প্রবন্ধ
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা
প্র ল য় ব সু
মানবতাবাদী সাধক লালন ফকির তাঁর অজস্র ভক্তিবাদী সুরসাধনায় মানব জীবনের নানা আঙ্গিক এই গানে ফুটিয়ে তুলেছেন যে দর্শন তা যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। ছয়শোর বেশি এই দেহতত্ত্বের গানের রচয়িতা সুফি দার্শনিক মানুষের উৎস আর তার উদ্দেশ্য সন্ধান করতে গিয়ে মন, আত্মা সবকিছুর ধারক বাহক দেহকেই এই দেহতত্ত্বের গানগুলিতে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। আরবিতে সুফি শব্দটির অর্থ পশম বা পবিত্রতা। সুফিরা পশমের আচ্ছাদন বা কম্বল ব্যবহার করতেন। সুফি মতবাদ কোরানের গুপ্ত ঐতিহ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। দেহের মধ্যে খোদা আছেন, তাঁকে জানার সাধনায় গড়ে ওঠে সুফিদের দেহসাধনার সংস্কৃতি।
লালনের গানে একটা কলি আছে “… আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা/ মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা …”। সেই নয় দরজা, মানে দেহ যেখানে উন্মুক্ত হয়েছে সেখানেও অণুজীবের সাবলীল বসবাস। ভাবলে অবাক লাগে আমরা দেহকে ক্রান্তীয় বাদল বনের (রেইন ফরেস্ট) সাথে তুলনা করতে পারি আর তাতে বসবাস করে এক আকাশ ব্যাক্টিরিয়া, ছত্রাক, জীবাণু। যদি দর্শন চিন্তার বাইরে গিয়ে শুধু বিজ্ঞান মনষ্কতার দিক থেকে ভাবি তাহলে ত এভাবেও ভাবাই যায়।
এবারে আসা যাক শুধু মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির দৃষ্টিকোণ থেকে – বহুগামিতা।
প্রকৃতিগতভাবে মানুষের মধ্যে বহুগামিতা আছে। সামাজিক বিধিনিষেধ এই প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। কাক্ষিত সকল গুণের সমাহার কোনো একক মানুষের মধ্যে পাওয়া অসম্ভব। এই অপূর্ণতা, অপ্রাপ্তি থেকে বহুর প্রতি আকর্ষণ – সে শরীর হোক মনের। আবার বয়স, অভিজ্ঞতার সাথে ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন আসে, চাহিদা বদলায়। পুরনো সম্পর্কে শিথিলতা, একঘেয়েমি, উত্তেজনাহীনতা, মোহহীনতা মানুষকে নতুনের সন্ধানী করে তোলে বৈচিত্র্যের নেশায়; গড়ে ওঠে নতুন সম্পর্ক। কেউবা পুরোনো সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলে কেউ বা তা পারে না - টানাপোড়েনে দ্বিখণ্ডিত হয়। তবু পরিণতির কথা না ভেবে সমান্তরালে চালিয়ে যায় একাধিক সম্পর্ক। ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলে ভাল আর না পারলে পিছিয়ে পড়া কারণ অনেক অনুঘটকের সমন্বয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে, যা মানসিক চাপে পরিণত হয়, দীর্ঘ মেয়াদে জটিলতার জন্ম দেয়। কিন্তু মানুষের মন তো সরলরৈখিক নয়, তাই ফুলকির জায়গা তো থেকেই যায়। আবার যদি এই ধরণের সম্পর্ক যদি শুধু শরীরগন্ধী না হয়ে পারস্পরিক মানসিক নির্ভরতা বা ভাবের আদানপ্রদানের মাধ্যম হয় তাকে অসুস্থ ভাবার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণও হয় না, বরং তা ঋদ্ধতার লক্ষণও হতেই পারে। এক্ষেত্রে সম্পর্কের শীর্ষ বিন্দুগুলির অবস্থান, তাদের কৌণিক দূরত্ব ও গুরুত্ব মূল প্রণিধান যোগ্য। পরিশেষে নিজেকে যুক্তিগ্রাহ্যভাবে স্বচ্ছ অনুভব করা সবচেয়ে জরুরী।
নারী পুরুষের প্রথাগত সমস্ত ধারণাই আসলে কেমন এলোমেলো, আবার এর মধ্যে জটিলতার বিষয় জেন্ডার এন্ড ডিসক্রিমিনেশন। তবে শুধুমাত্র জেন্ডার, যৌনতা, দেহতত্ব এসবের দার্শনিক ধাক্কায় সামজতত্ত্ব, বিধিনিষেধ এগুলোকে উড়িয়ে দেওয়াও যায় না।
প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায় বিখ্যাত লোকশিল্পী গগন হরকরার রচনা – “আমি কোথায় পাব তারে / আমার মনের মানুষটারে”। ওনার প্রভাব তো স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের লেখা “আমার সোনার বাংলা” গানে বা “ডাকঘর” গল্পে বড্ড সুস্পষ্ট। আসলে এই সুফিয়ানা বা বাউল ভাবনা প্রচলিত সমাজ ধারণার থেকে অনেক মুক্ত, উচ্চমার্গীয়, তাই আমরা সবসময় একে পূর্ণমাত্রায় নিরূপণ করে উঠতে পারি নি। শুধু সুফিবাদ কেন পদাবলী সাহিত্যের দিকেও নজর ফেলা যায়। কবি বিদ্যাপতির ভাষায় –
“কুশিল শত শত পাত-মোদিত
ময়ূর নাচত মাতিয়া।
মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী
ফাটি যাওত ছাতিয়া ||
তিমির দিগ্ভরি ঘোর যামিনী
অথির বিজুরিক পাঁতিয়া।
বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়বি
হরি বিনে দিন রাতিয়া ||”
যদি রাধাকৃষ্ণের দৈবিক সত্ত্বাকে ভুলে শুধু লৌকিক গুণাবলীর দিকে মনোনিবেশ করি তাহলে এই মাথুর পর্যায়ের মৈথিলী কবির ভাবনায় ঘোর বর্ষার দিনে প্রিয় অভিসারে বিরহিনী নারীর হৃদয় ব্যাকুল। কিন্তু প্রাণপ্রিয় শ্রীকৃষ্ণ মথুরাপ্রবাসী, প্রিয় মিলনের কোনো সম্ভবনা নেই। অথচ বর্ষার আগমনে দাদুরী আর ডাহুকির উল্লাসের সীমা নেই তারা তাদের প্রিয়জনকে মিলনে আহ্বান জানাচ্ছে । তাদের এই আহ্বান রাধার হৃদয়বেদনাকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে । সবাই প্রিয়সান্নিধ্য লাভ করবে, আর রাধাই শুধু বিরহতাপিত বক্ষে কালাতিপাত করবে - ভাবতে গিয়ে রাধার হৃদয় দীর্ণ হয়ে যাচ্ছে । অথচ এঁরা উভয়েই বিবাহিত।
শুধু প্রাচ্য কেন? যদি চলে যাই মিশরীয় সভ্যতার নাসের হ্রদের তীরে দ্বিতীয় রামাসিস কলোম্বাকে তাঁর প্রেমে পড়তে নিষেধ করেন কারণ তার কোনো পরিণতি ছিল না, যদিও প্রেম তাতে বাধা মানে নি কিংবা তৃতীয় পারস্য সম্রাট দারায়ুসের অন্দরমহলেও তো এই একইরকম চিত্র খুঁজে পাব। দারায়ুসের মা সিসিগাম্বিসের সঙ্গে আলেকজান্ডারের শ্রদ্ধাপূর্ণ অকৃত্রিম বন্ধুত্ব ছিল। অথচ তাঁর স্ত্রী স্টেটিরা অ্যালেকজান্ডারকে বিবাহ করেন যুদ্ধে হেরে দারায়ুস ওনাদের ফেলে চলে গেলে। ঐতিহাসিক প্লুটারকের মতে, ৩৩২ খ্রীস্টপূর্বাব্দের প্রথম দিকে স্টেটিরা একটি পুত্র ওকাসের জন্ম দিয়ে মারা যান।
এবারে আসা যাক একটু ভিন্নধর্মী ভাবনায়। আচ্ছা লালন ফকিরের গানের এই পংক্তিটি কি শুধুমাত্র পরকীয়া কেন্দ্রিক? একেবারেই তা নয়। এর অবস্থান মনস্তাত্বিক দিক থেকে আরো ব্যাপক। উদাহরণ খুঁজতে গিয়ে তুলে আনব স্কটিশ লেখক রবার্ট লুইস স্টিভেনসন রচিত উপন্যাস “স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড”-এর যেটি কেন্দ্র করে ১৯৩১ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র দুনিয়া কাঁপিয়েছিল। আরও অনেক এমন কাহিনী, ছায়াছবির কথা বলা যায় যেমন জন ডেপ অভিনীত “সিক্রেট উইন্ডো”, রবার্ট এলিয়টের “ড্রেসড টু কিল”, আইডেন্টিটি, সাইকো, স্প্লিট ইত্যাদি। বহুব্যক্তিত্ব মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একটি মানসিক রোগ যা ব্যক্তিত্বে দ্বৈত বা ততোধিক সত্ত্বা আনয়ন করে থাকে। এটি সবসময় যে সমস্যা তৈরী করবেই এমন নয়, কিন্তু যদি কোনো বিধ্বংসী সত্ত্বার অবস্থান থাকে তা অবশ্যই উদ্বেগের।
তবে সাধারণভাবে মানুষের চরিত্র বহুরৈখিক। একজন পুরুষ কখনও বাবা, কখনও স্বামী, কখনও প্রেমিক, কখনও সন্তান। মহিলাদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ। আসলে সামাজিক সুবিধার্থে আমরা নানা সম্পর্ককে নানা নামে ভূষিত করে থাকি আর কিছু কিছু সম্পর্কের যখন নাম খুঁজে পাই না তখন সেগুলো নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। আর পরচর্চার চেয়ে মুখোরোচক আর কিবা হতে পারে। তাই পরিশেষে, আমার, তোমার, সবার ঘরে বাস করে অগুন্তি জন। শুধু আমাদের পায়ের তলার চামড়ায় বসবাসকারী ব্যাকটিরিয়ার সংখ্যা অগুন্তি। আমরা তাই পৃথিবীর বুকে এক আকাশ গা আর লক্ষ তারার দ্যুতি নিয়ে বেঁচে থাকি, শুধু একটাই খেয়াল রাখার বিষয় মানুষ হিসাবে যেন মানুষের উপকার করতে না পারলেও অন্যের বা সমাজের ক্ষতি না করে ফেলি।
(শব্দ সংখ্যা ৮৮০)
আজও রবীন্দ্রনাথ কতটা প্রাসঙ্গিক
সু দী প ঘো ষা ল
জনৈক যুবক, তাঁকে অশ্লীলভাবে আক্রমণ করে জনপ্রিয় হতে চান,এটা বড় বিস্ময়কর ঘটনা।আজও রবীন্দ্রনাথের দেশজ প্রয়োজন, রাজনৈতিক প্রয়োজন, সমসাময়িক প্রয়োজন আছে৷ তবে তারও উপরে যেটা প্রয়োজন, সেটা হলো রবীন্দ্রনাথকে আরও ভালো করে জানা, তাঁকে অন্তরে ঠাঁই দেওয়া, রবীন্দ্র দর্শনে নিজেদের উজ্জীবিত করা৷
আজো রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
বর্তমান সময়ে ভারতে যখন অতি-জাতীয়তাবাদের জিগির ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, তথাকথিত উদারপন্থীদের প্রায় আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, সেখানে রবীন্রনাথের জীবনদর্শনের কথা আরও একবার মনে করা আশু প্রয়োজন বইকি। আর কয়েকদিন পরেই চলতি লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরোবে এবং তার উপরেই নির্ভর করছে আগামী দিনের ভারত কোন পথে এগোবে। যদি জাতীয়তাবাদী জিগির আরও উগ্র হয়ে ওঠে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার উপরে নেমে আসে তরবারির আঘাত, তবে ভবিষ্যতের দিনগুলি যে খুব অস্বস্তিজনক হবে না, তা বুঝতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় না।এই কথা সহজেই অনুমেয় এবং বিবেচ্য কারণ তাঁকে বাদ নিয়ে কেউ সম্পূর্ণ রূপে বাঙালি হয়ে উঠতে পারে না। আমাদের প্রকৃত বাঙালি হয়ে উঠতে গেলে ক্রমশ রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করতে হবে; কোথায় নেই তিনি বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের জাদুকরি হাতের স্পর্শ পড়েনি শুধুমাত্র মহাকাব্য ছাড়া। হয়তো অনেকে আমার সঙ্গে একমত পোষণ করবেন না কিন্তু সত্য হলো এটাই বাঙালি হয়ে বাঙালিত্ব গ্রহণ করতে হলে রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় গ্রহণ করতেই হবে। জন্ম থেকে মৃত্যু, মৃত্যু থেকে জন্ম, বিরহ থেকে আনন্দ, বিষাদ থেকে আত্মপ্রকাশ সব কিছুর ভেতরেই আমাদের শ্রেষ্ঠতম আশ্রয় হলেন তিনি; এমনকি বাঙালির আর্থসামাজিক উন্নয়নের ভাবনা এবং এই উপমহাদেশে প্রথম সমবায় তথা কৃষি ব্যাংকের ভাবনা এবং ক্ষুদ্র ঋণের কথা তিনিই প্রথম ভেবেছেন। তিনি জমিদারি থেকে দূরে গিয়ে দরিদ্র কৃষকের দ্বারে পদচারণা করেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন আর্থসামাজিক উন্নয়নের ভাবনা এবং তাদের মুক্তির কথা; কারণ অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া শুধু শিল্প আর সাহিত্য দিয়ে কখন মানবজাতির মঙ্গল সম্ভব নয়; আর এখানেই তিনি অনন্য এক মহীরুহে পরিণত হন। তিনি জীবনব্যাপী সাধনার মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্যের যে নতুন মাত্রা দান করেছেন, তা তুলনাহীন। তাকে ঘিরেই বাংলা সাহিত্যে, শিল্প ও সংস্কৃতির ভুবনে আধুনিকতার সূচনা হয়েছে। পরবর্তী কালে এই ধারার ধারাবাহিকতায় বাংলা সাহিত্য বিষয় বৈচিত্র্যে, জীবন জিজ্ঞাসায় ও মানবিকতায় বিশ্বস্ত হয়ে উঠে। তার কাছে আমাদের অনেক ঋণ। তাঁর একক প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যের সকল শাখা আজ সমৃদ্ধ। শুধু সাহিত্যে নয় সংগীতে এবং পরিণত বয়সে চিত্রকলায় বঙ্গীয় চিত্রধারার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে তিনি যে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন, পরবর্তীতে তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আমাদের দেশে রবীন্দ্র চর্চার ইতিহাস আজকের মতো এত সহজ ও সুন্দর ছিল না; তিনি ছিলেন দেশ কাল জাতি বর্ণ নির্বিশেষে এক মহাবৃক্ষের মতো আশ্রয়দাতা। আজকের তরুণ প্রজন্ম যতটা সামাজিক মাধ্যমে সাবলীল বোধ করে, ততটা বইয়ের পাতা ওল্টাতে করে না। ওল্টালে বুঝতে পারত, মৃত্যুর এত বছর পরেও রবীন্দ্রনাথ সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। এই প্রাসঙ্গিকতা যে নবীন প্রজন্মকে সে ভাবে নাড়া দিচ্ছে না, সেটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। বর্তমান প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল এবং তাতেই আকৃষ্ট। তাই রবীন্দ্রনাথকে তাদের সামনে তুলে ধরার জন্য সেই পথ অবলম্বন করা ছাড়া উপায় নেই।
আদর্শ ও চারিত্রিক বলিষ্ঠতার প্রতিফলন তিনি রেখে গিয়েছেন তাঁর সুবিশাল সৃষ্টিতে। আজকের অস্থির সমাজের কাছে সেই সৃষ্টি অতি অল্পসময়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ডিজিটাল মাধ্যম ছাড়া বিকল্প পথ নেই। এই বিষয়ে কিছু কিছু কাজ অবশ্যই হয়েছে। ইন্টারনেটের সহায়তায় এখন চাইলেই যে কোনও রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা যায়। ই-বুকে রবীন্দ্ররচনাবলি সংযোজিত হয়েছে। এখন আর কাগজ নয়, রবীন্দ্রনাথ তরুণ প্রজন্মের পছন্দের ডিজিটাল ফর্মেই। কিন্তু তবু সংশয় থেকেই যায়।
শুধুমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে বা গল্প-কবিতা পড়েই কি রবীন্দ্রনাথকে জানা সম্ভব! সেটাই-বা ক’জন করছেন! আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল রবীন্দ্রনাথ নিয়ে খুব আগ্রহী। নেপালি ভাষায় অনূদিত হয়েছে বেশ কিছু রবীন্দ্ররচনা। সেখানে রবীন্দ্রনাথকে জানতে অনেকেই শিখে নিচ্ছেন বাংলা ভাষা। আর আমরা বাঙালিরা! আমরা রবীন্দ্রনাথ বলতে কার্যত পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণে সীমাবদ্ধ! নতুন প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কি ঠিকঠাক পালন করতে পারছি আমরা?
এই বিষয়ে যুক্তিতর্ক চলতেই থাকবে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিসম্ভারের নানাবিধ আয়োজন আজও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দু:খ, বিরহ-মিলন, প্রাত্যহিক কাজকর্মের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। যুক্তিতর্ক বাদ দিয়ে আমাদের উচিত রবীন্দ্রনাথের বিশাল সম্ভারকে মানবতার উৎকর্ষ বৃদ্ধির কাজে লাগানো। রবীন্দ্রনাথ দেশকালের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নন। তিনি চিরকালের। তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতাটি লিখেছিলেন আজকের শতকের জন্যই। তিনিও নিশ্চিত ছিলেন যে, এই শতকেও তাঁর রচনার সমান গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। নতুন প্রজন্মের জন্য কবিতায় দেওয়া তাঁর বার্তাই সেই কথার সাক্ষ্য বহন করে।
উনিশ শতকে নারী স্বাধীনতা বা অধিকার যখন এক কথায় অকল্পনীয়, তখন কবি নারীকে তুলে এনেছেন তাঁর রচনার কেন্দ্রীয় চরিত্রে। নারীকে উপস্থাপন করেছেন স্বাধীনচেতা ও সাহসী হিসেবে, যা আজও একই রকম ভাবে প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে যে বিষয়টি পরিবেশবিদ তথা সমগ্র মানবজাতির অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়, তা হল বৃক্ষচ্ছেদন ও পরিবেশের উপর তার প্রভাব। রবীন্দ্রনাথ বহু আগেই এটি উপলব্ধি করেছিলেন এবং সেই প্রকৃতিবাদী দর্শনচিন্তার প্রতিফলনও রেখে গিয়েছেন কাব্যে, গানে, সাহিত্যে, যার প্রাসঙ্গিকতা কখনওই অস্বীকার করা যায় না। আর তাই ষাটের দশকে যখন তাঁর চর্চার প্রয়াস পূর্ণতা লাভ করছিল ঠিক তখনই নেমে আসে তৎকালীন সামরিক সরকারের বিরোধিতা কিন্তু তা সত্ত্বেও রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালি এক নতুন অভিযাত্রার সন্ধান পায় এবং রবীন্দ্রিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সৃজন করেন বাঙালির জীবনে এক নতুন অধ্যায়। পরবর্তীতে রবীন্দ্র সংস্কৃতির চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েই এই অঞ্চলের বাঙালি সব আনন্দ বেদনায়, সংকটে ও স্বপ্নে তাঁকে অবলম্বন করেছে, এমনকি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর গান সৃষ্টি করেছিল এক মহান উৎস, যা প্রেরণাসঞ্চারী হয়ে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন,"আজি হতে শতবর্ষ পরে,কে তুমি পড়িছো বসে আমার কবিতাখানি"।
ছোটগল্পের যাদুকর
শং ক র ব্র হ্ম
আধুনিক ছোটগল্পের অন্যতম জনক যা'কে মনে করা হয়, তিনি হলেন উনিশ শতকের বিখ্যাত ফরাসি কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক গী দ্য মোপাসাঁ। তাঁর পুরো নাম 'হেনরি রেইনে আলবার্ট গি দ্য মোপাসাঁ'।
তাঁর জন্ম হয় ১৮৫০ সালের ৫ই আগস্ট ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে। তাঁর পিতার নাম গ্যুস্তাভ দ্য মোপসাঁ এবং মায়ের নাম লোর ল্য পোয়াতভাঁ।
এগারো বছর বয়সে তাঁর বাবা এবং মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদের পরে তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকতেন।
তিনি স্বল্পভাষী লাজুক স্বভাবের ছিলেন। মায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনেকখানিই প্রভাব ফেলেছিল তাঁর উপর। তাঁর মা দুরারোগ্য ব্যাধি ম্যালানকোলিয়ায় ভুগতেন। তার বাবা-মায়ের এই বিচ্ছেদ আর মায়ের এই অসুস্থতা - এই দুই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাই তাঁকে সাহিত্যচর্চার দিকে ধাবিত করে তুলেছিল।
মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান বলে লেখাপড়ার সুযোগ কিছুটা পেয়েছিলেন। তিনি স্থানীয় একটি চার্চে পড়াশোনা করতেন। ১৮৬৭ তিনি একটি নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৬৯ সালে মোপাসাঁ প্যারিসে আইন পড়তে যান। তবে শীঘ্রই তাকে পড়াশোনা ছেড়ে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ফরাসি-প্রুশীয় যুদ্ধের কারণে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়। এরপর ১৮৭৩ সালে সামরিক বিভাগে কেরনীর চাকরী পেলেন মোঁপাসা। ১৮৭৩ সাল থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত তিনি সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে ফ্রান্সের নৌ মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কেরানীর কাজ করেন।
কিন্তু অবসরের অধিকাংশ সময়টাই কাটতো তাঁর স্যেন নদীতে জল-বিহার করে, অথবা সাহিত্য গুরু গুস্তার্ফ ফ্লোবেয়রের সঙ্গে সাহিত্য আলোচনা করে।প্রকৃত পক্ষে ফ্লবেয়রই এই সময় তাঁকে সাহিত্য চর্চায় তালিম দিতে থাকেন।
ফ্লবেয়রের বাড়িতে তখন রীতিমতো সাহিত্যের আড্ডা বসতো। সেখানে আসতেন, ফ্রেদরিক বেঁদ্রি, ক্লদিয়স পপলিন,আলেকজান্ডার দঁদে প্রমুখেরা। মাঝে মাঝে রাশিয়া থেকে আসতেন আইভান তুর্গেনিভ। আর ১৮৭৪ সাল থেকে আসতেন এমিল জোলা। ক্রমে জোলাকে ঘিরে পাঁচজন তরুণ সহিত্যিকদের একটি গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। স্যেন নদীর তীরে জোলার মেদাম গ্রামের বাড়িতে এই ' মেদাম-গোষ্টী'-র আসর বসতো।
আসরে সামিল হতেন - পল অ্যালেকসি, জোরিস কার্ল উসমান, হেনরি সেয়র্ভ, লিয়ন হেনিক ও মোঁপাসা। এরা সকলে মিলে একটি গল্প সংকলন প্রকাশ করেন, যার নাম 'লা সয়ার দ্য মেদান' (Less Sovress de Medan) । ১৮৮০ সালের কথা সেটা।
সংকলনের প্রথম গল্পটি ছিল এমিলি জোলার। কিন্তু পরে জোলা স্বীকার করেছেন, সংকলনের সেরা গল্পটি লিখেছে মোঁপাসা।
এখানে মোপাসাঁর প্রথম বড় গল্প 'ব্যুল দ্য সুইফ' (Boule de Suif) - ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের পটভুমিতে একজন বেশ্যার কাহিনী প্রকাশিত হয়। সেটাই তাঁকে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। আজও এই গল্পটিকে মোপাসাঁর সেরা একটি গল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৩৪ সালে এই গল্প থেকে নির্মাতা মিখাইল রম একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছিলেন।
স্কুলে পড়ার সময়ে ১৮৬৭ সালে তিনি প্রথম গুস্তাভ ফ্লবেয়র সঙ্গে দেখা করেন। গুস্তাভ ফ্লবয়র তাঁর মায়ের বন্ধু ছিলেন। মূলতঃ তার মা-ই তাকে গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের সঙ্গে দেখা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কেননা, তাঁর মা স্পষ্টভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন মোপাসাঁর সাহিত্যপ্রীতির কথা। আর তিনি নিজেও সাহিত্যের একজন সমজদার ছিলেন। মোপাসাঁর মায়ের প্রিয় লেখক ছিল উইলিয়াম শেক্সপিয়ার।
ফ্লবেয়ারের সঙ্গে মোপাসাঁর এই সাক্ষাৎ তাঁর পরবর্তী জীবনেও প্রভূত উপকার এনে দিয়েছিল, অর্থাৎ নানাভাবেই ফ্লবেয়ার তাঁর প্রতি সদয় হয়েছিলেন। ফ্লবেয়ারের এই পাশে দাঁড়ানো তাঁর জীবনের প্রায় প্রধানতম এক ঘটনা।
ফ্লবেয়ারের সাহায্যেই মোপাসাঁ নানান পত্র-পত্রিকায় নিজের নামে ছোটগল্প আর আর্টিকেল প্রকাশ করতে আরম্ভ করেছিলেন। মোপাসাঁকে তিনি নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন আর সত্যিকার অর্থেই তাঁর অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। ফলে মোপাসাঁর সাহিত্য এবং সাংবাদিকতার শুরু এই লেখকের হাতে হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। পরবর্তীতে গুস্তাভ ফ্লবেয়ার, এমিল জোলা, আলফস দোঁদে-দের উত্তরসূরী তিনি।
১৮৮০ সালে একটি কাব্যগ্রন্থ 'De Ver' প্রকাশের মধ্যে দিয়ে তিনি সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন।
১৮৮৩ সালে আরেকটি বিখ্যাত গল্প প্রকাশিত হল, মাদমোয়াজেল ফিফি।
১৮৮১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প সঙ্কলন " La Maison Tellier". ১৮৮৩ খ্রিঃ প্রকাশিত হত তাঁর প্রথম উপন্যাস "Une Vie". এই উপন্যাসটি পরবর্তীকালে "A Woman's Life" নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়। এবং প্রকাশের এক বছরের মধ্যে ২৫০০০ কপি বিক্রি হয়।
উপন্যাসটি সরকারি রোষানলের শিকার হল।
মোপাসাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস " Bel Ami" প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত উপন্যাস "Pierre et Jean".
ছোটগল্পকার হিসেবে তিনি যতটা পারদর্শী ছিলেন, উপন্যাসে ততটা ঋজুগতি ধরে রাখতে পারেননি। মাত্র এক দশক সাহিত্যচর্চার সুযোগ পান মোপাসাঁ।
সাহিত্যের নানান ধারায় কাজ করলেও তিনি মূলত ছোটগল্পকার হিসাবেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তাঁকে ছোটগল্পের যাদুকর বলা হয়।
বিশেষত, ফরাসি-প্রুশিয় যুদ্ধের দুর্বিষহ সব চিত্রকে তিনি তুলে ধরেছিলেন তার লেখালেখির মাধ্যমে। এই যুদ্ধে যেই সাধারণ মানুষেরা আক্রান্ত হয়েছিল তাদের দুর্বিষহ পরিণতির কাহিনী তিনি বলেছিলেন।
চমকপ্রদ ও চাতুর্য-পূর্ণ গল্পের প্লট রচনা তাঁর লেখার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তাঁর গল্পে অতিবাস্তবতা, কল্পনা, অতিপ্রাকৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক বিষয়সহ বিভিন্ন মানবিক সঙ্কটের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ছোটগল্পকার হিসেবে যতটা সফল ছিলেন, ঔপন্যাসিক হিসাবে তিনি ততটা সফল হতে পারেননি। তিনি মাত্র এক দশক সাহিত্যচর্চার সুযোগ পান। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি প্রায় তিনশ ছোট গল্প, ছয়টি উপন্যাস, বেশ কিছু কবিতা এবং তিনটি ভ্রমণকাহিনী লেখেন।
একনজরে মোপাসাঁ'র রচনা সম্ভার:-
---------------------------------------------------
কাব্যগ্রন্থ:
Des Vers (1880)
গল্প সঙ্কলন:
1.La Maison Tellier (1881)
2.Mademoiselle Fifi (1883)
3.Contes de la Bécasse (1883)
4.Miss Harriet (1884)
5.Les Sœurs Rondoli (1884)
6.Clair de lune (1884)
7.Yvette (1884)
8.Contes du jour et de la nuit (1885)
9.Monsieur Parent (1886)
10.La Petite Roque (1886)
11.Toine (1886)
12.Le Horla (1887)
13.Le Rosier de Madame Husson (1888)
14.La Main gauche (1889)
15.L'Inutile Beauté (1890)
উপন্যাস:
1.Une Vie (1883)
2.Bel-Ami (1885)
3.Mont-Oriol (1887)
4.Pierre et Jean (1888)
5.Fort comme la mort (1889)
6.Notre Cœur (1890)
ভ্রমণ কাহিনী:
1.Au soleil (1884)
2.Sur l'eau (1888)
3.La Vie errante (1890)
তিনি ছোটগল্প সম্পাদনা করেন -
১).দ্যা ডায়মন্ড নেকলেস
২).আফটার
৩).এ্যাট সী
১৮৮৮ সালে তার ছোট ভাই হার্ভে উন্মাদ হয়ে যাওয়ার পর মোঁপাসা খুব মুষড়ে পড়েন। তাঁর মনেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, তিনিও অচিরেই পাগল হয়ে যাবেন। তাঁর চুল উঠে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে বুকে ব্যথা হতো। স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়েছিল। গায়ে চর্মরোগ দেখা দেয়।
ব্যক্তি জীবনে তিনি নিয়ম-শৃঙ্খলা মানতেন না। বহুনারীর ঘনিষ্ঠতা লাভের পরও তিনি অতৃপ্ত ছিলেন। কেউ তাকে তৃপ্তি ও শান্তি দিতে পারেনি মনে। পরবর্তী কালে দেহের কিছুটা পঙ্গু হয়ে যায়। একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়।
তিনি সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হন, যা তাকে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। শেষে মারাত্মক মানসিক বৈকল্যের শিকার হয়ে ১৮৯২ সালের ২ জানুয়ারি কন্ঠনালী কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় ডাক্তার ব্লাস তাঁকে নিজের স্বাস্থ্য নিবাসে নিয়ে আসেন। সেখানে তাঁর দেড় বছর কাটে।
তারপরে, জুলাই মাসের ৬ তারিখে এই লেখকের প্রয়াণ ঘটে।অর্থাৎ ১৮৯৩ সালের ৬ই জুলাই, মাত্র ৪৩ বছর বয়সে, মারা যান এই প্রতিভাবান সাহিত্যিক।
পাঠকদের জন্য গী দ্য মোপাসাঁর কিছু বিখ্যাত উক্তি এখানে প্রকাশ করা হলো। সে'গুলো পড়লেই বোঝা যায়, মোপাসাঁ একই সঙ্গে যেমন ছিলেন প্রেমিক মানুষ, তেমনই ছিলেন মানবতার প্রতি পরম অনুরাগী একজন লেখক।
জীবন সম্পর্কে মোপাসাঁ লিখেছেন -
--------------------------------------------
১). ‘জীবনকে অর্থবহ করে তুলবার জন্যই এই জীবনের লড়াই’।
২). একটা বৈধ চুম্বন ততো মূল্যবান নয়, যতোটা মূল্যবান একটা চুরি-করা চুম্বন।
৩). চুম্বন ব্যাপারটাই এক অমর ঘটনা। পর্যটকের মতো এটা ঘুরতে থাকে মানুষের ঠোঁট থেকে ঠোঁটে, এক শতবর্ষ থেকে আরেক শতবর্ষে, অনতিগম্য সময়কাল ধরে। নারী এবং পুরুষ উভয়েই এই চুম্বনকে অর্জন করে, তারপরে একে অপরকে সেটি প্রদান করে, তারপরে পালা করে মারা যায়।
৪). দেশপ্রেম জিনিসটা ধর্মের মতো। যেসব যুদ্ধগুলো ডিম পাড়ে, এটা তাদেরই একটা ডিম।
৫). মিলিটারীরা হলো পৃথিবীর চাবুক।
৬.আমাদের শ্বাসক্রিয়া, ঘুম, পানাহার, কাজকর্ম এবং স্বপ্ন, এইসকল কিছুর মানে একটাই—মৃত্যু। এমনকি বেঁচে থাকা মানেও মৃত্যুই।
৭).অতীত আমাকে আকর্ষিত করে আর বর্তমান আমাকে আতঙ্কিত করে। কেননা ভবিষ্যতের অর্থ হলো মারা যেতে হবে।
৮). প্রকৃতপক্ষেই নিঃসঙ্গতা আমাদের চিন্তাপ্রক্রিয়ার জন্য ক্ষতিকর। আমাদের চারপাশে সেসকল মানুষদের থাকার প্রয়োজন আছে যারা ভাবতে এবং কথা বলতে জানে। যখনই আমরা দীর্ঘকালের জন্য নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ব, তখনই আমাদের পরিণতি হবে কার্য-কর্মহীন প্রেতাত্মার মতো।
৯). সবকিছু মিথ্যা। সবকিছু সম্ভব। এবং সবকিছুই সন্দেহজনক।
১০). কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা জ্বরাক্রান্তির চাইতেও বরং একটা অসুস্থ চিন্তাই মানুষের শরীরকে আরো ভয়ঙ্করভাবে গ্রাস করে থাকে।
১১). জীবনে একটাই মাত্র ভালো ব্যাপার রয়েছে, সেটা হলো ভালোবাসা।
১২). আমি যদি পারতাম, সময়ের এই বয়ে চলাকে আমি থামিয়ে দিতাম। কিন্তু ঘড়িতে ঘণ্টাগুলো তো ঘণ্টাগুলোর পরে বয়েই চলল, আর মিনিটগুলোও চলল মিনিটগুলোর পিছে পিছে। মূলত প্রত্যেকটা সেকেন্ডই আমার সত্তার সূক্ষ্মতম একাকিত্মগুলোকে হরণ করে নিচ্ছে—কেবল আগামীকালকের ‘কচু’টাকে বাস্তবায়ন করবার জন্য। যদি আমি বর্তমানের এই সময়ের এই অনুভূতিটিকে পুনরায় আবার পেতাম!
১৩). ভালোবাসায় অসুখী থাকা বরং ভালো, বিয়ে করে অসুখী থাকার চাইতে। অবশ্য কেউ কেউ উভয়টাকেই বাগে এনে ফেলতে পারে।
১৪). কথোপকথন ব্যাপারটা আসলে কী? আসলে মিস্ট্রি! এটা এমনই এক শিল্প, যা কখনোই একঘেয়েমি হয়ে ওঠে না। এটা চলতে থাকে প্রত্যেকটা নতুন বিষয়কে ছুঁয়ে ছুঁয়ে, খুঁটিনাটি যত আনন্দকে সঙ্গে করে। যেন কিছুই নেই, তবু এই না থাকারই বিমোহনের মধ্য দিয়ে তার যাত্রা।
১৫). তারাই মহৎ শিল্পী, যারা মানবতাকে নিজের চিন্তার ওপরে আরোপ করতে পারে।
১৬). ভাষা মূলত একটা ছলকলা, আর অতিব ঝলসানো এক ব্যাপার। কেননা এটা মানুষের মুখমণ্ডলের ওপরে থাকা এক মুখোশ। আমরা দেখতে পাই এটা মানুষের ঠোঁট দিয়ে বের হয়ে আসছে, আর সেই ঠোঁটগুলোই মানুষের চোখকে আমোদিত করছে। কিন্তু সাদা কাগজের ওপর যেইসব শব্দ আর বাক্য, কালো কালো, মূলত সেগুলোই মানুষের ভিতরকার সত্তাকে প্রকাশ করতে পারে।
-----------------------------------------------------------------------------
[ তথ্য সংগৃহীত ও সম্পাদিত। সূত্র - অন্তর্জাল। ঋণস্বীকার - সুশান্ত কর্মকার।]
(শব্দ সংখ্যা: ১৩৭৬)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন