কথিকা/মুক্তগদ্য



নির্যাস

শ র্মি ষ্ঠা

অবশেষে উজানিয়া বসন্ত এলো বুকের ভেতর। আমি হেমন্তের রানার। ভালোবাসার চিঠি বিলোব বলে পাতাদের ঝরিয়ে ফেলার মরশুম আমি। মেহবুবা নই এক্কেবারেই। সুতরাং, দূরত্ব তার আর তোমারদের অথবা তার আর আমার এইই নিয়তি। এক মস্ত রুক্ষ ডাল নিয়ে এগিয়ে যাই উপত্যকায়। হলুদ মাটি ছুঁয়ে হলুদ শব্দরা জমা হতে থাকে আমারই কানের কুহরে। দিবারাত্র গুজগুজ গোঙানি! আমি রানার বলেই! আর তোমরা যাঁরা ভালোবাসবে বলে দূরত্ব লিখে রেখেছিলে পাকদণ্ডীতে, তাদের কোনও দায় নেই বুঝি! প্রতিধ্বনির মতো ঝুনঝুন করে ওঠে ঝুমুর। মনে হয় ছুঁড়ে ফেলে দিই হাতের লণ্ঠন। জ্বলে উঠুক মর্মর বাদামি পত্রগুচ্ছ। অন্তত কখনও তো দামাল হোক আগুন! পুড়ে যাক এই নগরী, এই বিষণ্ণতা, তোমাদের প্রেমের রাত, চুম্বন আর যাবতীয় অভিসার। সব ছাই হোক, ছাই।

বড্ড আঁধার চারপাশ। ঘোর লেগে যায়। এ অরণ্যপথে চুপ করে বসে থাকি। চাঁদের ছায়ারও কত রূপ! রুখা সুখা ডালে জ্যোৎস্না ঢেলে দিয়ে মাটিতে রেখে যায় নিজের ক্ষণজন্মা নিশানা। আমার পিঠে কুঁজের মতো বোঝাই করা চিঠির ভেতরে জল জমা হয়। ঠিক ওখান থেকে শুরু হয় নদী। মুছে যায় দাবানল। সভ্য তুমি আর সভ্য আমি। কেউ যেন খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। 'একটা সই চাই'... আঁতকে উঠি। সই! কার সই! আমি তো বার্তাবাহক। তার সাথে তোমার আর তোমাদের বার্তার। আমি তো শীত বাঁচিয়ে রাখি আমার ভেতরে আবিলতা বুনবো বলে! পা চেপে ধরে ঘাসের নরম শরীর। বলে, 'তুমি তো এত রুক্ষ নও... প্রকৃতি এত শুষ্ক হলোই বা কবে! পুরুষ কবে ভুলেছে তার অভিমানী দোসরের কথা!...' নিভু হয়ে আসে লণ্ঠন। আমাকে ঘাসের পোশাক পরিয়ে দেয়। বিম্বিত ত্রাসে অসাড় আমি... আমি রানার। দূরত্ব বাঁচিয়ে রাখ। ছুটে যাই শিমুল গুঁড়ির পাশ দিয়ে, পলাশের ডাল ছুঁয়ে।

ওই অশোক না! কতকাল দেখিনি এই রঙ! কতকাল রাঙা শাড়ির আঁচল হাওয়ায় ওড়েনি! কতকাল তুমি শুষ্ক ওষ্ঠ আর্দ্র করে দাওনি, শুধু রানার রাখবে বলে! তোমরা বিপ্লব বলে চিৎকার করো। বিপ্লবের ভেতরেও তো প্রেম থাকে! যেমন আগুনের ভেতর পবিত্রতা। মুঠো খুললে উড়ে যায় অক্ষর। ওরা বলে খিদে নাকি প্রেমের কবিতা লেখায় না। ছিঁড়ে ফ্যালো জন্মকুণ্ডলী, মাংস, চামড়া, অধর, সৌষ্ঠব, কৌমার্য, দেশ কি তাতে নেই! শরীরের ভেতরে জমা আছে আস্ত একটা মহাদেশ। পাঁজরের ভেতর সেঁধিয়ে যাও! দেখবে কত কত রম্যবাহিকা! তাতে ভাসে আদরের নৌকো। দক্ষিণের বারান্দায় যে মেয়েটা অনবরত ঝগড়া করে যায় ব্যাটাচ্ছেলে কোকিলটার সাথে, ওকে এই অশোকের গুচ্ছ দিও। বলো 'সই' দিলাম। যে ছেলেটা বাবার ঘাড়ে বসে চড়কের মেলায় যাবে, ওকে এই তালপাতার বাঁশি দিও। আর ওর বাবাকে দিও এই পলাশের মালা। 'ঘরেক লিয়ে যাবে'। বলো 'সই' দিলাম। আমি শিমুলতলায় দাঁড়িয়ে থাকবো তোমার অপেক্ষায়। চিঠি দিও কিন্তু! আমি যে রানার!

অতঃপর বসন্ত আসে। তিরতির করে জল বয়ে যায় আত্রেয়ীতে। ছইএর ভেতরে বসে আলতো প্রেমে মজে ওরা দু'জন মানুষ। ঋজু আলো বয়ে আনে মৃদুমন্দ বাতাস। অকারণ গদ্য লিখবে বলে ঝাঁকরা চুলওয়ালা ময়লা শার্ট পরা ছেলেটা দৌঁড়ে যায় বালির চরে। ঠিক তার পাশেই সিনেমাহলের ঘাট। ওখানে মাচা করে প্রতিমার বিসর্জন হয়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছেলেটা ভাবে, 'সবটাই তো লেখা হয়ে গেছে। এসবই তো আমাদের সবার কথা! তাহলে কী লিখবো নতুন!' ভাবতে ভাবতে ছিঁড়ে ফেলে যাবতীয় পাণ্ডুলিপি। অট্টহাসি। হেঁটে যায় বড় ব্রীজের দিকে। তোমরা ব্রীজের গায়ে হেলান দিয়ে দ্যাখো পাগলের ব্যভিচারিতা। কত ধনী ও! কত নিঃশব্দ শব্দ সংগোপনে জমা আছে ওর বোতাম ছেঁড়া পকেটের ভেতর। 'অথৈ দরিয়ার পানি'... তোমাদের হুঙ্কার ভ্রূক্ষেপহীন ওর কাছে, আত্রেয়ীর জলের কাছে, চলনবিলের কাছে, জলের গভীরে জমে থাকা প্রতিমার বুকের মাটির কাছে, মাছেদের সংসারের কাছে। ও ভাবে আর কী নতুন লেখা যায়! তারপর সিঁড়ি ধরে উঠে গেলে আবার সেই বসন্তকথা। বুকের ভেতরে শুধু খুঁজে চলার নির্নিমেষ বিপ্লব জিইয়ে রাখে ঋতু বদলের সোপান। আমরা কেউই জানি না বসন্ত আসলে বিপ্লবের গান...

(শব্দ সংখ্যা: ৫৫৪)






আদর্শ পিরামিডের সংক্রমণ তত্ত্ব ও বিদেহী যুক্তাক্ষরের সান্দ্রতা

নি মা ই  জা না

প্রত্ন উত্তপ্ত স্থাপত্য জ্বলছে, লাল কাঁচের ভেতরে ছটফট করছে এক একটা মাংসপিন্ডের অ্যাবাকাস, আমি পিরামিড ছুঁড়ে দিচ্ছি লাল গ্রহের দিকে, আগুন আগুনের বৈধতা বৈরিতা, পুরুষাঙ্গে ১১১ আংটি, আমি প্রতিটি গ্রহ থেকে বেঁচে আসা এক একটা হিলিয়ামের ধাতু রস ডুবে যাচ্ছে আমার পা অথচ আমি একটা বিধেয় পুরুষ মাটির গর্ত থেকে শ্বেতাঙ্গদের ধরে আনি যুদ্ধ ফেরেশতা আজরাইলদের পারমাণবিক কথা শোনাবো বলে,

সৈন্যবাহিনীদের কাছ থেকে মহাপৃথিবীর অধাতব সেনানীরা জন্মের পর বিষাক্ত হয়ে উঠছে, প্রতিদিন পোশাক থেকে এক একটা খনিজ গন্ধে ভেসে আসছে
দ্রাক্ষা চুল আর আমার মাথার ভিতরে এক একটা সৌন্দর্যহীন স্মৃতিসৌধের আবর্তন গতি বন বন করে লাটিমের মতো ঘুরছে নদীর অনেক অতলে সরু সুতোর মতো রজঃরক্তের থেকেও আরো তীব্র স্রোত বয়ে যাচ্ছে ভূমধ্যের দিকে,
চাঁদের ভেদের মতো তীব্র, জানালাও উদ্বাস্ত কুয়াশা রৈখিক চলন পাখনা ওয়ালা পিপাসা, সুফি ধাতু, গুঞ্জন টমেটো বীজের মতো পারদ দাঁত, আমি একটা রেস্তোরাঁয় বসে মৃত মানুষদের ঠ্যাংগুলোকে কালো কাঁচ দিয়ে কেটে কেটে ঝুলিয়ে রেখেছি জয়চন্ডী হোটেলের খিড়কি দরজার পেছনে এখানে প্রতিটি মানুষ আত্মহত্যার জন্য শেষ রাতের দিকে মদে রুটি ডুবিয়ে খায়।

আর লাল প্লাস্টিকের তরলগুলো ঢেউ খেতে খেতে জীবনবন্দী সাতকর্ণী মহাপুরুষের গল্প বলছে কোন যজ্ঞের অগ্নিকোণের উপবনের সাক্ষ্য তান্ত্রিক প্রজনন মধু রহস্যপুরের বীভৎস সঙ্গীতের ন্যায়, একটি আইসক্রিমের লাল ডোরাকাটা পুরুষ সিংহের তৈরি কাঠের শবাসনে বসে পৃথিবীর মৃত মানুষদের উষ্ণতা নির্ণয় করছে সম্পাদ্য গ্রাফাইট ভঙ্গিমায়
সকলেই ক্ষুধার্ত মুখ নিয়ে বসে আছে একটা ধনুকের ত্রিশূল সমষ্টিগত বাকল ছালের কুষ্ঠ রোগীদের অন্তিম প্রহরের শ্বাস বিন্দুর জলযোগ কলা দোষ নিয়ে, স্থির থেকে থেকে ছটফট করে নেমে যাচ্ছে আধপোড়া কাঠের সর্বনাশ,

দুশো কুড়ি বর্গগজ বৃত্তাকার পৃথিবীর আদিম মানুষগুলো নিজেদের কঙ্কাল কাঠের বুকে ঝুলিয়ে একেকটি আত্মা বিক্রি করে যেত ভাদুতলার কর্নগড় মন্দিরের সেবায়েত নামক এক নৈঋত ভগ্নাংশ ক্যাসিওপিয়াকে।







মন্তব্যসমূহ

  1. নির্যাস এবং আদর্শ পিরামিডের সংক্রমণ তত্ত্ব... দুটি মুক্তগদ্যই অসাধারণ লাগল। ভাষার লালিত্য মুগ্ধ করল ,বিষয় নির্বাচনও মনগ্রাহী।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪