স্মৃতিকথা


এক শীতের সকাল ও আমার মা

মো য়া ল্লে ম না ই য়া
এই মধ্য বয়সে শীতের সকাল এলে কুয়াশায় মোড়া মনের বারান্দায় শৈশবের বহু স্মৃতি এসে ভিড় করে। যে স্মৃতির অনেকটা অংশ জুড়ে ঢেকে আছে বেদনার ধূসরতা। একা হয়ে যাওয়ার বিপন্নতা। ভাবতে গেলে সবকিছু কেমন যেন দুঃস্বপ্নের মতোই মনে হয়। এখনকার মতো তখনকার সকাল তো আর দেরিতে আসতো না! সূর্য ওঠার আগেই তার ঘুম ভেঙে যেত। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা এর কোন ব্যাত্যয় ঘটতো না। তখন ছোট বড় সবাই পাখি ডাকার সাথে সাথে জেগে উঠতো। শিশির স্নাত দুর্বাঘাস মাড়িয়ে মেঠো পথ ধরে তারা ছড়িয়ে পড়তো নানান কাজে। সেই শৈশবের সকালে আমরা যখন লেপের তলায় আধো জেগে আধো ঘুমে, মা তখন চুপিসাড়ে আমাদের উষ্ণ আরামকে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে সকালের শীত মেখে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন গৃহস্থালির কাজে। অন্যদিকে বাবা ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন মানুষ। কচ্চিৎ কদাচিৎ তাঁর সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হতো। তবে সাক্ষাৎ হলে তিনি হাজার বছরের সুখ যেন একদিনেই মিটিয়ে দিতেন। সারাদিন আমাদের মতো হয়ে আমাদের সঙ্গে মিশে যেতেন। বোঝাই যেত না এই মানুষটাকে আমরা আমাদের জীবনে খুব কম পেয়েছি। তিনি কখন ফিরতেন কখন ঘুমাতেন, তা আমরা কেউ জানতেই পারতাম না। আমরা মানে আমাদের দুই ভাই ও বোন। আমি বড় হওয়ায় মাঝে মাঝে বাবাকে দেখেছি মধ্যরাতে ফিরতে, কখনো বা এক সপ্তাহ দু সপ্তাহ বাড়ির বাইরে কাটিয়ে দিতেI ঠাকুরদা অর্থাৎ আমার বাবার বাবা ছিলেন, ওই এলাকার এক বর্ধিষ্ণু ধনী ব্যক্তি। বাবা ছাড়া তাঁর বাকী চার ছেলে সবাই প্রতিষ্ঠিত। তাই তাঁর চোখে বাবা ছিলেন নিষ্কর্মা, ধ্বংসের প্রতীক। অথচ পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বাবা নাকি ছিলেন সবচেয়ে তুখোড় বুদ্ধির অধিকারী। কিন্তু তিনি তাঁর সেই বুদ্ধিকে বৈষয়িক কাজে না লাগিয়ে পার্টি পাল্লা, মিটিং মিছিল, মানুষের দাবি-দাওয়া, তাঁদের সুখ দুঃখ ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করতেন। মায়ের মুখ থেকে শোনা--- তিনি ছিলেন কোনো এক বামপন্থী দলের সদস্য। ঠাকুরদার ভাষায়, ছোটলোকের দল। যাদের ঘর নেই, দোর নেই, না খেতে পাওয়া, অশিক্ষিত হা-ভাতের দল। ফলে, ঠাকুরদার সংসারে বাবার মূল্য ছিল ভোজন শেষে ফেলে দেওয়া কলাপাতার মতো। আর আমরা তো জানি, প্রতিটি যৌথ পরিবারে বৌমার মূল্য নির্ধারিত হয় ছেলের মূল্যের উপর। স্বাভাবিকভাবে আমার মায়েরও মূল্য ছিল খুবই কম। তাই হয়তো সংসারের কাজের জন্য মাকে বিছানা ছেড়ে আগেই উঠে যেতে হতো। সব কাজ সেরে তিনি যখন আমাদের কাছে আসতেন তখনও শেষ রাতের অন্ধকার গাছপালায় লেপটে থাকতো। আমরা ভাই-বোনেরা খুব অল্পতে সন্তুষ্ট ছিলাম। তাই অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হলেও কখনো দুঃখ পাইনি বা বাবা মার প্রতি কোন অভিযোগ করিনি। বাবা প্রকাশ্যে মায়ের সঙ্গে খুব কম কথা বলতেন। তবে যতটুকু বলতেন, তাতে তাঁকে কখনো হাসতে দেখিনি। আমরা ঘুমিয়ে পড়লে হয়তো বাবা-মা কথা বলতেন। তাই বুঝতে পারতাম না তাদের মধ্যে সম্পর্কটা কেমন ছিল! হঠাৎ একদিন ঘুম ভেঙে বিস্ময়ে দেখি, মা নিঃশব্দে বাবার বুকে মাথা রেখে অবিরত কেঁদে চলেছেন। বাবা তখন মায়ের মাথায় হাত বোলাচ্ছেন আর বোঝাচ্ছেন, বেনু, তোমাকে খুব বেশি দূরে যেতে হবে না। একটু বাইরে তাকিয়ে দেখো, তোমার গ্রামের গরীব অসহায় মানুষগুলো এই শীতের রাতে কীভাবে এক বেলা আধ বেলা খেয়ে, না খেয়ে, জরাজীর্ণ ভাঙা কুঁড়েতে শীতকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে! তুমি বা তোমার ছেলে মেয়েরা তবু তো লেপ, কাঁথা জড়িয়ে শীতগুলো অতিক্রম করতে পারছ? বলতো, ওদের কী হবে! ওদের জন্য আমরা কী করতে পেরেছি? মা জবাব দিতে পারতেন না, শুধু নীরবে নিজের নির্ভরতার জায়গায় অশ্রু বিসর্জন করে ক্লান্ত হয়ে যেতেন। আমার ওইটুকু বয়সে বাবার প্রতি মাঝে মাঝে ভীষণ অভিমান হতো। মা বুঝতে পারতেন। আদর করে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, তোর বাবার মতো বাবা এই পৃথিবীতে খুব কমই আছেন রে বাবু। আমি তখন মার দিকে তাকিয়ে বলতাম, মা এই সংসারে তোমাকে তো কেউ মূল্য দিল না। না বাবা, না দাদু, না জ্যেঠা-কাকা, কেউ না। এমন কি জ্যেঠি কাকিরাও না! তিনি ম্লান হেসে বলতেন, শত জন্মেও এমন স্বামী, এমন বাবা, এমন বন্ধু পাওয়া যায় নারে খোকা। আর বাকীদের কথা! তুই এখন বুঝবি না। একটু বড় হ। সেই সময় বুঝতে না পারলেও বাবার সঙ্গে যখন সাক্ষাৎ হতো তখন বুঝতাম, বাবা, কাকা জ্যেঠা বা অন্যদের থেকে হৃদয় অনুভূতিতে কতটা মহৎ, কতটা উদার! আমার বাবা যেন তাদের থেকে হাজার মাইল লম্বা এক মানুষ। কি অনাবিল হাসি! আমাদের জড়িয়ে ধরে যখন দু’গালে চুম্বন করতেন তখন এক অদ্ভুত মায়া যেন ঝরে পড়তো তাঁর দু’চোখ বেয়ে। তাঁর সেই ভুবন ভোলানো হাসি আর আন্তরিক উষ্ণতা, আহা! মন জুড়ে এখনো হাহাকার করে বেড়ায়। তবু কি আর এই সুখ চিরস্থায়ী হয়! জানি সব সুখ চিরস্থায়ী হয় না। কারণ সুখেরও বয়স বাড়ে তাই তার মৃত্যুও ঘটে। আমাদের সেই উষ্ণতা বিক্রি করা মায়ের জীবনে যতটুকু সুখ ছিল হঠাৎই এক শীতের সকাল এসে সেই সুখ এক নিমেষে কেড়ে নিল।

আমার বয়স তখন এগারোI বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ভোরে ওঠে পড়ছি। মা প্রত্যেক দিনের মতো বাড়ির কাজ করতে বাইরে বের হয়ে গেছেন। ভাই ও বোন তখনো ঘুমিয়ে। সেই হালকা আলো, হালকা আঁধারে মতিকাকা ওরফে আব্দুল মতিন--- আমাদের বাড়িতে যিনি শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সারাবছর কাজ করতেন, সেই মতিকাকা উঠোনে দাঁড়ানো বড় বড় ধানের গাদার একটাতে মাথা ঠুকতে ঠুকতে আর্তনাদ করে উঠলেন, —“বড়বাবু, ছোটবাবু, সর্বনাশ হয়ে গেছে। মেজবাবু আর নেই! মেজবাবুকে কারা সুখচরের মাঠে মাডার করে চলে গেছে।” মতিকাকার সেই আর্তনাদে আমি চমকে উঠি,---মেজ বাবু! মানে আমার বাবা? একে একে বাড়ির বাইরে বের হয়ে এলেন আমার ঠাকুরদা, কাকা, জ্যেঠা সবাই। মা উঠোনে পাষাণ প্রতিমার মতো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। ঘরে ঘুমানো ভাই বোনের দিকে একবার তাকিয়ে আমি ছুটে গেলাম মার কাছে। তাঁর দু’হাত ধরে মুখের দিকে তাকাতেই তিনি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর শিশির সিক্ত সকালে সদ্য ধান উঠে যাওয়া নাড়া বাদা মাড়িয়ে মা আমাকে নিয়ে এগিয়ে চললেন সামনের দিকে। যেখানে আমার বাবা, আমার মায়ের প্রিয় মানুষ শুয়ে আছে সেই কৃষকের ঘামে ভেজা জমির দিকে।





শৈশবে গাজন মেলা

বৃ ন্দা ব ন  ঘো ষ

আমার দেশের বাড়ির নাম করমা। চাকুরি সূত্রে আমি এখন বিষ্ণুপুরে থাকলেও আমার সম্পূর্ণ শৈশব এ গ্রামেই কেটেছে।চারিদিকে গাছ-গাছালিতে ভরা আমাদের এই গ্রাম। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল এক বিরাট বড় শাল গাছ। বসন্তের ভোরে সেই গাছে বসে থাকা কোকিলের কুহু কুহু ডাক শুনেই ঘুম ভাঙত আমার। করমা গ্রাম থেকে চার কিমি পশ্চিমে পাঁচাল গ্রাম অবস্থিত। খুব বর্দ্ধিষ্ণু গ্রাম। নানা জাতির লোক এখানে বাস করেন। এখানে অনেক শিক্ষিত জ্ঞানী গুণী মানুষ আছেন। এই পাঁচালে রত্নেশ্বর শিব বাবার একটি বহু পুরণো মন্দির রয়েছে।অনেক অনেক বছর ধরে চৈত্র মাসের সংক্রান্তির আগের দিন ও সংক্রান্তির দিন এখানে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই গাজনকে নিয়ে পাঁচাল ও পাঁচাল গ্রামের চারিদিকে অবস্থিত দশ বারোটি গ্রামের বিরাট উন্মাদনা বেশ লক্ষ্যনীয়। বহু বহু দূর থেকে অসংখ্য মানুষ পাঁচালের এই  গাজন দেখতে ছুটে আসে। রাত গাজনের আগের চার দিন পাঁচালের আটচালায় সামাজিক পৌরাণিক ঐতিহাসিক যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয়। শৈশবে দাদার হাত ধরে এখানে যাত্রা দেখতে এসেছি অনেকবার। স্মৃতিপটে আজও তা স্পষ্টভাবে জ্বল জ্বল করছে।আমি যখন পাঁচাল উচ্চ বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হই তখন থেকে আমি, আমার জ্যাঠতুতো ভাই দীনেশ, পাড়াতুতো দাদা ভজন তিনজনে মিলে গামছায় মুড়ি বেঁধে সন্ধ্যা বেলায় পাঁচালের শিবের গাজন দেখতে যেতাম। তখন প্রায় ছয়শত শিবের ভক্ত সন্ন্যাসী হতে দেখেছি। পরশা নামক পুকুর  থেকে অনেক ভক্ত সন্ন্যাসী প্রণাম সেবা খেটে খেটে শিবের মন্দিরে বাবার কাছে এসে আশীর্বাদ প্রার্থনা করত। অনেক ভক্ত সন্ন্যাসী জিভে বাণ ফোঁড় করতো। এখনও হয়। বেশ মনে আছে তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। বাবার সাথে গাজন দেখতে এসে হারিয়ে যাই। এক বয়স্ক ভদ্রলোক সেটা বুঝতে পারে।তিনি আমাকে বললেন, তোর নাম কি রে খোকা, কোথায় বাড়ি, কার সাথে এসেছিস। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, বাবাকে খুঁজে পাচ্ছি না। ওদিকে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে আমার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে। বাবা-ই বলতে বলেছেন। তখন ভদ্রলোক সেখানে আমাকে নিয়ে গিয়ে বাবার হাতে তুলে দেন।

পাঁচালে গাজন উপলক্ষে নানা ধরনের বহু দোকান বসে, নাগরদোলা, সার্কাস আসে।ম্যাজিক শো হয়। রাত গাজনের পরের দিন দিন গাজন। ঐদিন চৈত্র সংক্রান্তি। ঐদিন পাঁচালে চড়ক হয়।

রাত গাজনের দিন  সারারাত গাজন দেখে ক্লান্ত হয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিতাম ভোরবেলা।সঙ্গে থাকত ফোলানো বেলুন, ডুগডুগি, আর দাদামশায়ের জন্য গুড় দিয়ে তৈরি কানমোচড়া।





আমার শহরে পৌষের গুনগুন                            

ম ধু প র্ণা  ব সু 

এখন কলকাতার শীত ভীষণ দামী। কালেভদ্রে কপালে থাকে সেই সক্কাল বেলা, লেপের তলা থেকে উঠতে গায়ে জ্বর আসা বেলা, বোনরা মিলে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোলে বলা, এই দ্যাখ, তামুকে দুচারটে টান দিলাম। চারিদিক কুয়াশার চাদরে ঢাকা, পাশের কারখানায় সকাল নটার সাইরেন বেজে উঠল। চলচল!ডিউটি শুরু। শুয়ে শুয়ে শুনতে পাওয়া গভীর রাতে পাড়ার খ্রিস্টান পরিবারের ঘরে ঘরে বড়দিনের ক্রিসমাস ক্যারেল গাইতে আসতো চার্চের মিশনারীরা, আমরা দক্ষিণ দালানের জানলা থেকে শুনতাম ঘুমন্ত চোখে।

হোসেন শা পার্কের ভিজে পাতায় শিরশিরানি, টুপটাপ পদ্মপাতায় শিশির। একটু রোদের দেখা পেলেই বাঁদর টুপি মাথায় পাড়ার দাদুর কনকনে ঠান্ডায় মোড়ের দোকানে মাদার ডেয়ারির প্যাকেট অথবা গরম কচুরি কিনতে আসত। আমাদের দক্ষিণ বারান্দায় যখন সারি সারি জানলা দিয়ে মিঠেকড়া রোদ পড়তো, এক একটা রোদে আমরা ছয় বোন, পিঠে পিঠ দিয়ে বসে কমলালেবু ছাড়িয়ে খেতাম আর দুষ্টুমি করে খোসাগুলো এর ওর চোখের কাছে চিপে দিতাম, চোখ জ্বালা করতো... সেটাই ছিল মজা। রান্নাঘর গন্ধে বিভোর হতো পিঁয়াজকলি দিয়ে ছোট ট্যাংরা মাছের ঝাল, সাদা ফুলকপির বাটিচচ্চড়ি আর ফুলকো লুচিতে। রাতে রোজ সবজি দিয়ে ঘন মুসুর ডাল বেগুন পোড়া আর ম্যান্ডেটারি শেষ পাতে খেজুর গুড়ের সুজির পায়েস, আহা! মনটা কেঁদে হুহু করে উঠল। গিরিশ একরকম ছোট্ট গুড়ের কড়া পাকের গুলি সন্দেশ বানায়, তখন ২ টাকা পিস ছিল। মুঠো ভরে খেতাম। মনে আছে ছোটবেলায় ডিসেম্বরে রাজস্থান ভ্রমণে আমি আর মিঠু রাতের ট্রেনে চুপিচুপি খেয়ে ফেলেছিলাম এক বাক্স জয়নগরের মোয়া। ব্যাস, সকাল বেলা আর কেউ পেলনা তার ভাগ!

শীতের শহরে শিশিরে ভিজে ট্রামলাইন, মাঠে মাঠে ফুটবল আর ক্রিকেট প্র‍্যাক্টিস, লেকের জলে রোদের ঝিলমিল উৎসাহী মর্নিং ওয়াকারদের সোয়েটার জ্যাকেটের কোলাকুলিতে বেশ গরম হয়ে ওঠে। ভিক্টোরিয়ার পরীর পেলব শরীরের হাতছানি তো একদিন চিড়িয়াখানায় চড়ুইভাতি ডিম পাঁউরুটি টিফিনকেক। আমাদের বাড়ি চিড়িয়াখানার কাছে বলে ছোট বেলায় অনেক রাতে নিস্তব্ধতা ঘুচিয়ে বাঘের ডাক শুনতে পেতাম। শনি-রবিবার মানেই ঘুরে বেড়ানো মেলার মাঠে আর বাবুর সাথে গড়ের মাঠে ঘুড়ির প্যাঁচ দেখতে যাওয়া...

শীত ছুঁয়ে যায় মনের কুঠুরিতে, রুক্ষ অসজ্জিত পাহাড়ের মাটিরঙ বুকে, ছাদ বাগানের রঙিন পিটুনিয়া, কসমস, জারবেরা, গোলাপি কাগুজে বোগেনভিলিয়াকে লিখে দিয়ে আসি নীরব শুভেচ্ছা। চলন্ত রোমন্থন অদৃশ্য ছবি হয়ে ডিসেম্বরে পার্ক স্ট্রিট, বো ব্যারেকে, সাউথ সিটি কোয়াস্ট মলে জ্বলজ্বল করে ঠিকরে পড়ে। 
আমিও ভেসে যাই মুহূর্তের ভাসানে, ধোঁয়া ওঠা ক্যাপুচিনো, রকমারী ককটেলে, সান্তাবুড়োর ওয়েলকাম বার্তা যৌবন প্রৌঢ়ত্ব তফাৎ ঘুচিয়ে টেকনিক্যালি আপগ্রেড করে তোলে আমার সচেতন সত্ত্বাকে। 

শীতের আমেজ এইসব আদরের স্মৃতিতে মুখর। নেই, নেই যেন কি এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, মনের চিন্তাহীন জড়িয়ে পড়া। শুধু স্মৃতিতে সব নড়েচড়ে, বেঁচে থাকে। থাকবেও যতো দিন না এই প্রদীপের সলতেটা নিভে যাচ্ছে।




কলাপাতায় বেগুনভাজা
 
সু মা  গো স্বা মী 

বড়ো কাঁঠাল পিঁড়িতে ঘি মাখানো হয়ে গেছে, ঠাম্মা এক দৌড়ে চলে গেলেন নিরামিষ রান্নাঘরে। সাঁড়াশি দিয়ে ধরে বড়ো একটা কড়াই এনে হাজির হলেন পিঁড়ির সামনে। পিঁড়ির ওপরে উপুড় করে ঢেলে দিলেন কড়াইতে থাকা পাক দেওয়া নারকেল। আর তারপর খুন্তি দিয়ে সমান করে দিলেন সেই নারকেলের মন্ড। ঠাম্মার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় এরপর তৈরি হলো চৌকো আকারের নারকেলের তক্তি।

সংসারের ঊনকোটি কাজ সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া মধ্যবয়সী আমি আজ হঠাৎ করেই চলে এসেছি ঠাম্মার বাড়িতে।

যশোর রোড ধরে আসার সময়ই দেখতে পেয়েছিলাম রাস্তার দুপাশে গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। পরিবর্তনটা তখনই চোখে পড়েছিল। সময়টা নেহাত কম নয়, প্রায় বারো বছর পর আমি আজ এলাম ঠাম্মার বাড়িতে।

বড়ো ছেলের যখন দু বছর বয়স তখন এসেছিলাম মা-বাবার সাথে ঠাম্মার বাড়িতে। আর তারপর আজ এলাম। মাঝের বছরগুলোতে ছোট ছেলের জন্ম, বড়ো ছেলের স্কুলে ভর্তি হওয়া, এরপর নিয়ম মেনে ছোট ছেলের স্কুলে ভর্তি হওয়া- এসব নিয়েই ব্যতিব্যস্ত ছিলাম আমি।

বাড়িতে ঢোকার মুখেই অবাক হয়ে গেলাম। বাড়ির চারপাশের গাছগুলো কোথায় গেল! কিছুক্ষণ পর মনে পড়লো বাড়ির চারপাশের জমি ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেছে আর তারপর সেগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। এখন শুধু বাড়িটাই তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

ঠাম্মার নিরামিষ রান্নাঘর থেকে সুগন্ধ ভেসে আসছে। 'কি রান্না করছে রে ঠাম্মা'? 'দুপুরে খাওয়ার সময়ই দেখতে পাবি' রুবিদির উত্তরটা মনমতো হলো না আমার। ববিদি হাঁফাতে হাঁফাতে হাজির হলো, 'কলাপাতায় খাবি নাকি রে? সেজকাকু বলছে নেমন্তন্ন বাড়ির মতো আজ খাওয়া দাওয়া হবে । ঠাম্মা তো বড়ো বড়ো বেগুন ভাজছে, মেজপিসির বাড়ির বিয়েবাড়ির মতো'। এবার বুঝতে পারছি গন্ধটা বেগুনভাজার। আমাদের শহরের বাড়ির আড্ডায় মা অনেকবার ঠাম্মার বেগুনভাজার কথা বলেছে, 'যেমন তার গন্ধ তেমন তার টেষ্ট।'

'পোলাপান চলো সব কলাপাতা কাটি, সেজকত্তার অর্ডার হইয়েছে 'দা হাতে মেজজেঠু এগিয়ে চলেছে সেনাপতির মতো, পেছন পেছন চলছে তার সৈন্যদল ববিদি, রুবিদি, ঝুমা (মেজজেঠুর মেয়ে), আমি আর বোন (বাড়ির সেজকত্তা অর্থাৎ আমার বাবার মেয়ে)।

ঝপাঝপ স্নান সেরে সবাই বসে পড়েছি। কলাপাতায় তখন উচ্ছে লাউ দিয়ে তিতার ডাল আর ইয়া বড়ো বেগুনভাজা। বেগুনের বোঁটা আছে। 'ভুল কইরা বোঁটাখান খাইয়ো না' এক গেরাস ভাত মুখে ঢোকানোর আগে বাবার সর্তকবাণী।

'আরে হ, তুই ভালো কইরা খা তো। শহরে কি যে খাস সব তো ভেজাল। আমি দেখতাছি মাইয়াদের', ঠাম্মার সবদিকে নজর ঠিক যেন মা দুগ্গা।

'সব ভাত ডাল দিয়া খাইয়ো না, ঠাম্মা আরো দুইখান তরকারি করসে, আমি পরে মাছ দিমু', মেজজেঠি আমিষ রান্নাঘরের দাওয়া থেকে হাঁক দিলো।

'আমাদের দিয়া তুমিও খাইয়া লও মা', আলু-কুমড়োর ছক্কা দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে মেজজেঠুর সহাস্য মন্তব্যে ঠাম্মার উত্তর ছিল, 'কি যে অন্যায্য কথা কস তার ঠিক আছে! বউদুটো পেটে কিছু দেয়নি এহনতরি'।

'সে কি কথা! বৌদি তোমরা কিছু খাওনি সক্কালবেলা'? প্রশ্নটা মেজজেঠিকে করলেও বাবার দৃষ্টি ছিল একমাথা ঘোমটা দেওয়া আমার মায়ের দিকে। মা মৃদু হেসে ঘাড় নাড়লো। ঠাম্মার বাড়িতে এলেই মা একমাথা ঘোমটা দিয়ে খুব আস্তে আস্তে কথা বলতো। চাকরি করা বৌয়ের এমন রূপ ঠাম্মার ভীষণ অহংকারের কারণ ছিল।

'আরে খাইছি গো খাইছি, তোমার বৌও খাইছে'। মেজজেঠি আঁচল দিয়ে হাসি আড়াল করলো।

'আরে তুই কখন আইলি রে মনা'? তাকিয়ে দেখি মেজজেঠি দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। অনেক পাল্টে গেছে জেঠি, বয়েস থাবা বসিয়েছে শরীরে। কিন্তু নিরামিষ রান্নাঘরের গন্ধ, খাওয়া দাওয়া, ঠাম্মা, বাবা, মেজজেঠু, কলাপাতা, বেগুন ভাজা সব কোথায় গেল!

ব্যস্ত, একঘেয়ে প্রতিদিনের রুটিনের মধ্যে একঝলক টাটকা বাতাসের মতো অতীতের সোনাঝরা সময়টা সেলুলয়েডের মতো মঞ্চস্থ হয়ে গেল আমার দৃশ্যপটে।

বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীতে হেঁটে এলাম তাহলে!





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

চতুর্থ বর্ষ || দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল ও বাসন্তী সংখ্যা || ৯ চৈত্র ১৪৩১ || ২৩ মার্চ ২০২৫

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪