ভ্রমণকাহিনী

এক গোবেচারার ভ্রমণ বেত্তান্ত

তা প স দে

                    (১) 

-'এ বছরে লেবু খেয়েছো?'
-' লেবু তো আমার প্রতিদিনই লাগে, লেবু ছাড়া আমার খাওয়াই হয় না।'
ওদিকে কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। তারপর একটা বিরক্ত গলা ভেসে এলো ইথারে।
-' তুমি কোন লেবু প্রতিদিন খাও?'
-' ওমা, কেন? পাতিলেবু।'
- ' আমারই ভুল। তোমার মতো পাতি লোক পাতিলেবু ছাড়া কি ভাববে? আমি কমলালেবুর কথা বলছিলাম। খেয়েছো কমলা?'
- ' হুঁ, খেয়েছি।'
- 'কোথাকার লেবু?'
- 'কি যেন একটা বলেছিলো, মনে হয় ভাগলপুরের হবে।'
- 'ভাগলপুরে কমলা হয় জীবনে প্রথম শুনলাম। নাগপুর হলেও বুঝতে পারতাম।'
- ' তা হতে পারে। আমার ইতিহাস খুব খারাপ।'
- 'লেবু কোথায় হয়, সেটা ইতিহাসে লেখা থাকে? '
- ' আমি আমার লেখাপড়ার ইতিহাসের কথা বলছিলাম।'
- 'হুঁ, সেটা বলার দরকার নেই। মাথায় রাখো দার্জিলিং-এও কমলা হয় না ।'
- ' যা বাবা, দার্জিলিং-ও হয় না। তাহলে হয় কোথায়?'
- ' সিটং , কমলালেবুর উপত্যকা।'
- ' সিটং। শীতে টং হয়ে থাকে বুঝি?'
- 'ফালতু কথা কম বলো। যাবে নাকি?'
- ' যেতে পারি। '


কথা হচ্ছিলো স্ত্রীর এক বান্ধবীর সাথে। একে স্ত্রীর বান্ধবী তায় আবার সাউথ-পয়েন্ট থেকে পাশ করে কলিকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করা সুন্দরীর সাথে তর্ক করা চলে না। সুতরাং টিকিট কাটা স্থির হলো সবার সুযোগ সুবিধা বুঝে। টিকিট অবশ্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা দেখাচ্ছে। রেলের যে বন্ধু টিকিট কেটে দিয়েছে, সে আশ্বাস দিচ্ছে কোন চিন্তা নেই। গুগল বলছে প্রবল শীত সিটং-এ। সিটং(Sittong) বা সিতং গ্রামটি দার্জিলিং জেলার কার্শিয়াং মহকুমাতে অবস্থিত একটি লেপচা গ্রাম , এই সিটং এর উচ্চতা হল ৪০০০ ফিট। সুতরাং অকারণ কিছু শীতের পোশাক কেনা হলো। প্যাকেট করতে গিয়ে হিমশিম খেতে খেতে যে বস্তুটি শেষমেষ দাঁড়ালো, সেটিকে আলমারি বললে ঠিক হয়। সেই আলমারির মাল একটা বাক্সতে ঢুকিয়ে ফেলা জন্য আলাদিনের দৈত্যকে বোতলবন্দী করার প্রযুক্তির প্রয়োজন। যেহেতু সেই প্রযুক্তির জ্ঞান নেই, তাই বাদ পড়লো অনেক শীত পোশাক। সময় হুড়মুড় করে গড়িয়ে গিয়ে যাওয়ার দিনটি এসে গেল। সকাল থেকে তোড়জোড়। পাড়ার একটি ভাতৃপ্রতিম বন্ধু রাতের খাবার দেবে বলেছে। রাতের খাবার তো হলো কিন্তু ট্রেনের টিকিট কন্ফার্ম নয়। আমার বাল্যবন্ধু অবশ্য প্রত্যয়ী গলায় টিকিট হয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে। বিকাল সাড়ে তিনটে নাগাদ রেল কর্তৃপক্ষ থেকে ফোনে মেসেজ পাঠালো যে আমাদের টিকিট কন্ফার্ম হয়নি। মাথায় বাজ পড়ার মতো ব্যাপার। আমার স্ত্রীকে নিয়ে চারজন মহিলা যাচ্ছে। একজন আগে উল্লেখ করা স্ত্রীর বান্ধবী, অন্য দুজন সেই বান্ধবীর বান্ধবী। তবে একজনের তৎকালের টিকিট কন্ফার্ম আছে, কিন্তু অন্য তিনজন মহিলার কি হবে? রেল কর্মচারী বন্ধুকে ফোনে ধরলাম। সব হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিল সে। পনেরো মিনিট সময় চাইলো। ঘড়ি দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। সাতটা চল্লিশে ট্রেন। তখন প্রায় চারটে দশ বাজে। ফোন বাজলো। বন্ধুর ফোন এসেছে। ঝাঁপিয়ে ফোন ধরলাম। ওদিকে একটা ব্যর্থ বার্তা ভেসে এলো। কোটা পদ্ধতি নাকি কাজ করেনি, কিন্তু তারপরও প্রত্যয় কমে যায়নি আমার বন্ধুর। ট্রেন ছাড়ার একঘন্টা আগে পৌঁছে গেলেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে বন্ধুর এই প্রতিশ্রুতির ভরসায় বেরিয়ে পড়লাম। তার আগে রাতের বিপুল খাবার পৌঁছে দিয়েছে সেই পাড়াতুতো ভাই। লটবহর আর মাথায় এক ঝুড়ি টেনশন নিয়ে ট্রেন ছাড়ার অনেক আগেই শিয়ালদা স্টেশনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম । তার মধ্যে হোয়াটস্যাপে দুটো নাম্বার এসেছে বন্ধুর কাছ থেকে। শেষ নাম্বারটিতে ফোন করলেই নাকি মুশকিল আসান। উনি রণে, বনে, ট্রেনে সবকিছু বুঝে নেবেন। লোকটির নাম বিমলেস, আমি বিরলকেশ প্রবল আশায় বুক বেঁধে ফোন করলাম ট্যাক্সির থেকে নেমে। তেরো নম্বর তিনি প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন জানালেন। আমার স্ত্রীর বান্ধবীরা আগেই উপস্থিত। সবাইকে ভরসার হাত দেখিয়ে আমি বুক ফুলিয়ে এগিয়ে গেলাম তেরো নম্বর প্লাটফর্মের দিকে। ফোনে কথাবার্তা মোটামুটি এরকম -
-' হ্যাম তেরো নম্বর প্লাটফর্ম কা গোড়া মে হ্যায়। আপ কোথায় হ্যায়?'
-' গোড়া মতলব?'
-' সামনে নেহি সমস্তা '
- 'স্টেশন কি সুরুয়াদ মে। ওহী রুকো '


রুকে দাঁড়ালাম। দূর থেকে আমার দিকে চার রমণীর চোখ অনুসরণ করছে। সেই চোখে প্রবল সন্দেহ। আমার বন্ধু বলে দিয়েছে যিনি আসছেন তিনি রেল পুলিশে আছেন। সুতরাং খাকি পোশাক পড়া লম্বা লোক দেখলেই প্রবল উত্তেজিত হচ্ছি। হঠাৎ কানের গোড়ায় এক সরু কণ্ঠ -' আপ মুঝে ঢুন রাহয়ে থে?'
একজন আমার চেয়েও রোগা বেঁটে সাধারণ শার্ট-প্যান্ট পরা,গলায় লাল গামছা পড়া লোককে রেল পুলিশ বলে মেনে নেওয়া বড্ড মুশকিল। আমাকে ট্রেনে জেনারেল কম্পার্টমেন্টে তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোকটা এগিয়ে যাচ্ছিলো। আমি হাত ধরে থামালাম। এই মহিলাদের জেনারেল কম্পার্টমেন্টে তোলা তো দূর, এই কথা বললেও বোধহয় আমাকে রেললাইনে ফেলে ট্রেন চালিয়ে দেবার সম্ভবনা।


-'কোনোভাবেই অন্য ব্যবস্থা নেহি হ্যায়?'
লোকটা করুণ চোখে তাকালো। সেটা আমার বিশুদ্ধ হিন্দি শুনে নাকি ওর ক্ষমতার বাইরে বুঝতে পারলাম না। ইতিমধ্যেই মহিলাবাহিনী আমার উপরে ভরসা না করে কাছে এগিয়ে এসেছে।ট্রেন দিয়ে দিয়েছে প্লাটফর্মে। একটা থার্ড এসি কুপে একটাই কন্ফার্ম টিকিটের ভরসায় উঠে পড়লাম ট্রেনে, অবশ্য আমাদের টিকিটও থার্ড এসিতেই, শুধু কোন কুপ সেটা নির্দিষ্ট নয়। টিটি সাহেব আসলেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিল গলায় লাল গামছাধারী পুলিশ। বিরহিনী রাধার মতো টিটি সাহেবের জন্য প্রতীক্ষা শুরু হলো। পাশে এসে দাঁড়ালো স্ত্রীর বান্ধবী সুস্মিতা। তারও চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। তিনজন মহিলা ট্রেনের ভিতরে মাল সামলাচ্ছে। ভীষণ টেনশন। ট্রেন ছাড়ার মিনিট দশেক আগে টিটি সাহেব আবির্ভূত হলেন। পিছনে ফিরে দেখি লাল গামছা উধাও। অগত্যা আমি আর সুস্মিতা দুজনেই উদ্যোগী হলাম। টিটি সাহেবকে বলতেই তিনি একটা মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করলেন। আমি বন্ধুকে ফোন করে টিটি সাহেবকে ধরালাম। বন্ধুর কথা বিশেষ পাত্তা পেলো না, টিটি আমাদের ছেড়ে এগিয়ে গেলেন সামনে। এদিকে ট্রেন ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। দৌড় দিয়ে আমি আর সুস্মিতা ট্রেনে উঠলাম। একটা সিট আর পাঁচটা মানুষ। বন্ধুকে ফোন করলাম আবার।
 
বলল বর্ধমান থেকে একজন রেল কর্মচারী উঠে সব ব্যবস্থা করে দেবে। পাশ থেকে একজন সহযাত্রী জানালো এই ট্রেন বর্ধমান দিয়েই যাবে না। বন্ধুকে আর ফোন করিনি। যা বুঝতে পারার সেটা ততক্ষনে বুঝে গেছি। সবাই মুখ কালো করে বসে আছে, শুধু সুস্মিতা বলে যাচ্ছে বি-পজেটিভ। নিজের রক্তের গ্রুপ বলছে কিনা কে জানে। এবারে আমি আর সুস্মিতা রেল-এটেন্ডেন্টদের ধরলাম। নগদ দু'হাজার বিনিময়ে বাথরুম লাগোয়া বালিশ কম্বল রাখার দুটো বক্সে দুজন মহিলাকে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে বলে আশ্বাস দিল ছেলেটি। দুজন মহিলা একটা কন্ফার্ম সিটে একটু কষ্ট করে শুয়ে যাবে আর আমার জায়গা হলো একদম বাথরুম সংলগ্ন ছোট জায়গা। তখন অবশ্য সেটাই অন্ধকারে আলোর রেখার মতো। রাত দেড়টার সময় টিটি সাহেব আবার আবির্ভূত হলেন। দুটো কুপ পরে একটা সিট নাকি ফাঁকা পড়ে আছে সেখানে একজন মহিলার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। হঠাৎ করে ডিয়ার লটারীর প্রাইজ লেগে যাবার মতো ব্যাপার। আরও আশ্চর্য বিষয় টিটি সাহেবকে কোন টাকা দিতে হবে না। এ যেন আমাদের সামনে দিয়ে যেন স্বয়ং বজরংবলী সীতাকে উদ্ধার করে অযোধ্যার দিকে সরি সিটের দিকে নিয়ে গেলেন। আমরা সবাই একটু নিশ্চিত হয়ে চোখ বুজলাম। রাত তিনটে নাগাদ পায়ের কাছে ধপ করে কি যেন পড়লো। আঁতকে উঠে বসলাম । যে মহিলাকে উদ্ধার করে টিটি সাহেব নিয়ে গিয়েছিলেন, মালদা থেকে সেই সিটে বুকিং ছিল, সুতরাং আবার ‘পুনঃ মুষিক ভবঃ’ এবং সেই নারী ক্ষীণতনু নন, সুতরাং…। 
বাকি দুজনও বাক্সের ডালা সরিয়ে উঁকি দিল। চারজন অগত্যা আড্ডা মেরে রাত কাবার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। অবশ্য উপায়ই বা কি? ভোরের দিকে সিটচ্যুত নারী দুঃখের সুরে গেয়ে উঠলো - ‘একটা সিট্ দে, মা / শুয়ে পড়ি / হরি হরি / কি যে করি / একটা সিট্ দে মা… ইত্যাদি। এটেন্ডেন্ট লাফ দিয়ে ওঠায় সে গান থামলো। আস্তে আস্তে ভোর হচ্ছে। সকাল ছ’টা নাগাদ কিছু সিট্ খালি হয়ে গেল। তিনজন মহিলাকে ভিতরে জায়গা দেওয়া গেল। আমি বালিশ কম্বলের বাক্সে ঢুকে পড়লাম। ট্রেন একটু লেট্ চলছে। বক্সের ভিতরে প্রবল ঝাঁকুনি, মনে হচ্ছে আমার বাড়িতে আগুন লেগে গেছে বলে কেউ আমাকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করছে। সবচেয়ে বড় কথা কি একটা যেন গায়ে ফুটছে মাঝে মাঝে। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দেখি বাক্সের ডালার সামনে সারমাইকা স্কু দিয়ে লাগানো হয়েছে এবং সেই স্কুর অসংখ্য ছুঁচুলো অংশ বক্সের ভিতর দিকে বেরিয়ে আছে। হাতে আলো ফেলে বুঝলাম, অল্পবিস্তর হাত কেটেছে। তার মানে দু’জন মহিলাও হাত-পা কেটেছে। রিস্ক না নিয়ে জয় মা কালী বলে বাক্স থেকে বেরিয়ে এলাম। চারিদিকে ঘন কুয়াশা। চা-কফি বলে হেঁকে যাচ্ছে ফেরিওয়ালা। প্রায় বিনিদ্র রাত কাটিয়ে আমরা অপেক্ষায় আছি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছনোর। মোটামুটি সাড়ে সাতটা নাগাদ আমদের শাপমুক্তি ঘটলো। হালকা রোদে আর ঝাপসা কুয়াশায় ভেজা স্টেশনে আমরা সবাই গভীর শ্বাস টেনে প্রস্তুত হলাম পাহাড়ের কোলে যাবার জন্য।

                       (২)

 নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে সিটং এবং তার পাশাপাশি অঞ্চলে ঘুরে দেখাবার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছে সুস্মিতা। স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই একটা সাদা টয়োটা ইনোভা গাড়ি এসে উপস্থিত হলো। ড্রাইভার ছেলেটি ভারি চটপটে। নাম অতীশ প্রধান। সুস্মিতা আর তার দুই বান্ধবী তিনটে আলমারি নিয়ে এসেছে বললে ঠিক বলা হয়। সেই গন্ধমাদন তোলা হলো গাড়ির উপরে। আমাদের দুটো ছোট সুটকেস আর টুকিটাকি উঠল ডিকিতে। সুস্মিতা যেহেতু ব্যবস্থাপনায় প্রধান চরিত্রের ভূমিকায় তাই সে ড্রাইভার প্রধানের পাশে বসলো। তিন নারী পরের সিট্ দখল করলো আর আমি গোবেচারা মানুষকে ঠেলে দেওয়া হলো শেষ সিটে, সঙ্গে চার নারীর হাতের ব্যাগ, বেশ কিছু জলের বোতল, শুকনো খাবারের ব্যাগ। একেই কোনঠাসা অবস্থা বলে। শিলিগুড়ি শহর জ্যাম পেরিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি। ট্রেনের মধ্যে রাতে খাওয়ার পরিবেশ ছিল না, যদিও আমার পাড়াতুতো ভাইয়ের খাবারের স্বাদ অসাধারণ ছিল। খিদে পাচ্ছে সবার সুতরাং গাড়ি পাহাড়ে কিছুটা উঠে একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্টে দাঁড়ালো। ভেজ-মোমো আর থুপ্পা অর্ডার হলো। কারণ জানি না, তবে এই ধরণের খাবারের স্বাদ এইসব পাহাড় ঘেরা জায়গায় অতুলনীয় হয়, এবারেও তার ব্যতিক্রম হলো না। খাবার খেয়ে মহিলাকুলের ছবি তোলার উৎসব চালু হলো। গোবেচারা আমাকে ফটোগ্রাফার হিসাবে পাকড়াও করে সেই উৎসব চলল কিছুক্ষণ।


উৎসব শেষে আমরা চললাম ‘চিমনি হেরিটেজ পার্ক’। ৭২০০ ফিট উপরে অবস্থিত একটা পার্ক যেখানে একটা ২৩ ফিট উঁচু একটা ইটের তৈরী চিমনি দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে। ১৮৩৯ সালে একটা ব্রিটিশ বাংলো ছিল। কালের প্রভাবে বাংলোটি মিশে গেছে মাটিতে, শুধু ঔদ্ধত্য নিয়ে বেঁচে আছে এই চিমনিটি। পার্কের ডানদিকে একটা সরু রাস্তা উঠে গেছে। একটু এগিয়ে গেলেই ১৮০ ডিগ্রী পানোরমিক লুক। দূরে কুয়াশায় ঈষৎ ঝাপসা রহস্যময়ী কাঞ্চনজঙ্ঘা। অসীম স্তব্ধতাতে ভেসে আসছে এক অজানা পাখির ডাক।
পরের গন্তব্য ডাউ হিল চার্চ। এই চার্চটি ভুতুড়ে বলে বিশ্বাস করে স্থানীয় লোকজন। সামনের রাস্তায় রাতে কেউ বেরোয় না। রাস্তার নাম ডেথ-লেন অর্থাৎ মৃত্যু রাস্তা। অসংখ্য গল্প ভেসে বেড়ায়, তারমধ্যে একটা গল্প হচ্ছে গির্জার পাশের স্কুলে নাকি কয়েকটি বাচ্চা অস্বাভাবিক ভাবে মারা যায়। তারপর থেকেই নাকি ওই রাস্তায় বাচ্চাদের হাসি, কোলাহল শুনতে পাওয়া যায় কিন্তু কোন বাচ্চাকে দেখা যায় না। হালকা কুয়াশার রহস্যময়তা ঘিরে রেখেছে এলাকা। এবারে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি হোমস্টের দিকে। ড্রাইভার প্রধান গাড়িতে নেপালি গান চালিয়েছে। কার্শিয়াং শহরের রঙীন বাড়িগুলোকে পিছনে ফেলে আমাদের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে ‘উডস এডভেঞ্চার ক্যাম্প’ নামক হোমস্টের দিকে। গাড়ি থেকে যেখানে নাবলাম, সেই জায়গা থেকে পায়ে হেঁটে চা-বাগানের ভিতর দিয়ে উঠতে হবে কিছুটা। মালপত্র নিয়ে যাবে হোমস্টের কর্মচারীরা। বেশ কিছুটা চড়াই ভেঙে হোমস্টেতে পৌঁছেই মন ভালো হয়ে গেল। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা শান্ত নির্জন একটা জায়গা। চান সেরে কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা মধ্যাহ্নভোজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, যদিও ঘড়ির কাঁটা সাড়ে তিনটে পেরিয়েছে। গরম ভাত, ডাল, একটা ঘ্যাট-তরকারি, আর ডিম কষা হচ্ছে মেনু। পাহাড়ের কোল বেয়ে কুয়াশা মেখে ছায়ারা দীর্ঘ হচ্ছে আস্তে আস্তে। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ চিকেন পকোড়া আর চা এলো। চা পর্ব শেষে মহিলাকুল লুডু নিয়ে বসলো। আমি বারান্দায় এসে বসলাম। সামনে বনফায়ার জ্বলছে। দূরে আলোর মালা গেঁথে কার্শিয়াং শহর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমি রান্নাঘরের দিকে চললাম। রান্নাঘরটি হোমস্টের একদম লাগোয়া নয়। একটা অস্থায়ী টিন আর কাঠের তৈরী কাঠামো। গ্যাসে রাতের খাবার তৈরী হচ্ছে আর একটু পাশে কাঠের আগুনে শরীর গরম করছে ড্রাইভার প্রধান, সঙ্গী হোমস্টের দুজন কর্মচারী। চিরশহুরে আমি আর পাহাড়ী সরল মানুষের আড্ডা জমে গেল। পাহাড় থেকে ভেসে আসছে প্রবল ঠান্ডা হাওয়া । নতুন বন্ধুদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছি স্কটল্যান্ডের তরল কম্বল। রোমান্টিক নেপালি গান বাজছে। সুর আর খাবারের গন্ধ ভাসছে শীতল হাওয়ায়। একটু পরেই শুরু হবে ডিনার।

                      (৩)

তখন ভোর পাঁচটা। ঘরের পর্দা সরিয়ে দিতেই আমার মতো ঘুমকাতুরের ঘুম ছুটে গেল। অপরূপা কাঞ্চনজঙ্ঘা তাঁর সব সৌন্দর্য মেলে তাকিয়ে আছে। সেই স্বর্গীয় ভোরে কোথাও কোন শব্দ নেই। শুধু দূর থেকে একটা অচেনা পাখি মিষ্টি সুরে ডেকে চলেছে। একটা বর্ণনাহীন মুগ্ধতাতে আমরা সবাই চুপ করে তাকিয়ে আছি।
সকাল সাড়ে আটটার সময় ব্রেকফাস্ট করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। নামথিং পোখরি আমাদের প্রথম গন্তব্য। পোখরি শব্দের অর্থ পুকুর। অবশ্য শীতে সেই পুকুরের কোন অস্তিত্ব নেই। ঘন পাইন বনের পাশ দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ উঠে গেছে উপরে। সেই পথ কিছুটা ওঠার পরে দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। বাঁদিকে 
সিঙ্কোনা গাছের চাষ হচ্ছে, আর একটা রাস্তা উঠে গেছে উপরে শিব মন্দিরের দিকে। শান্ত নিরিবিলি জায়গাটা। প্রণাম সেরে নেবে এলাম নিচে। এবারে গাড়ি ছুটলো অহলধারা ভিউ পয়েন্টে । একদিকে ডুয়ার্স, সঙ্গে ৩৬০ ডিগ্রি প্যানোরামিক দৃশ্য , অন্যদিকে কালিম্পং, দার্জিলিং এবং সিকিম। পাহাড়ী বাজ উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে ভেজ মোমো দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে ফেললাম। এবারে রওনা দিলাম সিটং এর মূল আকর্ষণ কমলালেবুর বাগানের উদ্দেশ্যে। জনপ্রতি পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে কমলা বাগানে ঢোকার অনুমতি পাওয়া গেল। অবশ্য গাছ থেকে লেবু তোলা বারণ। সারাজীবন ঝুড়িতে দেখা কমলালেবু গাছে ঝুলে আছে। জানুয়ারি শেষে এই কমলালেবু পরিপক্ক হয় । কমলালেবু বাগানের পাশ দিয়ে ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। বাগানের মালকিন একটা কমলালেবু তুলে দিলেন। এখনো সম্পূর্ণ পরিপক্ক হয়নি, কিন্তু স্বাদ তুলনারহিত। আমাদের আজকের সফর শেষ হবে লেপচা মনেস্ট্রি দিয়ে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের ‘লাত্সুন নামকা জিগমে’ নামক একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তিব্বত থেকে সিকিম পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিলেন এবং সিকিম ও দার্জিলিং অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। লেপচা জনজাতি আরধ্য দেবতাকে বলেন ‘গুরু লুম্বু ছে’, যদিও স্থানীয় লোকের মুখে বলা এই নাম আমি কোন বইয়ে খুঁজে পাইনি। মূল মনেস্ট্রির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। একটা ছোট মনেস্ট্রি পিছনে তৈরী করা হয়েছে। একটা লেপচা পরিবার সেটার রক্ষণাবেক্ষণ করেন। ভীষণ হাসিখুশি মহিলারা আমাদের তিনটে ‘স্কোয়াশ’ উপহার দিলেন। আমরাও কিছু টাকা দিলাম মনেস্ট্রির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। 
মোটামুটি দ্বিতীয় দিনের ভ্রমণ শেষ। নারীকুল আকুল হয়ে ছবি তুলছে এবং নিরীহ গোবেচারা আমাকে ধরে ছবি তোলাচ্ছে। আমাদের মধ্যাহ্নভোজ এখনো বাকি। ড্রাইভার প্রধান গাড়িতে উঠে আসার জন্য তাড়া দিচ্ছে।                                         

                     (৪)

অনুষ্ঠান কিংবা বেড়াতে বেরোলেই ইদানিং তরলে নিমজ্জিত হয় বাঙালী। এই তরলকৃত ব্যক্তিত্ব মাঝে মাঝেই বিপত্তির সৃষ্টি করে। সাড়ে আটটা নাগাদ আগের দিনের মতোই নতুন পাহাড়ী বন্ধুদের সাথে নিজেকে গরম করছিলাম রান্নাঘরে। আড্ডার মাঝে এক তরল নব্যবাবু হাজির হলেন। শুরুই হলো তুই তুকারি দিয়ে।
-‘ তোদের তো সাড়ে নয়টা খাবার দেবার কথা? এত দেরি হচ্ছে কেন?’- স্খলিত কণ্ঠে বললেন তিনি।
-‘স্যার, এখন তো ন’টা বাজে।’- নেপালি রাঁধুনি ভীষণ বিনয়ের গলায় বলল।
-‘আবার তক্কো করছিস?’
- না স্যার, আধঘন্টা পরে দেবো খাবার।
- কেন? সাড়ে নটায় খাবার দেবার কথা!!
বুঝতে পারছি তরল কম্বলের আধিক্য অংকের অম্বল পাকিয়ে দিয়েছে।
আমিই বাধ্য হয়ে আসরে নাবলাম।
‘ দাদা কি আজকেই এলেন নাকি এখানে?’
‘কে রে তুই ?’
‘ সেরকম কেউ নই। বেড়াতে এসেছি এখানে। আপনি কোথা থেকে এসেছেন?’
‘কলকাতা থেকে এসেছি।’
‘ ও কলকাতা থেকে? কলকাতায় কোথায় থাকেন?
‘ বসিরহাট’
‘ও আচ্ছা, একেবারে মধ্যকলকাতা!!’
‘তুই কি করিস?
‘সেরকম কিছু বলার মতো নয়। কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করি।’

সঙ্গে সঙ্গে মাতাল কিরকম ভেবলে গেল। ‘সরি স্যার, সরি স্যার’ - বলতে বলতে চলে গেল আপদটা। আমি আবার ফিরে গেলাম আমার নতুন সঙ্গীদের কাছে। কালকে আমরা আলাদা হয়ে যাবো। পাহাড়ী রাস্তায় ড্রাইভার প্রধান গাড়ি চালিয়ে যাবে আর আমি আটকে থাকবো কলকাতার জ্যামে। স্মৃতির ঝড়োকাতে আটকে থাকবে এই দুটো রাত। আমরা সবাই একসাথে চিয়ার্স বলে উঠলাম।

                      (৫)

সকাল হলো। রূপসী কাঞ্চনজঙ্ঘা তাঁর অপরূপ মহিমায় বিদ্যমান। চান সেরে ব্রেকফাস্ট পর্ব শেষে আমরা নেবে আসবো সমতলে। আমাদের হলুদ রঙের রেশমি কাপড়ের টুকরো গলায় পড়িয়ে বিদায় দিল হোমস্টের কর্তৃপক্ষ। শিলিগুড়িতে আসার পথে পড়বে রবি ঠাকুরের মংপু। ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ী দেবীর আমন্ত্রণে প্রথম আসেন মংপুতে। সেবারে কবি এসেছিলেন কালিম্পং থেকে। মৈত্রেয়ী দেবী বিয়ের পরেই স্বামী ডঃ মনোমোহন সেনের সঙ্গে চলে আসেন মংপু। ভারতে প্রথম কুইনাইন বড়ি তৈরির কারখানা স্থাপিত হয় এই মংপুতে ১৮৬৪ সালে। মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী মনমোহন সেন ছিলেন এখানে কর্মকর্তা এবং কারখানার প্রবেশপথের উল্টো দিকেই ছিল তাঁর বাংলো। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে চারবার এ বাংলোতে এসে বাস করেছেন। ১৯৪০ সালে শেষবারের মতো জন্মদিন উপলক্ষে এখানে বসেই তিনি রচনা করেন ‘জন্মদিন’ নামের কবিতাটি এবং এটি কলকাতা রেডিওতে সরাসরি প্রচারের জন্য তিনি কালিম্পং থেকে টেলিফোনে কবিতাটি আবৃত্তিও করেন। মৈত্রেয়ী দেবী ‘‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ” বইয়ে বিশ্বস্ত লিপিকরের মতো ধরে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথের দিনলিপি ও প্রতিটি কথাবার্তা। যতই মনে পড়ছে এই লেখা, ততই উত্তেজিত হয়ে পড়ছি। 


কাঞ্চনজঙ্ঘা কখনো দৃশ্যমান, আবার সে লুকিয়ে পড়ছে পাহাড়ের আড়ালে। আমাদের গাড়ি এসে থামলো মংপুতে। সামনে কিছুটা খোলা জায়গা, কিন্তু মূল ফটক বন্ধ। তাহলে কি সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ? জানা গেল, অবাধ প্রবেশ কিন্তু বৃহস্পতিবার বন্ধ, আর আজকে বৃহস্পতিবার। সুখস্বপ্ন ভেঙে গেলে যে কষ্ট আমাদের সবার মুখে। কিন্তু উপায়ই বা কি? আমাদের ফিরে যেতেই হবে। 


রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া এবারে আমাদের ভাগ্যে নেই। ভাঙা মন নিয়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম। সন্ধ্যাবেলায় ট্রেন ছাড়বে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে। আমরা ফিরে যাবো আবার দূষিত শহরের বুকে। নাকে টেনে নেবো কার্বন। আমাদের গাড়ি দ্রুত নেমে আসছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছে অনেক আগে।


 




একদিনের ব্যাণ্ডেল ভ্রমণ

শ ম্পি তা  রা য়

আমাদের পশ্চিমবঙ্গে এমন অনেক জায়গা আছে যেগুলো কলকাতা থেকে একদিনে ঘুরে আসা যায়।আমাদের পরিবারের কয়েকজন মিলে এরকম অনেক জায়গায় মাঝে মাঝে ঘুরতে যেতাম। সেইরকমই একটি জায়গার গল্প আজ আপনাদের বলব।জায়গাটি? ধৈর্য্য ধরুন বলছি।এই জায়গায় একই সঙ্গে খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মাবলীদের দ্রষ্টব্য স্থান - একটি চার্চ ও অপরটি  ইমামবাড়া। এবার নিশ্চয়ই বুঝেছেন জায়গাটি কোথায়। হ্যাঁ, এটি হুগলির ব্যান্ডেল শহর। আমরা পরিবারের পাঁচ জন মিলে ব্যান্ডেল গিয়েছিলাম আগস্ট মাসে। হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে সকাল ৮ টার সময় পৌছালাম ব্যান্ডেলে। স্টেশন থেকে একটা টোটো রিসার্ভ করলাম সারাদিনের জন্য। 


প্রথমেই কচুরি মিষ্টি দিয়ে পেট পুজো করে গেলাম ব্যাণ্ডেল চার্চে।আমাদের অত সকালে ব্যান্ডেল চার্চ যাওয়ার একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এই চার্চে একমাত্র বাংলায় প্রার্থনা ও কয়ার বা প্রার্থনা সঙ্গীত হয় বলে শুনেছিলাম। প্রার্থনার সময় আমাদের ঢুকতে দেয়নি খৃস্টান নই বলে, কিন্তু মাইকের মাধ্যমে  গান শুনতে পেয়েছিলাম। এবার একটু ইতিহাসের পাতা উল্টানো যাক।১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজরা হুগলি নদীর তীরে একটি বন্দর ও দুর্গ নির্মাণ করে। পরের বছর এরা সম্রাট আকবরের অনুমতি নিয়ে এখানে গির্জা নির্মাণ শুরু করে। পরবর্তী কালে এই গির্জা ভস্মীভূত হয়ে যায়। পরে এটি আবার নির্মাণ করা হয়। এখানে এখনও পুরোনো গির্জার ভিত্তি প্রস্তরটা দেখা যায়। আমরা মাঠ পেরিয়ে গির্জায় ঢুকলাম। অপূর্ব এর নির্মাণ শৈলী। এখানে কয়েকটি সমাধি প্রস্তর , তিনটি বেদি,মেরি মাতার একটি মন্দির আছে। 


এছাড়া জাহাজের একটি মাস্তুল গির্জার সামনে এ দাঁড় করানো আছে। গল্প আছে যে কোন ডুবন্ত জাহাজকে মাতা মেরি বাঁচিয়েছিলেন,তাই সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন এটি গির্জা কে দান করেন। আমরা সবাই চার্চের ছাদে বসে ছিলাম ।মেঘলা আকাশ আর বৃষ্টি ভেজা হাওয়ায় ওখানে বসে চার্চের প্রার্থনা সঙ্গীত শুনতে খুব ভালো লাগছিল।


উঠতে ইচ্ছে করছিল না। এরপর আমরা গেলাম বড়া ইমামবড়া দেখতে। টোটো করে যেতে বেশিক্ষণ লাগলো না। আমরা বেশ গল্প করতে করতে পৌঁছে গেলাম এই খানে। চারিদিক বেশ শুনশান। বড় গেট দিয়ে ঢুকলাম ইমামবড়ার ভিতরে। এই স্থানটি শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের। মুহম্মদ মহসিনের কথা আমরা ইতিহাসে পড়েছিলাম। উনি এই ভবনটি নির্মাণ করান। ভিতরেও লোক প্রায় নেই বললেই চলে। একজন আমাদের গেটের পাশে ঘড়ি টাওয়ারটি দেখাল। অনেক গুলো সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলাম। বাপরে কি বড় একটা ঘড়ি। এই ঘড়ির দুটো কাঁটা আছে আর তার সাথে তিনটে ঘণ্টা। ছোট ঘন্টাটা পনেরো মিনিট অন্তর বাজে। বাকিগুলোরও  হিসাব আছে,কিন্তু আমি সেটা ভুলে গেছি। কিন্তু আমার তাক লেগে গেছিল ঘড়ির চাবিটা দেখে, প্রায় কুড়ি কেজি ওজন।দুজন লোক আছে যারা এই চাবি ঘুরিয়ে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে দেয়।ইসস আমাকে এই চাকুরি সেধে দিলেও করতে পারব না। চাবিটা তুলতেই পারব না। এই সব ঠাট্টা তামাশা করতে করতে টাওয়ার থেকে নেমে ভবনের পিছনের দিকে গেলাম। এখানে হুগলি নদী বয়ে যাচ্ছে। জায়গা টা গাছপালায় ঢাকা, বেশ মনোরম। ভবনটির পিছনের দিকের দেওয়াল জুড়ে কোরান এর বাণী খোদাই করা, যেটা নদী থেকেও দেখা যায়। আর একটি দারুণ জিনিস আছে, সেটা হলো সূর্য ঘড়ি। আমরা নিজেদের ঘড়ি মিলিয়ে দেখেছি সময় একদম ঠিক দেখাচ্ছিল। ইমামবাড়ার ভিতরে একটি ঘরে মুহম্মদ মহসিনের ব্যবহৃত আসবাবপত্র ছিলো। এইখানে বারান্দার ছায়ায় খানিকক্ষণ বসে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম হংসেশ্বরী মন্দিরের উদ্দেশ্যে। দেবী হংসেশ্বরীর মন্দিরে পৌঁছে প্রথমে গেলাম দেবী দর্শনে। মন্দিরে গুণে দেখলাম তেরোটি মিনার আছে। প্রতিটি মিনার প্রস্ফূটিত পদ্ম ফুলের মত। দেবীও একটি পদ্মের বেদির উপর প্রতিষ্ঠিত। শায়িত শিব ঠাকুরের নাভি থেকে নির্গত হয়েছে এই পদ্মটি। খুবই অপূর্ব এই দেবী মূর্তি। শুনলাম এই মন্দিরটি রাজা নৃসিংহ দেব শুরু করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা পত্নী রানি শঙ্করী সম্পূর্ণ করান। এই মন্দিরের পাশেই ছিল অনন্ত বসুদেবের মন্দির। যার টেরাকোটার কাজ অপূর্ব। এই দুটি মন্দিরই এখন পুরাতত্ত্ব বিভাগ সংরক্ষণ করে। এই মন্দিরের পরিবেশও বেশ শান্ত ও নিরিবিলি। 


একটা জিনিষ ব্যান্ডেল এ এসে লক্ষ্য করলাম যে সব কটি দর্শনীয় স্থানই বেশ শান্ত যা এগুলোর স্থান মাহাত্ম্য বাড়িয়ে দিয়েছে। এরপর আমরা চা ও তারসাথে কিছু খেয়ে গেলাম যোগ গুরু শ্রীশ্যামাচরণ  লাহিড়ীর নামাঙ্কিত লাহিড়ী বাবার আশ্রম দেখতে। এই বিশাল আশ্রমে কোন প্রবেশ মূল্য নেই।  গেটের পরেই জলের উপর ব্রিজ করা আছে, যা দিয়ে মূল মন্দিরে ঢুকতে হয়। এই জায়গাটা অনেকটা স্বর্ণ মন্দিরকে মনে করায়। এখানে পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে চারপাশ সাজানো হয়েছে। বিশাল জায়গা জুড়ে প্রচুর আম গাছ,ফুল গাছ ভরে আছে।


মন্দিরের স্থাপত্য দক্ষিণ ভারত ও রাজস্থানের মন্দিরের মিশ্রণে তৈরি। প্রধান মন্দির ছাড়াও লোকনাথ বাবা,শিব ও নারায়ণের মন্দিরও এখানে আছে। প্রতিটি মন্দিরই দৃষ্টিনন্দন। লাহিড়ী বাবার আশ্রম থেকে আমরা ফিরে চললাম স্টেশনের উদ্দেশ্যে। পিছনে পরে রইলো একটি ঐতিহাসিক প্রাচীন শহরের স্মৃতি। এই আমার ভারত বর্ষ। যেখানে একই জায়গায় সব ধর্মের মিলন দেখা যায়। আমরা একই দিনে হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিষ্টান ধর্মের দর্শনীয় স্থান গুলো দেখলাম। বর্তমান ভারতবাসী যেনো এই ভাবেই মিলেমিশে থাকে, তবেই ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।




 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪