অণুগল্প
গল্প নয়
ভা র্গ বী
বাবাই ওঘরে তৈরি হচ্ছে। বেরোবে একটু পরে বাবাইয়ের বাবা নির্মাল্য এলেই। বসুধা ড্রেসিং টেবিলে বসে সাজছিলো। নিজেকে রং তুলিতে আঁকতে গিয়ে থমকে তাকালো নিজের দিকে। এত সাজছে মুনাইয়ের বিয়েতে যাবে বলে সে কি খুব খুশি? নাকি প্রিটেন্ড করছে খুব খুশির একটা আবহের মধ্যে আছে বলে। ঠোঁটে ব্লাড রেড লিপস্টিকটা লাগাতে গিয়ে দেখলো নিজের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির রেখা। কিন্তু আয়নার কাঁচের প্রতিচ্ছবিতে কোনো হাসি ধরা পড়ছে না সেখানে কেবল একটা খুশি মুখের অবয়ব। বসুধার নিজেকে বড়ো পাকা অভিনেত্রী মনে হয়। মনে হয় কেন বলছে সে পাকা অভিনেত্রীই বটে। নিজেকে বার কয়েক অস্কার দিয়েও দিল নিজের মনেই।
অভিনয় করে কেন সে? আকাশ পাতাল ভেবে বোঝে জীবন একটা রঙ্গমঞ্চই বটে। অভিনয় করা হয়তো কতকটা প্রয়োজনে, কতকটা দেঁতো ভদ্রতায়, আর কিছুটা নিজের একটা চালচিত্তির উপস্থিত করার অভ্যেস। সে নিজেকে জানে। সে জানে অভিনয়ের বাইরে তার একটা মন আছে। আর সে মন জুড়ে কত ভালবাসার কুঠুরি বানিয়েছে।একটিও মিথ্যে নয়। সে সব থাকা সত্ত্বেও এটাও সত্যিই বটে যে জীবনের সাথে তালমিলিয়ে সবাই অভিনয় করে। বাবাই অঙ্কের স্যারকে পছন্দ না করলেও মাথা নামিয়ে সম্মান দেখিয়েই কথা বলে। নির্মাল্য বসের সাথে এক ভাবে স্টাফের সাথে এক ভাবে কথা বলে। বসের ফোন রেখে গালাগাল দিতেও দ্বিধা করে না, "উফ জ্বালালে দেখছি ছুটির দিনেও ড্যাসটা।" ড্যাসে কি বলে সে সব বাদ রাখাই ভাল। অথচ বসুধাকে কেমন টক করে বলে, "উফফ সোনালী বৌদির সাথে দেখা হলে কি করে যে এত হেসে কথা বলো মনে হয় এক আত্মা এক প্রাণ।" বসুধা বলে, "করতে হয় নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়।" গায়ে মাখে না। অথবা অভিনয় ক'রে গায়ে মাখেনি ভাব দেখায়। ফোনটা বেজে উঠতে ভাবনায় ছেদ পরে বসুধার। নির্মাল্যর ফোন। দেরী হবে। বসুধা কপট রাগ দেখায়। ফোনটা রেখে ভাবে ভাল হয়েছে একটু নিজের সাথে থাকার সুযোগ পাওয়া গেছে। নিরবিচ্ছিন্ন অভিনয়ে একটু ব্রেক পাওয়া গেল। সেদিন কি কথায় বাবাই বললো তুমি ভালো অভিনয় করলে কিন্তু। গায়ে লাগে। তার অভিনয়টাকে এত হাইলাইট করা হচ্ছে কেন? কেউ নিজের বউয়ের সামনে কেউ সন্তানের সামনে কেউ প্রতিবেশীর সামনে কেউ কাস্টমারের সঙ্গে সবাই সবার জায়গায় অভিনয় করে তবুও! নাঃ! আর থাক এই অনেক সাজ হয়েছে। ড্রেসিংটেবিলটা গোছাতে গোছাতে ভাবে বসুধা। সে একজন খুব ইমোশনাল মানুষ। বাবা বলতো ইমোশনাল ফুল। কিন্তু তারপরেও বলতো ইমোশনের জায়গাগুলো একদম ব্যক্তিগত বুঝলি মা। সবার সাথের তুই আর তোর নিজের সাথের তুই দেখবি একদম আলাদা। হয়তো তুই একটা সত্যি ইমশানের জায়গা থেকে অনুভূতি থেকে একটা এক্সপ্রেসন দিবি দেখবি অন্য চোখে উফ বাড়াবাড়ি, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ এমন সব শুনবি। এটাই জীবন বুঝলি। পুরোটাই দেখবি ফাঁকি। নিজের পাশে নিজেকে ছাড়া কাউকে আশা করিস না মা।
বাবা তাহলে ভালবাসা???
সেটাও তোর অনুভূতি। প্রকাশে তা কলুষিত হবে। গোপনে রাখাই ভাল। বাবা তবে নিজের জনের সাথেও রেখে ঢেকে ইমোশন লকারে তুলে কথা বলবো নাকি আমরা।
বাবা মুচকি হেসে বলেছিল তোর মতো মেয়ে আমার আছে আর তো কারও নেই। তাই তোর আর আমার মধ্যে সবটাই প্রকাশিত।সেখানে লকার ব্রাত্য। তবে বাকি ক্ষেত্র সময় এবং জীবন তোকে বোঝাবে। আমি তো ত্রিকালজ্ঞ পন্ডিত নই। তবে তোর আমার মতো সম্পর্ক একহাজার কোটিতে একটা।
বসুধা একা থাকলে আকাশ থেকে তারার আলো এসে পড়ে ওর কপালে। বাবা ছুঁয়ে যায় ওকে। এ সময়টা অনুভূতির অভিনয়ের নয়।
বেল দিল নির্মাল্য। অনুভূতিতে লম্বা যতি চিহ্ন দিয়ে দরজা খুলেই বললো, "দেখ কেমন সেজেছি বলো।" নির্মাল্য চমৎকার বলে চটপট রেডি হয়ে নিল, ভীষণ খুশি মনে ওরা মুনাইয়ের বিয়েতে চলে গেল।
আমার গল্প এমনই। এ গল্পে কোনো গল্প নেই।
রণ
সু দী প ঘো ষা ল
ধমাস,দুম...
গুলি চলছিল, বোমাবাজিও...
তার মাঝে পড়ে গেছিল ইতু। ইতু একটা স্কুলে পড়ায়। বিয়ে করে নি। সংসার তরীর কান্ডারী সে।তার তরী সাতজন যাত্রীতে বোঝাই, ঠাঁই নাই...
ছাত্রীরা, ইতু ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকলেই জ্যোৎস্না রঙের হয়ে যেত। মুখমন্ডলে চাঁদ, ধুয়ে দিত পাশ ফেলের কচকচানি। ইতু ম্যাডাম যাদুকাঠি বুলিয়ে কালো বোর্ডে ছাত্রীদের রঙীন ভবিষ্যতের ছবি আঁকতেন।
ইতু ম্যাডাম একদিন স্কুলে না এলে, স্কুলে আসত প্যাঁচার দল, তারা দিনকে রাত বানিয়ে দিলে ছাত্রীরা ম্লানমুখে বাড়ি ফিরত।
ইতু ম্যাডাম আজ স্কুলে এসে ক্লাসের ভিতরে ছাত্রীদের সঙ্গে ভিজতে ভিজতে চলে গেলেন মনগঙ্গার তীরে। সেখানে চল্লিশ মিনিট জম্পেশ জোয়ারে সাঁতার কেটে স্টাফরুমে বসলেন।
স্টাফরুম কন্টকপূর্ণ হতেই ছেঁড়া মনটাকে সেলাই করার জন্য মেয়েদের সঙ্গে টিফিন সারলেন ধীরে ধীরে।
তারপর আবার মোমবাতি নিয়ে ঢুকলেন শ্রেণীকক্ষে, আলো ছড়িয়ে বের হলেন আপন তরীর সন্ধানে।
'একা মোর গানের তরী, ভাসিয়ে দিলেম নয়নজলে' ইতু পূর্ণ হলেন গানের ছোঁয়ায়।
গন্তব্যের দিকে কী একটা গন্ডগোল হচ্ছে। হাজার মানুষ একে অপরকে বিদ্ধ করছে তীক্ষ্ণ অস্ত্র দিয়ে, রাস্তার রঙ লাল কেন?
কৌতূহলী ইতু ভিড়ে ঢুকতেই হারিয়ে গেলেন। অনেক হাত, কার হাত চেনা দায়। সমাজ ছিঁড়ে, লজ্জা ছিঁড়ে, ভূষণ মাটিতে গড়িয়ে পৈশাচিক আনন্দে মশগুল। ইতু রক্তাক্ত, মাটিতে পড়ে বল্কলহীন বৃক্ষ, আরোহী ডাল নাড়ায়, পাতা ছেঁড়ে। ইতুর চিৎকার ঢাকা পড়ে যায় গন্ডগোলের বীভৎস শব্দে,
ধমাস, দুম....
প্রাক্তন
মে খ লা ঘো ষ দ স্তি দা র
নাগরিক ভিড় ঠেলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সোহমের সন্ধ্যা সাতটা বেজে যায়, নিজেই চাবি দিয়ে তালা খুলে ঘরে ঢোকে, পোশাক ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসে, ফ্লাস্কে রাখা চা কাপে ঢেলে চুমুক দিতে দিতেই সায়নীর মা এসে কলিং বেল বাজায়, কাপ হাত নিয়েই দরজা খুলে দেয় সোহম।
সকালে রান্না করে চলে যায় তারপর আবার রাতের রুটি - তরকারি করতে আসে সায়নীর মা, সোহম বাড়ি ফিরে কোনোদিনই সাথীকে পায়না, ও তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে সান্ধ্য-ভ্রমণে, আটটা সাড়ে আটটার মধ্যে ঘরে ফেরে, তারপর ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যা দেখিয়ে ঠাকুরকে ভোগ দিয়ে পূজা সেরে শয়ন শয্যা করে ঠাকুরকে শুইয়ে দিয়ে তারপর সোহমের সঙ্গে এসে দেখা করে, ততক্ষণে সায়নীর মা ডিনার বানিয়ে চলে যায় তাও প্রায় নটার মধ্যে।
একদিন রাত দশটা বেজে গেলো সাথীর তখনো দেখা নেই। সোহম ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে মাঝে মাঝেই উত্তেজিত হয়ে উঠে সায়নীর মাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো সাথী কোথায় গেছে সে ব্যাপারে কিছু জানে কি না বা সাথী কিছু বলেছে কিনা...
সায়নীর মা বলে সে কিছুই জানে না আর একথাও বলে সাথীবৌদি তাকে কিছুই বলে যায়নি, সোহম কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না ওদিকে সায়নীর মাকে আটকে রেখেছে ওরও বাড়ি যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে ঠিক এমন সময়ে সাথী প্রবেশ করলো ঘরে, কারোর সঙ্গে কথা না বলে সোজা চলে গেলো নিজের বেডরুমে।
ঘন্টাখানেক বাদে সোহম ঢুকলো সাথীর রুমে, চুপিচুপি ব্যাগটা খুলে তন্ন তন্ন করে কী যেন খোঁজার চেষ্টা করলো, হঠাৎ ব্যাগের ভিতরের চেন খুলতেই একটা ছবি আরেকটা প্রেসক্রিপশন চোখে পড়লো। অবাক হয়ে বার বার দেখতে লাগলো সেই ছবিটা। সোহমের ক্লাসমেট অমিতাভ। সাথীর প্রাক্তন।
বন্ধু
র মে শ দে
একজন বৃদ্ধ বাজারে কিছু পেয়ারা নিয়ে বিক্রি করতে এসেছিল। লোকজন এসে দাম নিয়ে বচসা করছিল। কিন্তু বৃদ্ধ মানুষটি বিক্রি করার জন্য খুবই অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। তাই কম দামে বেচে চলে যেতে চাইছিল। একজন ভদ্রলোক দূর থেকে সবকিছু দেখছিলেন। তিনি গিয়ে বেশি দামে সব কিনতে চাইলেন। তিনি বৃদ্ধ মানুষটিকে বললেন, 'আপনি কেন কম দামে দিতে চাইছিলেন?' বৃদ্ধ মানুষটি বললো, 'আমি একজন পিতা,
ছেলে আজ দুইদিন ধরে খুব অসুস্থ, তাকে ডাক্তারখানাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুবই টাকার প্রয়োজন ছিল। আপনি সবগুলো কিনে আমাকে অর্থাৎ এক বয়স্ক পিতাকে বাঁচালেন, আপনি আমার কাছে ভগবান। ভদ্র লোকটি বললেন,'--- না, না বাবা আমি ওসব কিছুই নই।' 'তাহলে আপনি ভগবানের বন্ধু হবেন।' --- ভদ্রলোকটি কিছু না বলে বৃদ্ধ মানুষটিকে প্রনাম করে চলে গেলেন। ভাবলেন ভগবান হওয়া কি মুখের কথা? অপকার না করি, কিন্ত কারো উপকার তো করা যায়!
টীকের টিকে থাকা
সু নৃ তা রা য় চৌ ধু রী
জগদ্দল শরীর নিয়ে এত্তোখানি জায়গা জুড়ে বসে আছো, পারবে টিকতে? বাড়ি তো ভাঙা হচ্ছে, যাবে কোথায়? চ্যালাকাঠ হবে? হিহিহি!"
পালঙ্ক বলে, "সেই বর্মার আসল টীক খোদাই করে আমাকে গড়েছিল, বুঝলি? দ্যাখ কেমন সিংহের মতো পায়া, ছত্রিতে কেমন কারুকার্য! যখন রোজ ঝাড়পোছ হতো, ঝকঝক করতাম। কোথায় লাগে তোদের সানমাইকা।"
"রাখো তোমার টিকটিক! জানো আমি মোল্ডেড কাঠের। গায়ে উই ধরেনা।"
"তোদের গায়ে উই ধরেনা তো ঘেন্নায়! আর আমাকে ধরতে এসে চোয়াল ভেঙে উই আর পালাবার পথ পায়না। কত প্রজন্মের কত জন্মমৃত্যুর সাক্ষী আমি!"
চারদিকে ভাঙনের শব্দ, তার মধ্যে কারা যেন সাবধানে ধরাধরি করে পালঙ্কটাকে বার করে নিয়ে গেল। টীকের তৈরি পালঙ্ক এযাত্রাতেও টিকে গেল অ্যান্টিক হিসেবে।
একটি সংক্ষিপ্ত প্রেমের গল্প
পা র মি তা দা স চৌ ধু রী
আজকে একটা মজার অভিজ্ঞতা হলো। বাজার করে সবে টুকটুকে উঠেছি। আমার সামনের সিটে এক সুদর্শন তরুণ এসে বসলো। সেও বাজার সেরে ফিরছে। ভারি ব্যাগটি তার পাশে রেখে সে নিজের মনেই বসে ছিল। যথারীতি টুকটুক চলছে। কিছুদুর আসার পরে এক অপরূপা সুন্দরী তরুণী টুকটুকে উঠে তার পাশে বসে। সেই তরুণীটি ছিল সুসজ্জিতা। বসার সাথে সাথেই সে একবার তরুণটিকে ভালো করে দেখে। কিন্তু সেই ছেলেটি তখন এত অন্যমনস্ক ছিল যে সে এসবের কিছুই বুঝতে পারেনি। মেয়েটি বেশ কয়েকবার তার কাজল চোখের কটাক্ষে তরুণটির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। একটু পরেই মেয়েটির গন্তব্য এসে যাওয়ায় সে নেমে যায়। আমি উলটো দিকে বসে এসব দেখছিলাম। হঠাৎ একটা হিন্দি সিনেমার ডায়লগ মনে পড়লো--- "কৌন হে ওহ জিসনে দোবারা মুরকে মুঝে নেহি দেখা"?
উপ-সংহার
মৈ ত্রে য়ী সে ন গু প্ত
ছোটবেলার বান্ধবী তিয়াসার জন্যে একটা নদী কিনবে ভেবেছে বাবান। নদীর মতোই মেয়েটার স্বভাব উচ্ছল, প্রানবন্ত। কোনো নিয়মের বেড়া জালে বাঁধা পড়ে না ওর গতি। ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড়ো হওয়া ওদের। তিয়াসার বাবা আবার বাবানদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ফলে ওদের বাড়িতে যাতায়াত বরাবরই ছিল বাবানের। গলির ক্রিকেট খেলা থেকে প্রথম সিগারেট, ওপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মারামারি থেকে প্রথম বিরহের ব্যথা সবেতেই বাবানের সঙ্গী তিয়াসা। কখন যে মেয়েটা তার জীবনে এমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেল কে জানে? জলঙ্গীর তীরে বসে এসবই ভাবছিল বাবান। আজ তিয়াসার জন্মদিন। কী উপহার দেওয়া যায় তাকে? আজ প্রায় কুড়ি বছরের সম্পর্ক। এতো বছরে কত কিছু বদলেছে! এই জলঙ্গীও তো আর আগের মতো পরিপূর্ণ নেই, তার বুকেও জমেছে চড়া। বাবান উঠে পড়ে নদীর ধার থেকে "নাহ, আজ অনেক কাজ আছে।" সেখান থেকে সে যায় 'নন্দিনী' নামের একটা এনজিওতে। এরা সমাজের সমস্ত নিপীড়িত মহিলা ও শিশু কন্যাদের নিয়ে কাজ করেন। তবে এখানে প্রথম আসলে বোঝা যায় না সমাজে এখনও মেয়েরা পণ্য। এখানে যে মেয়েরা থাকে তারা সকলেই উচ্ছল, প্রাণবন্ত জীবনযুদ্ধে কেউ হার মানেনি। কিন্তু এদের গল্পগুলো শুনলে বোঝা যায় এখনও সমাজ কতটা ভয়ংকর। এখানে বাবান প্রায়ই এসে সময় কাটায়। এরা সকলেই বাবানকে খুব ভালোবাসে। এই বিশেষ দিনে তিয়াসার জন্যে ওরা অনেক আয়োজন করেছে। কেউ নিজের হাতে কেক, পায়েস বানিয়েছে, কেউ আবার সুন্দর কার্ড আর ফুলের গুলদস্তা। বাবানও ওদের জন্য অনেক খাবার দাবার এনেছিল। তারপর বাবান গেল তিয়াসার কর্মস্থল, ওর প্রিয় স্কুলে। সেখানেও অনেক অনুষ্ঠান ছিল আজ। ছাত্র ছাত্রীরা অনেক গান নাচ আবৃত্তি করল। এসমস্তটাই তো তাদের প্রিয় দিদিমনির জন্যে। বাবাণের মনে পড়ছিল তার সেই প্রথম তিয়াসাকে প্রেম প্রস্তাব দেবার দিনটির কথা। সেদিনও ছিল তার জন্মদিন। সে স্কুল থেকে ফিরছিল একটা আশমানী নীল শাড়ীতে। কিছুটা এলোমেলো চুল এসে পড়ছিল চোখে মুখে। ঠোঁটের কোণে সেই চিরপরিচিত হাসিটুকু লেগেছিল। ওরা হাঁটছিল পাশাপাশি। "আজ তোকে একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে!" বাবানের এই কথার উত্তরে একটা দমকা হাওয়ার মতোই খিলখিল করে হেসে ওঠে পাগলীটা, বলে, "লাগবেই তো আজ আমার জন্মদিন বলে কথা! বল, আজকে কী উপহার দিবি আমাকে? এবারে কিন্তু ইউনিক কিছু চাই, একদম আনকোরা।" বড্ড ভাবনায় পড়ে যায় ও। কী দেবে, কী বলবে? হঠাৎ ওর হাতটা ধরে তিয়াসা, বলে, "আমার তোকে চাই।" নিমেষে যেন বিদ্যুত খেলে যায় ওর শরীর জুড়ে। এটাই তো ও বলতে চেয়েছিল। কি অদ্ভুত ভাবে মেয়েটা ওর মনের সব কথা বুঝে যেত কে জানে! স্কুল থেকে বেরিয়ে বাবান এবার চলেছে বাড়ির পথে। তার আর তিয়াসার ছোট্ট সংসার। আজ তিয়াসাকে চমকে দেবার মতো উপহার আছে তার কাছে। বহু বছরের কাঙ্ক্ষিত উপহার। বাবান জানে আজ তিয়াসার চোখ দুটো সেই আগের মতোই জয়ের খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠবে। ঘরে ঢুকে কালো কোটটা খুলে বিছানার উপর রাখে বাবান। সূর্যমুখী ফুলের গুলদস্তাটা নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায় তিয়াসের। "আজ আমরা জিতে গেছি, আমাদের বহু কাঙ্ক্ষিত সুবিচার পেয়েছি আজ। যে শয়তানগুলো সেদিন তোর গায়ে অ্যাসিড ছুঁড়েছিল তাদের আজ আমি শাস্তি দিতে পেরেছি। আমাদের দীর্ঘ পাঁচ বছরের লড়াই আজ শেষ হল। তুই খুশি হয়েছিস না রে? বল না? "ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বাবান। কোথাও যেন মনে হয় ছবিতে তিয়াসার চোখেও জল ভেসে ওঠে। আর সেই চোখের জলে প্লাবন লাগে ছোট্ট নদী জলঙ্গীতে। বহু বছর পর দুটি হৃদয় সেই জলে হারিয়ে যায়। একাকার হয়ে যায় এপার ওপার।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন