটুকুর জন্য খালি!"






সংকীর্ণতা

মে খ লা  ঘো ষ দ স্তি দা র

না, না, না, রিনি আর সত্যি ভাবতে পারছে না, সব তালগোল পাকিয়ে গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে, সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে নদীর স্রোতের মতোন কিন্তু কোনো সমাধান সূত্র বের করতে পারছে না, কেন কেন রণজয় রিনির সঙ্গে এমন ব্যবহার করছে, কিছুতেই রিনি বুঝে উঠতে পারছে না,
কথায় কথায় ছোটো করছে, অপমান, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, কটাক্ষ করা রণজয়ের একটা বাঁধাধরা নিয়মে এসে দাঁড়িয়েছে, ফেসবুক, ইনবক্স সবখানে রিনি টের পাচ্ছে রণজয়ের বন্ধুত্বে এক বৈপরীত্য বা প্যারাডক্স মনোভাব থেকে বিষম মানসিক ব্যাধির জন্ম নিচ্ছে, কেউ ধরতে বা ছুঁতে পাচ্ছে না, একমাত্র রিনি অনুভব করছে ও হাড়ে হাড়ে অনুভূত হচ্ছে,
রিনি একদিন পবিত্র বন্ধনে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো রণজয়ের দিকে আন্তরিক ভালোবাসা থেকে, একসঙ্গে পা রেখেছিলো ভার্চুয়াল দুনিয়ায়, কবিতায়, গল্পে, লাইভে, আরো কতো না প্রাণোচ্ছল অনুষ্ঠানে,
কলেজ স্ট্রীট, কফি হাউস, নন্দন চত্বরের সেই রক্তিম গোধূলি গড়িয়ে সাঁঝ বেলা, কখনো বৃষ্টিমুখর আমেজ, আবার কখনো হিমশীতল বিকালের ঠাণ্ডা আবেশ, সঙ্গে নিবিড়তা মোহময় মায়াবী টান যা দুজনের কাছে ছিলো পরম প্রাপ্তি স্বরূপ দেওয়া-নেওয়া হিসেবের অনেক ঊর্ধ্বে, আর এখন রণজয়
"আমার বন্ধু-বান্ধবে, আমার সফলতা, আমার নাম ডাক, খ্যাতি যশে ও খুশি হচ্ছেনা, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সকলের কাছে আমার নামে নিন্দা করে বেড়াচ্ছে, সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে প্রতি পদক্ষেপে, বলছে রণজয়ের জন্যই নাকি আজকে আমার এতো জনপ্রিয়তা, পরিচিতি, লেখালেখি আখর, শব্দ, বাক্য সবই ওর কাছ থেকে ধার করা",
ওর এরকম আচরণ ঈর্ষা, ক্ষোভের কারণ রণজয়কে দিন দিন রোগগ্রস্ত করে তুলছে অতি সহজেই, ধীরে ধীরে ওর ভালো দিকগুলে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মনের নীচতায় কালো আবরণে, রিনির খুব কষ্ট হচ্ছে রণজয়ের এরকম শোচনীয় অবস্থা দেখে, বারে বারে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করছে, কখনো ফোন তুলে চুপ করে থাকছে কখনো বা বিজি রাখছে আবার কখনো একদম তুলছেই না, রিনির প্রতি রণজয়ের এরকম চিন্তাধারা রিনিকে ভাবিয়ে তুলছে...

রিনি চাইছে এর হাত থেকে কিভাবে রেহাই পাওয়া যাবে বা মুক্তি দেওয়া যাবে, এখন কী উপায় আছে যেখানে রণজয়ের রিনির প্রতি অন্তর্দহন, জ্বলন মেটানো যাবে স্বর্গীয় সূক্ষ্ম আলোর কিরনে বা অমৃত সুধায়...

রিনির বড়ো বেশি ওর মায়ের বলা কথা মনে পড়ছে, "দেখবি মা, এমন একটা সময় আসবে পরিবেশ, পরিস্থিতি, অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে বন্ধুত্বের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়", 
সত্যি তাই, এতোদিন পরে রণজয়ের আসল রূপটা ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে ওর কদর্য ব্যবহার, ও হীনমন্যতায় ভুগছে,
"আমার সুখ সমৃদ্ধি, সম্মান ও না পারছে মেনে নিতে না পারছে সহ্য করতে, রণজয় নিজে খুব বেশি ম্যাটিরিয়ালিস্টিক চিন্তাভাবনা জড়িয়ে পড়ছে, ওকে ঘিরে আছে সৌন্দর্য ও রূপের বাহ্যিক ইন্দ্রজাল, সেখানে ওকে অনিশ্চয়তা গ্রাস করছে, রণজয় চাইছে রিনির সব কিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক, ক্ষতিকারক হয়ে উঠছে, রণজয়ের ইমান হাল্কা হয়ে যাচ্ছে, এখানেই রিনির মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে এই ভেবে যে রণজয় যেন অসুস্থ হয়ে না পড়ে, ঈশ্বরের কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করছে "রণজয়কে রক্ষা করো ঠাকুর, ওকে আত্মগ্লানি থেকে মুক্ত করো, ওর মনকে তোমার আশিসে, ভালোবাসার ছটায় ভরিয়ে দাও"।







পপকর্ণ ও এক বিষণ্ন পরী

সি রা জু ল  ই স লা ম

বয়স তার কতই বা হবে? পাঁচ কি ছয়, তার বেশী নয়।
বিবর্ণ মলিন চেহারায় পদ্মাপাড়ের বালুচরে মান্ধাতা আমলের হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নীচে বসে আছে উদাস দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে।
পথের ব্যস্ততায় সুগন্ধি সৌরভ ছড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে কপোত-কপোতী জোড়া। কতরকম কলোহাসি ছড়িয়ে, বসন্তের  উন্মাদনায় বিভোর হয়ে। কতরকমের বাহারী রংবেরঙের সাজুগুজু। আহা! দেখে  মন ভরে যায়। যেন স্বর্গের দখিন দ্বার খুলে মর্তে নেমে এসেছে মেনকা উর্বশী রম্ভার দল।

আজ ভালোবাসা দিবস। চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি। তারুণ্য জোয়ার বয়ে এনেছে ভীনদেশী কোন এক মিঃ ভ্যালেন্তাইন। বাপ-দাদারা বোধহয় কষ্মিনকালেও এসব নাম শোনেনি। হালফিল জামানায় আর এক ভীনদেশী মিঃ জুকারবার্গ সব চিনিয়ে দিয়েছে। উদোম হাওয়ায় পাল তুলেছে তাই গোচারণ ভূমির দুরন্ত ষাঁড়ের মত বল্গাহীন।

দুপুরের ভাতঘুম সেরে যখন উঠলাম যখন, তখন বেলা গড়ানোর পথে। 
নদীপাড়ে অলস বেলায় হাঁটবার বাসনায় ততোধিক অলস পায়ে। বিস্তির্ণ চরাচর জুড়ে সবুজ হয়ে আছে ফসলের মাঠ
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সরঞ্জামাদি আনা-নেয়ার কাজের জন্য দ্রুতগতিতে নদীর পাড় ঘেঁসে গড়ে উঠছে নতুন রেললাইন।  দৃষ্টি ছড়ালে, যতদূর দেখা যায় সোজা মাথার সিঁথির মতন সোজা, সমান্তরাল নতুন ঝাঁ চকচকে রেল লাইনটা।
ইতিউতি তাকাতে তাকাতে কয়েক শ ফুট উঁচু নদীপাড় থেকে একসময় নেমে উদ্দ্যম জনস্রোতের সাথে মিশে গেলাম প্রবহমান নদীজলের ছলচ্ছলাৎ জলসীমায়। অবিশ্রান্ত মানুষের জটলা, বাইকের দৌরাত্ব, চরের বালু উড়ছে, মানুষের নাকেমুখে। ধুলোয় ধুসরিত সবকিছু। সেই চলতি পথের অপরিসর জায়গাতে গজিয়েছে সদ্য কিছু অস্থায়ী দোকানপাট। চা পাপড়, খেলনার দোকান। দোকানগুলোতে উপচে পড়া মানুষের ভীড়। বিক্রি হচ্ছে পপকর্ণ।
জুটিবাঁধা কপোত-কপোতীরা দু'ঠোঁঙা কিনে নিয়ে চিবুতে চিবুতে রাস্তা এগুচ্ছে। হয়তো জলের ধারে বসবে অথবা কোন পানসী ভাড়া করে, সওয়ারী হয়ে ভাসতে থাকবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
সেসব দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার দু'চোখ আটকালো ক্ষুদে এক দোকানীর দিকে। রুক্ষোশুস্ক চুল,ধুলোমলিন চেহারা। পায়ে সস্তার চটি। একটা প্লাষ্টিকের ঝাঁকায় আট দশটা ক্যারিব্যাগে বাঁধা টক-কুল(বড়ই) নিয়ে বসে আছে বিক্রির আশায়।
আহা!
তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। কেউ খোঁজ নিচ্ছে না কত দাম। খোঁজ নিচ্ছে না কচি-কোমল মুখটা কেন তার এত শুকনো! খোঁজ নিচ্ছে না, "ওগো পরী মেয়ে, তুমি কি আজ দুপুরে খেয়েছো কিছু?"
বরঞ্চ সেই হতদরিদ্র গরীব অসহায়া পরীরাণী দু'চোখ মেলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে ওইসব বিত্তবানদের বৈভব। তাদের সাজগোছ আর বাহারী পোষাক। তার কচিমনে হয়তো স্বপ্ন দেখছে, " বড় হয়ে একদিন...!"

মনটা আমার উদাস হলো।
পায়ে পায়ে তার দিকে এগুতেই সে প্রত্যাশার হাসি হেসে শুধালো, "বড়ই লিবেন? "
"না রে।
"ল্যান না একটা পেকেট! " মাত্তর দশ ট্যাকা। "
নিরবে মাথা নাড়ি তার চোখে চোখ রেখে। ফিরে আসতে চাই সেখান থেকে। পারি না। পা দু'টো যেন চরের বালিতে আটকে যায়। অসহায়া মেয়েটাকে দশটা টাকা দেবো বলে পকেট হাঁতড়াই ; ভাঙতি নেই। মাত্র একশ টাকার একটা নোট পড়ে আছে সেখানে। ধোয়াকাচার জন্য সকালে অন্য প্যান্টটা খুলে রেখেছিলাম, মনের ভুলে সেই প্যান্টের পকেট থেকে বের করা হয়নি আর টাকা পয়সা, সেভাবেই রয়ে গেছে।  বলি,"খুচরো টাকা তো নেই রে! আছে কি তোর কাছে ভাঙতি? "
মাথা নাড়ে, নেই। বিক্রিই হয়নি তো। টাকা আসবে কোথা থেকে। তার ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতটা দেখে প্রশ্ন করি, "কি করে কাটলো?"
"নৌকায়!"
নদী পার হওয়ার সময়, নদীতে স্রোত থাকায় মাঝি টাল সামলাতে পারে নি নৌকা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেয়ে লোহার পেঁরেকে চিরে গেছে অনেকখানি।শুনে মায়া হলো। তার মাথায় হাত বুলিয়ে এলোমেলো রুখোশুকো চুল নাড়িয়ে দিলাম। আমার কান্ড দেখে পথচলতি ভদ্দলোকেরা মুখ টিপে হাসছে। যেন একটা ছোটলোকের মেয়ের সাথে বসে কথা বলে আমি ঘোর অন্যায় করে বসেছি। জিজ্ঞেস করি, "তোর নাম কি? "
"সাবিহা।"
"বাড়ী কোথায়?"
"নদীর ওই পাড়ে" বলে আঙ্গুল তুলে দেখালো ইশারায়। কোনদিকে তা ঠিক বুঝলাম না আমি।
"সাথে কেউ আসে নি?"
"মা আসবে সন্ধ্যায়"
"তোর বাবা?"
হাসি হাসি মুখটা হঠাৎ কেমন যেন তার নিস্প্রভ হয়ে এলো। সাবিহার আধাআধো কথায় যতটুকু জানলাম, বাবা তার মাছ শিকারী। পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ের বুকে চেপে মাছ ধরতে আনন্দ। বিশেষ করে ইলিশের মৌশুমে। তেমনি এক ভরা মৌসুমের মাঝরাতে মাছ ধরতে যেয়ে বাবা আর ফিরে আসেনি। সাবিহা তখন মায়ের পেটে। অভাব অনটনের সংসারে দেখার মতন কেউ নেই। মা এখন পরের বাড়ীতে ঠিকা ঝিয়ের কাজ করে। দুপুর হলে সাবিহা পরিচিত নৌকায় চড়ে ওপার থেকে এপারে আসে মৌসুমী ফল নিয়ে, বিক্রি করতে। ছোট মানুষ বলে তার কাছ থেকে কেউ কিছু কিনতেও চায় না। তারপরও বিক্রি হয়। তিরিশ চল্লিশ টাকা হয় কোন কোন দিন। 

বেদনায় ঝাঁপসা হয়ে আসে আমার দু'চোখের কার্নিশ। তপ্ত লোনাজলের আভাস টের পাচ্ছি চোখের কোণায়। লুকোতে চেয়ে দ্রুত সরে এলাম সাবিহার সান্নিদ্ধ্য থেকে।

পপকর্ণ বিক্রি হচ্ছে। একটা প্যাকেট কিনে নিয়ে ফিরে এলাম সাবিহার কাছে। হাতে তুলে দিতে চাইলে লজ্জায় সে মুখ ঢাকলো। কি বুঝলো তা সেই জানে। আদর করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে এলাম।

নদীপাড়ে অযথা অকারণের পথ হেঁটেহেঁটে অস্তরাগের অন্তিম আলোয় যখন প্রান্তসীমায় লাল হয়ে আসছে দিকচক্রাবাল,তখন ফেরার পথ ধরলাম। দেখলাম সাবিহা তেমনি ঠাঁয় বসে আছে। ঝাঁকাটাও তেমনি ভরা।
নাহ্, আজ আর বিক্রি হয় নি। পায়ে পায়ে এগিয়ে এলাম তার কাছে।
"কি রে, বিক্রি হয় নি? "
"ননাহ্! " মুখটা তার আরও বেশী বিষণ্ন।
আদর করে বলি, "চলি রে! "

হয়তো আমার সে আদরমাখা কন্ঠে সে সপ্রতিভ হয়ে উঠলো। আদরমাখা কন্ঠে সে আবদার নিয়ে বলে উঠলো," খেলনাপাতি কিনে দ্যান।"
বললাম," অত টাকা যে আজ আমার পকেটে নেই রে! "
"আমি দ্যাখায়ে দিচ্ছি! "বলেই সে বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো তার ফলভরা ঝাঁকার মায়া ত্যাগ করে।
আমার দীনতায় আমি লজ্জা পেলাম। বুক থেকে ঝরে পড়লো দীর্ঘশ্বাস।
পকেট হাঁতড়িয়ে সব টাকাগুলো বের করে সাবিহার হাতে দিয়ে দিলাম।
"কিছু কিনে খাস। মাকে দেয়ার দরকার নেই। "
"নাহ্! এ ট্যাকা আমি আলাদা করে রাকপো। "তার উদ্ভাসিত মুখে যেন একপলকে ঝলসে উঠে অমলিন দ্যুতি ছড়ালো স্বর্গীয় সুষমায়। ঠিক যেন স্বর্গের বাগানে খেলা করা দেবশিশু। এক বিষণ্ন পরী। 

দূরের মসজিদ থেকে তখন সুমধুর আওয়াজ ভেসে আসছে, আল্লাহু আকবার।।  আল্লাহ এক।।







হনুফা খালা

রু মা না  সো ব হা ন  প রা গ

 বছর বিশেক আগে আমরা সংসার শুরু করেছিলাম  আম্মাদের চিলেকোঠায়। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অর্থনৈতিক অবস্থা। জামাই ডাক্তার হলেও পেশাজীবী না। তিনি উচ্চতর ডিগ্রির জন্য পিজির লাইব্রেরীতেই পরে থাকেন বলতে গেলে চব্বিশ ঘন্টাই। জীবিকার জন্য সপ্তাহে একদিন নদীর ওপারে গিয়ে চেম্বার করে। আর তাতেই আমাদের দুজনের চলে যায়। আমার এহেন ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক অবস্থার কথা এক ফ্লোর নীচে থাকা আব্বা আম্মাদের বুঝতে দেইনি কখনও । প্রকৃত সমস্যাগুলো আড়াল করলে যে সমস্যা হয় তারই বর্ণনা করছি এখন।

সে সময় আম্মাদের বাসায় যত মেহমান আসে অলিখিত ভাবে তাদের আমার বাসায়ও দাওয়াত  খাওয়ানোর একটা রেওয়াজ হয়ে যাচ্ছিল। উপায়ন্তর না দেখে একদিন আম্মাকে খরচের কথা না বলে কাজের চাপের কথা বললাম। এরপর আরোও ভয়ঙ্কর বিপদে পড়লাম, আম্মা অতি উৎসাহ নিয়ে উপহার হিসেবে একজন সানগ্লাস পরা মধ‍্য বয়সী বুয়া জোগাড় করে আনলেন আমার জন্য। রাগে দুঃখে কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। রাতে সোহেল বাসায় ফিরে  মুখ অন্ধকার করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞাসা করলো সানগ্লাস পরা একজন বয়স্ক মহিলা ঘোরাঘুরি করছে; কে উনি? উনি কি খালা শাশুড়ি নাকি ফুপু শাশুড়ি? বললাম উনি বুয়া। এর পর পুরো ঘটনা খুলে বললাম। বলল কোনো ব্যাপার না, রেখে দাও। তোমার সত্যিই তো কষ্ট হচ্ছে। প্রয়োজনে আমি আর একদিন বেশি চেম্বার করবো। আর তা ছাড়া তুমি মাছ কাটতে পারো না বলে আমি পছন্দের ছোট মাছ কিনিই না বহু দিন। বুয়া থাকলে কিছু ছোট মাছ তো অন্তত খেতে পারবো।

হনুফা বুয়া একটু আজব ধরনের মহিলা ছিল। একহারা গড়নের, উঁচু করে খোপা বাঁধাতো আর সবসময় সানগ্লাস পরে থাকতো। আমি একদিন বলেছিলাম খালা, এই যে তুমি সবসময় সানগ্লাস পরে থাকো আমার দেখতে খুবই ভাল লাগে। উত্তরে হেসে বলেছিল আপনাদের খালুও সেইটা বলতো। আমারে দেখতে নাকি রানী সরকারের মতো লাগে।

একজন মানুষ বর্তমানে থেকেও যে অতীতের মাঝেই নিমজ্জিত থাকে ওকে দেখে সেদিন টের পেয়েছিলাম। যাই হোক হনুফার কাজের প্রসঙ্গে আসি।

 হনুফা বুয়ার জন্য বিরাট সারপ্রাইস অপেক্ষা করতো প্রতিদিন সন্ধ্যায়। সোহেল বাসায় ফেরার সময় পথের ধারে পচা ধচা যে মাছই পায় কিনে আনে। আমার সানগ্লাস পরা হনুফা বুয়া সানগ্লাস পরেই মাছ কোটাকুটি করে। এভাবে প্রতিদিন মাছ কেনা সোহেলের একটা নেশায় পরিনত হলো। প্রথম কয়দিন বুয়া ভাল সার্ভিস দিলেও পরবর্তীতে তিনি একটা মাইন্ড গেম খেলতে শুরু করলেন। একদিন সোহেল তেলাপিয়া মাছ এনে বলল খালা মাছটা মচমচে করে ফ্রাই করবে। বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে হনুফা বুয়া একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল তেলাপিয়া মাছ তো মাইনষের গু খায়; এগুলিন পয়সা দিয়া কেউ কেনে? অবশ‍্য এগুলির দামও বেশি  না।

সেদিন আমরা দুজনই  আর মাছ দিয়ে ভাত খেতে পারিনি। ডাক্তার হলেও বয়স কম থাকার কারণে বুয়ার এই চালে সোহেল সেদিন বেশ বিব্রত হয়ে গেল। নতুন বউয়ের সামনে কম দামি মাছ আনায় সে ভীষণ লজ্জিতও হয়েছিল।

পরদিন আবার ফেরার সময় সোহেল কুচো চিংড়ি নিয়ে আসল। বলল খালা এই মাছের ভর্তা করো আজকে। আমি রান্না করছি আর খালা চিংড়ি মাছ বাছতে বাছতে এর জন্ম বৃত্তান্ত বলা শুরু করলো। এই গুলিন তো মাছ না। এই গুলিন হইলো কিরা(পোকা), দাউদ নবীর গায়ের কিরা। তারপর নবীর গায়ে কিভাবে পচন ধরে লাল রক্ত পচে পুঁজ হলো আর সেই পুঁজ থেকে তৈরী সাদা কিরা। সেই সাদা কিরা কিভাবে নবীর সারা শরীরে ঘোরাফেরা  করতো তার বিশদ বর্ননা খালা দিতে শুরু করলো। নবী যখন নদীতে গোসল করতেন তখন এই কিরাগুলো পানিতে ভেসে যেতো। পুঁজ থেকে তৈরী বলে এই কিরার গায়ে কোনো রক্ত নাই, আর আপনারা এগুলোরে কন মাছ! গল্প শুনতে  শুনতে আমার পেট গুলিয়ে উঠে বমি আসল। আমি ঐ রাতে আর ভাত খাইনি। সোহেল রাতে একাই খেল, তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে বলল খালা চমৎকার কিরা ভর্তা খাওয়াইলেন। আলহামদুলিল্লাহ।

এভাবে কই, মাগুর, পাঙ্গাস সহ প্রায় সব মাছেরই একেকটা ভয়ংকর ইতিহাস খালা আমার কাছে বলতো। অল্প কয়দিনের মধ্যে আমারও মোটামুটি সব মাছের উপরই অবঘিন্না ধরে গেল। কিন্তু সেই সাথে একটা নিবিড় তথ‍্য অনুসন্ধান করারও তাড়নাও অনুভব করলাম। একদিন দুপুরের খাবার শেষে আমি ভাত ঘুম দেবার জন্য একটা গল্পের বই নিয়ে বিছানায় বসেছি আর হনুফা খালা টিভি দেখছে।আলাপ শুরু করলাম। গন্ডোগোলের সময় তোমার বিয়া হইছিলো খালা? বলল তখন সে দুই বাচ্চার মা। গল্প করতে করতে বরফ গলতে শুরু করলো খালা নিজেই আরও পেছনের দিকের ইতিহাস বলতে আরম্ভ করলো।

ওর বাবা ছিল জেলে, প্রায় প্রতিদিনই গভীর রাতে উনি খলোইয়ে করে নানা রকমের মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। তাজা মাছ গুলো ঝপ ঝপ করে খলোইয়ের মধ্যে লাফাতো । জোছনার আলোতে বসে ওর মা আর বোনেরা মিলে মাছগুলো কেটে রান্না করতো, তারপর ছয় ভাই বোন আর বাবা মা মিলে মাছের শালুন দিয়ে ভাত খেত। ঐ তাজা মাছে কোনো গন্ধ করতো না, খালা এতো খুশী হয়ে কথা গুলো বলছিল যেন মনে হচ্ছিল ও ঐ সময়েই চলে গেছে।

 আমাদের কেনা মাছ গুলো দেখে ও কেন এতো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো তার একটা পরিস্কার ব্যাখ্যা পেলাম এতদিনে। নদীর টাটকা মাছ দিয়ে যে প্রতি রাতে ভাত খেত তার কাছে রাস্তার ধারে ফরমালিন দেয়া মাছগুলো তো তুচ্ছেরই হবে। গরীব হলেও তার অবস্থানে সে রাজার মতোই জীবন যাপন করেছে। যে কারনে বতর্মানের সাথে সে আপোষ করতে পারেনি।

বেশীরভাগ ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষই তাদের অতীতকে আঁকড়ে বেঁচে থাকেন। বর্তমানের সাথে সর্ব ক্ষণই চলে তাদের অতীতের টানাপোড়েন।






বাবা হতে চাই

উ প মা  বে গ ম 

আজকে দুপুর বেলা হঠাৎ ছেলের স্কুল থেকে ফোন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম ছেলে ব্যথা পেল না ও কোন দুষ্টুমি করেছে এরকম কিছু ক্লাস টিচারকে জিজ্ঞেস করছি। কিন্তু উনি একটা কথাই বললেন আপনি আজকে পারুন বা কালকে পারুন এক দু দিনের মধ্যে আমার সাথে দেখা করুন। আমি বললাম কাউকে নিয়ে আসবো- উনি বললেন না না আপনি একাই চলে আসুন। আমি যথারীতি ওর স্কুলের পরে অফিস থেকে আধাবেলায় ছুটি নিয়ে ওর স্কুলে গেলাম। ক্লাস টিচারের  সাথে দেখা করলাম। আমি একটু ভয় পেয়ে গেছি। ওর ম্যাডাম বললেন একটু বসুন সময় নিয়ে এসেছেন তো। আমি বললাম হ্যাঁ হ্যাঁ। তারপর উনার  সাথে বসলাম একটা চেয়ার  টেনে। আমি বললাম আচ্ছা আমার ছেলে মানে উমায়ের কি খুব দুষ্টুমি করে নাকি পড়াশোনা ভালো করে করে না না আপনাদের ঠিকমতো সম্মান করে না কোনটা। উনি একটু  সময় চুপ করেছিলেন। তারপর বললেন আরে না না ও পড়াশোনায় ভীষণ ভালো, ভীষণ বাধ্য আর দুষ্টুমিও তেমন করে না। বললাম তাহলে ডাকলেন যে, আমাকে বললেন ওর  প্রায় সময় মন খারাপ থাকে। আমি বললাম এ স্কুলে তো এর প্রথম বছর হয়তো পুরনো বন্ধু বান্ধব কে মিস করে। উনি বললেন আপনাকে কালকে যে ফোন করেছিলাম একটা ঘটনা বলার জন্য। আমি বললাম কি? উনি বলা শুরু করলেন, যে কালকে ওদের  সবার সাথে গল্প করছিলাম ক্লাসের পরে, কে  ভবিষ্যতে কি হতে চায়। ওদের কেউ পাইলট হতে চায়, কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ স্কুল টিচার, কেউ আর্মি অফিসার এরকম সবাই বলে চলছে। শুধু উমায়ের চুপ করেছিল। আমি কাছে গেলাম মাথায় হাত রাখলাম ওকে বললাম বাবা তুমি বলছো না যে তুমি কি হতে চাও। একটু সময় চুপ করে ছিল তারপর ছল ছল চোখে বলল ম্যাম তোমার কানে কানে বলবো। আমি একটু ঝুঁকে ওর মুখের কাছে কানটা নিলাম ভাবলাম দেখি কি বলে? ও আস্তে করে বলল আমি বাবা হতে চাই। আমি একটু অবাক হলাম বললাম কি? কি হতে চাও? ও এদিক ওদিক দেখছে ওর কথা ওর কোন বন্ধু বা বান্ধবী শুনছে কিনা? আরো বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর এই কথাটাই বলেছে। আমি তারপর ওকে ক্লাসরুমে ডেকে নিয়ে যাই।
ওকে জিজ্ঞেস করি কেন তুমি বাবা হতে চাও? কার মতো হতে চাও তোমার বাবার মত? কতক্ষণ চুপ থেকে বললো আমার তো বাবা নেই যখন ছোট ছিলাম মাকে আর আমাকে ফেলে চলে গেছে? আমার দাদুর বাড়ি তে ও আমরা থাকি না। মা আমাকে নিয়ে ভাড়া থাকে। আমি ঠিক জানিনা ম্যাম বাবার আর মায়ের নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমি কোন সময় দেখিনি আমার দাদু আমার মায়ের সাথে বসে ভাত খেয়েছে। মাকে ডাক দিয়েছে বা আদর করেছে। বা কোন সময় ঈদে কাপড় কিনে দিয়েছে। আমার মাসি আসলে বেড়াতে আমার দাদু কথা বলে কিন্তু আমার মায়ের সাথে বলে না। আমি আমার দাদুর মত হতে চাই না- না আমার বাবার মত। আমি খুব ভালো বাবা হতে চাই। আমি যখন বড় হয়ে একটা বেবি আনবো, তখন আমার বেবিটাকে আমি খুব ভালোবাসবো, পার্কে নিয়ে যাব আমাদের এখানে যে রাজ বাড়িটা আছে ওইখানে যাব, যখন স্কুলে যাবে আমি সঙ্গে যাব, এখন যেমন আমি অটোতে করে আসি আমার বেবিকে অটোতে দিলেও আমি সঙ্গে যাব। পরীক্ষার সময় কোনদিন একলা ছাড়বো না, স্কুলে প্রোগ্রাম হলে সঙ্গে যাব। রাত্রিবেলা বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমাবো। এখন যেমন আমি দুপুর বেলা একলা বাড়িতে থাকি--- আসলে ম্যাম মা তো অফিসে থাকে আর আমি ঘুমাই কিন্তু আমার বেবিকে আমি একলা ঘরে রাখবো না, না হলে ও আমার মতে ভয় পাবে।

তাই আমি খুব ভালো বাবা হতে চাই।
আমার তখন চোখ দিয়ে জল পড়ছে আর হাসিমুখে ওর ম্যাম কে বললাম ম্যাম আমিও চাই আমার ছেলে খুব ভালো বাবা হোক।







সাদা থান

ত প ন  ম ন্ড ল
        
ডাক্তার অজয় চক্রবর্তীর বাড়ির সামনে আজ সকাল থেকে  মানুষের ঢল। ৭৩ বছরের অজয় চক্রবর্তী গত রাত্রিতে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে। তাকে শেষবারের মত দেখবে বলে বহুদূর থেকে মানুষ এসে ভিড় করতে শুরু করেছে। গ্রামের সকলেই অশ্রু চোখে গেটের সামনে অপেক্ষারত। বহু মানুষকে তিনি বিনা পয়সায় চিকিৎসা পরিষেবা দিয়েছে। সারাটি জীবন অজয় চক্রবর্তী জনকল্যাণে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে।
       
শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে নফরগঞ্জ গ্রামে অজয় চক্রবর্তী তার সাধের রেহানা কুঠি নির্মাণ করেছে। এই অজ পাড়াগাঁয়ে তিনি হয়ে ওঠেন গরিবের একমাত্র ভগবান। রাত-বিরেতে কত অসহায় মানুষকে সে চিকিৎসায় সুস্থ করেছে। কত দরিদ্র ঘরের ছেলে মেয়েকে স্কুলের বইও কিনে দিয়েছেন। সাধ্যমত বিনা পারিশ্রমিকে টিউশন পড়িয়েছে। সাধ্যমত গরিবের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছে।
         
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এত বড় মুসলিম প্রধান এলাকায় তিনিই একমাত্র হিন্দু। তাও আবার ব্রাহ্মণ। 
        
দু'জন দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত কাজের লোক ছিল। তারাও মুসলিম। কাজের লোক  অজয় চক্রবর্তীর  মুখ থেকে তার পূর্ব পরিচয় সম্পর্কে কিছু কিছু শুনেছেন বটে। অবশ্য তারা অজয় চক্রবর্তীর পুরো পরিচয় জানে না।
        
কাজের লোকের মুখ থেকে যেটুকু জানা যায়, তা হল--- পাটনা শহরের বিখ্যাত এক ব্রাহ্মণ পরিবারে অজয় চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেন। স্কুল জীবন শেষ করে তিনি সাইন্স নিয়ে পড়াশোনা করেন। তারপর পরিবারের অনুকূলে কলকাতা শহরে ডাক্তারি পড়তে যান। সেখানেই সুন্দরী রেহানার সঙ্গে তার প্রেম হয়। এই সম্পর্ক অবশ্য রেহানার পরিবার মেনে নিতে অস্বীকার করে। 
        
তবে অবশেষে রেহানার জোরাজুরিতে তার পরিবার বিয়েতে সম্মতি দেয়।
         
ডাক্তারি পাস করে রেহানাকে বিয়ে করে অজয় চক্রবর্তী পাটনায় তার পরিবারে ফিরে আসে কিন্তু, পরিবারের ভৎসনা শুনতে হয় তাকে। ত্যাজ্যপুত্র করা হয়।
         
অজয় চক্রবর্তী অভিমানী হয়ে রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ছাড়েন। নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে নিয়ে  রাঁচি শহরে আসেন। রেহানা সব সময় চাইতো অজয় চক্রবর্তী যেন গরিবদের চিকিৎসা করে বিনামূল্যে।
          
কিছুদিন পর একটি ভয়ংকর রোড এক্সিডেন্টে রেহানার মৃত্যু হয়।
           
অজয় চক্রবর্তী, তার ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে প্রচন্ড দুঃখ ও অভিমানে এই নফরগঞ্জ গ্রামে আসে।
দ্বিতীয়বার বিয়ে করেনি। রেহানার স্মৃতি বুকে নিয়ে দিন কাটাতে থাকে। কিছুদিন যাযাবরের মতো জীবন কাটে। 
        
তারপর এই গ্রামের মানুষের অভাব অনটন ও দুর্দশা দেখে সে ব্যথিত হয়।  রেহানার ইচ্ছার বাস্তব রূপ দিতে সে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ায় জন্য বদ্ধপরিকর হয়।
          
অজয় চক্রবর্তী একজন ডাক্তার তা গ্রামের মানুষ জানতো না। ধীরে ধীরে সে গ্রামের মানুষের সান্নিধ্যে আসে। দু' চারজনকে চিকিৎসা পরিষেবা দিতে থাকে। তার চিকিৎসায় রোগীরা সুস্থ হয়। ধীরে ধীরে গ্রাম থেকে গ্রাম গ্রামান্তরে অজয় চক্রবর্তীর নাম ছড়িয়ে পড়ে।
            
অজয় চক্রবর্তী নফরগঞ্জ গ্রামকেই নিজের মাতৃভূমি মনে করে বসতি শুরু করে। নয় নয় করে ৪০ বছর সে মানুষের মঙ্গলার্থে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছে। মানুষের সুখ দুঃখের সাথী হয়েছে। গরিবের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে। মুসলিম প্রধান এলাকায় তিনি হিন্দু ব্রাহ্মণ। তবুও এখানকার মানুষ তাকে নিজের পরিবারের একজন বলে মনে করে।
              
হঠাৎ গত রাত্রিতে অজয় চক্রবর্তী মৃত্যু হয়। এই খবর  বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। ভোর থেকে মানুষের জমায়েত শুরু হয়। বেলা বাড়তেই কয়েক হাজার লোক সমবেত হলো।
           
বেলা ১১ টা নাগাদ মাওলানা সাহেবের উপস্থিতিতে অজয় চক্রবর্তীর দেহ বাইরে বের করা হলো। চারিদিকে কান্নার রোল। সকলেই প্রচন্ড শোকাহত। চোখের জল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না কেউ। প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে সবাই যেন সর্বস্বান্ত।
          
স্থানীয় মানুষজন সকলে অজয় চক্রবর্তীর বুকে মাল্য দান করছে। কেউ কেউ শেষবারের মতো পদধুলি নিচ্ছে।
          
মাওলানা সাহেবের পরামর্শে এলাকার মুসলিমরা হিন্দু রীতিতে অজয় চক্রবর্তীর শেষকৃত্য সম্পন্ন করবে বলে স্থির করলো।
       
অজয় চক্রবর্তীকে বাঁশের দোলাতে শোয়ানো হলো। বাঁশের দোলা চারিদিকে ফুল দিয়ে সাজানো হলো। কপালে কারুকার্য করে চন্দন লাগানো হলো। বুকে গীতা রাখা হলো।
        
ঘন্টাখানেক বাদে অজয় চক্রবর্তীর শবদেহ সাদা থানে ঢেকে চার কাঁধে নিয়ে হরি নাম গাইতে গাইতে শ্মশানের দিকে রওনা দিল।  মানুষের ভিড়ে পা গলানো যায় না। সমস্ত গ্রাম  অজয় চক্রবর্তীর সঙ্গী হল।
       
সমস্ত স্তরের মানুষ মহাশোকে, এবং মহাসমারোহে অজয় চক্রবর্তী শেষকৃত্য সম্পন্ন করল।    
         
রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ, অভিমান, হিংসার উর্ধ্বে  সম্প্রীতি বজায় রেখে শেষবারের মতো গ্রামবাসীরা তাদের প্রিয় অজয় চক্রবর্তী এর জন্য অশ্রু বিসর্জন করল। 
        
অজয় চক্রবর্তী সাধের রেহানা কুঠি আজ প্রথমবারের জন্য একাকী নিভৃতে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমবারের জন্য সেও সঙ্গীহারা হল।







দূর্গা

সু ব্র ত  রা য়  শ র্মা 

আজ একাদশী গতকাল দশমী গেছে রাতে মাকে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে এসেছি, পুজো শেষ তাই সকালে তাড়াতাড়ি উঠার তাগিদ নেই এই কটা দিন বেশ আনন্দেই কেটেছে, ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি সকাল সাতটা বাজে একটু ঠান্ডার আমেজ বিছানা ছাড়তে ইচ্ছা করছে না হঠাৎ ঢাকের আওয়াজ পুজো তো শেষ তবে, মনে পড়ে প্রতি বছর একাদশীর দিনে বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে ঢাকিরা সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরনো জামাকাপড় কিছু বখশিশ চাইতে আসে। আমার ঘরের দরজার ঘন্টা বেজে উঠল বুঝতে পারি  ঢাকিরা এসেছে বিছানা ছেড়ে দরজা খুলতেই দেখি কাঁধে ঢাক নিয়ে নিতাই দাস ঢাকি দাড়িয়ে আছে, এক গাল হেসে হাত জোড়ে বলল--- শুভ বিজয়া দাদাবাবু, কেমন আছেন? আমি  উত্তর দিই--- ভাল আছি এবার বল্ তুই কেমন আছিস। নিতাই উত্তর দেয়--- ভালই আছি, গত দু'বছর যা গেছে সে তো আপনারা বেশি ভালো জানেন। নিতাই ঢাকির গলার আওয়াজ পেয়ে গিন্নি সারা বছরের জমিয়ে রাখা পুরনো জামাকাপড় সাথে কিছু টাকা, মিষ্টি  নিতাইয়ের হাতে তুলে দেয়, নিতাইয়ের মুখ আনন্দে ভরে ওঠে। ওকে দেখে আমার মনটা ভরে যায়। সত্যি এদের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত কতো অল্পতেই এরা খুশি হয়, এবার আমি খেয়াল করি নিতাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা বছর পাঁচেকের মেয়ে, একটা পুরনো রঙ ওঠা জামা গায়ে, বোধহয় কেউ দিয়েছে--- রোগা শরীরে ঢলঢল করছে।মেয়েটাকে কাছে ডাকতেই মেয়েটা চোখ নিচু করে  নিতাইয়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়ায়, তখন নিতাই বলে--- দাদাবাবু এটা আমার মেয়ে, যে বছর তুমি পূজোর সেক্রেটারি ছিলে আমি এখানে ঢাক বাজাতে এলাম সেই পূজোর অষ্টমীর দিন ও জন্ম নিল তাই ওর নাম রেখেছি দূর্গা,  তা প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। আমার দৃষ্টি তখন দূর্গার দিকে নিতাইয়ের কথাগুলো আর আমার কানে আসছিল না। হঠাৎ গিন্নির ডাকে তাকিয়ে দেখি গিন্নির হাতে কটা নতুন জামা যেগুলো  আমাদের একমাত্র পাঁচ বছরের নাতনিকে পুজোয় দেবে বলে কিনে রেখেছিল কিন্তু ছেলে বৌমা নাতনি কেউ এবার আসেনি। এবার পূজো আমাদের খালি ঘরেই কেটেছে। গিন্নি দূর্গাকে কাছে টেনে নিয়ে গায়ে একটা জামা পড়িয়ে দেয়, একটু ঢিলে হলেও লাল রঙের জামাটা দূর্গাকে মানিয়েছে, এবার আমি দূর্গাকে জিজ্ঞাসা করি--- কিরে পুজো কেমন কাটালি, গিন্নির দেওয়া মিষ্টি খেতে খেতে দূর্গা বলে আমাদের পুজো শুরুই হয়নি, কাল থেকে শুরু হবে যখন তোমাদের দেওেয়া জামা কাপড়  আর পয়সা নিয়ে বাড়িতে যাব। ওর উত্তরে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই এইটুকু মেয়ে অথচ জীবন সম্বন্ধে তার কত অভিজ্ঞতা। আমার চোখ ভরে জল আসে, নিতাই ঢাকি আবার একবার প্রণাম জানিয়ে বলে, চলি দাদাবাবু সামনের বছর আবার দেখা হবে। আমি ওদের চলার পথের দিকে চেয়ে ছিলাম যতক্ষণ বাবা  আর মেয়ে আমার দৃষ্টিতে ছিল, পেছন ফিরে দেখি গিন্নি দাঁড়িয়ে আছে ওর চোখেও জল।।







বসন্তের ছোঁয়া

 সু ব্র ত  দ ত্ত

কলেজ জীবন বছর পেরিয়ে গেল পাপড়ির। তবুও আবীরকে দেখলে কেমন যেন হয়ে যায়। দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তাকাতে লজ্জা করে। একসঙ্গে ছেলেমেয়েদের আড্ডা হয়। কিন্তু সেখানে আবীর থাকলে পাপড়ি সিঁটিয়ে থাকে। আবীর চলে গেলে পাপড়ির মুখে বুলি ফোটে। এই নিয়ে বন্ধুরা হাসাহাসি করে। মধুশ্রী একদিন বলে---

-আবীরকে তুই অ্যাভয়েড করিস কেন? খারাপ কিছু করেছে?

   পাপড়ি জিভ কেটে বলে---

-না না, তা কেন? কিছু করে নি তো?

    দেবিকা হেসে বলে---

-ও কলেজের কত মেয়ের ক্রাশ জানিস? জিনিয়াস ছেলে একটা। আমি হ্যাংলার মত লেগে রয়েছি, তবুও পাত্তা দেয় না। 

পাপড়ি দায়সারা ভাবে "হুঁ, চলি রে" বলে উঠে যায়।

রোজ আবীরকে দেখলেই পাপড়ির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়, আর চোখ নামিয়ে নেয়। এভাবেই কেটে যায় কিছু দিন।

পরের দিন দোলের জন্য কলেজ ছুটি। তাই আগের দিনেই দোল-উৎসব শুরু হয়ে যায় কলেজে। পাপড়ি কলেজের গেটের ভেতরে ঢুকতেই সামনে এসে দাঁড়ায় আবীর। পাপড়ি কি করবে তা ভেবে উঠতে পারে না। শুধু বলে---

-কি হলো?

    আবীর বলে---

-দেবো?

    পাপড়ির অজানা আতঙ্কে তাকিয়ে বলে---

-কি?

-শুধু কপালে একটা টিপ দিতে পারি?

চমকে ডাগর দু'টি চোখ নামিয়ে নেয় পাপড়ি। পড়ন্ত শীতেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে ওঠে। সে যেন অথৈ জলে পড়েছে! থার্মোমিটারে মাপলে নির্ঘাত জ্বর উঠবে ১০৫ ডিগ্রি!

-কি হল, উত্তর নেই যে?

আবীরের প্রশ্নে পাপড়ি মাথা নিচু করেই থাকে। তার ঠোঁট দু'টো কেঁপে ওঠে শুধু।

-ও, ইচ্ছে নেই তাহলে! ঠিক আছে, যাও। আমি জোর করবো না। মনক্ষুণ্ণ হয়ে আবীর বলে। 

-না!

    পাপড়ি আঁতকে উঠে বলে---

-তা নয়! ঠি-ঠিক আছে। দা - দিন।

    আবীর এবার জোরে হেসে বলে,

-দিন আবার কি? দাও বলতে পারো না?

-না, মানে - হ্যাঁ!

 মাথা নেড়ে বলে পাপড়ি। আবীর তার নতুন প্যাকেট খুলে লাল আবীরের টিপ পরিয়ে দেয় পাপড়ির কপালে। পাপড়ি চোখ বন্ধ করে এক অচেনা শিহরণ অনুভব করে। আচমকা বহুকাঙ্ক্ষিত এক মনের মানুষের স্পর্শ! আবেশ জড়ানো কন্ঠে বলে---

-হয়েছে?

-না, হয় নি।

    পাপড়ি বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলে---

-তার মানে? আবার কি?

     আবীর তার মুখটা পাপড়ির মুখের সামনে নামিয়ে এনে বলে,

-তুমি দেবে না আমায়?

-আ-আমি যে আনি নি!

-কি আনো নি?

-আবীর! 

বলেই পাপড়ি জিভ কাটে। এবার মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাবে। কানে শোঁ শোঁ শব্দ শুধু শোনে সে।

-এই যে, আবীর!

পাপড়ি দেখে, তার দিকে এগিয়ে দেয়া আবীরের হাতে সদ্য খোলা আবীরের প্যাকেট। পাপড়ি মন্ত্রমুগ্ধের মত সেই প্যাকেটের দিকে ধীরে ধীরে হাত বাড়ায়। কিছুটা আবীর নিয়ে মাখিয়ে দেয় আলতো করে আবীরের কপালে, গালে। পাপড়ি রীতিমত কাঁপছে। এই প্রথম কোনও পুরুষকে স্পর্শের অনুভূতি পেলো সে। পুলকে যেন এক পরম সুখের শিহরণ বয়ে যায় তার শরীরে। আর আবীর পাপড়ির  নরম হাতের ছোঁয়ায় বিবশ হয়ে বলে---

-এবার তো চোখ খোলো। 

আবীরের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে পাপড়ি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় সরাসরি আবীরের চোখে। কিছু একটা বলতে যেতেই, হাততালি আর কলরবে হতচকিত হয়ে ওরা দেখে, সব বন্ধু বান্ধবীরা ওদের ঘিরে রয়েছে। সারাটা দিন বেশ আনন্দেই কাটে। বসন্তোৎসবের প্রাক মুহূর্তে প্রথম স্পর্শে ওদের দু'জনের জীবনের প্রথম বসন্তের রঙে রঙিন প্রজাপতি ডানা মেলে।







এপ্রিল ফুল

বি ধা ন  ঘো ষ

এমনিতে ফৌজে ছুটি বলে কিছু হয়না। ডিউটি না থাকলেও জওয়ানদের দিয়ে কিছু না কিছু কাজ করিয়ে নেওয়া হয়। নিছক বসিয়ে রাখা হয়না! ঝোড়-জঙ্গল সাফাই, ব‍্যারাক সাফ-সাফাই, গাছপালায় জল দেওয়া অথবা চুন ও রঙের বালতি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় রঙের পোঁচ লাগানো ইত্যাদি লেগেই থাকে। যদি তেমন কিছু কাজ নাও থাকে তবে বেলচা-গাঁইতি ধরিয়ে দেওয়া হয় সমান জায়গা খুঁড়ে গর্ত করতে অথবা গর্ত থাকলে তা বুঁজিয়ে ফেলার জন্যে। ফৌজে একটা কথা খুব প্রচলিত--- জওয়ান busy তো অফিসার easy!!
ঠিক এইরকমই একটা পরিস্থিতি ছিল সেদিন। সকালে পি.টি করে আসার পর আমরা সবাই নিজ নিজ স্বয়ংক্রিয় হাতিয়ারগুলো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করছিলাম। ব‍্যাপারটা তদারকি করছিলেন ব‍্যোম সিং মেজর, আমাদের সিএইচএম, হরিয়ানার মানুষ ছিলেন উনি। ভীষণ রকম গম্ভীর প্রকৃতির। বিনা প্রয়োজনে একটি কথাও বলতেন না। আমরা কোনদিন ওনাকে হাসতে দেখিনি। তবে প্রচণ্ড কর্তব‍্যপরায়ণ ও সৎ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। ওনার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো--- কথা বলার সময় চোখগুলো বুঁজে যেতো, আর থেমে থেমে কথা বলতেন, অনেকটা আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাননীয় অটলবিহারী বাজপেয়িজীর মতো!

যাইহোক আমরা আপনমনে কাজ করছিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তে ঝড়ের বেগে সেখানে হাজির হলেন সুদর্শন মেজর। সুদর্শন নেগী, গাড়োয়ালের বাসিন্দা। প্রচণ্ড হাসিখুশি এবং খোলামনের মানুষ। কিন্তু ওইমুহুর্তে প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন ও গম্ভীর লাগছিল। ব‍্যোম সিং মেজরের উদ্দেশ্য বললেন- "মেজর, আপ তুরন্ত উর্দী লাগা লিজিয়ে! উসকে বাদ আপনা বোরি-বিস্তর আউর সমান প‍্যাক করকে, সিধা কোম্পানি কমান্ডার সাহাবকে পাস রিপোর্ট কিজিয়ে! আপকো আভি হেড কোয়ার্টার শিলং জানা পড়েগা। গাড়ি আনেওয়ালা হ‍্যায়।" যারা ফৌজে কাজ করেন তাঁরা ভালোমতোই ওয়াকিবহাল এইরকম পরিস্থিতির সঙ্গে। প্রশ্ন করার কোনো জায়গা নেই, শুধু হুকুম তামিল করা ছাড়া। মেজর একবার শুধু স্বগতোক্তির স্বরে জিজ্ঞেস বললেন, "কিস লিয়ে!" জবাব এলো "হামে কিয়া পতা! সাহাবকো মালুম হোগা!!"

সিএমএইচ মেজর চলে যাওয়ার পর পরই আমরা সবাই মিলে সুদর্শন মেজরকে চেপে ধরলাম--- "মেজর, বাত কেয়া হ‍্যায়! ডালমে কুছ কালা লাগ রহা হ‍্যায়!"  

মেজর আমাদের থেকে বয়সে অনেক বড়ো, প্রায় বাপের বয়সী লোক! কিন্তু আমাদের সাথে সম্পর্ক একদম বন্ধুর মতো । আমাদের সঙ্গে ওঠাবসা, তাস খেলা, পানাহার করা, এমনকি একসাথে বসে নিষিদ্ধ ছবি দেখা, সবকিছুই চলতো! সবসময় কারুর না কারুর পিছনে কাঠি দিতে সদাই ব‍্যস্ত থাকতেন! আমাদের কথা শুনে বললেন, "দেখতে রহো ইয়ার, পিকচার তো আভি শুরুহি হুয়া!"

ইতিমধ্যে সিএইচএম মেজরকে দেখলাম পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম পরিহিত হয়ে কোম্পানী কম‍্যান্ডার সাহেবের বাংলোর দিকে অগ্ৰসর হতে। লাগেজ-টাগেজ সব গোছানো, ব‍্যারাকের সামনে পড়ে রয়েছে।...

বোধহয় দশ মিনিটও হয়নি! মেজরকে দেখলাম আবার ফিরে আসতে! ব‍্যারাকের দিকে নয়,  সোজা আমাদের দিকে! মুখখানা প্রচন্ড গম্ভীর! কালবৈশাখীর মেঘের মতো, এখনই ঝড় উঠে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেবে যেন!  সোজা সুদর্শন মেজরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমরা ভেবে পাচ্ছিনা কি ঘটতে চলেছে! ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম... মেজরের চোখ বন্ধ হয়ে গেলো! বুঝলাম কিছু বলতে চলেছেন! ............ আমরা শুনে যাচ্ছি ! ......" ওয়ে সুদর্শনা ! ....... তেরী আ্যয়সি কি ত‍্যায়সি !........ তেরী ইতনি হিম্মত ! .......( আবার থামলেন ) ....... শুভে শুভে মজাক উড়ানে কে লিয়ে তেরেকো ওউর কিসিকো নেহি মিলা ! ( আমরা দেখলাম মেজরের চোখ আর খুলছেই না! সাধারণত প্রচণ্ড রাগলেই তবে এটা ঘটতো !) ......  থামার কোনো লক্ষণই নেই ........"ওই বান্দর কি আউলাদ! ...... . খামোশ কিঁউ হ‍্যায়! ......... ওই তেরী ...... কী .........!  ওই তেরী নানী কী .......! " আমরা নীরব দর্শক!!

ইতিমধ্যে কখন যে কোম্পানি কমান্ডার দরিয়া সি‍ং সাব তাঁর বাংলো থেকে বার হয়ে এসে  চুপিচুপি পুরো ঘটনাটির মজা নিচ্ছেলেন, কেউ টের পায়নি।  সাহেবের গলা শুনে সবাই চমকে উঠলাম "মেজর ব‍্যোম সিং, গালি থোরা মুঝে ভি দিজীয়ে! ম‍্যাভি ইসকা হকদার হুঁ! আখির প্ল্যানিং তো হাম দোনো মিলকেহি বনায়া থা!"

জীবনে ভুলবোনা সেই দৃশ্যের কথা! কোম্পানি কমান্ডার সাহেব মুচকি মুচকি হাসছেন! সুদর্শন মেজরের চোখেমুখে  ছেলেমানুষী হাসি! সমবয়সী একই পদমর্যাদার সহকর্মীকে বোকা বানিয়ে যুদ্ধ জয়ের হাসি! আর ব‍্যোম সিং মেজর, যার মুখের হাসি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য জিনিস বলে মনে করা হতো, আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। ঠোঁটের এক কোণে হাসির ঝিলিক দেখা গেল! ক্রমশ তা চওড়া হতে হতে অট্টহাসিতে পরিণত হলো! সাহেব হাসছেন, দুই মেজর হাসছেন,  আর আমরা--- জওয়ানরা কি করে চুপ থাকতে পারি! সে কি হাসি! সবার মিলিত হাসিতে আকাশ-বাতাস সমস্তকিছু শিহরিত হয়ে উঠলো! বিশ্বাস করুন ওইরকম হাসি না কেউ কোনোদিন শুনেছে, না কেউ দেখেছে!!

দিনটা ছিলো পয়লা এপ্রিল, উনিশশো বিরানব্বই।






আত্মদান

শ্যা ম লী  ব্যা না র্জী

কফিন বন্দী দেহটা এলগিন রোডের বাড়িতে এসে পৌঁছল প্রায় বেলা বারোটায়। সমস্ত রাস্তাটা লোকে লোকে লোকারণ্য।  ট্রাফিক গার্ডরা হুইসল্ দিয়ে ছোটাছুটি করছে। পুলিশের কঠোর বেষ্টনী ভেদ করে মিডিয়া ও সংবাদপত্রের ফটোগ্রাফাররা ভেতরে ঢুকে পড়ছে। জাতীয় পতাকায় মোড়া কফিনটা বিমানবাহিনীর লোকেরা বাড়ির পোর্টিকোতে নামিয়ে রাখলো। দরজায় দাঁড়িয়ে রোরুদ্যমানা ঊর্মিকে দুহাতে জড়িয়ে আছেন ঊর্মির মা। তাঁর চোখও বাষ্পায়িত। তাঁদের চারদিকে ঘিরে আছে তাঁদের অগণিত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব। কারো চোখই শুষ্ক নেই। সোসাইটির ডাকসাইটে সুন্দরী, 
উচ্চশিক্ষিতা, স্মার্ট, ধনী ঊর্মির  কপালে যে এমন বৈধব্যযোগ লেখা ছিল সেটা কারোর কল্পনাতেই আসেনি কখনো। ঊর্মি ধীরে ধীরে কফিনের পাশে বসে পড়ে। তার বিশ্বাসই হতে চায় না সেদিন ভোরে রাজনকে ডিউটিতে যাবার সময় শেষ বিদায় জানানোটাই এই জীবনের মত তাদের শেষ দেখা হবে সে কি স্বপ্নেও তা কোনদিন ভেবেছিল?
সেদিন সন্ধ্যার পার্টি থেকে রাজনের তাড়ায় একটু আগেই ফিরে এসেছিল তারা। পরের দিন স্পেশাল প্লেন 'বন্দে ভারত মিশান' প্লেন চালাবার ডিউটি ছিল পাইলট রাজনের। আরব দেশ থেকে দুশো জন দেশবাসীকে ভারতে ফিরিয়ে আনার ডিউটি।  রাতপোশাক পরে শোবার ঘরে এসে ঊর্মি রাজনকে ঘুমন্ত দেখেছিল। পরের দিন ভোরেই ডিউটিতে বেরিয়ে গেল রাজন।
যাবার আগে অভ্যাস মত ঊর্মিকে চুম্বন করে গেল রাজন।

প্লেনটা অবতরণ করবার সময়
যান্ত্রিক গোলযোগের কথা বুঝতে পেরে রাজন সহযাত্রীদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য আকাশে রাউন্ডের পর রাউন্ড মেরে সব জ্বালানি শেষ করে তবে নীচে নেমেছিল যাতে আগুন লেগে একজন যাত্রীরও প্রাণহানি না হয়। শুধু বাজি রেখেছিল নিজের প্রাণকে। প্লেনের ডানদিকের উইং রাজনের সঙ্গে ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল।
যাত্রীরা অল্পবিস্তর আহত হয়েছিল তবে একজনেরও প্রাণহানি ঘটেনি। সমস্ত ফুয়েল নিঃশেষ হওয়ায় এয়ার ক্র্যাফটে  আগুনও ধরেনি । তাই কোনও ধোঁয়া  দেখা যায়নি।

রাজন দীর্ঘ কুড়িবছর ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের পাইলট ছিল। প্রতিবার উড়ানে যাবার আগের রাতে  ঊর্মি উদ্বেগে ও ভয়ে রাজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো। রাজন ঊর্মিকে বলতো এই কান্না ঊর্মির শোভা পায় না। রাজনের পরিবারে রাজনের বাবা, দাদা প্রত্যেকেই দেশরক্ষার জন্য এই পাইলটের পেশা বেছে নিয়েছেন। সীমান্তে রাজনের বড় দাদা যুদ্ধে প্রাণ দেন। তা সত্বেও রাজনের বাবা রাজনের এয়ারফোর্সে যোগদানের ইচ্ছেতে বাধা দেননি। রাজনের একবার এয়ারফোর্সে থাকার সময় প্লেন এক্সিডেন্ট হয়। প্রায় একবছর হসপিটালে শয্যাশায়ী থাকার পর সুস্থ হয়ে উঠে রাজন এয়ারফোর্সের কাজ ছেড়ে কমার্সিয়াল পাইলটের চাকরী নিয়ে প্রাইভেট প্লেন চালানোর কাজে যোগ দেয়।
ঊর্মি তো ভেবেছিল রাজন হয়তো আর পাইলটের কাজ করতেই পারবে না। কিন্তু ওর অসম্ভব মনের জোর ওকে সব বাধা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।
আজ ঊর্মির কানে বাজছে রাজনের প্রায়ই বলা একটি কবিতা, যা রাজন ঊর্মিকে শোনাতো।
"If I die in a war zone,
Box me up & send me home.
Put my medals on my chest,
Tell my Mom I did the best.
Tell my Dad not to bow,
He won't get tension from me now.
Tell my brother to study perfectly,
Keys of my bike will be his permanently.
Tell my Sis not to be upset,
Her Bro will not rise after this sunset.
And tell my love not to cry,
"Because I am a soldier Born to Die...."
যদি আমি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিই,
আমার পদক আমার বুকে লাগিয়ে আমার কফিন আমার বাড়িতে পাঠিও।
আমার মাকে বোলো আমি আমার পক্ষে দেশের জন্য যা  যা সবচেয়ে ভাল কর্তব্য ও সেবা তাই আমি দিয়েছি।
আমার বাবাকে বোলো আজ থেকে তাঁর পুত্রের জন্য আর 
উদ্বিগ্ন না হতে।
আমার ভাইকে বোলো আজ থেকে আমার বাইকের চাবি তার হল।
আমার বোনকে বলো আজকের সূর্যাস্তের পর তার ভাই আর  জেগে উঠবে না।
আমার স্ত্রীকে বলো সে যেন অশ্রুপাত না করে। কারণ আমি একজন সৈনিক, যে দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন করার জন্যই জন্মেছিল।
ঊর্মি চোখের জল মুছে কফিনের ওপর হাত রাখে। আজ থেকে বাকি জীবন এই ব্যথার সংহিতা তাকেই বহন করতে হবে।






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪