গল্প

 

মৃণাল ও একটি অনবহিত সিনে সংবাদ

শা শ্ব ত  বো স

খুব ভোরের জেদী একগুয়েঁ ধোঁয়া আর ছেঁড়া ছেঁড়া বাক্স পুঁটুলি থেকে ভেসে আসা ভ্যাপসা গন্ধের মিশেলে, ভিজে যাওয়া সংস্কৃতিশূন্য সকালটার একটা নিজস্ব গন্ধ আছে| গরম ভাতের ফ্যান, ডাস্টবিনে ফুলে ওঠা মাছ কিংবা সারা রাত জেগে বাজারটার এক কোনায় পরে থাকা মুটে মজুরের গায়ের তেঁতো ঘামের গন্ধ, সব কিছু মিলে মিশে গিয়ে একটানা পচা একটা গন্ধ তৈরী হয় এই সকালটার গায়ে| মশলা বাজারটা খুলতে এখনো দেরী আছে, এখন শুধু মাছের বাজারটা ঘিরে শব্দের আনাগোনা| ভারী বরফের চাঁই মাটিতে আছড়ে ভাঙার শব্দ, মুটে মজুরদের লরি থেকে মাছ খালাস করার সময় দেহাতী হিন্দি আর বাংলা মেশানো খিস্তির বলিষ্ঠ বিস্ফোরণ, স্বস্তার ঠেলাঠেলি আর মাছ বাজারে দর হাঁকাহাঁকির শব্দ| হারানিধির এসবে অভ্যাস হয়ে গেছে| এই শব্দটা তার কানের কাছে শ্লেষ্মা মিশ্রিত ঘড়ঘড়ে গলায় বাজে ঘন্টির মতন| একটানা বেজে চোখের বাসী ঘুমটাকে তাড়িয়ে দেয়, অ্যালার্ম ঘড়ির আর দরকার পরে না| এখন তার তক্তপোষ ছেড়ে উঠে গিয়ে লবির গায়ে ঝুলন্ত বাল্বটা নেভানোর কথা| তারপর আস্তে আস্তে হারান কে তুলে পায়খানা বাথরুম সেরে বাজারের পথ ধরতে হবে| বাজারের মধ্যেই হোটেলটা, "বেঙ্গল লজ"| একইসাথে লজ ও ভাতের হোটেল| অবশ্য হারানিধি যখন প্রথম এখানে কাজে লেগেছিল, তখন এটা শুধু ভাতের হোটেলই ছিল| এই হোটেলটার মালিক ‘শশধর গুপ্ত’, এই এলাকার ‘গুপ্ত দা’, রামনিধির হাতের ছোলা দিয়ে কুমড়োর তরকারি, হালকা হিং ফোড়ন দিয়ে, সাথে সর্ষে দিয়ে বেগুনের ঝাল দিয়ে ভাত মেখে খেতে খেতে বলেছিলেন, "কাঠ বাঙাল হয়ে ঘটি বাড়ির রান্না কি করে শিখলে হে?" বাজারের মাঝখানে সদ্য খোলা ভাতের ঝুপড়িটার খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হারানিধি উত্তর দিয়েছিল, "আজ্ঞে কত্তা,মায়ের কাছে| ছেলেবেলায় বাবা মারা গেছেন, আমরা তিন ভাই বোন, মা এদিক ওদিক করে যা পেত, রেঁধে বেড়ে খাওয়াত| মায়ের হাতের রান্না ছিল অমৃত, ছোলা দিয়ে মোচার ঘন্ট রাঁধত ঘটি বাড়িকে হার মানিয়ে দেবে|" আশেপাশে গাছের পাতার চাপে পৃথিবীটার সব ফুটো বন্ধ হয়ে যাবে এমন একটা সময়ে শশধর তাঁকে প্রস্তাব দেয়, "আমার দোকানে কাজ করবে? উড়ে বাউনটা সেই যে দেশে গেছে আর ফেরার নাম নেই| আপাতত মাস গেলে ৩০০ টাকায় ঢোক, থাকা খাওয়া সব আমার ওখানেই, পরে আস্তে আস্তে বাড়িয়ে দেওয়া যাবে|" সেই থেকে হারানিধি, গুপ্তদার হোটেলে নোঙ্গর ফেলল| এই এতো বছরে শিয়ালদাহ ব্রিজের উপর দিয়ে চলা, টিং টিং ঘন্টির ট্রামগাড়িটা চলে গেছে কয়েক লক্ষ বার| ট্রামের ভেতর বসে থাকা মুখটা জানলা দিয়ে বেরিয়ে এসে বাজারটাকে দেখেছে কয়েক অর্বুদ মাইক্রো সেকেন্ড ধরে, ধুলোকাদা জড়ানো একটা হাওয়াকে বুকে আঁকড়ে| রামনিধি আজ রাঁধুনি থেকে হোটেলের কত্তা হয়েছে| কয়লার উনুনের গনগনে আঁচ, ছাঁকা তেলে কড়া করে ভাজা মাছ, পুইশাঁকের চচ্চড়িতে মেশানো পাঁচফোড়ন এসব ছেড়ে হারানিধি এখন খাবার সময় খদ্দেরদের দেখভাল করে| কার কি অসুবিধা, কে কি নেবেন? কার ভাত লাগবে? কার ডাল তরকারি? কে কি মাছ নেবেন, কোন টেবিলে কত হল| গুপ্তদা বাজারটা ও ছাড়া কারুর হাতে ছাড়েন না| নেহাত পড়াশোনাটা বেশীদুর শেখেনি হারানিধি, নাহলে হয়তো হিসেবের খাতাটাও ওই দেখত| আজ থেকে তিরিশ বছর আগের রানাঘাট স্টেশনের বাইরে একটা মাটির দেওয়ালের বাড়িতে, খড়ের চালায় ভাতের হোটেল খুলে বসা বছর তেইশের তরতাজা যুবক হারানিধি, কলকাতায় এসেছিল কলোনীর বিশুদার হাত ধরে| বাজারের মাঝের জামগাছটা তখন সদ্য মাথা তুলছে| ওই গাছটাই একদিন আবছা আলো-আঁধারিতে ভেবে নিয়েছিল ভবিষ্যতে সে বনবিথীকা হবে| আজ এলাকার ছেলেপুলেরা ঢিল ছুড়ে গাছটা থেকে জাম পারে, ওর শরীর জুড়ে চামড়ায় ফাট দেখা দেয়, মুছে যায় স্মৃতির জন্মদাগ| গাছটা জুড়ে কয়েকশত কাক যত্নশীল সংশয়হীনতায়, ঘিঞ্জি বাসা বেঁধেছে নির্লজ্জ বংশবিস্তারের আশায়| রোজ বিকেলে নিয়ম করে হারানিধি ওদের মুখে ছুড়ে দেয় এঁটো ডেচকির গায়ে লেগে থাকা পীতাম্বরী ভাতের দলা| কাকগুলোর মাঝে বুক চিতিয়ে মাস্তানি করে বেড়ায় একটা শঙ্খচিল, ঐটাই হারানিধির বাপ| বাকিগুলো হয়তো ওরই পূর্বপুরুষ সব, জন্মান্তরে অনস্তিত্ত্বের সাজা কাটছে| বাজারের মাঝখানের পোড়ো বাড়িটার ভাঙা দেওয়ালে, বাড়তি চৌকাঠে আছড়ে পরে ফেটে যাওয়া রোদটার গায়ে কান পাতলে বুঝতে পারা যায় রানাঘাটের রেফিউজি কলোনীর ‘হারানিধি দাস’ এখন বেঙ্গল লজের ভরকেন্দ্র| তাকে ঘিরে হোটেলটা ফিরে পেয়েছে এক নিশ্চিন্ত যোগনিদ্রা, বিরামহীন আগডুম বাগডুম এর মাঝেও তার নড়েটি যাবার উপায় নেই| তিনশ টাকার মাসিক বেতন এখন প্রায় ছয় হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে| গুপ্তদা ওর ছেলের পড়ার খরচ দেন| সেরকম কোন অভাব অভিযোগ রাখেননি এককথায়| নিন্দুকেরা কিন্তু বলে হারানিধি ‘শসাবাবুর গুপ্ত কথা’ জানে| তাই বেঙ্গল লজে তার এত খাতির| হারানিধিকে গুপ্তবাবু নিধি বলেই ডাকেন| তাই গল্পের পরবর্তী সময়ে আমরাও সেই নামটিই ব্যবহার করবো|




ঘুম থেকে উঠে পরে হারানিধি| জৈষ্ঠ্যের ঝকঝকে ভোর আর কিছুক্ষনের মধ্যেই সূর্য্যের তাপ গনগনে হয়ে পোড়াবে তাবৎ ব্রম্ভান্ডকে| গরমের দিনে বাজারটাও জেগে যায় একটু তাড়াতাড়ি| তোলা ঝি টা আসে, এঁটো বাসন মাজে| বাসনের ডাঁই দেখলে রাগে গজগজ করে| নিধি ঘুম থেকে উঠে সিঁড়ি বেয়ে তলায় নেমে আসে| হারানটা রান্নাঘরের মাটিতে বিছানা পেতে শুয়ে আছে, রাস্তার নেড়িটার মত মুখ গুঁজে| নিধি গিয়ে তার গা থেকে চাদরটা সরিয়ে দিয়ে আলতো করে নাড়া দেয়|
“ওঠ বাবা হারান| উঠে পর বাবা| ভোর হয়ে গেছে| চট করে ঘরদোরগুলো ঝাড়পোঁছ করে দে দিকিনি| ওই দেখ, ঝি টা উঠোনটা ঝ্যাটাচ্ছে| তোকে কতদিন বলেছি ওটার পিছু পিছু থাকতে| ও বেটির হাতটান স্বভাব আছে| ওটাকে এবারে তাড়াতে হবে কত্তাকে বলে|" 
নিদ্রাবিলাসী ভোরের প্রপঞ্চময় বিরক্তি নিয়ে একটা চোখ কোনমতে খুলে হারান বলে, "তুমি আর ঘ্যাঁচাঘ্যেচি করোনি বাপু, ও মাগীকে ছাড়ায়ে দিলে ওর কাজ গুলো কে কইরবে শুনি? এই বাজারে তুমি হোটেলি কাইজ করার ঝি পাইবে? সেই তো মুর ঘাইরে এসে পুইরবে| এক পয়সা মাইনে বাড়াইবেনি ওই কিপ্টা ঢ্যামনা বুড়া!! যেতিছে যেতিছে বুড়ার যেতিছে তুমার কি খুড়া?"
কথাটা শুনে নিধি চুপ করে যায়, গুপ্তবাবুর নিন্দা শুনে সে খুব একটা অভ্যস্ত নয়, কিন্তু হারানের কথাগুলোর উপর কিছু বলতে পারেনা| বেশ কিছু বছর আগে এই বৈঠকখানা বাজারে আধপাগলের মত ছেঁড়া কাপড়ে ঘুরছিল ছেলেটা| নিধি তখন সবে হোটেলের দুপুরের খাবার পর্ব শেষ করে, সামনের সরু রাস্তাটায় একটা ঝরঝরে টুল পেতে বসেছে| এমন সময় ছেলেটা এসে খেতে চেয়েছিল| হেঁশেলে উনুনের আঁচ নিভে গেছে ততক্ষণে| এঁটো বাসনগুলো পাহাড় হয়ে পরেছিল এক কোণে| কদাকার ডেচকির তলা হাতড়ে কিছু আধপোড়া ভাত পাওয়া গেছিল, সাথে সেই ছোলা দিয়ে কুমড়োর সব্জী, ঠাকুরটা হয়তো তুলে রেখেছিল রাতের জন্য| শীতের ধুলো আর রোদ মাখা মায়াবী আলোয় ছেলেটার মেঘের মত মুখে, সেটুকু তুলে দিয়েছিল নিধি| হাপুস হাপুস বুভুক্ষুতায় থালাটা শেষ করে রাস্তার এক কোনে ছেঁড়া চাদরটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পরেছিল ছেলেটা| রাতের খাবারটা আলাদা করে সরিয়ে রেখে যখন ওর মুখের কাছে ধরতে গেল নিধি, ছেলেটা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, "না মাগনা খাবুনি, আমায় কাজ দাও"| এর আগে দেশ থেকে ওর বয়সী একটা ছেলে ধরে নিয়ে এসেছিল নিধি| ব্যাটা মহা পেছন পাকা আর ওস্তাদ গোছের ছিল| কিছুদিন পর থেকেই কাজে ফাঁকি দিতে শুরু করলো| কিছু করতে বললেই হাজার বায়নাক্কা| একদিন তো নিধির মুখের ওপর ছোটবড় কথা বলে, পয়সা কড়ি বুঝে নিয়ে কাজ ছেড়ে বেরিয়ে গেলো| নিধি পরে শুনেছিল ব্যাটা এই বাজারেই একটা মশলার দোকানে কাজ নিয়েছে| আসা যাওয়ার পথে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখত নিধিকে| এই ছেলেটাকে দেখে বেশ মায়া হয়েছিল নিধির| গুপ্তদা কে বলে ওকে রেখে দিয়েছিল, সেই থেকে হারান এই হোটেলেই আছে|

মুখহাত ধুয়ে, চান করে, গুরুর দেওয়া কৃষ্ণ মন্ত্র জপ করে নিধি| সারা হোটেল, লজে গঙ্গার জল ছেটায়| কর্পূর আর ধুনোর গন্ধে ভুরুভূর করে লজের বাতাস| এই লজে গুপ্তবাবু যাকে তাঁকে ঘর দেননা| পরশু দিনই একটা ছেলে মেয়ে এসে ঘর চাইছিল, বলে কিনা ভাইবোন! বোন কে পাশের কলেজে এডমিশন করাতে নিয়ে এসেছে! নিধির দেখেই সন্দেহ হয়েছিল| বন্ধ ম্যানহোলের ঢাকনা সরালে যেরকম গুমোট অন্ধকার, সেরকম অন্ধকার পেরিয়ে নিধি হেঁটে এসেছে অনেকটা দিনকাল| এখানকার অন্যান্য লজে কি হয়, নিধি খুব ভালোভাবেই জানে| আর বেঙ্গল লজ বাজারের অনেকখানি ভেতরে হওয়াতে, এসব তো এখানে সুবিধে! গুপ্তদা কে ও চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছিল ব্যাপারখানা| গুপ্তদাও তো কম দিন হোটেল চালাচ্ছেন না এখানে! শেষমেশ গুপ্তদা ওদেরকে বলে দিলেন, "না বাপু, এখানে ঘর খালি নেইকো, তোমরা আশেপাশে দেখো"| 

রেডিওতে এখন নীতিকথা বাজে| বাজারের মুখটা থেকে একটা চলতি হাওয়া, আঁশটে গন্ধ গায়ে করে নিয়ে এসে নিধিকে মনে করায়, এবার মাছ কিনতে বেরুতে হবে| এই বেলা গফুরের কাছে গেলে তাজা মাছ পাওয়া যাবে, কাতলা-রুই-পার্শে-পমফ্রেট, লাল কানকো, চকচকে গা| বেঙ্গল লজের ভাতের হোটেলে কিন্তু অন্য পাইস হোটেলের মত রোজ ২৪ রকমের মাছ পাওয়া যায় না| নিধি বাজারের ভেতর গিয়ে পকেটের রেস্ত বুঝে, ভালো মাছ বুঝে, যা নিয়ে আসে রোজ তাই রান্না হয় হেঁশেলে| বাজার চলতি মানুষজন, কলেজ পড়ুয়া, বাজারের মুটে, কাঠের দোকানে আসা বোটকা লুঙ্গির ‘পালিশের লোক’, পুরু চামড়া, গোত্রহীন চৈত্রমাস কিংবা সলজ্জ আষাঢ়, সবাই জলহীন মেঘরোদহীন দুপুরে খিদের মুখে দুটো ভাত খেতে আসে, সাথে হয়ত মুরগীর মাংসের লাল ঝোল, ইচ্ছেমতন চেয়ে নেয় বুক, পাঁজরা কিংবা লেগপিস কিংবা হয়তো কড়া করে ভাজা পোনা মাছ সর্ষে দিয়ে, কখনও বা শুধুই মাছভাজা, ডাল, ঝুরঝুরে আলু ভাজা সাথে চাটনী, পাঁপড়| অবৈতনিক অবিনশ্বর খিদে আর দু মুঠো ভাতের কোন জাত বা কর্ম-বর্ণ-গন্ধ বিচার নেই এই হোটেলে| 

বাজারের ভেতর তিনশ বছর পুরোনো কোনো কার্নিশে ওঁৎ পেতে বসে থাকা কাকটা নেমে আসে| চোখ বোজার কৌশলে সুযোগ বুঝে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায় মাছের কাঁটাটা, পোষা মেনিটার মুখের থেকে| এখানে অন্য হোটেলের মত বিরিয়ানী বা চিকেন চাপ, টমেটো সস দিয়ে সাঁতলানো চিকেন কষা হয় না| তবে নিয়ম করে পয়লা বৈশাখে রেয়াজী খাসির মাংস হয়, নিধি নিজে হাতে রাঁধে| যে মাংসটা ও ওর মায়ের কাছে শিখেছিল| সাথে হাওয়ায় কচ্ছপের গতিতে ধুলো কালি এসে, খরচ-না-হওয়া জীবনটার ধর আর মুণ্ডুর মাঝখান দিয়ে ফস করে উড়ে গেছিল| ওর মা হয়তো সেই রান্নাটাই শিখেছিল খুলনার কোনো এক বিরামহীন ফুরিয়ে যাওয়া নদীর গা ঘেঁষে| এই রান্না শেখার গল্পটাই নিধি করে গেছে বারবার| হয়তো সেই সুদীর্ঘ্য ও একঘেঁয়ে বাক্যরাজির আড়ালে প্রতিবার একটা প্রায় অলৌকিক আন্তরিকতা মিশে থাকে| কিন্তু সেই একই সময়ে ওকে দেখলে মনে হয় যেন, মুহূর্তটায় ও সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত, নিঃসঙ্গ ও নিঃস্ব| নির্গুণ, নির্ঘুম একটা মুখ হয়ে আশে পাশের অপরিচিত বিবর্তনকে সাক্ষী করে, উনুন ধরিয়ে কৃষ্ণ মন্ত্র জপ করতে করতে, এক মুঠো চিনি ছড়িয়ে দেয় উনুনের ভেতর| 

সকালের টিফিনটায় উড়ে ঠাকুরের সাথে হারানও হাত লাগায়| কচুরী, লাল আলুর তরকারি সাথে কড়া করে চা| এই টিফিনটা মূলত কলেজের মর্নিং শিফটের ছেলেমেয়ে কিংবা সেইসব ভেন্ডরদের জন্য, যারা মাল বয়ে এনে বাজারে ঢুকেছে গত কাল রাতে| সকাল এগারোটা নাগাদ ভাত চাপে| হারান হোটেলের বাইরেটায় একটা ভিজে ফেঁসে যাওয়া গামছা পরে, থেবড়ে বসে আলুর খোসা ছাড়ায়| উড়িয়া ঠাকুর উনুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বিশাল কড়া চাপায়| উনুনের গনগনে আঁচে, কলকলে ধোঁয়ায় ভরে যায় চারিদিক| কিছুক্ষন পর থেকে সেই বাতাসে পুইঁ শাক কষার সুবাস এসে মেশে| গরম তেলে পিয়াঁজ ফোড়ন সাথে গোটা ধনে, লঙ্কা ছাড়ার গন্ধ|

পৌষের কোন হিম ধরা রাতে কুয়াশার সর সরিয়ে, মৃত্যু এসে ওর মাকে নিয়ে চলে গেছিল, কোন পা টা আগে ফেলেছিল, এখন আর মনে পরে না নিধির| শুধু মনে আছে তখন ওর বারো বছর বয়স, বয়ঃসন্ধির সবে শুরু| ওদের রানাঘাটের ক্যাম্পের টিনের দেওয়ালের গা ঘেঁষে উনুনের ধোঁয়ায় নির্দোষ বিষ শরীরে নিয়ে ওর মা রান্না করছে, পিছনে দুটো বিড়াল বসে লেজ নাড়ছে, পাশের ক্যাম্পে খালি গলায় গলা সাধছে খুকিদি, লাল শাকের রংটা কমলা দেখাচ্ছে কুয়াশা কেটে গিয়ে| এখনও কয়েকটা দিন মায়ের হাতের স্পেশাল পোনা মাছের ঝোল টা রাঁধে নিধি| কড়াই তে অল্প সর্ষের তেল দিয়ে মাছগুলোকে ভেজে নিয়ে, সেই তেলেই পিয়াজ-রসুন-টমেটো-আদাবাটা দিয়ে সমানে কষতে থাকে| খুন্তি নাড়ার সাথে সাথে, ঝুল কালির মাথা থেকে চুন সুরকি খসে পরে| কয়লার ধোঁয়ায় চোখ জ্বলতে থাকে নিধির| রানাঘাটের বাড়ির কাঁঠালিচাঁপা গাছটা ঢলঢলে চাঁদের পাটালি গায়ে মেখে, মৃত্যুমুখী অন্ধকারকে পিছনে ফেলে ফ্যাটফ্যাটে একটা ফণা তুলে এসে দাঁড়ায় নিধির সামনে|

দুপুরের খাওয়া পর্ব মিটতে মিটতে বিকেল চারটে| এর ফাঁকে গুপ্তবাবু ফিরে যান নিজের আর্মহার্স্ট স্ট্রিট এর বাড়িতে| হারান, ঠাকুর আর বাকি ছেলেপুলে এসময়টা একটু গড়িয়ে নেয়| নিধি কিন্তু দুপুরে ঘুমায় না| দুপুরবেলাটায় বাজারটার অন্য রূপ| লোকজনের আনাগোনা কমে আসে অনেক| মশলার দোকান গুলো থেকে ঠিক দুপুর দুটো বেজে সতেরো মিনিটে অচেনা একটা গন্ধ ভেসে এসে, নিধির নাক চোখ মুখ দিয়ে ভেতরে ঢুকে সজোরে টোকা মারে| একটা চাবুক মারা বাজারী হই হল্লা বাজারের মাঝখানের পেচ্ছাপখানার গন্ধটাকে চাপা দিতে চায়, উল্টে তাতে গুড় বাজারের তাল পাটালির চাক ভেঙে আজ্ঞাবাহী ধরণের একটা অতি আলো বা অতি শব্দের মাঝে ফ্যাকাসে হয়ে যায় চড়াই পাখিটার ঘুম| এই সমস্যা কাকেরও এই সমস্যা হোটেলের কড়িবর্গায় বাসা বাঁধা পাওয়রারও| গন্ধটা নিধিকে টেনে নিয়ে যায় বাজারের উত্তর দিকে| সেখানে দোকান জুড়ে ডাই করে রাখা শুকনো লঙ্কা, খেজুর, কাজু কিসমিস, বাতাসার স্তুপ| শব্দহীন,ক্লান্তিহীন ভাবে ঘুরে বেড়ানো কত মানুষ আছড়ে পরে, আবার উঠে দাঁড়ায় এই দিকে| শুঁটকির একটা পচনশীল টক গন্ধ সারা গায়ে মেখে নাক খুঁটতে খুঁটতে হেটে চলে একটি শিক্ষিত ধোপ দুরস্ত উন্মাদ| আকাশের নীল রংটা গড়িয়ে পরে তার পায়ের কাছে| জিতে যাওয়া-হেরে যাওয়া জীবনটার হিসেব কষতে কষতে আপন মনে বলে চলে, "পচে যাবে, সব একদিন পচে ফুলে যাবে| ব্যাকটেরিয়াগুলো এই দোকানটা থেকে ছড়িয়ে গিয়ে, পচা শরীরগুলো খুবলে খুবলে খাবে|" উত্তরদিকের কোনো আবর্জনা স্তুপের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিধির চোখদুটো বুজে আসে| এক অদৃশ্য প্রেতাত্মা এসে যেন ভড় করে তার উপর| নিধি ছাপাখানাটার পাশ দিয়ে গলির পথ ধরে, তারপর একসময় বড় রাস্তাটা পার করে এসে ‘সার্পেনটাইন লেন’ বরাবর খুঁজতে থাকে তার ছোটবেলার ভাতঘুমটা| সেটা বুঝি তখন ডুব দিয়েছে দুপাশের উঁচু উঁচু পুরোনো দিনের কলোনিয়াল বাড়িগুলোর মাঝের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা এক চিলতে আকাশের শূন্যতায়, নিশ্চিত ক্ষুধার সাথে প্যাঁচ কষতে গিয়ে ভোকাট্টা হয়ে পরে আছে পাশের ‘হুজুরীমল লেনে’| সেটাকে অক্সি অ্যাসিটিলিনের শিখায় গলিয়ে গয়না বানিয়ে ফেলছে সাতপুরোনো কোনো স্যাঁকড়ার দল|

জগৎ সিনেমায় বেশ কিছুদিন হলো শো বন্ধ যাচ্ছে| হল মালিকের সাথে স্টাফেদের আকচাআকচি চলছে কিছু নিয়ে| নিধি আজ দেখলো হলের বাইরের দেওয়ালে বিশাল বড় একটা হোর্ডিং ঝোলাচ্ছে একদল লোক| নিজেদের ভেতর খিস্তি খামারি করছে, রিকশাওয়ালা,বাসের কন্ডাকটর,বাজারের মেছুড়ে, বিহারী মুটেদের মুখের খিস্তি| নিধি দেখেছে অতি পরিচিত এই বাজারটার শরীর জুড়ে জটিলতর সমীকরণের এই যে জাল বোনে কত শত দুপুর-বিকেলহীন মানব তরঙ্গ, তাদের মুখের নিতান্ত বর্জিত অপশব্দই বলে দিতে পারে তাদের আবাস, জনপদ কিংবা কতটা ইতর অনুষঙ্গে এই দৈনিক উৎসবমুখরতার মানচিত্রে তাদের আগমন| এই চত্ত্বরে কেউ হয়তো মশলা নিয়ে এসেছে, কেউবা ত্রিপল পট্টি থেকে মাল নিয়ে গিয়ে লোকালে ব্যবসা করবে, কেউ বা এসেছে একুয়ারিয়ামের মাছ বা পাথর নিতে, আবার দু পয়সা লাভের আশায় কেউ ক্যানিং লাইন থেকে ঝুড়ি করে ফল নিয়ে এসে বসে পরেছে বাজারের বাইরেটায়| চিহ্নহারা কর্মব্যস্ত শিয়ালদাহ, বাস-ট্রাম, ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্টের সাউন্ডস্কেপের সাথে লোকগুলোর থেকে ভেসে আসা শব্দের টাকডুমাডুমের মাঝে পরে, এক জটিল বর্গক্ষেত্রের কোণ বরাবর বাহকহীন পালকিতে বসে দোল খেতে থাকে নিধি|
"হালায় লুঙ্গী তুইলা তর পোদ মারে নাই?", কথাটায় সম্বিৎ ফেরে নিধির| শব্দের অনুপ্রাণনে উপর দিকে তাকিয়ে দেখে, বাঁশের ভাড়ার মাথা থেকে একটা ছেলে, খৈনি-গুটখা খাওয়া কালো দাঁত বের করে হাসছে আর তলায় ওর বয়সী আরেকটা ছেলেকে কি যেন ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে| আশেপাশের জিজীবিষু জগৎটার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন এরা| বিশাল পোস্টারটার দিকে হিম হিম চোখে চেয়ে থাকে নিধি| এটা কোনো সিনেমার পোস্টার নয়| বাংলা যেটুকু পড়তে পারে তাই দিয়ে লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করে| পোস্টার টার এক পাশে একটা কাঁচাপাকা চুলের লোককে দেখে চেনা চেনা ঠেকে ওর| পোস্টারটার ডান পাশে কিসের যেন একটা লিস্ট, তাতে কিছু নাম| এর মধ্যে কয়েকটা নাম আগে শুনেছে নিধি| এগুলো সিনেমার নাম, ‘খারিজ’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘চালচিত্র’| ছেলেটার মুখে যেন খিস্তির ফোয়ারা| এটাই যেন ওর কাছে এখন জলভাতের মতন|শব্দগুলো বড্ডো কানে বাজতে থাকে নিধির| তলায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে এগিয়ে গিয়ে নিধি এবার জিজ্ঞেস করে, "ও ভাই শুনছ? এদিকে শুন|"
নিধিকে দেখে ছেলেটা মুখের হাসি থামিয়ে এগিয়ে আসে,"বলেন!" 
"এইডা কি ব্যাপার কইতে পারো?" 
ছেলেটার চোখে মুখে একটা অকিঞ্চিৎকর বিরক্তি খেলে যায়,"দূর বাল, এইসব হইলো বড়োলোকগুলার ধ্যাশডামো, ওই দাদুর বুইঝলেন শত বৎসর পূর্ণ হইলো. হালায় সেঞ্চুরি মারসে| ফিলিম বানাইতো, তাকে লইয়া নাচন কোঁদন হইবো| বুইড়া ফিলিম বানাইয়া কি ছিড়সে কেডা জানে! আমাগো কনো কামে আইসে বুড়া? কইতে পারেন?" 
নিধির চোখে একটা ভুতুড়ে স্বপ্নের ঝিম ধরা ঘোর লেগে আসে| ছবিটার দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে নামটা পরে নিধি, ‘মৃণাল সেন’| নিধির চোখের সামনে কালো জানালাটার ওপার থেকে একটা মুখ ভেসে ওঠে, ধরহীন একটা মুখ| হালকা ফুঁ দিলে উপর থেকে ধুলোবালি সরে গিয়ে মুখটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে| রাঙামাইমার মুখ, পৃথিবীর সমস্ত মিথ্যাবাদীকে একপাশে রেখে কোনো এক অন্ধকার বিকেলে তিনি নিধিকে ডাক দিচ্ছেন, "নিধু, অ নিধু, টিভিতে সিনেমা দেখাইতেসে, দেখবা না? তর লগে মুড়ি ভাইজ্যা রাখসি, আইস চাঁদ আমার|" মা মারা যাবার পর নিধি ছোট ভাই বোনদের নিয়ে কল্যাণী সীমান্তের মামাবাড়ি গিয়ে উঠেছিল| মামা ওদের খুব একটা দেখতে পারতেন না| অথচ নিঃসন্তান রাঙা মাইমা বুক দিয়ে আগলাতেন, খালি বলতেন “নিধু মোর প্যাটের ছাওয়াল আছিল গত জনমে| জনম জনম ফিরিয়া আইস চাঁদ এই অভাগীর কোলে|" 
চোখের পাতা ক্রমশ ভারী হয়ে আসে নিধির| পাতলা মধুর মত টলটলে বিকেলগুলোয় কানা ভাঙা অ্যালুমিনিয়ামের চায়ের কাপের উপর দিয়ে পিঁপড়েটা এদিক হয়ে ওদিকে চলে যেত| পাশের কারশেড থেকে একটা মালগাড়ি চলে যেত, অনেক্ষন ধরে দীর্ঘ্য একঘেঁয়ে একটা বিচ্ছিরি শব্দ করে| ঐ শব্দটার পর রোদের তাঁত পরে গেলে ফিরে আসতো অনিবার্য্য রোববারের বিকেল গুলো, মস্ত একটা সোনার ডিমের ভেতর দিয়ে| টিভির পর্দা জুড়ে তখন কেবল ধোঁয়া| উনুনের ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া, উঠতি ছেলের মুখের সিগারেটের ধোঁয়া, শ্মশানের চিতার ধোঁয়া| সেই দুকূল ছাপানো ধোঁয়ার মাঝে পুরোনো লেপ কম্বলের উপর সাবানগুঁড়োর মত ধামসে পরে থাকে নিধির অন্ধকার কৈশোর| কুয়াশা খিমচে হঠাৎ সেই ধোঁয়ার ভেতর থেকে উঁকি দেয় ওদের কলোনীর গদাই দা, অল্প বয়সে যে নকশাল হয়ে গেছিল| ওকে খুঁজতে একদিন পুলিশ এলো, কলোনী টা ঘিরে ফেললো চতুর্দিক দিয়ে| প্রচন্ড জোরে একটা শব্দ, জংধরা একটা স্লোগান, আবার শব্দ| ব্যাস, প্যালিওলিথিক যুগ থেকে একটা সংবেদনশীল আলো গড়িয়ে পরে নিধির চোখদুটো সাদা হয়ে গেল|  

সেদিন সন্ধ্যায় বাজারের ভিতর কালীমন্দিরটায় ফলাহারিণী উৎসব| সন্ধ্যে থেকেই শ্যামাসংগীত বাজছে| এবেলা তাই হোটেলও বন্ধ| হারান ব্যাটা কোথায় বসে গ্যাঁজা টানছে| নিধি মন্দিরে একটা প্রণাম ঠুকে জগৎ সিনেমার দিকে হাঁটতে শুরু করলো| দোকান পাট একটু একটু করে বন্ধ হতে শুরু করেছে সবে| সিনেমাহলের টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে নিধি সোজা জিজ্ঞেস করলো, “ইভনিং শো এর একটা টিকেট হবে?”
”আরে টিকিট লাগবে না, এটা সরকারী শো| ‘মৃণাল সেন রেট্রোস্পেক্টিভ’|” 
কথাটার মাথা মুন্ডু কিছু বুঝলোনা নিধি| ফ্রীতে সিনেমা! এও আবার হয়! চুপচাপ ঢুকে অন্ধকার হলে বসে পড়লো একটা চেয়ার দখল করে| হলে সর্বসাকুল্যে পাঁচটা লোকও নেই| অনেকদিন হল টা বন্ধ হয়ে পরে আছে, সিটগুলো ধুলো পরে গিয়েছে| ফাঁকা হলের সুবিধে নিতে ছেলে মেয়ে সব হলে ঢুকে কোনের সিটগুলো দখল করে নিয়েছে| এরই মধ্যে পর্দায় সিনেমা চলছে, “খারিজ”| সিনেমাটা নিধি দেখেছিল বহু বছর আগে| নিধির তখন কাঁচা বয়স| শেষ বিকেলের অতি বেগুনী রশ্মি তখন স্পর্শ করেনি ওদের ক্যাম্পের ভেতর চৌকির তলায় উপুড় করে রাখা কাঁসার বাসনগুলোকে| ছবিটাকে তখন খুব সহজ লাগেনি নিধির| দূরদর্শনের পর্দায় সেদিনও ‘পালান’ মরেছিল কলকাতা শহরের বুকে কোন এক হাঁড়কাঁপানো শীতের রাতে ভেন্টিলেটর বিহীন মৃত্যুকূপে, একটু উষ্ণতার আশায়| পালান আজ এই হলের মধ্যে আবার মরে, পালানদের জন্মই বুঝি হয় শুধু মরবার জন্য| মৃত্যুর আগের যে ব্যাথা ও বিষন্নতা, সেটা ওরা টের পায়না ঠিক করে| বড় অসাবধানী মৃত্যু| ৩০ ফুটের পর্দা জুড়ে পালান পুড়ছে, ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে গোটা হলটা| সেই নামগোত্রহীন ধোঁয়াটা কুণ্ডলী পাকিয়ে এই দমবন্ধ কালো ঘরটায় কাঁদতে থাকে, পালানের বাপের মুখ হয়ে| মৃত্যুর কম্পাঙ্ক ক্রমে স্থির হয়ে এলেও মৃত্যুবোধটা আত্মগোপন করতে পারে না কোন ভাবে| বেঙ্গল লজের প্রথম দিকের দিনগুলোর কথা মনে পরে যায় নিধির, কিংবা আরো আগের কথা, যখন ও বাজারের ভিতর দোতলা ভাঙা বাড়িটার এক কোণে পরে থেকে রাত কাটাত| কালাচ সাপের মত ঘুমহীন শীতের কোন রাতে বিহারী মুটে দুটো, মৃত্যুমুখী অন্ধকারটাকে গায়ে পেঁচিয়ে এগিয়ে এসেছিল ওর দিকে| এক ধাক্কায় ওদের ছিটকে ফেলে দিয়ে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসেছিল ও| মুহূর্তে শহরটার সব জাদুগরী উধাও হয়ে গিয়ে, নিধি ফিরে গেছিল রানাঘাট ক্যাম্পের ভিটেমাটি ফেলে আসা পোড়া লেগে যাওয়া জীবনে| গলাটেপা মধ্যরাতে বাজারের অলি গলি ঘুরে, হার ভাঙা শীতটাকে সঙ্গে করে মুখোশহীন পৃথিবীর ছবি এঁকেছিল খোলা আকাশের নিচে নীল রং ধার করে| 
রাত নটায় শো শেষ হল| পুরো হল জুড়ে তখন শুধু নিধি আর তার ঠিক বিপরীত গোলার্ধের শত বসন্ত পার করা একটি মানুষ ও তাঁর সৃষ্টি করা সার্বভৌম জীবন চেতনা| গত দেড় ঘন্টা ধরে যিনি চির বিচ্ছেদের দাঁড়ে নিধি কে টেনে নিয়ে গিয়ে, ওর জীবনের আকাঙ্খাকে আরো তীব্রতর করে তুলেছেন| নিধি এখন আরো তীব্র ভাবে বাঁচতে চায়, ওর বর্তমান আর ভবিষ্যতের আবর্তে| ঠিক এমনি ভাবে বাঁচতে নিধি শেষ কবে চেয়েছিল?
হল থেকে বেরিয়ে নিধি হোটেলে ফেরে না| আজ রাতটা এমনিতেও ঘুম হবে না| একটু পর বাজারের ভেতর মন্দিরের কীর্তন বন্ধ হয়ে হিন্দি গান চালিয়ে মদ খেয়ে উদ্দাম নাচ শুরু হবে| কখন থামবে কে জানে! অনেক রাতে ফিরে আসবে নিধি ওর চেনা জগতে| বাজার থেকে ধেড়ে ইঁদুরগুলো দৌড় দেবে, খেলার মাঠের গোলহীন স্টপারের মত| হোটেলের হেঁশেল জুড়ে এঁটো নিয়ে লোফালুফির প্র্যাক্টিস শুরু করে দেবে| নির্বাক দর্শক হয়ে সেই খেলা দেখবে নিধি| মনের ভেতর তপতপে একটা সেন্টিমেন্টাল মনস্তাপে, আরো ভালো দর্শক হয়ে ওঠার প্রস্তুতি নেবে|
কাল সারারাত ধরে নিধি ভেবেছে গুপ্তদাকে বলে জগৎ সিনেমায় যদি সবকটা বই ও দেখতে পেত! পয়সা তো লাগছে না| কিন্তু কি ভীষণ একটা উত্তেজনা! যেন খামখেয়ালী মধু তামস, সংস্কারহীন যজ্ঞ চালাচ্ছে পুরো জায়গাটা জুড়ে| সেই যজ্ঞের আগুনে ওর পুড়তে ইচ্ছে করে ভীষণ| ওর গলার কাছটা শুকিয়ে আসে| অস্বাভাবিক খিদেতে পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠে| মনে হয় গায়ে চাপানো ধার করা চামড়াটা ছিড়ে ফেলে দিয়ে, লালচে মাংসটাকে প্রত্যক্ষ করে| আবার একটা শব্দ হোক, হাজার মানুষের সমবেত কোরাস হয়ে সেটা রক্তারক্তি একটা কান্ড ঘটাক| ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘একদিন প্রতিদিন’, সব কটা সিনেমা নিধি দেখতে চায়| ওর নিশ্চল জীবনে গলগল করে প্রাণ ফিরে আসে যেন| সন্ধ্যের পরে ওর তো আর তেমন কাজ থাকে না হোটেলে, গুপ্তদা কেন ওকে ছুটি দেবেননা কদিন হাফবেলা করে! ইনসমনিয়ার রূপ ধরে এই কথাটা বার বার নৈতিকতা আর হকের সমকালীন সংঘাত হয়ে বাজারের চার দেওয়ালের মাঝে ধাক্কা খেয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে| জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিধি| ওর কণ্ঠ সময়ের কোন অদৃশ্য কোণ থেকে ওর মুখে মলত্যাগ করতে করতে উড়ে গেছে সংক্রান্তির দিকে|




মেয়েটা পাশের কলেজে পড়ে| রোজ সকাল-দুপুর বেঙ্গল লজে খেতে আসে| নিধিকে ‘কাকা’ বলে| মেয়েটা খেতে এলে আবদার করে এটা সেটা| মাছের মুড়ো খাওয়ার খুব শখ মেয়েটার| একটু বড় মাছ আনলে মুড়োটা টিফিন বক্সে ভরে দেয় নিধি| মেয়েটাকে দেখে মা মরা ভাইঝিটার কথা মনে পরে নিধির, কলেরায় অকালে চলে না গেলে আজ এই বয়সেরই হত| মেয়েটার বাড়ি মছলন্দপুরে| কলকাতার কলেজে পড়বে বলে বাড়ি ঘরদোর ছেড়ে এসেছে| ঠিক যেমন একদিন নিধি এসেছিল এই মায়ার শহরটায় ওর বেড়া টপকানো ইতিহাসটাকে একটা এলেবেলে ধূলিকণা দিয়ে ঢেকে ফেলে| নিধি নিজে ইস্কুলের গন্ডি পেরোয়নি হয়তো, কিন্তু পড়াশুনার বেশ কদর করে| কলেজের দিকে যেতে গিয়ে যে প্রকান্ড পুরোনো দিনের বাড়িটা, দুধারে দুটো পেল্লাই প্রাগৈতিহাসিক থামে ভর দিয়ে পার করে দিল কাগের ডিম বগের ডিম কত গ্রীষ্মকালীন সৌরঝড়, সেটা ইদানিং লেডিস পিজি হয়েছে| মেয়েটা ওখানেই থাকে| সারাদিন কলেজের পর রোজ সন্ধ্যেবেলা মেয়েটা টিউশন পড়াতে যায় রাজাবাজার, বেলেঘাটা| নিধিকে একদিন বলছিল, "ঘরে ঠিক কইরা চাল চড়ে না কাকু, বাপডা আমাগো ছাড়ি অন্য মাইয়ার লগে পলাইসে তা প্রায় এগারো বস্যর হইলো, বাকি ভাই বোনগুলা তখন খুবই ছোট আসিল| পড়ার খরচডা নিজেরেই চালাইতে হয়|" কাল রাতে মেয়েটা খেতে আসেনি, আজ সকালেও না| আজ দুপুরে শরীর-টরীর খারাপ নাকি জিজ্ঞেস করায় ওর বন্ধুটা বললো কাল রাতে নাকি পিজিতেও ফেরেনি মেয়েটা| ফোন করলে ধরছেও না| একটা মন খারাপের দুশ্চিন্তা সন্ধ্যা কিংবা মাঝরাতের হাওয়ায় উড়ে এসে জুড়ে বসলো নিধির নশ্বর জীবনে| এর আগে কারো জন্য এতো ভাবনা হয়নি ওর| মেয়েটা হয়তো ওর কেউ না, আবার এই শহরটার সাথেও কোন আত্মীয়তা নেই মেয়েটার| এই শহরের রাতের আলোগুলোর বুকে গজিয়ে ওঠা অনভিপ্রেত মাংসপিন্ডের মত মেয়েটার অবস্থান| হয়তবা ওর হারিয়ে যাবার খবর, পিঠে ডানা লাগিয়ে উড়তে গিয়ে চাপা পরে যাবে, গায়ে ফোস্কা পরা আলোর কোলাহলের মাঝখানে| এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কে ওর খবর নেবে? নিধি কি একবার মুচিপাড়া থানায় যাবে? কি উত্তর দেবে যখন পুলিশ ওকে জিজ্ঞেস করবে মেয়েটা ওর কে হয়? বাঙাল কথায় একটা প্রবাদ আছে, "আলায় বুলায় না, আমি কার মাউসা?" ভয়ানক একটা রাগ পায় নিধির| মনে হয় এই বিষণ্ণ, পরশ্রীকাতর, আত্মকেন্দ্রিক শহরটার মুখে গরম তেল ছুঁড়ে মারে| কিন্তু রাগটা কেন হয় ওর? প্রতিদিন এরকম কতশত মেয়েরা নিয়ম করে হারিয়ে যায়, এই শহরের পেটের ভেতর গজিয়ে ওঠা অর্ধেক আলো আর অর্ধেক অন্ধকারের ছায়াপথে| তাদের কজনকে পুলিশ খুঁজে বার করতে পারে? নচ্ছার হারানটা শুনে বলে "বুড়ো, তোমার ভীমরতি হইসে, ওই মেইয়ে কে লাগে তোমার? হাওয়ার খবর রাইখো বুড়ো? কলেজির ভিতর নেতা মন্ত্রীর ছেলেরা আইসে টপ মাগীদের লিয়ে ফুর্তি কইরে যায়| রাতেও নাকি কলেজির কমন রুম খুলি রেখি দেয় দারোয়ানডা| দেইখগে যাও এ মাগীও লাইনে নামিসে, পুলিশে ধরিসে নয়তো যমডায় ধরিসে|" হারানের হলদে দাঁতের নির্লজ্জ হাসিতে কাঠফাঁটা দুপুরে সারা শরীরে যেন আগুন ধরে যায় নিধির| সজোরে এক থাবড়া কষিয়ে দেয় হারানের গালে, "মুখ সামলে কথা কইস ছ্যারা, মাইয়াদের লগে কিকইরা কথা কইতে হয় জানস না?" 
"হ্যা তুমার মাইয়াডা তো সতী লক্ষ্মী ছিল| বুড়ো তুমি বইলা কিছু বুইল্লাম না অন্য কেউ হুইলে না!"
অসংবৃত মেজাজটা লাগাম ছাড়িয়ে দেশের ভাষা মুখ দিয়ে বার করে এনেছে নিধির| কিন্তু এই অনাম্নী অঙ্গনা কৃষ্ণবেনীর জন্য কেন এত রাগ আসছে নিধির? উত্তর ওর নিজের কাছেই নেই| হয়তো অনেক দিনের জমানো অনেক না বলা ক্রোধ-হিংসা-স্বার্থপরতা জমা হয়েছিল| জীবনের আলো অন্ধকার হাতড়ানো দৌড়টা শেষ করার আগে, দশমীর বিকেলে কাঁটাতার ছিঁড়ে ওর সমগ্র জাগতিক অনুভূতিগুলোকে পিছনে ফেলে উঠে আসতে চাইছে একটা উগ্র স্ফুলিঙ্গ|

বর্ষার শুরুতে বাজারটার গায়ের কাপড় ভিজে যায় ফুটো অ্যাসবেস্টসের জলে| প্রৌঢ়ার শরীরের বাড়তি মেদের মত বাজারটার ভেতর ফুটে ওঠে বেশ কিছু আঁশটে অনুষঙ্গ| ভোরের অন্ধকার চিরে হ্যালোজেন বাল্বগুলো থরে থরে সাজানো ইলিশের রুপোলী আঁশে ধাক্কা খেয়ে, আলো করে চারিদিক| শুটকির গন্ধটা এখন হোটেলে বসেই দিব্যি টের পাওয়া যায়, পেচ্ছাপখানার গন্ধটাও আরো তীব্র হয়| মশলার গন্ধটা আরো মিশে মিশে যায়| জামগাছটার শরীরে প্যারাসাইট এর মত ছাতা ফেলা কাকগুলো হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে শুরু করে দেয় ঠুমরী-টপ্পার ধ্রুপদী কলহ| সেদিন নিধি রোজকার মতন দুপুরের খাবারের তোড়জোড় করছে| হারানটা কদিনের জন্য বেপাত্তা ছিল, আজ হঠাৎ এসে হাজির, সাথে বছর ষোলোর একটা মেয়ে| শ্যামলা গড়ন, পানপাতার মত মুখ, তাতে টানা টানা ডিঙি নৌকার মত দুটো চোখ, নিটোল স্তন, উদ্যাপী নিতম্ব| মেয়েটাকে এক ঝলক দেখে নিধির পোকায় কাটা ফুটিফাটা সাদা পাতার মত জীবনের আগু পিছু তিরিশটা বছর চোখের সামনে সিনেমার মত ভেসে ওঠে| হারান বলে, "খুড়া বিয়া কইরা আইলাম দিশ থিকা|" হারান হাত বাড়িয়ে নিধির পা ছোয়, ইশারায় কাজল চোখের মেয়েটিকেও নিধির পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে বলে| নিধির হাতদুটো উপরের দিকে উঠে থমকে যায়|
"আজ লাল লাল করি মাগুর এর রসা রাইন্ধ খুড়া, সাথে সর্ষির তেল ছড়ায়ে আলু পোস্ত| আর খুড়া আমাদের থাইকবার ব্যাপারখানা তোমারে ম্যানেজ দিতি হবে| নতুন বৌ, বুঝই তো! এই কয়টা টাকায় কোথায় নিয়া তুলবো? লজের দ্বিতলে যে স্টোরখান খালি পইরা আসে, ঐখানেই থাইকবে লাহয়, কি কও?" ফুলকির মত হারানের কথার তোরে ভেসে যেতে থাকে নিধি, "ছ্যাড়া কয় কি? গুপ্তরে ম্যানেজ দিবে এই হারানিধি দাস? বুইড়া এককে নম্বরের কনজুস| ঘরখান স্টোর কইরা রাখসে, সিজনে কম পয়সায় ভাড়া দেওনের লগে| আর এ আপদ কয় কিনা ওই ঘরডাতে মাইয়া লইয়া থাকব!!" মনে মনে কথার জাল বোনে নিধি, সংখ্যাহীন চোখদুটো দিয়ে আপনমনে জ্যামিতিক অংক কষতে থাকে| মেয়েটার উপর মায়া লাগে তার| ইশারায় মেয়েটাকে ওর পিছু পিছু আসতে বলে, হোটেলের ভেতর ঢুকে নিধি তাকে নিয়ে দোতলায় ওঠে| স্টোর টা খুলতে বলে সামনে পরে থাকা নোংরা তক্তপোশটার দিকে ইঙ্গিত করে বলে, "মা, এইখানে একটু বস, আমি দেখি ঘরখানা একটু সাফা করাই|" মনে মনে ভাবে "গেলো জনমে তুই আমার কেডা আছিলি রে? তোরে দেইখ্যা এতো মায়া লাগে ক্যান?" দূর থেকে ঠাকুর চাকর ঝি সব হাঁ করে দেখছিল ওদের| এর মধ্যে বাজার থেকে কেঁদো একখানা মাগুর কিনে নিয়ে এসেছে হারান| মুহূর্তে খবরটা আশেপাশের দোকান ছুঁয়ে বাজারের ঘিঞ্জি গলিগুলো দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, মহাত্মা গান্ধী রোড আর বি বি গাঙ্গুলী স্ট্রিট এর ক্রসিং এ এসে থমকে দাঁড়াল| শিয়ালদাহ স্টেশন থেকে স্বস্তার ছাপা শাড়ীতে করে নবদম্পতির সাথে যে হাওয়াটা হোটেল অবধি এসেছিল সেটার কাঁধে করে গিয়েই উঠলো এবার ‘শসাবাবু’র কানে| নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় তার পায়ের ধুলো পড়লো বেঙ্গল লজে| অন্যান্য লোকের উপর বেশ একটু চোটপাট করে উপরে উঠে গেলেন তিনি, কিছুক্ষন পর টিউবেলাইটের ফ্যাকাসে আলোতে, উপরে ডাক পড়লো হারানিধি আর হারানের| 
"এসব কি শুনছি রে হারামজাদা, মেয়েছেলে নিয়ে ঢুকেছিস লজে? এতো সাহস তোর!! নিধির ছায়ায় নিজেকে কি মহারাজা ভাবছো বাঞ্চোৎ?" আচমকা গুপ্তদার মুখে খিস্তি শুনে চমকে ওঠে নিধি, চোখ কুঁচকে তাকায়, আজ ত্রিশ বছরে এই প্রথমবার| এতদিনে হয়তো লোকটা বাজারটার উপযুক্ত রোজগেরে হল| 
"কত্তা হারান টা ছেলেমানুষ, দুম করে বিয়ে করে ফেলেছে| কোথায় যাবে কচি বৌটাকে নিয়ে? এতদিন আপনার অন্ন খেয়েছে, বেইমানি করবেনা| মেয়েটাকে এই হোটেলেই কাজে লাগিয়ে দেব ঠিক দেখবেন, অসুবিধে হবে না| দিব্যি আমাদের সবার সাথে মিশে যাবে| হারানটার মত ওকেও খাওয়া পরা দেবেন| মাইনে লাগবে না" 
"আমি কি ধর্মশালা খুলেছি হারানিধি? যাকে পারবে এনে ঢোকাবে একেনে? ওরা যে বিয়ে করেছে কে সাক্ষী আছে? তোমার কথায় এই রাস্কেলটাকে কাজে রেখেছিলাম, সে কাম-কাজ যাই করুক, আমি কোনোদিন কিছু বলিনিকো, আজকে তো সীমা ছাড়িয়ে ফেলেছে| তোমার লজ্জা করছে না ওটার হয়ে দালালি করতে? না না এখানে জায়গা হবে নেকো| অত দরদ থাকলে ওই বাজারের দোতলার ঘরে রাখগে যাও গে| আমার ও ঘর সিজনের জন্য রাখা|" 
গুপ্তদার কথায় পুঁজময় অন্ধকার দেখে নিধি, তার চোয়াল তখন শক্ত| হারানটা রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে| 
"না কত্তা ওরা ঐখানে যাইবে না|", নিধির গলায় ক্রমান্বয়ী রেণুঝড় খেলে যায়| 
"এতো দরদ যখন নিজে বাড়ি ভাড়া করে নিয়ে রাখগে যাওনা বাপু, তোমার আদরের ধোন আর তার বৌকে| আর সাথে তুমিও বিদেয় হওনা কেন? আমার লজে এসব ছোটলোকি আমি বরদাস্ত করবো না|" 
"হ কত্তা তাই হইবো| রাস্তার কুত্তার তো আর ঘর হয়না| দেইখ্যা লইবেন, ওই মাইয়ারে আমি রাস্তায় ফেলাইয়া রাখুম না| আসি কত্তা ভালো থাইকবেন| বহুকাল আপনের নুন খাইসি, আপনের ব্যবসাডার বারোটা বাজামু না নিশ্চিন্তে থাইক্কেন| নইলে এই হারানিধি দাস এই বেঙ্গল লজের অনেক গুপ্ত কথাই জানে|" একটি ঠান্ডা পিস্তলসম নির্জনতা তখন ফুটে উঠতে আরম্ভ করেছে ঘরটার সিলিং জুড়ে তারই মাঝে নিধি শুনতে পায় আশেপাশের বাড়িতে দূরদর্শনে সিনেমা হচ্ছে| ধীরগতির ইন্টারনেটের মত শব্দগুলো ওদের ওর মগজে ঢিল ছোঁড়ে, আকাশ থেকে একটা দুর্বল তীর এসে ওর পায়ের সামনে পরে| তিরটির রং নীলই থাকবে যতদিন না ওটার অন্য কোন রং কেউ খুঁজে পায়|

বর্ষাটা এখন আরো অনেক গাঢ় হয়েছে| ভিজে হাওয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকে ওর সব সুখ দুঃখ| চৌকো করে মেঘ জমে বাজারটার উপর| ‘বাজারের উপর এক্ষুনি ভেঙে পড়বে’ এরকম অবস্থার দোতলার কার্ণিশটার গা ঘেঁষে বেরিয়ে থাকা অশথ্বর চারাটা, একদিন মহীরুহ হয়ে ওঠার শপথ নেয়| তারপর হয়তো সেটা একদিন বাড়িটাকেই ফেলে দেবে| শিয়ালদাহ স্টেশনের চার নম্বর গেটের কাছে ভাতের ঝুপড়ি খুলেছে নিধি, চাইলে বেঙ্গল লজের উল্টোদিকের বাজার চত্ত্বরেও খুলতে পারতো| এই বাজারে ওটাই নিধির আঁতুরঘর| কিন্তু বেইমানি নিধির ধাতে নেই| এখানে প্রত্যেকদিন আশেপাশের বিহারী দোকানদার গুলোর সাথে বেঞ্চি পাতা নিয়ে ঝামেলা লাগে, নিধি ঠান্ডা মাথায় সবটুকু সামলায়| রোজ সকালে হারানের বৌটা গামছা উপুড় করে ভাতের ফ্যান গালে, সেই ফ্যান পিটুলিগোলা রাস্তাটার উপর ইচ্ছেমত ছড়িয়ে গিয়ে অক্ষরলিপি আঁকে, ঊর্ণ জালের যাযাবরী চরিত্র অববাহিকায়| বিহারী ছোকরাগুলো প্রথম দিকে কটু নজর দিয়েছিল, মেয়েটা ভয়ে সিঁটিয়ে যেত| সবসময় নিধি পেছনে বটগাছের মত দাঁড়িয়েছে| কোমরে গামছা বেঁধে হারানিধি বড় কড়াইয়ে তেল ঢালে, পিঁয়াজ-রসুন-আদা ফোড়ন দিয়ে কষতে থাকে| কষে-কষার গন্ধে পথচলতি মানুষের আতশী অষ্টপ্রহর কাটে শ্রীহীন বিরিঞ্চি নগরযাপনে| হারান উবু হয়ে বসে কয়লা ভাঙে| ওরা তিনজন এখন সার্পেন্টাইন লেনের পুরোনো একটা বাড়িতে ভাড়া থাকে| বাড়িটায় সব ভদ্রলোকদের বাস, বলে কয়ে স্বস্তায় সিঁড়ির নিচে পুরোনো একটা ঘর ভাড়ায় পেয়েছে নিধি| আর যাই হোক এখানে মেয়েটার উপর আর কোন শকুনছায়া পরবে না| এখান থেকে ওকে আর যোগাযোগের অজানা ক্রসিংএ হারিয়ে যেতে হবে না| আসা যাওয়ার পথে একান্নবর্তী দৃষ্টিতে রাস্তার ওপারের বাজারটাকে দেখে নিধি| দেখতে দেখতে ওর প্রতিটা রন্ধ্রে ঈশ্বর প্রকট হয়ে ওঠেন| বর্ষার নিষিদ্ধ বারবেলাটায় যোগনিদ্রার শীর্ষে উঠে, ওরা স্বপ্ন দেখে মহাজাগতিক দর্শনে ওদের হোটেল বেঙ্গল লজ হয়ে উঠেছে| বেঙ্গল লজে গ্যাসে রান্না হচ্ছে| তৎপুরুষ খুন্তি নাদে, বিবস্ত্র বেগুনের নাগরিকত্ত্বকে মেনে নিয়ে রান্নাঘরদুটো মিশে গিয়ে, ক্রমশঃ একটা উদ্বৃত্ত দেশ হয়ে উঠছে| 
জামগাছের কোটর থেকে শ্রমিক মৌমাছিটা এদিক ওদিক উড়ে যায়| সামনের শীতে গাছটার নিচে লজের মিনি বেড়ালটা পোয়াতি হবে| বাজারটা কাকে ভালোবাসবে আর কাকে অবহেলা ছুঁড়ে দেবে এই ভেবে চুপ করে থাকে|







লাস্ট ট্রেনের যাত্রী
 
ছ ন্দা  চ ট্টো পা ধ্যা য়

প্রান্তিক স্টেশনে বসে শেষ ট্রেনের জন‍্য প্রতীক্ষায় রয়েছেন বিকাশ।  অন্ধকারের বুক চিরে দ্রুত  ধাবমান লৌহশকট একটার পর একটা বেড়িয়ে যাচ্ছে। ভীড়ে ঠাসাঠাসি। পাদানিতে পা রাখারও জায়গা নেই। এতো লোক কোথায়  যায়? বিকাশ বিড়বিড় করলেন,-" লাস্ট  ট্রেন কটায় ছাড়বে?"

হাসপাতালের বেডে শোয়া কোমায় আচ্ছন্ন বৃদ্ধ বিকাশের  মুখের ওপর ঝুঁকে  প্রশ্ন করে সেবিকা মায়া-" দাদু, কিছু বলছেন?"-  নিরুত্তর বৃদ্ধ। সেবিকা ছুটে গিয়ে  ডাক্তার সেনকে ডেকে আনে। বলে -   --"ডাক্তারবাবু, পেসেন্টের  ঠোঁট  নড়ছিলো, উনি  কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু কোমার পেসেন্টের তো জ্ঞান থাকে না?"--  ডাক্তার  বলেন -"অবচেতন থেকে হয়তো কিছু বুঝতে পারছেন। হয়তো ফিরে গেছেন অতীতে। ঈশ্বরের ইচ্ছায় হয়তো মিরাকল ঘটবে। অথচ  ওনার সন্তানদের কাছে সেটা হয়তো কাম‍্য নয়। এই কদিনে বাড়ির লোক তো কেউই আসেনি।"-- মৃদু হাসেন ডাক্তার। বিষন্ন সেই হাসি।    -"শোনো সিস্টার, আজ তোমাকে সজাগ থাকতে হবে। রাতটা কাটবে কিনা জানিনা। বি কেয়ারফুল।"  সেবিকা মায়া টুলটা টেনে বসে বিকাশের পাশে।

জীবনটা যেন ছুটন্ত এক রেলগাড়ি। বিকাশের মনে পড়ছে তাঁর প্রথম স্টেশনের কথা। যেদিন তিনি ভূমিষ্ঠ হলেন। মাতৃদুগ্ধের সেই অমৃত স্বাদ!! মায়া দেখে ঠোঁট  চাটছেন বৃদ্ধ। কয়েকফোঁটা জল মুখে ঢেলে দেয়। একটা ঘড়ঘড়ে শব্দ ওঠে -" আঃ, মায়ের দুধ।"- বিকাশের চোখের সামনে ছায়াছবির মতো ভেসে যায় স্টেশনের পর স্টেশন। শৈশব, কৈশোর এবং বর্ণময় যৌবন। কলেজের বন্ধুবান্ধব, সাহিত‍্য, কবিতার চর্চা।  নবপরিণীতা অবগুন্ঠনবতী প্রেমিকা ঊষা। ভরাভরন্ত সংসার, সন্তান। বড়ো মায়াময়!!

 চলমান জীবনশকট প্রান্তিক স্টেশনে আসতেই নেমে পড়লেন বিকাশ। ঊষার হাত ধরে নামানোর আগেই ট্রেন ছেড়ে দিলো। ঊষা বলে  গেলো-" লাস্ট ট্রেনে উঠে পড়ো, শেষ স্টেশনে আমি অপেক্ষা করবো।"- সেই অপেক্ষায় কেটে গেলো দশ বছর। আজ লাস্ট  ট্রেনের যাত্রী বিকাশ। শেষ স্টেশনে অপেক্ষায় আছে  ঊষা। -" আসছি আমি তোমার কাছে ঊষাআআ। "- 

মায়া দেখে ঘোলাটে চক্ষু  মেলে বৃদ্ধ একবার ঘরের চারপাশে যেন  কাকে খুঁজলেন। খুঁজে পেলেনও। এক অপার্থিব স্বর্গীয় হাসি ফুটে উঠলো  রোগক্লিষ্ট মুখে। জীবনের রেলগাড়ি অন্ধকার বিদীর্ণ করে ছুটে চলে গেলো অরুণোদয়ের পথে। ঊষায় আত্মসমর্পণ করতে। সেই লাস্ট ট্রেনের একমাত্র  যাত্রী বিকাশ।





শেষের সেদিন

পা ভে ল  ঘো ষ 

খাঁ খাঁ দুপুর। নিবেদিতা বৃদ্ধাশ্রমে মৃণালিনী একা বসে আছেন। শরীরটা কদিন ধরেই খারাপ। যেন মজে যাওয়া নদী। বইতে চাইছে না মোটেই। এই অশক্ত শরীরে একটা ইচ্ছা আঁকড়ে ধরছে মন জুড়ে। একমাত্র ছেলে অনির্বানকে অনেকদিন দেখা হয় নি। বউ, বাচ্চা নিয়ে সেই যে বিদেশ গেলো..! আর ফেরার নাম গন্ধই নেই।
"শুভ.., শুভ..." কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলেন আশ্রমের কেয়ার টেকারকে।
"যাই, দিদুন .." বলে শুভ হাসিমুখে সামনে এসে  দাঁড়ায় মলিনা দেবীর।
"কিছু বলবে..?"
"বলছি, ছেলে যে নাম্বারটা তোকে দিয়ে গেছিল,একবার ফোন করে দেখবি..? বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে রে ছেলেটাকে।শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।একবারটি ওকে দেখলে মরেও শান্তি পেতাম .."
"এক্ষুনি আসছি বড় ফোনটা নিয়ে। তুমি চিন্তা কোরো না।"
এইজন্যই ছেলেটাকে বড় ভালো লাগে মৃণালিনীর। গর্ভের নয়, কিন্তু গর্বের। কোনো বিরক্তি নেই, কোনো কড়া চোখে তাকানো নেই,হাসিমুখে শুধু ভালোবাসা দিয়ে যায় ছেলেটা।
ফিরে আসে শুভ কিছুক্ষণের মধ্যেই। নেট অন করে হোয়াটস অ্যাপে চোখ রাখে ও। অনির্বাণবাবু অন আছেন। মুখে এক চিলতে হাসি খেলে যায় ওর। দিদুর মুখের দিকে দৃষ্টি চলে যায় । একটা চাপা আনন্দ মুখমন্ডল থেকে যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে।
অডিও কল করতেই অপর প্রান্ত থেকে গম্ভীর কন্ঠে কেউ বলে ওঠেন,"হ্যালো..."
"অনির্বাণ স্যার, আমি শুভ বলছি নিবেদিতা বৃদ্ধাশ্রম থেকে। দিদু আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়। আপনি ধরুন একটু। আমার সামনেই আপনার মা বসে আছেন। ফোনটা দেবো..?"
শুভ এক নিঃশ্বাসে বলা শেষ করে।
"শোনো ভাই, আমি একটা ভার্চুয়াল মিটিংয়ে আছি। মাকে বোলো, রাত্রে ফোন করবো আমি,কেমন..?"
কেটে যায় ফোনটা।
"কি বলল রে আমার বাবু..?"
দিদুর মরমী গলাটা তীরের মত বেঁধে শুভর বুকে। মানুষ কি অদ্ভুত..! মায়ের সঙ্গে দু'মিনিট কথা বলার সময় নেই.!
চোখে জল চলে আসে শুভর। নিয়ন্ত্রণে রেখে বলে,"দিদু, তোমার ছেলে গাড়ি চালাচ্ছিল তো, তাই বললো, রাত্রে ফোন করবে।"  
চুপ করে যায় মৃণালিনী। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে ওর। আবার রাত পর্যন্ত অপেক্ষা..!  অবশেষে রাত আসে, রাতের পর সকাল। কিন্তু ফোন আসে না..!
প্রতিদিনের মত শুভ উঠে পড়ে ভোরের আলো থাকতে থাকতেই। কি ব্যাপার..? শোকার্ত শব্দগুচ্ছের একটা সমবেত ধ্বনি কানে আসছে..! দেখতে হয়। মশারি সরিয়ে খাট থেকে নামে শুভ। কাল রাতে বৃষ্টি তাপমাত্রাকে নামিয়ে দিয়েছে অনেকটাই। ঘুমটাও হয়েছে নিশ্ছিদ্র। একটা বড় হাই তুলে দরজাটা খোলে শুভ। একটা জটলা দেখতে পাচ্ছে ও। চোখ দুটো কচলে নেয় । দিদুর ঘরের সামনে না..? কিছু হলো নাকি..? কাল থেকেই শরীরটা খারাপ লাগছে বলছিল।
দ্রুত পা চালায় শুভ। ভিড়ের মধ্যে অধিকাংশই আবাসিক।
কি হয়েছে..? কিছু হয়েছে দিদুর..?
অম্লান জেঠুকে জিজ্ঞাসা করে ও।
"সকালে জবার হাত ধরে প্রতিদিন ভোরে জগৎগৌরী মায়ের মন্দিরে একবার মায়ের দর্শনে যান। প্রতিদিন নিজেই উঠে পড়েন। আজ জবা ডাকতে গিয়ে দেখে, দরজা হাট করে খোলা আর মাসিমা খাটে শুয়ে আছেন। ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না। মনে হয়..." এক নাগাড়ে বলে থামলেন অম্লান বাবু।
ওঁর কথা শুনতে শুনতে ঘরে ঢোকে শুভ। বিছানার চারিদিকে তখন আবাসিকদের ভিড়। মৃণাল জেঠু, অমলা মাসি, লক্ষী ঠাকুমা, শিশির কাকুরা একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে দিদুনের দিকে। যেন ঘুমিয়ে আছে দিদুন। ডাকলেই যেন বলে উঠবে, "শুভ.., এসেছিস..? বস ।"
একমাত্র মৃনালিনীকেই শুভ শুধু দিদুন বলে ডাকতো। তাহলে কি ছেলের অবজ্ঞা, অবহেলা গতকাল ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে টের পেয়েছিল দিদুন..? চোখ ফেটে জল আসছে শুভর। ছেলেবেলায় হারিয়ে যাওয়া দিদাকে মৃণালিনীর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল শুভ। 
এই চরম বিপত্তির মাঝেও হঠাৎ করে ওর মনে হয় অনির্বাণবাবুর কথা। কমপক্ষে মুখাগ্নিটাও যদি  মায়ের করতে পারেন, তাহলে দিদুন স্বর্গে গিয়েও শান্তি পাবেন। কিন্তু সুদূর লন্ডন থেকে ওঁর আসতেই তো দিন দুয়েক লাগবে। তাহলে তো পিস হেভেনে রাখতে হবে..!
"শুভ, মাসিমার ছেলেকে ফোন করো। খবরটা ওনাকে দাও।" আশ্রমের সেক্রেটারি প্রনববাবুর কথায় সম্বিত ফেরে শুভর।
"হ্যাঁ দাদা.." বলে প্যান্টের ডান পকেটে হাত ঢোকায় ও। গতকালের মত আবার নেট অন করে হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে কল করে অনির্বাণবাবুকে। এখন লন্ডনে গভীর রাত। পাবে কি দিদুনের সবেধন নীলমণিকে..?
সৌভাগ্যক্রমে অনির্বাণবাবুকে এক চান্সেই পেয়ে যায় শুভ।
"হ্যালো, অনির্বাণ স্যার বলছেন..?"
"বলছি। কিন্তু এত রাতে কেন..? সবে অফিসের কাজ সেরে শুতে যাবো, আর আপনি জ্বালাচ্ছেন..?"
"বলছি, আপনার মা গতকাল রাতে.."
"গতকাল রাতে কি..? অপেক্ষা করেছিল তো..? তাতে হলো কি..? মাকে বলে দেবেন.."
"ধুর মশাই, শুনুন না..! একটা খারাপ খবর আছে। আপনার মা কাল রাতে এক্সপায়ার করেছেন..!"মেজাজ হারায় শুভ।
"অ্যাঁ ..! কি বলছেন..? কালকেই তো.."
"শুনুন। তাই বলছি,একমাত্র পুত্র হিসেবে আপনি কি মুখাগ্নি করতে আসবেন..? আপনি সম্মতি দিলে আমরা পিস হেভেনে.."
"মা যখন নেই, তখন যাওযার কি খুব প্রয়োজন আছে..? আপনারাই দাহ করার ব্যবস্থা করে দিন। আমি না হয়.."
শুনে রাগে ফোনটা কেটে দেয় শুভ।
মনে পড়ে যায়, দিদুনের করুণ আর্ত কন্ঠস্বর,"বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে রে ছেলেটাকে।"





চা-পিত্যেস

শ র্মি ষ্ঠা

চা-পিত্যেস। সে এক ভয়ঙ্কর ত্রাস। তবুও সুন্দরী। চা-পাতা ব্যাপারটা স্ত্রী মনে হলেও, কাপের চাগুলো কেমন পুরুষ পুরুষ মনে হয়। এক ঝটকায় পৌরুষত্ব দেখিয়ে মাটিতে এনে ফেলে। যেমন ধরুন, এই পরশু রুচিরা'র বিয়ে হলো। তা নামে সে যতই রাবীন্দ্রিক মাধুরী ছড়াক, কাজে এবং সাজে আদ্যপ্রান্ত জুলিয়া রবার্ট। সে পরেছে শাড়ি! গতরাতে ফুলশয্যা ছিল। তার আবার নেকটারে অ্যালার্জি। মা একখানা স্লিভলেস, লং সাইড কাট সার্টিনের নাইট ড্রেস দিয়েছিলন বটে, কিন্তু কী অদৃষ্ট দেখুন, পরতে পারছে না! পরনের শাড়িও খুলতে পারছে না। যদি সকালে উঠে ঘর থেকে বেরোনোর সময় আর না পরতে পারে! স্লিভলেস পা গুটিয়ে জবুথবু তত্ত্বের প্লেটে লাল ছিলছিলে প্লাস্টিকের পেছনে থম মেরে পড়ে আছে। বেচারা ভিভানের কপালে প্রথম রাতেই চললো ফিসফিসানি কথার গুঁতো। মানে ইংলিশ ফুলঝুরি! এভাবে রাতটুকু তো কাটলো কোনওমতে! সোফায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে রুচিরা আর ফুলের শয্যায় ভিভান। বসে থাকতে থাকতে কখন যেন ঘুমে চোখ ঢুলে আসে ওর। তখন মনে হচ্ছিলো, ফুলরথে কোনও ফুলপরী ওকে আদরে সোহাগে বরণ করছে। সকালে দরজার ওপাশের ক্যালোর-ক্যালোর শব্দে তন্দ্রা কাটলে রুচিরা বাইরে আসে। 'আজ বৌমা চা করুক।'... রুচিরা এখনও ঠিক মনে রেখে উঠতে পারেনি সবাইকে। কে যে বললো! এদিকে 'রাত কা ন্যাশা আভি আঁখ সে গ্যায়া ন্যাহি…' বেশ বুদ্ধি করে সম্মোধন ছাড়াই স্মিত হেসে সম্মতি জানালো ও। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়। আজ বিকেলে থেকে হয়তো ফাঁকা হবে! মাসতুতো পিসিশাশুড়ি, জ্যাঠতুতো মাসি, কাকাতো দেওর, ননদের মামিশাশুড়ি ইত্যাদি বিভিন্ন তুতোদের ভিড়ে চোখে তুঁতে ফুল দেখার জোগাড়! গুটি গুটি পায়ে কিচেনের দিকে এগোলো। যথারীতি টি-মেকার নেই। তাতে কী! রুচিরা চা বানাতে জানে। এই যে এমনি এমনি বাসনে চা বানানোর ব্যাপার, এটা মা ক'দিন আগেই শিখিয়েছিলেন। রাইস-মেকারে গলা কোলয়ডিও ভাত, রুটি-মেকারে চিমড়া রুটি, স্যান্ডউইচ-মেকারে টাকরার মসৃণতায় অবিশ্রান্ত ধর্ষণ প্রত্যেক ব্রেকফাস্টে, প্রেসার কুকারে গলা টিপে মারা চিকেন আর একেকবার সিঁটির সাথে কক কক ক… এবং টি-মেকারে ঘোড়ার পেচ্ছাবসম চা। মা বলেছিলেন এতেই নাকি কাজ চলে যাবে। বেশিদিন কারোরই সইবে না। বাকি সময় তো অফিস! একটা বড় হাঁড়ি নিয়ে কাপ মেপে পনেরো কাপ জল ঢাললো। আসার আগেই চোখের আন্দাজে মাথা গুনে এসেছে। আভেন জ্বালিয়ে বসাতে যাবে, শাশুড়ি বলে উঠলেন, 'কে কী খাবে শুনে এসেছ তো!' রুচিরার ভ্রু ঘুচে এলো মদ্দ্যিখানে। চা-ই তো বললেন সবাই! শাশুড়ি যেন মা অন্তর্যামী! আবার বলে উঠলেন, 'বলছি কে দুধ চা, কে র-চা, কে চিনি বেশি দুধ কম, কে কড়া পাকের দুধ দেওয়া, কে চিনি কম দুধ কম পাতলা, কে চিনি কম নরম্যাল দুধ, কে দুধ ছাড়া চিনি ছাড়া, কে চিনি ছাড়া...' রান্নাঘরে ধপাস শব্দ। শাশুড়ি কড় গুনে বলছিলেন। সব ছন্নছাড়া হয়ে জববন্ধ। চোখ উঠলো কপালে! 'ওকে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দাও। এত ধকল কি আর নিতে পারে! বাচ্চা মেয়ে...' সবাই ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে শাশুড়ি নমিতাকে হুকুম ছুঁড়লেন, 'চা-টা বসিয়ে দিস।' নমিতা জানে বড় হাঁড়ির এক হাঁড়ি চিনি কম দুধ চা আর এক হাঁড়ি চিনি কম র-চা করতে হবে। বাকিটা যার যার নিজ দায়িত্ব সামলে নেওয়ার। খেল খতম। যাই বলুন, ভিভানের মা কিন্তু পরোক্ষভাবে বৌমাকে বাঁচিয়েই দিলেন!

          আমি চুপচাপ বেরিয়ে এলাম বাসী রজনীগন্ধার গন্ধ ছেড়ে। পাড়ার মোড়ে পাবলোদার চায়ের দোকানে তখন মাটির ভাঁড়ে গরম চা আর খবরের কাগজের উত্তাল তরঙ্গ। সাথে সাথে সকালের গার্গেল স্বরূপ মন এবং মস্তিষ্ক প্রক্ষালনকারী কাঁচা খিস্তি। সে আপনি যতই ধোয়া তুলসীপাতা হোন না কেন, চুম্বকের মতো আকর্ষিত হবেনই হবেন। আমাদের পাবলোদা কখনও নেরুদা কখনও পিকাসো হয়ে সেসব চা-জল্পনার কাঁচা ঘায়ে নুনের ছিটে এঁকে দেন। মেশিনের মতো কাঁচের গ্লাসের গায়ে চামচের ঘুটঘুটি চলতে থাকে। একটু পরের দিকে লাইলনের ব্যাগ বগলে হাজির হোন বংশী উপাধ্যায়। বয়স পেরিয়েছে পঁচাত্তর। 'চা দে রে নাড়ু... শেষ বয়সের কী যন্ত্রণা। সকালে দু'বারের বেশি চা চাইলেই বলে ডিভোর্স দিয়ে দেবে! কী হুমকি! এই বংশী উপাধ্যায়কে হুমকি দেয়! একসময় মিছিলের দায়িত্বে ছিলাম রেড রোডে। পার্টির কত বড় বড় কাজ করে দিয়েছি। আজ আমাকেই বাড়ির বাইরে এসে চা খেতে হয়! এই দেশের কিচ্ছু হবে না...' শুরু হলো গাজন। উপাধ্যায় জ্যাঠার কাছে পাবলো, নেরুদা হয়েই থেকে গেল। ওই নেরুদা থেকে নেরু থেকে নাড়ু। এই চায়ের দোকানটাও তো তাঁদের আমলেই করে দেওয়া! ভাবছিলাম ডিভোর্স মামলার কারণ শেষে কি না চা! এটা কত নম্বর ধারার আওতায় আসতে পারে!

               দ্বিতীয় কাপে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথেই ভেসে উঠলো কৌশানির সেই পুরোনো চা-বাংলোর ছবি। যুবক থাকতে গিয়েছিলাম। ত্রিশুল ছুঁয়ে এসে পড়া ঋজু একফালি রোদ। ওখানে তখন টুরিস্ট থাকতো। ভেতরে যাওয়ার রাস্তার দু'পাশে চা গাছ সারি সারি। তাদের কচি পাতা ছেঁড়া হয় না। সাদা ফুলের কেন্দ্রে হলুদ থোপ। বড় সুবাস। পাহাড়ের গায়ে খানিকটা গা-ঢলানি করে এসে আবার ঘনীভূত হচ্ছে উপত্যকায়। ওপরের জঙ্গলে ভেসে চলে যাচ্ছে চিকন ধোঁয়ার রেখায়। ওকে বড় ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। মনে হয় কোনও একলা পাহাড়ি কন্যার স্খলিত কস্তুরী। স্থানীয় লোকেরা বলেছিল ওগুলো ব্রিটিশদের সময়ে তৈরি করা বাড়ি। লাগোয়া গজিয়ে উঠেছে ছোট ছোট টুরিস্ট স্পট।

         সে যাইহোক, চা কত বনেদী সেটাই ভাবছিলাম। বাড়িতে কেউ এলেই এক কাপ চা থেকে বন্ধুর পকেট খালি করে চা আর প্রজাপতি বিস্কুট সাথে ফিল্টার উইইলস, কলেজ ক্যান্টিনে টেবিলে বসে ঘন্টার বেহিসেবি গুলতানি, অথবা পরীক্ষার আগে এক সিপ চায়ের সাথে উধাও ঘুম, শীতের ভোরে এক কাপ চা আর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কবিতা মাখা বা মুখ শুকিয়ে আসলেই 'মা, একটু চা দাও'... মা ও মাঝে মাঝে ভাবেন ভাগ্গ্যিস চা ছিল। তবুও তো এর কারণে, অকারণেই তাঁর ডাক পড়ে!.. বেচারা বংশী উপাধ্যায়! আসলে চা-খোরদের বিবাহের পূর্বেই ক্লিয়ার করে নেওয়া উচিৎ অপর পক্ষের ব্যক্তিটি চা খান কি না! মানে খোর কি না! নইলেই সাড়ে সব্বনাশ! সে যাই বলো বাপু, আমাদের ফেলুদাও কিন্তু ওই দার্জিলিং সেকেণ্ড ফ্লসেই মগজ খুলতেন! যদিও ছেলেবেলায় শুনেছি চা খেলে নাকি গায়ের রঙ কালো হয়ে যায়। বালাই ষাট! চায়ে তো আমার পেটের বেদনা, মনের বেদনা সবই কমে প্রফুল্ল এসে ভর করে। মন ও পেট বেদনা নয়, বেদানার দানার মতো টসটসে হয়ে যায়। কত গানের সৃষ্টি চা থেকেই! সেই মান্না দে'র কফিহাউস থেকে 'এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই' এর সুমন। কত অনুষ্ঠানের নামাঙ্কন হয়! 'এক কাপ চা এবং', 'চায়ের সাথে...' ইত্যাদি। চায়ের কাপ বানিয়ে কত কোটি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। তা সে চায়নারই হোক বা আফ্রিকার। সবই বোন চায়না। এই প্রসঙ্গে বলি, সে এক বিষম গোলযোগ। একবার গ্রামের মেলায় গিয়েছি। সাথে ছোট বোন। ঘুরতে ঘুরতে এক হরেক মালের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছি। চায়ের কাপের সব অপূর্ব বাহার। মনকাড়া রঙ্গিলা আঁকিবুঁকি। দোকানদার হয়তো আমার চকচকে লোভাতুর চোখ দুটো দেখে কিছু আন্দাজ করেছিল। অন্য কাস্টমারদের ফেলে আমার দিকেই এগিয়ে এলো। 'নিন দাদা। সব বোন চায়না।' আমিও হাতে নিলাম একখানা। দেখতে মাটির ভাঁড়ের মতো হলেও মাটির নয়। এদিক সেদিক দেখে ফেরৎ দিয়ে দেব আর কি! কারণ অদ্দুর থেকে কাপ টেনে আনতে চাইলে আমার মাতৃদেবী আমাকে পরিত্যাগ করবেন, এ কথা আমি বেশ জানি। হয় কাপ নয় আমি! বললাম, 'বোন চায় না'। শুনে সে আরও জোর গলায় বলে উঠলো, 'বিশ্বাস হচ্ছে না! বোন চায়না!'... আমি যতই তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করি না কেন যে 'বোন চায় না', সেও একই কথা রিপিট করে যাচ্ছে, 'বোন চায়না'। বেশ অনেকক্ষণ বচসার পরে বোনের কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে আমার বোধোদয় হয়েছিল ব্যাপারটা। 

একবার হাঁক ছাড়লাম, 'কী গো পাবলোদা! আর কত ঘুটবে! দাও'। উত্তর এলো, 'সবুর করো। আজ চা-দিবস। ইস্পেশাল দিচ্ছি।' আমি তো অবাক! পাবলোদা কী করে জানলো! পাবলোর উত্তর, 'কীভাবে জানলাম ভাবছো তো! গতকাল লজে নেমতন্ন খেতে গেলাম যে, নতুন বৌদি উইশ করেছে হ্যাপি টোয়েন্টি ফাস্ট...' আমি ভাবলাম, যাকগে, ফার্স্ট আর ফাস্ট যাইই হোক না কেন, পাবলো'র চা দুটোই। ফার্স্ট এবং ফাস্ট। বংশী উপাধ্যায়ের কথায় 'ফাস্টুকেলাস'। ওদিকে রুচিরার জ্ঞান ফিরেছে তো! জয়গুরু। তৃতীয় রাউণ্ড শুরু। এটা পাবলোদার থেকে একদম ফ্রি ট্রিট। 
সুউউউউপ... আহাঃ...

(শব্দ সংখ্যা: ১১৪৮)





গ্রন্থকীট
 
ত প ন  ম ন্ড ল

ঘরখানির মেঝেতে এলোমেলো বই ছড়িয়ে তারই মাঝখানে ইতিহাস  অনার্সের ছাত্র বিমল সামন্ত আনমনা  বসে আছে। সপ্তাহ দুই আগে কলেজ লাইব্রেরী থেকে আনা চিনা গ্রন্থ ডায়মন্ড সূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বইয়ের টেবিলে  তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না। অথচ দিন কয়েকের মধ্যেই বইটি কলেজ লাইব্রেরীতে জমা দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বই জমা না দিতে পারলে ভালো রকম ক্ষতিপূরণ তাকে বহন করতে হবে।

বিমল সামন্ত পাড়ার বকাটে ছেলেদের থেকে নিজের দূরত্ব বজায় রেখে চলেন। স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই বললেই চলে। স্কুল ফাইনাল দেওয়ার পর বন্ধুদের অনেকেই জেলার বিভিন্ন স্কুলগুলিতে ভর্তি হয় । তাদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। কলেজে পড়া চলাকালীন সময়ে দুই একজন নতুন বন্ধু তৈরি হয়েছে এই যা।

বিমল সামন্ত একগুঁয়ে প্রকৃতির। মানুষের সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠ হয়ে মেশে না । টিভি বা মোবাইলের প্রতি ততটা ন্যাক নেই তার । সারাক্ষণ রকমারি বইয়ের প্রেমে মজে। বইয়ের সঙ্গে দারুন বন্ধুত্ব তৈরি করেছে সে। তামাক বিড়ি সিগারেটের প্রতি একরকম বিদ্বেষ তৈরি করেছে। নেশা বলতে নতুন বা পোকায় খাওয়া পুরাতন বইয়ের গন্ধ অনুভব করা। বিমল সামন্ত প্রকৃতই যে একজন গ্রন্থকীট।

বিমল সামন্ত নিজের ঘরটাকেই বইয়ের আস্তানায় পরিণত করেছে। তার ঘরে পরিবারের কোন সদস্যই তেমন প্রবেশ করে না। তার খাটের তশকের চারপাশে বই  স্তূপে স্তূপে পড়ে । বিমল সামন্তের সহযোগিতায় নিজেদের অস্তিত্বকে যেন টিকিয়ে রেখেছে তারা। শুধুমাত্র বিমল তশকের যে স্থানটিতে নিশিনিদ্রাতে মেতে ওঠে সেটুকু স্থানেই কেবল ফাঁকা।

বিষন্ন মনে আজ বিমল সামন্ত বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বসে আছে । তার মনে হল ছোট ভাই অমিয় মনে হয় বইটি নিজের কাছে রেখেছে । কিন্তু খাবার টেবিলে অমিয় বই নেওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। সে জানায় ওই ঘরের দরজা সব সময় বন্ধ থাকে । বিমল বই পাওয়ার বিষয়ে হতাশ হলো।

বিমল মনে মনে বলল,সত্যিই তো তার ঘরে তো তার অবর্তমানে তালা পাহারাদার হিসেবে কাজ করে।

ডায়মন্ড সূত্রের কয়েকটি অধ্যায় সে পাঠ করেছে। এই বইয়ের আরো কিছু বিষয় তার জানা বাকি আছে । বইটি মনে হয় তার হাত ছাড়া হল।
       
কয়েকদিন পরে সে কলেজ স্ট্রিটের পুরাতন মার্কেটে উপস্থিত হলো। নতুন মার্কেটে চীনা ঐ প্রাচীন গ্রন্থ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অগত্যা পুরাতন মার্কেটেই তার একমাত্র সম্বল। সে মনে মনে ভাবল, ডায়মন্ড সূত্র এখান থেকে কিনে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে বাকি অধ্যায় গুলো পড়বে। তারপর কলেজ লাইব্রেরীতে ফেরত দেবে।

হতাশ হতে হলো। পুরাতন মার্কেটের কোন দোকানেই ডায়মন্ড সূত্রের অস্তিত্ব নেই। পাগলের মত এ দোকান থেকে ও দোকানে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। বিমল সামন্তের মাথা কাজ করছে না । কত প্রাচীন গ্রন্থ যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করে রেখেছে কলেজ স্ট্রিটের পুরাতন মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। অথচ ডায়মন্ড সূত্রের হদিস তারা দিতে পারল না।

বিকেলের দিকে নিরাশ হয়ে বিমল সামন্ত বাড়ির পথ ধরল। বড়ই মন মরা দেখাচ্ছে তাকে। চুলগুলো উসকো খুশকো। রৌদ্রে পরিষ্কার মুখ পাংশু হয়ে গেছে।

শিয়ালদহ ওভারব্রিজের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে সে। কত নতুন দোকান হয়েছে। আধুনিক সরঞ্জামে দোকানগুলি রঙিন হয়ে উঠেছে। মানুষের চাহিদা প্রতিনিয়তই নতুনের প্রতি। 

এসব ভাবতে ভাবতে সে এগিয়ে চলেছে । হঠাৎ তার চোখে পড়ল সত্তর ঊর্ধ্ব এক ব্যক্তি তালপাতার পাখা নিয়ে নিজের শুকনো শরীরে শীতল বাতাসের পরশ লাগাচ্ছে । সে পুরাতন বই পত্র নিয়ে বিক্রির জন্য বসে আছে । বইগুলোর উপর ধুলোর আস্তরণে লেখাগুলি প্রায় ঢাকা পড়েছে । খদ্দেরের ছিড়ে ফোটা নেই । কেবল দু-একটি মাছি ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে । বিরক্তকর গাড়ির হর্নের শব্দ আর কালো ধোঁয়ার সাম্রাজ্যের মধ্যেও বৃদ্ধ চুপচাপ শান্তভাবে বসে আছে। পাশের দোকানগুলোতে কত না ভিড়। অথচ বৃদ্ধের বই এর দোকানে শুধু মাছিরাই ভিড় জমাচ্ছে।

বিমল সামন্ত এক বুক আশা নিয়ে বৃদ্ধের কাছে এসে দাঁড়ালো । বৃদ্ধের পাশে সাজানো বইগুলি যেন বিমল সামন্তকে আপন মনে করে ডাকেছে। তারা যেন আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করতে চায় বিমল সামন্তকে।

বৃদ্ধকে নমস্কার করে বিমল সামন্ত বলল, আপনার কাছে চীনা প্রাচীন গ্রন্থ ডায়মন্ড সূত্র পাওয়া যাবে কি?

বৃদ্ধ ফ্যালফ্যাল করে বিমল সামন্তের দিকে তাকিয়ে রইল।

বিমল সামন্ত ডায়মন্ড সূত্র আছে কিনা পুনরায় জানতে চাইলে। 

বৃদ্ধ কোন উত্তর করল না। শুধুই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

বিমল সামন্তের বুঝতে বাকি রইল না। বৃদ্ধ কানে শুনতে পান না। শুধু চোখে দেখতে পান ।

বিমল সামন্ত চট করে নিজের ব্যাগ থেকে একটি কাগজ ও পেন বের করে তাতে ডায়মন্ড সূত্র পাওয়া যাবে কিনা লিখে বৃদ্ধের হাতে দিল।

বৃদ্ধ একদৃষ্টে লেখাটির দিকে দেখতে থাকলো । তারপর বিমল সামন্তের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, বইটি পাওয়া যাবে। দীর্ঘ ১০ বছরে এই বইয়ের কোন খোঁজ কেউ নেয় নি। আপনি এত বছর পরে খোঁজ নিলেন।

বৃদ্ধ অনেক সন্তর্পণে ডায়মন্ড সূত্রটি জীর্ণ বইয়ের স্তূপ থেকে ধীরে ধীরে বের করে বিমল সামন্তর হাতে দিলেন। বিমল সামন্তের হৃদয়ে তৎক্ষণাৎ এক অজানা আনন্দের বিদ্যুৎ ঝলক উদিত হল। সে বইয়ের দাম মিটিয়ে বৃদ্ধকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রিয় বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে আনন্দ তৃপ্তি নিয়ে গুটি গুটি পায়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

আশপাশের চিত্তাকর্ষক রঙিন দোকানগুলিতে হাজারো মূল্যবান দ্রব্য সযত্নে শোকেস গুলি দখল করেছে। দোকানের শোভা বাড়িয়েছে। আধুনিক যুগের সৌখিন মানুষ ওই মূল্যবান বস্তুগুলির নেশায় পাগল। ভিড়ের ঠেলায় সেখানে ঢোকার কোনো জো নেই। কত না বাহারী সৌখিন দ্রব্যের ঘনাঘটা। বিপুল চাহিদা। আরও চাহিদা! শুধু যোগান দিতে পারলেই হলো।     

এদিকে বৃদ্ধ বিপুল ধূলিকণার  সাগরে বসে আরো এক গ্রন্থ কীটের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে বসে। হয়তো আবারও একদিন আরো এক বিমল সামন্ত বইয়ের খোঁজে তার কাছে উপস্থিত হবে।





পারিজাত ফুলগন্ধ

মী না ক্ষী  চ ক্র ব র্তী  সো ম

ব‍্যস্ততায় জীবনের অনেকটা সময় কেটে গেছে শুভাকাঙ্খীর। যাপনকথার পাতা ভরে ছিল সময়ের অপ্রতুলতায়। কতকাল আগে লেখাপড়ার পাট চুকেছে, সেই থেকে চাকরির  ঘেরাটোপে জীবন এগিয়ে গেছে তরতর করে। আজকাল তুখোড় ব‍্যস্ততায় যোগ হয়েছে ফেসবুক, হোয়াটস্ অ‍্যাপ ইত্যাদি। সত্যি বলতে সোশ্যাল মিডিয়ায় শুভাকাঙ্খীর সময় কেড়ে নিয়েছে অনেকটা। তবে সে এটাও মানতে বাধ্য হয়েছে যে সম্পর্ক জুড়তে জুড়ি নেই সামাজিক মাধ্যমগুলির। লোকে কত দুর্নাম ছড়ায় সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব নিয়ে! যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে হবে। সরকারি নির্দেশাবলি সেই সোশ্যাল মাধ‍্যমেই যাতায়াত করে যখন তবে আর ছ‍্যুৎমার্গে কাজ কি? সামাজিক মাধ্যম শুভাকাঙ্খীর কাছে সব পেয়েছির দেশ। রীতিমতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে সে এই মাধ্যমের সাথে। ওর জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে জুড়ে গেছে দীর্ঘসময় ধরে হারিয়ে যাওয়া পুরোনো সব সম্পর্ক। সবচেয়ে বড় পাওনা পেয়েছে সে শুভলক্ষ্মীকে পেয়ে। পরস্পর পরস্পরকে খুঁজে বের করেছে ফেসবুকে। তারপর যোগাযোগের জন‍্য নম্বর নিয়ে ঝালিয়ে নিয়েছে পুরোনো বন্ধুত্ব। 

নামের কিছুটা সাদৃশ‍্য থাকায় ছোটবেলা খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল শুভলক্ষ্মীর সাথে শুভাকাঙ্ক্ষীর। নাম ধরে ডাকতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলতেন শিক্ষকরা পর্যন্ত। শুভলক্ষ্মীর বাবা চাকরিসূত্রে বদলি হয়ে এসেছিলেন শুভাকাঙ্ক্ষীদের পাহাড়ি শহরে। চিঠিপত্রের মাধ্যমে সেই ছোটবেলার বন্ধুত্ব জারি ছিল ভিন্ন শহরে থেকেও। চিঠিপত্রের যোগাযোগ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েও ব‍্যস্ততার প্রকোপে হালকা হতে হতে স্তিমিত হয়ে গেছিল একসময়। সংসার আর চাকরির ঘেরাটোপে শুভাকাঙ্ক্ষীর সময় কমে আসে জাগতিক নিয়ম মেনে। সংসারের চারিসীমা যখন সময়ের সুতোয় বাঁধা, সেরকম সময়ে চিঠিতে সম্পর্ক জারি রাখা অসম্ভবের নামান্তর। 

কিন্তু সবধরনের ব‍্যস্ততাও স্তিমিত হয় কোনও একসময়, তখন অবোধ বুঝতে শেখে, নিজের কাজটুকু গুছিয়ে করতে জানে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মন্ত্রগুপ্তি পাঠ করে। ফিরে দেখা সময়গুলো মনের সিল‍্যুয়েটে ভেসে ওঠে, ব‍্যথাতুর স্মৃতিচারণ সাথি হয় অবসর সময়ের। সেরকম এক বিচিত্র সময়ের আবরণে অস্থির যাপন ঘিরে যখন উদাস সময় চাপ দেয় স্মৃতিতে, তেমনি সন্ধিক্ষণে সামাজিক মাধ্যম যেন ব‍্যাপক হারে মুক্ত হাওয়া বিলিয়ে দেয় শুভাকাঙ্ক্ষীর জীবনে। ফেসবুক খুলে দেয় সম্পর্ক পুনর্নবীকরনের কপাট। অনেক বছর পর যোগাযোগ হল শুভলক্ষ্মীর সাথে ভার্চুয়ালজগতে। একসময় যাকে একদিনের জন‍্য না দেখে থাকা অসম্ভব ছিল সেই তাকেই সময়ের ফেরে ভুলে গিয়েছিল।  

সময় নেই থেকে প্রচুর সময়ের ধারাবাহিক যাত্রায় উদ্ধারের পোতবক্ষে দেখা দেয় প্রযুক্তিবিদ‍্যার জয়ধ্বজা। পৃথিবীটা ছোট হয়ে বোকাবাক্স থেকে হাতের মুঠোয় বন্দি। দিনরাত্রির ব‍্যবধান ঘুচিয়ে দূরকে কাছে নিয়ে এসেছে। ন‍্যানো সেকেন্ড সময়ের পলকে হাতের মুঠোয় চলে আসে বিশ্বসংসারের যাবতীয় সূচনা। স্রোতে ভেসে যেতে হয় ইচ্ছেয় অথবা অনিচ্ছেয়। সেই কত আগে পড়াশোনায় যতিচিহ্ন এঁকে দেয়া বিদ‍্যালয় পরম আদরে ডেকে নেয় অ‍্যালুমনির সভাঘরে। হারিয়ে যাওয়া বাল‍্যবন্ধুদের সাথে দেখা হয় বয়সের গভীরতম খাদের ওপারে দাঁড়িয়ে, অবাঞ্ছিত মেদের ভারে রূপোলি চুলের ভিড়ে। স্কুল কর্তৃপক্ষের অসীম আগ্রহে হোয়াটস্ অ‍্যাপ গ্রুপে জড়ো হয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সহপাঠীরা। প্রিয় বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের রাস্তা প্রশস্ত করে দুয়ার খুলে দাঁড়ায় স্কুলের রি-ইউনিয়ন। ছুটে এসেছিল বেশিরভাগ বন্ধুরা। শুভাকাঙ্ক্ষীর ছোটবেলার স্মৃতিতে শুভলক্ষ্মী প্রবলভাবে জড়িয়ে। কিন্তু সেই শুভলক্ষ্মীই আসেনি একবারও। 

এবার কোন অনুষ্ঠান ছাড়াই আসবে শুভলক্ষ্মী। নিছক বন্ধুর সাথে নিজের মত করে দুটোদিন কাটিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে সে। অনেক বছর পর ভার্চুয়াল জগত ছেড়ে চাক্ষুস দেখা হবে দুই বন্ধুতে। হোয়াটস্ অ‍্যাপে লোকেশন নিয়ে এবং ফোন করে শুভাকাঙ্ক্ষীর বাড়িতে পৌঁছে গেল চিরকালের স্মার্ট শুভলক্ষ্মী। শুভলক্ষ্মীকে দেখে জড়িয়ে ধরল শুভাকাঙ্ক্ষী। আনন্দ অপার দুজনারই। এখন সে কলকাতার বাসিন্দা, থাকে নিজের ফ্ল‍্যাটে। অনেক বছর পর দেখা হওয়াতে ওরা ভুলে গেল বর্তমান। কথাবার্তায় ধরে রাখল ফেলে আসা নিবিড় ছোটবেলা। গল্পে আড্ডায় মশগুল হয়ে রইল দুই বন্ধু। 

বাবার সাথে নানা জায়গায় পড়াশোনা করে শুভলক্ষ্মীর চালচলনে ছিল টানটান স্মার্টনেস। স্কুলের কো-ক‍্যারিকুলার অ‍্যাক্টিভিটিজে উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল তার। ছোটবেলাতেই যথেষ্ট প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিল সে প্রতিটি অনুষ্ঠানে। বিয়ে করে সংসার করায় বরাবরের অনীহা ছিল মেধাবী শুভলক্ষ্মীর। বিয়ের জন‍্য অনেক চেষ্টা করেছিল ওর বাড়ির লোকেরা। কিন্তু ক‍্যারিয়ার সচেতন শুভলক্ষ্মীকে কোনমতেই রাজি করানো যায়নি। সে খুব ভালো করেই জানত যে তার রূপের আগুনে ঝলসে যায় অনেক পুরুষ। প্রেমের ছোঁয়া পেতে তারা শুভলক্ষ্মীর সান্নিধ্যে এসে তৃপ্ত হয়। অনেক প্রেমিকপ্রবর তো বিয়েই করেনি তার প্রেম তপস‍্যায় ব্রতী হয়ে। এখনও তারা শুভলক্ষ্মীর প্রেমে দেবদাস হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। দুইবন্ধু মিলে সেসব দিনের কথাগুলো আরও একবার ঝালিয়ে নিয়ে মজা পেয়েছে ওরা। 

শুভলক্ষ্মীর হাসিতে সেই ম‍্যাজিক ছোঁয়াটা যেন পায়না শুভাকাঙ্ক্ষী। ছোটবেলার বন্ধুকে পেয়ে প্রজাপতি ওড়ে তার মনের আকাশে। অথচ আবছায়া উদাস হাওয়া উঁকি দিয়ে যায় শুভলক্ষ্মীর কথাবার্তার ফাঁকে। স্বাভাবিক ছন্দ যেন কেটে যাচ্ছিল কোথাও। উচ্ছাসহীন গালগল্পে কোথায় যেন খটকাগুলো হোঁচট খেয়ে যাচ্ছিল বারবার। কিছু কথা সযতনে এড়িয়ে যায় শুভলক্ষ্মী। গভীর রাতে দুই বাল‍্যবন্ধু পাশাপাশি শুয়ে। গল্পের বেলাগাম ঘোড়া ছুটছিল তীব্রবেগে। সারাদিনের ধকল শেষে নিদ্রাদেবী ভর করে শুভাকাঙ্ক্ষীর দুইচোখে। 

গভীর রাতে শুভাকাঙ্ক্ষীর মনে হল কেউ যেন ফোঁপাচ্ছে। ঘুমচোখে ঠাহর করা যাচ্ছে না শব্দের উৎস। কিছু সময় যেতে একটু ধাতস্থ হতেই মনে হল ওর পাশে শুয়ে থাকা শুভলক্ষ্মী বসে আছে বিছানায়। তাহলে সে কি জেগে রয়েছে এতসময়! ধড়মড় করে উঠে বসল শুভাকাঙ্ক্ষী। পেছন ফিরে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। ওর পিঠে আলতো হাত ছোঁয়াতেই কান্নার দমক বেড়ে গেল। "কি হয়েছে তোর! বল, আমাকে খুলে বল তোর কী অসুবিধা হচ্ছে" উদ্বিগ্ন হয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী জানতে চাইল। বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল শুভলক্ষ্মী। কান্না থামিয়ে বলল, "বলব, তোকে সব বলব বলেই তো এতদুর ছুটে এসেছি। সময়ের সাথে সাথে মনের কথা বলার জায়গা সীমিত হয়ে গেছে আমার। মা বাবা গত হয়েছেন, সে কথা তো তুই জানিস। ভাই বোনদের সংসারে ঝামেলার কথা ঢেলে অশান্তি দিতে চাইনা।" আরও একটু থেমে একা একাই যেন জবাবদিহি করছিল, "দেরি করে নেওয়া বিয়ের সিদ্ধান্তটাই মনে হয় ভুল হয়েছিল।" 

গভীর রাতে ফিসফিস করে এক নারী তার যাবতীয় ব‍্যথার ডালি মেলে ধরছে আরেক নারীর কাছে। পরতে পরতে বিস্ময়ের পাতা খুলে যাচ্ছে  শুভাকাঙ্ক্ষীর সামনে। নিবিষ্ট মনে সে শুনেছে ফ্ল‍্যাশব‍্যাকে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথন। গ্র‍্যাজুয়েট হয়েই মনের মত একটি চাকরি জুটে যায় শুভলক্ষ্মীর। ভীষণ ব‍্যস্ততায় কাটতে থাকে দিনগুলো। প্রমোশন হলেই বদলি হয়ে নতুন জায়গায় চলে যেতে হত তাকে। অনেক বছর পর পোস্টিং হল যে জায়গায় সেখানে মাতৃভাষায় কথা বলতে লোক খুঁজতে হয়। তবে অনেক ভাষায় কথা বলতে অভ‍্যস্ত শুভলক্ষ্মীর অসুবিধা হয়নি তেমন। 

এমন এক সন্ধিক্ষণে আদিত‍্য এসে যোগ দিল সেই অফিসে। বয়সে বছর দুয়েকের ছোট আদিত‍্যের সাথে সম্পর্ক দানা বাঁধল অচিরেই। জীবনের একটা দীর্ঘসময় প্রেমের সৌরভ ছড়ানোর আগেই নির্মমভাবে মুছে ফেলত শুভলক্ষ্মী। এখন সেসব কথা ভাবলে হাসি পায়। অথচ চল্লিশের ঘরে পা দিয়ে শুভলক্ষ্মীর প্রতি মদনদেবের অযাচিত করুণা হল। আদিত‍্যের সান্নিধ্য তাকে রঙিন জীবনের ছাড়পত্র এনে দিল প্রথমবারের মত। মা-বাবা অবসর জীবনযাপনে অভ‍্যস্ত হয়েছেন ততদিনে। ভাইবোনেরা সংসারী হয়েছে অনেকদিন আগেই। তাই অনুমতি দেওয়া অথবা নেওয়ার কোন প্রয়োজন ছিলনা বরঞ্চ বলা ভালো ওদেরকে জানিয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল শুভলক্ষ্মী। অনাড়ম্বর ছিল বিয়ের অনুসঙ্গ তবে সহকর্মীদের জন‍্য জম্পেশ পার্টি থ্রো করেছিল শুভলক্ষ্মী। 

চল্লিশোর্ধ শুভলক্ষ্মী শ্বশুরবাড়িতে এসে মানিয়ে নিয়েছিল অতি সহজেই। শাশুরি গত হয়েছেন প্রায় একযুগ আগে। তারপর থেকেই সংসারের সব দায়িত্ব সামলানোর ভার পড়েছে যুথিকাদি আর বংশীবদনের ওপর। বনেদি বাড়ির ছোঁয়া রয়েছে চলনে বলনে। বেশ ভালো লাগল শুভলক্ষ্মীর। অল্পদিনের ছুটির মেয়াদ ফুরোতে দুজনেই ফিরে এল কর্মক্ষেত্রে। যুগ্মজীবনের শুরুতে একমাস যেতে না যেতেই আদিত‍্যর চালচলনে পুরুষালি দম্ভের আভাষ টের পেল শুভলক্ষ্মী। প্রথম কয়েকদিন মানিয়ে নিতে একটু টালমাটাল অবস্থা হল তার। নিজের বিশ্বাসের উপর এই প্রথম সন্দেহ হল শুভলক্ষ্মীর। অবচেতন মনে ভাবনারা এসে দাঁড়ায়। দীর্ঘ অনেক বছর একা জীবনযাপনের কুফল বলে মনে হল তার। একটু তো মানিয়ে নিতেই হবে ভেবে মনকে সান্ত্বনা দেয়। অথচ সেই মানিয়ে নিতে গিয়েই পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে শুভলক্ষ্মী। আদিত‍্যের ব‍্যক্তিত্বময় পৌরুষ দেখে আকৃষ্ট হয়েছিল সে। কোথাও যেন ঢিলে হয়ে যাচ্ছে বন্ধনের গিঁট। ভালো লাগার ক্ষেত্রগুলো এক এক করে সরে যেতে লাগল। সন্তানের জন‍্য উন্মত্ত হয়ে উঠছিল আদিত‍্য। শেষমেশ একটি দুর্বল সন্তান জন্ম হল তাদের। স্বাভাবিক শিশুদের তুলনায় রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম নিয়ে বড় হতে লাগল একমাত্র পুত্রসন্তান । 

ঝড়ের গতিতে দিন কাটে শুভলক্ষ্মীর। রাত জেগে শিশুর দেখভাল করে কায়িক পরিশ্রমে নাজেহাল হয়ে পরদিন অফিসে দশটা পাঁচটা করা ঝক্কির ব‍্যাপার। সন্তানের বাবা হওয়ার সুতীব্র ইচ্ছে জাহির করে আদিত‍্য পরিতৃপ্ত। সন্তান প্রতিপালনের বেলায় সে কিন্তু ভীষণ রকমের উদাসীন। ছেলের অসুখ করলে শুভলক্ষ্মীর বয়সকে দায়ী করে সরে থাকে নির্দ্বিধায়। হাল ছেড়ে দিয়ে একসময় সুনীতা নামের একটি মেয়েকে আয়া হিসেবে বহাল করতে বাধ‍্য হল শুভলক্ষ্মী। সেই থেকে সুনীতা রয়েছে সংসারের অনেকখানি জুড়ে। এখন সুনীতাকে পরম আপনজন বলে মনে হয় ওর। বাবার কাছে আদর আব্দারের দাবি না করে ছেলেও বড় হচ্ছিল চন্দ্রকলার মত। উঁচুপদে চাকরি করে দুজনেই, তবু বাড়িতে পৌরুষত্বের দাবি নিয়ে আদিত‍্যের অহংকার সংসারের আনাচে কানাচে শ্বাস ফেলে নিরন্তর। ছেলের জন‍্য দামি খেলনা কিনে অর্থের অপচয় করতে বারণ করেছে বারবার। কথার খেলাপ হলে বিষদাঁত খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পারে এই ভেবে মেনে নেয় শুভলক্ষ্মী। খাদ‍্যরসিক আদিত‍্য নানাধরণের খাবার-দাবার ছাড়া অন‍্যসব শৌখিন কেনাকাটা করতে দেখলে ভীষণ রকম খেপে যায়। শান্তির সৌজন্যে টুকটাক কেনাকাটা করতেও ইতস্তত বোধ করত শুভলক্ষ্মী। দিনের পর দিন অসম এক সংসারের অনুষঙ্গ হিসেবে রূপান্তরিত করছিল সে নিজেকে। 

বিয়ের পর থেকে প্রমোশন নিতে অনীহা দেখিয়েছিল শুধু সুখে সংসার করার উদ্দেশ্য নিয়ে। সুখ বয়ে আনতে দুটো মানুষের সমান আগ্রহ থাকা দরকার সেকথা আদিত‍্যকে বোঝাতে গেলে অ-সুখ বাড়ে। আদিত‍্যের তরফে কোন আগ্রহের প্রকাশ দেখতে পায়না শুভলক্ষ্মী। তার উপর অল্পতেই অসুস্থ হয়ে পড়া ছেলেকে নিয়ে ব‍্যতিব‍্যস্ত মায়ের জীবন। ছেলেকে স্কুলে দেবার পর নিজের কথা ভাবার অবকাশ এল শুভলক্ষ্মীর। অফিসের কলিগদের সহমর্মিতা ঘেঁষা কথাবার্তা শুনে তার মনের অশান্তি বাড়ে। চুলের রূপোলি ছোপ দেখে নিজের প্রতি করুণা হয় ওর। এমন দমবন্ধ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ হিসেবে শুভলক্ষ্মী দুরে থাকার জন‍্য প্রমোশন নিয়ে চলে এল হায়দ্রাবাদ হেডঅফিসে। জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতে পেরিয়ে সে এখন অনেকটাই স্থিতপ্রজ্ঞ। আদিত‍্য আসা-যাওয়া করে স্বামী হয়ে নাকি ছেলের বাবা হয়ে সেটা জানার আগ্রহ দেখায় না শুভলক্ষ্মী। কিছুটা অতিথির মত আবার কখনও বন্ধুর মত হয়ে এসে ছুটি কাটিয়ে যায় আদিত‍্য। শুভলক্ষ্মীর জগতে আদিত্যের আবাহন বা বিসর্জনের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই। 

সকল বাঁধনের অর্গল খুলে বেরিয়ে আকাশের দিকে চোখ মেলে সুন্দর পৃথিবীর রঙ রূপ গায়ে মেখে নেয় শুভলক্ষ্মী। পৃথিবীর বুকে নানারঙের খেলায় নিজেকে আবার মেলে ধরার সুযোগ এখনো রয়েছে । নিজের জীবনের হারিয়ে যাওয়া গান, অভিনয়, কবিতা সবকিছু একে একে ফিরে এসেছে। আবার মঞ্চে উঠতে দেখা যায় তাকে। চাকরিতে যোগ দিয়ে প্রথম অফিসটিতে শুভলক্ষ্মী সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিল মৈত্রেয়ীদিকে। এখন অনেক বছর ধরে হেডঅফিসে রয়েছেন তিনি। মৈত্রেয়ীদি খুব ভালো অভিনেত্রী। একসময় অফিস থিয়েটারে দুজনেই অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ওনার জন‍্যই হেডঅফিসে সবাই জেনে গেল শুভলক্ষ্মীর অভিনয় প্রতিভার কথা। এত বছর পর আবার মঞ্চাভিনয়ে ফিরে আসা সম্ভব হল মৈত্রেয়ীদির জন‍্য। জীবন যেভাবে সামনে এসে দাঁড়াবে, সেভাবেই গ্রহণ করতে রাজি শুভলক্ষ্মী। ছেলেকে ডে-বোর্ডিং-এ ভর্তি করে দিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত সে। ছেলে ঘরে ফিরে আসার আগে মা শুভলক্ষ্মী ফিরে আসে। সুনীতাকে সাথে নিয়ে শপিং সেরে নেয়। রাস্তায় গল্প চলে সারাদিনের রোজনামচার। কোনদিন বাইরে ডিনার সেরে ঘরে আসে ওরা। 

ইতিমধ্যে  স্কুলের অ‍্যালুমনি গ্রুপে ছোটবেলার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের নম্বর পেয়ে যোগাযোগ জোরালো হয়ে ওঠে । ছেলে এখন নিজের প্রয়োজনটুকু সামলাতে শিখে গেছে অনেকটা। রুগ্নতা কমেছে বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে। সুস্থ থাকার প্রয়াস রয়েছে তার মধ্যেও। সুনীতা জানে ছেলের পছন্দ অপছন্দের তালিকা। খাদ‍্যরসিক আদিত‍্য যে দু-চারদিনের জন‍্য আসে, সেটাও সুনীতা সামলে নেয় সুনিপুণভাবে। নির্ভার জীবন নিয়ে এবার একা এসেছে বন্ধুর বাড়িতে।  

বন্ধুর পরিপূর্ণ জীবন দেখে কোথায় যেন নিজেকে পরাজিত সৈনিক মনে হচ্ছিল শুভলক্ষ্মীর। আর্থিক স্বাধীনতা মানুষকে সুখ এনে দিতে পারেনা এমনতর বদ্ধমূল ধারণা পোক্ত হতে থাকে মনের গভীরে। গভীর রাতের আঁধারে আলোর খোঁজে এতদূর ছুটে এসেছে শুভলক্ষ্মী। আপাতকঠিন বর্মে সব আবেগ ঢেকে রাখা শুভলক্ষ্মীর অবাধ‍্য চোখের জল অঝোরে বইছে কিসের জন‍্য সে জানে না। সেই জলে প্রতিবিম্বিত সব চেনা মুখের মিছিল। 

আদিত‍্যর প্রোফাইল ঘেঁটে দেখেছে শুভকাঙ্ক্ষী। কিন্তু বন্ধুকে সেসব কথা বলে দুঃখের বোঝা বাড়াতে মন চাইছেনা। তার থেকে এই ভালো সুন্দর ভুল নিয়ে কাটুক শুভলক্ষ্মীর বাকি জীবনটা।।





গ্যালারি

অ সী ম  পা ঠ ক

মুম্বাই টাটা মেমোরিয়াল হসপিটালের একশো একচল্লিশ নম্বর বেডে শুয়ে আকাশের দৃষ্টি শরতের নীল আকাশে থমকে। পেঁজা তুলোর মত সাদা মেঘ, গিনি সোনার মত রোদ ছড়িয়ে পড়ছে দিক থেকে দিগন্তে। মাঝে মাঝে হঠাৎ বৃষ্টি। জানালার পাশ থেকে পুরো আকাশটা দেখা যায়না, তবুও যেটুকু চোখে পড়ে ঝাঁ চকচকে অভিজাত ফিল্ম সিটির এই স্বপ্নের শহরে সে আজ সুন্দর পৃথিবীর অসুস্থ ঠিকানায় বন্দী। তার মানসপটে ভেসে ওঠে অতিক্রান্ত সময়ের ছবি।

প্রত্যন্ত গ্রামের বনেদী বাড়ির ছেলে আকাশ, স্বপ্ন ছিলো বাবার মতো সেও অধ্যাপক হবে আর লিখবে সমাজের পরিবর্তনের কথা। একজন সাকসেসফুল রাইটার হবে। একদিন হয়তো তার লেখা গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র হবে। দুনিয়া জোড়া নাম হবে। কিন্তু বিধি বুঝি বাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে বি এড ট্রেনিং শেষ  করে কোলকাতার একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে যখন সে নিজেকে তৈরী করছে প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার জন্য, তখনই প্রায় অসুস্থ বোধ করতে লাগলো। মাসখানেক পাত্তা না দিয়ে মেডিসিন শপ থেকে এটা ওটা ওষুধ কিনে খেতে লাগলো, তারপর একদিন পুজোর ছুটিতে গ্রামে এসেই অসুস্থ বোধ করতেই জেলা হাসপাতালে ভর্তি করলেন তার বাবা অনাদিবাবু। ধরা পড়লো লিভার ক্যানসার। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সুখী সচ্ছল পরিবারে নেমে এলো অমানিশার কালো মেঘের ছায়া। 

শুরু হলো মুম্বাইয়ে চিকিৎসা। কেমোর কঠিন যন্ত্রণা চুল শূন্য মাথায় এখনো কবিতা আসে আকাশের। এখনো সে লেখে হৃদয়ের বোবা আর্তনাদের কথা।  বারাবরই সে লেখে দারুণ। গোটা বাড়ি জুড়ে আকাশের পুরস্কার আর প্রশংসাপত্রের ছড়াছড়ি। অজস্র ট্রফি। সাহিত্যের ছাত্র সে, একবুক স্বপ্ন নিয়ে জীবনের দিনলিপি লিখতো সে। হঠাৎই ছন্দপতন। তবুও অজস্র শব্দের পোকা কিলবিল করে তার মাথায়। বোন পায়েল দাদাঅন্ত প্রান। দারুণ বন্ডিং ভাই বোনের। মা মাধবীদেবী বলতেন এই দুটো থাকলে গোটা বাড়িতে আর কারো কথার কোন দাম নেই। যেকোন উৎসবে পুজোতে মেলাতে ভাই বোন দাপিয়ে বেড়াতো। 

বর্ষার টগর শরতের কাশ ফুল আর বসন্তের পলাশে আকাশের মন জুড়ে থাকতো শুধু একটিই নাম সুহানা। শীতের পিঠেপুলিতে ছাদ বাগানের গাঁদা চন্দ্র মল্লিকায় সুহানা নামের মিষ্টি বাতাসটা খেলে যেতো। 

নার্সারি থেকে হায়ার সেকেন্ডারী  বারো বছরের অনাবিল বন্ধুত্বে প্রেমে আকাশ আর সুহানা যেনো এক বৃন্তে দুটি ফুল। কতো ঝগড়া কতো গল্প কতো মান অভিমান সব কিছুর নীরব সাক্ষী মাথার উপরে উদার নীলাকাশ আর সবুজ মাটি। মাধবীদেবী সব জানতেন আর জেনেও প্রশ্রয় দিয়েছিলেন কারন সুহানা নামের মিষ্টি ফুলটা যে তাঁর হৃদয়েও ভালোবাসার ঝর্না বইয়েছিলো। অনাদিবাবু তো সাংসারিক জগতের বাইরে থাকা একজন মানুষ। দূর থেকে মনে হবে নীরস পদার্থবিজ্ঞানের নির্লিপ্ত সাধক। কিন্তু ভেতরে ভেতরে দারুণ রোমান্টিক, অনেকটা শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন। 

সুহানা হায়ার সেকেন্ডারীর পর জয়েন্ট এন্ট্রান্স এ কোয়ালিফাই করে ডাক্তারি পড়তে প্রানের শহর বর্ধমান ছেড়ে ব্যাঙ্গালোর চলে যায় পাঁচ বছরের জন্য। দুজনের লক্ষ্য আলাদা। একজন সাহিত্য নিয়ে এগুবে আর একজন চিকিৎসক হবে।

এদিকে সাথী হারা আকাশ বর্ধমানের মাটিতে অপেক্ষায় থাকে তার মনের মানসীর। সে ভাবে প্রতিটা প্রেমের গল্পই তো অসমাপ্ত, তাই তার সব লেখা নিঃশব্দে সমর্পন করে সুহানাকেই। মাঝে মাঝে একটা চিন্তা যেনো গ্রাস করে তাকে, আচ্ছা তাদের পরিবার না হয় অস্বীকার করবে না, কিন্তু সুহানার বাবা কি মেনে নেবেন বিধর্মী আকাশকে জামাই বলে। সুহানা খান বর্ধমানের নাম করা ক্রিমিনাল ল ইয়ার জাভেদ খানের একমাত্র আদরের দুলালী। বিদায় বেলায় সুহানা সেই ভিড় প্লাটফর্মে আকাশের হাতে হাত রেখে বলেছিলো, তুই এমন করছিস যেনো আমি শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি। এই চল না একটু কফি খাই। দুজন যেনো দুজনের মন পড়ছে। কেউ কাউকে ব্যাথা দিতে চায়না। আকাশ সানগ্লাসে ভেজা চোখ আটকে বলেছিলো, আরে পাগলী আমি তো ভাবছি এই তিনবছরে পার্ট টাইম একটা জোগাড় করি কাউকে। এতো সুন্দর কলেজ লাইফটা কি নিরামিষ থাকবো? সুহানা বলেছিলো, এই খবরদার! যদি তোর ধারে কাছেও কাউকে আসতে দেখি খুন করে ফেলবো।  আকাশ বলে, তুই টেরই পাবিনা। মুখ ভেংচে সুহানা বলে তোকে আমি জ্যান্ত কবর দেবো, যদি শুনি কিছু গড়বড় করছিস তাহলে... কথা শেষ হয়না দুজনের মাঝে পায়েল এসে দাঁড়ায়, এই দাদা এই বৌদি তোমরা কি শুধু ঝগড়াই করবে গো? তার চেয়ে রোমান্টিক মুডে দাঁড়াও একটা সেলফি নিই, বলা যায়না যদি বিয়ের পর এই একমাত্র ননদকে পর করে দাও, এখন থেকেই নিয়ে রাখি বাপু। আকাশ পায়েলের চুলে একটা টান মেরে বলে, এই  শাঁকচুন্নী একদম বলবি না এসব। সুহানা বলে আমার এই মিষ্টি বোনটাকে আমি খুব মিস করবো। আকাশ বলে হ্যাঁ ওই পেত্নী আর শাঁকচুন্নী দুজনে তো খুব ভাব। আর কথা এগোয়না। দানবীয় গর্জনে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন এসে পড়ে। গোটা প্লাটফর্ম জুড়ে কোলাহলময় ব্যাস্ততার মাঝেও এক নৈশ নৈশঃব্দে ছেয়ে যায় আকাশের মন। সুহানাকে নিয়ে আকাশের বিরাট স্বপ্ন জাল, তার কল্পনার মশলায় গড়া ইমারতে সব কবিতা গল্প যেনো এক নির্মল প্রেমের স্মৃতি সৌধ। আকাশের ল্যপটপে পাস ওয়ার্ডটা অবধি সুহানা নামে সংরক্ষিত। আর প্লাটফর্মে কফি খেতে খেতে নেওয়া সেলফিটা সুহানার মোবাইলে ওয়ালপেপার থেকে ফেসবুক প্রোফাইল সর্বত্র বিরাজমান। 

কে বলে আধুনিক প্রজন্ম ডিজিটাল? এরা প্রেম ভালোবাসা বোঝেনা ক্যারিয়ার বোঝে? অন্তত আকাশ আর সুহানা দুজনকে দেখে মনে হয় এরা প্রান উজাড় করে ভালোবাসতে জানে। স্কুল থেকে ফেরার পথে লাল মাটির রাস্তায় রিমঝিম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দুজনে গাইতো, "সারাদিন রিমঝিম ঝিম কতো বৃষ্টি কতো বৃষ্টি হয়েছে মন জুড়ে "। ফুচকার স্টলে দুজনের কম্পিটিশন চলতো কে ফার্স্ট হবে, ব্যাডমিন্টনেও তাই। আকাশ কিন্তু মুখে জোর দেখাতো খুব আর চাইতো সব প্রতিযোগিতায় সুহানাকে জিতিয়ে দিতো। সেই যে একবার ছোটবেলায় লুডো খেলায় সুহানা হেরে গিয়ে খুব কেঁদেছিলো, তখন থেকেই আকাশ নিজে হারতো আর কপট রাগ দেখাতো। সুহানা সব বুঝেও খুশী দেখতে চাইতো আকাশের মুখে। অপার্থিব ভালোবাসার স্বর্গরাজ্যে দু'জন যেনো দু'জনের পরিপূরক। 
 হঠাৎই আকাশের ভাবনায় ছেদ পড়ে, লেডি ডক্টর আকাশের প্রেশার পালস রেট চেক করার জন্য তার বেডের সামনে দাঁড়ায়। আকাশ হঠাৎ যেনো চমকে ওঠে বলে তুমি? ভুল দেখছে না তো! সুহানা কি? না না তা কি করে সম্ভব... এ তো ডক্টর অনিতা বর্মন। পরক্ষনেই সরি বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। ডক্টর অনিতা বলেন, হ্যালো মিঃ আকাশ, হাউ আর ইউ? আকাশ বলে একজন মৃত্যুপথযাত্রী আর কেমন থাকবে ডক্টর! ডক্টর অনিতা বলেন, আপনি মনে জোর রাখুন, এটাই সবচেয়ে বড়ো মেডিসিন ক্যানসারকে হার মানানোর। আকাশ বলে আমি তো একটা জিন্দা লাশ। মরে গেছি অনেক আগেই। 

এই দীর্ঘ চিকিৎসার কিছু সময়ে ডক্টর অনিতার সাথে আকাশের পেশেন্ট ডক্টর বাদ দিয়েও এক নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়েছে। ডক্টর অনিতা সব দেখে রিপোর্ট নোট করে বলেন, ঘাবড়াবেন না মিস্টার আকাশ। আমি রুটিন ভিজিট কমপ্লিট করে আসছি। লনে বসে কফি খাবো একসাথে।  একটুতেই আকাশ এখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে। হসপিটাল স্টাফদের সহায়তায় মাঝে মাঝে লনে গিয়ে বসে আবার বেডে বসেও কিছু লেখা মাথায় এলেই বোন পায়েলকে ফোন লাগিয়ে বলে, লেখ তো, আমি বলি--- আর কটা দিন বিরক্ত করি তোকে। পায়েল প্রচ্ছন্ন ধমকের সুরে বলে, 'দাদা, থামবি?' তারপর চোখের জল মুছে বলে, হ্যাঁ বল। আকাশ বলে যায় বিরহ ব্যাথাতুর জীবনে আঘাত জর্জরিত শব্দ মালায় সাজানো তার অনুভুতির কথা। উপলব্ধির নির্যাসে হেমলকের জ্বালা যন্ত্রণাময় অস্তিত্বের কথা।  রোগে শরীর অচল, আর মন সেও যেনো নির্বাসিত একাকী জনমানবহীন পরিত্যক্ত এক দ্বীপে।
জীবন উপন্যাসের ক্লান্তিকর অধ্যায় জুড়ে সুহানার স্বপ্নকে সফল করার এক করুণ প্রয়াস চালিয়ে যায় আকাশ। যেনো অসম যুদ্ধে সে বিধ্বস্ত ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত। তবুও লিখতে হবে ধূসর জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতা। সুহানার শেষ স্বপ্ন তাকে সাহিত্য একাডেমি পুরষ্কার পেতেই হবে। 

লনে বসে ডক্টর অনিতা আকাশকে বলে, আচ্ছা মিস্টার এই যে এতো লিখেছো বা এখনও লিখে চলো তুমি এটার মধ্যেই প্রেরণা দাও সমাজ সভ্যতাকে। আচ্ছা তুমি কি জানো, যে তোমার গ্যালারি উপন্যাসটা আমার হাজব্যান্ডের খুব পছন্দ। আকাশ বলে, তাই? সে জানে অনিতার স্বামী একজন ফিল্ম প্রোডিউসার। অনকোলজিস্ট স্ত্রীর প্রোডিউসার স্বামী! এ নিয়ে আকাশ একটা মজার কবিতা লিখে দিয়েছিলো। অনিতার স্বামী আদিত্য খুব হেসেছিলো কবিতা পড়ে। শব্দহীন মন্থরতা ভেদ করে শান্ত গলায়  আকাশ বলে, ফোনের গ্যালারি হয়তো একদিন নিশ্চিহ্ন হবে কিন্তু মনের গ্যালারি মরলেও পুড়ে ছাই হবে না। অনিতা বলে, হুম বুঝছি, তা এই যে আমার মতো সুন্দরী স্মার্ট ডক্টরের সামনে আপনি বসে আছেন, আপনার কি কোন ফিলিংস আসছে না? নাকি সুহানাতেই ডুবে।  আকাশ বলে জানেন ডক্টর অনিতা, যেদিন সুহানাকে শেষবার দেখেছিলাম ওর লাস্ট ইয়ারে, আমি তখন মা-কে চেকআপ এ ব্যাঙ্গালোর নিয়ে গিয়েছিলাম। সাতটা দিন একসাথে কেটেছিলো স্বপ্নের মতো। শপিং মলে শেষ সেলফি নিয়েছিলাম। মা তো তার আদরের হবু বৌমাকে ওখানে একটা সুন্দর শাড়ি কিনে দিয়েছিলো, তো সুহানা বললো এটা পরেই সেলফি নেবো। সে ছবিটাই আমার গ্যালারি উপন্যাসের প্রচ্ছদ।  অনিতা বলে দেখেছি, কি মিষ্টি দেখতে ছিলো সুহানা। আকাশ যেনো এ কথায় উত্তেজিত হয়ে পড়ে, বলে ছিলো নয়, আছে। আছে ডক্টর। এখনো সুহানা আসে আমি যখন কেমোয় তন্দ্রাচ্ছন্ন  থাকি, তখন সে চুপিচুপি এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে যায়।  অনিতা বলে, চলুন আপনাকে বেডে পৌঁছে দিই। 

বেডে শুয়ে অসুস্থ আকাশের চোখ জলে ভরে আসে। সুহানার চলে যাওয়াটাও আজ তিন বছর হয়ে গেলো। পড়া শেষ করে ওখানেই একটা বেসরকারি নার্সিং হোমে সে ঢুকেছিলো। সবাই আপত্তি করেছিলো, যে চলে আয় এখানে। কথা শোনেনি মেয়ে। আকাশকে ফোনে বলতো অনেক অনেক টাকা জমাতে হবে রে, দুজনে পুরো পৃথিবী ঘুরবো। কত নতুন দেশ যাবো, আকাশ মজা করে বলতো, বলতো হ্যাঁ আর যেখানে যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার, কাতুকুতু বুড়োর কাছে যেওনা খবরদার। শুনে সুহানা বলতো, এই তুই যখন বুড়ো হবি তখন কি তোর মাথা ভর্তি টাক হবে? আকাশ বলতো, আর তুই ফোকলা বুড়ি। সুহানা হেসে বলতো, তখনও আমরা সিঙ্গাপুরে ঘুরবো। স্বপ্নের শহর ইতালির ভেনিস ঘুরবো। যেদিন শেষবার কথা হলো সুহানার সাথে ভিডিও কলে সেদিন প্রথমেই ফ্লাইং কিস দিয়ে সুহানা বলেছিলো, এই হাঁদারাম তুই তো বেশ স্বার্থপর, নিতে জানিস, দিতে জানিসনা। সেদিন যেনো সুহানা আরও ডেসপারেট হয়ে উঠেছিলো।
ফোন যেনো ছাড়তেই চায়না। সুহানার মধ্যে কেমন যেনো একটা প্রানখোলা বন্যতা ছিলো। একবার কল করে না পেলে চারদিকে গোটাফ্রেন্ডস সার্কেল অতিষ্ঠ করে তুলতো। পায়েলকে ফোন, মাকে ফোন--- মানে সে এক সাংঘাতিক ব্যাপার। সুহানা ছোট বেলাতেই মাকে হারিয়েছিলো। তাই আকাশের মাকে সে মা বলেই ডাকতো। শেষদিকটাতে সুহানার বাবাও একপ্রকার ধরেই নিয়েছিলেন যে আকাশই তাঁর হবু জামাই। 

শেষবারের কলটা ছিলো রাত দশটা দশে। আর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই ভোর সাড়ে পাঁচটায় আকাশদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় জাভেদ খানের কালো স্করপিও গাড়িটা।  আকাশকে পায়েল ঘুম থেকে তুলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। কিছুই বলতে পারে না। শুধু আকাশের বাবা বলেন, রেডি হয়ে নে তোর জাভেদ আংকলের সাথে এক্ষুনি ব্যাঙ্গালোর বেরুতে হবে। এগারটায় ফ্লাইট, তার আগে দমদম পৌঁছোতে হবে। আকাশের মুখে কথা বেরোয়না, সে বাড়ি এসেছিলো বড় দিনের ছুটি কাটাতে আর বড়োদিনের রাতেই কি এমন তোলপাড় করা ঘটনা ঘটে গেলো? জাভেদ খান মর্মাহত হয়ে সোফাতে বসে। আকাশকে দুঃসংবাদটা তিনিই দেন। বলেন বাবা হয়ে আমি যদি পারি, তোমাকেও পারতে হবে আকাশ, চলো। আকাশ তখনও ভ্যাবাচ্যাকা। জাভেদ খান বলেন, সুহানা এ পৃথিবীতে আর নেই।  আকাশ যেনো ইলেকট্রিক শক খেয়ে যায়, বলে, কি বলছেন? তক্ষুনি আর একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। ভেতরে ঢোকেন স্থানীয় থানার অফিসার-ইন-চার্জ অবিনাশ শাসমল। ভনিতা না করেই বলেন এই যে সবাই এখানে, আসলে অধ্যাপক সাহেব আমিই উকিল বাবুকে কাল রাত আড়াইটায় খবর দিই। আমাদের সাথে ব্যাঙ্গালোর হোয়াইট ফিল্ডের পুলিশ স্টেশন যোগাযোগ করতেই আমরা তৎপর হয়ে যাই। রাত দেড়টা নাগাদ নাইট শিফট সেরে ফেরার পথ ম্যাডাম সুহানাকে কারা যেনো ফলো করেছিলো, এবং সুহানা প্রান ভয়ে ভীত হয়ে দৌড়াতেই চলন্ত লরির সামনে স্কুটি সহ পড়ে প্রান হারায়। রোডের সি সি টিভি ফুটেজে এরকমই তথ্য পাওয়া গেছে। এবং ব্যাঙ্গালোর পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। সুহানাকে যখন রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তখন একটা শব্দই শুধু শোনা গেছে, আকাশ...। আকাশ যেনো তখন যন্ত্রমানব, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অস্ফুটে বলে, চলে গেলি...!
ব্যাঙ্গালোর পৌঁছে সমস্ত ফর্মালিটি শেষ করে যখন সুহানার নিথর বডি ওখানেই কবর দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন এগিয়ে আসেন ওখানে গোটা মেডিক্যাল অর্গানাইজেশন।  এবং তার প্রিয় কর্মভূমিতে তাকে শেষ বিদায় জানানোর মুহূর্তে ডক্টর জাভেদ খান একখানা সিঁদুরের কৌটো আকাশের হাতে ধরিয়ে বলেন, ও খুব চাইতো তোমাকে। ওর শেষ ইচ্ছা পূরন করো।  মৃত সুহানার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দেয় আকাশ। চারিদিক থেকে ফুল এসে ঢেকে দেয় নিষ্পাপ সুহানার প্রানহীন দেহ। আকাশ তখন সুহানাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। উপস্থিত সবার গ্যালারিতে ভিড় জমে ওঠে সেই ছবির। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় সেই উজ্জ্বল মুহূর্ত।  প্রেম যেনো চির অমর অমলিন।  সংবাদপত্র জুড়ে শিরোনামে থাকে সেই ছবি, প্রেমের মৃত্যু নেই। 

আকাশ তারপরেই বোহেমিয়ান হয়ে ওঠে। লেখায় ডুবে যায় আর সুহানাকে ভুলতে তার সঙ্গী হয় মদ। সে যেনো অপ্রকৃতিস্থ থাকতে চায়। বাস্তব জীবন থেকে পালাতে চায়। যাবতীয় সুখ ঐশ্বর্যের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে সে যেনো অনন্তের অভিসারে মগ্ন হয়ে ওঠে।

চারটা কেমো নেওয়া হয়ে গেলো। শরীর যেনো আর ধকল নিতে পারছেনা। আকাশ ও অপেক্ষায় কখন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে সে। এই দ্বন্দ্ব সংঘাতময় পৃথিবী ছেড়ে সে সুহানার কোলে মাথা রাখবে। যাবার আগে যদি তার পুরস্কারটা জোটে তো সুহানাকে গিয়ে বলবে, তোর ইচ্ছা পুরণ করে তোর কাছে এসেছি। সে জানে না মহাকাল তাকে সেই সুযোগ দেবে কিনা। এরমধ্যে ডক্টর অনিতার স্বামী আদিত্য বর্মন এসে দেখা করে গেছে আকাশের সাথে। তার গ্যালারি উপন্যাস নিয়ে হিন্দি বাংলা দুটো ভাষাতেই মুভি হবে। এও এক সান্ত্বনা। সুহানার কাছে সে শুধু ব্যার্থ প্রেমিক থাকলো না, তাদের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখলো সময়ের ব্যাবধানে। কালোত্তীর্ণ যুগোত্তীর্ন এই পবিত্র প্রেম প্রতিটি মানব মনের গ্যালারিতে বন্দী থাকবে।

এবছর পূজো শরত পেরিয়ে হেমন্তে। হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুর যেনো খোলস খসা সাপের মতো নিস্তেজ। মহাষষ্ঠীর সকালে বোধনের মহা লগ্নেই খবর আসে পায়েলের ফোন থেকে, যে আকাশের গ্যালারি একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। আর আকাশের কোন স্বপ্ন নেই। এবার ডক্টর অনিতার দেওয়া সময়সীমার কথা মনে পড়ে, লাইফ লাইন। হ্যাঁ এটাই তার শেষ উপন্যাস। চিকিৎসা বিজ্ঞানের হিসাব মতো আর থার্টি সেভেন ডেজ সে পৃথিবীতে থাকবে।  লাইফ লাইন উপন্যাসটা ডক্টর অনিতাকে উৎসর্গ করে যাবে সে। এমন সময় ডক্টর অনিতা এসে আকাশের মাথার কাছে দাঁড়ায়। আজ মিস্টার আকাশ না বলে, সে ডাকে--- বন্ধু, তোমার বোন আমাকেও ফোন করেছিল। কনগ্রাচুলেশনস! এই নাও তোমার জন্য সুহানার পছন্দের লাল রঙের পাঞ্জাবি এনেছি। এটা আজ পরবে। আকাশ বলে, হ্যাঁ বন্ধু আর কোন চাপ নেই। এবার আমি শান্তিতে যাবো, আর শোনো ওই মুভি থেকে যা আসবে আমার পারসেন্টেজ সবটা দান করে দেবে কোন অনাথ আশ্রমে। ওদের মধ্যেই আমার আর সুহানার ভালোবাসা বেঁচে থাকবে। অবারিত জোছনা ধারায় তখন যেনো ঢেকে যাচ্ছে স্বপ্নের শহর মুম্বাই। আকাশের বুকে সুহানা নামের তারাটা জ্বলজ্বল করছে। দেরী না করে লাইফলাইনের পান্ডুলিপিটা ডক্টর অনিতা বর্মনের হাতে দিয়ে বলে, শেষ অধ্যায়টুকু  সাঁইত্রিশ দিনে না হয় শেষ করবো, এখন এই পূজোর উপহার হিসেবে তোমাকেই দিলাম বন্ধু আমার লাইফলাইন।।





আবার কৈশোর

অ র ণ্যা নী 

শুভমিতা এখন মধ্য বয়স পার করে প্রৌঢ়ত্বের দিকে এগিয়ে চলেছেন। কিন্তু তাকে দেখলে এখনো বয়স বোঝা যায় না। যদিও মাথার দু'পাশের চুলে রূপালি আভা দেখা দিয়েছে, কিন্তু চুলের কাটিংয়ের জন্যই বোধহয় বয়স কম লাগে। মুখে না প্রকাশ করলেও অন্তরে শুভমিতার নিজের কিশোরী রূপ দেখার বড় সাধ। সাজগোজ একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন আজকাল। তবে যখন কোথাও যান , তখন চুলে শ্যাম্পু, চোখে কায়দা করে কাজল পরা ও ঠোঁটের লিপস্টিকের জন্য বয়সটা বেশ কমে যায়। গয়নাগাটি শুভমিতার চেহারায় অতিরিক্ত লাগে। তাই তিনি গয়নাগাটি পরেন না। নিজের চুল তিনি নিজেই কাটেন। পছনের চুলগুলো বড় হলে মেয়েরা কেটে দেয়, আর সামনের লগস্ থেকে সমস্ত কাটিং আয়না দেখে দেখে শুভমিতা নিজেই করেন। পার্লারে চুল কাটতে গেলে ওরা সেক্সি করে সাজিয়ে দেয়, যা শুভমিতার কাছে এই বয়সে ডাইনির মতো মনে হয়।

শুভমিতার ঘরে কোনো বড় আয়না নেই। শুভমিতার ভাগে ড্রেসিং টেবিল হীন ঘর পড়েছে। তবে হাত আয়না ও বেসিনের আয়নার দ্বারাই তার কাজ চলে যায়। একদিন মাথায় শ্যাম্পু করে, চুল শুকিয়ে, শুভমিতা চিরুনি দিয়ে চুলগুলো আঁচরাতে যাচ্ছিলেন। বড় মেয়ে বাড়ি নেই। তাই ওর ফাঁকা ঘরটায় ঢুকে গেলেন শুভমিতা। ঢুকতেই ড্রেসিং টেবিলের মুখোমুখি হতে চোখ চলে গেল নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলেন শুভমিতা! এ যেন সত্যিকারের কিশোরী শুভমিতা। চুল পিঠ ছাপানো, চোখে হাল্কা কাজল, গায়ের রঙ মাঝারি, একটা বিনুনির মধ্যে বিন্যস্ত চুলের রাশি। মুচকি হাসছে যেন শুভমিতাকে দেখে! হাসি কি রোমান্সের না বিদ্রুপের তা বুঝতে শুভমিতা আয়নার প্রতিবিম্বের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে একভাবে চেয়ে রইলেন।

প্রতিবিম্বকে প্রশ্ন করলেন শুভমিতা – তুমি কে?
প্রতিবিম্ব – আমি তোমার কৈশোর ।
শুভমিতা – কী চাও তুমি?
প্রতিবিম্ব – আমি তো কিছু চাই না। তুমিই তো আমাকে চাও। আর যা চাও, তা ফিরিয়ে নেওয়ার সাহসও তোমার নেই।
শুভমিতা – হ্যাঁ, আমি ফিরে চাই আমার কৈশোরকে। কিন্তু সাহস নেই বলছো কেন? আমি স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষ।
প্রতিবিম্ব – স্রোতের বিপরীতে চলার মানুষরাও একটা পর্যায় পর্যন্তই এগোয়। তুমি এটুকুতেই নিজেকে সমাজ সংস্কারক ভাবো। তুমি কৈশোর ফিরে পাবে কী করে? কৈশোর ওসব কিছু ভেবে করে না। যা মন চায় তাই করে। নিজেকে প্রচার করার দরকার পড়ে না।
শুভমিতা – তুমি তো মোটেই পারফেক্ট নও। তাই এই বয়সে তোমাকে পুরোপুরি নেওয়া তো সম্ভব নয়।
প্রতিবিম্ব – পারফেক্ট কেউই নয়। ওটা ভাবে সবাই। বরং আমি তোমার সহজ সরল দিকটা। যেটাকে নিয়ে কাট ছাঁট করে তুমি এই বয়সে নিজের মধ্যে বসানোর চেষ্টা করছো। পারছোও না। মনের ব্যাধিতে ভুগছো।
শুভমিতা – আমি কিছু করিনি। তুমিই আমায় ছেড়ে গেছো। 
প্রতিবিম্ব – ছেড়ে যেতে তুমি বাধ্য করেছো। কোথায় সেই সারল্য? কোথায় সেই সহজ ভালোবাসা? সব কিছুকে কৃত্রিম করে তুমি সামাজিক হতে চাও। পারো কি? 
শুভমিতা – সমাজ যদি আমাদের আচার আচরণকে এভাবে বেঁধে দেয়, আমার কিছু করার আছে কি? তবু তো আমি অনেক বেশি সহজ অন্য মানুষদের চেয়ে। 
প্রতিবিম্ব – ওই অহংকারই তোমার কাল করেছে। কাদের সঙ্গে তুমি নিজেকে তুলনা করছো? কেনই বা করছো? নিজের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে দেখেছো কখনও? তুমি কে ছিলে, আর এখন কে? 
শুভমিতা – এখন আমি কে? 
প্রতিবিম্ব – আমার মতো কিশোরীর সে উত্তর জানা নেই। আমাকে যদি ফিরে চাও, তবে আগের মতো করে আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। সে যতই চুল নিয়ে কাট-ছাঁট করো। কিন্তু জীবনে আবারও নতুন করে কৈশোরকে ফিরে পেতে পারো। তুমি তো এখন স্বাধীন, নিশ্চন্ত জীবন যাপন করছো। নিজের মনের খুশির উপর সব ছেড়ে দাও। কেউ অন্যায় করলে সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করো। কিন্তু ভেঙে পড়ো না নিজে। আবারও নিজের অফুরন্ত খুশিতে চলতে থাকো। 
শুভমিতা – আমার বন্ধু কে থাকবে? 
প্রতিবিম্ব – থাকবে অনেকেই। তাদের মধ্যেও কৈশোর লুকিয়ে আছে। তবে সবাই বা অনেক বন্ধু থাকবে না। যদি একজনও থাকে, সেই তো তোমার পক্ষে যথেষ্ট। 
কখন যেন ঘুম ভাঙা চোখে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো শুভমিতা। শ্যাম্পু করে এসে বড় মেয়ের ঘরে ঘুমিয়ে পড়ল অসময়ে! এখন বেলা তিনটে বাজে। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার সময়। স্বপ্নটার কথা ভাবলে মনটা বেশ হাল্কা লাগছে। সত্যিই নতুন করে আর একটা কৈশোর শুরু তো করাই যায়!





নয়ন ভরা জল

আ শ রা ফ  হা য় দা র 

রাফি সেই বিকেল থেকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন এক ধ্যানে, এক জ্ঞানে ঝুল বারান্দায় দিগন্ত জোড়া আকাশ চেয়ে। তিনি তাকিয়ে আছেন মনের উদ্বিগ্নতা নিয়ে! কোন দিকে খেয়াল নেই! পাথরের একটা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। 
আস্তে আস্তে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে লাল আবীর ছড়িয়ে। আজ আর কোন দিকে রাফির খেয়াল নেই। কোন কিছুই খেতেই ইচ্ছে করছে না তার। সব কিছুতেই বিরক্ত মনে হচ্ছে। অন্যদিন তো সাগরিকা এসে কফি খাওয়ার জন্য বলতো। আজ তো সে আর ইহজগতে নেই। আর কোনদিন সাগরিকা বলবে না কিছু খেতে। আজ সাগরিকা না ফেরার দেশে চলে গেছে‌। সাগরিকা হলো রাফির সহধর্মিণী। বিশ বছর আগে সাগরিকা এসেছিল রাফির জীবনে। রাফি আর সাগরিকা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। কলেজে পড়ার সময় সাগরিকা সাথে রাফির পরিচয় হয়ে ছিল। রাফি যেমন সুন্দর সাগরিকা ও তেমনই সুন্দরী। সাগরিকা দেখতে ছিল ঠিক যেনো সাগরের মতো অপূর্ব। যেমন রূপ সৌন্দর্য তেমনই গুণে গুণান্বিত লীলাবতী। তাই মাঝে মাঝে রাফি আদর করে সাগরিকাকে লীলাবতী বলে ডাকতেন। 

রাফি আর সাগরিকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এক সাথে পড়তেন। সেই টিএসসি মোড়, মধুর ক্যান্টিন, বইমেলা, বানিজ্য মেলা, কক্সবাজার, পটুয়াখালী সমুদ্র সৈকত, সিলেট পাহাড়ী ঝর্ণা আর রাঙামাটির মতো অপূর্ব নিদর্শন জায়গাগুলো দু'জনের ঘুরে ঘুরে দেখা। শুধু কি তাই দেশ বিদেশ ও ঘুরে দেখা। টোটো করে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতেন বলে বন্ধু বান্ধবীরা বলতো কপোত কপোতী।
রাফি আর সাগরিকার খুব পড়ার অভ্যাস ছিল তাই প্রতিবছর বইমেলা থেকে বিভিন্ন স্টল ঘুরে ঘুরে পছন্দের বই কিনতেন। এক কথায় দু'জনই বইয়ের পোকা ছিলেন। 

এমনই ভাবে কেটে যাচ্ছিল তাদের স্বপ্নময় সোনালী দিনগুলি ইচ্ছে ঘুড়ির মত। গানের স্বরলিপির সুরে সুরে বাঁধা ছিল তাদের দুটি প্রাণ। আলোর বাঁশিতে ভরা দুটি জীবন।

রাফির জীবনে সেই স্মৃতি গুলো একের পর এক ইথারে ভেসে আসছে। বিশ বছরের স্মৃতি বলে কথা! বিশ বছরে বাঁধা সুখের স্রোতে ভেসে যাওয়া সেই সব দিন গুলো কোন এক বৈশাখী আকাশ কাঁপানো ঝড়ে লন্ডভন্ড করে দিল। ভেঙে দিল সাজানো হাসি খেলার নীড়। 

রাফির এক ছেলে। বয়স তের বছর। বিয়ের সাত বছর পর সাগরিকার কোল জুড়ে এসেছিল অনিন্দ্য। অনিন্দ্যকে ঘিরে সাগরিকার কত স্বপ্ন ছিল। অনিন্দ্যকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে। ঘরে লাল টুকটুকে বৌমা নিয়ে আসবে। বৌমা তো নয়, সে মেয়ে হয়ে থাকবে। সাগরিকার সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো অধরা। সাগরিকা স্বপ্ন দেখতে ভীষণ ভালবাসতো। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য সে উঠে পড়ে লাগতো। বিভিন্ন খাবার ছিল তার পছন্দের তালিকায়। তবে নিজ হাতে বানাতে পছন্দ করতো। আজ সাগরিকা আর নেই। বাড়িতে সেই আনন্দ উল্লাস নেই! সারা বাড়ী ছিল আলোয় আলোয় আলোকিত। আজ সেই আলো নেই। চিরদিনের জন্য নিভে গেছে সাগরিকার জীবন প্রদীপ। সাগরিকা এখন একা অচেনা অন্ধকারে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আর কোনদিন জাগবেনা। ঘুম আর কোনদিন ভাঙবে না তার। এই ঘুম চিরতরের ঘুম। চিরশান্তির ঘুম। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে সাগরিকা একা ঘুমিয়ে আছে। 

হঠাৎ করে সাগরিকার জ্বর আসলো। দু'দিন ধরে জ্বর ছিল। তিন দিনের দিন রাফি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। রোগী দেখে ডাক্তারের একটু সন্দেহ হয়েছিল তাই কিছু টেস্ট করতে দিলেন। সেই টেস্ট রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। ডাক্তার সাগরিকাকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করলেন। ব্যয়বহুল চিকিৎসা। রাফির কাছে একটাই কথা যত টাকা যায় যাক তারপরও আমার সাগরিকা সুস্থ হয়ে উঠুক। দিনদিন সাগরিকা অবনতির দিকে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে রাফি সাগরিকাকে নিয়ে ভারতের চেন্নাইয়ে চলে গেলেন। ওখানেও ডাক্তার কিছু টেস্ট করার জন্য ল্যাবে পাঠালেন। টেস্ট রিপোর্টে ধরা পড়লো মরণ ব্যাধি ক্যান্সার! রাফি হতাশ! ক্যান্সারের কথা শুনে রাফির পৃথিবী তিমিরাছন্ন হয়ে আসছে। রাফি এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না। ডাক্তার এসে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন‌ চিন্তা করবেন না আল্লাহ ভরসা। আল্লাহ যেটা ভাল বোঝেন সেটাই তিনি করেন। আমরা তো উপলক্ষ্য মাত্র। কোন চিন্তা করবেন না। এই কথা বলে ডাক্তার চলে গেলেন। সাগরিকা তখনও জানেনা সে মারণ ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত। তাকে জানানোই হয়নি। সাগরিকা বারবার রাফিকে জিজ্ঞেস করে ছিল তার কি হয়েছে? রাফি বলে ছিলেন তেমন  কিছু নয়। ভাল হয়ে যাবে। রাফির বুকের ভেতর শূন্যতা বিরাজ করছিল। হাহাকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। এই বিরহ ব্যথা অনুভব কে করবে? রাফি সাগরিকার কাছে গিয়ে বসলেন। তখন সাগরিকার ব্লাড দেওয়া হচ্ছিল। সাগরিকা রাফিকে জিজ্ঞেস করছিল আমরা কবে বাড়ি যাবো? আমার ভাল লাগছে না। আমাকে নিয়ে তুমি দৌড়াদৌড়ি করতে করতে শুকিয়ে গেছো। তোমাকে ভাল মন্দ রান্না করে খাওয়াবো সেটাও পারছিনা। অনিন্দ্যের খোঁজ নিয়েছো? কেমন আছে? জানো অনিন্দ্যকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। তুমি আমার কাছে এগিয়ে এসো। তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। রাফি এগিয়ে গিয়ে মাথার কাছে বসলেন। সাগরিকা ওড়না দিয়ে রাফির চোখ মুছে দিয়ে বললো তুমি কাঁদছো! কেন কাঁদছো! তুমি কাঁদলে আমি যে কষ্ট পাই। তুমি কেঁদো না। আমার মাথায় হাত রাখো। রাফি সাগরিকার মাথায় হাত রাখলেন। সাগরিকা বললো যদি আমার কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার অনিন্দ্যের মুখের দিক চেয়ে তুমি আমার ছোট বোন সাথিকে বিয়ে করবে। বাবা মা মারা যাবার সময় সাথিকে আমার হাতে তুলে দিয়ে গিয়ে ছিলেন। আর আজ আমি তোমার হাতে সাথিকে তুলে  দিলাম। তোমার সুখে দুঃখে সাথিকে আত্মার আত্মীয় করে নিও। যেমন আমাকে আপন করে নিয়ে প্রবল আবেগে ভালবেসে ছিলে তেমনই সাথিকে ভালবেসে যেও। রাফি আস্তে করে বললেন আজ এই সব প্রশ্ন কেন? থাক না এ সব কথা। 
সাগরিকা বললো তুমি না বললেও আমি বুঝতে পারছি আমার যাবার সময় হয়ে এসেছে। একটু আগে মা বাবা এসেছিলেন। আমাকে বলে গেলেন সাথিকে রাফির হাতে তুলে দিয়ে চলে আয়। তারা যে আমাকে ডাকছে! রাফি বললো তুমি চুপ কর। এভাবে আর বলো না। তোমার কিছুই হয়নি। তুমি ভাল হয়ে যাবে। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারোনা। 

সাগরিকার শরীর খারাপের  দিকে যাচ্ছে। তাই আস্তে করে একটু হেসে বললো কেউ কি সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায়! তারপরও চলে যেতে হয়। তেমনই আমাকেও যেতে হবে। আমি যতক্ষন পর্যন্ত পৃথিবীতে আছি ততক্ষন পর্যন্ত আমার হাতটি ধরে রেখো। রাফি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নিঃশব্দ নীরবে চোখের জল ফেলে যাচ্ছেন অঝোরে! 

এরই মধ্যে সাগরিকা জ্ঞান হারিয়েছে। সাথে সাথে ডাক্তার এসে একটা ইনজেকশন দিলেন। কিছুক্ষণ পর সাগরিকা চোখ মেলে দেখলো রাফি তার হাতটি ধরে বসে আছে। তার দু'নয়ন জলে ছলছল টলমল করছে। তুমি আমাকে বাড়ি নিয়ে চল। এখানে আমার ভাল লাগছেনা। শোন যদি আমি মারা যাই তাহলে আমাকে সমাধি দিও কৃষ্ণচূড়া ফুল গাছটির নিচে। তুমি তো জানো আমি কৃষ্ণচূড়া ফুল পছন্দ করি। কত কথা বকবক করে সাগরিকা বলে যাচ্ছে। সেই প্রেম করা থেকে শুরু করে বিশ বছরের সব কথা, সব স্মৃতিগুলো বলে চলেছে ফুলঝুরির মতো।

ডাক্তার এসে আরেকটি টেস্ট রিপোর্ট দেখে রাফিকে বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে দিলেন স্যরি রাফি সাহেব। আমাদের হাত নেই। আপনি যত দ্রুত পারেন দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যান। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। রোগী একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছে। ডাক্তার সাহেব রাফির দেশে ফেরার সব ব্যবস্থা করে দিলেন। সকালেই রাফি সাগরিকাকে নিয়ে দেশে পৌঁছালেন। বিমানের ভিতরে সাগরিকা কোন কথা বলেনি। কেবল রাফির বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিল। বাসায় পৌঁছে সাগরিকা অনিন্দ্যকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। অনিন্দ্যকে কিছু উপদেশ দিলো। ছোট বোন সাথিকে বললো অনিন্দ্য আর রাফিকে তোর কাছে রেখে যাচ্ছি। মা বাবা এসেছিলেন তারাও তোর কথা বলে গেছেন। বাড়ির সবাই কান্নাকাটি করছে। সাগরিকা হাসতে হাসতে বললো কাঁদছো কেনো? আরে আমার তো কিছুই হয়নি। আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আমার কিছুই হয়নি। কিন্তু রাফি তো জানে আর কয়েক ঘন্টা মাত্র সাগরিকা দুনিয়াতে আছে। তাই রাফি সাগরিকার হাত ধরে বসে আছে। হঠাৎ সাগরিকা রাফিকে বললো ওই দ্যাখো মা এসেছেন! তুমি কেঁদো না। তোমার সাথে আমার দেখা হবে ওপারে। কথা বলতে বলতে আস্তে আস্তে সাগরিকা মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়লো। শুধু রাফিকে বললো ক্ষমা করে দিও। অনিন্দ্য কাছে আয়। অনিন্দ্যের মুখে চুমু খেয়েই চোখ বুজলো। তখনও রাফি হাত ধরে রেখেছে। রাফি দেখলো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। রাফি অনিন্দ্যকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে বললো অনিন্দ্য তোর মা আর নেই! সারা বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেছে। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে, সবাই শোকে পাথর। সাগরিকা ছিল সকলের নয়নের মণি। অকালেই সে চলে গেলো। দেরি না করে সাগরিকার কথা মতো বাদ জোহর দাফন কাফন সম্পন্ন করে ফেললেন। 

এই পৃথিবীর মায়া মমতা স্নেহ ভালবাসা ত্যাগ করে আজ না ফেরার দেশে চলে গেছে সাগরিকা। আর কথা হবেনা, রাগ অনুরাগ হবে না, মান অভিমান হবে না! এই তো পৃথিবীর সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার লীলা খেলা। একজন আসে আরেকজন চলে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম। যার জীবন আছে তার মৃত্যু আছে। যার সৃষ্টি আছে তার বিনাশ আছে। প্রতিটি জিনিসের মৃত্যু আছে। মেয়াদোত্তীর্ণ হলে সেই জিনিসটি ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে। তেমনই মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। স্রষ্টা কাকে পাঠাবেন আর কাকে নিয়ে যাবেন সেটা তিনি ভাল জানেন। স্রষ্টার ইচ্ছে হয়েছে তাই সাগরিকাকে নিয়ে গেছেন। জন্ম মৃত্যু তো স্রষ্টার হাতে। তাই স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না‌। তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি যাহা জানেন এবং যাহা বোঝেন সেটা আর কেউ বোঝে না। এই সব কথা ভাবতে ভাবতে রাফি হারিয়ে গেছে সাগরিকার মাঝে। তখন সূর্য ডুবু ডুবু ভাব। যাকে বলে গোধূলি সন্ধ্যা। পিছন দিক থেকে  সাথি এসে রাফির গায়ে হাত রাখলো। রাফি পিছু ফিরে দেখে সাথি। রাফি সাথিকে বললো দ্যাখো সাথি কৃষ্ণচূড়া ফুল গুলো পড়েছে কবরের উপর। ফুলে ফুলে কবর ছেয়ে গেছে। বিশ বছরের ভালবাসার  অবসান হলো! আর আমাকে বলবে না তুমি খেয়েছো? তোমার কি হয়েছে? মন খারাপ কেন ? চিন্তা করোনা আমি তোমার পাশে আছি। কথা গুলো রাফি বলছিলো আর চোখের জল ফেলছিলো। সাথি মৃদুস্বরে বললো আমি আছি। আপনার আর অনিন্দ্যের সব দায়িত্ব আমি নিলাম। ভিতরে চলুন। রাফি সাথি অনিন্দ্য ভিতরে চলে গেলো। সূর্য ডুবে গেছে। তিমির রাত্রি এখন। সেই তিমির রাত্রিতে জোনাকিরা দল বেঁধে আলো জ্বেলে দিয়েছে। আলো আঁধারে সারা বাড়িময়। রাফির চোখে নিদ্রা নেই। তাই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সাগরিকার সমাধি। সারা রাত রাফি দাঁড়িয়ে ছিলো এক ধ্যানে এক জ্ঞানে। পাশে হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো সাথি আর অনিন্দ্য। রাতের আঁধার পেরিয়ে ভোরে নতুন সূর্য উদয় হলো। চারিদিক নির্মল আলোর সমাহার। 

নীড়হারা পাখিরা যে যার মত উড়ে চলেছে জীবনের তাগিদে। এই তো ক্ষণিকের পৃথিবী। তারপরও পৃথিবীর মায়া মমতায় মানুষ আবদ্ধ। আকাশ মাটির প্রেমে মানুষ সিক্ত। এই পৃথিবী হলো হাটবাজার করা আর পুতুল খেলা। রাতের আঁধার শেষে ভোরে নতুন সূর্য উঠে আলো ছড়িয়ে দেবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তাই রাফি স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোন প্রকার স্বাভাবিক হতে পারছে না। যার যায় সেই বোঝে বিষাদের যন্ত্রণা। প্রতিটি মানুষের বেলায় সেই একই নিয়ম, একই বিধান। এই আলো আঁধার সুখ দুঃখ হাসি কান্না ভাঙা গড়ার খেলা। তেমনই রাফির প্রেম বলে কথা। জীবনের সব কিছু ভুলে যাওয়া যায় কিন্তু প্রথম প্রেম ভুলে যাওয়া যায় না। প্রথম প্রেম হলো অমর প্রেম। রাফি ও ভুলতে পারছে না মধুময় প্রেমের সেই সব স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলো। স্মৃতি যে বড়ই বিধুর! প্রতিটি মুহূর্তের স্মৃতি মনে করে দিচ্ছে অতীত স্মৃতিময়। রাফি স্ত্রীকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল! জীবনের বিয়োগান্ত পরিণতিতে মর্মাহত। রাফির ব্যথাহারি মনটা বড়ই চঞ্চল, বড়ই অশান্ত। হৃদয়ের মন্দির অন্ধকারাচ্ছন্ন! হাসি কান্নার ভুবনে শুধু নয়ন ভরা জল! এ জল সে জল নয় রীতিমত প্রলয় নির্বাসিত অশ্রু গঙ্গা জল। বিরহ মনে এমনি ভাবে রাফির দিন চলে যাচ্ছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।  শুধু বিরহ বেদনায় নয়ন ভরা জল!





সাইকো কিলার

ম ম তা  শ ঙ্ক র  সি ন হা (পা ল ধী)

         সন্তোষ দে অশোক নগরের দেবীগড়ের একজন প্রতিষ্ঠিত ধনী ব্যবসায়ীক ব্যক্তি,তিনি ও তার পরিবার বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত। তারা বেশ ভালোই ধার্মিক পরিবার হিসাবে পাড়ায় পরিচিত।বছরে দুই তিনবার তার বাড়িতে বেশ ঘটা করে নারায়ণসেবা,বৈষ্ণব সেবা ও হরিনাম সংকীর্তণের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও পাড়ার লোকেদের সাথে সন্তাষ দে ও তার পরিবারের সদস্যদের তেমন সদভাব কোনোদিনই সে রকম নেই।কারণ সন্তোষ দে'র কেবলমাত্র ছোটোছেলে মনীষ ছাড়া বাকিরা সকলে তেমন মিশুকে নয় ।সম্প্রীতি ও সংযুক্তা এই দে বাড়ির দুই ছেলের বৌ,মানে ছোটো ছেলে মনীষের স্ত্রী সম্প্রীতি ও বড় ছেলে শিবেনের স্ত্রী সংযুক্তা।মনীষের স্ত্রী সম্প্রীতি মনীষের মতই প্রাণবন্ত ও মিশুকে।অপরদিকে বড়বৌ সংযুক্তা প্রাণবন্ত হলেও এবং সকলের সাথে মিশতে চাইলেও স্বামী,শ্বশুর,শ্বাশুড়ির চাপে সকলের সাথে মিশতে পারেনা।
        সে যাই হোক-- তাদের এই ধর্মাচরন ও ঐ দে পরিবারের সদস্যদের বেশকিছু আচারন পাড়ার মানুষদের কাছে বিশেষ ভালো লাগতো না।তবুও প্রতিবেশীরা তা মেনে নিতেন পাড়ায় শান্তি বজায় রাখার জন্য।একটি অপ্রত্যাশিত, অনভিপ্রেত ঘটনার পরিপেক্ষিতে অশোকনগরের দেবীগড়ে সন্তোষ দে'র পরিবারকে কেন্দ্র করে পাড়ায় তৈরী হল চরম উত্তেজনা।এই পরিস্থিতি ঘটার দিন পাঁচেক আগে সন্তোষ দে'র ছোটছেলে ও বৌমা তাদের একমাত্র মেয়ে মৌ কে নিয়ে দিল্লী বেড়াতে গিয়েছিল। তারা তাদের বাড়িতে ও পাড়াতে যা ঘটনা ঘটে চলেছে তার বিন্দুবিসর্গ জানত পারেনি। মনীষের ব্যবহার তাকে পাড়ার মানুষের কাছে বেশ ভালোবাসার পাত্র করে তুলেছিল। সেই জন্য মনীষকে ওর বন্ধুরা ও কিছু সহৃদয় প্রতিবেশী ওর বাড়ির ও পাড়ার বর্তমান অবস্থার কথা জানায় ওকে ফোনে এবং দিল্লী থেকে ফিরে সম্প্রীতি ও মৌ'কে নিয়ে মনীষ যেনো এখনই বাড়ি না ফেরে সে পরামর্শও দেয় তারা মনীষকে। তারা এও বলে--পরিবার নিয়ে মনীষ যেনো এখন বেশ কিছুদিন বারাসতে ওর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে থাকে।পাড়ার পরিবেশ ও থানা পুলিশের ঝামেলা একটু ঠান্ডা হওয়ার পর ওরা মনীষকে ফোন করে সব খবর দিলে তারপর যেনো মনীষ স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরে।মনীষ সম্প্রীতিকে বড়বৌদির অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা,থানা,পুলিশ ও পোস্টমটেম রিপোর্টের কথা জানায়।
        সম্প্রীতি মনীষের মুখে সব ঘটনা শুনে বলে--"বড়দিকে আমি কতবার বলেছিলাম যে দিদি তুমি এইসব অন্যায় মুখবুঝে আর সহ্য করো না।অনেক হয়েছে ,আর নয় ,তুমি এবার ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে তোমার বাপের বাড়ি চলে যাও।আর আমি এও দিদিকে বলেছিলাম--চলো তোমার দেওয়ারকে নিয়ে পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের তোমার উপর হওয়া নিত্য এই অত্যাচারের কথা জানাই। ওনার কিছু তো একটা ব্যবস্থা করবেন,নয় তো থানা পুলিশ করি।না!দিদি কিছুতেই কিছু করলো না।শ্বশুর বাড়ীর আর বাপের বাড়ির সম্মানের কথা ভেবে।শুধু শুধু বাচ্চা দুটোকে অনাথ করে মনীষ তোমার বাবা মা দাদা আর তোমার দিদি মিতার অকথ্য অত্যাচারের বলি হলো বড়দি।অর্থ আর সম্পত্তির এত লোভ??তোমার বাবার তো অনেকে আছে।তোমার দিদির শ্বশুর বাড়ীর সম্পত্তি,অর্থও তো কম নয়।জামাইবাবুও তো ভালো চাকরি করেন। তোমার জামাইবাবু দেবদত্তদা তো খুব ভালোমানুষ। আর তোমার দিদি তার ঠিক বিপরীত। এই নিয়ে তো প্রায়ই অশান্তি হতো।সেটা আমরা জানি।এখন দেবদত্ত দা তোমার দিদির উপর বিরক্ত হয় আর কিছু বলেন না ঠিকই তবে মিতাদিকে কোনও দিনই উনি কোন খারাপ কাজে প্রশ্রয় দেন না।মনীষ কেবলমাত্র এই বাড়িতে ওনার সাথে তোমার আর আমারই মতের মিল হয়।আর সকলকে দেবদত্ত দা একদম পছন্দ করেন না বলে আর আসেন না এবাড়ি খুব একটা।
তবে কেনো ,কেনো তোমার বাড়ির সকলের এত লোভ ছিলো বড়দির বাবার সম্পত্তির উপর??আমি তো শুনেছি শুধু নয়--নিজের চোখেও তো বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এসে দেখেছি বড়দির বাপের বাড়ির থেকে কম কিছু দেয়নি!সোনা থেকে শুরু করে যাবতীয় জিনিস পত্র যখন যা দাবি করেছে বড়দা থেকে শুরু করে তোমার বাবা-মা।বিয়েতেও শুনেছি প্রচুর দিয়েছেন দিদির বাবা, দাদারা ওদের বাড়ির একমাত্র আদরের মেয়ে কে।তবে কেনো,কেনো ঘটলো এ অঘটন?? মনীষ এর উত্তর কি? কি এর উত্তর মনীষ?? বলো,বলো মনীষ।" রাগে,খোভে,ঘৃণায় সম্প্রীতির আর মনীষের মন ভোরে ওঠে।সংযুক্তার করুণ মুখটা বারংবার ওদের চোখে ভেসে ওঠে।দুজনের চোখ থেকে প্রিয়জন হারাবার বেদনায় গড়িয়ে পড়ে অশ্রুধারা।

        সংযুক্তা বনগাঁর এক সম্ভ্রান্ত বনেয়াদি বাড়ির মেয়ে।ছোটো থেকেই সে গ্রামের মুক্ত পরিবেশে বাড়ির সকলের উদার মানসিকতার মাঝে বেড়ে উঠেছিল প্রাণবন্ত ভাবে।তাদের পৈত্রিক সুবিশাল দ্বিতল বাড়ির, বিঘের পর বিঘে চাষের ধানি ও দোফসলী জমি এবং পাটের আড়ৎ সহ বাপ-ঠাকুরদা সহ কাকাদের পৈত্রিক বিভিন্ন ব্যবসা।সংযুক্তা বনগাঁর নামকরা সেন বাড়ির সকলের ছোট একমাত্র আদরের মেয়ে।বাবা-মা,দাদা,কাকা-কাকিমা ও বৌদিদের চোখের মণি ছিল সংযুক্তা।পড়াশুনাতেও সে ছিলো যথেষ্ট ভাল ছাত্রী।কলেজে পড়ার সময় শিবেনের সাথে ওর আলাপ।কথার চাতুর্যে শিবেনে সংযুক্তার সাথে তৈরী করে ভালোবাসার সম্পর্ক। যে সম্পর্ক একমাত্র মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই প্রায় নিজেদের শত অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও মেনে নেয় সংযুক্তার পরিবার।তারপর কলেজের পাঠ চুকিয়ে শিবেন তার বাবার ব্যবসার কাজ দেখাশোনা করলেও বদনেশা তাকে চেপে ধরে ও সে পয়সা ওড়াতে থাকে।যাতে এমত অবস্থায় ছেলের কুকর্ম সকলের কাছে জানাজানি না হয়ে সে কথা চিন্তা করে ও সংযুক্তার মত ধনী পরিবারের সোনার ডিম দেওয়ার মত রাজহাঁস যাতে হাত ছাড়া না হয়ে যায় সেই কথা ভেবে শিবেনের পরিবার তড়িঘড়ি সংযুক্তার পরিবারের সামনে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়। 
      লোভী সন্তোষ বাবু ও তার পরিবার এত বড় সুযোগ কোনো মতেই হাতছাড়া করতে চান না।সন্তোষ বাবুর ছোট ছেলে মনীষ বারংবার তার "বাবা,মা,দাদা সকলকে বলে এত বড় অন্যায়ই তোমরা করো না মেয়ের বাড়ির সকলের সাথে।ওদের তোমরা জানও এ বিয়ে সম্ভব নয়।তোমরা তো জানো যে দাদার অনেক আগে থেকেই ব্যারাকপুরের অবিনাশ রায়ের মেয়ে দীপার সাথে একটা রিলেশন রয়েছে।তবে কেনো করছো একটা নিরীহ, নিষ্পাপ মেয়ের এত বড় সর্বনাশ।"
          সন্তোষবাবু ও তার স্ত্রী সহ শিবেন ছোটো ভাই মনীষের প্রতিবাদে যেনো তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে ও তার প্রতি মারমুখী হয়।অর্থ আর সম্পত্তির লোভ মানুষকে কতটা নির্মম, পৈশাচিক করে তুলতে পারে তার প্রকৃত উদাহরণ সন্তোষ দে'র পরিবার।
         সন্তোষ বাবুর ছোটো ছেলে মনীষ বার দু'য়েক সংযুক্তার বাড়ির লোকজনকে ফোনে তার দাদা,বাবা-মার মতলবের কথা বলতে গিয়েও বলতে পারেনি এবং বললেও ওর দাদা শিবেন ও সন্তোষ বাবুরা বিভিন্ন কথার মারপ্যাঁচে সে সব কথা উড়িয়ে দিয়েছেন। 
         যথা সময়ে বেশ মোটা টাকা বরপণ,সোনার গহনা সহ দামী,দামী উপঢৌকণ নিয়ে এক কথায় প্রায় বেকার---যদিও শিবেন ও তার বাড়ির লোকজন বলে যে শিবেন তার বাবার ব্যবসার অংশীদার আর ওর ছোটো ভাই এইসব ব্যবসার মধ্যে নেই। কারণ সে চাকরীর জন্য পড়াশুনা করছে।সে কোনদিনই তারা বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নেবে না।সে একটু অন্য ধাতের ছেলে।অত ব্যবসা ট্যাবসা সে বোঝে না।
        মাঘের এক শুভক্ষণে শিবেন ও সংযুক্তার চারহাত এক হয়ে গেলো বিবাহের পারিবারিক ও সামাজিক সকল রীতি নীতি মেনে।নববধুর গৃহপ্রবেশ বিবাহের সকল স্ত্রী আচার থেকে রিসেপসন ও অষ্টমঙ্গলা সব শেষে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসার পর সংযুক্তার শ্বাশুড়ি ওর কাছ থেকে সংযুক্তাকে পরার মত সামান্য গহন পরার জন্য সংযুক্তার নিজের কাছে রেখে দিতে বলে বাকী সকল ভারী ভারী গহন শ্বাশুড়ি মা তার নিজের আলমারির লকারে তুলে চাবি দিয়ে সেই চাবি নিজের শাড়ির আঁচলে বেঁধে রাখলেন এবং সংযুক্তাকে বললেন শোনো বড় বৌমা "দিনকাল তো ভালো নয় তারপর আবার তোমরা সব আজকালকার ছেলে মেয়েরা নিজেদেরই এখনও ভালো করে সামলে উঠতে পারো না।তাই তোমার বাপের বাড়ির থেকে দেও ঐ সব ভারী ভারী গহনা আজ থেকে আমার দায়িত্বেই থাক বাপু।তোমার মনের আনন্দে ঘোরোফেরো সংসার কর তারপর ছেলেপুলে হলে আমার যখন বয়স হবে তোমার জিনিস তোমার হাতেই আমি ফিরিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হব মা।আর ঘরের জিনিস তো ঘরেই রইলো।যখন মন চাইবে বা কোনো অনুষ্ঠানে যাবে আমার কাছে চাইলেই আমি তোমার গহনা তোমাকে পরতে দেবো।"নিষ্পাপ, নিরীহ সংযুক্তা শ্বাশুড়ি মা'য়ের কুট চাল কিছুই বুঝতে পারলো না।একদিন নয় দুদিন নয় বেশ দু'চার বছর পর সংযুক্তা তার একমাত্র আদরের দেওয়র মনীষের বিয়েতে পরার জন্য শ্বাশুড়ি মা'য়ের কাছে ওর বাবার দেওয়া গহনাগুলো পরার জন্য চাইতেই সংযুক্তার প্রতি ওর শ্বাশুড়ির শুরু হলো নানা আকথা কুকথার বর্ষণ। এর আগে একটু বলে রাখা ভালো যে সংযুক্তা ও শিবনের প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ায় সংযুক্তাকে শ্বাশুড়ি মা প্রায়ই গালিগালাজ করতেন। মেয়ে দীপার মুখের দিকে তাকিয়ে ও সংসারের শান্তি কথা মাথায় রেখেই সংযুক্তা সব রকম অত্যাচার সহ্য করতো আর শিবেনও তাকে কোনো না কোন অছিলায় বাপের বাড়ির থেকে টাকা আনার জন্য চাপ দিতো এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতো ঘর বন্ধ করে উচ্চস্বরে মিউজিক সিস্টেম চালিয়ে দিয়ে।যা ঘটতো তা মনীষের অজান্তেই বা মনীষ বাড়ি থাকলে বিষয়গুলি থামাতে চাইলে তাকেও মারধর করতো ওর দাদা শিবেন। এরপর অশান্তি মাঝখানে চরমে উঠলে সংযুক্তার বাপের বাড়ির লোকজন এসে সংযুক্তা আর মেয়েকে ওনাদের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখেন।কিন্তু মাসখানেক কাটতে না কাটতেই শিবেন ওর বাবা-মার সাথে বনগাঁয় শ্বাশুড় বাড়িতে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা প্রাপ্তি হয়ে এবং এসব ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না এই মর্মে সংযুক্তা ও মেয়ে দীপাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে আনে।
       আজ মনীষের বিয়ে উপলক্ষ্যে শ্বাশুড়ির কাছে সংযুক্তা তার নিজর গহনা পরতে চাওয়াতে শ্বাশুড়ি মা কেনো এরকম তেলেবেগুণে জ্বলে উঠে এক বাড়ি আত্মিয়স্বজনের সামনে অপমানজনক কথা বলার কারণ সংযুক্তার মাথায় না আসলেও তার নিষ্পাপ মনে যেনো কেমন সন্ধেয়োর উদ্রেক হলো যখন সে দেখলো তার ননদ মিতার গলায় সংযুক্তার বাপের থেকে দেওয়া ওর ঠাকুমার সেই পৈত্রিক আভিজাত্যময় সাতনরির সীতা হার ও কানের পরে শ্বাশুড়ি মা'য়ের ঘরে প্রবেশ করতে।
  
          সংযুক্তা এবার সকলের সামনেই তার একমাত্র ননদ--মিতাকে প্রশ্ন করে--মিতা তুমি কেনো আমার বাবার দেওয়া আমার ঠাকুমার সাতনরির সীতা হার কানের পড়েছো?কে দিয়েছে তোমাকে এ হার কানের পড়তে?
       এবার সংযুক্তার শ্বাশুড়িমা ওর হাত ধরে টেনে ওই ঘর থেকে বার করে এনে সংযুক্তার ঘরে এনে সংযুক্তার গালে সপাটে এক চড় মেরে বলেন "বৌমা তোমার যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা দেখছি!বাপের বাড়ির থেকে আসার পর দেখছি তোমার খুব কথা ফুটেছে মুখে।মিতাকে আমিই তোমার ঐ হার বিয়েতে পরার জন্য দিয়েছি।তাতে তোমার অত গাত্রদাহ হওয়ার কি হয়েছি শুনি?তুমি তো তোমার বড়লোক বাপের একমাত্র আদরের মেয়ে আর তোমার দাদাদেরও তো প্রচুর অর্থ। যাও না বাপু বাপের বাড়ির থেকে দেওয়ার বিয়েতে পড়ার জন্য আরও গহনা নিয়ে এসো গে।" সংযুক্তার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ে।মানুষ এত বেইমান,ঠগ,জোচ্চোর, অমানবিক হতে পারে??সে কার কাছে যাবে এসব কথা বলে তার প্রতিকার চাই তে??স্বামী!না!সে তো আরও বড় অমানুষ।যাকে ভালোবেসে প্রতারিত হয়েছে জীবনে।সংযুক্তা মনে মনে বলে আমার ভুলেই তো আজ এত অশান্তির সূত্রপাত। কেনো সেদিন আমি বিশ্বাস করলাম শিবেনের মিথ্যা ভালোবাসার ছলনা।বাড়ির সকলের অনিচ্ছাতে শিবেনকে বিয়ে করে চরম ভুল আমি করলাম। আজ আর সে ভুল শোধরানোর সুযোগ ভগবান আমাকে দেবেন!!!হায় ঈশ্বর!!"
        এরপর সকলে মেতে ওঠে মনীষ আর সম্প্রীতির বিয়ের আনন্দে।

         মনীষ আর সম্প্রীতির কিন্তু শিবেন আর সংযুক্তার মত ভাব ভালোবাসা করেই বিয়ে।যে ভালোবাসার মধ্য নেই কোনো স্বার্থ আছে কেবল নিঃস্বার্থ প্রেম,বিশ্বাস। মনীষ ও সম্প্রীতি একই রকমের মানসিকতার মানুষ। তারা দুজনেই স্বাধীনচেতা,উদার মনষ্ক,শিক্ষিত ও চাকুরীরত। সম্প্রীতির বাপের বাড়ির সকলেই উচ্চশিক্ষাত ও প্রতিষ্ঠিত। তারা মনীষের চিন্তাধারা,ব্যক্তিত্ব এইসব বিচার করেই এ বিয়েতে রাজি হন।আর অপরদিকে মনীষের পরিবার সম্প্রীতির প্রতি তেমন দুর্ব্যবহার করতে ভয় পায় সংযুক্তার মত কারণ সম্প্রীতি প্রতিবাদী,চাকুরীরত, স্বাধীনচেতা,উদার মনষ্ক এক অন্য ধাঁচের মানবী।যে বিয়ে হয়ে এসে পর্যন্ত সন্তোষ দে'র পরিবারের সদস্যদের অমানবিকতার বিরুদ্ধে তার স্বামী মনীষের মতই আর এক প্রতিবাদী সত্ত্বা হয়ে উঠেছে।সম্প্রীতি তার বড়জা'কে ভীষণ ভালোবাসে।বড়দির প্রতি তার শ্বশুর বাড়ীর উদ্দেশ্য প্রণীত, অভিসন্ধীকর দুর্ব্যবহার সে ও মনীষ কোন ভাবেই মানতে পারে না।বারংবার সম্প্রীতি সংযুক্তাকে বলে দিদি তুমি তোমার উপর হওয়া অত্যাচারের প্রতিবাদ করো।সম্প্রীতি যখন দিয়ার জন্ম দেয় তখন সংযুক্তাও দ্বিতীয়বার মা হয়---জন্ম দেয় ছেলে অনির।তবুও ঘরোয়া,মিশুকে নম্র সংযুক্তার জীবনে সম্প্রীতি ও মনীষের অনুপস্থিতে ঘটে জীবনের করুণ চরম পরিনতি। 
           পূজোর ছুটিতে কয়েকদিনের জন্য মনীষ ও সম্প্রীতি এবার ওদের একমাত্র মেয়ে দিয়াকে নিয়ে দিল্লী বেড়াতে যায়।এদিকে বাড়ি ফাঁকা পেয়ে সংযুক্তার উপর সন্তোষ বাবুর স্ত্রী,মেয়ে মিতা ও সংযুক্তার গুণোধর স্বামী শিবেন চড়াও হয়।সংযুক্তা ও শিবনের বেডরুমে বেশ জোরেই মিউজিক সিস্টেম বাজতে থাকে।আর সংযুক্তার ছেলে ও মেয়ে পাশের বাড়িতে ওদের সমবয়সী দুটি বাচ্চার সাথে নিত্যদিনের মত খেলতে চলে যায়।এরপর বেশকিছুক্ষণ পর দেখা যায় একটি ট্রলিভ্যান ডেকে তাতে করে হঠাৎই সংযুক্তাকে অচেতন অবস্থায় চাপিয়ে শিবেন বাড়ির থেকে বার হলে পাড়ার বেশ কয়েকজন যানতে চান সংযুক্তাকে কেনো শিবেন এরকম করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ করে।এইসব কথা শুনে সন্তোষ বাবুর স্ত্রী ও কন্যা মিতা ঘর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বার হয়ে উঠনো দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে আরে আমাদের সংযুক্তা আর বোধ হয় বাঁচবে না ঠাকুর। ওর তো আজ সকাল থেকেই বুকে ব্যথা করছিলো আর সাথে প্রচন্ড ডিহাইড্রেশন হয়েছে গো।তাই আর কোনো উপায় না পেয়ে এখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে শিবেন। কিন্তু এভাবে কেনো ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে প্রতিবেশীরা কিছু বুঝতে পারলো না কারন ওদের তো বাড়িতে গাড়ি আছে---তাও এইভাবে বাড়ির বৌটাকে নিয়ে যাচ্ছে ওরা ডাক্তারের কাছে। পাড়ার লোকেদের ব্যপারটা বেশ ঘোটালো বলে মনে হয়।সে যাই হোক তবুও তারা কিছু বলে না।এই ভেবে যে আগে অসুস্থ মানুষটা সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসুক তারপর মনীষ ও সম্প্রীতি দিল্লী থেকে বাড়ি ফিরলে সব কিছুই সঠিকভাবে জানা যাবে।
       এরপর শিবেন মিনিট কুড়ি বাদে সংযুক্তাকে নিয়ে ট্রলিভ্যানে করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলে দে বাড়ির উঠোনে পাড়ার লোকেরা ভিড় করে এবং দেখে ভ্যানের উপর নিথর সংযুক্তার দেহটি পড়ে রয়েছে আর শিবেন বাড়ির ভিতর কাঁদতে কাঁদতে ছুটে ঢুকে গেছে।সংযুক্তার মৃতদেহ দেখে আশেপাশের বাড়ির মহিলাদের সন্দেহ হয়। তারা দে বাড়িতে সংযুক্তার উপর ঘটা নিত্যদিনের অত্যাচারের কথা ও নিত্য অশান্তির কথা কেউ কেউ জানতো ।সেই জন্য তারা পড়ার ক্লাবের ছেলেদের ডেকে সব কিছুই দেখায় ও তাদের সন্দেহের কথা খুলে বলে।অশোকনগরের দেবীগড়ের সন্তোষ দে'র পাড়ার মৈত্র সংঘের ছেলেরা ডেডবডি শ্মশানঘাটে নিয়ে যেতে বাঁধা দেয় এবং বলে আগে থানায় ও সংযুক্তার বাপের বাড়ির লোকজন এই বাড়িতে আসবে তারপর যা করার তা করা যাবে।
        অতীন মৈত্র কলকাতা হাইকোর্টের একজন বেশ নামকরা ক্রিমিন্যাল লইয়ার।বেশ জটিল জটিল ক্রিমিন্যাল কেস তিনি অনায়াসে সমাধান করে অভিযুক্তদের জেলার ঘানি টানিয়ে ছেড়েছেন।
         আজ রবিবার সকাল এগারোটা-- অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্র সোদপুরে তার নিজস্ব বাসভবন নীলয় ভবনে নিজের চেম্বারে বসে একজন মক্কেলের সাথে একটি কেসের বিষয়ে জরুরী আলোচনা করছিলেন।এমন সময় তার জুনিয়র মৈনাক একজন পৌড় ও দু'জন মাঝ বয়সী যুবকের সাথে অতীনবাবুর চেম্বার সংলগ্ন বসার ঘরে এসে হাজির হলো।অতীনবাবু ফ্যানের হাওয়ায় উড়ন্ত পর্দার ফাঁক দিয়ে আড়চোখে তা খেয়াল করলেন। আসলে উকিলের চোখ তো।কোনও কিছুই এড়িয়ে যায় না।মৈনাক তাদের সেই ঘরের সোফায় বসতে বলে তার স্যার অতীনবাবুর অনুমতি নিয়ে চেম্বারে প্রবেশ করে অতীনবাবুকে ঐ তিনজন মক্কেলের কথা বললে অতীনবাবু মৈনাকে বলেন-- ওদের একটু বসতে বলো।অতীনবাবু তার সামনের চেয়ারে বসে থাকা মক্কেলের দিকে তাকিয়ে বলেন--আমি ওনাকে ছেড়ে একটু পরেই ওদের ডেকে কথা বলে নেবো।
      মৈনাক চেম্বার থেকে বেরিয়ে ঐ তিন ব্যক্তিকে একটু অপেক্ষা করতে বলে নিজের কাজে চলে যায়।মিনিট দশ-পনেরো পরে অতীনবাবু ঐ তিনজনকে তার চেম্বারে ডেকে নেন।
       তিনজনের চোখে মুখে একটা হতাশা,কষ্টের ছাপ পষ্ট। অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্রকে ঐ তিনজন পরিচয় দেন সংযুক্তার হতভাগ্য বাবা দিবাকর সেন,সংযুক্তার ছোটদা রথীন সেন ও দেওয়র মনীষ দে বলে।
       নমস্কার উকিলবাবু আমি দিবাকর সেন এ আমার ছোটো ছেলে রথীন সেন আর এ আমার একমাত্র হতভাগ্য মেয়ে সংযুক্তার একমাত্র দেওয়র মনীষ দে---রথীন ও মনীষকে দেখিয়ে অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্র এর সাথে পরিচয় পর্ব সারেন সংযুক্তার হতভাগ্য বাবা দিবাকর বাবু।
       দিবাকর বাবু অতীন বাবুকে বললেন-"উকিলবাবু আজ থেকে ঠিক সাত বছর আগে আমার একমাত্র মেয়ে সংযুক্তার সঙ্গে ভালোবাসা করে মনীষের দাদা শিবেনের সাথে দুই বাড়ির মতেই তবে এখানে আগে আপনাকে বলে রাখি আমাদের কিছুটা অমতেই আমার মেয়ের জেদের কাছে নতী শিকার করে আমার ও আমার পরিবারের অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও অশোকনগরের দেবীগড়ের বাসিন্দা সন্তোষ দে'র বড়ছেলে মানে মনীষের দাদা শিবেনের সাথে আমার একমাত্র আদরের মেয়ে সংযুক্তার বিবাহ হয়।দিবাকর সেন অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্রকে বললেন --আমি আমার সাধ্যমত উজার করে আমার একমাত্র মেয়ের বিবাহ দিই।শুধু তাই নয় বিয়েতে মেয়েকে শুধু ভারী ভারী গহনা নয়--আসবাবপত্র,দানসজ্জা এবং একমাত্র জামাই শিবেনকে ও তার পরিবারকেও যথেষ্ট উপঢৌকণ দিই বিয়েতে।শিবেনের ছোটভাই মনীষ এ বিয়েতে প্রথম থেকেই আপত্তি করে আসছিল।আমাদের ও আমার মেয়ে সংযুক্তাকে মনীষ বারংবার বারন করে এ বিয়ে না করার জন্য।আমরা ভবি মনীষের কোন দুর্ভিসন্ধী আছে এই বিয়ে নিয়ে।কিন্তু এখন আমরা সকলে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি--সেদিন মনীষের কথা না শোনার ফল।"দিবাকর সেন আবার অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্রকে বলতে থাকেন--"উকিলবাবু জানেন মনীষের তার দাদা শিবেন ও আমার মেয়ে সংযুক্তার এ বিয়েতে আপত্তির কারণ---কারণ মনীষ ওর দাদাসহ ওর বাড়ির সকলের অভিসন্ধীর কথা আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল কিছুটা।কিন্তু না!!!!!আমরা মনীষের কথা বিশ্বাস না করে শিবেনসহ সন্তোষ বাবুর পরিবারের আর অন্য সকলের কথা বিশ্বাস করে শিবেন আর সংযুক্তার বিয়েটা দিয়েই ফেললাম।"আর-----দিবাকর বাবুর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো।মনীষ ও রথীন তাকে শান্ত করলো।এবার সংযুক্তার ছোটদা রথীন অতীনবাবুকে বলতে থাকে-"নানা কারনে অকারণে শিবেন ও ওর বাবা, মা ও শিবনের বোন মিতা আমার বোনের উপর অত্যাচার করত।আর প্রায়ই ব্যবসার নাম করে আমাদের কাছে বোনকে দিয়ে জোর করে টাকা চাইতো।অনেক বার মনীষ এই বিষয়গুলির তীব্র প্রতিবাদ করলে ওকেও অশান্তি চরমে উঠলে বাড়ি ছাড়তে হয় এবং আমাদের বোনকে মানসিক ও শারীরিক ভাবে ওর শ্বশুর বাড়িতে মনীষ ব্যতীত অন্যান্য সদস্যদের দ্বারা নিগৃহীত হতে হয় চরমভাবে।মনীষ সে কথা আমাদের ফোনে জানালে আমরা সংযুক্তার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে চাইলে শিবেন ও ওর বাবা মা সংযুক্তা সহ ওর মেয়ে দীপাকে সন্তোষ বাবুর অশোকনগরের দেবীগড়ের বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে আমাদের সাথে।আমরাও আমার বোন সংযুক্তা ও ওর মেয়ে দীপাকে নিয়ে বনগাঁতে আমাদের বাড়িতে চলে আসি।"
       এবার সংযুক্তার দেওয়র মনীষ অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্রকে বলে-- "আমার বড়বৌদি সংযুক্তার দে'র এই অস্ভাবিক মৃত্যুর জন্য আমি আমার বাবা,মা,দিদি ও দাদাকে অপরাধী বলে দায়ী করি উকিলবাবু।ওরাই আমার নিরীহ, নিষ্পাপ দেবীর মত বৌদিকে হত্যা করেছে।আর আমার বাবা ও দাদা তো সহজ লোক নয় ওরাই পয়সা দিয়ে বৌদির পোস্টমটেম রিপোর্টের অদলবদল করেছে বলে আমি মনে করি। আমার বৌদি কোনও দিনই আত্মহত্যা করতে পারেনা অমন দুটি ফুটফুটে ফুলের মত বাচ্চর কথা না ভেবে।এই অপরাধের আসল রহস্যের সমাধান আপনাকেই করতে হবে স্যার।আপনার কাছে সকল অপরাধীই তার অপরাধ শিকার করতে বাধ্য হয়।আপনি বহু নিরাপরাধ মানুষের যেমন সাহায্য করেছেন তেমনি আমাদের মত হতভাগ্য মানুষদের সাহায্য করেছেন সকল জঘন্য অপরাধীদের আইনের শাসনের সঠিক পাঠ পড়িয়ে। তাই তো আমি আপনার জুনিয়র মৈনাকের সাথে যোগাযোগ করে আমার বৌদির বাবা ও ছোটদাকে নিয়ে আপনার কাছে আইনি পরামর্শ ও সাহায্যের জন্য এতদুর ছুটে এসেছি উকিলবাবু।"
          অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্র এতক্ষণ বেশ মনযোগ সহকারে তার তিন মক্কেলের কথা শুনছিলেন এবং এই কথা শোনার ফাঁকে দুঁধে ক্রিমিনাল লইয়ার অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্রের চোখে এও ধরা পড়ে---মনীষ মাঝে মাঝেই অতীনবাবুর বইয়ের র‌্যাকে রাখা আইনীবই, কিছু দেশী-বিদেশী সুনামধন্য বিশিষ্ট লেখকদের বইয়ের সংগ্রহ ও অতীনবাবুর চেম্বারের দেওয়ালে টাঙানো একটি সুন্দর সৌখিন ফ্রেমেবন্দী প্রাকৃতিক দৃশ্যপটের ছবি দেখছিল-- যা অতীন মৈত্র তার স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে অভীককে নিয়ে যখন তিনবছর আগে মোরিসাস ভ্রমণে গিয়েছিলেন সেই সময় সেখান থেকেই নিয়ে এসেছিলেন ওর স্ত্রী দেবযানী।মনীষের চোখের সেই দৃষ্টি দেখে অ্যাডভোকেট অতীনবাবুর মনে হয়েছে যুবকটি বেশ সৌখিন,শিক্ষিত।
         সব কথাবার্তা শোনার পর--এবার সংযুক্তার বাবা দিবাকর সেন ও সংযুক্তার ছোটদা রথীন সেনকে অতীনবাবু প্রশ্ন করলেন--"আপনার মেয়ে/আপনার বোনের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য আপনারা কি লোকাল থানায় কোনও F I.R করেছেন আপনার মেয়ের স্বামী,শ্বশুর, শ্বাশুড়ির ও ননদের নামে?আর পোস্টমটেম রিপোর্ট টি যে মনীষবাবুর সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে মনে হচ্ছে তার সপক্ষে কি আপনাদের কাছে কোন প্রমাণ আছে?যদি থাকে তা কি ইভেসটিগেশন অফিসারকে আপনারা দেখিয়ে ছিলেন বা কিছু জানিয়ে ছিলেন?"
দিবাকর সেন বলেন "আমাকে ও আমার পরিবারের লোকজনকে সংযুক্তার মৃত্যুর খবর শিবেনদের পাড়ার মৈত্র সংঘের ছেলেরা সম্ভবত ওদের কাছ থেকে জোর করে আমাদের ফোন নম্বর নিয়েই কিংবা মনীষকে দিল্লীতে ফোন করে জেনে নিয়ে জানায়।একমাত্র মেয়ের এহেন মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমরা প্রথমে সম্পূর্ণ বিমর্ষ হয়ে পড়ি এবং উদ্ভ্রান্তের মত অশোকনগরের দেবীগড়ের সন্তোষ বাবুর বাড়িতে মানে আমার মেয়ে সংযুক্তার শ্বশুরবাড়িরতে ছুটে যাই। ততক্ষণে সেখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভিড় যথেষ্ট জমে উঠেছিল এবং পুলিশও এসে হাজির হয়।আমাদের সকলের উপস্থিতেই আমার মেয়ের মৃত্যদেহ পোস্টমটেমের জন্য নিয়ে চলে যায় পুলিশ।"
     অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্র বলেন--"আচ্ছা দিবাকর বাবু আপনাদের কেনো বারে বারে মনে হয়েছে পুলিশ সংযুক্তার পোস্টমটেম রিপোর্টে কোনা কোন গড়মিল করেছে?আর মৈনীষ বাবু আপনারও কেনো মনে হয় আপনার বৌদি সংযুক্তা আত্মহত্যা করেন নি ।তাকে হত্যা করা হয়েছে?"
        এবার মনীষ অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্রকে বলে আমাদের এই কথা মনে হওয়ার একটা কারন আছে উকিলবাবু,সেই কারনটা হল--- --"আমার দাদার সাথে ব্যারাকপুরের অবিনাশ রায়ের মেয়ে নিশার সাথে একটা রিলেশনশিপ গড়ে ওঠে আমার বৌদি সংযুক্তার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরীর অনেক আগে থেকেই। আসলে আমার দাদা বৌদির বাবার অর্থ ও অগাধ সম্পত্তির লোভে বৌদিকে কলেজে পড়ার সময় চাতুরী করে ভালোবাসার ছলে ওকে বিয়ে করে।আর দাদা বৌদির প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ার পর থেকেই আমার দাদাসহ বাবা-মার মনোভাব বৌদির উপর আরও বিরূপ হতে শুরু করে।আমার বিয়ের সময় আমার মা বৌদি বিয়ে হয়ে আসার পর ওর যে সকল গহনা বৌদির কাছ থেকে নিয়ে নিজের কাছে যত্নসহকারে রেখে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে নিজের কাছে রেখে দেয় এবং আমার আর সম্প্রীতির বিয়ের সময় সে গহনা মা'র কাছে আমার বিয়ে উপলক্ষ্যে পড়তে চাইলে আমার মা বৌদিকে অকথ্য কথা বলেন একঘর আত্মীয় স্বজনদের সামনে।আর দেখুন স্যার ভগবানের কি লীলা--ঠিক ঐ সময় আমার বিবাহিত দিদি মিতা বৌদির বাপের বাড়ির থেকে বৌদিকে দেওয়া বৌদির ঠাকুমার সাতনরির পৈত্রিক সীতাহার পরে আমার মায়ের ঘরে প্রবেশ করে।তা দেখে বৌদির মাথা রাগে,ক্ষোভ জ্বলে উঠলে--বৌদি এই জঘন্য ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করে।আর আমার মা ও দিদির সাথে অশান্তি হয় ওর-- আমার বৌদি সংযুক্তার।"
       অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্র সংযুক্তার বাবা দিবাকর সেন,সংযুক্তার ছোটদা রথীন সেন ও সংযুক্তার দেওয়র মনীষ দে আবারও জিজ্ঞেস করেন "আপনারা কি লোকল থানায় কোন অভিযোগ দায়ের করেছেন?কোন সাক্ষ্য প্রমাণ আপনাদের কাছে আছে কি সংযুক্তার এই অপমৃত্যুটা যে আত্মহত্যা নয়,এটা যে একটা ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত হত্যাকান্ড তার প্রমাণ?" 
দিবাকরবাবুরা এবার অশোকনগরের লোকাল থানার F.I.R এর একটা কপি ও মনীষের ফোনে ওর বন্ধুদের দেওয়া স্থানীয় উৎসাহী,কৌতুহলী অধিবাসীদের ফোনে তোলা সংযুক্তার মৃতদেহের কিছু ছবি অতীন মৈত্রের ফোনে পাঠিয়ে দেয় মনীষ। সেদিনের মত এই পর্যন্ত কথাবার্তার পর মনীষেরা অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্রের হাতে সংযুক্তার কেসের দায়িত্ব দিয়ে আপাতত বিদায় নেয়।একসপ্তাহ পরে অতীন মৈত্রের সাথে পুনরায় সাক্ষ্যাতের অ্যপয়েটমেন্টর সময় নিয়ে।
       আজ অতীন মৈত্র কোর্টের থেকে সন্ধ্যা সাতটার সময় চেম্বারে যখন প্রবেশ করলেন তখন বাইরের করিডোরে দুচারজন মক্কেলে তার সাথে দেখা করার জন্য অলরেডি এসে হাজির। অতীনবাবু ওর জুনিয়র মৈনাকে ডেকে appointment এর ডাইরিটা দেখতে বলেন---আজ কার কার নাম আছে সে তালিকায় মৈনাক জানায় তার স্যারকে।এবার জয়ীতা,দীপ্ত ও ধীমান মানে অতীনবাবুর আর বাকী তিন জুনিয়র চেম্বারে এসে যায় সময়মত।যথারীতি অতীনবাবু তার সাথে আজ যে যে মক্কেলের appointment ছিলো তাদের সাথে তাদের কেস সংক্রান্ত জরুরী আলাপচারিতা সেরে চেম্বার ফাঁকা হলে ওর বাড়ির সব সময়ের কাজে ছেলে বিল্টুকে তাদের পাঁচজনের জন্য একটু গরম গরম চা ও বিস্কুট আনতে বলে একটা সিগারেট ধরিয়ে চেম্বারের লাগোয়া ছোট্ট ব্যলকণিতে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিতে দিতে রাতের আঁধারে শহরের বুকে নিয়ন আলোর মোহমায়ায় কি যেনো একমনে ভেবে চলেছেন।
      কাজের লোক বিল্টু চেম্বারে চা দিয়ে চলে গেলে---তার স্যার অতীনবাবুকে চা-বিস্কুট দিতে গেলে--তার ডাকে অতীনবাবুর ঘোরকাটে।তিনি তার হাতের সিগারেটের শেষটান দিয়ে জয়ীতার হাত থেকে চা-বিস্কুট নিয়ে চেম্বারে এসে তার চেয়ারে বসেন।এবার
জয়ীতা বাকী সকলের হাতে চা আর বিস্কুট তুলে দেয়।
       চা পর্ব শেষ হলে---অতীনবাবু মৈনাক,জয়ীতা,দীপ্ত ও ধীমানের সাথে সংযুক্তার কেসটাকর বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসেন সংযুক্তার বাড়ির লোকের কাছ থেকে পাওয়া পুলিশের কাছে করা F.I.R রিপোর্ট ও সংযুক্তার দেওয়র মনীষের ফোন থেকে অতীনবাবুকে পাঠানো সংযুক্তার মৃতদেহের কিছু ছবি যা অতীনবাবু প্রিন্ট আউট করে আনিয়েছেন ফটোল্যাব থেকে। অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্র এবার একে একে তার জুনিয়রদের বলতে থাকেন "তোমরা ভালো করে সংযুক্তার মৃতদেহের ছবিগুলো দেখো,খুব ভালো করে ছবিগুলি দেখলে তোমরা নিজেরাই বুঝতে পারবে যে সংযুক্তার মৃত্যু আত্মহত্যা নয় বা সে অসুস্থতার জন্য এইভাবে মারা গেছে।তাকে খুব ঠান্ডামাথায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং খুনি খুব চালাক ও বিত্তবান,সে নিজেকে আড়াল করার জন্য পুলিশকে টাকা দিয়ে সংযুক্তার পোস্টমটেম রিপোর্টের অদলবদল ঘটিয়েছে বললেই আমার অনুমান।"
      অতীন মৈত্র তার জুনিয়রদের সাথে এই সকল কথাবার্তা বলার সময় হঠাৎই অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্রের মোবাইল ফোন বেজে ওঠে।তার ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটি অননোন নম্বর। একটা ইমপটেন্ট রহস্যময় কেস নিয়ে জুনিয়রদের সাথে জরুরি আলোচনার মূহুর্তে এই রকম হঠাৎই একটা অননোন নম্বর থেকে ফোন আসায় অতীনবাবু একটু যেনো বিরক্ত হলেন---তবুও স্বাভাবিক কন্ঠে হ্যালো বললেন। ফোনের ওপারের ব্যক্তি অত্যন্ত ভীত ও উত্তেজিত হয়ে অতীনবাবুকে জানালেন আজ কিছুক্ষণ আগে অশোকনগরের পুলিশ ও বারাসত থানার পুলিশ অফিসাররা এসে বারাসতে মনীষের শ্বশুর বাড়ির থেকে মনীষকে ওর বড়বৌদি সংযুক্তার মৃত্যুর জন্য প্রকৃত অপরাধী এই অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে।উত্তেজিত ফোনের ওপারের ব্যক্তি আর কেউ নন মনীষের স্ত্রী সম্প্রীতি,তিনি মনীষের ফোনের কল লিস্ট থেকে অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্রের ফোন নম্বরটি নিয়ে অতীনবাবুকে ফোন করেছেন তার নিরাপরাধ স্বামীর পুলিশের হাত থেকে মুক্তির জন্য। 

         সম্প্রীতির ফোনের কথা শুনে---ফোনটা রাখার পর অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্রেকে বেশ চিন্তিত ও উত্তেজিত মনে হল জয়ীতা,দীপ্ত, মৈনাক ও ধীমানকে।মৈনাক জিজ্ঞেস করল--"স্যার কোনো সমস্যা হয়েছে কি? আপনাকে তো বেশ চিন্তিত লাগছে স্যার!"
অতীনবাবু মুখ থেকে একটা সিট শব্দ বার হল--তিনি সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন--" আমার ধারনাই ঠিক,আসল অপরাধী ভীষণ চালাক,বুদ্ধিমান ও ধূর্ত।সে নিজেকে ও তার সহযোগী অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য নিরাপদ মনীষ দে, মানে মৃত সংযুক্তার একমাত্র দেওয়কে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করিয়েছে।"মৈনাকরা একযোগে বলে উঠল কি বলছেন স্যার!হুম--"এইমাত্র যিনি ফোন করেছিলেন তিনি হলেন সংযুক্তার ছোট জা মানে মনীষের স্ত্রী।সেই জানালো যে তার স্বামী মনীষকে ওর বারাসতের শ্বশুর বাড়ী থেকে অশোকনগরের লোকাল থানার পুলিশ ও বারাসত থানার পুলিশ অফিসাররা এসে একযোগে সংযুক্তার খুনের অপরাধে অভিযুক্ত বলে গ্রেফতার করে নিয়েগেছে।আর অভিযোগকারী ব্যক্তির নাম শুনলে তোমাদের সকলে বিস্মিত হয়ে যাবে---অভিযোগকারী আর কেউ নয়--সে সংযুক্তার গুণোধর স্বামী,মনীষের দাদা শিবেন দে।
তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে শিবেন নিজেকে ও তার পরিবারের অন্যান্য অপরাধীদের আড়াল করার জন্য এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করে চলেছে।"
জয়ীতা বলে "স্যার,আপনি কি করে এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন যে শিবেন তার স্ত্রীকে খুন করেছে,আর তার দায় ওর ভাই মনীষের উপর চাপাতে চাইছে?"
অতীনবাবু একটু মুচকি হাসলেন।তিনি একটি সিগারেট ধরিয়ে বলতে শুরু করলেন--"সংযুক্তার মৃত্যুর সময় সংযুক্তার দেওয়র মনীষ, জা সম্প্রীতি ও ওদের মেয়ে দিয়া গিয়েছিল দিল্লী বেড়াতে এবং মনীষের কাছে সংযুক্তার মৃত্যুর খবর মনীষের পাড়ার কিছু সহৃদব্যক্তি ও ওর বন্ধুরা ফোন করে জানায় এবং পুলিশি ঝামেলা না মেটা পর্যন্ত তারাই মনীষেকে বলে দিল্লী থেকে ফিরে ওরা যেনো অশোকনগরের দেবীগড়ে মনীষদের বাড়ি না এসে কিছুদিনের জন্য সম্প্রীতির বাপের বাড়ি মানে বারাসতে মনীষের শ্বশুর বাড়িতে চলে যায়।একথা মনীষ ও সংযুক্তার বাপের বাড়ির মানে সংযুক্তার বাবা দিবাকর সেন ও সংযুক্তার ছোটদা রথীন সেনও যেদিন আমার চেম্বারে কথা বলতে এসেছিলেন সংযুক্তার কেসের ব্যাপারে আমাকে জানিয়ে ছিলেন। আর আমি গোপন সূত্র মার্ফত খোঁজ করে জানতে পেরেছি মনীষ ও তার স্ত্রী সম্প্রীতি অশোকনগরের দেবীগড়ের ঐ দে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে সম্পূর্ণ অন্য ধাতের মানুষ। ওরা সংযুক্তার উপর হওয়া সকল অত্যাচারের সব সময় প্রতিবাদ করত।অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্র হেসে বললেন--ঐ ভক্তকুলের প্রহ্লাদ,আর কি!"

    অতীনবাবু তার জুনিয়রদের এবার সংযুক্তার মৃতদেহের ছবিগুলো আর পুলিশের লেখা F.I.R উপর concentrate করতে বললেন।
     
       সংযুক্তার F.I.R এ পুলিশ লিখছে----" সংযুক্তা আত্মহত্যা করেছে।তাকে ঘরে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে তার স্বামী শিবেন বাড়ির সকলকে চিৎকার করে ডাকলে শিবেনের বাবা-মা ছুটে আসেন পাশের ঘর থেকে এবং শিবেন সংযুক্তাকে ওই অবস্থা থেকে উদ্ধার করে একটি ভ্যান ডেকে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়----"
তোমাদের কি মনে হয় "শিবেন এইভাবে তার স্ত্রীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে একজন ডাক্তার সেই অসুস্থ ব্যক্তিকে কোন পরীক্ষানিরীক্ষা না করেই মৃত বলে দেবেন??আর এখানে যখন গলায় দাড়ি দিয়ে আত্মহত্যার বিষয় তখন তো স্বাভাবিক কিছু ব্যাপার মৃতদেহের মধ্যে লক্ষ্য হবেই। তা কি করে একজন ডাক্তারের চোখ এড়িয়ে যায়???আরও অন্যান্য কিছু বিষয় যেমন সংযুক্তার বাপের বাড়ির লোকজন ও সংযুক্তার দেওয়র মনীষের বয়ান অনুযায়ী এই কথা বলা হয়েছে যে---সংযুক্তাকে যখন ভ্যানে করে শিবেন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল তার বেশকিছুক্ষণ আগে থেকেই ওর পাড়া প্রতিবেশীরা দে বাড়ির থেকে উচ্চ স্বরে মিউজিক সিস্টেম চলার আওয়াজ পাচ্ছিল যা না কি প্রায়ই সংযুক্তার উপর যখন ওর শ্বশুর বাড়ীর লোকজন শারিরীক অত্যাচার করত--বা ঐ বাড়িতে সংযুক্তাকে নিয়ে কোন অশান্তির সূত্রপাত ঘটাতো তখনই চালানো হতো উচ্চস্বরে--সংযুক্তার দেওয়র মনীষের ও তার স্ত্রী সম্প্রীতির অনুপস্থিতিতে।এই কথা জানার পর মনীষ,সম্প্রীতি প্রতিবাদ করে বারংবার, কিন্তু আশানুরূপ ফল কখনোই হত না।কিছুদিন পর পর একই ঘটনা ঘটতো। পরে তারা ও পাড়ার লোকজন সংযুক্তার বাপের বাড়িতে এই বিষয়গুলি জানালে প্রাথমিক একটা মীমাংসার পর সবকিছুই কিছুদিন ঠিক থাকার পর আবার মনীষ ও সম্প্রীতির অনুপস্থিতিতে ঠিক সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো দে বাড়ির অনন্য সদস্যরা সংযুক্তার প্রতি???আর সংযুক্তার হলো রহস্যজনক মৃত্যু!!!!!
         অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্রের জুনিয়রা সংযুক্তার মৃতদেহের ছবিগুলো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।মৈনাক বলে ওঠে "স্যার এই ছবিটা একটু দেখুন---"এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সংযুক্তার গলায় দড়ির ফাঁসের ছাপ আর এই একটা অস্পষ্ট ছাপ এবং সংযুক্তার মুখের অভিব্যক্তি--যা দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না যে সে নিজে গলায় দিয়ে আত্মহত্যা করেছে!!!" মৈনাকের এই কথাগুলো শুনে দীপ্ত,জয়ীতা,ধীমান সকলে বলে উঠল "কি বলছো মৈনাক দা"!!!আসলে মৈনাক অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্রের জুনিয়র হিসাবে প্রায় দশ বছর প্র্যাকটিস করছে আর জয়ীতা ধীমান ও দীপ্ত কেউ পাঁচ কি ছয় বছর হবে জুনিয়র হিসাবে কাজ করছে অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্রের সাথে। 
      সে যাই হোক, মৈনাকের কথায় অতীনবাবু একটু মুচকি হেসে বললেন--"না!দেখছি আমার শিক্ষা আর আমার ছাত্রের অধ্যাবসায় বেশ কিছুটা সফল হয়েছে আজ--এই বলে তিনি মৈনাকের দিকে তাকালেন গর্বের সাথে।অতীনবাবু বললেন--"তুই ঠিকই ধরেছিস মৈনাক। সংযুক্তার মৃত্যু শুধুমাত্র সাধারণ আত্মহত্যা নয়।এটা ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত একটি রহস্যজনক জটিল মনস্তত্বের হত্যাকান্ড।যা একজন Psycological disorder person ই ঘটাতে পারে তার চরম স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য।"
      এরপর অতীন মৈত্র তার জুনিয়রদের আরও বলেন--"সংযুক্তার ছবিগুলো দেখে এবং আমার দীর্ঘ ত্রিরিশ বছরের criminal legal practice জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমার মন বলছে সংযুক্তাকে প্রথমে শ্বাসরোধ করে বা হাই ডোজের কোনো ঘুমের ওষুধ কিছুর সাথে খায়িয়ে হত্যা করা হয় এবং তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য সংযুক্তাকে হত্যাকারী গলায় দড়ি দিয়ে তার বেডরুমের সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলিয়ে দেয়।কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন হয় তো সবার মনে আসতেই পারে যে তাহলে 'দে' বাড়িতে কেনো সংযুক্তার মৃত্যুর দিন ঐভাবে মিউজিক সিস্টেম বাজানো হলো?"
    এবার অতীন মৈত্রের জুনিয়রা সকলে একযোগে প্রশ্ন করে ওঠে--"কেনো স্যার? আপনার কি কিছু সন্দেহ হচ্ছে এ বিষয়ে?"
অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্র শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে বলেন "এ মৃত্যুর রহস্য ভেদ করতে আমাকে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তৃপক্ষের সাহায্য অতি প্রয়োজন,তাই আমি লালবাজারে (আমার এক পরিচিত মানে সে আমার ছেলেবেলার বন্ধু)পুলিশ কর্তা নিলয় শর্মাকে ফোনে যোগাযোগ করি এবং ওর কাছে সংযুক্তার মৃতদেহের ছবি ও F.I.R রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়ে ওকে বলি পুঃরায় সংযুক্তার পোস্টমটেম আসল রিপোর্ট যাতে আমার হাতে আসে সে বন্দোবস্ত করে দিতে।"
জয়ীতা অতীনবাবুকে জিজ্ঞেস করে--"স্যার উনি কি বললেন আপনাকে?" অতীনবাবু বললেন আমি বুঝতে পারছি তোদের এই কেসটা নিয়ে বেশ উৎসাহ তৈরী হয়েছে রহস্যভেদ করার। যদিও আমরা ডিটেকটিভ নই? তবুও তো আসল অপরাধীকে আইনের সাহায্যে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে নিরাপরাধীকে মুক্ত করাই আমাদের কাজ।হ্যাঁ,যেটা বলছিলাম-- আমার সব কথা শুনে ও ছবি এবং রিপোর্ট দেখে নিলয় আমায় বলে যদিও আসল ফরেন্সিক রিপোর্ট বা পোস্টমটেম রিপোর্ট বার করার কাজটা একটু শক্ত তবুও সে আমার জন্য সেই ঝুকিটা নেবে,পুলিশ অফিসারা ইচ্ছে করলে ভালো কাজ হামেশায় করতে পারে।নিলয় দু'চার দিনের মধ্যে সংযুক্তার পোস্টমটেমের রিপোর্ট আমাকে পাঠিয়ে দেবে বলেছে।সংযুক্তার পোস্টমটেম রিপোর্ট হাতে পেলে অপরাধীর নাগল আমাদের পেতে তেমন কোন অসুবিধা হবে বলে আমার মনে হয়!!"
        অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্র আর বেশি দিন সময় নষ্ট করতে চাইছেন একদম।সংযুক্তার বাবা দিবাকর সেন ও সংযুক্তার দেওয়র মনীষের স্ত্রী তাকে ফোন করে সংযুক্তার মৃত্যুর জন্য দায়ী আসল অপরাধী ও তার মৃত্যুর রহস্য সহ নির্দোষ মনীষের মুক্তির জন্য বারবার অনুরোধ করছে।ঠিক এই রকম এক অবস্থায় অতীনবাবুর হাতে লালবাজের থেকে অতীনবাবুর পুলিশ বন্ধু নিলয় শর্মার কাছ থেকে এসে পৌঁছায় বহু প্রতিক্ষিত সংযুক্তার মৃত্যুর আসল পোস্টমটেম রিপোর্টের কপি।যা লোকাল থানার ওসিকে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে খুনী সংযুক্তার মৃত্যুকে প্রথমে আত্মহত্যা বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে।
       কি আছে সেই পোস্টমটেম রিপোর্টে??কে বা কারা সেই অপরাধী--যাদের জন্য অকালে দুটি বাচ্চাকে অসহায় অবস্থায় রেখে সংযুক্তাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হলো???কি ছিলো সেই নিরাপরাধ,সদ্য হাস্য,শিক্ষিত ঘরোয়া,উদার মনের মেয়েটির??যে একদিন তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে সুখের সংসার করতে এসেছিলো "দে" বাড়িতে।
      অতীন মৈত্র তার জুনিয়রদের কোর্টের কাজ শেষে একটু তাড়াতাড়ি আজ তার চেম্বারে আসতে বলেন।সকলে ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে অতীনবাবুর চেম্বারে হাজির।জয়ীতা মৈনাকে জিজ্ঞেস করে--"কি ব্যাপার বলো তো মৈনাক দা,স্যার আজ আমাদের সকলকে চেম্বারে আসার জন্য এত জরুরী তলব করলো কেনো?তুমি কি কিছু জানো মৈনাক দা?" মৈনাক জয়ীতাকে বলে সে তেমন কিছু জানে না?
      ঘড়িতে ঠিক আটটা বাজতেই অতীনবাবু তার চেম্বারে প্রবেশ করলেন। তার জুনিয়রা সকলে এ ওর মুখের দিকে চোখ চাওয়া চায়ি করছে কারন তারও আজ তাদের স্যারের এই জরুরী তলবের আসল কারণ জানার জন্য অধীর আগ্রহে উত্তেজনার সাথে অপেক্ষা করছে।
     অতীন মৈত্র মৈনাককে কাছে ডেকে তার সেকেটারিয়েট টেবিলে রাখা বিফকেসটা খুলে একটা সাদা খাম বার করতে বললেন।মৈনাক তার স্যারের কথা মত সেই সাদা খাম বিফকেস থেকে বার করার পর অতীনবাবু তাকে খামের ভিতর রাখা কাগজগুলোর কপির পাঁচ-ছটি জেরক্স করে সকলের হাতে দিতে বলেন পড়ার জন্য। মৈনাক তার কথা আনুসারে চেম্বারে রাখা প্রিন্টার থেকে তাদের সকলের জন্য এক কপি করে সেই কাগজগুলোর জেরক্স করে এবং জেরক্স এর সময় তার চোখে পড়ে এ যে সংযুক্তার পোস্টমটেম রিপোর্ট। তাহলে কি রহস্যের সমাধান এর দোড়গোড়ায় আমরা উপনীত হয়েছি?স্যার কি তার আইনী কথার মারপ্যাঁচে অপধীর দাবা খেলার চালের উপযুক্ত চাল দিয়ে কিস্তিমাত করবেন ?"----------------
          অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্রের জুনিয়র---মৈনাকের সংযুক্তার পোস্টমটেম রিপোর্ট দেখে মনে হতে থাকে মানুষ সত্যিই কি এত বিকৃত মানসিকতার হতে পারে???সে এতটাই exsited যে মৈনাক তার স্যার অতীনবাবুকে প্রশ্ন করেই ফেলে " স্যার--মানুষ অর্থ, সম্পদ আর পরোক্রিয়ার জন্য এত জঘন্য অপরাধ করতে পারে???আর এই রকম একজন অপরাধীকে এই জঘন্য অপরাধ ঘটনার জন্য যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সাহায্য করছে তারও তো সমান অপরাধী,,তাই নয় কি স্যার?" এবার জয়ীতা,দীপ্ত, ধীমানের দিকে তাকিয়ে অতীনবাবু দেখেন তাদের চোখে মুখে মৈনাকের করা প্রশ্নগুলোর ছাপ যেনো প্রকট হয়ে উঠেছে।তিনি তাদের সকলকে শান্ত হয়ে যে যার চেয়ারে বসতে বলে,নিজের চেয়ারে বসে সবিস্তারে সংযুক্তার পোস্টমটেম রিপোর্টের বিশ্লেষণ করেন তার জুনিয়রদের কাছে এবং আগামী যেদিন সংযুক্তার কেসের হেয়ারিং এর ডেট পড়েছে সেদিন কি ভাবে আসল অপরাধীকে জর্জ সাহেবের সামনে হাজির করে প্রশ্নবাণে নাস্তানাবুদ করে অপরাধীর শতরঞ্জ খেলার শেষ দান দিয়ে কিস্তিমাত করবেন তার ছক গভীরভাবে আলোচনা করে সেরে ফেললেন। 
          
          আজ সংযুক্তার মৃত্যুর আসল কারণ জলের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে সকলের সামনে।ধরা পড়তে চলেছে আসল অপরাধী।ঘড়িতে সকাল ১১টা বেজে ৫ মিনিট হয়েছে।শুরু হলো কোর্ট,,,,জর্জ সাহেবের সামনে বাদী বিবাদী উভয় পক্ষের উকিল বাবুরা সওয়াল জবাব শুরু করলেন। অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্র একে একে সংযুক্তার বাবা,ভাই, দেওয়র মনীষ, মনীষের স্ত্রী
সম্প্রীতি,শ্বশুর ,শ্বাশুড়ি ও ননদ সকলকে কাঠগোড়ায় ডেকে যা যা প্রশ্ন করার করলেন। এবার ডাকলেন সংযুক্তার স্বামী শিবেনকে।শিবেন তো অতীনবাবুর প্রশ্নের উত্তরগুলি বেশ ভালো করেই জবাব দিচ্ছিল এতক্ষণ। এবার অতীনবাবু মহামান্য বিচারকের সামনে পেশ করলেন সংযুক্তার সেই পোস্টমটেম রিপোর্ট যেটি তার গুণোধর স্বামী ও তার গার্লফ্রেন্ড নিশা বেশ বুদ্ধি করে মোটা টাকার ঘুষ পুলিশকে দিয়ে সম্পূর্ণ বদল করে দেয়।আসলে শিবেনের সাথে সংযুক্তার বিয়ে ও ভালোবাসার সম্পর্ক হওয়ার অনেক আগে থেকে ভালোবাসার সম্পর্ক শুধু নয় শারীরিক সম্পর্কেও নিশা আর শিবেন একে অপরের সাথে জড়িয়ে ছিলো।যা সংযুক্তার সাথে বিয়ের পরও শিবেন ও নিশা চালিয়ে যাচ্ছিল।নিশার মন পেতে--নিজের ও সংযুক্তার পরিবারের অর্থ, সম্পদের লোভে নিশা ও শিবেন পরামর্শ করে সংযুক্তাকে পৈশাচিক ভাবে হত্যা করে। যে কাজে প্রচ্ছন্নভাবে শিবেনকে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সাহায্য করে কেবলমাত্র শিবেনের ছোটভাই মনীষ ও তার স্ত্রী সম্প্রীতি ছাড়া। কারন তারা শিবেন ও তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের অনৈতিক কাজকর্ম মোটেও কোনোদিনই সমর্থন করত না।
    সংযুক্তাকে হত্যা করার সময়---সংযুক্তার সাথে যে ঘটনা ঘটানো হয় তার প্রতিচ্ছবি অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্র জর্জ সাহেব সহ কোর্টে উপস্থিত সকলের সামনে তার কথার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন। ঘটনাটি ঠিক এই রকম ছিল---
"শিবেন প্রথমে সংযুক্তার হাত দুটি পিছনে ঘুরিয়ে ধরে ওর বাঁহাতের আঙুলগুলি মট মট করে জোরে চেপে ভেঙে দেয়।সংযুক্তার সেই পরিত্রাহি চিৎকার যাতে প্রতিবেশীদের কানে না পৌঁছোয় তার জন্য ঐ দিনও বোধ হয় শিবেন তার বেডরুমের মিউজিক সিস্টেম উচ্চস্বরে চালিয়ে দিয়েছিল। শিবেনের মা সেই মূহুর্তে সংযুক্তার মুখ চেপে ধরে,তারপর শিবেনের বাবা ও বোন সংযুক্তার হাত পা চেপে ধরে থাকে এবং শিবেন সংযুক্তার কলারবোনে মোটা খালি ইঞ্জেকশনের সিঞ্জ দিয়ে ক্রমাগত হাওয়া পুশ করতে থাকে ফোনে নিশার করা ম্যাসেজ অনুযায়ী।এরপর সংযুক্তা মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়ে। ওর মৃত্যু সুনিশ্চিত করতে শিবেন সংযুক্তার মুখে শেষ পর্যন্ত বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে যার ছাপ সংযুক্তার মৃতদেহের ছবিগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে এবং সব শেষে সংযুক্তার মৃত্যুকে আত্মহত্যার রূপ দিতে ওরা সকলে মিলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সংযুক্তার নিথর দেহ সিলিং ফ্যান থেকে সংযুক্তার শাড়ি দিয় ওর গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলিয়ে দেয়।
             ভরা এজলাসে বিচারকের সামনে অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্র কাঠগোড়ায় দাঁড়ানো সংযুক্তার স্বামী শিবেনকে বলেন--"প্রেমিকা আর বাবা মা,বোনের সাথে বেশ ভালো রকম ফন্দি আটকে আপনি আপনার নিরীহ,নিষ্পাপ স্ত্রীকে সম্পদ,অর্থের লোভে এই ভাবে হত্যা করলেন!!কি নিষ্ঠুর এই সমাজ তাই না বলুন মিস্টার শিবেন বাবু??এত কিছু করেও আপনি ,আপনার বান্ধবী আর আপনার পরিবার ভগবানের শেষ মারের হাত থেকে রক্ষা পেলেন না!"
হুজুর এবার আসি কি ভাবে শিবেন তার স্ত্রীকে এইভাবে খুনের মতলব করেছিল সে বিষয়ে।আমি মহামান্য বিচারক সাহেবের সামনে আগেই বলেছি যে শিবেনকে তার বান্ধবী কাম প্রেমিকা নিশা ফোনে ম্যাসেজ করে পাঠায় কি ভাবে সংযুক্তার কলারবোনে খালি ইঞ্জেকশনের সিঞ্জ দিয়ে ক্রমাগত হাওয়া পুস করে তাকে মৃত্যুর মুখে পতিত করতে হবে।আসলে অনেক তথ্য ও অনুসন্ধানের পর আমি জানতে পারি নিশা একজন ফারমাসিস্ট কর্মী যার ফলস্বরূপ তার এই ইঞ্জেকশনের বিষয় সম্পর্ক যথেষ্ট জ্ঞান আছে এর ফলে সংযুক্তার কি হাল হতে পারে তাও সে জানতো আর সে সব জেনে বুঝেই শিবেনকে ফোনে নির্দেশ দেয় কিভাবে সংযুক্তাকে হত্যা করে তাদের পথ থেকে হঠানো যাবে।আর রইল সংযুক্তার পোস্টমটেম রিপোর্টের অদলবদল। সে তো আপনি ভালো করেই জানেন মহামান্য আদালত আমাদের দেশের পুলিশি ব্যবস্থা।ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না ।সেই রকম ভাবে মোটা টাকার বিনিময়ে পুলিশের হাতে আসা সংযুক্তার পোস্টমটেম রিপোর্ট বদলে যায়।আমি আমার বিশিষ্ট পুলিশ অফিসার বন্ধু নিলয় শর্মার সাহায্য নিয়ে সংযুক্তার পোস্টমটেমকারী ডাক্তার নীরাঞ্জন সেন এর কাছে পৌছিয়ে ওনার সাথে কথা বলে ব্যারাকপুরের মর্গের থেকে আরও এক কপি সংযুক্তার পোস্টমটেমের আসল রিপোর্ট বার করি এবং আমার সকল সন্ধেয়োর অবসান হয় সেই রিপোর্ট দেখে।স্যার আজ এই এজলাসে ডাক্তার নীরাঞ্জন সেন, পুলিশ অফিসার নিলয় শর্মা ও সর্বোপরি এই সংযুক্তা হত্যাকান্ডের নেপথ্যে থাকা মাস্টার মাইন্ড অপর Psyco killer নিশাকেও আমি ব্যারাকপুরের থানার সাহায্য নিয়ে এখানে হাজির করেছি।"
জর্জ সাহেব অতীনবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলেন "উকিলবাবু আপনি একে একে আপনার বাকী সাক্ষী ও অভিযুক্তদের যা যা প্রশ্ন করার আছে করুন।" অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্র জর্জ সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে ডাক্তার নীরাঞ্জন সেনকে কাঠগোড়ায় ডাকলেন এবং জর্জ সাহেবের সামনে সংযুক্তার পোস্টমটেম রিপোর্টের বিশ্লেষণ করতে অনুরোধ করলে ডাক্তার নীরাঞ্জন সেন ভরা এজলাসে জর্জ সাহেবের সামনে যা বলেলেন তা ঠিক এই রকম---ডাক্তার নীরাঞ্জন সেন জানালেন তার দীর্ঘ ত্রিরিশ বছরের ডাক্তারী জীবনে তিনি বহু লাশের পোস্টমটেম করেছেন।কিন্ত এহেন মর্মান্তিক, পৈশাচিক ভাবে একজন মানুষকে যে হত্যা করা যায় তা তিনি যেদিন সংযুক্তার মৃতদেহের পোস্টমটেম করেছিলেন সেদিন দেখে সত্যিই হতবাক হয়ে যান।মানুষ কতটা বিকৃত মানসিকতার না হলে এই রকম একটা পৈশাচিক হত্যাকান্ড ঘটাতে পারে তা নিজে চোখে ডাক্তার নীরাঞ্জন সেন সেদিন যদি সংযুক্তার মৃতদেহ না পোস্টমটেম করতেন তাহলে সে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতেন না।ডাক্তার সেন আরও বলেন সংযুক্তার মৃতদেহে যে হাতের ছাপ গুলো স্পষ্ট হয়ে রয়েছে এবং সংযুক্তার বেডরুমের থেকে যে পায়ের ছাপ গুলো ফরেন্সিক রিপোর্টরা সংগ্রহ করেছেন সেগুলি পরীক্ষা করে এবং অভিযুক্তদের পায়ের ছাপ ও হাতের আঙুলের ছাপের সাথে সেগুলি হুবহু মিলে গেছে।"
ডাক্তার নীরাঞ্জন সেনকে অতীনবাবু বলেন "এবার আপনি আসতে পারেন ডাক্তারবাবু,আপনার কাছ থেকে আমার যা জানার আমার তা জানা হয়েগেছে।"এবার পুলিশ অফিসার নিলয় শর্মা অতীন মৈত্রের প্রশ্নের উত্তরে বলেন লোকল থানার ওসি,কমলেশ ঘোষ শিবেন ও নিশার কাছ থেকে মোটা টাকার ঘুষ নিয়ে সংযুক্তার পোস্টমটেম রিপোর্টের অদলবদল করেছিলো।"সব শেষে অ্যাডভোকেট অতীন মৈত্র শিবেনের প্রেমিকা নিশাকে কাঠগোড়ায় ডাকলে সে কাঠগোড়ায় উঠেই তাকে অতীনবাবু কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই জর্জ সাহেবের সামনে নিজের কৃতকর্মের জন্য কান্নায় ভেঙে পড়ে নিজের ও তার প্রেমিক মানে সংযুক্তার স্বামী শিবেনর সব অপরাধের কথা শিকার করে নেয়।
জর্জ সাহেব বাদী, বিবাদী,সাক্ষী, প্রমাণ সব কিছু দেখে শুনে বুঝে সংযুক্তার হত্যাকান্ডের মূল দুই অভিযুক্ত সংযুক্তার স্বামী শিবেন ও তার প্রেমিকা নিশাকে যাবজ্জীবন স্বশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন।সংযুক্তার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি ও ননদকে পরোক্ষভাবে এই হত্যাকান্ডে সাহায্য করার জন্য সাত বছরের জেল এবং একলক্ষ টাকা করে জরিমানা ও সেই জরিমানার অর্থ অনাদেও হলে আরও দীর্ঘ পাঁচ বছর জন্য স্বশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন। আর অপরদিকে সংযুক্তার দেওয়র মনীষ দে'কে বেকসুর মুক্তির আদেশ দেন।





একটা কালো মেয়ের গল্প
  
উ ত্ত ম  ব নি ক
                                      

লক্ষ্মী মা আমার এবার শেষ বারের মতোন অন্তত একবার বস। আমি কথা দিচ্ছি আর কোনোদিন তোকে আমি আর এইভাবে বসতে বলব না। না, মা" আমার এই সং সাজতে আর ভালো লাগেনা। এই নিয়ে প্রায় পঁচিশবার হলো, একজনও তো আমাকে পছন্দ করেনা। কেনো মা" কি অপরাধ আমার, শুধুমাত্র আমার গায়ের রং কুচকুচে কালো এইজন্য? কেনো মা আমার নাম সাধ করে পূর্ণিমা রাখতে গিয়েছিলে, অমাবস্যা রাখতে পারলে না।
তুমি কি জানো মা" আমার গায়ের এই রং আমার হৃদয়কে কতবার ক্ষত বিক্ষত করেছে? আমার মনেহয় এই রং আমার শুধু গায়ে নয়, আমার রক্তের সাথে মিশে গিয়েছে।
তুমি কি জানো মা" আমি জন্মেছি একবার কিন্তু আগে চব্বিশবার আমার আত্মার মৃত্যু হয়েছে আর এবার নিয়ে হয়তো পঁচিশবার হবে। কেনো মা" সমাজের এত বৈষম্য? মানুষ কি চিরকাল রঙের দলদাস?
বসন্তের রং লাল, শরতের রং নীল সাদা, শুধু আষাঢ়ের রং কালো তবে সে কালো আতঙ্কের। কোথাও কি কখনো দেখেছ যে কেউ কারো মঙ্গলার্থে কালোর পূজা করে? অথচ সবাই বলে কালোই নাকি জগতের আলো। ভুল বলে মা ভুল বলে। অথচ দেখো রামধনুতে সব রঙের অস্তিত্ব থাকলেও কালোর অস্তিত্ব মেলেনা। মানে দুনিয়ার কোনো ভালো কিছুতেই কালোর অস্তিত্ব মেলেনা।
মা "আজ আমি বড় অসহায়, আজ আমি রিক্ত, আমি নিঃস্ব, আমি আজ সর্বহারা। এই বলে পূর্ণিমা আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলোনা। হু হু করে উঠলো বুকের ভেতরটা, হাউ হাউ করে কেঁদে ভাসালো মায়ের আঁচল।   এবারেও প্রত্যাখ্যান পাত্রপক্ষ দ্বারা.......

কুড়ি বছর পর...
ম্যাডাম আজ আমাদের" পূর্ণিমা" ম্যাটরিমনির পঁচিশ হাজারতম বিয়ে সম্পূর্ণ হলো, অভিনন্দন ম্যাডাম। আপনার অদম্য ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম আর অকৃত্রিম ভালোবাসায় "পূর্ণিমা ম্যাটরিমনি" আজ দেশের এক নম্বর সাইট। এই বলে ম্যানেজার আকাশবাবু পূর্ণিমা দেবীকে অভ্যর্থনা জানালেন।
ধন্যবাদ আকাশ, আসলে এই কৃতিত্ব আমার একার শুধু নয়। এটা একটা পরিবার তাই এই কৃতিত্বের স্বীকৃতির অংশীদার সবাই, মানে তুমি আমি এবং আমাদের পরিবারের সেই প্রায় দুশোজন সমাজ অবহেলিত হয়ে পড়া নিষ্পাপ মেয়েগুলো।
আকাশ, তোমাকে আজ একটা কথা বলি শোনো - এতদিন আমি ভুল ভাবতাম যে এই পৃথিবীতে কালোর কোনো মর্যাদা নেই, সবাই শুধু আলোর পূজারী। আসলে কি জানো আলোর কি মূল্য যদি অন্ধকার না থাকে, অমাবস্যার কি মূল্য যদি পূর্ণিমা না থাকে, চামড়া যতোই সাদা হোক চোখ যদি কালো না থাকে।
তাই বলছি জীবনে কখনো হতাশ হবেনা, জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলতে হবে। সমাজ যা ইচ্ছা তাই বলুক, তুমি যদি দৃঢ় সংকল্পযুক্ত একজন মানুষ হও এবং নিজের লক্ষে অবিচল থাকো তবে ভগবানেরও সাধ্যি নেই তোমাকে দমাবার।
আমাদের আরো অনেক পথ চলতে হবে, এখানে থামলে চলবে না। আমরা যে প্রতিজ্ঞাবধ্য হয়েছি সমাজকে কালো রং মুক্ত করার।
আকাশের আনা ফুলেরমালাটি পূর্ণিমা তার মায়ের ছবিতে পড়িয়ে বলল - মা " তোমার দেওয়া আমার পূর্ণিমা নামটি আজ বুঝি সার্থক হয়েছে মা। আমি পূর্ণিমা হয়েই বাকি জীবনটা কাটাতে চাই, অমাবস্যা হয়ে নয়। আকাশের ওই তারা হয়ে তুমি আমার জীবনের চলার পথে জ্বল জ্বল কোরো মা" ।





নিখোঁজ ডায়েরি

কা বে রী  রা য়  চৌ ধু রী

আদিবাসী পরিবারে বাবা কাঠুরে মা শুকনো ডালপালা সংগ্রহ করে জ্বালানি হিসেবে মাথায় করে বাড়িতে বয়ে আনে রান্নার সংস্হান করে। চারটি সন্তান, অভাব অনটনে মজবুরি পরিবার। বড় মেয়েটি ডাগর ডোগর হওয়ার পর পঞ্চায়েত প্রধানের নজর কাড়ে, মেহুলকে কাজ দেওয়ার নাম করে বাবাকে প্রস্তাব দেয়। দরিদ্র বাবার সরল মনে কাদা নেই বিশ্বাস করে বসে। পর্যটকদের জন্য আদিবাসী ঝুমুর নাচ শেখানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন, তিনবেলা খাওয়া ও কিছু মাসোহারা।
বাবা মা মেয়েকে খোঁজ খবর রাখে নিয়মিত, এভাবে কিছুদিন চলার পর একদিন হঠাৎ পঞ্চায়েত মশাই জানায় তোমার মেয়ে কোন এক ভিনদেশী পর্যটকের সঙ্গে পালিয়ে গেছে, তখন থেকেই বাপমায়ের মনে সন্দেহের বীজ বপন। এরা থানায় গিয়ে এফ. আই. আর করে নিখোঁজ ডায়েরি তালিকায় নাম নথিভুক্ত করে। দরিদ্র মানুষ কষ্টের টাকায় ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ার হয়। রোজ দারগাবাবুর কাছে এসে করুণ আবেদন আমার মেয়েকে কি পেয়েছেন? দারগাবাবু - একই কথা তোর রোজ ঘ্যানঘ্যান পেলে তো তুই জানতেই পারবি। এদিকে মেয়েটিকে মুম্বাই এ একটি অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। দৈনিক খাবার দিতে আসে এক বৃদ্ধা মহিলা, মেহুল তাকে মাতাজী করে সম্বোধন করে ডাকে, ওর চোখের জলের বন্যায় হৃদয় গলিত হয়। স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, উনি জানে এই বিনয়ী মেয়েটির জন্য ভয়ংকর পরিণতি অপেক্ষা করছে, মায়া জাগে, নারীমন মাতৃ হৃদয়ে মাতাজী ডাকটি নাড়া দেয়। ভগবান রূপী হয়ে এই মহিলা মেহুলকে রেসকিউ হওয়ার নম্বর যোগার করে একটি মোবাইল সংগ্রহ করে ওকে ফোন করতে বলেন। সেইমত মেহুল যোগাযোগ করে নিজের বৃত্তান্ত জানায়। 
তিন দিনের মাথায় কলকাতা থেকে এক টিম এসে ওকে রক্ষা করে পুরুলিয়া নিয়ে এসে বাবা মায়ের সাথে দেখা করে এবং থানার দারগাবাবু সমেত পঞ্চায়েত প্রধানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শাসকের কাছে নালিশ জানানোর পাশাপাশি বিচার বিভাগে তদন্তে ওদের জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। 
ঐ মহিলা এক মহান ব্যক্তিত্ব, অভাবের তাড়নায় কুকর্মের পরিবেশে থেকেও নীরবে মহৎ কাজে আত্ম নিয়োজিত প্রাণ।গোপন সূত্রে ওনার রেসকিউ সেন্টারের সঙ্গে যোগসূত্র এবং নিখোঁজ মেয়েদের জীবন ফিরিয়ে দেওয়ায় ব্রতী। 
রেসকিউ সেন্টার থেকে ওকে স্কুল ড্রেস সেলাই এর সংস্থায় চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। সাইকেল চালিয়ে দৈনিক সকালে কাজে যায় এবং বিকেলে ঘরে ফিরে বাবা মা এবং ভাইবোনদের লেখাপড়া ও সংসারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে উন্নতির পথে নির্ভরতা হয়ে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে আনে।।





ফুলের বনে

অ শো ক  কু মা র  মো হা ন্ত

নিস্তব্ধ দুপুর গড়িয়ে পড়ে সূর্যটা যখন নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে গলে পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়ে  তখন কত কথাই না মনে পড়ে দামিনীর। 

সেই কোন ছোটবেলায় হলদিবাড়িতে বেড়ে ওঠা। বাবার সাথে কত জায়গা ঘোরা, হেমকুমারি, বড় হলদিবাড়ি, মধ্য হুদুমডাঙ্গা, আরো কত জায়গা , সঙ্গিনীদের সাথে মজা করা , কলেজ ,বিশ্ববিদ্যালয়ের কত স্মৃতি যেন মনের দুয়ারে হানা দিয়ে ডানা মেলে উড়ে যায়
এখন সেই সব জায়গার কত পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নতুন বাড়ীঘর হয়েছে। ঝাঁ চকচকে শপিং মল, যত্রতত্র গড়ে উঠেছে মাল্টিপ্লেক্স, বিগ বাজার,  মেখলিগঞ্জ-হলদিবাড়ির মধ্যে সংযোগকারী জয়ী সেতু। পশ্চিম বঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘতম সেতু। এ নাকি প্রায় চার কিমি লম্বা। ফরাক্কার চেয়ে বেশী দীর্ঘ। ভাবতে গেলে কেমন যেন নষ্টালজিয়ায় ঘিরে ধরে। শিহরণ জাগে। 

কোন এক পথিক যেন অজানা পথের অলিগলি পেরিয়ে এগিয়ে চলে পথের টানে ভবিষ্যতের হাত ধরে। তেমনি ভাবনার রশি বেয়ে তরতর করে এগিয়ে চলে দামিনী । মনটা যেন অতীতের মায়াবী সুখস্পর্শ পেতে সুদূর নীহারিকায় পাড়ি জমায়। 

  ছোটবেলায় দামিনী ছিল একটু অন্য রকম। বন্ধুদের সাথে মিশত বটে কিন্তু তার বেশী আপন মনে হত প্রকৃতিকে। প্রকৃতির বুক বেয়ে বেড়ে ওঠা গাছপালাকে। ভাবত ওদের ও তো প্রাণ আছে। সৃষ্টি কর্তা ওদের ও তো পাঠিয়েছেন নিজ নিজ সৌন্দর্য্যের ডালি দিয়ে। বিশ্ব সংসারে ওরাও তো সর্বদা সৌন্দর্য্যের মাধুরী ঢেলে প্রকৃতিকে সাজাতে ব্যস্ত। ওরাও সৌন্দর্য্যের কারিগর। আপন মনে কবির বসুন্ধরা কবিতার দুটি লাইন আওড়াতে থাকে,"হে সুন্দরী বসুন্ধরে, তোমা পানে চেয়ে , কত বার প্রাণ মোর উঠিয়াছে গেয়ে।" এই মহাযজ্ঞে নিজের সত্তা টুকু দিয়ে  সাজাতে চায় দামিনী। প্রাণপনে । মনথেকে আপনি উৎসারিত হয় কবির দুটি ছত্র, "ব্যাকুল প্রাণের আলিঙ্গন, তারি সনে, 
আমার সমস্ত প্রেম মিশায়ে যতনে
তোমার অঞ্চল খানি দিব রাঙাইয়া
সজীব বরণে;" 

    দামিনীর বিয়ে হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের এক বড় শহরে। স্বামী উচ্চ পদাসীন সরকারী আধিকারিক। অঢেল পয়সা , নিজের বাড়িঘর। দামিনীর চোখে পুরো বাড়ীটা যেন উদ্যান সাজানোর উন্মুক্ত প্রান্তর। বিয়ের পরে ছোট বেলা থেকে মনের একান্ত কুঠুরীতে সযত্নে লালিত অপূর্ণ সাধ মেটানোর নিরন্তর প্রয়াস ছিল দামিনীর। দু'হাত ভরে ফুল গাছের চারা কিনে নিপুণ কারিগরের প্রকৌশল প্রয়োগে বাড়িটাকে দুদিনেই  স্বর্গীয় রূপের মাধুর্য্যমন্ডিত করে গড়ে তোলে । স্বামী আরো আরো কিনে দেয় দামী নার্সারী থেকে  ফুলের চারা। যত চায় তত দেয় ।  মাত্রা ছাড়িয়ে অতিমাত্রায় ধাবিত হলে, স্বামী সৌম্য বারণ করে, এত দিয়ে কি হবে , কোথায় লাগাবে এতসব ! তবুও কেনে দামিনী। উন্মাদের মতো কেনে । সৌম্য ও দাম মেটায় । 

বাড়ির একচিলতে জায়গা ও ফাঁকা নেই । দামিনীর নজর এড়ায় নি কোথাও।  লাগিয়েছে বিভিন্ন প্রকার গোলাপ।  গোলাপের সে বসেরাই হোক আর মন্টেজুমাই হোক। ছাদ ভরে লাগিয়েছে বারবারা কার্স্ট , গ্লেনডোরা ইত্যাদি জাতের বোগোনভিলিয়া ফুল। বারান্দার সামনে লন মুড়িয়ে দিয়েছে রকমারি ফুলের সম্ভারে। ছোট ছোট খন্ড ভরিয়েছে ক্যান্ডি টাফ্ট, ক্যালেন্ডুলা, ফ্লক্স, গমফ্রেনা,ফ্লক্স, কক্স কম্ব, হলি হক, কারনেশন , স্যালভিয়া প্রভৃতি বর্ষজীবী ফুলের চাদরে। বারান্দায় রেখেছে নানা রংয়ের নানা আকারের ক্যাকটাস।কোনোটা ফেরোক্যাকটাস, কোনোটা গোলাকার অপানশিয়া ক্যাকটাস, কোনোটা এরিও ক্যাকটাস, কোনোটা আবার টেফ্রোক্যাকটাস্। ছাদে গিয়ে আপন মনে সে গেয়ে ওঠে পুরণো সুরে," আজ প্রথম ফুলের পাব প্রসাদখানি ,তাই ভোরে উঠেছি । আজ শুনতে পাব প্রথম আলোর বাণী," 

  সেদিন যে ওদের বিবাহ বার্ষিকী, তা ভুলেই গেছিল দামিনী। রবিবার থাকায় স্বামী সৌম্য ও অফিস যায় নি। গাছগুলো পরিচর্য্যা ছাড়া দামিনীর ও বিশেষ কাজ ছিল না। বিকেলে সৌম্য বলে, " চল আজ একটু ঘুরে আসি।" রাজী হয় দামিনী । সোজা চলে যায় সৌম্য গাড়ি চালিয়ে ভালো নার্সারীতে। দামিনী যেন আপন ভুবনে ডানা মেলা প্রজাপতি । ইচ্ছে মতো দামী গাছ কেনে। আজ যেন অন্য সৌম্য। বাঁধা দেয় না কোন কিছুতেই। কেনা হলে নির্বিকার সৌম্য দাম মেটায়। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার টাকা বিল উঠল। ফেরার পথে দামিনী কে নিয়ে গেল সৌম্য সোনার দোকানে । দামিনী বুঝতে পারে সোনায় রাঙাতে চায় তার স্বামী তার মনটাকে। স্বামী দুঃখ পাবে বলে বারণ করে না। আবার সেই কথাগুলো মনে পড়ছ, "মনেরে আজ কহ যে ,ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে ।" কিনে দেয় তাকে আড়াই লক্ষ টাকা দামের হীরে বসানো নেকলেস। দামিনী তবুও বুঝতে পারে না। বাড়ী ফিরে সৌম্য জানায় আজ তাদের বিবাহ বার্ষিকী। তাই এই চমক । 

অনাবিল আনন্দ পেয়েছে সে প্রতিবাদ হীন আজকের স্বামীর থেকে।  অনধিক মূল্যের ফুল গাছের চারাগুলি‌ আজ যেন তার পরম প্রিয় । তার বেশী আদরের। লক্ষাধিক টাকার গহনার চেয়ে। গহনা তো থাকবে তালাবন্দী হয়ে তোরঙ্গে। আর ফুল তার সুবাস ঢেলে মাতাবে তার ঘরের প্রতিটি কোণে কোণে।  মনের মাঝে আপনা থেকেই বেজে ওঠে কবির 'অনন্ত প্রেম' এর লাইন দুটি,
"একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি সকল কালের  সকল প্রেমের গীতি।"





মালতীদের গল্প

শ র্মি ষ্ঠা  সে ন

"ভিকসা দে রে মাঈ!" লাঠি ঠুকঠুক করে কানহাইয়া মালতীর দুয়ারের সামনে এসে দাঁড়ায়। 

বেলা দুপুর। সূর্য মাথার ওপরে দাউদাউ জ্বলছে। মালতী তখন ঘরের সামনে সরকারি কলতলায় হাঁটু অবধি কাপড় তুলে বাসনের পাঁজা নিয়ে বসেছে। 
  দু বালতি ভেজানোও আছে। বাসন মেজে ঘষে কাপড় কেচে উঠতে উঠতে তিনটে। এতক্ষণ জল থাকেনা। দেড়টা বাজতে না বাজতেই সরু হয়ে জল পড়ে, তারপর বন্ধ হয়ে যায়। তবে ব্যবস্থা আছে। ড্রাম রাখা থাকে, তাতে পাইপে জল জমা হতে থাকে। যার যখন দরকার পাইপ দিয়েই বালতি, বোতল ভরা হয়। তারপর আবার ড্রামে। মালতী একেবারে চান সেরে ঘরে যায় সাধারণত। দুপুরবেলা বড় একটা কেউ থাকেনা রাস্তায়। অবিক্রীত শুকনো সবজি, নেতিয়ে পড়া শাক পাতা নিয়ে বাড়ি ফেরে সবজি ওয়ালা। নামমাত্র দামে এ পাড়ার অনেকেই কিনে নেয় সেসব। আর আসে কানহাইয়ার মতো ভিখিরি। যারা জানে কোন বাড়িতে গেলে একটু জল টল পাওয়া যাবে। 

  কানহাইয়া হাতের লাঠি নামিয়ে ঘরের সামনে পড়ে থাকা মস্ত কংক্রীটের চাঙরটায় বসে। 
বাসন মাজতে মাজতে মেয়ের উদ্দেশ্যে হাঁক দেয় মালতী, 'একমুঠো চাল দিয়ে যা রে বুল্টি!' 
ঘর থেকে সাড়া শব্দ আসেনা। বুল্টি চান টান সেরে ঠাকুমার সাথে টিভি দেখতে বসে এসময়। বাইরের আওয়াজ এত সহজে কানে যাওয়ার কথা নয়।  

আরো দু একবার ডাকাডাকির পর মালতীর বর শিবেন বাইরে আসে। 
'কী হইছে! বুল্টিরে ডাকো ক্যান?'
'আমার বাপের পিন্ডি দেওয়ার জন্য ডাকি! একমুষ্ঠি চাল নিয়ে আসো।' মালতী ঝামরে ওঠে। 

শিবেন আজ দু'মাস ঘরে বসা। বারাসাত-দক্ষিণেশ্বর রুটের এক বাসের হেল্পার ছিল সে। মালিক বেশী বেতন দিচ্ছিল না লোকসান দেখিয়ে। রোজকার ভাড়া থেকে কন্ডাক্টর কিছুমিছু সরালেও ওর ভাগে পড়তো কাঁচকলা। তারপর কাজটা ছেড়েই দিল। এখন টুকটাক যা পায় তাই করে। করতে চাইলে কাজের অভাব হয়না। তবে কিনা সব জায়গায় মান থাকেনা। রান্নাঘরের চিমনি পরিষ্কার করাতে ডেকে বৌদিরা মিষ্টিমুখে শোবার ঘরের পাখা, ঝুল টুল এবং বাথরুমটা ও পরিষ্কার করে দিতে বলে!
 এলাকায় ফ্ল্যাট উঠেছে প্রচুর। ফাঁকা উঠোন, বাগান নেই বললেই চলে তাই মাসে মাসে বাগানের কেয়ারী করবার জন্য মালীর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। দু একজন ডাকে বটে তবে পয়সা দিতে চায়না! 
কিছুদিন বাজারে কচু-ঘেঁচু নিয়ে বসেছিল শিবেন। পোষায়নি। জমানো টাকা দিয়েই চলছে এ ক'মাস। আর মালতীর বাঁধা মাইনে টুকু তো আছেই। মাস গেলে ছাক্কা সাত হাজার। পালা পার্বণে ভালো-মন্দ খাবারদাবার, নাইটি, পুরোনো শাড়ি টাড়ি তো আছেই। অল্প কিছু চাল-ডাল- তেল সোয়াবিন-ডিম পায় পাড়ার নেতা ধরে। বছরভর ‘মিটিন’ এ হাজিরা দেওয়ার পুরস্কার। এইসব দিয়েই টানাটানির সংসার। এদিকে ঢাকতে গেলে ওদিক উদলা হয়ে যায়! তার ওপর এই ছ'মাস মায়ের দেখভালের ভার শিবেনের। মাস পুরোলে এক মুহুর্ত দেরী করেনা বড়দা। বেড়াল পার করার মতো বুড়িটাকে ছোট ছেলের ভাগে ফেলে যায়। বছরকার শাড়ি, সায়া ব্লাউজ দিয়ে দিদি নিজের দায়িত্ব সারে। কপাল জোরে মানুষটার শরীর খারাপ টারাপ হয়না বলে রক্ষে! তবে সারাদিন মুখ করলেও মালতী শাশুড়ির অযত্ন করেনা। নিজে এক কাপ চা করলে বুড়িটাকেও দেয়, সময়তে গল্পগাছা করে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে শিবেন একটু চাল আর একটা আলু এনে কানহাইয়ার শতচ্ছিন্ন নোংরা ঝুলিটায় ঢেলে দেয়। 

বাসনের ঝুড়ি ঘরে রেখে এসে মালতী ধাঁই ধপাধপ কাপড় কাচতে লেগে যায়। 
'একটু বসে যাও রে বাপ, কাল তালের বড়া করেছিলাম, দুটো মুখে দিয়ে জল খেয়ে যেও।' মালতী একফাঁকে বলে।

কানহাইয়া বসে থাকে আর ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে। নাতনীকে দুমাসের রেখে মেয়েটা বিষ খেয়ে মরেছিল তার। এখন সেই নাতনী ইস্কুলে যায়। সরকার জামা-জুতো-বই-খাতা দিয়েছে সেকথা বলে। 
শিবেন দুয়ারের সামনে বসে বিড়ি খায় আর পিচিক পিচিক থুতু ফেলে নর্দমার জলে। বসে বসে ভাবে, এমাসেও মেয়েটার নামে ব্যাংকে বই চালু করা গেল না। বই খুলতেও পাঁচশোটা টাকা না হলে হয়না! হেডমাষ্টার নাকি বলেছে সামনের মাস থেকে ব্যাংকে মিড ডে মিল এর টাকাটা ঢুকবে। ভালই হবে। ঐ ছোলা মোলা খায় কে! ফেলে ছড়িয়ে শেষ করা হতো কোনমতে। টাকাটা পেলে সংসারের কাজে লাগবে। মেয়েকে তো তারা না খাইয়ে রাখবে না!

জামাকাপড় দ্রুত মেলে মালতী ঘরে ঢুকে যায় গায়ে জল ঢালার জন্য। অন্যদিন বাইরের কলেই চানটা সারে, কে কোথা দিয়ে দেখছে ভাবলে মালতীদের চলে না। তবুও আজ দু জন পুরুষ মানুষের চোখের সামনে স্নান সারতে মন চাইলো না। 

কানহাইয়া বসে থাকে চারটি খাবারের আশায়। গত দশ বারো‌ বছর ধরে এ পাড়ায় ভিক্ষা করতে আসে সে। কোনো কোনো বাড়িতে জুটে যায় দিনমানের খাবারটুকু। বাসী রুটি, মুড়ি টুড়ি পেয়ে যায় ঠিক। 

শিবেনের পছন্দ হয়না ভিখিরির প্রতি এই অযাচিত দয়া। একবার দিলে মানুষের মনে আশা তৈরী হয়, আর এ তো ‘আপনি খেতে পায়না শংকরীকে ডাকে’ অবস্থা। তেল, চিনি, জ্বালানী সবই তো লেগেছে। ঘরে চারখানা পেট। মানুষ কে না বিলোলে কি হয়! তেতো মুখে মালতীর বেড়ে দেওয়া চারটি মুড়ি আর বড়া গুলো‌ দিয়ে কানহাইয়াকে বিদেয় করে সে।
          
                              ****

খাওয়া দাওয়া সেরে মালতী একটু চোখ বুঁজে ছিল। ভোর ভোর তার দিন শুরু হয়। পাঁচ বাড়ি কাজ ধরা আছে। মুখার্জীদের ছাড়া সবার বাড়িতেই একবেলা। ঘুম চোখে ফোনের টুংটাং আওয়াজ পায়, বুঝতে পারে বড় বাড়ি তলব করেছে। আজ বিকেলেও শিবেন কে নিয়ে যাওয়ার কথা। সামনে পুজো। সকালে  চিলেকোঠা থেকে বাসন পত্র পেড়ে দুজনে মিলে মেজে দিয়েছিল। পুজোর বড় বড় বারকোশ, গামলা, হাঁড়ি, কড়াই, খন্তা ইত্যাদি। পুজোর ঘর ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে দিয়েছিল। এবেলা নারকেল ছুলে দিতে হবে গোটা কুড়ি। 

'মা, তোমার জেঠিমা ফোন করেছে, বাবাকে নিয়ে এক্ষুনি যেতে বলল।' বুল্টি তড়িঘড়ি ব্যস্ত গলায় মাকে ডেকে দেয়। 

ক্লান্ত শরীরটা টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে শাড়ি ঠিকঠাক করে মালতী। শিবেন চোঙা প্যান্টের ওপর গলিয়ে নেয় ব্যাটম্যান ছাপ মারা গেঞ্জি। কাজের বাড়ির পুরোনো গেঞ্জি, সেদিন পাওয়া। 

'শুনো, ওইবাড়িতে আবার গায়ে পড়ে কথা টথা বলতি যেয়ো নি। যা বলে শুনবা আর সেই মতো কাজ করে চলি আসবা। পয়সা কড়ি খুশিমতো যা দেয় তাই নিবা।'
শিবেন বিরক্ত হয়। বলে, 'আমি নতুন যাচ্ছি নাকি, আমারে পাখি পড়া করাচ্ছে! গেল বচ্ছর দুইশত দিছিল, এইবার অন্তত বিশ পঞ্চাশ বেশী না দিলে পোষাবে না বলি দিলাম!'
'তার সাথে যে খোরাকি টা পাও একবেলার, সেটি ধরবা না? ' বলে মালতী থেমে যায়। পুরুষমানুষ কাদায় পড়লে খাওয়ার খোঁটা দিতে নেই। 

গেট খুলে কাজের বাড়িতে ঢুকে যায় মালতী। শিবেন উঠোনেই দাঁড়ায়। বেলা‌ পড়ে এলেও গুমোট গরম। একফোঁটা ছায়া নেই শরীর জুড়োবার মতো। উঁকিঝুঁকি দিয়ে বাড়ির ভেতরে দেখবার চেষ্টা করে সে।  দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বুকের ভেতরটা বিড়ির জন্য আনচান করে। ভেতর থেকে কথাবার্তার ক্ষীণ আওয়াজ আসে, জেঠিমা কাউকে নির্দেশ দেন বোধহয়। 
ভদ্দরবাড়ির মানুষেরাই পারে এভাবে একজন লোককে ডেকে এনে ঠায় দাঁড় করিয়ে রাখতে। শিবেন মনে মনে গাল দিয়ে পিচ্ করে থুতু ফেলে। তারপর গলা তুলে মালতীকে ডাকে। 

জেঠিমা দোতলার বারান্দা থেকে উঁকি মেরে বলেন, 'ওমা, শিবেন এসেছে কেউ বলেনি‌ কেন! ওরে শিবেন কে নারকেল গুলো দিয়ে আয় কেউ।'

একটু পর মালতী উঠোনে এনে ফেলে এক বোঝা ঝুনো‌ নারকেল। আর দুটো হাত-দা। দুটো চটের বস্তাও। শিবেন ঝটপট নারকেল ছুলতে থাকে। মালতী ছিবড়ে গুলো চৌকো টুকরো করে কেটে একটা বস্তায় ঢোকায়। ফি সন্ধ্যায় ধুনো দেওয়া হবে। দেখতে দেখতে পরিষ্কার করে বাঁধা ছাঁদা করে ঘরে দিয়ে আসে দুটো বস্তা। শিবেন হাত পা ঝেড়ে উঠোনের বাঁধানো বেদীতে বসে দম নেয়।

 এ বাড়িতে একসময় সারা বছর মালীর কাজ করেছে সে। এখন গোটা উঠোন টাই সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করা। বাগানের অনেকটা খেয়ে গেছে গ্যারেজ, দাদাবাবুর লাল টুকটুকে চারচাকা। বাকীটুকুতে খাপছাড়া ভাবে নিত্যপুজোর জবা, টগর, অপরাজিতা লাগানো। হাত নিশপিশ করে এক চিলতে বাগানটা কে সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে! কিন্তু মালতীর বারণ আছে। শিবেন কথা বলতে শুরু করলে থামতে জানেনা, তাই চেয়ে চেয়ে শুধু দেখে যায়। একটু পর রান্নার মেয়েটি বাইরেই দিয়ে যায় ‌এককাপ চা আর দুটো বিস্কুট। শিবেন জল চায়। 

চা জল খাওয়া হতে হতেই মালতী কাজ সেরে চলে আসে। হাতে দেয় চারটে একশ টাকা। একদিনের রোজগার। চোখ চকচক করে শিবেনের।
ওপর থেকে মুখার্জী জেঠিমা বলেন, 'ক'দিন আসিস শিবেন। হাতে হাতে করে আমার পুজোর কাজটা তুলে দিস বাবা। তোরা তো ঘরেরই ছেলে।' 

শিবেন বিগলিত হয়ে হাসে। টাকা হাতে নমস্কার করে বাড়ির পথ ধরে। গরম ভাতের সাথে আজ রাতে মালতীকে একটু হাঁসের ডিমের কষা করতে বলবে।





প্রেম প্রতিশোধ 
 
প্র দী প  কু মা র  দে


-- প্রেম জীবন দেয় আবার নেয়ও।

-- সেটা কিরকম?

-- একটা স্বাভাবিক নিয়ম এটা। সব কিছুরই ভালোমন্দ যেমন থাকে এই আর কি!

-- তুমি এরকমই একটা ব্যাখ্যা দাও না --
হরিহরের দাঁড়িভর্তি মুখে এক‌টি আকুতি - আমার কাছে।

-- সে না হোক বলবো - কিন্ত চা না হলেই যে নয় হরিদা ! দেখেছো আকাশ কালো হয়ে গুজরাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকে চমকে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে। যেন বলছে সাবধান -সাবধান !

--  কিসের ভয় কিসের?
হরিহরের মুখে প্রশ্নের আর্তি।

-- হরিদা - দেখো, - বলতে বলতে বৃষ্টির খেলা  শুরু হল। যে বাড়িতে আমরা দুজনে বসে আছি তার ইতিহাস তুমি জানো?

-- ইতিহাস ফিতিহাস আমি কিছু জানিনে। আমি শুধু বর্তমান জানি আমি এই ভাঙা কুটিরে ইয়াসের ঝড় জল এড়াতে দুদিন এসে জুটেছি। আমার বেড়ার কুটির এখন বিশবাও জলে। বৃষ্টি এখনো চলছে। কবে নিজের ডেরায় যেতে পারবো তা ঈশ্বরই জানেন। তবে হ্যাঁ একথা ঠিক তোমায় সঙ্গী  হিসাবে পেয়ে ছিলেম বলে আমার অনেক সুবিধে হয়েছে নিশ্চিত। না হলে এই জলাভূমিতে আর জংলি এই ভাঙা বাড়িতে আমি একা থাকতে পারতুম না। তুমিও আমার মত অসহায় হয়ে এসে আমায় সাথ দিলে তাই সাহস পেলুম!

-- আমি ও অসহায়। ঠিকই বলেছো। তাইতো ছুটে আসি অসহায় কে সাথ দিতে। বাইরে নির্জন জনমানব শুন্য। আমরা দুটি প্রাণী এই কুটিরে জীবন বাঁচতে খাদ্য পানীয়বিহীন হয়ে দিনযাপন করছি স্রেফ যে যার নিজের তাগিদেই।

আকাশ যেন ভেঙ্গে পড়ছে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। চারদিক ভেসে যাচ্ছে। ঝড় থামার পরেই চলছে এই বারিপাত। হরিহরের কাছে আজ আমি সব বলে দেবো পুরানো কথা। যা আমি জানি।

--  হরিদা - শোনো - বলছিলাম না প্রেম বড়ই পবিত্র।  তবে এর পরিনতি সব সময় সুখের হয় না বা সার্থকতা লাভ করে না মাঝে মধ্যে অভিশস্পাত হয়েও ধরা দেয় বা ফিরে আসে।

হরিদার মুখ বিবর্ণ। ফ্যাকাশে নীল। একেবারে আকাশের মতোই। ঘোর ঘনঘটা। আমার দিকে ওর চোখ হাপিত্যেশ করে দেখতে চায় চাক্ষুষরূপে আমার বলা কথাকাহিনী।

--  সেও এক বর্ষাকাল। এই বাড়ি তখন ছিল একেবারে ঝাঁ চকমকে। চৌধুরীদের পৈতৃক ভিটে।
যৌথ পরিবার। আর তার স্বাদই যে আলাদা। তবে গ্রামের বাড়ি। লোক লস্করে ভর্তি।

বড় ভাইয়ের ছোট ছেলের বিয়ে। বাবা মুকুন্দকিশোর, পাত্র মনজিত আর পাত্রী অনুসূয়া। বউ আজ এসেছে। বাড়ি ভর্তি লোকজন। সানাই বাজছে। গ্রামের সকলের দুবেলা আহারের ব্যবস্থা চলছে  মোট তিনদিনের জন্য। চেঁচামেচি - হৈচৈ ব্যাপার। নানান মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান চলছে নতুন বউকে নিয়ে। বউ ল্যাটা মাছ ধরবে তাই হাড়িতে চাপা দিয়ে মাছ রাখা রয়েছে। এয়োদের একজন যেই সেই হাঁড়ির মুখ খুলেছে ওমনি এক বিষধর কেউটে ফনা উঁচিয়ে ধরেছে। সে এক ভয়ানক পরিস্থিতি। বলে বোঝানো যাবেনা।  ভয়ে কে কি করবে বুঝে ওঠার আগেই বাবা মুকুন্দকিশোর ক্ষিপ্র গতিতে তার হাতের লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করে কেউটেটাকে। সাপটা  ছিটকে পড়েও ফোঁস করে মাথা তুলতেই বাগানের মালী যুধিষ্ঠির  গাছ কাটার সরু ধারালো দাঁ দিয়ে ওর মাথায় কোপ বসিয়ে দেয়। সাপটা মাটিতে তিনবার মাথা ঠুকে মারা যায়। ভন্ডুল হয়ে যায় সব অনুষ্ঠান।  আকস্মিক এই ঘটনার জের চলতে থাকে। ভয়ে আর অমংগলের শব্দ যেন সকলকে বিচলিত করে। বারিধারা আরও জটিলতা সূচিত করে।

গ্রামের প্রবীণেরা বেশি জটিলতার সৃষ্টি করে। গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। বিবাহের রেশ কাটে না চৌধুরীর বড় কর্তা গুঞ্জনের শিকার হন। অসুস্থ হয়ে পড়েন। শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ডান হাত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়।
বাড়ি ফাঁকা হলে নিস্তব্ধতার শক্তি  বাড়ে। বাড়িতে যেন কারোর ঘুমরানো কান্নার আওয়াজ বয়ে যায়। আস্তে আস্তে সকলেই সেই আওয়াজ শোনে। গুনীন আসে ,গুনে  বলে অতৃপ্ত আত্মা বাড়িতে কাঁদছে। সম্ভবত ওই সাপটি মহিলা ছিল এবং গর্ভবতী ছিল। গ্রামের লোকেরা তাই বিশ্বাস করে।

কিছুদিন বাদে মুকুন্দ শয্যাশায়ী থেকে মারা যান। ওই পরিবারের কুনজরে পড়ে গেছিলো অনুসূয়া। সবাই আড়ালে আবডালে তাকে কুলক্ষুনে বলতে লাগলো। কথা থেমে থাকে না। গ্রামে হু হু করে এ প্রান্তের খবর অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে যায়। তাই হলো।
যে নতুন বউ মহানন্দে ভালোবাসা দিয়ে সংসার সাজাতে বসেছিল তা তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে যায়। অনেক লড়াইয়ে স্বামীর মনেও সন্দেহ পাকাপোক্ত ভাবে বসে গেল। 

অন্যদিকে যে যুধিষ্ঠির মালী সাপটাকে কাটারির কোপ বসিয়েছিল তার গিন্নিকেও একদিন এক বিষাক্ত  সাপ দংশন করে। 
ওঝার শত চেষ্টা তাকে বাঁচাতে পারেনি। কারণ সেটাও ছিল কালকেউটে। ওঝা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং স্বপ্নে আদেশ পায় সরে যেতে -- এ নাকি মৃত নারী-কেউটেটিরই জোড়া সাপ, পুরুষ-কেউটে। তার উদ্দেশ্য হলো এদের বংশ কে ধ্বংস করে দেওয়া। প্রেমিকার মৃত্যুর প্রতিশোধ। ভালোবাসা থেকে হিংসার জন্ম।

পঁনেরো দিনের মাথায় যখন যুধিষ্ঠির মালী তার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে দূরে শহরে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছে, তখনই ঘুমের মধ্যেই তার ছেলেকে ছোবল বসিয়ে ছেড়েছে সেই ক্ষিপ্ত নাগ। স্বপনে তাকে এই দুঃখ বয়ে বেড়ানোর জন্য বাঁচিয়ে রেখে দিয়েছিল।

হরিহর চোখ মেলে আমাকে ভালো করে মাপলো কয়েকবার। ব্যাপারটা এইরকম তুমি এসব কথা জানলে কি ভাবে ? 

আমি আমার মতো করে বলে যেতে থাকলাম, --

ওদিকে পুত্রবধূ ছিল আসন্ন প্রসবা। স্বামী মনোজিত তখন স্ত্রীর প্রতি অনেকটাই অনুরক্ত।
গর্ভবতী খবরে বংশবৃদ্ধির আশায় স্ত্রীকে নতুনভাবে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। কিন্তু  অনুসূয়া চেয়েছিল এই পরিবার কে আর তার স্বামীকে একটু শিক্ষা দিতে। প্রসবের সময় বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার ব্যবস্থা তাই আগেই করে রেখেছিল।
কিন্তু নিয়তি, ভাগ্য আর অভিশাপ এই তিন মেল্বন্ধনের জের তাকেও মেটাতে হলো ওই কাল কেউটের ছোবলেই। এতদিনে বোধহয় ওই কেউটে
শান্তি পেল তার প্রতিশোধে। তার গর্ভবতী স্ত্রীর মৃত্যু বদলা নিল, মনোজিতের স্ত্রী গর্ভবতী অনুসূয়া বৌয়ের মৃত্যু  ঘটিয়ে।

এসব কথা জানা গেছিলো গুনীন মারফত। পুরুষ কেউটেটি পরপর বদলা নেওয়া চালিয়ে গেছে যতোক্ষন পর্যন্ত  না, এই বংশের গর্ভবতী কোন মহিলার প্রান নিতে পেরছে। তবে ওই বাড়ির অভিযুক্ত আর অভিশপ্ত দুইজন পুরুষকে সে বাঁচিয়ে রেখেছিল স্রেফ নিজের স্বার্থেই। এই দুজনের একজন মনোজিত অন্যজন ওই মালী যুধিষ্ঠির।  দুই ব্যক্তিকে বাঁচিয়ে রেখে তার পরিবারকে শেষ করে দিয়ে তার যন্ত্রনা বোঝাতে চেয়েছিল, যেমনটি সে পেয়েছিল।  ভালোবাসা তার সার্থক। প্রেমের মৃত্যুর  ক্রোধ আর তার প্রতিশোধ যার অন্য রূপ হিংস্রতা! এরপর থেকে ওই সাপকে আর কেউ দেখতে পায়নি।

হরিহর প্রশ্ন করে --  মনোজিতকে আমি চিনি। সে একজন জানি। যে সব ছেড়ে দেশান্তরে। বাড়ির অন্যান্যরা অনেকে আগেই মরে, পালিয়ে বেঁচেছে। কিন্তু অন্যজন ওই যুধিষ্ঠির মালী কোথায় হারিয়ে গেল?  তার আর্থিক অবস্থা এমন নয় যে সব ছেড়ে পালিয়ে যাবে?

আমি নিরুপায়। আবার আজ আমায় সব বলে দিয়ে হালকা হতেই হবে -- এই ছিলো আমার ইচ্ছে। তাই বাকী না রেখে হরিহরের কাছে স্বীকার করেই নিলাম, ---

--  আমিই সেই দ্বিতীয়জন -- সেই বাগান মালী -- যুধিষ্ঠির !

বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টিপাত হয়ে চলেছে , সব বুঝিবা ভাসিয়ে দেবে ……  দিক সব ভাসিয়ে…।।





হৃদ মাঝারে

সো না লী  ব্যা না র্জি

আজ থেকে তিরিশ বছর  আগের
ঘটনা। আমার এক বন্ধু ছিলো
কাঁকন। ভালোবেসেছিল  সুপ্রতিম বলে এক ছেলেকে। 
শীতের উষ্ণ ভালোবাসায় সারা না দিয়ে পারে নি কাঁকন। 

পরন্ত বিকেলের হিম শীতল পরসে,
 গোধূলির আলোর ছটায় মোহময়ী  হয়ে উঠেছিল কাঁকন। পার্কে জলের
 ধারে বসে দেখছিল, পরন্ত সূর্যের রশ্মি জলের ওপর গা ভিজিয়ে
মোহময়ী হয়ে উঠেছিল। সেই ছটা
কাঁকনের চোখে মুখেও আবির রঙ ছড়িয়ে তাকে রক্তম করে তুলেছিল।  ও একমনে কুয়াশার হাতছানিকে উপেক্ষা করে শীতের উষ্ণতার পরশ মাখতে মাখতে অপরুপ দৃশ্য অনুভব করছিল। কাঁকন বুঝতে ও পারেনি তারই পাশে বসে কেউ তাকে মনোযোগ সহকারে দেখছে।
এই প্রকৃতির প্রেমে পাগল কাঁকন। যখন প্রকৃতির সাথে মিশে যায় তখন কোনো দিকেই তার নজর পরে না।
সুপ্রতিম কাঁকনের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। প্রকৃতির সাথে কাঁকনেরও গোটা কতো ছবি নিজের মুবাইলে ধরে রাখে
কাঁকনের অজান্তেই।
কাঁকনের বন্ধুরা ডাকতে এলে সে 
বন্ধুদের সাথে চলে যায়।
সাহস জুটিয়ে সেইদিন সুপ্রতীম কাঁকনের সাথে কথা বলতে না পারলেও মনের মণীকোঠায় জায়গা দিয়ে ফেলেছিল নিজের অজান্তেই।
বন্ধুরা ডাকতে এলে, ওর নামটা শুনে হৃদমাঝারে বসিয়ে ছিলো খুব শর্তপরণে।
আস্তে আস্তে বন্ধু ও সোশ্যাল মিডিয়ার দরুন কাঁকনের খোঁজ নিয়ে তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়  সুপ্রতিম। 
তাঁর ছবিগুলো দেখে কাঁকন নিজেই হতবাক। এতো সুন্দর করে যে 
কোনো জিনিস রিপ্রেজেন্ট করা যায় তা ছবিগুলো না দেখলে সে কল্পনাও করতে পারতো না। 
এই ভাবে বন্ধুত্ব।  বন্ধুত্ব কখন আস্তে
 আস্তে প্রেমে পর্যবসিত হয় কাঁকন বুঝতেও পারেনি। 
এইভাবে গল্প করতে করতে শীতের রাতগুলো ওদের কাছে আরো মহময়ী হয়ে উঠলো। প্রতিটা রাত ফোনের ওপারে একজন এপারে একজন তপ্ত হৃদয়ের আনাগোনা ও তাদের ভালোবাসার আদান-প্রদান করতে থাকে। কিছু দিনের মধ্যেই  ওদের একজন আরেকজনকে ছেড়ে থাকা দুস্কর হয়ে পড়ে। কিন্তু সুপ্রতীম বেকর। সব জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছে। কাঁকন আর সুপ্রতিম বাইরে দেখা করা শুরু করে । শীতের সন্ধ্যায় গঙ্গার পারে দুজনের মিলন হয় একটু উষ্ণতার ছোঁয়া পেতে। শীতের কুয়াশা ঘেরা ঠান্ডাতে ভালোবাসার চাদর বিছিয়ে মেলে ধরে ওদের প্রেমের উষ্ণতা।
ওরা ঠিক করে এইভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে আর নয়।দুজনেই বলবে  কথা ঘরে।
ওদের পক্ষে আর ছেড়ে থাকা দুস্কর হয়ে পড়ে।
ভালোবাসার পরতে পরতে ওদের দেহ মন মিশে একাকার হয়ে গেছে।ওরা ঠিক করলো এই কাজটা হয় গেলেই মা ,বাবার কাছে ওদের ভালবাসার কথাটা বলবে। এই শীতের রাত সাক্ষী হয়ে রইলো তাদের ভালোবাসার।

 
  অন্য দিকে কাঁকনের বিয়ে দেবার তোরজোড় শুরু হয়েছে।
কাঁকন মা, বাবাকে না বলে থাকতে পারলো না কেননা এই মাঘ মাসেই কাঁকনের বিয়ের ঠিক করেছেন তার মা বাবা।
কাঁকন মা, বাবাকে বলতেই ওনারা একটা  বেকার ছেলের‌ সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলেন না।

"যতোই তার মধ্যে গুনের সম্ভার থাকুক না কেনো!
বেকার ছেলে কবে চাকরি পাবে তার নেই ঠিক।তার ভবিষ্যত নেই কোনো!"

এই কথা বলে উঠলেন মা। 

  কাঁকন, মা বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে সব বাঁধাকে উপেক্ষা  করে সেই রাতেই ঘর থেকে বেড়িয়ে  সুপ্রতিমকে বিয়ে করে। মন প্রান দিয়ে ভালোবেসেছিলো দুজনেই দুজনকে।
সাক্ষী থাকলো অগ্নি, শীতের রাত আর মন্দিরের কালি ঠাকুর।।
দুটো দেহ মন এক হলো সেই শীতের রাতে ভালোবাসার উষ্ণতা পেতে।।


ভালোই চলছিল তাদের সংসার।  সুপ্রতিম অনেক কষ্ট করে ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে এক জায়গায় ভালো চাকরি পেলো।
ঘর আস্তে আস্তে কাঁকনের আর সুপ্রতিমের  সাহায্যে স্বর্গে রূপান্তরিত হয়।
দুজন দুজনকে হৃদ- মাঝারে রেখেছিলো।
দু বছর ঘুরতে না ঘুরতে একটা মেয়ে আসে ওদের ঘর আলো করে। মৌ খুব মিষ্টি মেয়ে। 
কাঁকন মেয়ে নিয়ে মা বাবার কাছে প্রনাম করতে  গেলে মেয়ে ও নাতনি কে দেখে ওদের রাগ ও অভিমান সব জল হয়ে যায়। কাঁকন সুখের সাগরে ভাসতে থাকে। 
কিন্তু এতো সুখ ভগবানের সহ্য হলো না।
সুপ্রতিম প্রমোশন পেয়ে শিলিগুড়ি ট্রান্সফার হওয়াতে খুশির সাথে সাথে কাঁকনের মনে দুঃখ ও দানা বাঁধে। 
সুপ্রতিমকে ছেড়ে থাকবে কি করে!
এই কষ্ট ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেলেও, সুপ্রতিম ওকে শান্তনা দেয়--,

"আমি তো পরের সপ্তাহে আসবো মাস ঘুরতে না  ঘুরতেই তোমাকে আর আমার মিষ্টি মাকে নিয়ে যাবো কোনো চিন্তা করো না। দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যাবে।”

এই সব কথা বুঝিয়ে সুপ্রতিম রওনা হয়। শ্বশুর ও শাশুড়িকে প্রনাম করে ওদের দায়িত্বে রেখে যায়  সুপ্রতিম কাঁকন ও মৌকে। কাঁকনের দুচোখ বেয়ে বারিধারা প্লাবিত হয়।অনেক কষ্টে সুপ্রতিম  ওদেরকে ছেড়ে এগিয়ে যায় নিজের গন্তব্যস্থলের দিকে। 
কিন্তু ভাগ্য বিধাতা অন্য কিছুই ভেবে রেখেছিলেন।
কিছুদিন ধরে ফোন আসছে না সুপ্রতিমের। মনটি বড়ই উচাটন হয়ে আছে কাঁকনের।

"কি করছে খবর নেই! ফোন নট রিচেবল বলছে!”
 কাজ করতে করতে কাঁকন অন্য মনস্ক ভাবে এইসবই চিন্তা করছিলো।

হটাৎ  ফোনটা বেজে ওঠাতে অবসাদগ্রস্ত মনে হাজার আলোর রসনাই খেলে গেলো মনে। 
‘এই তো সুপ্রতিমের  ফোন
 এসেছে!”
দৌড়ে পড়িমড়ি করে ফোনটা এসে ধরলো।
ওপার প্রান্ত থেকে অফিসের এক কলিগ বলে ওঠে---, 
"আমি শিলিগুড়ি থেকে বলছি ম্যাম। হসপিটালে আপনার স্বামী   সুপ্রতিম বাবু এ্যাডমিট আছেন। এক দুর্ঘটনায় খুব গুরুতর আহত হয়েছেন। আপনারা সত্বর যোগাযোগ করুন।"  

কাঁকন এই কথা শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।কাজের লোক এসে  কাঁকনকে মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে আর পাশে বাচ্চাটা কাঁদছে দেখে সঙ্গে সঙ্গে কাঁকনের মা,বাবাকে ফোন করে খবর  দেয়।
 কাঁকনের বাবা, মা এসে  মেয়েকে  একটু সুস্থ করে নিয়ে নিজেদের  গাড়ি  করে  রওনা হয় শিলিগুড়ির
পথে।
ওরা যখন শিলিগুড়ি পৌছায় বেশ রাত হয়ে গেছে। তখন হসপিটালে
 ঢোকা যাবে না। ওদের কাছে কোনো পাসও নেই তাই অফিসের আউট হাউসে মা,বাবা  কাঁকনকে নিয়ে আসে। ওখানেই অফিসের একজন কলিগ সুদীপ ওদের জন্যই
 ওয়েট করছিলো। ওখানেই ওঁরা  ওদের ব্যাগ রেখে সুদীপের কাছে পাস নিয়ে   হসপিটালের  দিকে রওনা হয়। হসপিটালে গিয়ে ডাক্তারের সাথে  কথা বলে অবাক হয়ে যান  কাঁকনের বাবা অখিলেশ
 বাবু।  
ডাক্তারবাবু বললেন, 

"কালই তো উনি মারা গেছেন! মর্গে গিয়ে  ডেডবডি  সনাক্ত করে আসুন। দুর্ঘটনাতেই  স্পট ডেথ হয়।” 
কাঁকন এই কথা শুনে ওখানেই সেন্সলেস   হয়ে পড়ে ও  হসপিটালে ভর্তি করতে হয়।

সুপ্রতিমের   দাহ সংস্কার  করে কাঁকনরা ঘরে ফিরে এলো। কিন্তু সেইদিন থেকে কাঁকন ঘুম , খাওয়া সব ছেড়ে দেয়।‌‌ জোর করে কিছুই করানো যায় না। কাঁদাতে পারে না
কেউ। একদম নিরেট পাথরে  রূপান্তরিত হয়ে গেছে কাঁকন!
 মা ,বাবা,অনেক ডাক্তার দেখিয়ে , ডিপ্রেশনের ওষুধ খাইয়েও  কোনো  লাভ হয়  নি। একদিন রাতে কাঁকন একসাথে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেলো ঘুমের দেশে পাড়ি দেবার জন্য। কিন্তু কাঁকনের মায়ের চোখে পড়ে যাওয়ার দরুন সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় কাঁকনকে। পেট ওয়াস করে অবজারভেশনে রাখা হয়।
দুই দিন পর যখন কাঁকন হসপিটাল থেকে ফিরে এলো তখন মৌ এর শরীর খুব খারাপ জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। ডাক্তার দেখে গেছেন।  কিন্তু ঘুমের ঘোরে মা, মা করে যাচ্ছে মেয়ে। ডাক্তারবাবু যখন বললেন,

“ ওর মা কে ওর কাছে নিয়ে আসুন, না হলে মেয়ে কে বাঁচানো যাবে না।”

 সুপ্রতিম চলে যাওয়ার পর কাঁকন একবারও  মেয়ের কাছেও আসেনি। হসপিটাল থেকে আসার পর কাঁকনের মা,বাবা দুজনে কাঁকনকে তার মেয়ের কাছে নিয়ে এসে বললো----,
 "তুই তোর মেয়ে কেও হারাতে বসেছিস! সুপ্রতিম চলে গেছে কিন্তু মেয়ের জন্য তোকে বাঁচতে হবে মা। এমনি নিথর হয়ে থাকিস না কাঁকন!
 জীবনটা অনেক বড় ও সুন্দর। পৃথিবীতে অনেক কিছু করার আছে। এতো সহজে হার মানলে চলবে না সোনা! তোকে তোর মেয়ের জন্য বাঁচতে হবে! তাকে  মানুষ করতে হবে। ওর স্বপ্ন পূরনের দায়িত্ব তোর। ওর মধ্যেই তো সুপ্রতিম বেঁচে আছে। ওপর থেকে দেখবে তোরা দুজনে খুশিতে আছিস ,সুখে আছিস। ওর আত্মার শান্তি পাবে মা।”

এতোদিন পর কাঁকন মেয়েকে জড়িয়ে হাউ, হাউ করে কেঁদে উঠলো।
ভেতরের সব আবর্জনা, দুঃখ ,কষ্ট, যন্ত্রণা বেরিয়ে এক নতুন জীবনের উত্থানের পথে।
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বলতে থাকে,

“ হ্যাঁ আমাদের বাঁচতে হবে!  নতুন আলোয়, নতুন ভাবে, নতুন পথে, উওরণের পথে!”

মেয়ে কে বড় করার সপথ নিলো। “সুপ্রতিম আছে থাকবে চিরজীবন অমর হয়ে আমার হৃদ- মাঝারে আমার সন্তানের মাঝে!”
********
কাঁকন এক স্কুলে জয়েন করলো। বাচ্চাদের পড়াতে লাগলো। ছোটদের মানুষ করার সপথ নিয়েছে।প্রান খুলে তাদের সাথে হাসে আর ভাবে পৃথিবীটা অনেক বড়, জীবনটা বড় সুন্দর, এই জীবন নষ্ট করার অধিকার কারোর নেই।প্রান খুলে হাসো আর সব বাঁধা বিপত্তি সরিয়ে এগিয়ে যাও। এই শিক্ষাতে মেয়েকেও মানুষ করে। 

অনেক বছর পর ----,

আজ সুপ্রতিমের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
 মেয়েকে ডাক্তারি পাশ করিয়ে।
আজ নিজে রিটায়ার্ড হেড দিদিমনি।
সবার কাছে অনেক ভালোবাসা ও সম্মান পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করে। এন .জিওর সাথে ও যুক্ত ছিলো। আজ সে জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছে। আর সবাইকে সেই শিক্ষাতে বড় করে তুলেছে।
সবার ওপর হলো এই জীবন,
যাকে তুমি সুন্দর করে সাজাও।
সব বাধা বিপত্তি সরিয়ে উওরণের পথে এগিয়ে চলার নামই জীবন। 
কবিদের কথায়----_,
এই গান সে গায়-----,,,,
"মরিতে চাহি না আমি এই সুন্দর ভূবনে।”
********
  অন্তিম পর্ব  
××××××××
সুপ্রতিমের ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে আর দুগাল বেয়ে জল গড়িয়ে পরে। 

"দেখো তোমার মেয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়েছে।আমি পেরেছি গো আমি পেরেছি তোমার স্বপ্নপূরণ করতে।আমি মাথা উঁচু করে তোমার সব দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে জয়ী হয়েছি। তোমা বিনা, তোমার 
  ভালোবাসা কে পাথেয়  করে , আমি এগিয়ে গেছি জীবনের  এক উওরণের পথে।
জানি তুমি আছো আমার হৃদ-মাঝারে।”





ভাসান

র ঞ্জ না  বি শ্বা স

রুমিয়ার প্রবল চিৎকারে শিখা দেবী টিভির পূজা পরিক্রমা ছেড়ে মেয়ের ঘরে ছুটলেন।
কিরে কি হল?উফ্ মা এতদিন  
তোমাদের সব কথা শুনেছি কিন্তু এখন আমি কলেজে পড়ি!একটা দিন বাপি আমাকে বন্ধুদের সাথে ঠাকুর 
দেখতে দিতে চাইছে না,আজকে আমি যাবোই।
ওহ্ এই জন্য এতো রাগ!
কিন্তু মনা দেখ ঐ মুসলিম ছেলেটা কি যেন নাম;ঐ যে রনি,তোর বাবা ওকে একদম পছন্দ করেনা।কেন মা,মেঘ,দুবাই ওদের মতো রনিও তো আমার বন্ধু!না মনা
আমরা বুঝতে পারি,ও তোকে ঠিক বন্ধুর চোখে দেখে না।
আচ্ছা আচ্ছা মা,আমি তোমার সাথে তর্কে যেতে চাই 
না।আমি রনি ফোন করে বারণ করে দিচ্ছি যাতে ও না
যায়,ওর খুব আত্মসম্মান বোধ আছে বুঝেছ।বাকি বন্ধুদের সাথে আমাকে যেতে দাও প্লিজ।
অতএব মেয়ের জেদের কাছে 
পরাস্ত হয়ে শুভ্র বাবু মেয়েকে যাবার পারমিশন দিয়ে দেন।

এই রুমিয়া তোকে তো কি অপূর্ব লাগছে ব্ল্যাক শাড়িতে!
হ্যাঁরে আমার জীবনের প্রথম শাড়ি।চল চল গাড়ি তে উঠি।
বাহ্ সুবীর তুই পাঞ্জাবি করেছিস!এই মেঘ তোর শার্টের কালার টা ভীষণ সুন্দর 
রে।অমনি মিতা বলে উঠলো আর বুবাই কে দেখ,জাপ্টে ফাটাফাটি।হাসি মজায় মেতে উঠে ওরা পাঁচজন একটার পর একটা ঠাকুর দেখতে থাকে।

বাইরে রাত ঘন হচ্ছে কিন্তু কেউ জানেনা সবার অলক্ষ্যে
রনি একটা বাইক নিয়ে ওদের 
গাড়ির পিছনে পিছনে চলছে।
রনির বুকটা মুচড়ে উঠছে,
রুমিয়া কে এতো ভালোবাসে
অথচ মেয়েটা একসাথে ঠাকুর 
দেখতে যেতেও বারণ করে দিল!
এদিকে গাড়িতে হঠাৎ বুবাই আর সুবীর নিজেদের মধ্যে চোখে চোখে কি একটা ইশারা করে দিলো।বুবাই বললো শোন না, সামনেই তো লেক 
চল না ভেতরে গিয়ে বসে একটু হাত পা ছাড়িয়ে নিই।
মেঘ বললো তোরা লেকে ঢোক, সামনেই তো মুদিয়ালীর 
ঠাকুর, আমি ঠাকুরটা দেখে তোদের সাথে জয়েন করছি।ওমনি বাকিরা ও দৌড়লো 
ঠাকুর দেখতে। শুধু রুমিয়ার পা ব্যথা করছে তাই ও চললো 
বুবাই এর সাথে।

লেকের এই দিকটা প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে।রুমিয়া 
একটা বেঞ্চে বসতে গেল,
কিন্তু বুবাই ওর হাত ধরে টেনে 
বললো চল হাত পা ছড়িয়ে গাছের তলায় গিয়ে বসি।
কাছের বন্ধুর সাথে নিশ্চিন্তে 
গিয়ে সে বসলো গাছের তলায়। টুকটাক কথা বলতে বলতে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে বুবাই হঠাৎ করে 
রুমিয়ার শাড়িটা ধরে একটা টান দিল। পাতলা শাড়ি পিন থেকে ছিঁড়ে গেল।রুমিয়া ভয় 
পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,এই 
বুবাই কি করছিস,ছাড় ছাড় 
বলছি!আরে আয় না একটু 
মজা করি, এখানে কেউ নেই।
এই বলে পকেট থেকে একটা 
ছোট বোতল বের করে নিয়ে 
বললো একটু খা, দারুণ জমবে।বুবাই কে ধাক্কা দিয়ে রুমিয়া উঠে পড়তে গেল,
বুবাই জোর করে ওকে চেপে 
ধরে।

হঠাৎ জোর ধাক্কায় বুবাই
অবাক হয়ে তাকিয়ে 
দেখল রনি ওকে পিছন থেকে 
টেনে ধরেছে। প্রবল রাগে বুবাই রনিকে ঠেলে ফেলে 
দিল।দুজনের মধ্যে জোর 
ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়।
রাগে আর উত্তেজনায় হঠাৎ করেই হাতের কাছে বোতলটা
কুড়িয়ে পেয়ে আছড়ে ভেঙ্গে 
বুবাই ভাঙ্গা বোতলটা ঢুকিয়ে 
দেয় রনির পেটে। ক্রমাগত 
রুমিয়ার ভয়ার্ত চিৎকারে 
দূর থেকে কতগুলো ভারি 
বুটের ছুটে আসার আওয়াজ 
পাওয়া গেল। জোরালো টর্চের 
আলোয় দেখা যায় রক্তে ভিজে নিথর হয়ে পড়ে আছে 
রনির দেহ টা।

লেকের বাতাস কেঁপে উঠলো 
রুমিয়ার বুক ভাঙ্গা কান্নায়।
ও কাঁদছে আর পাগলের মত 
বলছে বাপি দেখ, তোমার 
মেয়েকে বাঁচিয়ে, তোমাদের 
সম্মান রক্ষা করে আজ নিজে 
ভাসান হয়ে গেল...জান কে?
তোমাদের ঘৃণার পাত্র, তোমাদের চক্ষুশূল।
.....রনি এই রনি ওঠ নারে.....
শরতের শিউলির গন্ধে মিশে 
রনির সারা শরীর জুড়ে গাছ 
থেকে নিশ্চুপে কতো কুঁড়ি 
তখন টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে।





সোনার হরিণ

শ্যা ম লী  ব্যা না র্জী

বারান্দায় আরামকেদারায়
বসে শূন্য দৃষ্টিতে দূরের পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে ছিল অহনা। একটি লাল শাল ঘিরে আছে তার তন্বী শরীরটাকে। পরণে নীল সাদা ডুরে শাড়িখানা তার শরীরকে বেষ্টন করে ঝর্ণাধারার মত এলিয়ে পড়েছে। কানে দুটি লাল চুনির দুল। অন্যমনে গলার সোনার চেনটি দাঁতে চেপে সে গভীর চিন্তামগ্ন। অঘ্রাণের শুরুতেই এই মধুপুরে হিমেল হাওয়ার আমেজ।
গেটের কাছে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছটায় লাল আর হলদে ফুলের গুচ্ছ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে শীতের অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছে। হ্যাঁ। শীতের শুরুতেই এখানে  চেঞ্জারদের আগমন হয়। কলকাতার অনেকেরই এখানে বাগানবাড়ী কেনা আছে। পূজার অথবা শীতকালীন ছুটি কাটাতে  অনেকেই এখানে আসেন।
অহনা অবশ্য গত ছয়মাস যাবৎ এখানে তার পিসিশাশুড়ীর কাছে এসে আছে তাঁর দেখাশোনা করবার জন্য।
অহনা কলকাতার মেয়ে।
দুবছর আগে বাবা মায়ের সঙ্গে পূজার ছুটি কাটাতে পিসিমার বাড়ীতে বেড়াতে এসেছিল সে। বিরাট বাগানবাড়ীটির পূর্ব দিকের অংশটি চেঞ্জারদের ভাড়া দিতেন এই পিসিমা। পিসিমা উচ্চশিক্ষিতা ও অবিবাহিতা ছিলেন। সারাজীবন কলেজে শিক্ষকতা করে অবসর জীবন কাটাবার জন্য এই মধুপুরের বাড়িতেই এসে থাকতে শুরু করেন তিনি। তাঁকে দেখাশোনা করার জন্য এক পুরানো ও বিশ্বাসী পরিচারিকা মঞ্জুমাসী ও এক মালীপরিবার থাকতো এখানে।
অহনা মধুপুরের এই বাড়ীটিতে পৌঁছেই খুব খুশি হয়ে গিয়েছিল। লাল বাংলো টাইপের দোতলা বাড়িটি ঘিরে ফল ও ফুলের বাগান, গেটের দুধারে কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া গাছ ফুলভারে নুইয়ে পড়েছে। সে কৃষ্ণচূড়ার শাখায় শাখায় লাল ফুলের সমাহার দেখে 
নেচে নেচে গান গেয়ে উঠেছিল "আজ কৃষ্ণচূড়ার আবির নিয়ে আকাশ খেলে হোলি"---,
তার সুরেলা মিষ্টি গানের আওয়াজে পিসিমা বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিলেন। টুকটুকে লাল শাড়ি পরা অহনাকে দেখে তাঁর ভারী পছন্দ হয়েছিল। পছন্দ হবে নাই বা কেন? ষোড়শী অহনাকে তখন যে দেখতো তারই মনে ধরত। একমাস মধুপুরে ছুটি কাটাবার অবসরে ক-তো বার  পিসিমাকে গান শুনিয়েছে সে। নজরুল গীতি, আধুনিক, রবীন্দ্রসঙ্গীত, রজনীকান্ত ও অতুলপ্রসাদী গান। হাসি গল্পে সঙ্গ  দিয়েছে পিসিমার। ওরা কলকাতা ফিরে আসার আগেই কথাটা  পাড়লেন
পিসিমা। অহনার বাবাকে ডেকে বললেন তাঁর শ্বশুর বাড়ির সম্পর্কে এক বিবাহ যোগ্য ভাশুরপো আছে। কলকাতায় নিজস্ব বাড়ি, বাবার বইয়ের ব্যবসা দেখাশোনা করে। মা, বাবা স্বর্গলাভ করেছেন। তার জন্য অহনাকে তাঁর খুব পছন্দ।
অহনার বাবা ও মায়ের যদি এই সম্বন্ধ অহনার উপযুক্ত বলে মনে হয় তবে কলকাতায় গিয়ে তাঁরা যোগাযোগ করতে পারেন। ঠিকানা ও ফোন নম্বর নিয়ে অহনার বাবা কলকাতায় এসে ভাসুরপো রঞ্জনের সঙ্গে পরের সপ্তাহেই যোগাযোগ করলেন। পাত্র অত্যন্ত সুপুরুষ। ব্যবহারও ভদ্রোচিত।
একমাসের মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হল। অহনার ইচ্ছা ছিল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বিয়ে করার। কিন্তু আত্মীয়স্বজনের চাপে তার আগেই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হল।
ফুলশয্যার রাতে লাল বেনারসীর সাজে কনেচন্দন আঁকা অপরূপা অহনাকে কতিপয় আত্মীয়া শয়নকক্ষে পৌঁছে দিয়ে গেল। ফুলসাজানো খাটে বসে অহনা রঞ্জনের প্রতীক্ষায়। বাইরে নহবতের সানাইয়ের সুর তাকে উন্মনা করে তুলেছে।
রঞ্জন বরের সাজে ফুলের মালা গলায় ঘরে এলো অনেক রাতে। অপেক্ষায় থেকে থেকে অহনার চোখ ঘুমে বুজে এসেছিল। রঞ্জনের গলার শব্দ পেয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে সে দেখল রঞ্জন একটি ছিপছিপে লম্বা যুবকের গলা জড়িয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো।
অহনা সচকিত হয়ে জড়সড় হয়ে সরে বসতে গেলে রঞ্জন
মেয়েলি সুরে অহনাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল জগুকে লজ্জা কি? ও তো আমার ঘরের লোক। জগুকে ছাড়া আমার ঘুম আসে না। ও  রোজ আমার সাথেই শোয়। ভয়ে লজ্জায় অহনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এ কোথায় বিয়ে দিয়েছে তার বাবামা। বাকি রাত চললো ওদের দুজনের নানা অশ্লীল জোক, কুৎসিত গান ও আদি রসাত্মক রসিকতা। 
অহনার লক্ষ্য করলো রঞ্জনের মধ্যে মেয়েলি ভাবের প্রকাশ। আর জগু তার সঙ্গে প্রেমিকের মত আচরণ করছে। মাঝে মাঝে অহনাকে কাছে ডাকছে রঞ্জন।
অহনা শিউরে উঠে ঘরের দরজা খুলে দৌড়ে পালিয়ে এলো বারান্দায়। প্রতিজ্ঞা করলো কাল বা পরশু যেমন করেই হোক ফিরে যাবে বাপের বাড়ি। তার এই অল্প বয়সে সে রঞ্জনের মতিগতি ভালো বুঝতে পারেনি বটে, কিন্তু রঞ্জনের ব্যবহার যে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক সেটা মনে মনে উপলব্ধি করেছিল।
কিন্তু অহনার ইচ্ছে মত কিছুই ঘটলো না। পরেরদিন অহনার শাশুড়ী স্থানীয় একজন বেশ রুষ্ট হয়েই বললেন আমাদের বংশের নিয়মে  অষ্টমঙ্গলার আগে বাপের বাড়ি যাওয়া  চলবে না। কাজেই আবার সেই
একই শয়নকক্ষে রাত্রিযাপন।
তবে রঞ্জন বা জগু সারা রাত
নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। অহনাকে স্পর্শ করে না এই রক্ষে।
অষ্টমঙ্গলার দিন বাপেরবাড়ি 
পৌঁছেই অহনা আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল। অহনার বাবামা বুঝলেন একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। রঞ্জনকে প্রশ্ন করলে সংক্ষিপ্ত উত্তর পাওয়া গেল "আমি এরকমই"। "জগুর সঙ্গে আমি ছোটবেলা থেকে আছি,
ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারি না। অহনা যদি adjust করে থাকতে পারে তবেই আমার সঙ্গে ফিরে চলুক।"
অহনাকে এবারও  চোখের জল মুছতে মুছতে শ্বশুরবাড়ি
ফিরতে হল। ওর বাবা আর মা চললেন মধুপুরে পিসিমার কাছে।
পিসিমা সমস্ত ব্যাপারটা শুনে মর্মাহত হলেন। ওঁর মত হল কিছুদিন সময় দেওয়া উচিত রঞ্জনকে। যদি অহনার সঙ্গ পেয়ে রঞ্জন নিজেকে পরির্বতন করে। অনেক সময়
বাল্যের কুঅভ্যাস ত্যাগ করে লোকে। রঞ্জন তো ছোটবেলা থেকেই পিতৃমাতৃহীন। ওকে ঠিক পথে পরিচালনা করার মানুষের অভাব ছিল।
অহনার বাবা ও মা ফিরে এসে অহনাকে বোঝালেন কিছুদিন ধৈর্য্য ধরতে।
কিন্তু তিনমাস অপেক্ষার পর
কোনোই ফল না হওয়ায় অহনা ফিরে এলো বাবার কাছে।
পিসিমা ডেকে পাঠালেন অহনাকে। পিসিমার নিজস্ব গহনায় ভর্তি গহনায় বাক্সটি
তুলে দিলেন অহনার হাতে।
অহনা আর কলকাতায় ফিরতে চাইল না। কলকাতায় আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবীদের
শ্লেষ, বিদ্রূপের সম্মুখীন হতে চায়না আর সে। অহনার বাবাকে পিসিমা পরামর্শ দিলেন অহনার মন শান্ত হলে, পুনর্বিবাহের জন্য প্রস্তুত হলে
তিনি যেন ডিভোর্সের ব্যবস্থা করেন। আপাতত অহনা তাঁর কাছেই কিছুদিন থাকুক।
অহনার ও তাই মত। 
প্রাণোচ্ছ্বল মেয়েটা ধীরে ধীরে ছাই চাপা আগুনের মত স্থির হয়ে এলো। বিয়ে শব্দটা তার কাছে যেন এখন আতঙ্কের সৃষ্টি করে।




মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪