সাহিত্য সমালোচনা

ব্যতিক্রমী আঙ্গিকের কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষে মানুষে’

বি দ্যু ৎ চ ক্র ব র্তী

পৃথিবীতে উন্নত মগজ, উন্নত বুদ্ধিমত্তা ও মানবিকতাসম্পন্ন একমাত্র জীব মানুষ। যদিও এক বিচিত্র নিয়মে মানুষের কার্যপন্থা অবনত করে দেয় মানুষেরই মাথা এমন দৃষ্টান্ত ভূরিভূরি। মানুষকে নিয়ে, মানুষের কর্মকাণ্ড, তাঁদের অবস্থান নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর, রচিত হয়েছে বহু মহাভারত। মানুষের উত্তরণে, তাদের হাতিয়ার করে আখের গোছানোর অছিলায় গঠিত হয়েছে বহু দল-সংগঠন, রচিত হয়েছে বহু কথা, গাথা ও কবিতা। 
তবে ঠিক গড্ডলিকা প্রনাহে গা না ভাসিয়ে এক ভিন্নতর আঙ্গিকে, ব্যতিক্রমী ধারায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কবি প্রাণজি বসাকের কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষে মানুষে’। একটি জীবনের ভিন্ন ভিন্ন মোড়ে আহৃত অভিজ্ঞতার সূত্রে লেখা কবিতাগুলিতে বলা যায় কবি উন্মোচিত করেছেন সমকালিক মানুষের এক নির্মোহ চরিত্র, এঁকেছেন অসংখ্য অনুষঙ্গ সম্বলিত সবাকচিত্র। প্রাণজির গ্রন্থে কোনও ভূমিকা না থাকায় এই গ্রন্থের ভিন্ন মূল্যায়ন উপলব্ধ হয় না। তবে প্রকাশক ‘পত্রলেখা’র (কলকাতা) তরফে আলোচ্য গ্রন্থের শেষ প্রচ্ছদে কবি প্রাণজি সম্পর্কে লেখা আছে বিস্তৃত পরিচিতি। দুটি লাইন সেখান থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে - ‘...তাঁর একাধিক কাব্যগ্রন্থে মানবধর্মী ভাবনা, সমাজ চেতনা ও মুক্তির খোঁজ পাওয়া যায়। কবি প্রাণজি বসাকের কবিতার স্বতন্ত্র ভাষা, বুনন ও বাচনভঙ্গি অন্য কবিদের থেকে ভিন্নতা এনে দেয়...’।
আলোচ্য কাব্যগ্রন্থেও এমনই এক স্পষ্ট ধারা খুঁজে পাওয়া যায়। আঙ্গিক এবং ভাষ্য বা বিষয় একাধারে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে বজায় থেকেছে আদ্যোপান্ত। গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে গ্রন্থনাম অনুযায়ী শিরোনামের যতিচিহ্নহীন একমাত্র কবিতা ১ থেকে ৭৫টি ভাগে। প্রতিটি পৃষ্ঠায় রয়েছে দশ লাইনের একটি করে কবিতা। এক ব্যতিক্রমী আঙ্গিক নিঃসন্দেহে। অধিকাংশ কবিতার শেষ দুটি পঙ্‌ক্তিতে আছে মানুষের কথা। বোধ, মানবিকতা, কার্যকলাপের কথা। সমকালীন যাপনচিত্রের এক গভীর অনুসন্ধানমূলক বিশ্লেষণ -
...মানুষ হেঁটে হেঁটে একদিন মানবিক হয় পৃথিবীর পথে
মানুষের গন্ধে মানুষ আঁকে স্মৃতিকথা ভালোবাসাবাসি (কবিতা সংখ্যা ১৩)
...সেই কবেকার উঠোনে নেমেছিল সন্ধ্যা শঙ্খসুরে গাঁথা
ভয়ার্ত পদশব্দে আঁতকে ওঠা মানুষ খোঁজে মাতৃভাষা (কবিতা সংখ্যা ১৯)
...নজরে পড়ে না কোথায় সমুদ্র কোথায় পাহাড় বা নদী
প্রকৃতির এ মায়াময় খেলায় মানুষ মেতেছে দিনরাত্রি (কবিতা সংখ্যা ২৭)
...একটা মানুষ পেরিয়ে যায় অন্য মানুষের ঘন ছায়া
মানুষ অবয়বে মানুষ অন্তরাল অবয়বে থাকেন ঈশ্বর (কবিতা সংখ্যা ৪১)
...মানুষের ঘোর লাগে বিশ্বাসে রূপা-গলা পূর্ণিমা রাতে
পিথিবি গোল কিনা সন্দেহ লাগে তাবৎ শনাক্তকরণে (কবিতা সংখ্যা ৬০)
শুধু শেষেই নয়, প্রতিটি কবিতার মাঝখানেও কবি ঢেলে দিয়েছেন এক অপরাহ্নের মায়া। অন্তরঙ্গ অনুষঙ্গ হয়ে লুকিয়ে রয়েছে জীবনবোধ। ভাষা ও দেশ, জটিল সমকাল এসেছে তাঁর কবিতায় অনুষঙ্গ হয়ে বারবার। কবির পীড়িত মন ব্যথিত হয়েছে বন্ধনহীনতায়। বলে রাখা ভালো প্রতিটি কবিতা পড়তে হবে গভীর মনোযোগিতায়। নতুবা খেই হারাতে পারেন পাঠক। সহজ কথায় কথা সাজিয়েছেন কবি তবু যেন কেমন হাওয়ার মতো অধরা থেকে যায় খেই হারালেই। শব্দরা ঝঙ্কার তুলেই হারিয়ে যায় অনন্তে। বলা যায় একাধারে ঘোর এবং বেঘোরের অসামান্য মিশ্রণ। কোনও স্বর কিংবা মাত্রাবৃত্ত নয় তবু যেন এক সামঞ্জস্যের তারে বাঁধা সব কবিতার অবয়ব, বিন্যাস। গদ্য কবিতার আঙ্গিকে পদ্যের অবয়ব। এক বিচিত্র মননসাধ্য কাব্যসম্ভার। 
এখানে বলে রাখা ভালো গ্রন্থটির আকার যদিও অপেক্ষাকৃত ছোট তবু একটি পৃষ্ঠায় অনায়াসে জায়গা করে দেওয়া যেত দুটি কবিতার। এক্ষেত্রে পৃষ্ঠাসংখ্যা কম হতো এবং ‘সেভ পেপার সেভ ট্রি’ স্লোগানের সার্থকতা প্রতিপন্ন হতো। কিংবা এখানেই জায়গা হতো আরোও কবিতার যা কিনা উপরি পাওনা হতো পাঠকের। 
ছাপা, হার্ড বোর্ড বাঁধাই, শব্দ/অক্ষরবিন্যাস যথাযথ। প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে চঞ্চল গুই। গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন ‘অহনা, সেবিকা, দিব্যেন্দু’কে। সব মিলিয়ে এক ভিন্নতর পঠনসুখের কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষে মানুষে’।


মূল্য - ১৬০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৮৩১১১০৯৬৩ (প্রকাশক)


 



তবুও বৃষ্টি নামুক: রুদ্র গোস্বামী

উ ত্ত ম  কু মা র  দা স

সহজ কথা সহজ করে বলা সহজ নয়। আর যদিও আমাদের কাছে তা সহজ বলে মনে হয় তাহলেও পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করাটা কিন্তু বেশ কঠিন। সহজ কথায় যদি ভাবের গভীরতা থাকে তবেই তা পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছায়, পাঠক তাকে আদরের সঙ্গে বরণ করে নেয়। ভাবনার বিস্তৃতি আর সংযত প্রকাশ ভঙ্গি যখন আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে তখন স্রষ্টার কাব্য ভাবনা পাঠক হৃদয়ে উত্তীর্ণ হয়, কবিতাও কালের ঘরে উত্তীর্ণ হয়। কবিতায় কোন ব্যাকরণগত নিয়ম নেই। পাঠকের হৃদয়ে কবিতার অধিষ্ঠান। পাঠক ই কবিতার দেবতা। ভাবনা আর বোধ এই দুটো বিষয়ের উপর নির্ভর করে পাঠকের ভিন্নতা আছে। সহজ কথা সহজ ভাবে পাঠক সহজেই নিতে পারে। ব্যস্ততা, যান্ত্রিকতা, পরিশ্রান্ত মনের কোলাহলে মানুষ আজ ক্লান্ত। সময় নেই পেঁয়াজের খোসার মতো শব্দের ভাবনা রূপকের  আবরণ থেকে তুলে জীবন বোঝে তাকে উত্তীর্ণ করার। তাই সময় এসেছে কবিতা নিয়ে নতুন কিছু ভাবনার। জাতি-ধর্ম-সমাজ, আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ছবিগুলো একটা সময় কবিতা হয়ে ওঠে যদি তার মধ্যে একটা চলমান জগত থাকে। কবিতা কিন্তু থেমে থাকে না, ভাবের ব্যঞ্জনায় কবিতা আজীবন চলতে থাকে। এই চলা অনন্ত কোথাও আবর্তিত আবার কখনো সমান্তরাল... কিন্তু চলছে। 
"তবুও বৃষ্টি নামুক" রুদ্র গোস্বামীর এমন একটি কাব্যগ্রন্থ যেখানে সহজ সরল চলার মধ্যেও আত্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি আছে। তাই কবি অকপটে বলতে পারেন:
"ভালোবেসে মানুষেরা ঈশ্বর হয়ে গেছে চলো হেঁটে আসি"।

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী "তবুও বৃষ্টি নামুক" কাব্যগ্রন্থটির প্রসঙ্গে বলেছেন: "তাঁর গদ্য কবিতার নিরুচ্চার ছন্দময়তা এবং সরল উচ্চারণ চোখে পড়ার মতো"।

এই সরল ভাবনার পথে পাঠক সহজেই অগ্রসর হতে পারেন। আবার সবটা ফেলে রেখে যখন নিঃস্ব মন নিয়ে ভাঙা হৃদয়ের মানুষ গুলো সমস্যার শিকার হন তখন রুদ্র গোস্বামীর কবিতা পারে তাদের আশ্রয় দিতে। তাই আজ আমরা বৃষ্টির ঘরে কড়া নাড়বো মেঘের খোঁজে, দেখা যাক রুদ্র গোস্বামীর কবিতার সাফল্যের আসল রহস্যটা কোথায়।

'ঘর'কবিতাটি পাঠকের কাছে উপলব্ধির এক বিস্ময়কর জাগরণ। আমরা প্রচলিত অর্থে ঘরকে এক ক্ষুদ্র সংকীর্ণতার সীমানায় বাঁধি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সেই ঘর ইট, কাঠ,লোহা ,পাথরের এক নির্জীব উপাদান হয়েই রয়ে যায় শুধু দৈনন্দিন প্রয়োজনে। কবি ঘর বেঁধেছেন বুকের ভেতর। অনুভবে গড়া এই ঘরে শুধু ভালোবাসা আছে। এই ঘর আকাশের মত বিস্তৃত আবার বৃক্ষের মতো সুদৃঢ়। কখনো ভাবনা পাহাড়ের উপর থেকে নদীর মত, কখনো ঝর্ণার মত এই বয়ে যাওয়া হলো প্রাণশক্তিতে উজ্জ্বল। আজীবন গোলাপের মতো সেই ঘরে দুটো তারুণ্য প্রাণশক্তিতে বেঁচে থাকে। সেই ঘরের প্রতীক 'একটা ছাউনি'। এইটুকু শুধু প্রচলিত। বাকিটা কবির ভাবনায় ঘর বাঁধার উপকরণ , যা কবিতায় আমাদের একটা পৃথক ভাবনার নির্দেশ দিয়েছে।

সম্পর্ক গুলোকে আমাদেরই বাঁচিয়ে রাখতে হয়। জীবনের প্রতিটা পর্যায়ে ছড়িয়ে আছে নানান অনুভূতি সেগুলো একত্রিত করেই 'ঘর' হয়। ঘর হয় প্রাণশক্তিতে বেঁচে থাকার মধ্যে দিয়ে, প্রতিটা সকালে বুক পেতে নেওয়া সকালের সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে, যেখানে ভালোবাসার মানুষটা পাখি হতে চাইলে বুকের বাঁদিকে আকাশ পেতে দিতে হয়। "ঘর" কবিতার শুরুতেই কবি বলেছেন: 
"মেয়েটা পাখি হতে চাইল 
আমি বুকের বাঁদিকে আকাশ পেতে দিলাম।
দু চার দিন ইচ্ছেমত ওড়াওড়ি করে বলল 
তার একটা গাছ চাই।"
আসলে আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কিন্তু আমরা চাইতে পারিনা তাই দাবি করি। চাওয়ার মধ্যে একটা আবদার থাকে,দাবির মধ্যে থাকে অধিকার বোধ। নিজের পরিধি থেকে আমরা এক চুলও সরতে পারি না তাই আমরা তর্কবিতর্কে নিজেরাই জড়াই। সম্পর্কের মাধুর্য নিজেরা নিজেদের অজান্তেই নষ্ট করে ফেলি। সম্পর্কের মধ্যে যদি ভালোবাসার স্পর্শ থাকে তাহলে প্রত্যেকদিন নতুন সূর্যের মতো মনে হয়। তখন ঘর আর ইট ,কাঠ,পাথরের উপাদানে কে প্রাধান্য দেয় না, হৃদয় দিয়ে ভালবেসে সবটা উজার করে দেয়। ঘর হয়ে ওঠে মানব জীবনের প্রতিমূর্তি। তাই কবি কবিতার শেষ স্তবকে বলেছেন 
"তারপর একটা ছাউনির দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 
কী নাম?
বললাম ঘর

এবার সে আমাকে বলল 
তুমি সকাল হতে জানো? 
আমি বুকের বাঁ দিকে তাঁকে সূর্য দেখালাম ‌।"

অভিরূপ তোমাকে: রুদ্র গোস্বামী 

"অভিরূপ তোমাকে" একটি সম্পর্ক বিচ্ছেদের কবিতা, ফিরে পাওয়ার একটা ব্যাকুল আকুতি কবিতার সমগ্র শরীর বেয়ে নেমে এসেছে। ফেলে আসা ঘরে আর ফিরে যাওয়া যায় না, সেই ঘর আকাশের মত হারিয়ে যায়। সেই ঘরে মন পাখি কল্পনায় ওড়া উড়ি করতে পারে কিন্তু শারীরিক উপস্থিতি সম্ভব নয়। কবি বলেছেন: " সাধারণ মেয়েদের কোন পুনর্জন্ম থাকে না। 
অপেক্ষার জীবাশ্ম বয়ে বয়ে যে ভালোবাসা আজ আমার রক্ত প্রবাল
আমি কিছুতেই মৃত্যুর হাতে তাকে তুলে দিতে পারব না অভিরূপ।
আমি বাঁচবো অভিরূপ অসংখ্য মৃত্যুর পাঁজরে পাঁজরে আমি বাঁচবো 
তুমি যতদিন বেঁচে আছ।"
সম্পর্কের মৃত্যু হয় যখন মানুষ পরপারের বাসিন্দা হয়, অথবা বিবাহ বিচ্ছেদ বা প্রেমের মৃত্যু, এর বিভিন্ন কারণ হতে পারে। দৈনন্দিন চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ মেয়েদের মুক্তমন বলে কিছু থাকেনা, তারা সম্পর্কের উপর নির্ভর করে আশ্রয় গড়ে তোলে। আর মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই তারা সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যায় পরপারে। আবার এই কথা ঠিক স্বামীর মৃত্যুতে বৈধব্যকে আশ্রয় করে কিছু মেয়ে তার স্মৃতিকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকে যদিও সেই সংখ্যা নগণ্য, কিন্তু আছে। আবার মৃত্যু পথযাত্রীর প্রার্থনা হতে পারে অসংখ্য মৃত্যুর পাঁজরে পাঁজরে বেঁচে থাকার নির্মাণ প্রচেষ্টা স্মৃতিকে আশ্রয় করে। 

মূলত "অভিরূপ তোমাকে" একটি স্মৃতি নির্ভর কবিতা। এবার আমরা কবিতা শুরুতে যাই: 
"ঘরে ফেরা কি এতটা কঠিন? 
ঘর তো আর আকাশ নয় ফিরতে গেলে পাখি হতে হয়।
পাখির মতো দুটো দানা থাকতে হয়। 
পায়ে হেঁটে এতদূর যাওয়া যায় অভিরূপ?
যেখান থেকে ফিরতে গেলে আকাশ পেরুতে হয়?"
"ঘর তো আর আকাশ নয়"আর "পায়ে হেঁটে এতদূর যাওয়া যায় অভিরূপ"? এই দুটি বাক্যের মধ্যে একটা না ফেরার জগতের ইঙ্গিত রয়েছে। তুই ফেরা শরীর কে ঘিরেও হতে পারে। কারণ"যেখান থেকে ফিরতে গেলে আকাশ পেরুতে হয়? "আকাশ শূন্য। শূন্যকে পেরুতে যাওয়ার অর্থ দিগন্তে বিলীন হয়ে যাওয়া। সাধারণ দৃষ্টিতে পৃথিবী আর আকাশের সীমারেখাকে এখানে বোঝানো হয়েছে। এই সীমানা জীবিত অবস্থায় পেরুতে যাওয়ার অর্থ কল্পনাকে আশ্রয় করে অতীন্দ্রিয় সত্তায় নির্ভর করে জগত জীবনের  সত্যকে উপেক্ষা করে অতিপ্রাকৃতিক জীবনকে আশ্রয় করেও আমাদের মন আর মস্তিষ্কে সজাগ রাখা। যন্ত্রণায় মানুষ ইহ জগতের বাহ্যিক উপাদান গুলোকে উপেক্ষা করতে পারে কিন্তু তখন সে আর নিজের মধ্যে থাকে না ,পাওয়া না পাওয়ার দুঃখে কাতর হয়ে তার বেঁচে থাকার যেন মৃত্যুর সামিল। কবিতা এর কিছু উল্লেখযোগ্য লাইন রয়েছে যা কবিতাটি কে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে: 
"যে চোখে জলের ফোঁটা দেখলে স্বর্ণ মুদ্রা বলে রুমালে কুড়িয়ে নিতে
সে চোখের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত এখন 
অশ্বমেধের ঘোড়ার মত দাপিয়ে বেড়ায় তেরোটা নদী"
কবি রুদ্র গোস্বামীর কবিতার বাইরের ভাবনা আর আবরণটা যতটা সহজ সরল বলে মনে হয়, শব্দের প্রয়োগে তিনি ততটাই দৃঢ়চেতা; যেমন এখানে "তেরোটা নদী "শ্বরবিজ্ঞান অনুযায়ী মানবদেহের তেরোটা জলধারা । এই তেরোটা জলধারাকে বাংলায় বলে তেরো নদী। এই তেরো নদী হল(১) অশ্রু ২) শিকনি, ৩)বিষ্ঠা, ৪)মুত্র, ৫)ঘর্ম, ৬)কফ, ৭)রক্ত, ৮)রজো, ৯)লালা, ১০)শুক্র, ১১) দুগ্ধ, ১২)সুধা, ১৩)মধু--- আমরা প্রচলিত অর্থে "সাত সমুদ্র তের নদী" অনেক সুদূর কোন স্থান অর্থে ব্যবহার করি, বাস্তবে এই কথাগুলোর কোন কার্যকারিতা নেই কিন্তু সম্পর্কের অবস্থান বোঝাতে কথাগুলো ব্যবহার করা হয়। আবার কবিতায় আসা যাক: 
" তাদের অবাধ্য স্রোত খড় কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায় 
আমরা বেঁচে থাকার লক্ষ্য লক্ষ দিন, আমরা ভালো থাকার অসংখ্য সময়"
আমরা প্রত্যেকেই নিজের মতো করে ভালো থাকতে চাই কিন্তু স্মৃতি কে নিয়ে বেঁচে থাকার অর্থ বর্তমানকে কবর দিয়ে অতীতের সঙ্গে বসবাস করার একটা নির্মম প্রচেষ্টা। অভিরূপ এখানে ভবিষ্যতের নির্ণায়ক, কবিতার সমগ্র ভাবনা অভিরূপ কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। অভিরূপ বিশেষণ পদ যার অর্থ "আনন্দ"; আবার অপরূপ, মনোরম, পন্ডিত, বিদ্বান প্রভৃতি বিভিন্ন ভাবনায় নাম পদটিকে আমরা বিশেষিত করতে পারি। তাই শব্দ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কবির কুশলতা আমাদের মুগ্ধ করে। কবিতার নামকরণটি ও কবিতার ভাবনার সঙ্গে যেন সামঞ্জস্য বিধান করেছে।




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪