ভ্রমণ কাহিনী



এক টুকরো স্বর্গ

শ ম্পি তা রা য়

মার্চ মাস, অর্থাৎ আমাদের ভ্রমণ মাস। বেড়ানোটাকে আমরা আমাদের সুবিধামত বড়, মেজো, সেজো, ছোট করে নিয়েছি। মার্চে আমাদের বড়দা-বেড়ানো। যথারীতি দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে ট্রেনের টিকিট কেটে দার্জিলিং মেলে চড়ে বসলাম। এবার আমাদের দলের পরিধিও বেশ বড়। কনিষ্ঠ থেকে বড়িষ্ট - মোট ১৮ জন। হইহই করে দার্জিলিং মেলে  চেপে পরের দিন সকালে এনজেপি পৌঁছলাম। স্টেশনেই বেশ ভালো মত জলখাবার খেয়ে নিলাম। এখন থেকে গাড়িতে করে আমরা যাবো আমাদের গন্তব্য স্থলে। কোথায়? একটু ধৈর্য্য ধরুন, জানাচ্ছি।


শিলিগুড়ি ছাড়ানোর একটু পর থেকেই ধীরে ধীরে পরিবেশের পরিবর্তন চোখে পড়ছিল। গরম আস্তে আস্তে কমছিল গাছপালারও আমূল পরিবর্তন হচ্ছিল। ইতিউতি চা বাগান চোখে পড়াতে আমরা রীতিমত উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলাম। মাঝে কার্শিয়াং এ থেমে সুবাসিত চা খেলাম। ক্রমশ এসে পড়ল ঘুম স্টেশন। ঐতিহাসিক ঘুম স্টেশন আবার আমরা দাঁড়ালাম, ছবি তুলে রওনা হলাম বাম দিকের রাস্তা ধরে মিম এর উদ্দেশ্যে। ঘুম থেকে মিম চা বাগানের দূরত্ব ১২ কিমি এবং উচ্চতা ৫০০০ ফুট।ধীরে ধীরে রাস্তার দুধারে পাইন, ফার, রডোডেনড্রন এর জঙ্গল ঘন হচ্ছে। আর রাস্তা? এটা রাস্তা? গাড়ি শেষ ১০ মিনিট সোজা খাড়া উঠে যাচ্ছে। আমরা যারা ভয়ডরহীন তারা তো দারুণ উপভোগ করছি আর বাদ বাকিদের মুখের দিকে তাকাচ্ছি না। কিন্তু ড্রাইভার ভাইরা স্বচ্ছন্দ গতিতে গাড়িগুলোকে লিটল ফরেস্ট হোম স্টে এর সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। আমরা নিজেদের নড়বড়ে শরীরগুলোকে গাড়ির বাইরে বার করে পুরো থ হয়ে গেলাম।


অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য, অসাধারণ কটেজ ও তার সংলগ্ন প্রচুর অর্কিড, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া আমাদের পথের শ্রমকে এক লহমায় ভ্যানিশ করে দিলো। গরম জলে স্নান করে গরম গরম ভাত, ডাল, সবজি, ডিমের ঝোল ইত্যাদি খেয়ে চারপাশে হাঁটতে বেরোলাম। এই হোম স্টের চারপাশে পাইনের জঙ্গল। সেখানে অনেকক্ষণ কাটিয়ে সন্ধ্যার আগে ঘরে ঢুকে পড়লাম। এদের খাওয়ায় জায়গাটা অনেকটা প্রশস্ত, অনেকগুলো বেঞ্চ আর টেবিল রাখা। একসাথে ২০-২৫ জন খেতে পারে। আর চারদিকে কাঁচের জানলা। আমরা ওখানে বসেই আড্ডা মারতাম। দূরে দেখা যেত পাহাড়ের গায়ে কোন জনপদের আলো ঝিকমিক করছে। সেই দিন তাড়াতাড়ি ডিনার খেয়ে সবাই শুয়ে পড়লাম।

পরের দিন সূর্য ওঠার আগে আমরা উঠে পড়েছিলাম। ঘরের বড়ো বড়ো জানলার পর্দা সরিয়ে অধীর আগ্রহে ওনার দিকে তাকিয়ে বসে পড়লাম। ভোরের প্রথম আলো যখন ওনার ওপর পরল তখন বুঝলাম ওনাকে কেনো কাঞ্চনজঙ্ঘা বলে। সূর্যের আলো  'ঘুমন্ত বুদ্ধের' উপর পরে ধীরে ধীরে রং বদলাচ্ছিল , অপার্থিব সেই দৃশ্য আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখছিলাম। এ যেনো একটুকরো স্বর্গ পৃথিবীতে নেমে এসেছে। এই দৃশ্য সারাজীবন মনের মণিকোঠায় সযত্নে রেখে দিলাম।


সেই দিন জলখাবার খেয়ে মিম চা বাগান দেখতে গেলাম। চা কারখানাতে কি করে চা তৈরি হয় সেটা ওখানকার একজন কর্মী খুব ধৈর্য্য সহকারে বোঝালেন। আমরা সবাই বাড়ির জন্য চা কিনলাম।তারপর চা বাগানে মজা করে ফটো সেশন হলো। এরপর আবার গাড়ি করে অনেকটা নিচে একটা ছোট পাহাড়ি নদীর পাড়ে গেলাম। শান্ত ,পরিষ্কার নদীর পারে বসে চুপচাপ চারপাশের প্রকৃতিকে উপভোগ করছিলাম। ফেরার আগে ঠাণ্ডা নদীর জলকে স্পর্শ করে মনে মনে বললাম আবার আসবো।

হোম স্টেতে ফিরে দুপুরে লাঞ্চ খেয়ে একটু বিশ্রাম করলাম। এই হোম স্টেটা এত সুন্দর যে এখন থেকে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। এদের বাগানে প্রচুর বিভিন্ন রঙের অর্কিড ছিলো। এই হোম স্টের মালিক গল্প করছিলেন যে এখানে আগে চিতা বাঘও দেখা যেত। চারপাশ এত নির্জন যে আগে কেনো এখনও যদি দু'একটা চিতা বেরোয় আশ্চর্য হবো না। রাতে ওয়াচ টাওয়ার এ উঠে সেটা আরো বেশি মনে হচ্ছিল। ওয়াচ টাওয়ার থেকে চারদিকের ঘন নিকষ পাইন বন থেকে চিতা কেনো দু'একটা ভূত বেরোলেও অবাক হতাম না। সন্ধ্যা বেলায় চা ও পকোড়ার সাথে আমরা জমিয়ে গান করতাম। এই হোম স্টের একজন কর্মী বড় সুন্দর গান গাইতো। সে ডিনারের পর কিশোর কুমারের হিন্দি গান করতো, আর আমরা ওকে ঘিরে বসে গান শুনতাম। মুহূর্ত মগুলো তখন মনে হতো ওখানেই থেমে গেলে খুব ভালো হত। রাতে ঘুমের মধ্যেও কানে গানের অনুরণন চলত।


পরের দিন সকালে গাড়ি নিয়ে বেরোলাম ঘুম, লামাহাটা,লেপচা জগৎ ইত্যাদি ঘুরতে। মিম থেকে সবচেয়ে কাছে ঘুম মনস্ট্রি। মনাস্ট্রির ভিতরে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি ও গম্ভীর পরিবেশ আমাদের বিমুগ্ধ করেছিলো। ওখান থেকে গেলাম বাতাসিয়া লুপ দেখতে। টয় ট্রেন দেখে দারুণ মজা লাগলো। বেশ কিছু ছবিও তোলা হলো। ওখান থেকে একে একে দেখলাম লেপচা জগৎ, লামাহাটা ইত্যাদি। বড়ো বড়ো পাইন গাছের মধ্যে মেঘেদের সাথে লুকোচুরি খেলতে দারুণ লাগছিলো।সারাদিন ঘুরে অবিস্মরণীয় কিছু মুহুর্তকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসলাম আবার মিম এ। এরপরের দিন ওখান থেকে গেলাম দার্জিলিং। কিন্তু সেই গল্প অন্য কোন সময় করবো। এই লেখায় শুধুই মিম জড়িয়ে থাকুক। অর্কিডের নানা রঙের শোভা মনকে এত মুগ্ধ করে রেখেছে যে আমি সবাইকেই অনুরোধ করবো একবার মিম ঘুরে আসুন। স্বল্প পরিচিত জায়গা হলেও এই জায়গা আপনাকে এত কাছে টেনে নেবে যে ছেড়ে আসতে মন চাইবে না। সারা জীবনের মতো এক সুমধুর স্মৃতি আপনাকে আবিষ্ট করে রাখবে।





চোত-ফাগুনে লাল পাহাড়ির দেশে

ক ল্প না  রা য়

জীবনের রোজ নামচার মধ্যে একটু ফাঁক পেলেই মন চায় বেরিয়ে পড়তে আর বেড়ানো মানেই আনন্দিত প্রাণ। প্রকৃতির সাথে সময় বিশেষে বেড়াতে যাওয়ার জায়গা ঠিক হয় সেই মত। যেমন চৈত-ফাগুন মানেই লাল পাহাড়ির দেশ, প্রকৃতির রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়ে আনন্দের স্রোতে গা ভাসানোর দিন। 'বাসন্তী 'সংখ্যা বলেই এই ভ্রমনটাই লিখতে ইচ্ছে হল। থাকছে পথের বর্ণনা, দেখার জায়গাগুলোর ইতিহাস আর চলতি পথের ঘটনা, যা কিনা সবটাই আমাদের  চোখে দেখা।


পলাশের ডাকে গিয়েছিলাম কলকাতা থেকে পুরুলিয়া। পলাশ উৎসবের দুটো দিনের সাথে একটা দিন জুড়ে ছুটি ছিল তিনদিনের। কলকাতা থেকে সড়ক পথেই গিয়েছিলাম এবার। এই প্রথমবার গাড়ি নিয়ে এতদূর পাড়ি দেওয়ায় বেশ উত্তেজনা ও ছিল। ভোর চারটের সময় দুজনে বেরিয়ে পড়লাম, আবছা অন্ধকারের চাদর মুড়ে শহর  তখন ও ঘুমে আচ্ছন্ন। বেশ লাগছিল, ভোর হল ভোর থেকে সকাল দেখতে শহর ছাড়িয়ে চলেছি শহর থেকে দূরে। রোজকার ব্যস্ততায় তো আর এমন  করে ভোর দেখা হয় না। আমরা দিল্লি রোড হয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ধরে গিয়েছিলাম। আসানসোল পেরিয়ে পুরুলিয়ার দিকে যেতে যেতে ক্রমশ বদলে যাচ্ছিল প্রকৃতির দৃশ্যপট। ধূসর মাটির রঙ হল লাল, দৃশ্যমান হতে লাগলো ছোটো বড় টিলা । সিরকাবাদ পৌঁছতেই পুরো ল্যান্ডস্কেপ গেল বদলে। মন  আনন্দে গুনগুন করে উঠল। শাল, শিমুল, পলাশ, মহুয়া, পিয়ালের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য গড়পঞ্চ কোট। ঘড়িতে তখন প্রায় এগারোটা। প্রথম বলে একটু সময় বেশীই লেগেছে।


অপার নৈঃশব্দ্য আর অগাধ সৌন্দর্য্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে গড় পঞ্চকোট। রিসর্টের পেছনেই মাথা উচুঁ করে আছে পঞ্চকোট পাহাড়। নিস্তব্ধ পরিবেশ, কতরকমের পাখির ডাক কানে আসছে। রিসর্টটি সুন্দর বেশ জঙ্গলের মাঝে, আমরা ঘরে পৌঁছানোর খানিক পরেই গাইড দাদা এলেন, গড়ের ইতিহাস বলে গড়পঞ্চকোট ঘুরিয়ে দেবেন, তার সাথে বড়ন্তিও যাবো সূর্যাস্ত আর পলাশের খোঁজে। পর দিন সকালে শ্যামসুন্দর আমাদের পঞ্চকোট পাহাড়ে নিয়ে যাবে... এই কথা হল। শ্যামসুন্দরকে বলে দিলাম দুপুরে কি খাবো। আমরা স্নান সেরে ডাইনিং হলে লাঞ্চ করতে গেলাম। খুবই সুন্দর লাগছে। আমরা বন দপ্তরের রিসর্টে ছিলাম কলকাতা থেকেই অন লাইন বুকিং করেছিলাম।ডাইনিং এর গায়েই পঞ্চ কোট পাহাড়।
 
গড়পঞ্চকোট কলকাতা থেকে প্রায় তিনশ কিলোমিটার রাস্তা।আমরা মাঝে ব্রেক দিয়েছি বলে আমাদের ছয় ঘণ্টা মতন সময় লেগেছে। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলায় পঞ্চকোট পাহাড়ের কোলে অবস্থিত গড় পঞ্চকোট। শাল, পিয়াল মহুয়ার জঙ্গলে  ঘেরা, বসন্তের পরশ গাছে গাছে পাতায় পাতায় তার সাথে হাওয়ায় সুর তুলেছে ঝরা পাতা... নবীন প্রবীণ মিলেমিশে দারুন এক মোহময় আবেশের ছায়া সমস্ত বন জুড়ে।


প্রায় পাঁচ মাইল বিস্তৃত একটি দুর্গ ছিল আর দুর্গের চারপাশে  প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা  ছিল বারো মাইল জুড়ে, পরিখা দিয়ে ছিল ঘেরা। আজ সবই অতীত। ভগ্ন দেউল আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের স্তূপ বয়ে চলেছে প্রাচীন ইতিহাসের গল্পকে।  'গড়' মানে দুর্গ, 'পঞ্চ' হল পাঁচ আর 'কোট' অর্থ গোষ্ঠী।


পঞ্চকোটের প্রথম রাজা ছিলেন দামোদর শেখর। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে ঝালদা অঞ্চলের পাঁচ আদিবাসী গোষ্ঠীর সর্দারদের সাহায্যে এখানে তিনি রাজত্ব গড়ে তোলেন। সেই থেকেই এই জায়গা গড় পঞ্চকোট নামে পরিচিত। পঞ্চকোট পাহাড়কে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে দুর্গ, মন্দির, প্রাসাদ, স্থাপত্য যা কিনা গড় পঞ্চ কোট নামে পরিচিত। এই পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় 490 মিটার। সেই সময়ের রাজত্ব কালে পরিখা ছিল পাঁচটি, ছোট বড় পুকুর ছিল প্রায় একশ-দশটি, ছিল দক্ষিণ পশ্চিমে বাঁশকাঁটার জঙ্গল, মাঝে একটি পরিখা, সম্ভবত নৌকা করে এই পরিখা পার করেই দুর্গে প্রবেশ করতে হত। আরো ছিল রঘুনাথ-জীর মন্দির, কঙ্কালী মাতার মন্দির, রাস মন্দির, পঞ্চ মন্দির, রানীদের মহল, এমনই সব ঐতিহ্যমন্ডিত স্থাপত্য কালের নিয়মে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ এখনো বোঝা যায়। মন্দির দেখে এটাই প্রমাণ হয় যে বৈষ্ণব ধর্মের প্রাধান্যই ছিল। বাংলায় বর্গী উচ্চ আক্রমনের সাক্ষ্য গড় পঞ্চকোট বহন করে চলেছে আজও।


পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখতে দেখতে গাইড দাদার মুখে অতীতের কাহিনী শুনতে শুনতে বিস্মিত হচ্ছিলাম... এইভেবে যে প্রাসাদ রক্ষার কি নিপুণ কলা কৌশল! ক্ষনিকের জন্য যেন পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই সময়ে।

এবার আমাদের গন্তব্য বড়ন্তি। পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলাম সেই রঙের দেশে। শিমুল পলাশের বন্যায় প্লাবিত গোটা অঞ্চল। ছুটেছে রঙের ফোয়ারা, দিগন্ত হয়েছে লালে লাল তারই সাথে লাল মাটির পথ চলেছে এঁকে বেঁকে... এ দৃশ্য দেখার...! বর্ণনার নয়...। চৈত ফাগুনে রাঢ় বাংলার  আকাশে বাতাসে বনে বনে  পাতায় পাতায় চলে বর্ণ মিছিল।তারই মধ্যে সূর্য্য জমায় পাড়ি।সরোবরের বুক চিরে রক্তিম রেখায় সেদিনের মত তিনি ডুব  দিলেন। আমাদের গাড়ি চলল আবার গড় পঞ্চকোট রিসর্টের পথে। গাইড দাদার অনুরোধে পাঞ্চেত দেখলাম রাতের অন্ধকারেই হাতে সময় কম, তারপর ফিরে এলাম। পরের দিন ভোরে যাবো পঞ্চকোট পাহাড়। 
আগের দিন কথা হয়েই ছিল, পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় তৈরী হয়ে আমরা দুজন শ্যামসুন্দরের সাথে পঞ্চ কোট পাহাড়ের পথে চলা শুরু করলাম। রিসর্টের পিছন দিকেই পাহাড়ে ওঠার রাস্তা। শুধু আমরাই নয় আমাদের সাথে  দুটি কুকুর ও পথের সাথী হল। ওরা অতিথিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। ঘন জঙ্গলের মাঝে পাকদন্ডী বেয়ে পাহাড়ের চূড়ায়  পৌঁছে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। ঝরা পাতার ওপর চলার শব্দ, গাছে গাছে নতুন সবুজ পাতার ঝিলিক তারই সাথে নাম না জানা পাখির ডাক, ঘন জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে ভোরের আলোর লুকোচুরি... এইসব উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলেছি। কখনো হাত ধরে নয়তো গাছের ডাল ধরে ওপরের দিকে উঠছি।  এর আগের পর্বেই জানিয়েছি, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে থাকা পঞ্চ কোট সাম্রাজ্যের ইতিকথা। শান্ত স্নিগ্ধ সবুজ অথচ দুর্গম জঙ্গলের ২১০০ ফুট উঁচু চূড়ায় উঠতে বেশ লাগছিল। ভিউ পয়েন্ট টি গোলাকৃতির। এখান থেকে পাহাড়ের আঠারো বর্গ কিলোমিটার এলাকা দেখতে পাওয়া যায়। ভিউ পয়েন্টের নাম গোলঘর। নৈসর্গিক প্রকৃতির নিস্তব্ধতার মাঝে হারিয়ে যেতে যেতে শ্যামসুন্দরের মুখে অতীতের কথা, জঙ্গলের কথা শুনছিলাম। ও বলছিল হায়না, শেয়াল, বুনো খরগোশ, বিভিন্ন ধরনের সাপ এমনকি অজগর ও নাকি দেখতে পাওয়া যায় এই চলতি পথে। যদিও আমাদের সে সৌভাগ্য হয়নি। আরো বলছিল--- শাল, মহুয়া, কেন্দু অন্যান্য গাছের সাথে শুধুমাত্র ঔষধি গাছই আছে ২৯৩ রকমের। পাহাড়ের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে চূড়ায় পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। পথ হল সাত কিলোমিটার। বন পথের পায়ে পায়ে, সবুজ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অতীতের হাতছানি আর রোমাঞ্চকর রহস্যের ছোঁয়া। একদম ওপর থেকে দেখা যায় পাঞ্চেত, নীচের সবুজ গ্রাম.... কয়েকটি ছবি তুলে নীচে নেমে এলাম, সেই কুকুরদুটিও আমাদের সাথে নেমে এল। ওদের আতিথেয়তায় মন ভরে গেল। 'ইকো গাইড সেন্টার' আছে পাহাড়ে ওঠার সাহায্য করার জন্য। বন দপ্তরের রিসর্টটিও খুব সুন্দর। একবার বর্ষায় আসার ইচ্ছে আছে।
অপরূপ প্রকৃতির সাথে অবহেলিত ইতিহাসের অপূর্ব মেলবন্ধনের নিদর্শন এই গড় পঞ্চকোট পাহাড়। এক কথায় অনবদ্য। পরের গন্তব্য অযোধ্যা হিল টপ...


পঞ্চকোট পাহাড় থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট  সেরে গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম পলাশ বাড়ির উদ্দেশ্যে, ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে নটা। গড় পঞ্চকোট থেকে অযোধ্যা হিলটপের দূরত্ব প্রায় ৯৫ কিলোমিটার। আমরা সিরকাবাদ হয়েই অযোধ্যা হিলটপ গিয়েছি। যেতে যেতে পথে দেখছিলাম প্রকৃতির নৈসর্গিক রূপ। পাহাড়ের সারি আর জঙ্গল তারই মাঝে পড়ছিল এক একটি আদিবাসী গ্রাম। দেখছিলাম কখনো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, কখনো পথের ধারে ফুটে রয়েছে পলাশ শিমুল, আরো কতো ফুল যার নাম জানি না, পার হয়ে চলেছি কতো পলাশের বন। কোথাও বা নেমেও পড়েছি সুন্দরকে ধরার চেষ্টায়। জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়েছি পাতার বিভিন্ন রঙ দেখে।অযোধ্যা পাহাড় সেজে গুজে যেন বসন্তের রানী হয়ে বসে আছে।
পুরুলিয়াতে অযোধ্যা পাহাড় ছোটো-নাগপুর মালভূমির অন্তর্গত ও পূর্ব-ঘাট পর্বতমালার সম্প্রসারিত অংশ। পাহাড়টিতে অনেক শৃঙ্গ আছে। সব থেকে উঁচুটির নাম গোরগাবুরু প্রায় ২৮০০ ফুট উঁচু। অযোধ্যা পাহাড়ের মাথাটি সমতল, যা হিলটপ বলে পরিচিত।

ছোটো বড় টিলা আর পাহাড়ি জঙ্গলে ঘেরা লাল মাটির রূপকথা হল পুরুলিয়া। প্রায় দুপুর একটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম পলাশ বাড়ি। পরের দিন ছিল পলাশ উৎসব। পুরুলিয়ায় উৎসবের  প্রথম দিন। এই উৎসবের অনেক রকমের আকর্ষণ পলাশ, আবিরের ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে ওঠা, প্রত্যেকেই অনুষ্ঠানে অংগ্রহণ করেন। পলাশ উৎসবের মঞ্চে সকলেরই আহ্বান থাকে, সবার সাথে মনের ভাব আদান প্রদান করার মিলনস্থল এই পলাশ উৎসব, ঘুরতে যাওয়া তো আছেই আর অন্যতম বড় আকর্ষন হলো ছৌ নৃত্য আর আদিবাসী নৃত্য।
ছৌ-এর মুখোশ, পোশাক তার সাথে ধামসা ঢোল, সানাই সব হৈ হৈ করে ভীষন এক উদ্দ্যমে শুরু হয় ছৌ নৃত্য নাট্য। তারপর মাদলের দ্রিম দ্রিম শব্দে শুরু হয় সাঁওতালি নৃত্য। সেই নাচের আবেশ ছড়িয়ে পড়ে মনে ও শরীরে। মাদলের তালে তালে দুলে ওঠে মন আর নিজেদের অজান্তেই ওদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে নেচে ওঠেন অনেকেই।
ছৌ নাচ অথবা  ছো নাচ এক প্রকারের ভারতীয় আদিবাসী নৃত্য। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড ও ওড়িশায় এই নাচ জনপ্রিয়। যদিও ছৌ নাচের আদি জায়গা হলো পুরুলিয়া জেলা। এটি এক ধরনের  মুখোশ নৃত্য, ভারতীয় দেবদেবী, দৈত্য, রাক্ষস, নর, বানর এই সব ধরনের মুখোশ তৈরী করে সেই মুখোশ পড়ে নাচ পরিবেশন করেন ছৌ নৃত্য শিল্পীরা। পুরুলিয়ায় চড়িদা গ্রাম বলে একটি গ্রাম আছে যেখানে এই সব মুখোশ তৈরী করা হয়। মুখোশ গ্রাম ও বলা হয়। আমি অনেক বারই দেখেছি। বেশ লাগে দেখতে। সেই যাত্রা পালার মতন খানিকটা। কাহিনী অনুসারে  পালা শুরু হবার আগেই ধামসা বেজে ওঠে গুমগুম শব্দে তার সাথে সানাই ঢোলের মধ্যে কাহিনী অনুসারে সুর বাজে আর সেই সুর অনুসরণ করেই হাতে অস্ত্র নিয়ে মুখোশ পরে চরিত্রগুলি এক এক করে আসরে প্রবেশ করে। খোলা আকাশের নীচে গোল হয়ে নাচের আসর জমে ওঠে। বসন্তের হাওয়ায় আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যায় এক অন্য স্বাদের নাচ-গান-বাজনার সম্মিলিত সুরের মূর্ছনা। শুধুমাত্র মুখোশই নয় শারীরিক কসরত ও ছৌ নাচের এক অন্যতম অঙ্গ। মোটামুটি চৈত্র মাসের শেষ দিন থেকে বর্ষা না আসা অবধি চলতে থাকে এই নাচের অনুষ্ঠান। এই নাচের পোশাক হলো মাল কোঁচা দিয়ে ধুতি যার অন্য নাম 'ঘুটনা'। এই নাচ পরিবেশনের আগে  'গনেশ বন্দনা' করা হয়। কাহিনী, মুখোশ, নাচের উদ্দামতা, সরলতা সব মিলিয়ে এক উচ্চাঙ্গের নৃত্যনাট্যের মর্যাদা লাভ করেছে এই নৃত্য। বিশ্বের দরবারে ছৌ নাচ এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে।
এই নাচের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় বলিষ্ঠ লোকজীবনের কথা, এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে যুদ্ধ, শিকার আর আদিম মানুষের ভালোবাসার বিশ্বাস। প্রতিটি ছৌ নাচের অন্তিম পর্ব হয় যুদ্ধের চরম উত্তেজনার মধ্য দিয়ে।
আদিবাসী ও উপজাতি শিল্পীরা বহু কষ্টের মাঝেও এই লোকনৃত্যকে সযত্নে লালন করে চলেছেন। আজ এই ছৌ নাচের চাহিদা ও যেমন প্রচুর তেমনই  জনপ্রিয়। এবারে পলাশ উৎসবে ছৌ নাচের বিষয় ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের জনক বিরসা মুন্ডার জীবন কাহিনী।

পরের দিনটি ছিল রঙিন প্রকৃতির সাথে রং মেলানোর দিন। বসন্তযাপন-হোলি-দোল উৎসব।
প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার এক অনবদ্য ঠিকানা হল পুরুলিয়া। শীতের শেষে ঝরা পাতা বিদায়ের পরে পরেই গাছে গাছে সবুজ কচি পাতার আগমন, বাহারি রঙিন সব ফুলের সমাহার, দখিন হাওয়ায় কোকিলের কুহু ডাক সব মিলেমিশে এক দারুন উছ্বাস... বসন্ত এসে গেছে। আমিও ছুট লাগাই পুরুলিয়া, প্রকৃতির এই আহ্বানে, উচ্ছ্বাসে সাড়া দিতে। পুরুলিয়ায় বসন্তযাপন করতে। অশোক, শিমুল পলাশের লাল ছুঁয়ে থাকে দিগন্তের নীলকে, লালমাটির মেঠো পথ সুদূরে যায় এঁকে বেঁকে আর মন হারাতে হারাতে হারিয়ে যায় কখনও রবি ঠাকুরের গানে…
"আজি দখিন-দুয়ার খোলা,
এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো"....
আবার শাল-পিয়াল-আকাশমনি-মহুয়ার ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে মন গেয়ে ওঠে "পিন্দারে পলাশের বোন পলাবো পলাবো মন"

কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আরো কত অজানা অচেনা ফুলের মেলা রঙের মেলা চারপাশে, এমন রঙ-মিলান্তির খেলা প্রকৃতির ক্যানভাসেই হয়। সেই ফুলে ফুলে ভ্রমরের গুঞ্জন, পাখীর ডাক ভাবলেই ভালোলাগে। আট থেকে আশি সবাই পলাশ উৎসবে মেতে ওঠেন বসন্তের ডাকে, সকাল বেলায় প্রভাতফেরির আয়োজন করা হয়। সবাই সকাল বেলায় বাসন্তী সাজে সেজে অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। পলাশের আহ্বানে সবাই চলে পলাশ বনে.... বন জুড়ে চলে বর্ণ মিছিল.... শুধুমাত্র আবীরের রঙে রেঙেই ওঠেন না...মেতে ওঠেন নাচে-গানে-বাজনায়-হাসিতে হাসিতে খুশীর বান ডেকে যায়... আকাশ ভরে যায় রঙে  রঙে-সুরে সুরে-তালে ও ছন্দে-আনন্দে।রঙিন প্রকৃতির সাথে নিজেরাও সব মেতে উঠেছেন, রঙিন হয়ে মনে মেলেছে পাখনা ঐ নীল দিগন্তে।

এবারে পুরুলিয়া বেড়ানোর সেরা ঘটনাটি বলে লেখা শেষ করবো। 
 প্রকৃতির সাথে রঙ মিলিয়ে সকাল বেলার প্রভাত ফেরিতে এতো আনন্দ করেছি যে মন একদম কানায় কানায় ভরে গেছে। দুপুরের খাবার খাওয়ার পরে আশেপাশে কিছু দেখার জায়গা দেখানোর প্রোগ্রাম ছিল, আমি যেহেতু অনেকবার গিয়েছি তাই দুপুরের খাবার খেয়ে ভাত ঘুমই বেশী পছন্দ হলো, তাই ঘরে এসে ঘুম লাগলাম।

এখানে একটু বলে রাখি, পুরুলিয়া একবার ঘুরে সব দেখা সম্ভব নয়। অযোধ্যায় দেখার জায়গা আপার ড্যাম, লোয়ার ড্যাম, মার্বেল লেক, চড়িদা গ্রাম যেখানে ছৌ নৃত্যের মুখোশ তৈরি হয়, মুখোশ গ্রাম নামেও পরিচিত, আর আছে দুটি ঝর্ণা, বামনি  ফলস আর তুরগা ফলস, পাখি পাহাড় অথবা ময়ূর পাহাড় থেকে ভিউ পয়েন্ট। তারপর ইচ্ছে হলে চলে যেতে পারেন খয়রাবেরা ড্যাম, সূর্যাস্তের সময় দারুন লাগে, এছাড়া চলতি পথের সৌন্দর্য্য তো আছেই, আছে মুরুগুমা লেক, বরন্তি লেক। বর্ষার সময় ও পুরুলিয়ার মনোরম সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। প্রকৃতি বিভিন্ন ঋতুতে অনন্য সব রূপে সেজে ওঠে। আর পলাশ উৎসবের সময় এলে এনাদের সাথে কন্টাক্ট করতে পারেন আমি ফোন নাম্বার শেষে দিয়ে দেবো।এনাদের সব প্যাকেজ থাকে।

সন্ধ্যে বেলায় আদিবাসী নৃত্যের অনুষ্ঠান ছিল তাই দেখবো এই ছিল মনে। কিন্তু যেই সূর্য্য দেব পশ্চিমে হেলে পড়েছেন, আমি কি আর ঘরে থাকি! ভাবলাম কাছেই অযোধ্যা হিল টপে গিয়ে কয়েকটা সূর্যাস্তের ছবি তুলে আনি। দুজনে গাড়ি আর ক্যামেরা নিয়ে বেরোলাম। খানিক গিয়েই দেখি একটা সাইনবোর্ড রয়েছে কোন দিকে কোন জায়গা কতটা দূরত্বে তার দিক নির্দেশ দেওয়া আছে। আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে মুরুগুমা লেক মাত্র ১৪ কিলোমিটার। আমার হাজব্যান্ড বললেন “কল্পনা যাবে…” , আমি তো মনে মনে খুশী, মুখে বললাম “সাঁওতালি নৃত্যের ছবি তুলবো কিন্তু, তার আগে ফেরত আসতে হবে”। চলল গাড়ি, কিছুদূর গিয়ে ওখানকার বাসিন্দা তাকে জিজ্ঞেস করতেই পথ বলে দিলেন, গুগল মাতার কথা না শুনে সেই নির্দেশেই চলতে থাকলাম। সুন্দর ঝকঝকে পাহাড়ি রাস্তা দুপাশে জঙ্গল, বিকেলের পড়ন্ত আলোয় দারুন সুন্দর লাগছিল।আমরাও প্রকৃতির মোহে মোহগ্রস্ত হয়ে ছুটে চলেছি, কিছুটা যাওয়ার পর আমি বলছি মনে হয় পথ ভুল করেছি আমরা। ঠিকই তাই একটা জায়গায় গিয়ে আর পথ নেই আবার গাড়ি ব্যাক করে কোন রাস্তা ধরবো বুঝতে পারছিনা যখন তখনই দেখি একটি আদিবাসী বউ দুটি বাচ্চা নিয়ে হেঁটে আসছে, সে তো আমাদের দেখে ভয়ও পাচ্ছে, তাকে আমরা লেক যাবার পথ জানতে চাইলাম, সে বললো অনেকদূর এখান থেকে। যেতে যেতে অনেকের কাছে জানতে জানতে পথ চলতে লাগলাম। কয়েক জায়গায় রাস্তাও বেশ খারাপ। বেগুন কোদর হয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখি রাস্তায় চলা দায়, হাট বসেছে, গাড়ি যাওয়ার জায়গা নেই, সে তো এক ভীষন অবস্থা--- মোটেও গাড়ি চলে না, এদিকে সাইকেল আগে যাবে নাকি বাইক আগে যাবে, না গাড়ি আগে ! ভীষন রকম জট পাকিয়ে বিচ্ছিরি এক অবস্থা। গাড়ি আর নড়ে না। ভগবানকে ডাকা ছাড়া অন্য উপায় দেখি না, এদিকে সূর্য্য দেব তো গেলেন পাটে, তাকিয়ে দেখি একটা পুরনো কৃষ্ণমন্দির তার ভিতর বাইরে সব পসরা নিয়ে বসেছে, নানারকম জিনিষ, হাটে যেমনটি হয়, ছবির আশা তো নেই তাই মন দিয়ে লোকজনের হৈ চৈ, কেনা বেচা এইসব দেখছিলাম।অবশেষে যখন সেখান থেকে গাড়ি গিয়ে পড়লো ঠিক রাস্তায় তখন অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়ে গেছে।

গাড়ির আলোই একমাত্র আলো। একটি গ্রামের রাস্তায় এসে জনা কয়েক মানুষকে দেখে অযোধ্যা হিল টপ যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করায় তারা পথনির্দেশ দিয়ে দিলেন। এবার ফেরার পালা , লেক তখন মাথায়! পলাশবাড়ী পৌঁছতে পারলে হয়। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তা। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর প্রায় তিনশ ফুটের চড়াই অন্ধকারে বোঝা তো যাচ্ছে না, সে পেরোতে গিয়ে ভীষন বিপদ, গাড়ি বিকট আওয়াজ করে ওপরে না গিয়ে নীচে নেমে আসছে, আমি বলছি আর নামলে গাড়ি কিন্তু জঙ্গলের খাদে পড়ে যাবে, কিন্তু গাড়ি কি শুনছে, সে তো ঢালে নামছে আপনি আপনি, তখন কোনো মতে ব্রেক চেপে আমি গাড়ী থেকে নেমে একটা পাথর দিলাম চাকায় ততখনে একটা চাকা তো ঢুকে গেছে। ওকে বললাম বিপ্লবকে ফোন করতে, কেউ তো জানে না আমরা যে বেড়িয়েছি। তখনই দেখি দুটো বাইক আসছে আমি প্রাণপন হাত দেখিয়ে তাদের থামালাম। এক একটা বাইকে দুজন করেছিলেন, অন্ধকারে তো কাউকেই দেখা যাচ্ছে না, অন্য দিক থেকে দেখি একটা গাড়ি আসছে তাকেও থামালাম। আমার ইচ্ছে নয় আমার হাজব্যান্ড গাড়িটা ওপরে তুলুক, অনুরোধ করতেই সেই গাড়ির ড্রাইভার আমাদের গাড়িতে বসলেন আর বাকিরা ধাক্কা দিয়ে গাড়ি সেভ জায়গায় নিয়ে গেলেন আর কিছু নির্দেশও দিয়ে দিলেন, আর এও বললেন গাড়িটা পাল্টি খেতে খেতে বেচে গেছে। যতই হোক ওনারা লোকাল ওই রাস্তায়, সব সময় আসা যাওয়া করেন।সবাই নিজের নিজের গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। আমি একটাই কথা শুধু বললাম, ভগবান তো চোখে দেখিনি তবে আজ আপনাদেরকেই তাঁর দূত মনে হচ্ছে। ওই  পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে কেমন করে উদ্ধার হতাম জানা নেই। বিপ্লব জানতে চাইছিলেন কোথায় হয়েছে ঘটনাটা আমরা তাঁদের জিগ্যেস করাতে বললেন এটা সুইসাইড পয়েন্ট। উচুঁ পাহাড় থেকে নাকি লোকে এখানেই সুইসাইড করে তাই এই নাম। ওই অবস্থায় কেমন মনে হচ্ছিল ভাবুন একবার! বিপ্লব বলেছিল লোক পাঠাচ্ছি কিন্তু আর্মির লোক সাহসের অভাব নেই তাই তাঁকে না করে দেওয়া হলো, আসলে একটা অনুষ্ঠান পর্ব চলছে সেটাও ভাবছিলাম আমরা, যাই হোক আবার গাড়ি চলতে শুরু করলো, দুই পাশে শুধু ঘন জঙ্গল আর মাঝে রাস্তা, ঝিম অন্ধকার গাড়ির হেডলাইটের আলোয়  যতটা দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ দেখি কিছু দূরে দুটো সাইকেল চালিয়ে দুজন যাচ্ছে,আমি বললাম দেখো দুজন সাইকেল আরোহী, ও বলল হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। পরিষ্কার গাড়ির আলোয় দেখা যাচ্ছে, মাথায় পাগড়ি দেওয়া, গায়ে একজনের গোলাপী রঙের ফতুয়া আর ধুতি। গাড়ি খুব কম হলেও ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার বেগে তো চলছিল কিন্তু সাইকেল গুলো ঠিক প্রথমে যে দূরত্বে ছিল সেটাই কনটিনিউ করছিল, ঠিক গাড়ির লাইট যতটা দুর অবধি ছিল ওরাও ওই দূরত্ব মেনটেইন করছিল, এটাই একটু অবাক লাগছিল, নির্জন পথে কোথা থেকে এল আবার কিছুক্ষন পরে আর দেখাও গেল না কোথায় যে চলে গেল! দুই পাশে তো ঘন জঙ্গল আর আমাদের সামনে সামনেই চলছিল। যাই হোক অনেকটা পরে জঙ্গলের রাস্তা শেষ করে গ্রামের রাস্তায় এলাম সেখানে গ্রামের একজনকে ডেকে  ঘটনাটি বলতেই উনি বললেন ওদের মাঝে মাঝে দেখা যায়।অনেকদিন  আগে ওই গ্রামেরই দুজন লোক সাইকেল করে ফিরছিল সন্ধ্যে বেলা, মাওবাদীরা নাকি জঙ্গলে ওদের খুন করে। সেদিন পথ হারিয়ে পথ খুঁজে অনেক রাতে পলাশ বাড়ি ফিরেছিলাম। তখন সাঁওতালি নৃত্য অনুষ্ঠান প্রায় শেষ। তখন কিছু মনে হয়নি পরে মনে হয়েছিল দুজনেই এতোটা ভুল তো দেখতে পারি না অদ্ভুত  লাগে ভাবলেই। আমরা কিন্তু কেউ ভয় পাইনি। সত্যি বলতে কি আমি তো বলছিলাম তাঁর কৃপায় আজ আমরা উদ্ধার পেয়েছি। বিপ্লব বলছিল রাতের বেলা ওই রাস্তায় হাতির দল বেরোয় তাই সূর্য্য ডোবার পর কেউ ওদিকে যায় না। আমরাও এতোটা রাস্তায় একটি লোকও দেখিনি ওই দুজন সাইকেল আরোহী ছাড়া। হাতির দল অবশ্য দর্শন হয়নি। তবে যা হয়েছে তা লৌকিক... না অলৌকিক... নাকি ভৌতিক সে বিচারের ভার আপনাদের ওপরেই রইল। জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা যুক্তি তর্ক ব্যাখ্যার বাইরে... তবে আমরা দুজনের কেউই কিন্তু ঘাবড়ে যাইনি বা ভয় ও পাইনি। কিন্তু ভীষন রকম একটা দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরেছি এটা সত্যি। বহুবার গেছি পুরুলিয়ায় এমন ঘটনা এবারই ঘটলো। এখনো ভাবি নিজের চোখে দেখা তবু যেন বিশ্বাস করতে পারি না!


থাকার জায়গা: 
১) গড়পঞ্চকোট : গড়পঞ্চকোট প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র, 
গ্রাম: বাঘমারা, পি.ও: রামপুর, পি.এস : নেটুরিয়া, ডিস্ট্রিক্ট: পুরুলিয়া ।
Website for booking : bookings@wbfdc.c

২) অযোধ্যা হিল টপ: পলাশ বাড়ি ( A nature's crib ) ,
পারকিহদিঃ, তেনিয়াসি,
পুরুলিয়া।
Website for booking : polashbarinatures@gmail.com
যোগাযোগ করতে পারেন : 86971 68160 
Biplab Sar (East India Travellers Club)

(শব্দ সংখ্যা: ২৮৩২)







পালানোর পাঁচকথা: হর-কি-দুন, পর্ব : ক

 মা ন বে ন্দ্র না থ দ ত্ত

 স্যাক পিঠে হাঁটতে হাঁটতে বাস স্ট্যান্ড। যদি কিছু মেলে। যতটুকু এগোনো যায়। না, নেই কিছু। তা ছাড়া ওদিকের সব স্টেশনের কাছ থেকেই ছাড়ে। অটো ধরে তড়িঘড়ি ফেরত এসে স্ট্যান্ডে। এত দেরিতে আমাদের বইবার জন্য কেউ অপেক্ষা করে থাকার কথা নয়। ছ'টা দশের উপাসনা সাড়ে আটটায় না পৌঁছলে কোনও একটায় সওয়ার হয়ে এগিয়ে কোথাও রাত কাটানো যেত।
  এক বাস-ভাই 'কই প্রবলেম নেই' বলে-টলে তিনটে টিকিট ধরিয়ে দিলেন। কাল সুবে ছ'বাজে বাস। ইধার কোনও হোটেলে রাত বিতিয়ে চলে এসো।
  -----আরে ছ'টায় বাস হলে কত ভোরে উঠতে হবে! পারব কি? বিশেষ লম্বা ট্রেন সফর শেষে বিছানা পেলে নিদটাও তো থোড়া লম্বা হয়ে যাবে। টিকিট কেনা হল। পৌঁছতে না পারলে!
  ফের 'কই প্রবলেম নেই' শুনিয়ে মোবাইল নাম্বার নিয়ে কইলেন, ফোন করে ডেকে নেবেন। বেশ।
  কাছেই হোটেল নিতে হল। ট্রেন লেট-এর কারণে এই ঝক্কিটা সয়ে গেছে। যাক গে, মাঝরাত্তিরে তো নামায়নি! ভারতীয় রেলকে এ বাবদ বহুৎ সুক্রিয়া জানিয়ে রোটি-সবজির খোঁজে বেরোনো গেল।


  ঠিক সময়ে হাজির হয়ে বাসে সিট নেওয়ার পর একটা ফোন। রিসিভ করতে দেখি, তিনহাত তফাতেও একজন মোবাইলে কথা বলছেন। তাকাতাকি হতে পানসিক্ত ঠোঁটে হাসলেন, 'ও, আ গয়া?' এবার জানা গেল, বাস সোজা সাঁকরি যাবে না। পুরোলা গিয়ে গাড়ি পালটাতে হবে।
  পাহাড়ি উঁচাই পথ ধরতেই মন খুশ। তা হলে যাচ্ছি দেহরাদুন থেকে হর-কি-দুন। মসুরী পেরোতে জানলায় ভাসল কেম্পটি ফলস। সে ধীরে ধীরে শহুরে হয়ে উঠছে।
  এগারোটা নাগাদ বার্নিগাড। নওগাঁও থেকে রাস্তা দু'ভাগ। বারকোট ছুঁয়ে একটা গেছে সাতান্ন কিমি দূরে যমুনোত্রী। গাড়ি বাঁক নিল আঠারো কিমি বাদে পুরোলা অভিমুখে অন্যটায়।
  মুহুর্মুহু দৃশ্যপট ভিন্ন হচ্ছে সাপালো পথে। এপাশ-ওপাশ না-চেনা মার্গদর্শন হলেই মনে হয়, বেশ অফুরান সময় থাকবে হাতে। স্যাকে চিঁড়েমুড়ি সহ বেরিয়ে নতুন পথ যা দেখব, সেখানেই পৌঁছে যাব। "পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!"
  ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখব। দেখব চোখ দিয়ে, মন দিয়ে, সর্বাঙ্গ দিয়ে। এমন বসুন্ধরার সবখানে মিশে থাক আমার শ্বাস-প্রশ্বাস, আমার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্তিত্ব সংস্রব পাক অনিঃশেষ অস্তিত্বের।
  একটা ম্যাপ রাখব। লোকাল বাস, শেয়ার জিপে উঠব নামব আর খালি হাঁটব। এবং "শয়নং হট্টমন্দিরে, ভোজনং যত্রতত্র।" যা মিলবে তা-ই সই। হ্যাঁ, স্থানীয়দের সঙ্গে অবশ্যই থাকতে হবে তুমুল বাতচিত।
  বেমক্কা ব্রেক কষায় ঝটকা লেগে স্বপ্নঘোর কেটে গেল। পুরোলা কাছিয়েছে।

  নেমেই আর এক বাসে 'সাঁকরি যাব' বলে উঠে পড়া গেল। এও দেখি সোজাপথের নয়। পঁয়ত্রিশ কিমি পর মোরি নামিয়ে দেবে। দিলও তাই।
  মোরি মোড় থেকে এগিয়ে পুল পেরিয়ে পুলিশবাবুকে পুছে ঠিকঠাক খাড়িয়ে বাস মিলল অবশেষে। যত এগোয় তত যেন অনাঘ্রাত প্রকৃতির নিজস্ব সাম্রাজ্য স্পষ্ট হচ্ছে। কী সবুজ সবুজ পাহাড়! কী নিরিবিলি গ্রাম! আমরা গোবিন্দ পশুবিহার এলাকায় ঢুকে পড়লাম নৈটওয়ারে।
  গাছগাছালি আর নীলচে পাহাড়ের জগতে আনন্দ জমজমাট হচ্ছে ভিতরে। বিকেল চারটেয় ৬৪৫৫ ফুটের সাঁকরিতে পা রেখে মনে হল, হর-কি-দুন এসে গেছি। গায়ে ঠান্ডা ভালই জিভ বোলাচ্ছে।
  সুমুখেই গোছানো হোটেল স্বর্গারোহিণী। লটবহর রেখে বাইরে পায়চারি করতে ইচ্ছে করল। সারাদিনে তিন গাড়ি চড়ে শরীরে গজানো দুলুনি ছাড়াতে গুটি গুটি এগিয়ে যাই তালুকার রাস্তা ধরে। নীচে এক নদী অনেক জল বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তমসা। খোকাবেলায় বইয়ে-পড়া, গল্পে-শোনা নদী তমসা। এরকম অভিজ্ঞতায় চমৎকার গা-চমকানো থাকে। ভারী উপভোগ্য বটে!
  একবার গোমতীকে দেখে তার জল ছুঁতে ছুটে গিয়ে থমকেছিলাম। প্রকাণ্ড সব মাছ ড্যাবডেবিয়ে চেয়ে হাতের কাছেই। মহাশের না মহাশোল নাম যেন। এটা অবশ্যি বৈজনাথের কথা।
  গগনস্পর্শী মহীরুহ দু'পাশে। উপর থেকে ধাপে ধাপে নামতে নামতে নদীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার ওপারে অমনই ঢালু ধরে উঠতে উঠতে কোন উঁচুতে উঠে বৃক্ষরাজ নিজের মহিমা অ্যানাউন্স করছে।
  খাবারের দোকানে চায়ের সঙ্গে গল্পে গল্পে জেনে নেওয়া গেল হর-কি-দুনের সুলুক-সন্ধান। তিনজনের আয়োজনে ট্রেক বলে যতটা আগাম জানা যায় ততটাই কাজের। খোঁজ মিলল এখান থেকে অন্য ট্রেকরুট কেদারকণ্ঠের। এক গাইড দাদা তো পরদিনই তাঁর তাঁবুটাবু সহ নিয়ে যেতে চাইলেন। বললাম, আমাদের লক্ষ্য পূরণের পর শরীর-পকেটের দম থাকলে ফিরতি পথে যাব। যদিও কেদারকণ্ঠ শীতকালে একঘর। তুষারবিলাসের তরে তখন রমরমে রমণীয়। এখন গেলে দু'দিনেই সারা যাবে। দেখা যাক, হরির উপত্যকা কেমন হয়! আগে তো আগেরটা সারি।
  পরসকালে সাড়ে আটটায় শেয়ারজিপে আসন নেওয়া গেল। ছাড়বে কখন? ড্রাইভার ভাইটি বহুবার সকলের দ্বারা প্রশ্নিত হয়ে জবাব দিয়েছেন, 'আভি ছোড়েগি'। হাসিমুখেই। রসিক বড় সে নওজোয়ান। জিপের পিছনে লিখে রেখেছেন, 'হাস মত পাগলি, পেয়ার হো যায়েগি'। এমন লোকের উপর বিরক্ত হওয়া যায় নাকি!
  ঠাসাঠাসি একজিপ হতে ঠিক সাড়ে দশটায় চাকা ঘুরল। দোষ নেই কারও। একটিই সওয়ারি সারাদিনে। না ভরলে পোষাবে না। পেয়েছি, এই ঢের! নইলে তালুকা হাঁটতে হত। যেমনটি আগে ছিল। একস্ট্রা বারো কিমি।
  তবে বোরড হতে হয়নি। উঠে নেমে আর সহযাত্রীদের কাছে গল্প শুনে বেশ কেটেছে।

  স্থানীয় মহেশ্বর সিং বর্ষিয়ান গাইড। আশপাশের তো আছেই, তা বাদে হিমালয়ের এককাঁড়ি ট্রেকরুটের ছবি তাঁর হাতের পাঞ্জায়। দুর্গম কত জায়গার গা-শিরশিরানো কাহিনি-অণুকাহিনি যে তিনি বললেন!
  হর-কি-দুনের অন্য এক আকর্ষণ ছিল মাথায়। দুর্যোধন মন্দির। ভারতের একমাত্র (?) দুর্যোধন মন্দিরটি ওসলা গ্রামে নাকি, যেখানে আমাদের যেতেই হবে। আপত্তি করলেন তিনি। না, ওটা সোমেশ্বর মন্দির।
  সে কী! সমস্ত বাংলা লেখায় পড়েছি যে! জোরের সঙ্গে বললেন, ঠিক না। শুধু তাই নয়, গাড়িতে ঠাসাঠাসি বসা একজন মাঝবয়সিকে দেখিয়ে দিলেন। তিনি প্রাচীন সোমেশ্বর মহাদেব মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। মৃদু হেসে সম্মতি দিলেন গাইডজির বক্তব্যে।
  আর বাড়তি কথা নিষ্প্রয়োজন। তবে আরটু জানার আগ্রাসী ইচ্ছে তখনকার মতো মুলতবি রাখতে বাধ্য হলাম। ব্যাগ-ব্যাগেজ, শীতপোশাক এবং তার মধ্যে জায়গা-নেওয়া দেহটা উথালপাথাল ঝাঁকুনিতে নাজেহাল। মাঝে মাঝে পাথর আছড়ে পড়ে বা ঝরনার বেপরোয়া অবতরণ পথকে তার নাম ভুলিয়ে ছেড়েছে।
  উঃ! গাড়ির দম আছে বলতে হবে। বাড়তি লোড নিয়ে নানা ভঙ্গে নেচে নেচে ঠিক পেরিয়ে যাচ্ছে। চলমান সৌন্দর্য গুরুত্ব পাচ্ছে না মনে। কখন পৌঁছব, সেটাই আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
  তালুকা পর্যন্ত জিপেব্ ল রোড। পঁয়তাল্লিশ মিনিটে বারো কিমি উঠে নাস্তা-চা'য় শক্তিমান হয়ে পা রাখলাম টন্ স ভ্যালিতে।
  শুরুতে নেমে রামদানা খেতের পাশে পাশে চলা। বাঁ হাতে "নদী আপন বেগে পাগল পারা"। সুপিন নাম। আরজনের নাম রুপিন। দু'জনে আলাদা জায়গা থেকে স্টার্ট করে মিলেছেন নৈটওয়ারের কাছে। তারপর পাকা নাম তমসা। যদিও এখানে তমসা নাম চলছে।
  ডানপাশের রোমাঞ্চকর অরণ্য। উল্টোদিকে নদীর পরপারে খাড়া পাহাড় ধরে ছড়িয়ে আছে এমনই অরণ্য। নির্বাক অরণ্য কত কথা বলে তার অনন্য ভাষায়! আমন্ত্রণলিপি তার হাতে। অভ্যাগতকে অভ্যর্থনার জন্য উদ্গ্রীব।
  এহেন নিটোল প্রকৃতির আশ্রয়ে তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার অন্তরালে কিছু মানুষ বসতি গড়েছে কোন প্রাচীনকালে। কেউ বলে ছ'হাজার, কেউ বলে পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো। এখনও প্রায় সবই আদিম আরণ্যক এখানে। সহজ সরল সুন্দর মানুষজনের একজনা বিশ্রাম নিচ্ছেন দেখে দাঁড়ালাম, হাসলাম। আসছেন ডাটমির গাঁও থেকে পায়ে দলে উপলসরণি। তপন কাজু-কিসমিস বিলি করতে উনি দিলেন আপেল। টুকটাক কথায় আমাদের দিক থেকে যেটা থাকবেই, 'আর কতদূর' শুনে ঘাড় নাড়লেন, 'ধীর সে চলা যাও'।
  শুরুতে প্রায় সমতল ভেঙে এবার চড়াই। হালকা চড়াই। দুরধিগম্য জঙ্গল। পাথরনুড়ির অগোছালো সংকীর্ণ রাস্তায় কেবলই হেঁটে এগোনো। না-চেনা গাছ, না-জানা ফুল হামেশা নজরে পড়ছে। কিছু থাকছে ক্যামেরায়। বেশিটা মনঝাঁপিতে। নদীর কলতান গভীর থেকে স্পষ্ট। ভেজা-ভেজা পচা-কাঁচা পাতায় পা ফেলতে ফেলতে গুণে যাচ্ছি এক দুই তিন.....।
   প্রমিস থাকে পঞ্চাশের আগে দাঁড়াব না দম নিতে। সামান্য উতরাই পেলে একশো। এতে একটা ঘোরে খানিকটা এগিয়ে যাই। যদিও অন্যদৃশ্য প্রায়শ সংখ্যা গুলিয়ে দেয়। হাঁ-করা হাবা হয়ে দেখি নতুনকে। টাল খেতে হবেই এক-আধবার। পার্শ্ববিস্মৃত যে!

  কোথাও গাছ মাটির কাছে হেলে রোড ব্লক করেছে।কোথাও অ্যায়সা মোটা শেকড়ে পা ফেলে একটু হড়কে যাওয়া। তিরতিরে জলধারা রাস্তা টপকে নামছে তমসায়। এত জল কোথা থেকে আসে কে জানে! খেয়াল হল, বোতল শূন্যপ্রায়। ট্রেকিং-এ খুব জল খেতে হয়। গলা শুকিয়ে আসে খালি। লজেন্স কাজে দেয়। তবু জল চাই।
  সমস্যা নেই। উপর থেকে গড়ানো জল ধরে চৌবাচ্চার কল দিয়ে নেমে যাচ্ছে যেখানে, সেখানেই বোতল ভরা হল। সুব্যবস্থা।
  লালটু ঝুঁকে মাটি থেকে কুড়িয়ে নিল একটা শজারুর কাঁটা। তার মানে এনারাও আছেন। দেখাদেখির মধ্যেই নিঃশব্দে গাছ বদল করল এক পাখি। ফিঙে বুঝি। না তো, লেজটা অন্য রকম। দু'পাশে দুটি লম্বা আলাদা ডাঁটার শেষে তুলির মতো কালো পালক তার অনন্যতা জোরালো করেছে। রেকেট (র'য় য ফলা আ-কার দেওয়া গেল না) টেইল্ ড ড্রংগো। বাংলায় ভীমরাজ। হিন্দিতে ভৃঙ্গরাজ। মনটা অপ্রত্যাশিত খুশ পেল। পক্ষিবিদ্ অজয় হোমের আক্ষেপ ছিল, তিনি বহু ঘুরেও প্রাকৃতিক পরিবেশে এনাকে দেখেননি। ভীমরাজের কূজন কর্কশ ধাতব। কিন্তু অমন গলায় নাকি সব পাখিদের স্বর হুবহু ছাড়তে পারে।
  ব্যাকগ্রাউন্ড অনুকূল না হওয়ায় স্বল্পক্ষম ক্যামেরায় ছবি রাখা যায়নি।
  গাছগাছালি ভেদ করে তেরছা রোদ্দুর মাঝেমধ্যে পথে লুটোচ্ছে। বেলা গেল-গেল। পা চালাও ইয়ার। প্রথম দিন বলে কি পরেশান লাগছে একটু?
  নদী বড় পাথরে ঠোক্কর খেয়ে ঝরনার মতো তেড়েফুঁড়ে ফেনা ছড়িয়ে নামছে কোথাও। কোথাও এক খাঁজে উপলবেষ্টনে শান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে এক দণ্ড। সেখানে জলতলের নুড়ি গুণে নেওয়া যাচ্ছে, এমন স্বচ্ছ। তা এ-সব দেখতে একটু সময় যাবেই। চুপি চুপি ফাঁকতালে এক ঝলক রেস্ট।


  ওই দেখা যায় কাদের বাড়ি। গঙ্গাড় গ্রামে এলাম বুঝি! আসছেন এক গ্রামবাসিনী। বললাম, গঙ্গাড়?
  ----জি।
  ----রহনে কা জগাহ ইধার....
  ----ইয়েস বস্।
  তপন বলল, হোটেল লজ।
  আবারও হাসন্ত জবাব, ইয়েস বস।
  উরেব্বাস, তন্বী বেশ স্মার্ট দেখছি!
  এগিয়ে সামান্য উঠে খানিক নেমেই দেখি জলজ্যান্ত লজটা একেবারে নাগালে। সরু রাস্তার উপর প্রবেশপথে তোরণে লেখা বড় করে, 'ইয়েস বস'।
*******
  ছবি: সাঁকরিতে অস্তরাগ ও উচ্ছল তমসা।
  সেপ্টেম্বর, ২০১৭।






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪