পত্রসাহিত্য


আছে যে সংগোপনে
 
মা লা  চ্যা টা র্জ্জি
     
 
 অনেক দিন বাদে আন্তর্জাতিক বইমেলাতে তোমাকে দেখলাম সংগোপনদা। বইমেলা তখন জমজমাট। তুমি ধীর পদক্ষেপে আনন্দ পাবলিশার্সে প্রবেশ করলে। সাথে বোধহয় প্রিয় বান্ধবী ছিল। বেশ দেখতে মেয়েটি। চোখেমুখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ। অনেকটা “নায়ক” সিনেমার নায়িকা শর্মিলার মতো লাগলো। সেজেগুজে সুন্দরী হবার প্রচেষ্টা নেই, তবু কি অনন্যা!

জানি, আমার দেওয়া সংগোপন নামটা শুনলে তুমি ভীষণ অবাক হবে। আসলে, মনের অতলান্তে অতি সংগোপনে তোমাকে রেখেছি বলে সংগোপন নাম দেওয়া। চেহারাটা তোমার সামান্য পরিবর্তন হয়েছে। বেশ গুরুগম্ভীর ভাব এসেছে। নামকরা কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক, তাঁর কি প্রগলভতা সাজে? না, তুমি আমার প্রেমিক নও, প্রাক্তনও নও শুধু একান্ত সংগোপনের মানুষ। এত চরিত্রের অমিল ছিল আমাদের, কাছের মানুষ কি করে  হবো !

তোমাদের দেখে দু‘চোখ জুড়িয়ে গেল। রক্তে ঢেউ তুলে মাৎসর্যের কামড় আসতে দেই নি। প্রিয়জনের মঙ্গলই তো শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষ চায় তাই না?

না, এ চিঠি আমি কোনও বিরহী ডাকপিয়নকে দেবো না। ভোরাইয়ের ডাকের সাথে ভাসিয়ে দেবো। আলো হয়ে সুপ্রভাত জানতে আসবে সে। ফুলগুলি যখন হাই তুলবে, ভোরের হাওয়া যখন আল্পনা আঁকবে দীঘির জলে এ চিঠি তখন বলবে “বন্ধু, ভালো আছো তো?"

                                      ইতি
                                 পর্দাসীনা





চিঠি- মনের কথা

পা পি য়া  গো স্বা মী

শ্রদ্ধেয়া মনিদি (মেজদি),

এটাই আমার তোর কাছে লেখা প্রথম চিঠি। জানিস দিদি তুই যখন এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলি তখন আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। তখন তো আমি চিঠি লিখতে পারতাম না। প্রয়োজনও হয়নি। জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত বা যন্ত্রণা সেই প্রথম পেলাম। আমি যেন আমার ছোট্ট মাকে হারালাম।

তখন অনেক কিছুই বুঝি আবার অনেক কিছু বুঝিও না। সত্যি করে আমি তখন বড্ড ছোটো। ছোট হলে কি হবে? তখনকার অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা আমার মনে আছে। এই স্মরণশক্তিটা আমরা ভাই বোনেরা সবাই বোধহয় মায়ের কাছ থেকে জন্মসূত্রে পেয়েছি।
তোর সঙ্গে আমার কাটানো সময়ের‌ বিশেষ ঘটনাগুলো একটা একটা করে প্রায়‌ই মনে পড়ে।

আমি তোর থেকে‌ প্রায় এক যুগেরও বেশি ছোটো। তোর সঙ্গে আমার বোন-দিদির সম্পর্ক কম, যেন মা-মেয়ের সম্পর্কই ছিল বেশি। তুই যেন আমার ছোট্ট মা।
ছয় ভাই বোনের সংসারে আমি তো সবার ছোট কিন্তু মা সব দিকে খেয়াল রাখতে গিয়ে‌ আমাকে ঠিকমতো সময় দি‌য়ে উঠতে পারতো না। এই কথা অবশ্য আমি‌ বড় হয়ে মায়ের মুখ থেকেই শুনেছি, খানিকটা আমার মনেও আছে। সেই জায়গাটা তুই অনেকটাই পূর্ণ করে দিতিস।

আমার যে বছর মাম্স হয়েছিল তখন আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি। খুব জ্বর আর ভীষণ কষ্ট। কিচ্ছু খেতে পারতাম না। ডিমের ওমলেট খাবার বায়না করলাম। মা দিলো না। তুই নিজে হাতে বানিয়ে চামচ দিয়ে কেটে কেটে ছোট্ট ছোট্ট টুকরো করে আমায় খাইয়ে দিলি। বিশ্বাস কর এর আগের কথাও আমার মনে আছে। আমি যখন জলে পড়ে গেছিলাম আমায় জল থেকে তুলেছিল ছোড়দা। মেজদা আর তুই আমায় কোলে করে যখন হসপিটালে নিয়ে গেছিলি, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। তখন আমি মাত্র পাঁচ বছরের। আমার একটা অভ্যেস ছিল, খুব কষ্ট হলে আমি আমাদের কুয়োর কাছে চলে যেতাম। আর মাথাটা নিচু করে কুয়োর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমার চোখের জল‌ এক বিন্দু দুই বিন্দু করে কুয়োর জলে মিশে যেত। কেউ দেখতে পেত না। তুই কিন্তু সব জানতি। আমাকে কুয়োর পারে দেখতে পেলেই চোখের জল মুছিয়ে কোলে করে ঘরে নিয়ে আসতি। তারপর আমার কষ্টের কথা জানতে চাইতি। তারপর তোর সাধ্যমতো আমার আবদার মেটাবার চেষ্টা করতি। আমার স্কাউটের ইউনিফর্ম তুই কিনে দিয়েছিলি। আমার জীবনের প্রথম রং তুলিটা তুই কিনে দিয়েছিলি। তুই ছিলি আমার সমস্ত প্রেরণার উৎস। কখনো কখনো ঘুমের মধ্যে জেগে উঠলে দেখেছি কত রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু তুই লেখাপড়া করছিস। দিনের বেলা স্কুল, বিকেলে টিউশন পড়াতে যেতিস আর রাতে তোর নিজের পড়া। সারাটা দিন তোর খাটুনির শেষ ছিল না। জীবনযুদ্ধের যে বোঝা মাথা পেতে নিয়েছিলি সেই ভার তোর বুঝি সহ্য হলো না। তাই অকালে চলে গেলি। কতটুকুই বা বয়স তখন তোর, কলেজে পড়তিস। তুই যেন ছেলে, সংসারের হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট। কার কিসে ভালো হবে সব সময় সেদিকেই তোর নজর থাকতো অথচ নিজের কথা কখনো ভাবিস নি। এগুলো আমি অনেক পরে বুঝেছি। 
আমি যখন স্কাউট করি একদিন আমার স্কাউট-এর ইউনিফর্মের জন্য কোথায় যেন যেতে পারিনি তখনো আমি ওই কুয়োর ধারে দাঁড়িয়ে। আমাকে কাছে এনে আদর করে বললি এর পর থেকে তুমি ও সব জায়গায় যাবে। আমি আগামী মাসেই তোমার ইউনিফর্ম কিনে দেবো। ঠিক তাই হলো। একবার আমার জুতো ছিঁড়ে গেছে সেইবারও একটি অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি। পরের মাসে আমার জুতো এসে গেলো।
একদিন হঠাৎ দেখি আমার জন্য রং আর তুলি নিয়ে এসেছিস। সে যে কি আনন্দ আমার, কাউকে বলে বোঝানো যায় না। আমার চোখ মুখ ও শরীরের প্রতিক্রিয়ায় তুই সব বুঝতে পেরেছিলি। ছোট্ট বোনের ছোট ছোট ভালো লাগা ও আনন্দগুলোকে তুই যেন মুঠোয় ভরে সূর্যের আলোর মতো ছড়িয়ে দিতি। এভাবেই সব ভাই বোনের ভালোলাগাগুলো মুঠো মুঠো করে আলোর মতো ছড়িয়ে দিয়ে অন্ধকারটা নিজে বেছে নিলি। সবার আনন্দই যেন তোর সব সুখের উৎস।

তুই চলে গেলে বাবা আর আমি কতদিন যে একসাথে কেঁদেছি মনে নেই। বাবাকে সবসময় বলতে শুনতাম, "মানুষের একটা ছেলে চলে গেলেও এতো কষ্ট হয় না আমার মেয়ে চলে যাওয়াতে আমি যত কষ্ট পাচ্ছি।" জানিনা কজন ভাগ্যবানের ঘরে আমার শ্যামার মতো মেয়ে জন্মায়?"
বড়দির থেকে তোর গায়ের রঙ একটু চাপা ছিল তাই তোদের ডাকনাম যথাক্রমে উমা ও শ্যামা ছিল। তোর আলাদা করে আর কোনো নাম ছিলো না। শুনেছি তোর নিজের নামটা ও নিজেই রেখেছিলি। "ইতিকা" তার মানে পুরনো ইতিহাস।

যুগ অনেক এগিয়ে গেছে এখনকার বাচ্চারা অনেক বেশি সাবলীল। আমাদের সময় তখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এতটা উন্নতি  ঘটেনি। টেলিভিশন, মোবাইল, কম্পিউটার এইসব দেখা বা ঘাঁটা আমাদের‌ সময় ছিল না। আমাদের জীবনটা অনেক বেশি সহজ-সরল এবং খাঁটি ছিল। আমরা ওই ছোট্ট অবস্থাতে খুব একটা কিছু বুঝতাম না। আজকালকার ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা অনেক বেশি বোঝে এবং জানে। সেখান থেকে বলতে চাইছি আমি ভাবতাম পরম ঈশ্বর বোধহয় তোকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছে তিনি চাইলেই তোকে আবার আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারে। তাই যখন কেউ কাছাকাছি থাকত না আমি খুব করে ঠাকুরের কাছে জোড় হাত করে কাঁদতাম আর বলতাম আমার দিদিকে ফিরিয়ে দাও। একবার এই জীবন ত্যাগ করে চলে গেলে আর ফিরে আসা যায় না সে সব কথা জানতাম না বুঝতামও না। তোর ব্রেন ক্যান্সার হয়েছিল। তুই মারা যাবার পর আমি আর ছোড়দা তোকে দেখিনি বলতে পারিস আমাদের দেখতে দেওয়া হয়নি। তোকে দাহ করতেও দেখিনি। তাই তুই আজও আমার সেই জীবন্ত দিদি হয়ে বুকের ভেতরে বেঁচে আছিস। 
এখন তো সবকিছু বুঝি, জানি। যে তুই আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে তবুও তোকে ভুলতে পারলাম কোথায়? না না তোকে ভুলতেও চাই না। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার বুকে হৃদয়ের মাঝখানটাতে যেমন মা-বাবা আসন কেটে বসে আছেন জানিস তো তুইও সেখানেই আছিস। 
আধ্যাত্মিকতা ও জন্মান্তরবাদ আমি অনেকাংশে বিশ্বাস করি। তাই ঈশ্বরের কাছে আমার অনুরোধ সত্যিই যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে তবে তোকে যেন আবার আমার কোনো আপনজন হিসাবে ফিরে পাই। আমি যখন ক্লাস ফাইভে উঠেছি সে সময় আমাদের বাংলার দিদিমণি একদিন ক্লাসে পড়াচ্ছিলেন, "বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই মাগো আমার শোলোক বলা কাজলা দিদি কই।" 

আমি দ্বিতীয় বেঞ্চের কোনায় বসে ছিলাম আর আমার দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি। ‌দিদিমণি আমায় দাঁড়াতে বললেন। তারপর আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি শ্যামার বোন?" আমি হ্যাঁ বলাতে আমায় বসতে বললেন। 
যেখানেই থাকিস খুব ভালো থাকিস। তোর কথা ভাবলে বা কাউকে বললে আজও আমার দুচোখ জলে ভরে ওঠে। ওই যে বললাম তুই আমার দিদি কম আর মা বেশি ছিলি। আজ রাখি তাহলে। 

ইতি---
তোর স্নেহের বোন।




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

চতুর্থ বর্ষ || দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল ও বাসন্তী সংখ্যা || ৯ চৈত্র ১৪৩১ || ২৩ মার্চ ২০২৫

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪