স্মৃতিকথা



কাশ্মীর অষ্টম পর্ব

শু ভ্র জী ৎ বি শ্বা স 

আগের পর্বেই বলেছিলাম যে যেটা অন্যান্য জায়গার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবে নেওয়া হয় কাশ্মীরের ক্ষেত্রে সেটা কিন্তু ততটা স্বাভাবিক ভাবে কেউ নেয় না। শ্রীনগরে থাকাকালীন তাই কেউই স্থানীয় মানুষ জনদের সাথে ততটা মিশতে চাইতো না। আমার যে সব মানুষের সাথে খুব গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো তাদের মধ্যে উমর ভাই অন্যতম। যার সাথে এখনো সম্পর্ক রয়েছে। উমর ভাই দেখতে বলিউড হিরোদের থেকে কোনো অংশে কম নয়। হাতে একটা সিগারেট বেশিরভাগ সময়ই থাকতো। হিন্দি ভাঙাচোরা হলেও ইংরেজি তে ভীষণ দক্ষ। উমর ভাইদের পারিবারিক ভাবে হোটেল ব্যাবসা রয়েছে। এক কথায় সম্ভ্রান্ত পরিবার। উমর ভাইয়ের রাইট হ্যান্ড ছিলো মানজিল। তার বাড়ি ছিল গুলমার্গ। তার সাথে সম্পর্কটা ছিল ছোট বেলার বন্ধুদের মতো। মোমিন নামের একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছিল। মোমিনদের শ্রীনগরে একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্ট রয়েছে। ওরা আদতে ইসলামপুরের মানুষ। ওর বাবা পরিবার সমেত নয় মাস শ্রীনগরে থাকেন। শীতের দু তিনটে মাস যখন ডাল সিজিন তখন ইসলামপুর ফিরে আসেন। মোমিন ও তার ভাই ওখানকার স্কুলে পড়াশোনা করতো। সময় পেলেই মোমিন ওর বাবা কে সাহায্য করতে দোকানে আসতো। সেখানে ইসলামপুরের জামাই নয়িম বাবুর সাথেও পরিচয় হয়েছিল। আমি অকাজের বেশিরভাগ সময় মোমিনদের দোকানে আড্ডা মারতাম। তার একটা বিশেষ কারণ হলো ওদের দোকানের ভেতরে একটা জায়গা ছিল যেখানে সব সময় আগুন জ্বলতো। আমি সেখানে একটা চেয়ার নিয়ে পাশে বসে চা খেতাম আর মোমিন বা ওর বাবার সাথে গল্প করে সময় কাটাতাম। সেখানে স্থানীয় ব্যাবসায়ীদের ও অনেকেই মাঝে সাঝে আসতেন। শ্রীনগর লাল চকের প্রসিদ্ধ বস্ত্র বিক্রেতা সওকত সাহেবের সাথে সেখানে প্রথম পরিচয় হয়। পরবর্তী তে বিভিন্ন সময় ওনার দোকানে গেছি। উনি যেই দামে শাল থেকে জ্যাকেট আমাকে দিতেন ভাবতেও অবাক লাগে আমাদেরই বন্ধু বান্ধবরা তার তিন গুণ বেশি দামে সেই জিনিস কিনে আনতো। মোমিনদের দোকানে সিঙারা খুব বিখ্যাত ছিল। কিন্তু সিঙারায় আলু কোনোদিন পাইনি। মুলাই থাকতো সব সময় তাই আমার সেটা খুব একটা পছন্দের ছিল না। তবুও অনেক সময় খিদের জ্বালায় সেটাই খেতাম। তবে ওদের ভেজ পকোরা টা ছিলো ভীষণ লোভনীয়। যখন বাইরে স্নো ফল হতো দোকানের ভেতরে আগুনের পাশে বসে চা আর ভেজ পকোরা খাওয়ার স্বর্গীয় অনুভূতি আমি অসংখ্য বার পেয়েছি। আমরা সাধারণ সব খাবারেই কম বেশি আলুটা ব্যাবহার করি। ওখানে কিন্তু তা নয়। সবজি তে আলুর বদলে মুলা, টমেটো প্রভৃতি ব্যাবহার হয়। একবার মোমিন এর বাবা পনীর রান্না করেছেন কিছু টুরিস্টদের জন্য। আমাকে যথারীতি টেস্ট করতে দিয়েছেন। পনীর শুনেই প্লেট টা নিয়ে নিয়েছি। এবার না পারছি গিলতে না পারছি ফেলতে। বিষয়টা হলো ছোট থেকে পনীর ভেজেই বিভিন্ন রেসিপি খেয়েছি বাড়িতে। ওখানে পনীর ভাজার কোনো গল্প নেই। গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া হলো রান্না শেষে একটা পাত্রে সেটা ঢালার পর ওপর থেকে সর্ষের তেল ঢালা হয়েছে। যেটা আমি সেবার জীবনে প্রথম খেয়েছি। মোমিনের বাবা টুরিস্ট আসলেই বিভিন্ন সময় নানা ধরনের রান্না করতেন। সব সময় মনে করে টেস্ট করতে দিতেন। এটা বিরাট বড় পাওনা ছিল। উমর ভাই মাঝে মধ্যেই বাড়ি নিয়ে যেতেন। এমন প্রচুর স্থানীয় খাবার খেয়েছি যেগুলোর নাম এতবছর পর আজ আর মনে নেই।

(ক্রমশঃ)





শৈশবের বসন্ত

অ র ণ্যা নী 

গ্রামে শীত থাকত দীর্ঘ সময় ধরে। একটাই সোয়েটার জামার উপর চাপিয়ে রাখতে আর কতদিন ভালো লাগে? মাকে জিজ্ঞেস করতাম, "মা, শীতকাল কবে যাবে?" মার মুখে শীতের পর বসন্তকাল আসার কথা শুনে আশান্বিত হতাম। ক্যালেন্ডারে ফাল্গুন মাস পড়তে কতদিন বাকি রোজ গুণে গুণে দেখতাম। কিন্তু গ্রামে ফাল্গুন মাসেও ঠান্ডা থাকত। তবুও বসন্ত এসে গেছে বলে সোয়েটার খুলে দিতাম।
বসন্ত পাতা ঝরার দিন। বন জঙ্গল শুকিয়ে গেলে তার মধ্যে দিয়ে কত রাস্তা বেরিয়ে যেত। সেই রাস্তা দিয়ে কোন পাড়া থেকে চলা শুরু করে কোন পাড়ায় গিয়ে উঠতাম। সঙ্গে থাকত দিদি, আর কিছু কচিকাচা। মাঝে মাঝে রাস্তাও হারিয়ে ফেলতাম। খুব ছোটই তখন। আবার মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে বাড়ি ফিরতাম। এটা একটা মজার খেলা ছিল আমাদের। দিদি মাঝে মাঝেই গান ধরত, "কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা", কখনো "ওরে যাব না আজ ঘরে রে ভাই যাব না আজ ঘরে। ওরে, আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ নেবো রে লুঠ করে।" মা আমাদের খুঁজতে বেরিয়ে যেতেন। আমরা আমের মুকুল, বাতাবি ফুলের গন্ধ নিয়ে ঘরে ফিরতাম। বকাঝকা যথেষ্টই খেতে হতো। তবে এতো আনন্দের কাছে তা কিছু নয় তখন। বন জঙ্গলের নোংরা মেখে এসেছি বলে সাবান দিয়ে গা হাত পা পরিষ্কার করে স্নান করানো হতো।
তারপর দিদি একটু বড়। সঙ্গীটিকে নিয়ে মাঠে শিমুল ফুলের খোঁজ নিতে যেতাম। গাছের নিচে থেকে যেদিন কুড়িয়ে পেতাম কী আনন্দ! গাছ ভরা লাল ফুলগুলোর দিকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকতাম। ফাল্গুনের পর চৈত্র মাসে কৃষ্ণচূড়ায় ফুল আসত। শিমুল ফল ফেটে হাওয়ায় তুলো উড়ত। হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই তুলো ধরতাম। শিমুলতলায় তুলো কুড়িয়ে পেলে তো আরো মজা। তুলো জমিয়ে পুতুলের তোশক বালিশ হয়ে যেত দিব্যি। আমগাছের তলায় বসে পুতুল খেলা চলত। আমের বউলের গন্ধ, কোকিলের একটানা ডাক, চারপাশে নাম না জানা কত লতায় নানা রঙের ফুল, মৌমাছি, প্রজাপতির ভিড়, অন্যমনস্ক করে দিত আমাদের। কত রঙবেরঙের ফুল আর প্রজাপতি! কখন খেলার সময় শেষ হয়ে গিয়ে স্নান খাওয়ার সময় হয়ে যেত টের পেতাম না। যার যার মা ধরে নিয়ে গিয়ে কাজ সারতেন। আবারও বিকেলে খেলতে খেলতে কৃষ্ণচূড়া গাছটাকে একবার করে দেখে আসতাম। যতই দিন যায়, ততই যেন ফুলে ভরে ওঠে।

চৈত্র মাসের হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুই বন্ধুর ছোটার কথা খুব মনে আছে। হাওয়া যেন উড়িয়ে নিয়ে যেত আমাদের। আমার মা গা ধুয়ে, কাপড় কেচে, শাড়ি বাইরের তারে ভাঁজ করে মেলে দিতেন। হাওয়ায় সে শাড়ি যেন আকাশে উঠে যাবে মনে হতো। মায়ের শাড়িকে দোলনা করে আমরা নিজেদের পুতুলগুলো মার শাড়ির খাঁজে ঢুকিয়ে দিতাম। ওরা হাওয়ায় দোল খেত। বৈশাখ পর্যন্ত এই হাওয়া আর বসন্তের ছোঁয়া তখন থাকত।





উড়ান

সু নৃ তা  রা য় চৌ ধু রী

চারপাশে যা দেখি, সব কিছুতেই বিস্ময় লাগে। সে মাটির পোকামাকড়, পিঁপড়ে থেকে শুরু করে আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখি, ঘুড়ি, ফানুস, উড়োজাহাজ সব কিছুই অবাক চোখে দেখতে গিয়ে কত বকুনি যে খেয়েছি সারা জীবন ধরে, তার আর কোনো হিসাব নেই। তবুও বিস্ময় আর ঘোচে না। সবটুকু প্রকাশ করে বলার ভাষা নেই, শুধু দেখে চলি আর অন্তরের মধ্যে কেমন যেন করে ওঠে। 


এ হেন মফস্বলী সদা কৌতূহলী মানুষের কাছে বিদেশ পাড়ির সুযোগ, সে তো হাতে চাঁদ পাওয়ার সামিল। হলোই বা এশিয়ার মধ্যে। পুত্র যেদিন জানালো যে আমাদের ভিসা স্যাঙ্কশন হয়ে গেছে, উত্তেজনা আকাশ ছুঁয়েছে তখন। সারারাত ঘুমই এলো না। প্রথম উড়োজাহাজে চড়া, তায় আবার আন্তর্জাতিক উড়ান! “লয়ে রশারশি করি কষাকষি পোঁটলা পুঁটলি বাঁধি” আমরা প্রস্তুত। 

পয়লা নভেম্বর যাওয়ার টিকিট। সকাল আটটা পঞ্চাশে ফ্লাইট। আমরা ভোর চারটেয় তৈরি। আগে থেকে বুক করা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ির কাছাকাছি ছেলের বন্ধু সুদীপ্ত, তার দাদা সুপ্রতিম, বৌদি পারমিতা এবং সুদীপ্তর মা মিতা, এই চারজনকে নিয়ে সোজা কলকাতা বিমানবন্দর। আমাদের টিকিট দুবাই পর্যন্ত। সেখান থেকে এয়ারলাইনসেরই বাসে আবুধাবি। যেহেতু দুবাই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি রুটের টার্মিনাল, তাই এই রুটে যাত্রী সংখ্যা অতিরিক্ত বেশি। আগে আগে আসার ফলে বিরাট লাইনের পেছনে পড়তে হয়নি। 


সুদীপ্তরা দুই ভাই আবুধাবিতে আছে কর্মোপলক্ষে দীর্ঘদিন ধরে। ওদেরকে সহযাত্রী হিসাবে পেয়ে খুব সুবিধা হলো। ব্যাগপত্তর এমিরেটস-এর কাউন্টারে জমা করে ইমিগ্রেশনের পরীক্ষা নিরীক্ষা খানা তল্লাশি পার করে লাউঞ্জে এসে বসলাম। ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে। কাচের ভেতর দিয়ে রোদ এসে ঝলমলে করে তুলেছে। আকাশযানকে প্রথম মাটিতে বসা অবস্থায় দেখা। এর আগে যতবার ছেলেকে সী অফ করতে এসেছি, বাইরে থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। আমাদের যান এমিরেটস লেখা সুবিশাল এরোপ্লেনটিও সেখানে দেখা গেল। আমরা শুনেছিলাম যে এয়ার পোর্টে কোনো খাদ্য নিয়ে যাওয়া বারণ, তাই সেই ভোরে একটা বিস্কুট আর জল খেয়ে বেরিয়েছি। সাতটা বাজতে না বাজতেই খিদে পেয়ে গেছে। সাড়ে তিনশো টাকা দিয়ে আমার কর্তা একটি কাগজের গ্লাস ভর্তি কফি এবং দুটি কাগজের কাপ নিয়ে এলেন। সঙ্গে চিনির পুঁটলি। খুশি হলাম চিনি মেশানো নেই বলে। কিন্তু মুখে দিয়ে দেখি অসম্ভব তেতো স্বাদ। এক পাউচ চিনি মেশানোর পর খাওয়া গেল। কিন্তু যিনি চায়ে চিনি খেয়ে অভ্যস্ত, দুটো পাউচ ঢেলেও তার প্রয়োজন মেটেনা। মিতার কাছে কিছু বিস্কুট, স্লাইসড কেক ছিল, তার কিছু ভাগ পেলাম আপত্তি সত্ত্বেও। অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করার পর আটটা পঁয়তাল্লিশ নাগাদ ঘোষণা হল এমিরেটসের যাত্রীদের এবার বোর্ডিং-এর পালা। তাড়াতাড়ি হেঁটে লম্বা লাইনের সামিল হলাম। ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট গেট পর্যন্ত পৌঁছে প্রথম বিমানে আরোহণ। বিমানের রং, সীটের কভার, বিমান সেবিকাদের পোশাকের রঙে অদ্ভুত একটা সাযুজ্য লক্ষ্য করলাম। সব কিছুই খুব স্নিগ্ধ, চোখকে পীড়িত করে না। আমার আসন জানালার ধারে, আমার পাশে আমার কর্তা, তাঁর পাশে আরেক জন। আমাদের পেছনের সিটে সুপ্রতিম ও পারমিতা। প্রতি সিটের ওপর প্যাকেট করে রাখা কম্বল ও ইয়ার ফোন, আগের সিটের পেছনে ছোট্ট স্ক্রীন রিমোট কন্ট্রোল, যদি বমি হয় তার জন্য ব্যাগ, আরো কিছু স্যুভেনিয়ার জাতীয় বই, এই সব।

প্লেন ছাড়তে ছাড়তে সাড়ে নটা বাজলো। চল্লিশ মিনিট দেরী। সীটবেল্ট বেঁধে অবাক বিস্ময়ে জানালায় চোখ রেখেছি। প্রচণ্ড গতিতে বিমান ছুটতে ছুটতে একটু সামান্য ঝাঁকুনি খেলাম। বুঝলাম আকাশে উঠছি। প্লেনের ডানার ছায়া মিলিয়ে গেল। ধীরে ধীরে বাড়িঘর গাছপালা রাস্তা কেমন ছোট হতে হতে আমাদের ছোট বেলায় ঝুলন সাজানোর মত হয়ে গেল। বাড়িগুলো এক সময় দেশলাইয়ের বাক্সর চেয়েও ছোট হয়ে, বনস্পতিরা সবুজ বিন্দু হয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। আমাকে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন যে ভীষণ নাকি গা গুলোয়, মাথা ঘোরে, উঁচুতে উঠলে শীত লাগে, আমি কিন্তু এসব কিছুই অনুভব করলাম না। কিন্তু জানালা খুলে রাখি সাধ্য কি? সূর্যের কী তেজ! একটু কাছাকাছি পেয়ে সূর্যদেব কড়া শাসনে রাখলেন। বাধ্য হলাম বন্ধ করে সামনের স্ক্রীনে মন দিতে। সেখানে নানা ভাষায় এমিরেটসের বিজ্ঞাপন চলছে। সিনেমা দেখা, গান শোনা, দুটোর মধ্যে দ্বিতীয়টাই পছন্দ, অপারেট করতে পেছনের সীট থেকে পারমিতা সাহায্য করলো। কিন্তু অনেক চ্যানেল থাকলেও সব খুলছে না। শেষ পর্যন্ত অরিজিৎ সিং সঙ্গী হলো। এদিকে পেটে তখন ছুঁচো ডন মারছে। ‘সুরের খাদ্যে জানো তো মা বাণী নরের মেটে না ক্ষুধা’। মিতার দেওয়া দুটো বিস্কুট আর এক স্লাইস কেক কখন হজম হয়ে গেছে! সাড়ে দশটা নাগাদ খাবারের ট্রলি নিয়ে বিমান সেবক সেবিকাদের ছুটোছুটি শুরু হলো। কিন্তু তাঁরা তো পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যান, ফিরেও তাকান না। একটু পরে বুঝতে পারলাম ওঁরা শিশুদের আগে খাবার পরিবেশন করছেন। ভালো লাগলো দেখে। তার পর ওঁদের লাল রিবন বাঁধা  beige colour টুপি পরিয়ে ছোটদের ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্ট করে সুদৃশ্য এনভেলপে ভরে দিয়ে দিচ্ছেন। এইটুকু বিনোদন ওই একঘেয়ে যাত্রায় ভীষণ ভালো লাগলো। অরিজিৎ সিং-এর গান এক সময় শেষ, আর গান না শুনে এবার ব্যাগ থেকে বই বের করলাম। এই একমাত্র জিনিস আমার খিদে ভুলিয়ে রাখতে পারে। সুনন্দা শিকদার তাঁর পূর্ব বঙ্গের স্মৃতি বিজড়িত অতি চমৎকার ‘দয়াময়ীর কথা'য় আমাকে ডুবিয়ে রাখলেন। সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমার অভীপ্সিত খাবারের ট্রলি এলো। বিমান সেবক জানতে চাইলেন ভেজ, নাকি ননভেজ? আমাকে আলাদা করে জিজ্ঞেস করলেন, “মা, মাচ জোল বাত ?“ ভিনদেশীর মুখে ‘মা’ সম্বোধন এবং মাছের ঝোল ভাতের বিচিত্র উচ্চারণ কৌতুক জাগানোর সঙ্গে ভালো লাগায় ভরিয়ে দিলো। 


খাবার অতি সুস্বাদু। গ্লাসে আমাদের পছন্দ মতো আপেল জুস, থার্মোকলের খোপ কাটা থালায় সাজানো ছোট্ট বান, কর্ন স্যালাড, ভাত, ছোট ছোট কাঁটাহীন মাছের টুকরো দিয়ে অপূর্ব স্বাদের কারি, একটা মিষ্টি, এক কিউব চকোলেট, ছোট্ট এক বাটি জল, ঝুরি ভাজা, কাজু বাদামের প্যাকেট, মাউথ ফ্রেশনার দেখে পাউচ খুলে দেখি সেই ছোট্ট বেলার মৌরী লজেন্স! সেই লাল নীল হলুদ সবুজ এক পয়সার আনন্দ। সুগন্ধি টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ হাত মোছা মাত্র এসে খালি প্লেট বাটি চামচ ইত্যাদি নিয়ে গেল একজন। তার খানিক পরে গরম চা কফি নিয়ে আবার উদয়। কফি খেয়ে এবার প্রাণ ভরে গেল। 

মাঝে মাঝে জানালা খুলে দেখছি কখনো মেঘের মধ্যে দিয়ে, কখনো মেঘের উপর দিয়ে চলেছি। সঙ্গে চলেছে প্লেনের অতিকায় ডানা। আবার বইয়ের পাতায় মন দিলাম। এক সময় ঘোষণা হলো সিট বেল্ট বেঁধে নেবার জন্য। আমরা দুবাইয়ে অবতরণ করতে চলেছি। আমার ঘড়িতে তখন একটা চল্লিশ, স্থানীয় সময় বারোটা দশ। কিন্তু একবারে অবতরণ হলো না। কারণ হিসেবে সুপ্রতিম বললো হয়তো সিগন্যাল পাচ্ছে না। আমার খুব আনন্দ হলো একটু বেশি সময় আকাশযানে থাকতে পেরে। প্লেন চক্কর কাটছে, একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে নীচের জগত। যা ছিল সরু সুতোর মতো, আস্তে আস্তে চওড়া হয়ে ফিতে, তার পর একটা পথ হয়ে গেল, যা সমুদ্রের ওপর দিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে কানে তালা লাগার অনুভূতি। কিছু যেন শুনতে পাচ্ছি না। সেই অবস্থাতেই হ্যান্ডব্যাগ সব সংগ্রহ করে নামলাম দুবাইয়ে। বিমানসেবিকা এবং সেবকদের অভিবাদনের মধ্য দিয়ে।


দমদম বিমানবন্দরে বিস্মিত হয়েছিলাম, দুবাই বিমানবন্দর দেখে বিস্ময়ের আর অবধি রইল না। এত ঝলমলে, এত জাঁকজমকপূর্ণ! কিন্তু ভালো করে দেখার অবকাশ নেই,  নিষ্ক্রান্ত হতে হবে। সে এক বিপুল রাস্তা। কিছুটা হেঁটে, কিছুটা ট্র্যাভেলেটারের সাহায্যে চলেছি তো চলেছিই। ইতিমধ্যে আমাদের চশমা খুলে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে সাদা আরবী জোব্বা পরা কর্মচারীরা আমাদের কাগজ পত্র পরীক্ষা করে অনুমতি দিয়েছেন।  কনভেয়ার বেল্ট আমাদের স্যুটকেস হাতের নাগালে এনে দিয়েছে, ট্রলিতে চাপিয়ে চলতে চলতে অবশেষে পথের শেষ, আমরা এবার বাসের অপেক্ষায়।






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪