স্মৃতিকথা

হ্যারিকেনের সাতকাহন

ন ন্দি তা সো ম

আমি উত্তর কলকাতার মেয়ে। আমাদের পাড়ায় যখন লোডশেডিং চালু হলো--- তখন মা, বাবার মুখে হ্যারিকেন নিয়ে কতো গল্প। একটা হারিকেন ঘিরে ৭/৮ জন মিলে পড়াশুনো করতেন। রাত্রে সেভাবেই খাওয়া ইত্যাদি নানারকমের গল্প। তারপরেই মা, বাবার মন্তব্য--- এই প্রজন্ম এইসব অসুবিধেতো বুঝতেই পারলো না। গল্প ভালো ছিলো--- কিন্তু মন্তব্য খোঁচা দিতো।

যাইহোক, লোডশেডিংয়ের খবর কাগজে পড়ে বাবা নিয়ে এলেন নতুন হ্যারিকেন। আমি নতুন অতিথিকে সাদরে বরণ করলাম। খুব উৎসাহ আমার নতুন কলকব্জার কার্য্যক্রম শেখার। প্রতি বৃহস্পতিবার মায়ের পুজোর সময়েই আলোদিদি চলে যেতেন। মা পুজোয় বসার আগেই হ্যারিকেন জ্বালিয়ে, শিখা কম করে পুজোয় বসতেন। আমার কাজ ছিলো আলো চলে গেলে--- শিখা বাড়িয়ে দেওয়ার। খুব ইচ্ছে হ্যারিকেন পরিষ্কার করা, ধরানো শেখার। বাবা ধৈর্য্য ধরে শেখালেন। খুব মজা! পরের বৃহস্পতিবার মাকে বললাম--- তুমি পুজোয় বসে পরো। আমি জ্বালিয়ে দেবো। মা একটু অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমায় দেখে পুজো শুরু করলেন। আমি সুযোগ পেয়ে প্রথমে পরিষ্কার হ্যারিকেনকে আবার পরিষ্কার করা শুরু করলাম। দুর্ভোগ কাকে বলে--- যেই ওপরের ছোটো হ্যান্ডেল ধরে চিমনী বার করতে গেলাম--- হাত ফসকে চিমনি পড়ে চুরচুর আর চিমনী বাঁচাতে গিয়ে হাত রক্তাক্ত।

'অকর্মার ধাড়ি'--- এই কথাটি পাকাপোক্ত হয়ে গেলো আমার জীবনে।
  
সেই হ্যারিকেন জ্বালাবার পদ্ধতি কী করে শিখলাম এবার সেটা বলি। মে মাসে বিয়ে হয়েছিলো আর নভেম্বরে শ্বশুর শাশুড়ির সাথে উত্তরপ্রদেশে আলিগড়ে গিয়েছিলাম। আমার সেজো ভাসুর ওখানে গোণ্ডা বলে একটি জায়গার কানাড়া ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন। বিকেল হলেই বিদ্যুৎ চলে যেতো। আর সময় বুঝে আমি আমার জায়ের  সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তাম। একদিন জা ভাসুর  বেরিয়ে ছিলেন। শ্বশুরমশাই সান্ধ্যভ্রমণে গেছেন। শাশুড়ি রান্নাঘরে ব্যস্ত। আমি ঘরে--- পড়লাম মোগলের হাতে। আলো অদৃশ্য। শাশুড়ি হ্যারিকেন জ্বালিয়ে দিতে বললেন। আনাড়ি হাতে হ্যারিকেন জ্বালাতে দেখে বলে উঠলেন--- "রাইখ্যা দাও, এই সাধারণ কামটাও পারোনা।" ওই একদিনই আমায় অমন করে বলেছিলেন। তারপর যত্ন করে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। জীবনে আর ভুলিনি বা ভুলবো না।

বাবা বলেছিলেন--- বুঝলাম, আমার মেয়ের সম্মানবোধ আছে। শাশুড়ির এক কথায় হ্যারিকেন জ্বালানো কতো সহজ হলো। এখন সেই সর্বসময়ের সান্ধ্যসাথীকে আমরা বর্জনের গুদামঘরে বিসর্জন দিয়েছি।





কিছু স্বপ্ন কিছু স্মৃতি

শ্রী মা  গো স্বা মী  মু খা র্জী 

আমার একটা বড় বাড়ি হলে সেই বাড়ির পেছনে একটা বড় গাছ থাকবে। আমি সেই গাছে একটা পাখির বাক্স বানিয়ে ঝুলিয়ে রাখব। সেখানে থাকবে পাখির জন্যে খাবার, জল। পাখিরা সেখানে এসে বাসা বাঁধবে, ডিম পাড়বে। সেই ডিম ফুটে একদিন পাখির ছানারা উড়তে শিখবে। 

ছোটোবেলায় গরমের ছুটিতে একবার বাবা অফিস লাইব্রেরী থেকে সালিম আলির বই এনে দিয়েছিল। সেখানে দেখেছি কতরকম রং বে রঙের পাখি। অতো পাখি দেখে যখন মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতো, তখন আবার ফিরে আসতাম নিজের পাড়ায়। চড়ুই পাখি বারোটা, ডিম পেড়েছে তেরোটা/একটা ডিম নষ্ট/চডুই পাখির কষ্ট। এই সব ছড়া পড়তে পড়তে জানালা দিয়ে দেখতাম নারকেল গাছের ওপর খড়কুটো নিয়ে কাকেদের আনাগোনা। 

পাখির বাক্স বানানো আর হল না। কিন্তু ঘরের ঘুলঘুলিতে বাসা বানালো চড়ুই পাখি। মাঝে মাঝে চোখ না ফোটা বাচ্চারা নীচে পড়ে গেলে বাবা আবার বাসায় তুলে দিত। একবার আমাদের বাগানের বেগুন গাছে টুনটুনি পাখি বাসা বেঁধেছিল। কী সুন্দরভাবে  পাতার কোনাগুলো সেলাই করে মজবুত করে বাসা বানিয়েছিল। একটু উঁকি মেরে দেখেছিলাম ভেতরে মা টুনটুনি ডিমে তা দিচ্ছে। 

যখন গাছ থেকে নারকেল নামানোর জন্য লোক পায়ে দঁড়ি বেঁধে গাছে উঠতো তখন সব কাকেরা চেঁচামেচি শুরু করে দিত ঘুরে ঘুরে। কী না পাওয়া যেত সেই কাকের বাসায়। হারানো চামচ, দুধ খাওয়ার ঝিনুক, বাবার সবুজ রেক্সোনা সাবান, কড়া মাজার তারের জালি, দিদির back clip, মার চুলের কাটা, কত কিছু, আবার কখনো কখনো ছাই রঙের কোকিল ছানাও। কাকও যে এমন গুছিয়ে সংসার করতে পারে! 

আমাদের সিঁড়ির ওপর লম্বা কাঁচের জানালার বাইরে ইঁটের ফাঁকফোকরে বাসা বাঁধতো শালিক। একবার এক শালিক ছানা পড়ে গেছিল। পরে কলতলায় গিয়ে দেখি লাল পিঁপড়ে সারি বেঁধে ওকে ঘিরে ধরেছে। 

ঝড়ে ভাঙা পাখির বাসার মতো, পথ হারানো পাখির ছানার মতো আরো ছিল পাখির গল্প। একবার বাড়ির ছাদে ফুল গাছের টবে বাসা বেঁধেছিল এক ঘুঘু পাখি। রোজ সকালে, বিকেলে গাছে জল দেওয়ার সময় দেখতাম ঘুঘু পাখিটাকে। জল দেওয়ার সময় শুধু এক টব থেকে অন্য টবে হেঁটে যেত। ঘুঘু পাখির একটা গল্প আছে। ঘুঘু পাখি আগের জন্মে ছিল এক রূপসী নারী। বানের জলে ঘরবাড়ি ভেসে গেলে সতীনের ছেলেকে পিঠে আর নিজের ছেলেকে বুকে নিয়ে সাঁতরে পাড়ে উঠে দেখে নিজের ছেলেটা মরে কাঠ হয়ে আছে। তখন থেকেই সেই রূপসী নারী ছাইরঙা পাখি হয়ে বিষাদভরে ডেকে বেড়ায় ভরদুপুরে। আচ্ছা সতীনের ছেলে মরলে কী অপরাধবোধ এড়িয়ে যাওয়া যেত! অত সহজ! বেনেবউ এর গল্প তো সবার জানা। 

এই সব ভাবতে ভাবতে কোথা দিয়ে সময় কেটে যায়। প্রকৃতি কিন্তু দিব্যি চলে তার নিজের নিয়মে...





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪