গল্প


এক শীতের সকাল ও আমার মা

মো য়া ল্লে ম না ই য়া
    
এই মধ্য বয়সে শীতের সকাল এলে কুয়াশায় মোড়া মনের বারান্দায় শৈশবের বহু স্মৃতি এসে ভিড় করে। যে স্মৃতির অনেকটা অংশ জুড়ে ঢেকে আছে বেদনার ধূসরতা। একা হয়ে যাওয়ার বিপন্নতা। ভাবতে গেলে সবকিছু কেমন যেন দুঃস্বপ্নের মতোই মনে হয়। এখনকার মতো তখনকার সকাল তো আর দেরিতে আসতো না! সূর্য ওঠার আগেই তার ঘুম ভেঙে যেত। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা এর কোন ব্যাত্যয় ঘটতো না। তখন ছোট বড় সবাই পাখি ডাকার সাথে সাথে জেগে উঠতো। শিশির স্নাত দুর্বাঘাস মাড়িয়ে মেঠো পথ ধরে তারা ছড়িয়ে পড়তো নানান কাজে। সেই শৈশবের সকালে আমরা যখন লেপের তলায় আধো জেগে আধো ঘুমে, মা তখন চুপিসাড়ে আমাদের উষ্ণ আরামকে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে সকালের শীত মেখে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন গৃহস্থালির কাজে। অন্যদিকে বাবা ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন মানুষ। কচ্চিৎ কদাচিৎ তাঁর সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হতো। তবে সাক্ষাৎ হলে তিনি হাজার বছরের সুখ যেন একদিনেই মিটিয়ে দিতেন। সারাদিন আমাদের মতো হয়ে আমাদের সঙ্গে মিশে যেতেন। বোঝাই যেত না এই মানুষটাকে আমরা আমাদের জীবনে খুব কম পেয়েছি। তিনি কখন ফিরতেন কখন ঘুমাতেন, তা আমরা কেউ জানতেই পারতাম না। আমরা মানে আমাদের দুই ভাই ও বোন। আমি বড় হওয়ায় মাঝে মাঝে বাবাকে দেখেছি মধ্যরাতে ফিরতে, কখনো বা এক সপ্তাহ দু সপ্তাহ বাড়ির বাইরে কাটিয়ে দিতেI ঠাকুরদা অর্থাৎ আমার বাবার বাবা ছিলেন, ওই এলাকার এক বর্ধিষ্ণু ধনী ব্যক্তি। বাবা ছাড়া তাঁর বাকী চার ছেলে সবাই প্রতিষ্ঠিত। তাই তাঁর চোখে বাবা ছিলেন নিষ্কর্মা, ধ্বংসের প্রতীক। অথচ পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বাবা নাকি ছিলেন সবচেয়ে তুখোড় বুদ্ধির অধিকারী। কিন্তু তিনি তাঁর সেই বুদ্ধিকে বৈষয়িক কাজে না লাগিয়ে পার্টি পাল্লা, মিটিং মিছিল, মানুষের দাবি-দাওয়া, তাঁদের সুখ দুঃখ ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করতেন। মায়ের মুখ থেকে শোনা--- তিনি ছিলেন কোনো এক বামপন্থী দলের সদস্য। ঠাকুরদার ভাষায়, ছোটলোকের দল। যাদের ঘর নেই, দোর নেই, না খেতে পাওয়া, অশিক্ষিত হা-ভাতের দল।  ফলে, ঠাকুরদার সংসারে বাবার মূল্য ছিল ভোজন শেষে ফেলে দেওয়া কলাপাতার মতো। আর আমরা তো জানি, প্রতিটি যৌথ পরিবারে বৌমার মূল্য নির্ধারিত হয় ছেলের মূল্যের উপর। স্বাভাবিকভাবে আমার মায়েরও মূল্য ছিল খুবই কম। তাই হয়তো সংসারের কাজের জন্য মাকে বিছানা ছেড়ে আগেই উঠে যেতে হতো। সব কাজ সেরে তিনি যখন আমাদের কাছে আসতেন তখনও শেষ রাতের অন্ধকার গাছপালায় লেপটে থাকতো। আমরা ভাই-বোনেরা খুব অল্পতে সন্তুষ্ট ছিলাম। তাই অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হলেও কখনো দুঃখ পাইনি বা বাবা মার প্রতি কোন অভিযোগ করিনি। বাবা প্রকাশ্যে মায়ের সঙ্গে খুব কম কথা বলতেন। তবে যতটুকু বলতেন, তাতে তাঁকে কখনো হাসতে দেখিনি। আমরা ঘুমিয়ে পড়লে হয়তো বাবা-মা কথা বলতেন। তাই বুঝতে পারতাম না তাদের মধ্যে সম্পর্কটা কেমন ছিল! হঠাৎ একদিন ঘুম ভেঙে বিস্ময়ে দেখি, মা নিঃশব্দে বাবার বুকে মাথা রেখে অবিরত কেঁদে চলেছেন। বাবা তখন মায়ের মাথায় হাত বোলাচ্ছেন আর বোঝাচ্ছেন, বেনু, তোমাকে খুব বেশি দূরে যেতে হবে না। একটু বাইরে তাকিয়ে দেখো, তোমার গ্রামের গরীব অসহায় মানুষগুলো এই শীতের রাতে কীভাবে এক বেলা আধ বেলা খেয়ে, না খেয়ে, জরাজীর্ণ ভাঙা কুঁড়েতে শীতকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে! তুমি বা তোমার ছেলে মেয়েরা তবু তো লেপ, কাঁথা জড়িয়ে শীতগুলো অতিক্রম করতে পারছ? বলতো, ওদের কী হবে! ওদের জন্য আমরা কী করতে পেরেছি? মা জবাব দিতে পারতেন না, শুধু নীরবে নিজের নির্ভরতার জায়গায় অশ্রু বিসর্জন করে ক্লান্ত হয়ে যেতেন। আমার ওইটুকু বয়সে বাবার প্রতি মাঝে মাঝে ভীষণ অভিমান হতো। মা বুঝতে পারতেন। আদর করে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, তোর বাবার মতো বাবা এই পৃথিবীতে খুব কমই আছেন রে বাবু। আমি তখন মার দিকে তাকিয়ে বলতাম, মা এই সংসারে তোমাকে তো কেউ মূল্য দিল না। না বাবা, না দাদু, না জ্যেঠা-কাকা, কেউ না। এমন কি জ্যেঠি কাকিরাও না! তিনি ম্লান হেসে বলতেন, শত জন্মেও এমন স্বামী, এমন বাবা, এমন বন্ধু পাওয়া যায় নারে খোকা। আর বাকীদের কথা! তুই এখন বুঝবি না। একটু বড় হ। সেই সময় বুঝতে না পারলেও বাবার সঙ্গে যখন সাক্ষাৎ হতো তখন বুঝতাম, বাবা, কাকা জ্যেঠা বা অন্যদের থেকে হৃদয় অনুভূতিতে কতটা মহৎ, কতটা উদার! আমার বাবা যেন তাদের থেকে হাজার মাইল লম্বা এক মানুষ। কি অনাবিল হাসি! আমাদের জড়িয়ে ধরে যখন দু’গালে চুম্বন করতেন তখন এক অদ্ভুত মায়া যেন ঝরে পড়তো তাঁর দু’চোখ বেয়ে। তাঁর সেই ভুবন ভোলানো হাসি আর আন্তরিক উষ্ণতা, আহা! মন জুড়ে এখনো হাহাকার করে বেড়ায়। তবু কি আর এই সুখ চিরস্থায়ী হয়! জানি সব সুখ চিরস্থায়ী হয় না। কারণ সুখেরও বয়স বাড়ে তাই তার মৃত্যুও ঘটে। আমাদের সেই উষ্ণতা বিক্রি করা মায়ের জীবনে যতটুকু সুখ ছিল হঠাৎই এক শীতের সকাল এসে সেই সুখ এক নিমেষে কেড়ে নিল। 

আমার বয়স তখন এগারোI বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ভোরে ওঠে পড়ছি। মা প্রত্যেক দিনের মতো বাড়ির কাজ করতে বাইরে বের হয়ে গেছেন। ভাই ও বোন তখনো ঘুমিয়ে। সেই হালকা আলো, হালকা আঁধারে মতিকাকা ওরফে আব্দুল মতিন--- আমাদের বাড়িতে যিনি শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সারাবছর কাজ করতেন, সেই মতিকাকা উঠোনে দাঁড়ানো বড় বড় ধানের গাদার একটাতে মাথা ঠুকতে ঠুকতে আর্তনাদ করে উঠলেন, —“বড়বাবু, ছোটবাবু, সর্বনাশ হয়ে গেছে। মেজবাবু আর নেই! মেজবাবুকে কারা সুখচরের মাঠে মাডার করে চলে গেছে।” মতিকাকার সেই আর্তনাদে আমি চমকে উঠি,---মেজ বাবু! মানে আমার বাবা? একে একে বাড়ির বাইরে বের হয়ে এলেন আমার ঠাকুরদা, কাকা, জ্যেঠা সবাই। মা উঠোনে পাষাণ প্রতিমার মতো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। ঘরে ঘুমানো ভাই বোনের দিকে একবার তাকিয়ে আমি ছুটে গেলাম মার কাছে। তাঁর দু’হাত ধরে মুখের দিকে তাকাতেই তিনি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর শিশির সিক্ত সকালে সদ্য ধান উঠে যাওয়া নাড়া বাদা মাড়িয়ে মা আমাকে নিয়ে এগিয়ে চললেন সামনের দিকে। যেখানে আমার বাবা, আমার মায়ের প্রিয় মানুষ শুয়ে আছে সেই কৃষকের ঘামে ভেজা জমির দিকে।






স্মৃতির চেয়ে বিস্মৃতি ভালো
 
অ সী ম  পা ঠ ক 

মফঃস্বল কলেজের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক এটুকু পরিচয়েই আমি সন্তুষ্ট। একা মানুষ হাত পুড়িয়ে রান্না করি, না পারলে গঞ্জের দোকানে পাউরুটি বেকারি বিস্কুট আর মুরগির ডিম তো  আছেই। যা হোক চলে গেলেই হলো। সপ্তাহে বারো ঘন্টা ক্লাস, অবসর সময়ে লেখালিখি আর ছুটিছাটাতে বেরিয়ে পড়া মুসৌরী দেরাদুন হরিদ্বার পুরী। ঘুরেফিরে এই আমার পছন্দের জায়গা। 

নিজের বলতে কেউ নেই। আর দশ বছর পর রিটায়ার করবো , এর মধ্যে একটা বৃদ্ধাশ্রম খুলবো। ওটাই শেষ বয়সের অবলম্বন। 

দিন চলছে বেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। দিন যাপন আর প্রাণ ধারনের গ্লানির মাঝে আমার কোন বৈচিত্র্য বা বৈপরীত্য নেই। অযথা বন্ধু বান্ধবের ঝামেলা নেই, অহেতুক বিরক্তি নেই, অকারন টেনশন নেই। 
 ভলো লাগা বলতে একটু বৃষ্টি বিলাসী আমি‌। মেঘলা দিনে বাড়িতে বসে ফ্লাস্ক ভর্তি কফি ঢুকঢুক করে খাই আর আকাশের বুক থেকে বৃষ্টির ঝরে পড়া দেখি। চারদিক কেমন সবুজ, মায়াময় অনুভূতি। যেনো আকাশ আর মাটির প্রেমে বৃষ্টি হলো গভীর সংযোগ। 

এরকমই এক বাদল দিনে ভাবলাম সুকান্তসমগ্র খুলে চিঠিগুলো পড়ি। দারুন লাগে সুকান্তের লেখা চিঠিগুলো। হাসপাতালে যক্ষ্মার সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত মনে আবেগ অভিমানের কথা। সুকান্তের কবিতা আমার কৈশোরের প্রেম। সাহিত্যের প্রথম ভালো লাগা। 

সুকান্ত সমগ্র খুলতেই বেরিয়ে আসে একটা চেনা গন্ধ। বুক শেল্ফে এই পুরানো বইএর গন্ধে এক মাদকতা মিশে থাকে‌। মানুষ যেমন অনেকদিন পর পূজার পবিত্র শুকনো ফুল খুঁজে পায় পুরানো বইএর পাতার ভাঁজে, তেমনই একখানা ছবি বেরিয়ে পড়লো বই থেকে। একটা গ্রুপ ফটো। 

এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। একটু বিরক্ত হলাম, অসময়ে আবার কে এলো? দরজা খুলে দেখি সেকেন্ড ইয়ারের নিশা অদিতি আর কোয়েল। আমার পছন্দের তিন ছাত্রী। আমি এদের একসাথে ত্রিনয়নী বলে ডাকি। এরা মাঝে মাঝে আসে, আমার এলোমেলো ঘর গুছিয়ে দিয়ে যায়। সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হয়, ওরা চা বানিয়ে দেয়। ব্যাক্তিগত আলাপচারিতা আমি খুব একটা পছন্দ করিনা। তাই আমাকে নিয়ে যাদের অনন্ত কৌতুহল তারা নিজের মত গল্প বানায়, আমার অবশ্য দূর থেকে সে সব শুনতে ভালোই লাগে। মোট কথা সমালোচনা আলোচনা সবেতেই আমি নির্বিকার ।

আজ ওই গ্রুপ ছবিটা দেখে কেমন যেনো নষ্টালজিক হয়ে পড়ছি। স্মৃতির দরজা ঠেলে ভিড় করছে জীবনের প্রায়ান্ধকার ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষিত কঠিন ভালোবাসার অনুভূতি।
ভিড় করছে কলেজ ক্যান্টিন, গঞ্জের বুড়ো বটতলা, পলাশ বাগান, ফুটবল মাঠ আর লাইব্রেরী রিডিং রুম। আপাততঃ সেই মন ভালো করা ট্যাবলেট তোলা থাক। পরে না হয় একাগ্রচিত্তে ভাবা যাবে।

ছাত্রীরা আমার ড্রইং রুমে বসতেই আমি ছবি ও বই যথাস্থানে রাখতে তৎপর হলে নিশা বলে স্যার এখনো সুকান্ত পড়েন, একটু বইটা দেখি। একপ্রকার ছোঁ মেরেই বইটা ওরা তুলে নেয়। অদিতি বেশ কিছুক্ষণ গ্রুপ ছবিটা দেখে। ওদের দেখার আগ্রহ দেখে আমি বলি এটা কলেজের থার্ড ইয়ার সরস্বতী পূজোয় আমাদের ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের ছবি।

কোয়েল বলে , স্যার এই ছবির সবার সাথে আপনার যোগাযোগ আছে? আমি বললাম না, সময়র স্রোতে কে কোথায় আছে জানি না, আর তোরা তো জানিস আমি বড্ড সেকেলে, এসব সোশ্যাল মিডিয়ায়াতে আমার ঠিক পোষায় না, এখনো আমার কাছে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে চিঠিটাই বেস্ট। অদিতি বলে স্যার সবাই যদি আপনার মত এরকম ভাবতো। ওকে থামিয়ে আমি বলি দূর পাগলী, সময় এগুচ্ছে, মানুষের অনুভূতির প্রকাশ বদলাচ্ছে। আমাদের মত ব্যাকডেটেডদের সংখ্যা কমছে। 
নিশা ছবিটা দেখে বলে, স্যার এখানে কোনটা আপনি? কোয়েল বলে এই যে নীল শার্ট, তাই না? অদিতি বলে না ব্ল্যাক টি শার্ট।
এদের ছেলেমানুষী দেখে মুচকি হাসতে থাকি আমি। তারপর এক এক করে ছবির সবার সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে বলি এই ব্ল্যাক টি শার্টটাই আমি। অদিতি বলে আচ্ছা স্যার এই ছবির পেছনে কি আর কোন গল্প আছে?
আমি বুঝলাম এরা গল্পের রসদ পেয়ে গেছে। এতো সহজে আমার নিস্তার নেই। শিকারী বেড়ালের মত মাছের গন্ধে এদের চোখগুলো ঘুরছে। 

কফিতে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বললাম, প্রতিটি ছবির পেছনেই গল্প থাকে। আমার গল্পের নায়ক আমি নিজে, আর ঐ যে সবুজ শাড়ি যার দৃষ্টি মাটির দিকে, ঐ চন্দনা হল আমার গল্পের নায়িকা।

নয় এর দশকের শুরু, তখন ভালোবাসার সংজ্ঞা এতো সহজ ছিলো না, অনেক ব্যাকরন মেনে তবেই। মেরুদন্ড সোজা না থাকলে প্রেমের দু়ঃসাহস দেখানো বোকামি। আমার আর চন্দনার দেখাটা আকস্মিক এক ভিড় বাসে এরকমই বাদল দিনে। বারো কিমি দূরে আমার গ্রাম থেকে কলেজ যাবার বাস ছিলো রামশরন।  সেই ভিড় বাসে জবজবে ভিজে জামাকাপড়ে উঠেই দেখি এক সুশ্রী মেয়ে দাঁড়িয়ে, ভিড় ঠাসা বাস। আমি গোটা রাস্তা ওকেই দেখতে থাকি। সে তাকালে আমি চোখ ঘুরিয়ে নিই। আসলে ওই বয়সটাই ছিলো দুঃসহ। তাই বোধহয় কবি বলেছিলেন  এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে। পরে কলেজে গিয়ে দেখলাম ঐ মেয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্টের।
ধীরে ধীরে পরিচয় থেকে ভালোলাগা কখন যে ভালোবাসাতে রূপান্তর হলো বুঝতেই পারিনি। কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমরা পরিবেশন করেছিলাম ম্যাকবেথ নাটক। আমি ম্যাকবেথ আর ও লেডি ম্যাকবেথ। চন্দনা অনেক বুদ্ধিমতী, বিভিন্ন ছোট গল্পের দারুন নাট্যরূপ দিতে পারতো সে। আমাদের ভালোবাসার সেতু ছিলো সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা। 

একসাথে তিনবছর পথচলা, অনেক উজ্জ্বল মুহূর্ত এখনো স্মৃতির গভীরে। আমার চন্দনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। ভালোবাসার অর্থ জীবনকে গতিশীল করা, সমাজের সার্বিক উন্নতিসাধন। কুসংস্কার মুক্ত মনে বিশ্বাস যদি অটুট হয় তখন কাছে আসার চেয়েও বড়ো হলো অপরের সুখের জন্য নিজের ত্যাগ।

গোটা ঘর নিস্তব্ধ, যেনো পিন পড়লে শব্দ হবে। 

আমি যেনো আরো আবেগবিহ্বল। আমার বাড়ির চারপাশটা যেনো ঘষা কাঁচের ভেতর একটা বৃষ্টি ভেজা পৃথিবী।

নীরবতা ভেঙে অদিতি বলে, স্যার আপনাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেলো না কেনো?

আমি যেনো এক যুগান্তের দার্শনিক,  বললাম বিরহের অগ্নিস্নানে প্রেম যে পরিশুদ্ধ।

কোয়েল বললো স্যার শেষটুকু বলুন।

গল্পের শেষটা যে চরমতম বেদনার। আমি যখন কলেজ শেষ করে বাড়ি যাই তখন বাবা মৃত্যু শয্যায়। দাদা বৌদিকে নিয়ে আলাদ হয়ে গেছে। বাড়িতে অসুস্থ বাবা রুগ্ন মা, শেষে বাবাও বাঁচলো না, বাবা চলে যাবার তিন মাসের মধ্যে মা ও চলে গেলো। সে বছর আমার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া হল না। পরের বছর এক আত্মীয়ের সহায়তায় বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়। ওটাই হয়তো জীবনের একটা বাঁক। তবে জীবন নদীর প্রতিটি বালুকণায় আমার স্মৃতিগুলো সাঁতার কাটে। চন্দনা খোঁজ খবর করতো। আমিও নৈরাশ্যের মাঝে নেই রাজ্যে দাঁড়িয়ে ওকে অবলম্বন করেই যেনো বাঁচার তাগিদ অনুভব করছিলাম‌।

একদিন খবর এলো বাড়ি থেকে ওর বিয়ে ঠিক করেছে, ছেলেটি ব্যাঙ্কে কাজ করে। ওদের গ্রামেই নাকি মামাবাড়ি। আমার তখন চাল নেই চুলো নেই। মাথার উপরে কেউ নেই, অনিশ্চিত জীবন। তাই চুপ থাকলাম, ভবিতব্য কে খন্ডায়। চন্দনা আমার বুকের গভীরে তলিয়ে গেলো। তাকে আর কপালে রাখতে পারলাম না। সেই থেকে আমি বেঁচে আছি তার স্মৃতি বুকে নিয়ে। 

নিশা বলে এখন কোথায় আপনার চন্দনা কিছু জানেন? আমি বললাম সে আছে এই আকাশের নীচে, আর এই মাটিতে সে হাঁটছে, এই বাতাস থেকে শ্বাস নিচ্ছে। দীর্ঘ নীরবতা ভেদ করে শালিকের চিৎকার কানে এলো। আমি বললাম তোরা আজ আয়, আমি একটু একা থাকি। 

অদিতি বাকি দুজনকে বলে তোরা দু'মিনিট স্যারের বাগানে কদমতলায় একটু বোস আমি যাচ্ছি। বৃষ্টিটাও ততক্ষণে ছেড়ে গেছে‌। আবার নামবে কিছু সময় পর। 

অদিতি বললো স্যার একটা প্রণাম করবো? আমি কিছু বলার আগেই সে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো, বললো ঠিক এরকম একখানা ছবি আমাদের বাড়িতেও আছে স্যার, তাইতো গল্পটা শুনতে চাইছিলাম। আমার মায়ের নাম চন্দনা। 

আমি অস্ফুট কিছু বলতে গিয়েও পারলাম না, অদিতির মাথায় হাত রাখলাম। অদিতি করুন চোখে বললো আসি স্যার। আপনাদের ভালোবাসায় আমার প্রণাম রইলো। এই ডিজিটাল সময়ে বেঁচে থাক আপনাদের একে অপরের প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা ভালোবাসা। আমাদের প্রেরণা এটুকুই ‌। 

আমি যেনো তড়িতাহত এক অচল যন্ত্র। অনেক কথা বলতে চেয়েও চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করি।

ভালোবাসার মানুষগুলোর নিষ্পাপ আকাঙ্ক্ষা যতদিন পৃথিবীতে থাকবে ততদিন ভালোবাসা অপূর্ণ অধরা থেকে যাবে। নাহলে সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে না যে, বিবেক বোধ জাগ্রত হবে না যে। আজ যেনো মনে হলো পেয়েছি, সব পেয়েছি। এটুকুই কজন পায় ?






অনিবার্য

জ বা  ভ ট্টা চা র্য

হাওড়ার বড় ঘড়ির তলায় ধীরে ধীরে এসে দাঁড়াল ইলিনা। মেরুন রঙের ট্রলি ব্যাগটা হাতে ধরা, আস্তে করে রুমাল দিয়ে মুখটা মুছলো। তাতে কি ওর মুখের দ্বিধা দ্বন্দ্ব, উত্তেজনার ছাপ কিছুটা হলেও মুছলো--- কে জানে! একবার  চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয় ইলিনা। হাওড়া স্টেশন ভারি ব্যস্ত জায়গা, এখানে চট করে চেনাজানা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। চিরকালই  ও সাবধানী মানসিকতার মেয়ে।

আজ  কুড়ি বছর পর কুন্তলের সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হবে ইলিনার। সেই কলেজ জীবনের  পর এক শহরে থাকলেও দুজনে মুখোমুখি হয়নি। কুন্তল ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে বেশ কয়েকবার, ইলিনা ওকে বন্ধুবৃত্তে  ঢোকায়নি। মাস ছয়েক আগে এক ভীষণ মনখারাপের বৃষ্টিদিনে  ও  কুন্তলকে আবার মনের ঘরে ডেকে নেয়, সেই কুন্তল, কলেজে যাকে একদিন না দেখলে মনে হতো জীবনটাই বুঝি ব্যর্থ হয়ে গেল--- তারপর থেকে ওদের কথা হচ্ছে আবার, প্রথম তিন চার মাস মেসেঞ্জারে, তারপর হোয়াতে--- একমাস হলো ওরা নিয়মিত কথা বলছে ফোনে। কিন্তু কুড়ি বছর তো অনেক সময়, তখন ওরা ছিল টিন এজ প্রেমিক প্রেমিকা, এখন দুজনেরই  সংসার আছে, সন্তান আছে। তবু কি এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে ইলিনা আজ এখানে!!! 

অবশ্য  ওদের দুজনের পরিবারই জানে ওরা টাটানগর যাচ্ছে ঋতুর ছেলের পৈতে উপলক্ষে। ঋতু ওদের কমন কলেজ ফ্রেন্ড।  কলেজে তিনজনের গলায় গলায় ভাব ছিল চর্চার বিষয়। ঋতু  ওদের সপরিবারেই নিমন্ত্রণ  করেছিল, কিন্তু কুন্তলের বউ এর স্কুলে পরীক্ষা চলছে, আর ইলিনার বর তো এসব  অচেনা লোকজনের মধ্যে মোটেই স্বচ্ছন্দ  নয়, তাই যাওয়ার প্রশ্ন ওঠেনা। ছেলেও গেছে স্কুলের এক্সকারশনে--- সুজাত নিজেই বলল "একা যেতে পারলে দুদিন ঘুরে এসো বন্ধুর কাছে"--- হ্যাঁ সেটাই, ওদের দুজনের বাড়িতেই জানে ওরা একা যাচ্ছে।  কুন্তলের  জেদের কাছে হেরে গেছে ইলিনা , তাই আজ ওদের এই যৌথ যাত্রা। এসব কথা ভাবতে ভাবতে  এতোদিন পরেও ইলিনার ভেতরটা মোমের মতো গলে যেতে লাগল। কুন্তল প্ল্যান  করেছে কাল পৈতের ঝামেলা কাটিয়ে দুটো দিন একটু দূরে কোনো হোটেলে নিজেদের মতো করে এতোদিন পরে নিজেদের কাছে পাওয়াটুকু উপভোগ করবে।

ছটফট করে ঘড়ির  দিকে তাকায় ইলিনা। ওহ! অনেক দেরি ট্রেনের। একটা  পঞ্চাশের গীতাঞ্জলি। মাত্র  বারোটা পঞ্চান্ন। কুন্তল নিশ্চয়ই জ্যামে আটকেছে। ফোন করবে? নাহ!! থাক। হঠাৎই সেই সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে যায়--- ওরা বসেছিল  প্রিন্সেপ ঘাটের একদম জলছোঁয়া সিঁড়িটার এককোণে। জায়গাটা কুয়াশা ঢাকা আধো অন্ধকার। কুন্তল ওর হাতটা চেপে ধরে রেখেছিল, পুরুষের ওম কাকে বলে ইলিনার জানা ছিল না এতোদিন, কুন্তলের হাতের তাপে ও সেটা অনুভব করতে লাগল শক্ত কাঁধে মাথা রেখে।  ইলিনার ভিজে গোলাপরঙা ঠোঁট  কুন্তলের ঠোঁটের গভীরে ফুটে উঠেছিল সুগন্ধি গোলাপের পাপড়ি হয়ে। কুয়াশা জড়ানো অলীক নদী--- দূরে নৌকার  টিমটিমে আলো, এক অপার্থিব  অনুভূতিতে মিলিয়ে দিয়েছিল সেদিন ওদের দুজনকে।  

তারপর কি থেকে যে কি হয়ে গেল!! বাবার আচমকা মৃত্যু,  মায়ের  ক্যান্সার ধরা পড়া,  মায়ের কান্নার কাছে নতি স্বীকার  করে, মামার আনা সম্বন্ধে রাজি হওয়া, কারণ তখনও  কুন্তল  কিছু করেনা--- সব মিলিয়ে ইলিনার  জীবনটা তছনছ  হয়ে গিয়েছিল সে সময়ে। আত্মহত্যার কথা মনে হয়নি তা নয়, কিন্তু মায়ের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে সেটাও করে উঠতে পারেনি। এতদিন পর কেমন করে বলবে কুন্তল কে, যে ওর দৃঢ় বিশ্বাস  ছিল ওদের বিয়ে হবেই, ফুলশয্যার রাতে ও ফুলের মতোই মেলে ধরবে নিজেকে। বিয়ের পরও কতোদিন পর্যন্ত কেবল ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করেছে  কুন্তলের কাছে। ------- সুজাতের সাথে ওর সম্পর্কটাও দানা বাঁধেনি, সুজাত ইলিনার মনের গভীরে ঢুকতে না পেরে  নিজেকে সঁপে দিয়েছিল ইলিনার পায়ে, বশংবদের মতো--- বউয়ের জন্য  সে এক পৃথিবী যুঝতে পারে, আর সুজাতের এই ব্যবহারই ইলিনাকে মাঝে মাঝে ক্ষিপ্ত করে তোলে, এর থেকে সুজাত কিছুটা  পৌরুষের অধিকার ফলালে  ইলিনা স্বস্তি পেতো, সুজাতকে প্রবলভাবে আঁকড়ে কুন্তলের  ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারতো।

হঠাৎ ফোনটা বাজতে সম্বিত  ফেরে ইলিনার, চমকে উঠে মাথার ওপর বড় ঘড়ির দিকে তাকায়, একটা পনেরো--- ফোনটা ধরতেই সুজাত বলে ওঠে,
--- ট্রেন  দিয়েছে?
--- না, এখনও দেয়নি, তুমি ফোন করলে কেন?
--- এমনি, খুব মনে হচ্ছে তোমার  কথা।
--- লাঞ্চ করলে? 
--- না খাইনি, ইচ্ছে করছে না, তুমি নেই, ছেলেটা নেই---
--- সুজাত, তোমার কিন্তু গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, খেয়ে ওষুধগুলো খেয়ে নাও। এখন আমায় আর ফোন কোরোনা, আমি দরকার মতো করে নেব--- 

ফোনটা কেটে সাইলেন্ট করে দেয় ইলিনা--- আর তখনই দূর থেকে বড় ঘড়ির দিকে দ্রুত আসতে দেখল কুন্তলকে। হঠাৎই  অবিশ্বাস্য দ্রুততায় পাশের  একটা টি স্টলের আড়ালে চলে যায় ইলিনা। পাশে বসে থাকা জুতো পালিশ করার বাচ্চা  ছেলেটা  অবাক হয়ে ওর দিকে  তাকায়। চায়ের দোকানের আড়াল থেকেই  ইলিনা দেখে  কুন্তল চারদিকে চোখ চালিয়ে ওকে খুঁজছে--- নিজেকে আরও একটু গুটিয়ে নিয়ে অপলক চেয়ে থাকে ওর দিকে। কুড়ি বছরে  বেশ খানিকটা মেদ  জমা ছাড়া আর খুব একটা পরিবর্তন হয়নি ছেলেটার। কাঠের মতো দাঁড়িয়ে  ইলিনা কুন্তলের মুখের রংবদল দেখে। সেখানে উদগ্রীবতা ধীরে ধীরে রাগ, হতাশা কষ্ট দুঃখে  পরিবর্তিত হতে থাকে--- ইলিনার  গলায় কান্না এসে দলা পাকায়,  বুকের ভেতর মোচড় দেয়, কিন্তু এক পা এগোতে পারে না, কে যেন পায়ে পেরেক পুঁতে আটকে দিয়েছে ওকে। কুন্তল  ঘড়ির  দিকে তাকায় আর মোবাইলে রিং করে--- ইলিনার ফোন ভাইব্রেট  হয়ে হয়ে থেমে যায়। পাথর  ইলিনা! একটা  পঁয়তাল্লিশ,  মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে  এলোমেলো পায়ে গেটের দিকে ফিরে যাচ্ছে কুন্তল, সেই যাওয়া  দেখতে দেখতে ইলিনার চোখ  ঝাপসা হয়ে, বড় বড় জলের ফোঁটা গালের কোল বেয়ে নেমে বুক ভিজিয়ে দেয়। মনে মনে বলে --- ক্ষমা  করে দে কুন্তল, আমি পারলাম না।   

একটু ধাতস্থ হয়ে রুমালটা বের করে মুখটা মুছে, বড়ো যত্নে বানিয়ে নিয়ে আসা কুন্তলের পছন্দের লুচি, কিমাকারির প্যাকেটটা ব্যাগ থেকে বের করে  জুতো পালিশ করার বাচ্চাছেলেটাকে দিয়ে দেয়। এবার ফোনটা খুলে প্রথমে মেসেঞ্জার থেকে তারপর হোয়াটস্ অ্যাপ থেকে কুন্তলের  নাম্বার ডিলিট করে। সবশেষে  সুজাতকে ফোন করে বলে, আমি  বাড়ি ফিরব, বড় ঘড়ির তলায় দাঁড়িয়ে আছি, তুমি আমায় নিতে এসো।






গুরুংবুড়ো ও হীরার হোটেল

 শা ন্ত ম য়  গো স্বা মী
 
তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ অতি কম দিনের। দু-চার দিনের বেশি নয় মোটেই। তারপর, দশ বছর কোনো খোঁজখবর নেই। এই দশ বছরে কতো কিছু বদলেছে। সবচেয়ে বড় বদল যদি কিছু হয়ে থাকে, তা আমার মনের গঠনে। হয়তো তাঁরও মন বুড়িয়েছে, কি জানি তবু তিনি আমার কাছে একেবারে সেইরকমই রয়ে গেছেন, ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম।

তাঁর সঙ্গে আলাপ রামধুরায়। কয়েকদিনের জন্যে বেড়াতে গিয়ে তাঁর হোম-স্টেতে উঠেছিলাম। হোম-স্টের নাম তার পদবীর জোরেই… গুরুং হাউস। একেবারে পাহাড়ের ঢালের ওপরেই নিরিবিলি, ছোট পাহাড়ি গেস্ট হাউস। হোম-স্টের ঘর থেকে বেরিয়ে কয়েক হাত চওড়া সিমেন্টের চাতাল পেরোলেই ডাইনিং এরিয়া। টালির আটচালা মতন, তলায় দু-তিনটে প্লাস্টিকের টেবিল-চেয়ার। ডাইনিং এরিয়া শেষ হাতই ছোট্ট একটা বাগান। বাগানের সাদা রং করা কাঠের বেড়ার ওপারে রয়েছে আকর্ষণীয় নানান পাহাড়ি গাছ-গাছালির যত্নের সমাহার। বেড়ার গায়ে অনেকদিনের নানা রঙের অর্কিড।  

তাঁর চেহারা মোটাসোটা, তামাটে গায়ের রং। হাফপ্যান্টের ওপর, মস্ত বড় ভুঁড়ির মাঝখানে নাভিটা অদ্ভুতভাবে গোল হয়ে উঁচু হয়ে আছে। নাকের নিচে মোটা গোঁফ, হাসলেই ফোকলা দাঁত বেরিয়ে পড়ে। গুরুংবুড়ো ভোজনরসিক, নিজে হাতে রান্না করে খাওয়ান। ট্রাউট মাছ, চিকেন, মাটন। রান্নার মশলা জানতে চাইলে হেসে শুধু বলেন… ‘কুছ নহি বস… আচ্ছা মন আউর বড়িয়া পাহাড় কা মসালা দেতা হ্যায়।’   

তখন আমার মেয়ে, রাই বেশ ছোট, তাই ব্রিজটার দু'পাশের লোহার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে তার গা শিরশির করতো। নিচে তাকালে দেখা যেত, এক পাশের বিশাল ড্যামের জল অনেকটা ওপর থেকে হুড়হুড় করে পড়ে ব্রিজের নিচ দিয়ে অন্য পাশটায় বয়ে যাচ্ছে। সে সময় লোহার শিকের রেলিংটা রাইয়ের মাথার চেয়ে উঁচু। ব্রিজ পেরিয়ে রাস্তার বাঁ দিকে অনেকগুলো পুরোনো গাছ। একটা পাইন গাছের তলায় সিমেন্টের ছোট ভাঙা বেদি, তাতে সারাবছর একটা-দুটো ঠাকুরের মূর্তি রাখা থাকতো। হাতভাঙা হনুমান, নাকভাঙা দুর্গা… হোম-স্টে থেকে যাওয়া আসার পথে একঝলক দেখতে পেতাম। কেমন একটা হতাশ লাগতো। হয়তো রাইয়ের একটু ভয় ভয়ও করতো, কে জানে। ওর ছোট্ট নরম দুটো হাত আমায় আঁকড়ে ধরতো শক্ত করে।

গুরুং হাউসের সামনে একটা ছোট টবে একধরনের লতানে গাছ দেখে খুব পছন্দ হলো। গুরুং বুড়োকে বললাম। তিনি একটা প্লাস্টিকের মাটি দেওয়া একটুখানি লতা কেটে দিয়ে দিলেন, বললেন বাড়ি ফিরে জলের গামলায় রেখে দিতে। দিয়েছিলামও তাই কিন্তু কয়েকদিন যেতেই লতার পাতা হলুদ হয়ে যেতে লাগলো। বুদ্ধি খাটিয়ে জলে ওইখান থেকেই নিয়ে আসা কিছু পাথর দিয়ে রাখলাম। পাহাড়ি লতা, যদি পাথরের গন্ধে পাহাড়কে মনে করতে… চিনতে পারে। লাভ হয়নি। ফেরার দিন, গুরুংবুড়ো তার ছ্যাকড়া ওমনি গাড়ি নিয়ে আমাদের বাসস্ট্যান্ড অবধি পৌঁছতে এলেন। সঙ্গে তাঁর খাস বাদামী ল্যাব্রাডর, সে দেখি তাড়াহুড়ো করেই লেজ নাড়তে নাড়তে এসেছে। তারপর হুশ করে দশটা বছর কেটে গেল।

কয়েকদিন আগে হঠাৎ গুরুংবুড়োর কথা মনে পড়ল। গুগল করে দেখি, গুরুং হাউস এখনো আছে। হোম-স্টেতে থেকেছেন এমন অনেক মানুষ সদয় রিভিউ লিখেছেন। যোগাযোগ করাতে উত্তর দিলেন একজন অপরিচিত মানুষ। হোটেলের ম্যানেজার ঋষভ গুরুং। আমরা বুকিং করে পরের সপ্তাহেই এক সুন্দর সপ্তাহের শুরুতে পৌঁছে গেলাম গুরুংবুড়োর ডেরায়। কিন্তু ম্যানেজার গেছেন নিচে… শিলিগুড়ি। সপ্তাহের রেশন আনতে। খোঁজ খবর করাতে কিছুতেই গুরুংবুড়োর কথা জানতে পারছিলাম না। কিচেনটা আছে কিন্তু ওখানে অতিথিদের জন্য রান্না হয় না। একটু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেই হীরার হোটেল। ওখানে গিয়ে বা অর্ডার করে দিলেই মিলবে খাবারের আতিশয্য।

বার বার বাইরে খেতে যাওয়াটা একটা অসুবিধে। উত্তরে হোটেলের ম্যানেজার ঋষভ গুরুং বললেন… ‘চেষ্টা করছি হোম-স্টের কিচেনটা আবার শুরু করার। তবে সেটা যেমনই হোক, নতুন রাঁধুনি এসে তো আর বাবার জায়গা নিতে পারবে না।’

পাইন গাছটাকে পেছনে ফেলে আরেকটু এগোলে, রাস্তার বাঁ দিকেই হীরার ভাত-মোমো আর কফি-চায়ের হোটেল। বাঁশের চাটাইয়ের চার দেওয়াল, বাঁশের ওপর প্লাস্টিকের ত্রিপলের ছাদ। দুপুরে রূপোলি কাগজের প্লেটে ভাত, ডাল আর একটা চালু সবজি। টমেটোর লাল ঝাল চাটনি সহ গরম মোমো, দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা ময়লা ঝোলা থেকে বের করে টুকরো করে রাখা লেবু লঙ্কা পেঁয়াজ। এছাড়া আলাদা করে চাইলে স্টিলের ছোট ছোট চ্যাপ্টা বাটিতে ঝাল ঝাল স্কোয়াশের কশা ডিমের কারি, চিকেন। শুকনো শুয়োরের মাংসের চাট, কোনো কোনো দিন তাও পাওয়া যায়।

রাতে রুটি হয়। একজন গেঞ্জি পরে, কোমর অবধি গামছা জড়িয়ে সারা সন্ধ্যে রুটি বেলে। উনুনের আঁচে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হীরা ডিম-তড়কা করে সেটার আড়ালে একটু ঝাল চিকেনের বাসি ঝোল মেরে দেয়। লোকে কাঠের বেঞ্চে বসে বাঁ হাত দিয়ে নাকের জল মুছতে মুছতে খায়। হীরার বয়স হয়েছে। বুক অবধি সোয়েটার তুলে ফোকলা দাঁত বের করে হাসে। টাকার হিসেবের অঙ্ক করতে গিয়ে অনেক দেরি লাগায়। কাস্টমার উসখুস করে। শীতের দুপুরে, এই জঙ্গুলে রাস্তায় কেউ নেই, ড্যামের জল শুকিয়ে ফুটিফাটা পাথর-মাটি বেরিয়ে পড়ে… তবু হীরার দোকানে আলগা ভিড় কমে না। বেশিরভাগই স্থানীয় ছাংয়ের অমৃতরসে তূরীয়। হীরা হাসে, বলে… ‘দেখিয়ে স্যর, সব ও গুরুং সাবকা কেরামৎ। স্যর কা কিচেনমে কাম শিখা ম্যায়নে।’

হীরার হোটেল ভীষণ চালু কিন্তু মাঝে মাঝেই সে হোটেল অনেকদিন বন্ধ রাখত। লোকে খেতে এসে ফিরে যায়, রাগ করে। হীরা ফিরে এলে জানতে পারে সবাই, সে কোনো নেপালী গ্রামে হনুমান পুজোয় ঢোল বাজাতে ও ভজন গাইতে গেছিল। এটাই ছিল তার নানান নেশার মধ্যে একটা।

ঋষভ গুরুংয়ের সঙ্গে ফিরে এসেও যোগাযোগ রেখেছিলাম। কেন রেখেছিলাম আমি নিজেও জানি না আর ঋষভও কেন আমার যোগাযোগে আগ্রহ দেখাত বুঝে উঠতে পারি নি। হীরার কথা শুনতে চাইতাম। আর ঋষভও ভালবাসার গুনে অথবা তার হোম-স্টের খাতিরেই আমায় হীরার সব কথাই বলতো। হঠাৎ একদিন বললো… ‘এই বার বর্ষায় প্রচণ্ড ঝড়-বাদল! অনেকদিন ধরেই বন্ধ হীরার হোটেল। লোকে রেগেমেগে শেষে যাওয়াই বন্ধ করে দিলো। বৃষ্টি মাথায় করে শুধুশুধু অতদূর ধুর ধুর… একদিন ভীষণ বৃষ্টিভরা সকালে জানা গেলো… নিজের বন্ধ দোকানের ভিতরেই মরে গেছে হীরা।  

পরদিন নাকি বৃষ্টির তোড়ে ড্যামের জল ফেঁপে উঠে ব্রিজ ভেঙে দিয়ে ওপাশ দিয়ে বয়ে গেছিলো।






বিক্রেতা

ত ড়ি ৎ  চ ক্র ব র্তী

তখন বয়েস চোদ্দো পেরিয়ে পনেরোতে পড়েছে। গতবছর এ’রকম সময়ে ভরপেট চোলাই আর হাবিজাবি চাট খেয়ে  সারারাত হেগে বাপটা ভোরে মরলো। চোলাইয়ের ঠেকের লোকজন নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে এসেছিলো। এগারোদিন পরে মার হার দুটো বেচে শ্রাদ্ধ হলো আর বারোজন গাঁয়ুই খেলো। সেদিন অনেকদিন পরে ও বেশ আনন্দ  করে খেয়েছিল পেটপুরে।

বাপটা মরে যেতে ও’ প্রথমে এতো বোঝেনি, কদিন পর থেকে  ব্ড্ড ফাঁকাফাঁকা লাগতে। বাপ খুব ভালোবাসত তাকে, ভ্যানে বসিয়ে পাড়া ঘুরিয়ে আনতো, কাঁধে চড়িয়ে বনবন করে ঘোরাতো, কাঠি আইসক্রিম কিনে দিয়ে বলতো,
-‘তুই কলেজে পড়বি। তোকে রানী সাজিয়ে বিয়ে দেবো। কত আনন্দ করবো।’
সে মানুষটা নেই দুমাস হলো। মাঝেমাঝে মনেপড়ে, মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।

এখন সে ঢিল ছুঁড়ে আম পাড়ে , স্নান করতে গিয়ে আঁচল পেতে পুঁটি আর তেচোখা মাছ ধরে, আর প্রজাপতিকে বন্ধু করে দৌড়ে বেড়ায়।

সংসার নিয়ে মা গজগজ করে। মার শরীরটা কোনোদিনই ভালো ছিলনা, ইদানীং আরো হাড় জিরজিরে হয়ে গিয়েছে। তার উপর ছ’মাসের ভাইটা ইদানীং যেন আরো টেনে দুধ খায়, মা’র ভারী দুধগুলো কেমন যেন শুখিয়ে গিয়েছে, ভাইও পুরো দুধ না পেয়ে কামড়ে খিমছে দেয়।
কিছুদিন বাড়ির জিনিস বেচে সংসার চললো যখন একান্তই  অচল হলো সংসার, মা একবাড়িতে দু’বেলার রান্নার কাজ নিলো। ভাইকে সঙ্গে নিয়ে যেত। আমার উড়ে বেড়ানো আরো বাড়লো। মার অনুপস্থিতিতে বাড়ির কিছু কাজ সেরে রাখার জন্যে মা বলে যেতো কিন্তু কে কার কড়ি ধারে, দিনটা কাটতো পুকুরে বাগানে টইটই করে। আমার সে রকম কোনো বন্ধু ছিলনা, ছিলাম বড্ড একাসেঁড়ে।

সংসারটা বড়ই টনাটানিতে, অনেকদিন শুধু শাপলা সিদ্ধ আর খুঁদ জুটতো। হঠাৎ একদিন মা আমাকে হালদারবাড়ির ঘর মোছা আর উঠোন ঝাঁটের কাজে পাঠাল। বাড়িতে শুধু বুড়ো আর বুড়ি থাকে, কাজ খুব কম।
বুড়ো সারাদিন বই মুখে বসে থাকে, আর গিন্নিমা নিজের মনেই বকবক করে। আমাকে পেলে ছাড়তে চায়না, শুধু বকেই যায়, যার অর্ধ্যেক কথা বুঝিনা। তবু ঘাড় নাড়ি, গিন্নিমা বলে  কথা, মালকিন।

হালদার গিন্নি মানুষটা ভালো, খেতে দিতো,ওনার বাদ দেওয়া শাড়িগুলোও দিত আমাদের পরবার জন্যে। একটু খুশি ফিরলো। হঠাৎ একদিন দেখলাম, লম্বা ফরসা মাথা ভরা কোঁচকানো চুল, বেশ বড় একটা সুটকেস নিয়ে এক যুবক হালদার বাড়ীতে এলো। খুব হইচই, গিন্নিমা তো কী ভাবে সে ছেলেটিকে যত্ন করবেন যেনো ভেবে পাচ্ছিলেন না। বাপ মা দুজনায় মিলে কত আপ্যায়ন, কত আদিখ্যেতা।

ছেলেটার চাউনি ভালো ছিলোনা। ওর  চোখ সবসময়ে আমাকে ঘিরে থাকতো। মোটেই ভালো ঠেকতো না। ঝাঁট দেবার সময়ে জানলা দিয়ে আমার দিকে বিশেষ করে আমাকে যেন মাপতো, আমার বুকের ভাঁজ মাপতো। ফাঁকা বারান্দায় দু’দিন হাত ধরতে এলো। আস্তে আস্তে তার সাহস বাড়তে লাগল। একদিন ঘর মোছার সময়ে পাছায় হাত দিলো, গিন্নিমাকে বলে দেবো বলতে  মুচকি হেসে চলে গেলো।

মাকে বললাম। মা যেন কানেই দিলনা। হয়তো সমাধান ভাবতে আমাদের পাশের পাড়ার শিবু দাসের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করল। আমি তো অবাক, পাড়ার অনেকেই বারণ করল, শিবুর আগের বউটা বসন্ত রোগে মারা গিয়েছে। আমার দুগুণ বয়স। একটা ভ্যান আছে, সেটাই চালায়। দুদিনের মধ্যে আমাকে সিঁদুর পরিয়ে ওর টালির চালের ছ্যাচারী বেড়ার ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলল। বিয়ের রাতে একপেট চোলাই খেয়ে এসে অনেক আদর করল বটে কিন্তু বুঝলাম শিবু শারীরিক ভাবে অক্ষম। একদিন আমাকে বলে ফেললো মার কাছ থেকে ও আমাকে বিশ হাজার টাকায় কিনে এনেছে। সেদিন ঠিক করলাম আমার বিক্রেতা মার মুখ আর কোনোদিন দেখবোনা। 

দিনগুলো গড়াচ্ছিলো ভালই।
শিবু ভ্যান চালায়। সংসারটা চলে যায়। দুপুরে রাত্রে যখন পারে সোহাগ করে, কিন্তু আমার শারীরিক চাহিদার সময়ে শিবু করুণ চোখে তাকিয়ে নেতিয়ে পড়ে। আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকি, জানতে  পারিনা কখন নিজে থেকে চোখের কোল দিয়ে জল গড়িয়ে যায়। তবু শিবু, শিবুর চোলাই, ভ্যান, এসব নিয়ে আমার দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিলো। শিবু বাড়ি ফিরে বাজার দিলে রান্না করি।
হঠাৎ সেদিন সারাদিন শিবু ফিরলনা। শিবু না আসলে খেতামনা, সারা দিনরাত কিছু পেটে পড়লনা। সকালে ওদের ইউনিয়নের লোকেরা খবর দিলো, একটা ট্রাক শিবুর ভ্যানটাকে টুকরো করে শিবুকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়েছে। ভাগ্যগুণে শিবু প্রাণে বেঁচেছে, ইউনিয়ন থেকে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে কিন্তু খুব প্রাণ সংশয়। ইউনিয়ন থেকে টাকা দিয়ে ওষুধপত্র কিনে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের ঘরে সান্ত্বনা জানাতে ইউনিয়নের বড় নেতা এসে আমার গায়ের খারাপ জায়গাগুলোতে হাত ছুঁইয়ে বলে গেল, ইউনিয়ন শিবুর পাশে আছে। রাহা খরচের কিছু টাকা আমাকে দিয়েও গেল।
প্রায় একমাসের উপর যমে মানুষের টানাটানির পরে শিবু বাড়ি ফিরলো। ফিরল বটে কিন্তু শিবুর কোমর থেকে নিচের দিক অসাড় হয়ে গিয়েছে। বসতেও পারেনা। 

ইউনিয়নও টাকা দেওয়া বন্ধ করলো, শুধু মাঝেমাঝে এসে ওদেরই চায়ের খরচ করিয়ে দেয়।
অগত্যা একটা রান্নার কাজে ঢুকলাম। মেসের অনেকের রান্না , ধরে নিয়েছিলাম কষ্ট করতে হবে। দুপুরে ফেরার সময়ে একেবারের বাড়ির বাজার করে আনতাম, এসে নিজেদের রান্না আর ঘরের সব কাজ, শিবুকে পরিষ্কার করিয়ে দিতে হতো। আর কেন জানিনা ফেরার সময়ে শিবুর জন্যে বাবুর দোকান থেকে এক বান্ডিল কালো সুতোর বিড়ি আর একটা দেশলাই নিয়ে আসতাম। শিবুটা সারা দিনমান একই ভাবে শুয়ে থাকতো করুণ ভাবে তাকিয়ে। ইদানীংকালে শিবুর প্রতি একটু বেশ দরদ পরে গিয়েছিল। বাচ্চাদের মতো শিবুকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই কোথা থেকে সময় কেটে যায়, বুঝতেও পারিনা। অনেক সময়ে সব কাজ সেরে ঠ্যাং ছড়িয়ে চুল বাঁধার সময়ে শিবুর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতাম, ভালভাবে না হলেও চলে যাচ্ছিল টুকটুক করে। গোল বাঁধল তখনই যখন একদিন কাজ থেকে ফেরার সময় দেখলাম, হালদার বাড়ির ছেলেটা আমাদের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে। প্রথমটা কিছু মনে করিনি।
এরপর থেকে দেখলাম, হালদার বাড়ীর ছেলেটি প্রায় শিবুর কাছে আসতে লাগল। ছেলেটি চলে গেলে শিবু প্রায়ই আমাকে অনেকগুলো টাকা দিয়ে বাজার পাঠাতে। আনাতো অনেক খাবার দাবার। ছেলেটা যখনই আসত শিবুর আনন্দ বাড়তো নতুন মদের বোতল পেয়ে, সঙ্গে অনেক সময়ে নতুন জামা কাপড়।
সেদিন সারাদিন বৃষ্টি , কাজে যাইনি, আমাদের মেনু আজ খিচুড়ি পাঁপড় ভাজা, এই আবহাওয়ার সেদিন মনটা বেশ ফুরফুরে। আর শিবু যেন এই সুযোগই খুঁজছিল, খেতে বসে বলল, 
-‘আমার দিব্বি কর আমার একটা কথা রাখবি।’
-‘বলো রাখব, তবে দিব্বি ছাড়ো।’
-‘না, তোকে কথাটা রাখতে হবে। না হলে আমার মরা মুখ দেখবি।’
-‘আচ্ছা বলো রাখবো।’
-‘হালদার বাড়ির ছেলের কাছ থেকে আমি অনেক কটা টাকা নিয়েছি, কেবলমাত্র তুই একরাত তার সঙ্গে কাটবি বিছানায়। কেবল মাত্র তো একটাই রাত।’
একথা শোনার পরে চোখে অন্ধকার দেখলাম। অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলামনা। তারপরে খোলা খিলটা দিয়ে শিবুকে খুব পেটালাম। মার খেয়ে শিবু হাত জড়ো করে কাঁদতে লাগল। কিন্তু মুখে বল্লতে লাগল,
-‘আমাকে ক্ষমা করে দে। কিন্তু তুই না রাজি হলে হালদার বাড়ির ছেলেটা ওর দলবল এনে আমাকে জানে মেরে দেবে।
ভয়ে শিবুর মুখ পাংশুটে। মৃত্যু ভয়ে ভারাক্রান্ত। অগত্যা।
সেদিন একটু গভীর রাতে সে এলো। শিবু তখন কুঁকড়ে খাটের একধারে শুয়ে। আমার জন্যে সস্তা সিল্ক শাড়ি আর উগ্র সেন্ট নিয়ে এসেছিল আর শিবুর জন্যে একবোতল দামি মদ। আমাকে নতুন শাড়ি পরিয়ে প্রায় পুরো সেন্টটা ঢেলে দিলো। তারপরে চলল ভালোবাসার নামে নির্মম যৌন অত্যাচার। কামড়ে খিমছে আমার বুকদুটোকে ফালাফালা করল। আমার গোপনাঙ্গ হলো ক্ষতবিক্ষত। আমি চিৎকার করতে করতে কখন জ্ঞান হারিয়েছি মনে নেই। শুনেছিলাম ভয়ে পেয়ে সে একটা ভ্যান ডেকে আমাকে আমাদের কাছের ছোট  হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ছিল।
জ্ঞান ফিরলে গায়ে খুব ব্যথা। নিজেকে টানতে টানতে যখন রেল লাইনের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, পিছন থেকে কে একজন টেনে ধরল। পিছন ফিরে দেখি লাইন বস্তির শম্পামাসি। বললে,
-‘জীবনটা এত কম দামি নয়রে। এতদিন তো তোকে অন্যেরা বিক্রি করলো। এবার না হয়, নিজেকে নিজে বিক্রি কর।’
সেই থেকে আমি রানীর হালে আছি, শুধু সন্ধ্যার সময়টুকু কিছুক্ষণের জন্যে নিজেকেই নিজে বিক্রি করি, কারোর জন্যে নয়, একদম নিজের জন্যেই।





সম্পর্ক

ম ঞ্জি রা  ঘো ষ 

-- ও মা, শোনো না
--- বলো, শুনছি
----না, আগে এদিকে তাকাও
এই হলো মিতুল। সবটা attention  না পেলে মন পসন্দ হয় না। অগত্যা, মিতুলের দিকে ফিরতেই হলো মহুয়া কে।
---বলো কি বলবে 
---- ও মা, ফুল মামা এসেছে 
--- তাই!
---- হুম
--- বসতে বলো। বলো, মা হাতের কাজটা গুছিয়ে আসছে।
আজ মহুয়া স্কুলে যায়নি। আগামী কাল ও যাবে না। সি এল নিয়ে নেবে। সবেমাত্র টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। শীতের বেলা হুড়মুড়িয়ে ফুরিয়ে যায়।বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে পাঁচটা। সন্ধ্যা নামে। সারাদিন অবিশ্রান্ত পরিশ্রমে শরীর এলিয়ে আসে। অতিরিক্ত কোনো কাজ করতে ইচ্ছে হয় না।

রাঁচি থেকে খুকু মাসি আসছে আগামী পরশু। মাঝে মাত্র একটা দিন। মা এখন শিলচরে, ভাগ্নের বাড়ি। ফিরতে ফিরতে দিন পনের। খুকু মাসি কলকাতা আসছে চিকিৎসার জন্য। পঞ্চাশোর্ধ অবিবাহিত মহিলা।ব্যাঙ্কে রিজিওনাল ম্যানেজার। ভীষণ খুঁতখুঁতে আর কাঠখোট্টা।তাতে কি, মাসি তো! আসতে চাইলে বারণ করা যায়! বিশেষত চিকিৎসার কারণে যখন আসছে।

মাত্র আড়াইটা ঘরে মহুয়ার বসবাস। বাড়িটা ছড়ানো, আলো বাতাস আছে তবু। রাঁচির হাজারিবাগ রোডে বিরাট দোতলা বাড়ির এক অংশে মাসি একাই থাকেন, কাজের লোকেদের ভরসায়। আর আছে পোষ্য ভুট্টো। অন্য অংশে থাকে মামা মামী, মেয়ে নিয়ে। একান্নবর্তী পরিবারের যৌথ যাপনের রীতি নীতি, কৌশল, ধৈর্য্য, অ্যাডজাস্টমেন্ট কোনো কিছুর সঙ্গেই অভ্যস্ত নন, খুকু মাসি। তার উপর ভীষণ মুডি। তাই সারাক্ষণ ভীষণ চিন্তা হচ্ছে মহুয়ার। তাদের পরিবারে এখন হাঁড়ি আলাদা হলেও, সংসারের টিকিটা বাঁধা এখনও শাশুড়ি মা স্মৃতিকণা দেবীর হাতে। আর সব ভালো মন্দের হিসেব নিকেশ বড় জা জয়ীতার দায়িত্বে। কাছের মানুষ হলেও খুকু মাসি বড্ড আত্মকেন্দ্রিক। কে বলবে মায়ের বোন!

এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে স্টাডিটা যথাসম্ভব গুছিয়ে রেখেছে ও। একটা ঘরে তুতুল মিতুল কে নিয়ে ওর দিনলিপি। অন্য ঘরে অলোকেশ তার নিজস্ব জিনিস পত্র আর প্যাশন নিয়ে মশগুল। মহুয়া খুব গুছানো স্বভাবের মানুষ। পরিচ্ছন্ন পর্দা, বেড কভার, পিলো কভার, টেবিল ক্লথ পেতে ঝকঝকে করে দিয়েছে স্টাডি। দশ বাই বারো রুমে একজন মানুষ আরাম করেই থাকতে পারে। তবু চিন্তা হচ্ছে। একেকজন মানুষ বোধহয় এমনই হয়। অন্যপক্ষ আপ্রাণ আন্তরিক প্রচেষ্টা দিলেও, তাদের মন ওঠে না। নয়তো, শুভ্রা মামীর মতো মানুষের সঙ্গে ----

চায়ের জল ফুটে উঠেছে। গ্যাসের নব অফ করে চা পাতা দিয়ে, মহুয়া ঘরে এসে দ্যাখে, তুতুল মিতুল বীরুদাদা কে নিয়ে মশগুল।
 --- কি গো বীরু দাদা, এতদিন কোথায় ছিলে?
---- আর কোথায়! কোথাও যাবার জায়গা রইলো না গো বৌ দিদিমণি।
--- মানে! আমি তো ভাবছি, দেশে গ্যাছো 
--তাই গিয়েছিলাম গো
--- বলে যাও নি তো এবার। চিন্তা হচ্ছিল খুব।
---- বলে যাবার সময় হয় নি গো
----এলে কবে?
---- গতকাল সন্ধেবেলা 
---- বসো, চা ভিজিয়েছি। নিয়ে আসি।
রান্নাঘরে এসে মহুয়া দেখলো, মুড়ি বাড়ন্ত। মনে করে টুম্পার মাকে দিয়ে আনাতে হবে। আহা, বীরু দাদা যে মুড়ি চানাচুর খুব ভালবাসে! অগত্যা প্লেটে একটু বিস্কিট, চানাচুর আর কেক নিয়ে দুজনের দু কাপ চা নিয়ে ঘরে এলো মহুয়া।

শীতের বাতাসে আর্দ্রতা বড়ো কম। শরীরে টান টান ভাব। গলাটা তৃষ্ণায় শুকিয়ে গেছে।জাগ থেকে গলায় জল ঢেলে গলাটা ভিজিয়ে নিল ও। তারপর গ্লাসে করে জল এগিয়ে দিল, বীরু দাদার দিকে। ঢকঢক করে জল খাচ্ছে তৃষ্ণার্ত মানুষ টা।
--- এ নাও, গরম গরম চা খেয়ে নাও। তারপর তোমার দেশের বাড়ির গল্প শুনবো।
---- আর দেশের বাড়ির গল্প!
--- তুতুল মিতুল ততক্ষণে মায়ের পাশে এসে বসেছে, গল্প শোনার উৎসাহে।
বীরু দাদা পূর্ব মেদিনীপুরের পাশকুড়ার তমলুক মহকুমার ময়না গ্রামের মানুষ। বৃদ্ধা মা, বাবা, বৌ, ছেলে মেয়ে, ভাই, ভাইবৌ নিয়ে যৌথ পরিবার। দেশে ধান জমি আছে। বীরু দাদা কলকাতায় এক পার্শীসাহেবের কাছে কাজ করে, থাকে পার্শী বাগানে। বিকেলে অবসরে, কাছে দূরে বাড়ি বাড়ি ফুল দেয়।
সকালের দিকে এত ব্যস্ততার মধ্যে ঠিকমতো পুজো করা হয় না মহুয়ার। বেলায় ভালো ফুলও পাওয়া যায় না। তাই, সামনের বাড়ির আলো কাকিমা যখন বীরু দাদার সন্ধান দেয়, এককথায় রাজি হয়ে যায় মহুয়া। সন্ধ্যেবেলা যখন পুজো করবে, তখন বিকেলে ফুল দিলে অসুবিধে কি!

প্রথম দিন মানুষ টা বলেছিল,
---- আমারে বীরু বলেই ডাকবেন, বৌদিদিমণি। বাপে নাম রেখেছিল বীরেন, বীরেন মণ্ডল। পাড়া ঘরে বীরুই বলে সক্কলে। সেই থেকেই মহুয়ার কাছে উনি বীরু দাদা।বাড়ির অন্য সকলে কেউ বলে মালী, কেউ বলে মালী ভাই। কানে লাগে মহুয়ার, মন ভারি হয়ে যায়।

মিতুল তখনও হয় নি। তুতুল খুব ছোট্ট। এখন মিতুল প্লে স্কুল থেকে ক্লাস ওয়ানে আর তুতুল ক্লাস টু। এই সদাহাস্য, সরল, সৎ, গ্রাম্য মানুষটা কিভাবে যে এত আপন হয়ে গেল, কে জানে!
তুতুল মিতুল নিজেরাই কেমন ফুল মামা বলে ডাকে, খেলে। মাঝে মাঝে টুকটাক দোকান টোকান ও করে দেয় বীরু দাদা।
মনে পড়ে, ফুল দিদি একদিন বাবার সামনে বলেছিল, "কেডস্ টা মুচির কাছে রঙ করাতে হবে"।সে তো কতকালের কথা। তবু ছেলেবেলার অনেক কথাই মনে গেঁথে আছে ওর।

বাবা ছিলেন মিতভাষী, কোমল, স্নেহপ্রবণ মানুষ। কিন্তু তাঁর অভিজাত ব্যক্তিত্বের কাছে পরিবারের সকলেই আনত। বাবা সেদিন ফুলদিকে বলেছিলেন,   "এভাবে বলছ কেন? কাকু, মামা, দাদা এরকম ভাবে ডাকতে হয়"
ফুলদি ভয়ে, লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। বাবা তখন বুঝিয়ে বলেছিলেন, "কারো জীবিকাই তার শেষ পরিচয় নয়। জীবনের প্রয়োজনে আমি আমার কাজ করছি, তোমার মা তাঁর নিজের কাজ করছেন, তোমরাও সকলে নিজের নিজের মতো কাজ করছো। তোমাদের ছোটদের সবচেয়ে বড় কাজ গুরুজনদের সম্মান দেওয়া। এই যে কেডস্ টা রঙ করাতে যাবে, এই কেডস্ এর আবিষ্কারক টমাস বাটা চেকশ্লেভিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে খুব দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলেন।তারা বংশপরম্পরায় চর্মকার ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর তরুণ টমাস প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ও পরিশ্রমের জোরে সু কোম্পানি তৈরি করেন। এখন দেশ বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে বাটা সু প্রোডাক্ট।

মহুয়া ছেলেবেলায় বাবার কাছে শোনা প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনতো। যত বড় হয়েছে উপলব্ধি করেছে গভীর ভাবে। বাবাও জানতেন, তাঁর ছোট্ট বুবুন তাঁর অন্ধ অনুসারী।

তাদের ছেলেবেলায়, তাদের যাপনে তেমন আড়ম্বর ছিল না। ছিল শিক্ষা, রুচি আর আদর্শের চর্চা এবং তা প্রায় প্রতি ঘরে ঘরেই। কি সুখেই না কেটেছে ছেলেবেলাটা। আর এ বাড়িতে তুলনায় বিষয় আশয়, সম্পত্তি অনেকটা থাকলেও সুখ কোথায়! এতদিনেও  তো ওকে তিলমাত্র কেউ বোঝেনি। হয়তো সুখ আছে ওদের নিজেদের মতো, যা মহুয়া কে কখনো স্পর্শ করে না, তৃপ্ত করে না, শ্রান্তি দেয় না।
---- কি গো,শুধু চা খাচ্ছ যে
---ভালো লাগছে না বৌদি মণি।
----কেন?
--- আমাদের দেশে বন্যায় সব ভেসে তলিয়ে গেছে গো।
এবার ভেঙে পড়ে বীরু দাদা। বীরু দাদা দু হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে পিঠের অংশ। তুতুল মিতুল অবাক হয়ে দেখছে।

মহুয়া তো খবরে পড়েছে, তমলুক মহকুমার বহু গ্রাম জলের তলায় তলিয়ে গেছে। তবে কেন মনে হয় নি, বীরু দাদার পরিবারের কথা! অথচ ভাবছে কেন বীরু দাদা ফুল দিতে আসছে না। অপরাধ বোধের অব্যক্ত যন্ত্রণা বুক ঠেলে গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। একটু সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে, "তারপর?"
--- বন্যার খবর পেয়ে, দেশে পৌঁছে দেখি সব শেষ। জলে ভাসছে গোটা গ্রাম। আশে পাশের সব গ্রামেই খেত খামার, পুকুর, দালান, উঠোন সব একাকার। কিচ্ছুটি নেই। সব নিশ্চিহ্ন।

কিছুক্ষণ স্তব্ধতার পর চোখ মুছে বীরু দাদা বলে,
---- আর থাকবোনা কলকাতা।বাড়ি ফিরে যাবো।
----- কোথায় যাবে, বসত বাড়ি যে ভেসে গেছে তোমাদের।
---পশ্চিম মেদিনীপুরের কাঁথিতে মাসি,মেসো, তাদের ছেলেরা আছে। ওদিকটা উঁচু জমি তবু।চাষ বাস জানি। কিছু একটা করবো। আর তো দেখা হবে না, তাই দেখা করে গেলাম। বাচ্চা দুটোর যে বড় মায়া গো বৌদিমণি।

তুতুল মিতুল নির্বাক। ওরা কি বুঝতে পারছে, কি হারিয়েছে ওদের ফুল মামা?

মহুয়া জোর করে কিছু পথখরচ দিয়ে দেয়, বীরু দাদার হাতে।
--- যাবেই যখন, আজ রাতে আমাদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে যাও।
--- না গো,মন ভালো নেই। পরে কলকাতা এলে আসব গো তোমাদের কাছে।
  ---- আমাদের ফোন নম্বর নিয়ে যাও। ঠিকানা ও লিখে দিচ্ছি।অসুখ বিসুখ হলে, সময়ে অসময়ে তোমার ভাইদের বলবে আমাদের খবর দিতে। আমার বড় দিদির বাড়ি খড়গপুর টাউনে। দরকার হলে চলে যাব।
--- ঠিক আছে বৌদিমণি।
বীরু দাদা তুতুল মিতুলের দিকে তাকিয়ে আপনমনে কি যেন বলতে থাকে, বিড়বিড় করে।
চঞ্চল মিতুল স্তব্ধ। তুতুল খাটের এক কোণে, ড্রইং খাতার উপর ঝুঁকে পড়েছে।
--- কি করছো তুতুল? শুনছো তো ফুল মামা এখন অনেকদিন আসবে না। তুতুল ওর শান্ত অথচ উজ্জ্বল চোখ তুলে বললো, ---তাই তো ফুল মামাকে আঁকছি।সাড়ে ছ বছরের তুতুল সাধ্যমত তার ফুল মামাকে আঁকছে, খুব মন দিয়ে।
--- আমি তো আঁকতে শিখি নাই গো। তোমাদের মনেই ধরে রাখব গো। মহুয়া অ্যালবাম বার করে তুতুল মিতুলের যুগল ছবি বীরু দাদাকে দেয়।

বীরু দাদা চলে যাচ্ছে। মেন গেট পর্যন্ত এগিয়ে আসে মহুয়া। যে মানুষটা সম্প্রতি হারিয়ে ফেলেছে 
তার সর্বস্ব, তাকেও মনে মনে তৈরি হতে হচ্ছে আগামী জীবনের জীবনযুদ্ধে। মানুষটা চলে যাচ্ছে তার শেকড়ের টানে, এক অজানা, অনিশ্চিত জীবনের দিকে। এই হেরে না যাওয়া মনোবলের মানুষটিকে মনে মনে প্রণাম করে মহুয়া। সহজ, সরল, মাঝারি উচ্চতার, মাঝারি চেহারার মানুষটি ধীরে ধীরে দৃষ্টির আড়াল হয়ে যাচ্ছে। চোখের জল বাঁধ মানছে না।সম্পর্কের নানা সুতো কেমন করে যেন, হৃদয়ের নোঙরে বাঁধা হয়ে যায় নানা সময়ে। মানুষ বুঝতে পারে না। যখন একটু টান পড়ে, খা খা করে বুকের ভেতরটা। বড় নিঃস্ব লাগে।

গেট বন্ধ করে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে ঘরের দিকে। বীরু দাদা যে প্রতিদিনের যাওয়া আসায় ওদের এত কাছের হয়ে গিয়েছে, আগে তো বোঝে নি। বোঝার অবকাশও হয় নি বোধহয়।
রান্নাঘরে ছেলেদের টিফিন করতে করতে, মহুয়া আপন মনে গুনগুন করে --
"আপনাকে এই জানা আমার, ফুরাবে না '"






বউ যদি...

তা প স  পা ল 

দোকান থেকে এসে অনিক তার ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দেয় দোতলার বারান্দার খাটটাতে। ক'দিন ধরেই তার খুব পরিশ্রম হচ্ছে, তবু মুখে কাউকে কিছু বলে না। "ব্যবসায়ীদের কোন সম্মান নেই"--- শাশুড়ির বলা এই সত্যটা দিন দিন আরো প্রকট হচ্ছে। তুচ্ছ কারনে খরিদ্দাররা  দোকানে ঝামেলা করে, তাছাড়া নানা রকম চাঁদা, দান-অনুদান তো আছেই। ভালো বাজার না আনলে বাবা মুখ খারাপ করে। মা বলে, "বাড়ির একটা কাজ তুই করবি না, তুই না করলে কে করবে, তোর বাবার কি আর সে বয়স আছে! "ছেলেমেয়েদের নিত্যনতুন আবদার, স্ত্রীর মুখ-ঝামটা--- কোনদিন উঠতে একটু দেরি হলে বাড়ি মাথায় করা, দুপুরে-রাতে আসতে একটু দেরি হলেই খেয়ে-দেয়ে রমলা  ছেলেমেয়েদের নিয়ে ওপরে দরজা বন্ধ করে দেয়, খাবার তার ঢাকা থাকে। অনিক এসে ফ্রেশ হয়ে ঠান্ডা খাবার খেয়েই ওপরে চলে যায়। দীর্ঘ কয়েক বছর বারান্দায় তার বিছানা পাকাপাকি। স্ত্রী রমলা বলে, "ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে যদি তোমার সঙ্গে এক বিছানায় শুই তাদের মনে খারাপ প্রভাব পড়বে। তার চেয়ে বরং তুমি বাইরে থেকো, সব ছেলেরা ঘুমালে আমি তোমার কাছে আসবো। বেশির ভাগ দিনে রমলা ঘুমিয়ে পড়ে, অনিক দু একবার ডাকে, রমলা বলে আজ আর ভালো লাগছে না, অনেক রাত হয়েছে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, ভোর থেকে উঠে আবার হাজারো কাজ।"

ভোর থেকে উঠে রমলাকে সব কাজই করতে হয় সত্য, তবু দুটো মনের কথা স্ত্রীকে বলতে না পারলে তার ঘুম আসে না। সারাদিন খাটাখাটির পর একটু কোমল হাতের পরশ সব পুরুষেরাই কামনা করে--- বিয়ের আগে বন্ধুরা গল্প করতো তাদের বউদের রাতে খেতে না দিলেও ঠিক আছে কিন্তু একটু ভালোবাসার পরশ তাদের না দিলে তারা কিছুতেই ঘুমোবে না। কিন্তু রমলা একেবারেই আলাদা, শরীরের চাহিদা তার কোন দিনই ছিল না, চাহিদা নেই কোন কিছুরই। পছন্দ করে একটা ভালো কাপড় কিনে আনলে বলে, "কি হবে আলমারি ভর্তি কাপড় আমার পচছে, তার চেয়ে তুমি যদি আমায় দু'খানা সুতির শাড়ি এনে দিতে আমি মনের সুখে পরতাম"

---সুতির ছাপা তো এনে দেব, পুজোতে একটা ভালো শাড়ি দিলাম এটা তোমাকে খুব সুন্দর মানাবে--- ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর চোখে একটু কাজল, উপর করে ক্লিপ  দিয়ে চুলটা বাঁধবে, ওহ যা দেখাবে না তোমাকে, তুমি তো দেখতে কম সুন্দরী নও, কিন্তু কেন জানিনা তুমি একটুও সাজতে চাও না---

---সেজে কি প্রেম করতে বেরোবো নাকি, দেখো মেয়েরা বড় হচ্ছে, ঐরকম করে সাজলে তারা কি মনে করবে একবার ভাবোতো, তুমি না দিন দিন একেবারে রসপাগল হয়ে যাচ্ছ। যত বয়স বাড়ছে সুন্দর সুন্দর মেয়েদের দিকে নজর, কই আগে তো তুমি এরকম ছিলে না! মুখে তো একেবারে কথাই বেরতো না। দুপুরবেলায় একটু শোয়ার জন্য ডেকে নিয়ে গেলে না না আমার দোকান আছে বলে চলে গেছো, সেদিনের কথাগুলো আমি আজও---
যে সময়টা মেয়েদের স্বামী-সুখ পাওয়ার সে সময়টা তুমি আমায় বঞ্চিত করেছ, আজ ডাকলে আমায় পাবে কেন!--- এই বলে রমলা মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দেয়।
অনিকের সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণা চাপা পড়ে থাকে বালিশের তলায়। চার দেয়ালের বাইরে তাদের সম্পর্ক কেউ জানে না, বাবা-মাও না। পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে স্বামীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ রমলা। নিত্য স্বামীর পোশাক পাল্টানো, জামা-কাপড় কাঁচা, স্বামীর পছন্দের পদ রান্না করা, মায়ের কাছে স্বামীর প্রশংসা... ----পাড়া-প্রতিবেশীরা সবাই রমলার প্রশংসা করে বলে, "এমন বউ লাখে একটা মেলে!"

পুজোতে অনিক শ্বশুরবাড়ি যায়। রমলাই তাকে যেতে বাধ্য করে। অনিক বলে পুজোর সময় দোকানে ভীড়, আমি পরে যাব। কিন্তু রমলার জেদ অনিককে যেতে বাধ্য করে--- রমলার একটাই কথা, "পূজোর সময় একা গেলে পাড়া-প্রতিবেশীরা কি বলবে, অন্য সময় হলে আলাদা কথা কিন্তু আমারও তো পাড়ায় একটা প্রেস্টিজ আছে। দোকানতো তোমার সারা জীবন রইল!"

ক'দিন কাটিয়ে অনিক চলে আসে বাড়িতে। রমলা আসে লক্ষ্মী পূজোর পর। এসেই শাশুড়ি মাকে তত্ত্ব সাজিয়ে দেখায় বলে আমার বাবার এ বছর অনেক খরচা হয়ে গেল।

অনিকের মা বলে, "তুমি তোমার বাবার কাছে এত কিছু নিলে তুমি তাদের কিছু দাওনি? "

রমলা বলে, "আপনার ছেলের টাকা কই মা, যে তাদের দেবে!
কোনদিন মিষ্টি নিয়েই ঘরে ঢোকেনি ও দেবে তাদের জামাকাপড়!"

অনিক দুপুরে খেতে আসতেই তার মা জ্বলে ওঠে, বলে--- "যাওয়ার সময় বৌমার হাতে টাকা দিস নি কেন, ও তাদের কাছে সবার জন্য এত কিছু নিয়ে এলো, তাদের তো কিছু দিতে হবে, কারো কাছে কিছু নিলে প্রতিদানে কিছু দিতে হয়, এ বয়সে এটাও জানিস না, তোর সম্মানটাই বা কোথায় গেল, একবার ভেবে দেখেছিস।"

অনিক প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না; বলে, "আমার খুব খিদে পেয়েছে আমায় তাড়াতাড়ি খেতে দাও!"

---"মা আপনার ছেলে পেটে রাক্ষস নিয়ে বাড়ি আসে, এখন ও কিছু শুনতে পাবে না, আমি রান্না ঘরে চললাম, কি করে যে মানুষের এত খিদে পায়, জানিনা বাপু! আমরা তো কোন সকালে খেয়েছি, কই আমাদের তো খিদে পায় না, বাড়ি এসে হাত-মুখ ধোয়া নেই, বসা নেই, কারো খোঁজ খবর নেওয়া দূরে থাক, ছেলে মেয়েরা খেয়েছে কিনা জানার দরকার নেই, বাবুকে খেতে দিয়ে দিন, দাঁড়াবে না, খেয়ে দেয়ে দোকান চলে যাবে, দোকানে খদ্দের দাঁড়িয়ে রয়েছে কিনা! "

অনিক অবাক হয়ে রমলাকে দেখে। আগে তো ও এরকম ছিল না। কত ভালবাসা ছিল তার প্রতি, দিন দিন যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে বউটা, ভালো ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন।

রাতে শুয়ে শুয়ে কত কথাই মনে পড়ে অনিকের। রমলাকে তার তেমন পছন্দ ছিল না, দিদিমাকে সে কথা আগে জানিয়েছিল। দিদিমা একগাল হাসি হেসে বলেছিল, "মনের মত কি কাউকে পাওয়া যায় ভাই, নিজের মতো গড়ে নিতে হয়, দেখবি ওই মেয়ে হাসিতে আনন্দে তোকে ভরিয়ে তুলবে।"

ভরিয়ে তুলেও ছিল দুটো বছর। যখন মেয়ে হল তার মা তাকে নিয়ে চলে গেল, তখন আষাঢ় মাস। বলেছিল, পুজোর পর আসবে। কিন্তু অঘ্রাণ মাসে শালার বিয়ে চুকল, শাশুড়ি আবদার করে বলেছিল মাত্র তো দুটো মাস, একটু কষ্ট করে চালিয়ে নাও বাবা, বিয়েবাড়ির পরেই রমা যাবে, শুধু শুধু যাতায়াত করে বাচ্চাটার ঠান্ডা লাগবে।"
আপত্তি করে নি কেউই।

বিয়ের আগের দিন সন্ধ্যায় অনিক শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছায়। শাশুড়ি মা বলে, "তোমাদের লজে জায়গা করা হয়েছে বাবা। তাছাড়া মালপত্র সব চলে গেছে। বড় জামাই মাস্টার মানুষ সে যেতে পারবে না, তোমার মামারা যাচ্ছে তুমিও যাও। "

অনিক ভেবেছিল রমলা বলবে, "না, ও এখানেই থাকবে, এতদিন পরে এলো!" কিন্তু রমলা কিছু বলে না। বাধ্য হয়ে অনিক বলে, "আমার খারাপ লাগছে খেয়েদেয়ে এখানেই শুয়ে পড়ি, কাল সকাল সকাল লজে যাব!"
রাতে রমলা বলে, "কেন বউ ছাড়া কি ঘুম আসছিল না, এতদিন কি না ঘুমিয়ে ছিলে!"
এমন ব্যবহার আশা করেনি অনিক। পাস ফিরে শুয়ে থাকে, অভিমান ভাঙ্গায় না বউ । 

এমনি করে জীবন এগিয়ে চলে মন্দাক্রান্তা ছন্দে। সে জানেনা কি ট্র্যাজেডি লেখা আছে তার কপালে। বউকে কিছু বলা চলে না। কি করতে কি করে বসবে। বদনাম হবে, থানা-পুলিশ, পাড়াতে বাস করা দায় হয়ে দাঁড়াবে, লোকে আঙ্গুল তুলে বলবে, "ওই দেখ ওই যে---" 
---দোকানে কেউ আসবেনা, বলবে ওর দোকানে কেউ যাসনা, ও ওর এত সুন্দর বউটাকে --- ছেলেমেয়েগুলো অনাথ হয়ে যাবে, তাদের বিয়ে দেওয়া--- এইসব অনেক কথা ভেবে অনেক চুপ করে থাকে! আজকের পুরুষ এমনই অসহায়! পুরুষের জন্য আরও দুর্দিন আসছে--- ঠাকুর পরমহংসের ফোঁসহীন সাপের মতোই  আজ তাদের অবস্থা!






গোধূলি বেলা

মী না ক্ষী  চ ক্র ব র্তী  সো ম

সাকুল‍্যে চারজনের সংসার ছিল। বড়মেয়ে লিলি বিয়ে হয়ে চলে গেছে বিদেশে। সেই থেকে পনেরো বছর ধরে তিনজনের সংসার। এবার পুজোর ঠিক আগে চলে গেল বাড়ির প্রাণভোমরা সুচিত্রা। নৈঃশব্দের সাম্রাজ্য এখন এই বাড়ি। শরতের পুজো পুজো আবহে ভীষণ ব‍্যস্ততায় ভরে উঠত এবাড়ির আনাচকানাচ। ঘরের সর্বত্র শাড়ি-সালোয়ারের স্তূপ জমে থাকত। চেয়ার, টেবিল সবকিছুই সুচিত্রার কাপড়ের দখলে। সাথে ম‍্যাচিং জুয়েলারি। প্রয়োজনের সময় ঠিক সেই জিনিসটাই খুঁজে পাওয়া না গেলে দুজনের খিটিমিটি লেগে যেত যখন তখন। 

এখন আর সেরকমটা নেই। ছোটমেয়ে মিলি ভীষণ গুছোনো স্বভাবের। সে বেরিয়ে যায় অফিসের কাজে। মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তার ব‍্যক্তিত্ব বিকাশে সাহায্য করে একথা নির্মাল‍্য সেন চিরদিন বিশ্বাস করেছেন। সেই কতকাল আগেই তিনি ছোটবোনকে চাকরিতে যাবার জন‍্য সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সেই পথ ধরে বড় ভাইঝিও এগিয়ে গেছে। আর নিজের মেয়েদেরকে তো সবসময় উৎসাহ দিয়ে গেছে পিসি, দিদি ঢওরাই। অবসর সময় বন্ধুদের সাথে কাটাতে ভালোবাসে মিলি। বাবাকে সময় দেয়না এমনটাও বলতে বাধে নির্মাল‍্য সেনের। তবে তিনি লক্ষ্য করেছেন বন্ধুদের সাথে সময় কাটিয়ে এসে স্ফূর্তিতে থাকে মেয়ে। জীবনের মূলধন এইসব সঙ্গসুধা, এখন তিনিও বোঝেন। 

সুচিত্রা চলে গেল হঠাৎ করে। কিছু বলার সুযোগ পেলনা। মিলি নিজের কাজ-কাম নিয়ে ব‍্যস্ত থাকে। মায়ের শূন্যতা তাকেও বিধ্বস্ত করেছে। তবু ঘরের তদারকি করে পুরোটাই। কাজের মাসি আসে নিয়মিত। কোন কিছুর জন‍্য চিন্তা করতে হয়না। তবু কী এক অশান্তি কুরে কুরে খায় অবসর সময়টুকুতে। প্রতিপল, প্রতিদিন সুচিত্রার অভাব নিয়ে নিজের পৃথিবীতে গুটিয়ে পড়ছেন নির্মাল‍্য। যতদিন সুচিত্রা বেঁচেছিল একাকিত্ব বোঝেননি নির্মাল‍্য। পাড়ার সকলের সাথে যোগাযোগ রেখে চলত সুচিত্রা। পাড়ার দুর্গাপূজোর শুরুটা হয়েছিল সুচিত্রার উৎসাহে। সেইভাবে কালীপুজোর যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেছে সবসময়। 

পুজোর আগে-পরে সব মিলিয়ে প্রায় পনের দিন অতিথির মত বাড়িতে আসা-যাওয়া চলত সুচিত্রার। রাতের ঘুমের জন্যই চলে আসত হত কারণ রাতে দুটো বড়ি নিয়ম মেনে খেতে হয়। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ। অন‍্যথায় ভারী বিপদের আশঙ্কা। এই ব‍্যাপারে সুচিত্রাও ভীষণ সাবধান ছিল। পুজো এসেছে তিথি দিন-ক্ষণ নিয়ম মেনে। শুধু সুচিত্রা নেই। ইদানিং খুব বেশি করে মনে পড়ে সুচিত্রার কথা। ক্লাবের পুজোপ‍্যাণ্ডেলে পুরোনো গানগুলো বাজে তখন আরও বেশি করে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন নির্মাল‍্য। 

স্বল্পভাষী হয়ে তিনি সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। সংসার পরিচালনার বেশিরভাগটাই সামলে নিত সুচিত্রা কাজেই তেমন অসুবিধা বোধ হয়নি। দুর্গাপুজোর চাঁদা তুলতে দলবেঁধে যেত পাড়ার সব মহিলারা। বিকেলের তিন থেকে চার ঘন্টা বরাদ্দ সেই কাজে। অফিস থেকে ফিরে এসে সবকিছু হাতের কাছে নিখুঁতভাবে গুছানো পেতেন নির্মাল‍্য। কেসেরোলে গরম গরম টিফিন, ফ্লাস্কে চা, গরমজল সবকিছু টেবিলে সাজানো। বিছানার কোণে রাখা পায়জামা, পাঞ্জাবি, গামছা। হাতের কাছে দরকারি জিনিসপত্র রাখা। অনুযোগ করার কোনরকম অবকাশ অবশিষ্ট রাখতনা সুচিত্রা। নিজের থেকেই বলত, "সারাবছর ঘরেই থাকি। পুজোর ক'দিন নাহয় সবার সাথে মেলামেশা করে সম্পর্কে শান দিয়ে রাখি। কী বল?" যেন নিজেকেই নিজে কৈফিয়ত দেয় সুচিত্রা। 

সত্যিই তো। সমাজে একসাথে থাকতে হলে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা দরকার। সুচিত্রার জীবিতকালে এসব কথা ভাবার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু সুচিত্রা বিনা নোটিসে হঠাৎ  চলে যাওয়ায় নির্মাল‍্য সেন কেমন যেন একা হয়ে গেছেন। শুধু চাকরিটাই করেছেন তিনি। বাকি বাজারহাট ব্যাংক খাবার টিফিন উপহার সবকিছু সুচিত্রার হেফাজতে স্ব-ইচ্ছায় দিয়ে রেখেছেন। পাড়ার সকলে তাই সুচিত্রাকেই বেশি করে চিনত। যেদিন সে একেবারে চলে গেল সেদিনও দিব‍্যি হেঁটে চলে বেরিয়েছে। সকালবেলায় বাজার সেরে এসে ব্রেকফাস্ট তৈরি করেছে। দুজনে একসাথে বসে খেয়েছে। এসময় দুজনে দুকাপ ঘনদুধের চা পান করেন। দিনের শুরুটা ভালোই ছিল। তারপর দুপুরের রান্না শেষ করে বাথরুমে গেছিল সুচিত্রা। অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে মিলি ঘরে চলে আসে প্রায়সময়। সেদিনও মিলি এসেছিল। খুব জোরে একটা আওয়াজ শুনে নির্মাল‍্য ছুটে গিয়ে দেখতে পান স্নানঘরের মেঝেতে পড়ে আছে সুচিত্রা। মুখ দিয়ে গাঁজলা বেরোচ্ছে। ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে আসার আগেই (সব শেষ হয়ে গেল। সুচিত্রা কি কিছু বলতে চেয়ে নির্মাল‍্যর হাতটা জাপটে ধরে রেখেছিল! একা একা কত কথা মনে হয় নির্মাল‍্যর।  

সুচিত্রা খুব পান খেত দোক্তা দিয়ে। কতবার মান-অভিমানের পালা করেও ছাড়ানো যায়নি সে অভ‍্যাস। বাজার-হাট নিজেই করত তাই বাধা দেবার কেউ নেই। পান সুপুরীর সংসার লুকানো থাকত কোথাও। সে ঠিকানার হদিশ কোনদিনও পাননি নির্মাল‍্য। ছোটমেয়ে মিলির জন্মের পর কেমন করে যেন শাশুড়িমায়ের সাথে পানপাতার রসে মজে গেছিল সুচিত্রা। সেই শুরু। পরে নেশা হতে হতে জর্দা দিয়ে খিলি বানিয়ে মুখে পুরে রেখে দিত। 

পুজোর মাসখানেক আগে এমন ঘটনায় নির্মাল‍্য প্রতিনিয়ত ভেঙে পড়ছেন। অথচ মনের উচাটন ভাব কাউকে বলতে পারেননা। লোকে হাসবে যদি কান্নাকাটি করে চোখের জল ফেলেন। পুরুষ মানুষের এই এক জ্বালা। মনের ভাব মনেই চেপে রাখতে হয়। সমাজ ব‍্যবস্থা ছোটবেলাতেই শিখিয়ে দেয় ছেলেদের কান্নায় অধিকার নেই। ছেলেরা ব‍্যথা পেলেও বলতে নেই। স্ত্রীর স্মৃতিচারণ করলেও বিরূপ মন্তব্য শোনার হাজারো পথ খোলা। অতএব কিছুটা বাধ‍্য হয়েই চেপে যান মানসিক দুর্বলতা। কখনো ভাবেন মায়ের কথা বলে মিলি ঝরঝর করে কাঁদে, নিজেও যদি অমনটা কাঁদতে পারতেন। তাই বলে চোখে কি জল আসেনা সুচিত্রাকে ভেবে? সেরকম সময়ে অপ্রস্তুত হন নির্মাল‍্য। 

সুচিত্রা বেঁচে থাকতে নির্মাল‍্য অনুভব করেননি এতটা নির্ভরশীলতা। জীবন চলছিল তার আপন গতিতে এখন সকাল থেকে শুরু হয় সুচিত্রার অনুপস্থিতিতে নির্জন সংসারযাত্রা। মিলি বেরিয়ে গেলে শূন্য ঘরগুলি ব‍্যঙ্গ করে নির্মাল‍্যকে মনে করিয়ে দেয় স্ত্রীর অভাব। এসব কি বিরহের সংকেত! প্রেম থাকলে পরে বিরহের কথা। বিবাহোত্তর সময়ে প্রেম গড়ে উঠেছিল বোধহয়। তেমন করে ভাবার অবকাশ ছিলনা নির্মাল‍্যর জীবনে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে বিধবা মা ও বৌদি সাথে ছোট ভাইবোন এবং দাদার ছেলেমেয়ের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে প্রতিদিনের অন্ন জোগান ছিল জীবনের লক্ষ্য। ভাগ‍্যিস সরকারি একটা চাকরি জুটেছিল কপালে। 

সুচিত্রাকে পছন্দ করে নিয়ে এসেছিল মা ও বৌদি গিয়ে। পাশাপাশি থাকতে থাকতে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল অবশ‍্যই এবং পঞ্চাশবছর যুগ্মজীবন পেরিয়ে নির্মাল‍্য উপলব্ধি করেন প্রেম কখন যেন রূপান্তরিত হয়েছে বিশ্বাসে, নির্ভরশীলতায়। কালের চক্র মেনে গত হয়েছেন মা এবং মাতৃসমা বৌদি। ছোটদের পড়াশোনা শেষ হয়ে চাকরি-বাকরি হয়েছে। সবাই নিজের সংসার নিয়ে ব‍্যস্ত। ছোটমেয়ে মিলি বিদেশি কোম্পানিতে কর্মরত। সে জানিয়ে দিয়েছে সে বিয়ে করবে না। সংসারকে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে এনেছিল সুচিত্রা। স্ত্রীর প্রতি নির্মাল‍্যর অশেষ গোপন কৃতজ্ঞতা। সুচিত্রার নবযৌবনে তিনি ফিরেও তাকাননি। কোনদিন প্রশংসাসূচক একটি বাক‍্যও মুখ থেকে বের করেননি। সব খামতি পুষিয়ে নেবেন ভেবেছিলেন অবসর জীবনে। ঘুরতে যাবেন এখানে সেখানে, সামনে দূরে। অথচ কী যে হয়ে গেল! দীর্ঘশ্বাস পড়ে নির্ম‍াল‍্যর। 

পুজোর আনন্দে চারপাশ আচ্ছন্ন। আকাশে বাতাসে রিণরিণ করে বাজে আগমনী গান, নীল আকাশে পেঁজা তুলোর অকারণ ভেসে যাওয়া, মনের কোণে সুচিত্রার ঘনঘন আসা-যাওয়া, এসব নিয়েই কাটে নির্মাল‍্যর অলসদিন। একসময়ের প্রিয়বন্ধুরা সকলেই বয়সের ভারে স্তিমিত করেছে সামাজিকতা। বিকেলে হেঁটে আসার পর ব‍্যালকনিতে বসে থাকেন। মাঝে মাঝে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখেন মিলি ফিরছে কিনা। আজকাল বেশি সময় বসে থাকলে ঘুম পায়। কিন্তু উঠে বিছানায় যেতেও ইচ্ছে করেনা।

মণ্ডপে মণ্ডপে চলছে ষষ্ঠী পুজোর প্রস্তুতি। দেবী বরণের সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যাচ্ছে মাইকে। ঝুলবারান্দা থেকে মণ্ডপ দেখা যায়। অনেকসময় কেটে গেল। তিনি শুনতে পাচ্ছেন সুচিত্রা কী যেন বলছে। পাশের চেয়ারে এসে বসেই শুরু করেছে পুজোর যাবতীয় কথাবার্তা। কমিটির কথা, তিনদিনের খাবারের মেনু, প্রতিদিনের আলাদা ড্রেস কোড আরও কত কী। কথা মাঝপথে থামিয়ে নির্মাল‍্যকে বলল, "চল, এখন ভিড় কম। কয়েকটি প‍্যাণ্ডেল দেখে আসি। কতদিন হয়ে গেল দুজনে একসাথে বেরোইনি।" নির্মাল‍্য এই সঙ্গটুকুই তো চাইছিলেন ভীষণভাবে। সুচিত্রার পিছু পিছু তিনি বেরিয়ে এলেন।।






ভালো থাকা

কা জী  নু দ র ত  হো সে ন 

শিমুলতলা বাস স্টপেজে নেমে পুরনো সিনেমা রোড ধরেই সাধারণত মার্কেটে যায় গোবিন্দ। আজ কিন্তু ওদিকে গেল না। কারণ, যতীন দাসের পাওনার ব্যাপারটা আগে ফয়সালা করতে হবে। অর্ডারের মালগুলো পরিচিত রিক্সায় নিচুবাজারে পাঠিয়ে দিল। তারপর ব্যাঙ্ক রোড ধরে কিছুটা পায়ে হেঁটে গিয়ে প্রথমেই যতীন দাসের দোকানে উঠল। তার উপস্থিতি টের পেয়ে মুখটা কিছুটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল যতীন দাসের। তবু অন্যদিনের মত আজও সেই বিনয়ের হাসি মুখে ছড়িয়ে মোলায়েম ভাবে বলল,
-- এসো এসো ভাই গোবিন্দ... ভালো আছো তো তুমি?

প্রতি সাক্ষাতেই এরকম গদগদ ভাব দেখায় যতীন দাস। আজ তাই এত আন্তরিক আপ্যায়নেও হেলদোল নেই গোবিন্দর। সপ্তাহের প্রতি শনিবার এ শহরে মার্কেট করতে আসে সে। একবার না একবার, এ দোকানে আসতেই হয়। আগে অর্ডারির মাল দিতে আর নতুন অর্ডার ও পুরনো পেমেন্ট নিতে আসতো। এখন মাল দেওয়ার পাট চুকে বুকে গেছে। তিন মাস থেকে আসা-যাওয়া শুধু বকেয়া পড়ে থাকা পেমেন্ট আদায় করার জন্য। বিলগুলো পেমেন্ট না হলে স্বস্তি নেই গোবিন্দর। কিন্তু লোকটার ঐ মিষ্টি হাসি আর 'ভালো আছো তো গোবিন্দভাই'--- শুনে শুনে এখন ক্লান্ত হয়ে গেছে সে। শুনলেই পিত্তি জ্বলে যায়! কারণ গোবিন্দ জানে, টাকার কথা পড়ামাত্রই লোকটা বলবে,..  'হ্যাঁ হ্যাঁ ভাই, তোমার পাওনাটা দিতে হবে এবার। তবে আজ একটু টানাটানি আছে। তুমি বরং সামনের সপ্তাহে এসো, বিলটা আমি ক্লিয়ার করে দেব। চা বলব? চা খেয়ে যাও এককাপ...'

গত সপ্তাহে একই কথা শুনে তেতে উঠেছিল গোবিন্দ। লেবু কচলাতে কচলাতে তেতো হয়! বয়স্ক মানুষ বলে খাতির করেনি আর। কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছিল মুখের ওপর। শাসানি দিয়েছিল,
--কি পেয়েছেন কি আপনি বলুন তো! ডিস্ট্রিবিউটার কি আমার সম্বন্ধী, যে খাতির করে টাকাটা মাফ করে দেবে! পাইপয়সা আমার একাউন্টে লিখে রেখেছে। কমিশন থেকে কেটে নেবে পুরোটা হিসেব করে। আপনার জন্য কি আমি পথে বসব? লজ্জা করেনা আপনার, একটা মানুষকে কতদিন ঘোরায়?
যতীন দাস মাথা নিচু করে গোবিন্দর কথাগুলো শুনেছিল। কোনো জবাব দেয়নি। অন্যদিনের মতো চা খাওয়ার কথাও তোলেনি। গোবিন্দই শেষ কথা বলে দোকান থেকে নেমে গেছিল সেদিন,
--- আজ আমি যাচ্ছি, সামনের সপ্তাহে কিন্তু খালি হাতে ফিরব না বলে দিয়ে গেলাম। ফয়সালা যা করার করে যাব। আপনার সম্মান রাখতে পারব না।

গোবিন্দর আশা ছিল, গত সপ্তাহের কড়া ডোজে নিশ্চয়ই কাজ হবে। আজকে অন্তত বকেয়া পেমেন্টের কিছুটা হলেও মিলবে। কিন্তু তাকে হতাশ করে দু-হাত কচলে সেই অতি পরিচিত মিনমিনে গলায় যতীন দাস বলল,
--- গোবিন্দ ভাই, যা ক্যাশ ছিল সাবানের এজেন্সির লোককে একটু আগে পেমেন্ট করে দিলাম যে! আজকে আর তোমারটা হচ্ছেনা যে ভাই...'
দম ধরে একটুখানি চুপ করে থাকার পর রাগে গর্জন করে উঠল গোবিন্দ,
– দাঁড়ান আজ মজা দেখাচ্ছি, চালাকি পেয়েছেন? আজই থানায় যাব। এতদিন ভদ্রলোক বলে অনেক সম্মান রেখেছি, আর নয়। ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারিকে আমি বলে গেছি গেল হপ্তায়। তাকে নিয়েই এর ফয়সালা হবে।
বিচলিত যতীন দাস দোকান থেকে বেরিয়ে এসে ধরে ফেলল গোবিন্দর হাতদুটো। মিনতির সুরে বলল,
--- একটু...আর একটু ধৈর্য ধরো ভাই, দিয়ে দেব। আমি দিয়ে দেব তোমার টাকাগুলো। খুব অসুবিধায় আছি ,নইলে...

হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দোকান থেকে রাস্তায় নামতে নামতে গোবিন্দ মেজাজ চড়িয়ে চিৎকার করে বলল,
--- ওসব ফন্দিফিকির জানা হয়ে গেছে আমার। আর ওসবে ভুলছি না। নীচুবাজার মার্কেট ঘুরে আবার আসছি। ততক্ষণে আপনি যেখান থেকে পারেন জোগাড় করে রাখুন আমার টাকা। আজ আমি খালি হাতে ফিরে যাব না। আদায় কী করে করতে হয় আমি জানি।

প্রায় ঘণ্টা তিনেক পর মার্কেটের কাজ সেরে ওই পথেই ফিরছিল গোবিন্দ। হাল ছাড়লে চলবে না। যাবার সময় আরেক প্রস্থ চেষ্টা করে দেখবে কিছু পাওয়া যায় কিনা ! না আদায় করে উপায়ও নেই। মালগুদামে ম্যানেজার গতকাল বলেই দিয়েছে,--- ’এবার তোর বকেয়া টাকা কাটতে বলেছে মালিক। আমাকে দোষ দিসনে গোবিন্দ। অনেক দিন হলো।’
গোবিন্দ জানে, তার নিজের পাওনা কমিশনের উপরেই যতীনদার বকেয়ার খাড়াটা নেমে আসবে। ডিস্ট্রিবিউটর ত্যাদোড় লোক ! ওর সঙ্গে কারবার করতে ইচ্ছা হয়না গোবিন্দর। উপায় নেই বলেই পড়ে আছে। বাবার হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার পর, তার নিজের দোকানটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল। একসঙ্গে চিকিৎসার অত টাকা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা নিজের ছোট ব্যবসাটার ছিলনা। আর কোনো উপায় ছিলনা তার। সংসারে টানাটানি শুরু হল। গোবিন্দকে 'ব্রিজেশ এন্টারপ্রাইজে'র এই মার্কেটিংয়ের কাজটাতে ঢুকতেই হল। শুরুতেই ধুরন্ধর মালিক রাজেশবাবু বলে রেখেছে, 
--- মার্কেটে ধারধোরের দায়িত্ব কিন্তু তোমার। যা বকেয়া পড়বে তার দায়িত্ব আমরা নেব না। ম্যানেজার হিসাব করে মাল দেবে, পাইপয়সা বুঝে নেবে।

এ কারবার নগদ পেমেন্টে চালানোও সম্ভব নয়। বাজারে বকেয়া পড়েই। এখন, নয় নয় করে খাতায়-কলমে কয়েক হাজার টাকার বকেয়া গোবিন্দর হিসাবে চেপে আছে। গেল মাসেও বকেয়ার হিসেব দেখিয়ে ম্যানেজার একবার হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে, সামনের মাস থেকে তার কমিশন থেকে কিছু কিছু করে কাটা হবে।
এই অবস্থায় বকেয়াগুলো আদায় না হলে কী যে হবে, গোবিন্দ ভাবতে পারে না। ছেলেটাকে এবারই থার্ড ইয়ারে ভর্তি করেছে। বাবার প্রতিদিনের ওষুধেও মোটা টাকা বেরিয়ে যায়। যদি কমিশনের টাকাটাও পুরোপুরি হাতে না পায়...

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই পথ হাঁটছিল গোবিন্দ। জলট্যাঙ্কির মোড়টা ঘুরতে না ঘুরতেই তার ভাবনা-দুর্ভাবনার ছন্দটা কেটে গেল। যতীন দাসের দোকানটা এখান থেকে সরাসরি চোখে পড়ে। দোকানের সামনে এত ভিড় কেন! পথচলতি লোকজনে যেন মেলা বসে গেছে। কৌতুহল যেমন হচ্ছিল, তেমনি একবুক শঙ্কাও জেগে উঠছিল গোবিন্দর মনে। বাজারে কোনো ঝামেলা-ঝঞ্ছাট হলে, যতীনদা ফাঁক গলানোর সুযোগ পেয়ে যাবে। হয়তো গণ্ডগোলের সুযোগে দোকান বন্ধ করে ঘরে ঢুকে বসে থাকবে। বাড়ির ভেতরে ডাক দিলে, বেরিয়ে এসে হয়তোবা নাকে কেঁদে বলবে, --- ‘দোকান যে বন্ধ করে দিতে হল ভাই গণ্ডগোলের কারণে...'
আরও একটু কাছাকাছি হতে গোবিন্দর মনে হল, দুর্ঘটনা-টুর্ঘটনা কিছু বোধহয় ঘটেছে ওখানটায়! নইলে এত লোকের ভিড় কেন হবে। আর কয়েক পা এগোতেই ওর কানে এলো সেই ভয়ঙ্কর কথাগুলো, 
--- আত্মহত্যা করেছে লোকটা। ওই যে ওই দোকানের মালিক, টাঁকমাথা... বয়স্ক মতো। দোকানে বসে থাকতো...
গোবিন্দর পায়ের তলার মাটি হঠাৎ কেঁপে উঠল। মুখ দিয়ে শুধু অস্ফূট বেরিয়ে এলো,
--- কে যতীন দাস... যতীনদা!
ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পাশের এক দোকানদার কাকে যেন বলছিল,
--- মেয়েটার বিয়ে দেওয়ার পর থেকে ধারদেনায় জর্জরিত হয়েছিল। অত বড় সংসারটাও চলছিল না। প্রতিদিন পাওনাদারদের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি ! আজও নাকি কয়েকজন শাসিয়ে গেছে।...

গোবিন্দর পায়ের তলার ঢালাই রাস্তার শক্ত কংক্রিট আলগা হয়ে আসছিল। কম্পিত পদক্ষেপে কোনরকমে দোকানের সামনের রাস্তাটা পেরিয়ে গেল। দরদর করে ঘাম বের হতে লাগল তার শরীর থেকে। দোকানের দিকে একবার ফিরে তাকানোর সাহসও পেলনা। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল পুলিশের একটা কালো ভ্যান। টুকরো টুকরো কথাবার্তাও নানা প্রান্ত থেকে এসে কানে ধাক্কা মারছিল,
--- লোকটার দেহ তখনও নাকি ঝুলছে দড়িতে, ভেতরের কোন অন্ধকার ঘরে। ছেলেমেয়েগুলোকে নাকি সামলানো যাচ্ছে না।
আতঙ্ক আর বেদনার একটা সংমিশ্রিত অনুভূতি অস্থির করে তুলছিল গোবিন্দকে। অব্যক্ত এক যন্ত্রণা বুকের ভেতরটায়। হনহনিয়ে পা চালাচ্ছিল সে। মনে হচ্ছিল এখান থেকে পালাতে পারলেই যেন সে বেঁচে যায়! শিমুলতলা বাস স্টপেজ থেকে তখনই ছেড়ে যাচ্ছিল একটা বাস। সেটা ধরবার জন্য দৌড় লাগাতেই, হঠাৎ মনে হল পিছন থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বরে কে যেন বারবার চিৎকার করে ডাকছে তার  নাম ধরে। গোবিন্দর সাহস হলনা পিছন ফিরে তাকানোর। চলার গতি আরও বাড়ায় সে। তবু ক্রমাগত পিছন পিছন ভেসে আসতে থাকে পরিচিত এক কণ্ঠস্বর, জিজ্ঞাসা করতে থাকে বারবার,
--- গোবিন্দ ভাই, এসেছ? ভালো আছো, ভালো আছো তো গোবিন্দ ভাই?... চা খেয়ে যাও এক কাপ...

গোবিন্দ ছোটার গতি আরো বাড়িয়ে দেয় ছেড়ে যাওয়া বাসটাকে ধরবার জন্য। পিছন পিছন প্রশ্নটাও যেন ছুটে আসতে থাকে তার দিকে,
--- ভালো আছো, ভালো আছো গোবিন্দ ভাই...
পিছনে না ফিরেই প্রায় দৌড়তে দৌড়তে গোবিন্দ নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
--- না না... ভালো নেই। আমিও ভালো নেই, একেবারেই ভালো নেই গো যতীনদা...






ঈশানীমেঘ

ন ন্দি তা  সো ম

প্রকৃতির প্রবল রোষ নেমে এলো ধরায় সাথে আকাশভাঙ্গা বৃষ্টি। খোলা জানালার কাঁচে  অসম্ভব প্রতাপে তাদের নাচানাচি। বৃষ্টির ধারা ঘরে ঢুকে অর্পিতাকে ভিজিয়ে দিলো। অর্পিতা ঘুম থেকে জেগে উঠলো। জানালা খোলা---। ঝড়ের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কাঁচের জানালা বন্ধ করা কঠিন কাজ। কিন্তু অর্পিতার জীবন হলো ঝড়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করা। সেভাবেই জানালা বন্ধ করলো। হেসে ঝড়ের দিকে তাকিয়ে বললো--- পরাণসখা বন্ধু, জানালা বন্ধ করাতো সহজ কাজ।

ঘুমের দফারফা। মৃদু আলোতে দেখলো ঘড়িতে ভোর সাড়ে চারটে। আজ  পয়লা আষাঢ়--- ১৬ই জুন। জানেনা--- ঝড়ের পূর্বাভাস ছিলো কি না--- তবে তার জীবনের ঝড়ের কোনোদিন পূর্বাভাস ছিলোনা। আর আজকের দিনেই ১০ বছর আগে সেই প্রচন্ড ঝড়ের সম্মুখীন সে হয়েছিলো। উঠে পড়লো অর্পিতা। যেতে হবে ঠাকুরঘরে, তার পরলোকগত স্বামীর ছবিতে ফুলমালা চড়াতে হবে। শ্বশুরশাশুড়ি আসবেন, দেখবেন, একটু চোখের জল ফেলবেন, মনে খুশি নিয়ে ঘরে চলে যাবেন। সাধারণত ফুলমালা অর্পিতার কন্যা শিল্পী গুছিয়ে রেখে দেয়। আজ বৃষ্টিতে কি করেছে জানেনা।  

স্নান সেরে পুজোঘরে গিয়ে দেখে সব গুছানো। অবাক হয়ে কন্যা শিল্পীকে স্নেহের চোখে দেখতে দেখতে জিগ্যেস করে--- এতো ঝড় বৃষ্টিতে কখন করলি? শিল্পী কম কথা বলে। মৃদু হাসি দিয়ে বলে উঠলো--- মালিকাকা কাল রাতেই সব দিয়ে গিয়েছিলেন। নাও, এখন তুমি তোমার পুজো সারো। তারপরতো স্মৃতির ঝুলি খুলে বসবে। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় শিল্পী, বলে--- আচ্ছা মা,--- আজকের দিনটা তুমি কি ভাবে পালন করো? মুক্তির দিন না বিচ্ছেদের দিন হিসেবে? উত্তর নেই অর্পিতার---  নিশ্চুপ সে। বলতে পারলো না মেয়েকে--- শকুনের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার দিন হিসাবে। শিল্পী ঘর থেকে বেরিয়ে যায় দাদু ঠাকুমাকে আনার জন্য। সত্যি কথা বলতে ওঁদের জন্যই অর্পিতার  আয়োজন। সাজিয়ে, মিষ্টি দিয়ে ধুপ দীপ জ্বালাতে না জ্বালাতেই ওঁরা এসে পড়েন। পাঁচ মিনিট বসে দুইফোঁটা চোখের জল ফেলে আবার নিজেদের ঘরে চলে যান। গত দশ বছর ধরে চলছে। আগে রাগ হতো--- এখন কিছুই অনুভব হয়না। মেয়ে দরজা বন্ধ করে দিলে অর্পিতা  ৪২ বছরের স্মৃতির খাতা খুলে বসে। জীবনের ঝড়ের হিসাবনিকাশ করে। একদিকে জীবনঝড়--- অন্যদিকে শান্তির প্রলেপ শিল্পী।।  

অর্পিতার জবানে--- বছর কুড়ি বয়স তখন। স্নাতক পরীক্ষার শেষ দিন। বাড়ি পৌঁছে দেখি মা, দাদা খুব গম্ভীর, বিষন্ন। বাবার অফিসের লোকজন, ডাক্তার উপস্থিত। বাবার হার্ট এট্যাক হয়েছিলো অফিসে। ধীরে ধীরে বাবা সুস্থ হয়েই শুরু করলেন আমার বিয়ের চেষ্টা। দাদা ব্যাংকে মাত্র যোগ দিয়েছে। বোঝালাম বাবা মাকে আমি এখন বিয়ে করবোনা। আমি পড়তে চাই। টিউশনি করে পড়ার খরচ চালাবো। দাদাও বেঁকে বসলো---- বললো, আমি এতো জনের দায়িত্ব নিতে পারবোনা।

চোখের জল নিয়ে শ্বশুরবাড়ি এলাম। স্বামী ভালোই চাকরি করতেন। বাড়িতে দুই অবিবাহিত ননদ, শ্বশুর, শাশুড়ি। প্রথম দুইদিনে বুঝে গেলাম--- কপালে কষ্টের লিখন আছে। পড়তে চাই বলতেই স্বামী হাত ধরে টেনে নিয়ে এলেন শাশুড়ী মায়ের কাছে। একধাক্কা দিয়ে মায়ের কাছে ফেলে দিয়ে বললেন--- তোমার বৌমা বিদ্যেধরী হতে চায়। পাঁচজনে মিলে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে উঠলো। আমি জানতাম ওঁদের দাবী বাবা সব মিটিয়ে ছিলেন। শুধু বলেছিলেন আর কিছু দিতে পারবেননা। সেইকথার খোঁচা দিয়ে অনেক কিছু বললেন।

মা, বাবার কাছে বলে কোনো লাভ হলোনা। মা, বাবা, দাদা বলে উঠলেন--- মানিয়ে নেবার চেষ্টা করো। নালিশ করতে এসোনা। বুঝলাম বাপের বাড়ির দরজা কোন ভয়ঙ্কর ঝড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। অষ্টমঙ্গলা থেকে ফিরে এসে শুনলাম কাজের লোক ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির সব কাজ আমাকেই করতে হবে।

আমার কোনো আপত্তি ছিলোনা। থেকেও লাভ নেই। কিন্তু উঠতে বসতে ননদদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য, শ্বশুর শাশুড়ীর গঞ্জনা, তার ওপর পতি দেবতার কথার, হাতের নির্য্যাতন অসহ্য লাগছিলো। একদিন রান্না করতে করতে নিজের মনেই গাইছিলাম--- "ভেঙে মোর ঘরের চাবি, নিয়ে যাবি কে আমারে", ননদদের কানে পৌঁছেছিল। দাদা অফিস থেকে বাড়ি আসতেই তাঁকে সব বলা হলো। তারপর আমার ওপর যে ঝড় আছড়ে পড়লো--- তা দেখলে সুনামিও ভয়ে পালাতো। আমার কাছে জানতে চাওয়া হলো--- কোন প্রেমিকের জন্য এই গান? হাসবো না কাঁদবো। কোন রুচির মানুষ এরা???

অতিবাহিত দুই বছর--- অত্যাচারের বদলে পেলাম ফুটফুটে কন্যা শিল্পীকে। মনে হলো বাড়ির মানুষেরা তো সব শকুনের জাত। এদের অভিশাপ আমার কাছে বর হয়ে মেয়েকে উপহার দিলো। আমার যন্ত্রণার দৈব মলম আমার কন্যা। গর্ভবতী অবস্থায় সংসারের সব কাজ সামলাতে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। ডাক্তারের কথায়  বাড়ির কাজের জন্য বাসন্তীকে রাখতে হলো। কয়েকদিনেই বাসন্তী আমার নিজের হয়ে উঠলো। মনে হলো ঝড়ের রোষ বোধহয় একটু কমলো।

এবার ঝড়  পরিবারের ওপর। আমি অভিশাপ দিইনি। হয়তো আমাকে দেওয়া অভিশাপের ছিটে লাগলো ওদের ওপর। বড়ো ননদ পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলো এমন একজনের সাথে যাকে এঁরা কেউ মেনে নিতে পারলেন না। আমি খুশি এই ভেবে অত্যাচারীর সংখ্যা একজন কমলো। শ্বশুর শাশুড়ী উঠে পড়ে লাগলেন ছোটো ননদের বিয়ের জন্য। কিছুদিন সবাই একটু চুপ ছিলেন। আবার অত্যাচারের মাত্রা শুরু হলো। ইতিমধ্যে বিয়ের কেনাকাটা সমাপ্ত। আমাকে ডাকার প্রয়োজন নেই। আমিও দূরেই থাকি মেয়েকে নিয়ে। বিয়ের দিন দেখলাম আমার বিয়ের গয়না দিয়ে ননদের বিয়ে হলো। আমাকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন কেউ অনুভব করেনি। কারণ গয়না ছিলো শাশুড়ির কাছে আমার বিয়ের পর থেকে।

ছোটো ননদের বিয়ের পরে অত্যাচারীর সংখ্যা কমার বদলে বেড়ে গেলো। ননদের পতি যুক্ত হলো আরো একজন অত্যাচারী হিসেবে। পানের থেকে চুন খসলেই তাকে তাল বানিয়ে আমার পতিদেবতার কানে বর্ষণ করা হতো। অকথ্য গালমন্দ, মার। ভাবতাম, এরা সব শিক্ষিত?ছোটো ননদের স্বামী আমার দিকে নোংরা হাত বাড়িয়ে ছিলো। আমি মাছ কাটার বঁটি তুলে তেড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু শকুনের পাখা ছাঁটতে পারলাম না। তার থেকে নন্দাই আরো হিংস্র হয়ে উঠলো।

কেটে গেল বিয়ের বারো বছর। শিল্পী ১০ বছর--- আমায় আগলে রাখে। হাত বুলিয়ে দেয়, কিন্তু অন্তরের ক্ষতের নাগাল ও পাবে কি করে।

আবার আমি গর্ভবতী হলাম। চাইনি এই সন্তানকে বাঁচাতে। ভয়ে ভয়ে স্বামীকে বললাম। আমার চুলের মুঠি ধরে জানালো--- ওইসব হবেনা। আবার মেয়ে হলে বাড়ি থেকে বার করে দেবে। পতিদেবতা সেইকথা গর্বের সাথে মা, বাবাকে জানিয়ে দিলো।

সেদিন ছিলো পয়লা আষাঢ়। প্রকৃতির রোষ সকাল থেকে শুরু হয়েছে। এতো উন্মত্ত প্রকৃতি কখনো দেখেছি কিনা জানিনা। সকাল থেকে শরীর খুব খারাপ লাগছিলো। মন ভীষণ কু গাইছিলো। 

রান্না সেরে ঘরে যাবার পথে নন্দাই চা চাইলো। বাসন্তী বললো--- আমি করছি, বৌদি ঘরে যাও। আগুনে যেন ঘি পড়লো। ননদ চিৎকার করে দাদাকে ডেকে নালিশ করলো অত্যন্ত খারাপ কথা সহযোগে। আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, পতিদেবতা সিঁড়ি দিয়ে তড়িঘড়ি নেমে মাঝপথে আমার গলা চেপে ধরলেন। ছোট্ট শিল্পী সিঁড়ির কোণে নির্বাক দাঁড়িয়ে। অত্যন্ত অশ্রাব্য কথা বলে পা তুলে আমার পেটে প্রচন্ড জোরে লাথি মারলেন। ব্যথায় টাল সামলাতে না পেরে গড়িয়ে পড়ার আগে উদ্যত পা ধরে আমিও দিলাম টান। দুজনে  পড়লাম নীচে। পতিদেবতার মাথা সিঁড়ির কোণে ঠুকে রক্তারক্তি। আর আমি?

অর্পিতার কথা শেষ।

অবস্থা দেখে ননদ, নন্দাই বাড়ি থেকে পালালো। বাসন্তী ঝড়ের মাঝে ডাক্তার, প্রতিবেশীদের ডেকে আনলো। অর্পিতার পতিদেবতা ওখানেই শেষ। অর্পিতা হাসপাতালে জন্ম দিলো মৃত পুত্রের। ঝড়ের পরে  আকাশে সোনালী রোদ। পতির অফিসে চাকরি পেলো অর্পিতা। শ্বশুরমশাই বাড়ি লিখে দিলেন ওর নামে। অর্পিতা ওঁদের দেখাশুনোর দায়িত্ব নিলো এক শর্তে--- ওই দুই ননদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখা যাবেনা। অর্পিতা জানতে পেরেছিলো পুলিশ এসেছিলো। ছোট্ট শিল্পী তাঁদের বলেছে "মা পড়ে যাবার সময় মাকে বাঁচাতে গিয়ে বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে। টাল সামলাতে না পেরে দুজনেই পড়ে যায়। শুনে পুলিশেরা চলে যায়। বিধ্বস্ত অর্পিতা বাঁচতে চায় ঝড়ের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে। জীবন দিয়ে প্রবাদ বাক্যের অর্থ বুঝলো--- শকুনের অভিশাপে আর যাই হোক গরু মরে না। তা নাহলে বাড়ির লোকেরা ওকে যত মরার অভিশাপ দিয়েছে--- তাতে অর্পিতা কবেই মরে ছাই হয়ে যেতো।






নবাবপুরের ওয়েটিং রুম

দে ব যা নী  সে ন গু প্ত

অনিতা ও সুভাষ সদ্য বিবাহিত  দম্পতি। মাস তিনেক আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু  ছুটি না পাওয়ায় কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি। এবারে গরমের ছুটিতে ঠিক করল কোনো অফবিট জায়গাতে বেড়াতে যাবে। এক বন্ধুর ভিডিও থেকে এই নবাবপুরের খবর পেল। দারুণ  জায়গা। নিরিবিলি  ছোটো পাহাড়ের সারি সবুজের গালিচা মোড়া। আর কত ফুল! সাথে রকমারি ফল, যেন ঈশ্বরের প্রেমে নিবেদিত। ঠিক হল, ট্রেনের টিকিটও কাটা হল। ওখানকার হোমস্টে-র সাথে ফোনে যোগাযোগ করে সব ঠিক করে ঠিক সময়ে দুজনে ট্রেনে চেপে বসল। সারা রাত অনিতার ঘুম হল না। জানলা দিয়ে সাঁ সাঁ করে  চলে যাওয়া পথ ঘাট বাড়ি ঘর দেখতে দেখতে একটু চোখ  লেগে গেল, সুভাষ চায়ের ধোঁয়া ওঠা ভাঁড় নিয়ে ডাকতেই চোখ খুলো দেখল তারা পৌঁছে গেছে। মনে একটা আনন্দ হল। বিয়ের আগে তেমন ঘোরা বেড়ানো হয়নি। মনটা বেশ উৎফুল্ল  হয়ে গেল। চা খেয়ে কুলির হাতে ব্যাগপত্র চাপিয়ে চললো ওয়েটিং  রুমের দিকে। হোমস্টের ম্যানেজার বাবু সুকান্ত সমাজপতিকে ফোন করে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। অনিতা বলল, আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো। বেশ বড় স্টেশন মানে জংশন আর কি! সুভাষ গাড়ি ও অন্যান্য দরকারি ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। প্রায়  দেড়  ঘণ্টা পর গাড়ি এল। সুভাষ  ড্রাইভারকে বলল, অনেক দেরি করে ফেললেন। জোর খিদে পেয়ে গেছে। আমার ও আমার  স্ত্রীর।
ওয়েটিং রুমে এসে অনিতাকে বলল, চল গাড়ি এসে গেছে।
অনিতা চুল আঁচড়ে নিচ্ছিলো অন্যমনস্কভাবে। তাড়াতাড়ি  একটা এলোখোঁপা করে ভ্যানিটি ব্যাগটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। স্টেশন থেকে যে এতোটা দূর তা তো জানা ছিল না। 
পৌঁছোতে পৌঁছোতে দুপুর হল। এদিকে খিদে পেয়েছে ভয়ানক। গিয়েই আগে স্নান সেরে ডাইনিং  রুমে লাঞ্চ সেরে তবে ঘরে ঢুকে বসল সুভাষ। অনিতা কিন্তু  ঘুমিয়ে কাদা। দু'বার ডাকল কিন্তু  সাড়া দিল না। অঘোরে ঘুমিয়ে আছে। বেশ গরম। এ.সি টা চালিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল বালিশ টেনে নিয়ে।

ম্যানেজারবাবুর জোল ধাক্কাতে ঘুম ভাঙল। তখন সন্ধ্যা বেলা সাড়ে ছয়টা বাজে। ইস্ এতো ঘুমিয়ে পড়েছি। সুভাষ মনে মনে ভাবল, উঠি--- কিন্তু  অনিতাকে দেখতে পেল না।

এ বিষয়ে কিছু ভাবার আগে, দরজাটা খুলে দিল সে। সুশান্তবাবু বললেন, স্যার  আপনার মিসেসকে এতো করে বারণ করলাম, তাও জঙ্গলের দিকে গেল।

সুভাষ প্রথমে হাঁ করে শুনলো, তারপর বলল, কি যে বলেন, ও তো এখানকার কিছুই চেনে না। সুকান্ত সমাজপতি বললেন, না স্যার, উনি বললেন, চিন্তা করবেন না। আমার চেনা জায়গা। সুভাষ বলল, মানে? এটা ওর পরিচিত স্থান? আগেও এসেছ? হতে পারে না। বিয়ের আগে তেমন ভাবে কোথায় কোনোদিন বেড়াতে যায়নি। একজন স্টাফ এসে বলল, বনে চিতা বাঘ আছে।
আর ঘায়েল চিতাটা সবাইকে আঘাত করছে। এক্ষুনি চলুন, না হলে বিপদ বেড়ে যাবে। সুভাষ  তাড়াতাড়ি রুম লক করে ওদের সাথে গাড়িতে গিয়ে উঠল। হেড লাইটের আলোতে গাড়ি চলল লাফিয়ে লাফিয়ে। ফাঁকা রাস্তা,  জনপ্রাণীর দেখা নেই, তো অনিতাকে কোথায় পাবে! সুভাষ, অনিতার নাম ধরে চিৎকার  করতে লাগল। কিন্তু কোথাও কোনো সাড়া নেই। যেন রাতের জঙ্গল সুভাষের সাথে রসিকতা  করছে। কালো কালো আঁধার  মাখানো গাছগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ইচ্ছা করেই। যেন শুনেও শুনতে পাচ্ছে না ওর চিৎকার। বলে দিচ্ছে না অনিতা খোঁজ। সুভাষ মরিয়া হয়ে হোমস্টের ম্যানেজার বাবুকে বললেন, কিছু তো করুন! একজন এইভাবে হারিয়ে যাবে? হাত জোড় করছি। 
ম্যানেজারবাবু বললেন, না না আপনি এ ভাবে বলবেন না। চলুন থানাতে যাই। সুভাষ বলল, হ্যাঁ  তাই চলুন। অনিতাকে খুঁজে  পেতেই হবে। 

সকলে থানায় এল। পুলিশ ইন্সপেক্টর হলধর নাগ অনিতা সম্পর্কে সব কিছুই লিখে নিলেন আর পাসপোর্ট সাইজের ছবি দু'কপি নিলেন। এবারে সকলে মিলে হোমস্টেতে চলে এল। দূর থেকে সুভাষদের ঘরের ব্যালকনি দেখা যায়। দেখল, অনিতা  দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। গাড়ি থামতেই ছুটে গেল উপরে। জিজ্ঞাসা করল, তুমি কোথায়  গিয়েছিলে? অনিতা যেন আকাশ  থেকে পড়ল, আমি তো ঘরেই ছিলাম। পাশের ঘরে বসে গান শুনছিলাম। সুভাষ বলল, কি? আমি সারা জঙ্গল খুঁজে এলাম! থানায় গেলাম, তোমার  ছবি বায়োডেটা সব কিছুই দিয়ে এলাম। কোথায় কোন ঘরে ছিলে, দেখি চলো--- পাশের ঘরে তখনও  এখনকার সময়ের  আধুনিক গান বাজছে।
ম্যানেজারবাবুকে ফোন করে ডাকল। উনি এসে বললেন, আমি সত্যি বলছি স্যার, ম্যাডাম  জঙ্গলে একাই বেড়াতে গিয়েছিলেন। উনি চেনেন তাই চলে এসেছে। কি মনে হতে অনিতা জুতো দেখতে গেল, কারণ ওরা আসার আগেই এখনে ভালো বৃষ্টি  হয়েছে। জঙ্গলের পথে এখনও জল। জুতো জোড়া পুরোপুরি পরিস্কার। অনিতা জুতোর প্রতি যত্ন আছে। তা হলেও বোঝা যেত, না কাদা মাটি কিছু লেগে নেই। 

যাইহোক, ওরা রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সুভাষ  ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকল।
 কিন্তু, কই---  অনিতা তো কোথাও গেল না অভিসারে।
তাহলে? 

সকালে থানাতে এসে কেসটা তুলে ছবি বায়োডেটা সব ফেরত নিয়ে চলে এল। দেখল অনিতা সবে চা খাচ্ছে। গুড মর্নিং ম্যাডাম সুভাষ বউয়ের সাথে একটু প্রেম করতে চাইল। অনিতা ও বেশ আড়চোখে চেয়ে উত্তর দিল। মশাইয়ের কোথায় যাওয়া  হয়েছিল শুনি? থানা থেকে সব তুলে নিয়ে চলে এলাম। শুনে অনিতা একটু হাসল। তারপরে  সুখের সাগরে ভেসে গেল নব দম্পতি। সন্ধ্যাবেলা দুজনে ব্যালকনিতে বসে চা খেল।
 সুভাষ বলল,  যাই নীচে থেকে ঘুরে আসি। তুমি তাহলে গান শোনো। অনিতা মুচকি হেসে  মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। সুভাষ ট্রাউজার পড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। 

অনিতা উঠে দাঁড়ালো, কাপটা প্রায় ছুঁড়েই ফেলে দিল। তারপর পেছনের দিকে সিঁড়ি দিয়ে  নামতে শুরু করল। সেখানে  ঝোপের মধ্যে ছিলেন ইনসপেক্টর   নাগ সাহেব, তিনি পিছু নিলেন। অনিতা খালি পায়ে হাঁটছে। মনে হচ্ছে ও দাঁড়িয়ে আছে, আর জমি মাটি সব সরে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ প্রায়। যেন মৃত মানুষ। জঙ্গলে ঢুকল। আরো হাঁটছে। একটা পুরনো বাড়ি। এখানে বাড়ি! জানাই ছিল না তাঁর। কপালে ভাঁজ, ফোন বার করে ছবি নিলেন আর ফোন করলেন থানাতে। থানা সুভাষ আর ম্যানেজারবাবুকে গাড়ি করে নিয়ে এল। অনিতা চুপ করে বসে পড়ল মেঝেতে। তারপরে  দুলতে শুরু করল। একটা সময় চুল খুলে ফেললো, কাপড়  প্রায়  অর্ধেক খুলে গেল। সুভাষ দৌড়ে  গিয়ে  জাপটে ধরতেই ছিটকে ফেলে, ওকে মারতে শুরু করল। তখন ইনসপেক্টর নাগ, রাইফেলের একটা ফাঁকা  আওয়াজ করলেন, ওতেই কাজ হল। লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। 
একটা কালো ধোঁয়া ওর শরীরে  ছেড়ে  বেড়িয়ে গেল। তাড়াতাড়ি পাঁজকোলা করে গাড়িতে উঠিয়ে হোমস্টেতে এল। তারপরে  ডাক্তার ডাকা হলে সুখবর  জানা গেল।।





ভোরের শুকতারা

অ ন সূ য়া  পা ঠ ক

বাস ছাড়তে তখনো কিছুটা সময় বাকি ছিলো, আমি মা বাবার সাথে বাসের ভেতরে জানালার দিকের সিটটায় বসে আছি। এমন সময় দেখি  আমাদের পাশের সিটে বসে একজন রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা পড়ছেন, বইটাকে দেখে আমার চোখের সামনে একটা সোনালী ফ্রেমের চশমা পরা মুখ ভেসে উঠলো, চন্দন স্যারের মুখ। 
বছর পাঁচেক আগের কথা, আমার বাবা তখন জঙ্গলমহল মেদিনীপুরের আমলাশুলির পোষ্টমাষ্টার। দু কিমি দূরেই আমার পিসীমার বাড়ি। ওখানেই আমার হাইস্কুলে পড়াশোনা শুরু। আর যে স্যার আমার মননে সদা জাগরুক, বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষ বলা যায় যাকে, আমার গল্প যাঁকে নিয়ে সেই চন্দন স্যারকে ওখানেই পাওয়া। ফর্সা গায়ের রঙ, মাথায় কাঁচা পাকা চুল, সরু গোঁফ, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, এক কথায় সুদর্শন সত্যবাদী সরল সেই মানুষটিকে দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নীচু হয়ে আসতো। সবসময় স্যারের হাতে থাকতো পুরানো দিনের একটা হাতঘড়ি, নিয়মানুবর্তিতা শব্দটা যেনো উনার চারপাশে লক্ষ্মণরেখার মতো আটকে। স্যার শীত ছাড়া বাকি সব সময় সাদা হাফ শার্ট ও কালো প্যান্ট পরে স্কুলে আসতেন। স্যারকে দেখে আমাদের মনে হতো বাংলা ভাষাতে এমন কোন গল্প কবিতা নেই যা তিনি জানেন না। সবকিছুই তিনি এতো সুন্দরভাবে সাবলীল ও বর্ণময় করে তুলতেন যে আমরা অভিভূত হয়ে যেতাম। অন্য স্যারদের ক্লাসে ঘড়ির কাঁটা যেনো আটকে থাকতো, অথচ বাংলা ক্লাস কি ভীষণ দ্রুত শেষ হয়ে যেতো। ভাবতাম কেনো যে সব ক্লাসগুলোই চন্দন স্যারের হয়না! স্যার নিজের বাড়িতে অবৈতনিক একটি কোচিং সেন্টার চালাতেন। যেখানে সবার প্রবেশ ছিল অবাধ। সেখানে যে সমস্ত দুঃস্থ ছাত্রছাত্রী পড়তে যেতো, স্যার তাদের নিজের বেতনের টাকা খরচ করে একবেলা খাওয়াতেন ও বই খাতা কলম কিনে দিতেন। স্যারের ছোট্ট সংসারে তাঁর স্ত্রী এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। এবং বেতনের বেশীরভাগই খরচ করতেন হতদরিদ্রদের পেছনে। 
 প্রতি রবিবার আমিও স্যারের কাছে পড়তে যেতাম। এমনিতেই বাংলা ছিলো আমার পছন্দের সাবজেক্ট। স্যার আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও আরও নানাধরনের গল্প কবিতা তিনি আলোচনা করতেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ, তিনি যেনো স্যারের আদর্শ। সঞ্চয়িতার অনেক কবিতাই তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। স্যার বলতেন পড়াশোনা হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের জন্য। মাঝে মাঝে স্যারের স্ত্রী আমাদের জন্য দারুণ দারুণ সব খাবার বানিয়ে দিতেন। স্যারের স্ত্রীর কথাই ছিলো এরাও আমাদের ছেলে মেয়ে। আমিও মাঝে মাঝে স্যারের জন্য মায়ের হাতের বানানো পিঠে ও ছানা শীতল নিয়ে যেতাম। স্যার সবাইকে দিয়ে বেশ তৃপ্তি করে খেতেন। এরকমই বেশ কাটছিল সময়। তারপর একদিন শুনলাম স্যারের মেয়ে সন্ধ্যা দিদির জন্য স্যার একটি পাত্র খুঁজেছেন। ছেলেটি নাকি দেখতে খুব সুন্দর, পাশের থানার সাব ইনসপেক্টার। আমরা শুনে সবাই মহাখুশী। সন্ধ্যা দিদির বিয়েতে বেশ হৈচৈ হবে। কিন্তু সমস্যা হলো যে পাত্র পক্ষ বরপণ হিসেবে নগদ দশ লক্ষ টাকা ও একটি ফোর হুইলার চেয়ে বসলো। কিন্তু স্যারের এতো টাকা দেবার মতো সামর্থ্য ছিলো না। স্যার পাত্রপক্ষের কাছে অনেক অনুনয় বিনয় করেও নিস্ফল হয়েছিলেন। এরপর সন্ধ্যাদিদি দেখতে ভালো  হওয়া সত্ত্বেও প্রায় প্রতিটি সম্বন্ধই আর্থিক কারনের জন্য ভাঙতে শুরু করে। তবে এই সাংসারিক সমস্যা স্যারের চলার পথে বাধা তৈরী করতে পারেনি। স্যারের হাসিমুখ কখনও ম্লান হয়নি। স্যার বলতেন, জীবনে হতাশার কোন স্থান নেই, জানবে সব থেকে গভীর কালো অন্ধকার রাতের পরেই সোনালি সকাল আসে।
 এর কিছুদিন পর বাবার বদলি হয় বাঁকুড়া সদরে। খুব কষ্ট হয়েছিলো সেই স্কুল লালমাটির গ্রাম আর চন্দন স্যারকে ছেড়ে আসতে। বাবার বদলি হয়েছে শুনে স্যার বলেছিলেন, "দুঃখ করিসনা জানবি আমার আশীর্বাদ সবসময় তোকে আলোর পথ দেখাবে।" যেদিন আমরা সব মালপত্র গুটিয়ে চলে আসছিলাম, বাবা বলেছিলেন চল স্যারের সাথে দেখা করে আসি। কিন্তু আমি পারিনি। চোখের জল লুকিয়ে পারিনি স্যারকে বিদায়ী প্রণাম করে আসতে।

আজ পাঁচ বছর পর আবার সেই গ্রামে যাচ্ছি। পিসীমার মেয়ে মালতী দিদির বিয়েতে। ভালো পাত্র। সদ্য ঢুকেছে মহকুমা হাসপাতালে। পিসাবাবু বরপণ হিসেবে মেদিনীপুর টাউনে দশ কাঠা জমি হীরের আংটি ও বাড়ির সমস্ত আসবাব দিচ্ছেন। 
এইসব এলোমেলো ভাবনা মাথায় নিয়ে পৌঁছে গেলাম আমলাশুলি বাস স্ট্যান্ডে। নেমেই দেখলাম পাঁচ বছরে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি এলাকার। 

পিসাবাবু স্ট্যান্ডেই ছিলেন। ওখানে পৌঁছে বিশ্রাম নিয়ে মালতী দিদিকে জিজ্ঞেস করলাম চন্দন স্যারের কথা। মালতী দিদি বললো, স্যার এখন মানসিক ভাবে অসুস্থ, কারো সাথে খুব একটা কথাও বলেননা, মাঝে মাঝে চিনতেও ভুল করেন। বেশীর ভাগ সময় একাই বই হাতে বসে থাকেন।

একটার পর একটা সম্বন্ধ ভেঙে যাওয়া, পাড়া-পড়শীর নানান ধরনের কথাবার্তা, বাবার চাপা যন্ত্রণা, মায়ের কান্না সহ্য করতে না পেরে সন্ধ্যা দিদি কাউকে কিছু না বলে একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, শুধু একটা চিঠি রেখে গিয়েছিলো, তাতে লেখা ছিল, "বাবা, আমি ভোরের খোঁজে যাচ্ছি।" 

অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর সন্ধ্যা দিদিকে পাওয়া যায়নি।  চন্দন স্যারের স্ত্রী এই দুঃখ সহ্য করতে না পেরে কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পরপারে পা বাড়ান।  

সব শুনে আমার মন ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। গোটা ঘরে কেমন যেনো অনাকাঙ্ক্ষিত নীরবতা। নিজের অজান্তেই চোখ জলে ভরে যায় আমার। এই নীরবতা ভেঙে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা স্যারের দেখাশোনা এখন কে করেন? পিসাবাবু উত্তর দিলেন, উনার ছেলে আদিত্য স্থানীয় ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছে, ওই বাবাকে দেখে। আর থাকতে পারলাম না, ছুটে বেরিয়ে গেলাম স্যারের বাড়ির উদ্দেশ্যে। পৌঁছে দেখলাম তার বাড়ির গেটে এখনো সাদা মার্বেল পাথরের উপরে লাল কালির সেই লেখাটা, "খুলে দাও দ্বার নীলাকাশ করো অবারিত"।  তবে লেখাটির উপর প্রবহমান সময়ের অস্থিরতার সুস্পষ্ট ছাপ বোঝা যায়। বারান্দায় ইজি চেয়ারে উস্কোখুস্কো চুলে একমুখ দাড়ি নিয়ে স্যার বসে, হাতে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা। চুপি চুপি গিয়ে প্রণাম করলাম স্যারকে। চোখের জল তখন আর গোপন নেই। আমার মাথায় হাত দিয়ে আমার হাতে সঞ্চয়িতা ধরিয়ে দিয়ে স্যার বললেন, "তোর জন্যই রেখেছিলাম। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে ঝাপসা চোখে তিনি বললেন, জানিস রবীন্দ্রনাথকে জানলে গোটা বিশ্বকে জানা যায়।"






ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি

রু মা না  সো ব হা ন  প রা গ

ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। পুরো মাঠ ঘাট কাদায় সপসপে হয়ে আছে। আজ সন্ধ্যায় আর হাঁটতে যাওয়া হবে না অহনের। কফির মগটা হাতে নিয়েই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মেঘেদের উড়ে যাওয়া দেখছে সে। দ্বিতীয়বার মগে চুমুক দিতেও ইচ্ছা করছে না আর।

ইদানিং অতীত যেন ওকে ছেঁকে ধরে। জীবনের এই পড়ন্তবেলায় অতীতের প্রতিটা সময় এসে আচ্ছন্ন করে ফেলে অহনকে। বাবা মাকে ছেড়ে যেদিন ক্লাস সেভেনে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছিল সেদিন সারারাত চোখের জলে বালিশ ভিজেছিল ওর। সে যে কি কষ্ট! বিচ্ছেদ আর বিচ্ছিন্নতাকে কি ভাবে মোকাবিলা করতে হয় সেই বয়সেই অহন রপ্ত করেছিল। তবে সেই কষ্টটা যেন একটা ঘুমন্ত  আগ্নেয়গিরি। জীবনের যে কোনো আঘাতে সেই আগ্নেয়গিরি ফুঁসে ওঠে। এলোমেলো হয়ে যায় অহন তখন।

ক্যাডেট কলেজ থেকে সরাসরি আর্মিতে ঢুকে যাবার কারণে ফৌজি জীবনটাতে সে সহজেই মানিয়ে নিয়েছিল। যদিও অনেকের কাছে রাতের পর রাত ঘুম থেকে উঠে মাঠে দৌড়োনো, জঙ্গলে রাত কাটানো, জোঁক ভরা পুকুরে সাঁতার দেওয়া, সারাদিন সিনিয়রদের অকথ্য গালিগালাজ শোনা, ছুটি না কাটিয়েও ঈদ করা এসব বীভিষিকাময় মনে হতো। কিন্তু অহনের খারাপ লাগতো না, আবার ভালোও লাগতোনা। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনে একরকম অভ্যস্ত হয়েছিল সে। নিজেকে রোবোটের মতো তৈরী করে নিলেও আদতে অহন একজন আবেগী মানুষ।

সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যেটাই হোক না কেন, হয়তো নিয়তির ফেরে অহনের সাথে আরেক ক্যাডেট আর্মি অফিসারের বিয়ে হয়। তাদের সম্পর্কটা যতটা না স্বামী স্ত্রী বা বন্ধু সুলভ তার চেয়েও বেশি  সহকর্মীসুলভ। সেখানেও যথেষ্ট মায়া, মমতা আর আবেগের ঘাটতি ছিল। অহনের কষ্ট লাগলেও প্রকাশ করেনি। তবে কখনও যে ইচ্ছে হয়নি হাত ভরা রেশমি চুড়ি পরা কেউ এলোচুলে এসে অহনের বুকে লুটিয়ে পড়ুক, তা কিন্তু নয়। একজন ইস্পাত কঠিন অফিসার তাকে যতটা না ভালোবেসেছিল তার চেয়ে বেশি  দুরত্ব বজায় রেখে চলতো।

 সামান্য রেস্তোরাঁর বিল থেকে শুরু করে বাচ্চাদের বেতন বা ঈদের কেনাকাটা কোনোটাই অহনকে একাই বহন করতে হয় নি। নিমা আগ বাড়িয়ে সব সময় তার অংশটা দিয়ে দিত। নিমাকে সে কোনোভাবেই ইমপ্রেস করতে পারেনি। মাঝে মাঝে শখ করে কিছু নিমার জন্য কিনে আনলে নিমা  হাতে নিয়ে দেখেছে। পরেছে হয়তো একবার। এরপর  আলমারির কোণে পরে থেকেছে সেই কাপড় বা গহনা বছরের পর বছর। কোনোদিন অহনের প্রিয় খাবার রাঁধেনি নিমা। অহন বাসায় ফিরলে খুশী হয়ে দৌড়ে সামনে আসেনি যেমন আসতো অহনের আম্মা যখন অহনের আব্বা বাসায় ফিরতো। অহনের আব্বা বাড়ি ফেরার আগেই আম্মা একগ্লাস শরবত বানিয়ে রাখতো, নিজে হাতে অহনের আব্বাকে খেতে দিত। অহনের চাহিদা খুব সামান্য। সে শরবত, চা কিছুই চায়নি। শুধু চেয়েছিল নিমার একটু সঙ্গ। নিমার হাসির আওয়াজ তার শুনতে খুব ইচ্ছে করতো। কিন্তু আদতে নিমা ছিল একজন আবেগহীন এক ইশ্পাত কঠিন নারী। অহনের প্রতি তার বিন্দুমাত্র ভালোবাসা বা কর্তব্য কোনোটাই ছিল না। প্রেমহীন ভালোবাসাহীন শারীরিক সম্পর্ক করেছে সে নিমার সাথে শুধুমাত্র নিজের পুরুষত্বে আঘাত আসবে বলে। 

নিমা জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসতো রুটিন। বাচ্চাদেরও সে আর্মি ট্রেনিং-এ মানুষ করেছে। মাঝে মাঝে অহন লুকিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে পথের ধারের ঝালমুড়ি, ফুচকা কিনে খাওয়াতো। কিন্তু  বাচ্চারাও মায়ের মতোই রুচি পেয়েছিল। ওরা  ইনডোর গেম আর রেস্টুরেন্টের বাইরের খাবার খায় না। ওরা সিভিলিয়ানদের সাথে মিশতে পারতোনা। এদিকে সুটেড বুটেড জীবন ভালো লাগতোনা অহনের। একঘেঁয়েমি এসে গিয়েছিল ওর এই জীবনে। নিস্তরঙ্গ, নিঃসঙ্গ এক জীবন সে যাপন করতো। এভাবেই চলছিল তাদের সংসার। বাচ্চারা বড় হয়ে যে যার কর্ম জীবন আর সংসারে ব‍্যস্ত হয়ে যায়।

নিমাও ডিসিপ্লিণ্ড লাইফ থেকে পুরোপুরি মুক্তি পায়। রিটায়ারমেন্টের পর অবসাদগ্রস্ত নিমা না ফেরার দেশে চলে যায়।

অহনের জীবনে নিমার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি কোনোটাই ব‍্যপক ভাবে প্রভাব ফেলেনি।

দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর একছাদের নীচে থেকেও সেভাবে মনে জায়গা করে নেয়নি নিমা, যতটা যায়গা করে নিয়েছে মিসেস রহমান। প্রতিদিন ইভনিং ওয়াকে ওনার সাথে দেখা হয় অহনের। অহনের বয়সিই হবেন উনি। এই ষাট বছর ছুঁই ছুঁই করা বৃদ্ধাও যে প্রান খুলে  কিশোরীর মতো হাসতে পারে ভাবতেই অবাক লাগে অহনের। মনের ঘরে ইদানিং মিসেস রহমান নিত্য আসা যাওয়া করেন। সেদিন টিস্যুতে মুড়িয়ে নাগেট এনেছিল অহনের জন্য। হাসতে হাসতে বলল আপনার মুখের সব দাঁতই তো মনে হচ্ছে  নকল। দেখেন খেতে পারবেন কি না। না হলে পায়েস বানিয়ে পাঠাবো। আচ্ছা সুগার নেই তো আপনার! বলেই ভীষণ হেসেছিলো উনি। মাস ছয়েকের পরিচয় মিসেস রহমানের সাথে। একদিন ঐ পার্কের কোণে প্রেসার মাপাতে গিয়ে কথা হয় মহিলার সাথে। সেই থেকে বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক হয় ওদের। মহিলা বেশ জলি মাইন্ডের।

এই প্রান প্রাচুর্যে ভরা হাসিখুশি মুখটা গত দুই সপ্তাহ ধরে অহন আর গুলশান পার্কে দেখেনা। ওনার সাথে দেখা করার জন্য অহন সকালে উঠে পার্কে গিয়েছে, বিকেলে আবার গিয়েছে। বারবার গিয়েছে। হাঁটার গতি শ্লথ করে সবগুলো মহিলার মুখ ভালো করে দেখেছে সে প্রতিদিন। হঠাৎ এক অচেনা বৃদ্ধার জন্য এতো মনটা খারাপ হচ্ছে কেন, নিজেকেই প্রশ্ন করে অহন। সাদা চুলের ছোটখাটো হাতি সাইজের এক মহিলার জন্য এতো মায়া কেন এই  বয়সে এসে হলো ভেবে নিজেই অস্বস্তি বোধ করে সে। কিন্তু মনও মানে না। ভীষণ রাগ হয় মিসেস রহমানের উপর। জ্ঞানকান্ডহীন এক মহিলা, টিস্যুতে মুড়িয় নাগেট এনে খাওয়াতে পারে আর সেলফোন নম্বরটা দিয়ে যেতে পারেনা। একটা ননসেন্স লেডি বলে মনে মনে বকা দেয় অহন।

মিসেস রহমানের সাথে হাঁটতে আসা আরেক ভদ্রমহিলার সাথে দেখা হয় সেদিন। দৌড়ে গিয়ে অহন জিজ্ঞেস করেছিল মিসেস রহমান কোথায়! উনি আসছেন না কেন? ওনার কি শরীর খারাপ! ওনার সেল নম্বরটা আমাকে দেবেন।

ভদ্রমহিলাকে এতোগুলো প্রশ্ন একবারে জিজ্ঞেস করে অহন একটু লজ্জাই পেল মনে হয়। মহিলা শান্ত কন্ঠে বলল অহন সাহেব আসুন ঐ বেঞ্চে গিয়ে একটু বসি।

তখনও অহন বোঝেনি কি খবর ওনার জন্য অপেক্ষা করছে। মিসেস রহমান গতসপ্তাহে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। আমি দেশে ছিলাম না। গত পরশু শুনেছি ওদের বুয়ার কাছে। 

 অহনের বুকটা মুষড়ে উঠলো। চাপা একটা ব্যথা বুকটাকে চেপে ধরেছে। আর কিছুই ভালো লাগছেনা ওর। সেই ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি যেন আবার জেগে উঠলো। এতো কান্না, এতো কষ্ট অহন চেপে রাখতে পারছেনা। ঠান্ডা হয়ে আসে কফির মগ আর আঙুলগুলো ভিজে যায় চোখের জলে। এক ধূসর পৃথিবীতে নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ আর অসহায় লাগে অহনের। সাদা চুলের সেই হেলে দুলে হেঁটে যাওয়া এক মিষ্টি হাসির বৃদ্ধার ওপর ভীষণ অভিমান হয় অহনের। একবার বাই দিয়ে তো যেতে পারতো...






সেতুবন্ধন

কা বে রী  রা য়  চৌ ধু রী

প্রণীত ও মৌমিতার দুবছরের দাম্পত্য জীবন, নিজের পরিবেশ ছেড়ে এসে আরেকটি নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে মেয়েদের অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে পারাপার, সেখানে স্বামীরা সহযোগী হলে সকল সমস্যার মুখোমুখি হওয়া কিছুটা সহজসাধ্য হয়ে ওঠে।

প্রণীত- মায়ের মতো সুগৃহিনী প্রথম থেকেই বউকে ভেবে বসে আছে। নিজের পৌরুষত্বের গরিমায় ভালবাসার থেকে অধিকারবোধ বেশি। রান্না মায়ের মতো হয়নি খুঁত ধরার অভ্যাস ফলে মৌমিতা লেখাপড়া শিখেও চাকরির বাজার খারাপ হওয়ার জন্য শান্ত স্বভাবের মেয়ে মুখ বুজে মানিয়ে নেওয়া মজ্জাগত। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে একতরফা মানিয়ে নিতে হাঁফ ধরে আসে, মৌমিতা মনখারাপি করে বসে থাকলে প্রণীত তখন আবার তুমি বড্ড গোমড়ামুখো, কিন্তু এর কারণটা অনুসন্ধান করার ধৃষ্টতা এই ধরনের পুরুষের নেই। মৌমিতা মনে মনে ভাবে ওর ভাসুর তার বউ এর মন রাখার জন্য কতই না খোশামোদ করে আর একই মায়ের সন্তান হয়ে দুই ভাই দু'রকমের।

স্বামী মনোমত না হলেও বউরা সহজে ছেড়ে চলে যেতে পারে না। বাবা মায়ের কথা ভেবে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। দুজন সমান হলে সংসার টিঁকিয়ে রাখা দায়, সহ্য করে পথে আনার চেষ্টা লড়াইয়ের মতো চালিয়ে যাওয়া। সারাদিন যেমন তেমন রাত্রিবেলা বিছানায় আদরে সোহাগে নিজের উসুল পূরণ করে নেয়, সকাল হলে অমিত বিক্রম। মেয়ে তো বাবার প্রতি বিরক্ত চূড়ান্ত। মৌমিতা শুধু মায়া মমতা ভালবাসায় মানুষটিকে আঁকড়ে ধরে আছে, অথচ প্রণীত- এক মুহূর্ত মৌমিতা ছাড়া অচল, উঠতে, বসতে স্ত্রীকে ছাড়া জগৎ অন্ধকার, একমাত্র অফিস ছাড়া কোন কাজে স্বাবলম্বী নয়। এদিকে প্রভাব খাটাতে ওস্তাদ, এইভাবেই দাম্পত্য জীবন চলছিল একজনের ধৈর্য সহ্যের মধ্যে দিয়ে দিনযাপনের কাহিনী।

দিনবদলের পালায় টের পাওয়া যায় কত ধানে কত চাল, মেয়ে ছোট থেকেই দেখছে বাবার প্রতাপ, আধিপত্য। উচ্চ শিক্ষার সুবাদে সে মাকে নিয়ে পুণেতে পাড়ি দিলো, বাবা চাকরির জন্য আটকে পড়ে রইলো কোলকাতায়। কাজের লোকের তত্ত্বাবধানে নিজের পছন্দ অপছন্দ জলাঞ্জলি দিয়ে তথৈবচ অবস্থা, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে স্ত্রীর যত্নআত্যির অভাব। ফোনের পর ফোন আকুতি মিনতি তুমি মেয়ের জন্য লেডিস হোস্টেলে ব্যবস্থা করে চলে এসো, না এবার মেয়ে ছাড়বার পাত্র নয়, বাবাকে তার সারাজীবনের সুদে আসলে পূরণ করে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। মায়ের ত্যাগের এতদিনকার সময়টা তাকে পরিপূর্ণ রূপে অনুভব করতে হবে। মৌমিতার মায়ার শরীর, বলে- মেয়ে একা থাকতে চাইছে না তুমি রিটায়ার পর্যন্ত একটু কষ্ট করে এরপর এখানে চলে এসো। 

একা থাকতে থাকতে প্রতিপদে নিজের ভুলগুলো অনুধাবন করে স্ত্রীকে বুঝতে না পারার কষ্টে পীড়া দেয়। চাকরি জীবনের দু'বছর আগেই ভলিন্টারি নিয়ে অবসর গ্রহণ করে মেয়ে বউ এর কাছে ফিরে গিয়ে স্বভাবে আমুল পরিবর্তন দেখা দেয়, এখন সে স্ত্রীর প্রতি সহমর্মি ও যত্নবান, একা থেকে বুঝতে পেরেছে স্ত্রীর মর্যাদা, যৌবনে মৌমিতা যা পায়নি, বৃদ্ধ বয়সে স্বামীর পরিবর্তন তাকে দীর্ঘ দিনের অপূর্ণতায় পূর্ণতা দিয়েছে এবং সেটা সম্ভব হয়েছে মেয়ের জন্য, সেইই তো দুজনের মধ্যে সেতুবন্ধন।।






অবলা অনুভূতি

দী প ঙ্ক র  না য়ে ক (শ্রী দ্বৈ পা য় ন)

শরতের শুরু, তবুও মাঝে মধ্যে বর্ষারানী অভিমানে কান্নাকাটি করে যাচ্ছে। বন্ধের জন্য সব কাজ বন্ধ করে স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতেই আছি। দ্বাদশ শ্রেণির কতকগুলি ছেলেমেয়ে ডাউট ক্লিয়ারের জন্য এসেছে। ' আমার বাংলা' নিয়ে গভীরতম আলোচনায় বন্ধ কাঁচের ঘরে গমগম শব্দে আর একটি করুণ শব্দ চাপা পড়ে যাচ্ছিল, এমন সময় নবনীতা ছন্দপতন ঘটিয়ে বলে- স্যার দরজার দিকে তাকান।

দরজাটা হালকা ভেজানো ছিল, সামান্য ফাঁক থেকে দেখি করুণ একজোড়া চোখ। -রে রে করে ছুটে গেলাম, দরজা খুলতেই আগন্তুক আত্মরক্ষার উদ্যোগে সিঁড়ির 'পরে দাঁড়িয়ে। রক্তচক্ষুতে কিছু বলতে যাবো কিন্তু আগন্তুকের মুখটা যেন চেনা লাগালো, হ্যাঁ , ওনাকে বেশ কয়েকবার লালু সঙ্গে দেখেছি, এক-দুবার আতিথ্যগ্রহণ করেও গেছেন। রসিকতায় রঙ মিশিয়ে বললাম - কি মহারানী, এখানে কেন? আপনার রাজা বাহিরে কোথাও দেখুন। সম্ভবত গ্যারেজে আছে। তাড়াতাড়ি যান, নইলে গৃহলক্ষ্মীর নজরে পড়লে আপনার আর রক্ষে নেই।

কিন্তু আমার রসিকতা তেমন কাজ দিল বলে মনে হলো না। আগন্তুক করুণ নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে, অস্পষ্ট করুণ যন্ত্রনায় শুধু কুঁই কুঁই আওয়াজ করছে। বুঝলাম ও কিছু বলতে চায়। ভালো করে দেখলাম শরীরে আঘাতের তেমন কোন চিহ্ন নেই। দোতলা পর্যন্ত যেহেতু উঠে এসেছে নিশ্চয়ই পা-ও ঠিক আছে। সমবেদনা সুরে বললাম- কি হয়েছে রে! ব্যাপার কি?
এই সুরটা দেখলাম কাজে দিয়েছে। হঠাৎ দেখি বিনা ভূমিকায় ও আমার পাঞ্জাবী ধরে সিঁড়ির দিকে টানছে- আচ্ছা চল, আমি যাচ্ছি...

তাড়াতাড়ি নেমে ছেলেদের একটা ভেজা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। জোর বৃষ্টির ঝাপটের মধ্যে দেখি ও আমাদের গেটের সামনে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। গেটের বাইরে বেরুতে দেখি সৌভিকও ছাতা হাতে বেরোচ্ছে। আর ও একছুটে মেইন ঢালাই রাস্তার কাছে দাঁড়িয়ে। কিছু তো একটা ঘটেছে! কিন্তু কি হয়েছে! ভেতর ভেতর একটা দুশ্চিন্তা কাজ করছে। দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে দেখি লালু অসহায় ভাবে পড়ে আছে। এরকম কিছু একটা ভেবেছিলাম। কিন্তু অতোটা ভাবিনি।

পেছনের পা দু'টো ভেঙে গেছে। নাড়াতেই পারছে না। রানী ব্যাস্ত হয়ে ওর চারদিকে ঘুরছে, একবার লালুর মুখ চাটছে, একবার গিয়ে ওর ভাঙা পায়ের ক্ষতগুলো চেটে দিচ্ছে। সৌভিক এসে গেছে। ---বাবু ছাতাটা ধরো... বলে আমি লালুকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি। লালুর  যন্ত্রণার্ত অবরুদ্ধ আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছি। যে আওয়াজটা আমি একটু আগে রানীর মুখে শুনেছিলাম। 

লালুকে এমনভাবে নিয়ে যেতে দেখে মিসেস শশব্যস্ত হয়ে বলে- কি হয়েছে লালুর?
---পেছনের পা'দুটো ভেঙে গেছে মনে হয়। নাড়াতেই পারছে না। 
লালুর পা'ধোয়া রক্তজল আমার সাদা পাঞ্জাবি বেয়ে নামছে। গ্যারেজের চটটাতে লালুকে শোয়াচ্ছি, ওদিকে অভ্র ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছে, ছেলে মেয়েরা গ্যারেজের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। লালুকে শুইয়ে দিতেই রানী ওর পায়ের আঘাতের অংশগুলো ব্যস্ততার সঙ্গে চেটে চলেছে। 

একটু পরে ডক্টর সাঁতরা এলেন। আমি ততক্ষণে শুকনো গামছা দিয়ে ওর সর্বশরীর  মুছে দিয়েছি। ডক্টর আসতে রানী আমার পাশে এসে দাঁড়াতে আমি ওর ভেজা গাটাও মুছে দিলাম।  ও একদৃষ্টিতে লালর দিকে তাকিয়ে, চোখটা যেন ভেজা ভেজা মনে হলো। 

ডক্টর সাঁতরা ইনজেকশন রেডি করতে করতে বললেন- পেছনের পা দু'টো ভেঙে গেছে স্যার। সম্ভবত ভারি বাইক চলে গেছে। প্লাস্টার করতে হবে। পায়ে লোশন লাগিয়ে, কিছু ওষুধ দিয়ে, 'রাতে আসছি' বলে  ডক্টর বেরিয়ে গেলেন। একটু পরে দেখি অভ্র মাংসের জুস, আলু মাংস দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে প্লাস্টিকের বাটি দুটো এর ওর সামনে রাখতে দু'জন পরস্পরের দিকে চোখাচোখি করে সেবা শুরু করলো।

ছেলেদের বললাম- আজ তোমাদের ক্লাসটা হলো না; সময়টা নষ্ট হলো।
অদৃজা বলে-  স্যার, জীবনে অনেক করেছি আগামীতেও করবো। কিন্তু আজ যে ক্লাসটা করলাম তা অনন্য, অমূল্য।
একে ওকে ওরা বাড়ির দিকে রওনা হলো। আর একটা প্লাস্টিকের বাটিতে জল খেতে দিতে, রানী জল খেয়ে লালুর মুখের কাছে এমন ভাবে শোয়ার ইনতেজাম করলো যে, সহজেই বোঝা যায় তার আর বাড়ি ফেরার কোনো লক্ষন নেই। মান্না কাকুকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম- রানী আজ বাড়ি ফিরবে না।

হঠাৎ মনে পড়লো- হ্যাঁ, ঠিক, গতবছর এই সেপ্টেম্বরে লালু প্রথম এভাবেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে এসেছিল। তখন ও নিজের শুশ্রূষা নিজেই করতে পেরেছিল। তার মধুমাস তখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা শুধু খাদ্যের সেবা করতে পেরেছিলাম। একটা লাভ হয়েছে, অভ্রর কুকুরের প্রতি ভয়টা কেটেছে। 

এখন দেখছি লালুর কষ্টটা কমেছে। পরস্পর রসনায় রসনায় প্রেমালাপ করছে। আমি রসিকতা করে বললাম- কিরে লালু, দুটো সিজিন নষ্ট করলি তো?
লালু পিট পিট করে তাকাচ্ছে, রানীও। কিন্তু অনুশোচনার বিন্দু মাত্র লক্ষন নেই। ভাবলাম, হয়তো ওরা বুঝতে পারেনি। অভ্র হাসতে হাসতে বললো- তুমি না পারো বটে!

দিন পনের কেটে গেছে। লালুর প্লাস্টার কাটা হয়েছে। ও ধীরে ধীরে হাঁটা-চলাও করছে। রানী দুই বাড়িতে যোগাযোগ রাখছে। চেঞ্জ শুধু রানীর স্বাস্থ্য। সম্ভবত দু'ই বাড়ির সেবা পেয়ে এমন শ্রীবৃদ্ধি। আমার ভুল ভাঙালো অভ্র নিজে। বাইরে গেটের কাছে এসে দেখি দু'জনের দারুন খুনসুটি চলছে। মান্নাকাকু কি কারণে আমাদের বাড়িতে আসছেন। আমি পাতলা উষ্মা প্রকাশ করে বললাম- লালু, বাবা হতে চলেছো, বেশ ভালো কথা, এবার নিজের পরিবারের দায়িত্ব বুঝে নাও। লালু খালি আমার দিকে চেয়ে গ-র-র-র শব্দ করলো। মান্না কাকুকে  হাসতে দেখে বললাম- জামাইকে নিয়ে যান। ঘরজামাই করে রাখুন। 
মান্না কাকুর সটান উত্তর- আহা, তা আবার কেন? মেয়ে নিজের বাড়িতে তো বেশ ভালোই আছে; জামাই কতো কেয়ারিং...






স্যালুট

প্র শা ন্ত ঠা কু র 

বাহানুল্লা বিমল চেবানো মুখভর্তি পিক ড্রেনের দিকে যেই মাত্র ফেলেছে, ওমনি বি. এম. পৃথা দেবী গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছেন। সাত দিনের ট্রেনিংয়ের জন্য ম্যাম মুম্বাই গেছিলেন। বছর বিয়াল্লিশের বাহানুল্লা স্যালুটের ভঙ্গিতে ধুক পুক বুক করে দাঁড়িয়ে। নতুন চাকরিতে আজ তার ষষ্ঠ দিন। ম্যামকে সে আগেও কখনও দেখেনি। কিন্তু ম্যাম শুধু প্রতি নমস্কার করে উপরে উঠে গেল। অবাক বিস্ময়ে সে শুধু তাকিয়েই থাকে, হাতটা পর্যন্ত নামাতে ভুলে যায়।

ঘণ্টাখানেক পরেই বাহানুল্লার ভেতরে ডাক আসে; সে নিশ্চিত বাইরে যাওয়ার প্রোগ্রাম রেডি। কাঁচের দরজার সামনে দাঁড়ালে ম্যাম ইঙ্গিতে আসতে বললে বাহানুল্লা কাঁচু মাচু মুখে, মাথা নিচু করে ভেতরে দাঁড়ায়। 
---বসুন শেখ সাব।
বাহানুল্লার নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। 
---হ্যাঁ আপনাকেই বলছি। বসুন।
---সরি ম্যাম, আপনার সামনে আমি বসতে পরি না, নকর মালিকের সামনে বসতে পারে না।
---তাহলে আমিই দাঁড়াই... বলে ম্যাম ইজি চেয়ার থেকে ওঠার উপক্রম করাতে বাহানুল্লা বলে- ---সরি ম্যাম, আচ্ছা বসছি।  বলে সে কোনোক্রমে পেছনটা ঠেকিয়ে বসে। 

এমন সময় চরণ দু'কাপ কফি দিয়ে যায়। ম্যাম একটা কাপ বাহানুল্লার দিকে এগিয়ে দিয়ে, একটা ইঙ্গিত করে বলেন- ---আপনাকে কেনো ডেকেছি বলুন তো?
বাহানুল্লা মাথা নিচু করে বসে থাকে।
---আরে স্যার, আপনার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য। তারপর বলুন বাড়িতে কে কে আছেন? বাড়ি কোথায়? কেমন চলছে?
এ কথা, ও কথা চলতে চলতে বাহানুল্লার চোখে মুখে স্বাভাবিক সৌন্দর্য ফিরে আসে। 
---আচ্ছা শেখ সাব, একটা অনুরোধ করবো ?
---অনুরোধ নয়, অর্ডার প্লিজ ম্যাম।
---আর একবার সেই স্টাইলে স্যালুট করবেন প্লিজ? আপনার স্যালুটটা আমাকে জাস্ট মুগ্ধ করেছে।
---জরুর ম্যাম।
প্রায় একই সঙ্গে দু'জনেই উঠে দাঁড়ায়। আবার স্যালুট এবং প্রতি নমস্কার।
---আপনি এতো সুন্দর স্যালুটের স্টাইল শিখলেন কোথা থেকে।
---সে অনেক কথা ম্যাম, অন্য কোনো দিন বলা যাবে, মেইন গেটে এখন কেউ নেই। আমি...
---আচ্ছা আসুন।

দরজা খোলার আগে ম্যাম বলেন ---আচ্ছা শেখ সাব, আর একটু প্লিজ...
বাহানুল্লা পিছন ফিরে তাকায়।
---আচ্ছা শেখ সাব, আর একটা কথা- বাইরে থেকে আগত কোনো ব্যক্তির কাছে একটি কোম্পানিকে প্রথম কে রিপ্রেজেন্ট করে? 
একটু চিন্তা করে বাহানুল্লা বলে- ---ম্যাম, কোম্পানির গেট, আউটলুক, ডেকোরেশন...
সে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, ম্যাম তাকে থামিয়ে বললেন- ---ঠিক বলেছেন, কিন্তু এসব তো নির্জীব বস্তু, সজীব হলো দ্বার-রক্ষক, তাঁর প্রাণবন্ত অভ্যর্থনাই কোম্পানির প্রথম পরিচয় বহন করে। আর তাঁর ভরসাতেই কোম্পানির সবাই নিশ্চিতে ঘুমোতে পারেন...

বাহানুল্লা চলে যাওয়ার পর পৃথা ম্যাম, ওর ফাইলটা পি. এ. কে দিয়ে যেতে বললেন।

     
দ্বিতীয় অধ্যায়:

এ কাজ , ও কাজ নানা ব্যস্ততার মধ্যে বেশ কয়েকদিন কেটে যায়। পৃথা ম্যাম মাঝে মধ্যে বাহানুল্লাকে ডেকে পাঠান, এক সঙ্গে চা কফি কখনো টিফিনের সঙ্গে চলে নানান গল্প। তাই নিয়ে অন্যান্য কর্মচারীদের মধ্যে ফিসফাসও চলে। এমনকি বাড়ি পর্যন্তও খবর চলে যায়। একদিন ডাইনিং টেবিলে প্রথমাদেবী স্বামীকে ডেকে বলেন- শুনেছ তীর্থ, মেয়েকে বিদেশে পড়তে পাঠিয়ে কি লাভ হয়েছে, গ্রুপ ডির সাথে এক টেবিলে চা-কফি খায়।
ঠাকুমা বলেন- শুনেছি ছেলেটা নাকি মুসলিম!

বছর বত্রিশের স্মার্ট সুন্দরী পৃথা গ্লাসে জল ঢালতে ঢালতে কিছু বলার আগেই তীর্থসুন্দর বাবু বলেন- ঠিক এই কারণেই তো বিদেশে পাঠানো। দাদু খবরের কাগজের উপর চশমাটা রাখতে রাখতে বলেন- কোম্পানির আসল পরিস্থিতির খবর ওই গ্রুপ সি, ডি-র কাছেই পাবে দিদিভাই।


তৃতীয় অধ্যায়:

বেশ কয়েকদিন ধরে যখন তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। ছাতা হাতে বাহানুল্লা গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে। গায়ে বৃষ্টি পড়ার কথা নয়, কিন্ত সেদিন মাঝে মধ্যে দমকা বাতাস জলের ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছিল। গেটের কাছে বি.এম. ম্যমের স্কর্পিও দাঁড়িয়েছে, ড্রাইভার বড় ছাতা নিয়ে গেট খুলে ম্যামকে উপরে নিয়ে আসছে। ছাতা রেখে বাহানুল্লা ম্যামকে স্যালুট করার পরিবর্তে পাশের অফিসের উপরের দিকে তাকিয়ে, ম্যাম ততক্ষণে বাইরের ফ্লোরে এসে দাঁড়িয়ে; হঠাৎ দমকা বাতাস, তারপরে- 'ম্যাম উঠে আসুন, উঠে আসুন' বলতে বলতেই দেখা গেলো পাশের অফিসের বিজ্ঞাপনের বড় বক্সটি খুলে ম্যামের উপরেই নেমে আসছে। বাহানুল্লা লাফ দিয়ে বক্সটা আটকাতে যায়, কিন্তু ভারি বক্সের তোড়ে দু'জনেই ছিটকে পড়ে, ম্যামের মাথাতে দারুণ চোট লাগে, এবং অজ্ঞান।

বাড়ির আপনজন সহ কোম্পানির বিশেষ কিছু লোকজন নার্সিংহোমে হন্যে হয়ে অপেক্ষায়। ফিয়ন্সে ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং ছেড়ে এসে বার বার ঘড়ি দেখছেন। পৃথা ম্যামের জ্ঞান ফিরেছে; একটু স্বাভাবিক হতেই তাঁর প্রথম খোঁজ- বাহানুল্লা কেমন আছেন?
কেউ একজন বলে- ওর বাম পা-টা ভেঙে গেছে। এখন ভালো আছে? উৎকন্ঠিত হয়ে ম্যাম বলেন- উনি কোথায়?
---সরকারি হাসপাতালে ম্যাম।
ম্যাম প্রায় চিৎকার করে বলেন- কি!!! এবার বিরক্তিভরে  ফিয়ন্সে বলেন- একটা গ্রুপ ডি-র জন্য... ওনাকে কথা শেষ না করতে দিয়ে পৃথা ম্যাম তিরিক্ষি গলায় বলেন--- হ্যাঁ ওই গ্রুপ ডি. না থাকলে, আমি এতক্ষণে গ্রুপ এক্স. হয়ে যেতাম। শেখ সাবকে এখুনি এই নার্সিংহোমে নিয়ে আসুন। এক্ষুনি।


চতুর্থ অধ্যায়:

বাহানুল্লা শুয়ে আছে। শুকনো মুখে ওর আম্মা মাথার কাছে বসে। ধীর পায়ে পৃথা ম্যামকে ভেতরে আসতে দেখে ছেলেকে ডেকে সাবিনা বিবি উঠে দাঁড়ান।
---মাসিমা আপনি বসুন, বসুন প্লিজ।
ওদিকে বাহানুল্লা ওঠার চেষ্টা করেও উঠতে পারলো না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে পৃথা ম্যাম বাহানুল্লার সামনে গিয়ে তারই ভঙ্গিতে একটা স্যালুট জানায়। বাহানুল্লা ইতস্তত হয়ে সবিস্ময়ে লজ্জিত হয়ে বলে- হায় আল্লা, ম্যাম আপনি আমাকে স্যালুট করলেন কেন?
---এটা আপনার সম্মান, যা আপনি ডিসার্ভ করেন। আর এটা এক প্রকার মেডিসিন। যতদিন না সুস্থ হচ্ছেন, ততদিন পাবেন।






অজানা শারদীয়া

শি ঞ্জি নী  চ্যা টা র্জী

আবার একটা বছর পেরিয়ে আসা... পার করে আসা হাসি, দুঃখ, মনখারাপের জটলা। আকাশ জুড়ে সাদা মেঘের আনাগোনা, টিভি খুললে, "পূজো আসছে" হেডিং, রাস্তায় বেরোলে অল্পবিস্তর জটলা, হাসির বোল!এই সবকিছু, সওওব কিছুর মধ্যে সামিল তিতলি ও। বাহ্যিক ভাবে!অন্দরমহলের খবর কে রেখছে কবে? এই ব্যস্ত শহরে, টোটোর লাইনে, মলের অতিরিক্ত আড়ম্বরে, মেসের ভেতর কোণে গুছিয়ে রাখা কেনাকাটার মাঝে, ওর মনখারাপ আর অভিমানের জায়গা বড্ড কম! 

ওর শারদীয়া হারিয়ে গেছে দাদুর সাথে! ও জানে এবার অষ্টমীতে আর কেউ পাট করে রাখা ধুতি-পাঞ্জাবী পড়বে না, অঞ্জলি শেষে প্রণাম সেরে কারো কাছে টাকা নিয়ে ও যাবে না বন্ধুদের সাথে! এবার নতুন কেনা পাঞ্জাবীটা না পড়া থেকে যাবে!তবুও এসব কষ্ট তিতলির একান্ত, ও তো বরাবর চাপা, ও তো সবসময় ভেতরের ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না চাপা হাসিখুশি একটা মেয়ে। কে জানবে, আর কেনই বা জানবে ওর নিজস্ব ব্যাথা? কিন্তু জানত তো কেউ, ও না বললেও ঠিক বুঝে নিত, এখনও চোখ বন্ধ করলে ও দেখতে পায় সেই এলোমেলো চুল, টোল পড়া হাসি আর ওকে জড়িয়ে থাকা তাকে... ওর ব্যাথার বন্ধু, ওর একফালি উঠোন!

চমক ভাঙে, ফিরে আসতে হয় বাস্তবে!
নাঃ, কেউ নেই ওর, থাকতে নেই!তিতলি নিজের অন্দরমহলে চাবি দিয়ে বেরিয়ে আসে...।

একলা পাহাড়, রোডোডেনড্রনের সারি, এক হাতে ক্যামেরা আর এক হাতে পুড়তে থাকা সিগারেট!পূজোতে এভাবেই পালিয়ে আসে সম। পুজো বড্ড আদুরে,পুজো বড্ড স্মৃতিকাতর! ওর জীবনে পুজো আসে না আর, ওর মনে পড়ে না কিচ্ছু! শারদীয়া হারিয়ে গিয়েছে, বয়ে গিয়েছে খরস্রোতা নদীর মতো, অনেক দূরে... অনেক অনেক দূরে!
তবুও কুয়াশার বুক চিরে ভেসে আসে একটা মুখ, মুক্তোর মতো হাসি, অষ্টমীর শাড়ির সাথে টিপ পড়া এক মেয়ে আর একটা হাতের উষ্ণতা! এখন কার জন্যে সাজে সে? কার হাতে রাখে সেই হাত? মেঘেরা ভিড় করে আসে, ক্যামেরা কাঁধে সম হাঁটা দেয় নির্জন পথে!

এই শেষ না হওয়া গল্প গুলো বেঁচে থাক, অজানা থেকে যাক তিতলি আর সমের একাকীত্ব...।পুজো আসুক হাসিতে, কলরবে।বেঁচে থাকুক আনন্দ, শাশ্বত হোক শারদীয়া..। আর শেষ না হওয়া গল্পগুলো মুলতুবি থাক সেই দিনটার জন্যে, যেদিন কুয়াশা ঘেরা রাস্তায় আবার দেখা হবে দুজনের... কথা হবে অনেক কান্নাভেজা চোখে... দূরত্বের সাঁকো পার করে, সেদিনের জন্য।






আমি যুধিষ্ঠির

দে ব ব্র ত  রা য় 

এখন বাচ্চাদের পার্কে ঢোকার জন্য কুড়ি টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। ভেলকিওয়ালা রতন তাই আর পার্কে ঢোকে না। কুড়িটা টাকা দিন-দশেক বাঁচাতে পারলেই ওর ছোট ছেলেটার হাঁপরোগের ওষুধ কেনা যায়।এদিকে একটার পর একটা সমস্যা যেন রতনকে কচু-ঝোপের মশার মতো একেবারে পিনপিন করে ছেঁকে ধরছে। অকাল-বৃষ্টির জন্য ক-দিন ওর সেরকম রোজগারপাতি হয়নি। আর তারমধ্যেই কাল হাজরার মোড়ে বাস থেকে নামতে গিয়ে গাড়ির চাকার তলায় পড়ে ওর সাধের ডুগডুগিটা ভেঙে একেবারেই চানাচুর হয়ে গেছে।

একটা ডুগডুগি না-হলে খেলা দেখানো যায় না। আজকাল খদ্দের জোটানোর জন্য শুধু বাঁশি ফুঁকলে কাজ হয় না, সঙ্গে ডুগডুগিও বাজাতে হয়। এদিকে পকেটের অবস্থাও ভাঁড়ে-মা ভাবানী। তাই অনেক ভেবেচিন্তে, হিসেবনিকেশ করে রতন কালীঘাটের ব্রিজে ওঠার মুখটার সামনে এসে হাজির হলো। এখানটায় গলিঘুঁজির ভেতরে কয়েকটা বাজনার দোকান আছে, যেগুলোতে সস্তায় সেকেন্ডহ্যান্ড মাল পাওয়া যায়। রতন ধীর পায়ে হেঁটে গলির ভেতরের সেরকমই একটা ঘুপসিপারা দোকানে গিয়ে ঢুকল। দোকানদারটা একেবারেই ছোকরা টাইপের। রতন পকেটের অবস্থা বুঝে দর-দামের একেবারে মা-মাসি করে, ছোকরাটাকে কথার ম্যাজিকে পটিয়ে শেষমেশ একটা ডুগডুগি কিনেই ফেললো। খুব-একটা পছন্দ না-হলেও এত কম দামে এর চেয়ে ভালো ডুগডুগি যে পাওয়া যায় না, সেটা রতন ভালোমতোই জানে।
ছোকরা দোকানিটা বললো, মালটা নতুন বটে। তোমাকে দিয়েই বউনি করলুম। অভ্যাসমতো দু-একবার নেড়ে ঝাঁকুনি দিয়ে ডুগডুগিটা বাজাতেই, রতন আর দোকানি দুজনেই একেবারে থ-মেরে গেল। রতন আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো ছোকরা- দোকানিটাও ডুগডুগিটার দিকে ভুতে পাওয়া-রুগীর মতো বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে। রতন আবারও ডুগডুগিটা ধীরে ধীরে দু-চারবার নাড়িয়ে তারপর হটাৎ-ই, কব্জিতে একটা  জোর মোচড় দিয়ে একেবারে নিজস্ব স্টাইলে আরেকবার সেটা বাজাল। আর সঙ্গে সঙ্গে আবারও ডুগডুগিটার ভেতর থেকে যেন কেউ আগের মতোই চিল্লিয়ে বলে উঠলো, আমি যুধিষ্ঠির! আমি যুধিষ্ঠির! 
রতন তাড়াতাড়ি ডুগডুগিটা দোকানের মেঝেতে নামিয়ে রেখে খানিকটা ভ্যাবাচেকা খাওয়া-গলায় বললো, এমন ভুতুড়ে বাজনা তো জীবনে দেখিনাই গো দোকানি!
 দোকানদার-ছোকরাও যে বেশ ঘাবড়ে গেছে সেটা রতন তার হাবভাব দেখেই বুঝতে পারল। ছোকরাটা তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ডুগডুগির ঝাঁকার থেকে আরেকটা ডুগডুগি নামিয়ে এনে বেশ জোরে-জোরে দু-চারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেটা বাজালো। কিন্তু সেই ডুগডুগিটার থেকে আর আগেরটার মতন ওরকম অদ্ভুতুড়ে- আওয়াজ বের হলো না। বরং সাধারণ ডুগডুগির মতোই সেটা ডুগডুগ করে বেজে উঠল। ছোকরা দোকানদারটা এবার রতনের দিকে বেশ সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললো, এটা তোমার ভেলকির কারসাজি নয় তো!

রতন কথাটা শোনামাত্রই নিজের কান মলে, জিভ কেটে একেবারে অপ্রস্তুতের একশেষ হয়ে উঠলো। বললো, গুরুর দিব্যি, মাইরি বলছি। অমন পাপ কাজে গুরুর বারণ আছে গো দোকানি। গুরু-বিদ্যের ব্যভার যেখানে সেখানে করতে নাই। ছেলেটা তবুও রতনের দিকে কিছুক্ষণ সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থেকে নিমাই নামের কাকে যেন ফোনে ধরলো। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলো, কালকে যে ডুগডুগিগুলো সাপ্লাই দিয়েছ, সেগুলো কোথাকার মাল? 
ওপাশের নিমাই লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলো, কেন বল দেখি? দোকানি-ছোকরাটা বললো, একটা ডুগডুগির ভিতর থেকে কিরকম অদ্ভুতুড়ে সাউন্ড বেরুচ্ছে। নিমাই নামের লোকটা আবারও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সামান্য নীচু গলায় বললো, ওহ, তাহলে বোধহয় সেই ঢপের  ডুগডুগিটা তোর কাছে চলে গ্যাছে-রে। শোন, পাঁচ কান করিস না। ওটা আসলে একটা ঘুষখোর নেতা, ইয়ে মানে, মানুষের চামড়া দিয়ে তৈরি। আর তাই বোধহয়, আওয়াজটা একটু অন্যরকম বেরোচ্ছে। প্রথম-প্রথম একটু ট্যানট্যান করবে। তবে বিক্রি না হলে মালটা ফেরত দিয়ে দিস।

আধো অন্ধকারে ঝুপসি দোকানটার ভিতরে তখনও রতন আর ছোকরা দোকানদার সেই অদ্ভুতুড়ে ডুগডুগিটা নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। ওরা জানে ট্যানট্যান নয়, ডুগডুগিটা বাজালেই এক্ষুণি ওটার ভেতর থেকে আবারও আমি যুধিষ্ঠির! আমি যুধিষ্ঠির... আওয়াজ বেরিয়ে আসবে।





সিস্টার নীরজা কথা
  
মি ঠু ন  মু খা র্জী 

নীরজা নামের একজন সিস্টার সেদিন সারারাত হাসপাতালে ছিলেন। একই ঘরে সাত সাতটি  রোগী। সকলেই সবে মা হয়েছেন। অসুস্থ রোগীদের সকলেই তিন দিন আগে সিজারে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। কারো ছেলে আশা করে মেয়ে হয়েছে, আবার কারো মেয়ে আশা করে ছেলের পর ছেলে হয়েছে। কারোরই আশা পূর্ণ হয়নি। তাই কারো মনে সন্তুষ্টি নেই। সন্তানকে কোলে নিচ্ছেন না। সন্তান খুব না কাঁদলে বুকের দুধটা পর্যন্ত মুখে ধরছেন না। কারো শাশুড়ি বলে দিয়েছেন, এবার ছেলে না হলে বাপের বাড়ি বিদায় করে দেব। কারো স্বামী বলেছিলেন, ছেলের পর একটা মেয়েই চাই। আবার কোন মা আশা করেছিলেন দুই মেয়ের পর এবার একটা ছেলে হোক। সবাই সিজারের অসুস্থতা ও মনে ঈশ্বরের প্রতি একরাশ অভিমান নিয়ে শুয়েছিলেন। কেউ আবার ঘুমাচ্ছিলেন। সেদিন সমস্ত বাচ্চাদের ও তাদের মাদের দেখাশোনা করেছিলেন এই সিস্টার নীরজা। এই নীরজারা চিরকাল অন্যের জন্য নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে থাকেন। নিজের জীবনকে অন্যের সেবায় সর্বদা ব্যস্ত রাখেন। সকালবেলা নিজের ডিউটি শেষ করে সিস্টার নীরজা যখন বাড়ি যাচ্ছিলেন, তখন একটু থেমে তার ওয়ার্ডের সকল মায়েদের উদ্দেশ্যে বলেন---"তোমরা কেউই তোমাদের সন্তান ও পরিবারকে নিয়ে খুশি নও। আমরা প্রত্যেকে যা ঈশ্বরের কাছে চাই, তা পাই না। আর তার জন্য মনটা দুঃখে ভরে যায়। কিন্তু একবারও কি তোমরা ভেবে দেখেছো, এই পৃথিবীতে এমন কত নারী আছেন যারা কখনো সন্তানের মুখ দেখেননি! কোনদিন মা হতে পারেননি! তাদের মনের কষ্ট একবারও চিন্তা করেছ তোমরা!! সন্তান ছেলে হোক কিংবা মেয়ে সে মূল্যহীন হয়ে যায় না। একজন পিতা-মাতার কাছে সন্তানের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। যাদের যা চাহিদা ঈশ্বর তা তাকে নাই দিতে পারেন, এই যেমন আমি চল্লিশ বছর বয়সেও মা হতে পারিনি। হাজার হাজার নারীকে মা হতে সাহায্য করেছি কিন্তু নিজে কোনদিন মা ডাক শুনিনি। আমার মনের ভিতর গভীর যন্ত্রণা আছে। তাই বলি ভগবানের দান কখনো অবজ্ঞা করতে নেই।" 

সিস্টার নীরজার কথা শুনে কয়েকজন মায়ের চোখে জল দেখা যায়। আবার কারো কারো মন গলে না। তারা মনে করেন--- "এক একজনের সংসারে এক একরকম সমস্যা। ফলে বাইরে থেকে অনেকে অনেক কথাই বলতে পারেন। তিনি এই সকল সমস্যার সম্মুখীন হলে বুঝবেন বলা বা জ্ঞানদেওয়া কতটা সহজ ও কাজে কতটা কঠিন।" 

বিকেলবেলা নীরজা পুনরায় তার ডিউটিতে আসেন। তখনও তিনি দেখেন  মায়েদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি। শিশুরা সকলে নিজেদের মতো ঘুমোচ্ছে। তিনি অনুভব করেন সন্তানের গুরুত্ব, মায়েরা তখনি বুঝতে পারবেন যখন তাদের কাছে সন্তান থাকবে না। তিনি ঠিক করেন মায়েরা যখন ঘুমবে তখন তাদের কাছ থেকে বাচ্চাদের আলাদা করে দেবেন। তাদের ঘুম ভাঙলে তিনি দেখতে চান মায়েরা আগের মতো একই রকম চুপচাপ থাকতে পারেন কিনা। সিস্টার নীরজা সারা সন্ধ্যা একাই বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন। প্রতিটি বাচ্চাকে কোলে নিতেই সিস্টার নীরজা মাতৃসুখ অনুভব করেন। তার দুচোখে জল দেখা যায়। সে মনে মনে ভাবে--- "ভাগবান আমাকে মাতৃসুখ থেকে বঞ্চিত করলেও আজ আমি কিছু সময়ের জন্য সাত সাতটি শিশুর পালক মাতা হতে পেরেছি। জন্ম না দিয়েও মাতৃসুখ অনুভব করছি আমি। এই দিনগুলো আমি কখনো ভুলব না। এর আগে আমি অনেক শিশুর দেখাশোনা করলেও আজকের মতো এমন অনুভূতি আগে কখনো হয় নি। হে ঈশ্বর এদের মায়েদের এদের মূল্যটা বুঝতে সহায়তা করুন।" এরপর একে একে সবকটি বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে দেন তিনি। রাত দশটার মধ্যে মায়েরাও সকলে রাতের হালকা খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত বারোটার সময় সিস্টার নীরজা একে একে সকল বাচ্চাদের আলাদা একটা ঘরে নিয়ে যান। রাত একটার সময় একজন মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি দেখেন সিস্টার নীরজা ঘুমে ঢুলছেন। তিনি তার বাচ্চাকে দেখতে না পেয়ে চিৎকার করে কান্না করে ওঠেন। তার চিৎকারে সকলের ঘুম ভেঙে যায়। সকল মায়েরা তাদের সন্তানদের না দেখে কান্না করেন। সিস্টার নীরজা ঘুমের ভান করে বসে থাকেন। সমস্ত ব্যাপারটা তিনি চোখ বন্ধ করে অনুভব করেন। মাঝে মাঝে হালকা চোখ খুলে দেখেন সন্তানদের না দেখে মায়েরা পাগলের মতো আচরণ করেন। একজন আস্তে আস্তে বেড থেকে নেমে সিস্টার নীরজার গায়ে হাত দিয়ে ডাকেন। তৎক্ষণাৎ তিনি ঘুম ভাঙার ভান করেন। তাকে মায়েরা জিজ্ঞাসা করেন আমাদের বাচ্চারা কোথায় গেল। তিনি জানান ঘুমিয়ে পড়ার কারণে কিছুই তিনি দেখেন নি। তার কথা শুনে সকলের কান্না বেড়ে যায়। সিস্টার নীরজা মায়েদের বলেন--- "আপনারা কেউ কাঁদবেন না। আপনাদের বাচ্চার কিছুই হয় নি। ওরা সুরক্ষিত ভাবে ঘুমোচ্ছে একটা ঘরে। সন্তানের প্রতি আপনাদের বিমুখভাব কাটানোর জন্য আমি এটা করতে বাধ্য হয়েছি।" এরপর পাশের ঘর থেকে একে একে সাতটি বাচ্চা এনে সিস্টার নীরজা তাদের মায়েদের কোলে তুলে দেন। বাচ্চাকে ফিরে পেয়ে তাদের কান্না থামে। প্রত্যেকে সন্তানকে বুকের মধ্যে আগলে রাখেন এবং মাতৃসুধা পান করান। সিস্টার নীরজা তার উদ্দেশ্যে সফল হন। তিনি সাতজন মায়ের উদ্দেশ্যে বলেন--- "সন্তানের চেয়ে মূল্যবান মায়ের কাছে এই পৃথিবীতে আর নেই। একটা সন্তানের দায়ে কত মা যে প্রাণ হারায়। ছেলে ও মেয়ের মধ্যে পার্থক্য না করে সবাইকে যোগ্য তৈরি করার দায়িত্ব বাবা-মার নিতে হবে। যারা খুশি নন তাদের বোঝাতে হবে, ছেলে-মেয়ের ভেদ করতে বারণ করতে হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়লে ছেলে-মেয়ের সমস্যা সমাজ থেকে অবশ্যই দূর হবে।"

সিস্টার নীরজার কথা শুনে সকল মায়ের মনের অবস্থার পরিবর্তন হয়। তারা সিস্টার নীরজাকে বলেন---"দিদি আমরা সকলে কথা দিলাম আজ থেকে আমরা কখনো ছেলে-মেয়ে ভেদাভেদ করবো না। যারা এই ভেদাভেদ করবেন তাদের বোঝাব যে নিজেরা মেয়ে হয়ে মেয়েদের কেন অবজ্ঞা করেন। "মায়েদের এই পরিবর্তন দেখে সিস্টার নীরজা খুব খুশি হন। সন্তান ও মায়েদের সম্পর্ককে একই সুতোয় বেঁধে দেন তিনি। তার সিস্টার জীবন এভাবেই অন্যকে সহযোগিতা করে সফল হয়ে ওঠে।





পরিবর্তন

ম ম তা  শ ঙ্ক র  সি ন হা (পা ল ধী)

                 প্রথম পর্ব 

রণিত সেন--- সেন ক্রিয়েশনার এক মাত্র উত্তরাধিকারী। রণিতের চেহারার মধ্যে একটা আভিজাত্যের ছাপ আছে--- প্রায় ৬ ফিট লম্বা, জীম করা চেহারা, দেখতেও বেশ ভালো, তার কাছে টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই। ও যানে শুধু জীবনটাকে উপভোগ করতে। বড় বড় গাড়ি করে ঘুরে বেড়ানো, রঙিন মেহেফিল বসানো, পার্টি, ক্লাব আর বন্ধু বান্ধব এই সব নিয়েই ওর দিন কাটে। আর রণিত সেন এর আরও একটা জিনিসের অভাব নেই তা হলো--- গার্ল ফ্রেন্ড। নিত্য নতুন প্রজাপতির মত তারা রণিতের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়।রণিতও বিষয়টা বেশ উপভোগ করে। ওই বড়লোকেদের ছেলেদের যা স্বভাব হয় আর কি।নিত্য নতুন চেঞ্জ হয় তার গার্লফ্রেন্ড। আজ একে ভালো লাগে তো কাল ওকে--- এই করেই চলে যায়।

এইভাবে বেশ চলছিলো। রণিত এখন এম, বি, এ করতে ব্যাস্ত। আসলে তার বাবা শ্রীমন্ত সেনের এত বড় ব্যাবসা তো ওকেই দেখতে হবে ভবিষ্যত।তা রণিতের চারিত্রিক বিষয়ে একটু দোষ থাকলেও কিন্তু পড়াশোনায় সে খারাপ নয়। তাই শুধু পয়সা বা চেহারার ঔজ্জ্বল্যে রণিত সেন কলেজে বিখ্যাত নয়। পড়াশোনার জন্যও ওর নাম আছে--- আর রণিতের প্রতি কলেজের সব মেয়েরা ফিদা হোক না কেনো  একমাত্র রূপাঞ্জনার ছাড়া।রূপাঞ্জনা খুব হার্ড ওয়ার্কিং মেয়ে, পড়াশোনায়ও বেশ ভালো আর  দেখতেও খুব মিষ্টি। রূপাঞ্জনা নিজের জীবনে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। চাকরী করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাবা কে সাহায্য করতে চায়। তাই নিজের পড়াশোনার বিষয়ে ও খুব মনোযোগী। প্রাণ মন ও পড়াশুনাটা করে তার সাথে ও ভালো ছবি আঁকে আর নাচ করে। অনেক ছেলেরাই ওকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বৃথা মনরথ হয়েছে। কিন্তু রূপাঞ্জনা নিজের জীবন নিয়ে খুব সিরিয়াস।

এবার আসি রণিত আর রূপাঞ্জনার সর্ম্পকের ব্যাপারে। রণিত আর রূপাঞ্জনার সম্পর্ক অনেকটা টম এন্ড জেরির মতো। দুজনেই দুজন'কে দু চোক্ষে একদম দেখতে পারে না।রণিত রূপাঞ্জনার নাম শুনলে খেপে যায় তো রূপাঞ্জনাও রণিতের নাম শুনলে মারতে আসে।

                  দ্বিতীয় পর্ব 

আগেই বলেছি রণিত সেন--- সেন ক্রিয়েশনার একমাত্র উত্তরাধিকারী, সৌম্য দৃষ্টিআকর্ষক এক যুবক। বাবা-মার আদরের সন্তান। বিখ্যাত ব্যবসায়ী শ্রীমন্ত সেনের পুত্র রণিত ছোটবেলা থেকেই বোডিং স্কুলে পড়াশুনা করেছে।তার বাবা-মার ছেলের জন্য সময় ছিলো না তাদের কর্মজগত, সোসাইটির ক্লাব, পার্টি, সোস্যাল ওয়ার্কিং আরও নানাবিধ কর্মকান্ডের ফলে। তাই একদম ছোটবেলা থেকে মানে প্রায় দুমাস বয়স থেকেই রণিত আয়া আন্টি তৃণার কাছে ছয় বছর বয়স পর্যন্ত মানুষ হয়েছে। আর তার মা-বাবা মেতে থেকেছেন তাদের সো কল্ড সোসাইটির আভিজাত্যে। রণিত যখন কলকাতা ছেড়ে পাহাড়ের বোডিং স্কুলে পড়াশুনা করতে যায় তখন তার বাবা-মার জন্য যত না কষ্ট হয়েছিল তার থেকে ঢের বেশী কষ্ট পেয়েছিলো তার আয়া আন্টি তৃণাকে ছেড়ে থাকার ভয়ে। কারণ তৃণা যে রণিতের হৃদয়ের অনেকখানি জুড়ে ছিলো। মা বলে সে নিজের মা সোমদত্তাকে যত না ভালোবাসত তার থেকে ঢের ভালোবাসতো তৃণা আন্টিকে। সে যাই হোক রণিতকে চলেই আসতে হয় বোডিং স্কুলে।

সম্প্রতি বছর চারেক হলো রণিত কলকাতার বাড়িতে চলে আসে এবং কলকাতার এক বিখ্যাত কলেজে সে এখন এম.বি.এ করছে। এর পাশাপাশি সে তার বাবার সাথে সেন ক্রিয়েশনার কাজকর্মও দেখাশুনা করলেন তার মধ্যে একটা ছন্নছাড়া ঔদ্ধত্যময় আচরণ থেকেই গেছে সে তার ছেলেবেলার মানসিকতা থেকেই হোক কিংবা পারিবারিক আভিজাত্য ও বাবা-মার পারস্পরিক সম্পর্ক প্রতিফলন থেকে।

কথা প্রসঙ্গে বলি--- রণিতের কলেজের রূপাঞ্জনা বলে মেয়েটি আসলে তৃণার মেয়ে। হ্যাঁ সেই তৃণা--- রণিতের আয়া আন্টি তৃণা।সে কথা অবশ্য এখনও পর্যন্ত রণিত জানে না।

হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম, 
রণিত আর রূপাঞ্জনার সম্পর্ক ঠিক যেনো টম আর জেরির মত।কিন্তু বিধাতা পুরুষ কখন যে কার ভাগ্যে কি লিখে দেন তা কেউই বলতে পারে না।তার ভাগ্যলিখন খন্ডায় কার সাধ্যি।

                  তৃতীয় পর্ব 

সকলে একসাথে সকালে ডায়নিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছে।ঝাঁ চকচকে ডায়নিংরুম সেন প্যালেসের। সারা বাড়িটা জুড়ে কেবলই আভিজাত্য আর আর্থের প্রাচুর্য। দেশি বিদেশি নানা শোপিস, ল্যাপসেড, দামিদামী সব আসবাবপত্রে, এমন কি বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ দিয়ে বাড়ি ও সেন গার্ডেন সুসজ্জিত। যেনো এক পারিজাত কানন। 

সকলে ব্রেকফাস্ট করছে--- শ্রীমন্ত সেন তার স্ত্রী সোমদত্তাকে বলেন--- কাল কাশি থেকে মা'য়ের গুরুদেবের আশ্রম থেকে মা ফোন করে ছিলেন।এখানে বলে রাখি রণিতের দাদু অমিতাভ সেন গত হওয়ার পর ছেলে শ্রীমন্ত ও বউমা সোমদত্তার ঔধত্যপূর্ণ আচারন আর একমাত্র আদরের নাতি রণিতকে বোডিং স্কুলে রেখে পড়াশুনা করানোর পক্ষপাতি ছিলেন না রণিতের ঠাকুমা নিলীমা সেন। তাই একরকম এই সকল অশান্তির থেকে মুক্তি পেতে তিনি কাশিতে তার গুরুদেবের আশ্রমে চলে যান। তবে ফোনে প্রায়ই নাতি সাথে তার কথা হয়। প্রিয় নাতি আবার কলকাতায় সেন প্যলেসে ফিরে এসেছে শুনে নিলীমাদেবীও ছেলেকে ফোন করে বলেন তিনিও খুব শীঘ্রই কাশি থেকে কলকাতার বাড়িতে ফিরছেন।

শাশুড়ীর মায়ের বাড়িতে ফিরে আসা, রণিতের ঠাকুমার কথা শোনা, বাড়ির কর্তী হিসাবে নিলীমাদেবীর কথা শোনা সবদিক চিন্তা করে ম্যডাম সোমদত্তা সেনের মেজাজ গেলো বিগড়ে। তিনি স্বামীর উপর চোটপাট শুরু করলেন--- বললেন আরে তুমি মা'কে বল রণিত দু একদিনের মধ্যেই বন্ধুদের সাথে কিছুদিনের জন্য ছুটি কাটাতে মরিশাস যাচ্ছে। অতএব যখন ঠাকুমার সাথে প্রিয় নাতিরই দেখে হবে না তখন অতদূর থেকে এই বৃদ্ধ বয়সে এতটা পথ বেকার জার্নি করে এসে খামোখা শারীরিক ও মানসিক কষ্ট পাওয়া। তার থেকে বরং, মা'কে বল রণিত বিদেশ থেকে ছুটি কাটিয়ে ফিরলে আমরা নয় রণিতকে নিয়ে ওনার সাথে দেখা করে আসব গুরুদেবের আশ্রমে গিয়ে।

শ্রীমন্ত সেন এবার গম্ভীর গলায় স্ত্রীকে বলেন--- সেটি হবার নয় সোম, কেনো সেটা করা যাবে না!আরে বাবা!! তুমি তো মা'য়ের এখানে আসার আসল কারণটাই জানো না? আসল কারণ আবার কি? কি লুকাচ্ছ শ্রীমন্ত, তুমি আমার কাছ থেকে? মাথা ঠান্ডা রাখো সোম, শোনো রণিতই মা'কে ফোন করে বলেছে, সে এখন থেকে কলকাতার কলেজে পড়াশুনা করবে এবং সে বর্তমানে এ বাড়িতেই আছে। এছাড়া আমাদের গুণোধর পুত্রটি তার ঠাম্মামকে আগামীকালকে কলকাতা আসার ফ্লাইটের টিকিটটিও কেটে পাঠিয়ে দিয়েছে ও বলেছে সে নিজে এয়ারপোর্টে যাবে ঠাম্মামকে আনতে।অতএব তোমার আমার কোনো কাল্পনিক কথাই এখানে ধোঁপে টিকবে না আমার মা জননীর কাছে।

                  চতুর্থ পর্ব 

আজ রবিবার, সকালবেলা ঠিক দশটা বাজে।কলিংবেল বেজে উঠল সেন প্যালেসের গেটে। গেট ম্যান দিনেশ একটা লম্বা স্যালুট ঠুকে বিশাল আকৃতির সেন প্যালেসের সুকারুকার্যমন্ডিত গেটে খুলে দিলো। রণিত আজ অনেক সকালে উঠেই ফ্রেস হয়ে নিজের সখের পশ গাড়িটি নিজেই ড্রাইভ করে সোজা এয়ারপোর্টে চলে গিয়েছিলো তার ঠাম্মামকে বাড়ি নিয়ে আসতে। আদরের নাতির সাথে গাড়ি থেকে নেমে নিলীমা সেন প্রবেশ করেলেন সেন প্যালেসের সুসজ্জিত ড্রয়িংরুমে। 

একটু শান্ত অথচ গম্ভীর কন্ঠে নিলীমাদেবী ছেলে শ্রীমন্তকে নাম ধরে ডাকতেই সকালের খবরের কাগজ পড়া বন্ধ করে মা'কে এসে প্রণাম করে মা'য়ের কুশল জিজ্ঞেস করতে করতে তাঁর হাত ধরে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসায়।মা, ছেলে ও নাতি মিলে গল্প শুরু করে। এর মধ্যেই জিম থেকে ফিরে ম্যাডাম সোমদত্তা সেন, তার শাশুড়ী মা'য়ের কাছে এসে তাঁর কুশল-মন্দ জিজ্ঞেস করা তো দুর, তাঁকে প্রণাম পর্যন্ত না করে সোজা নিজের বেডরুমে চলে গেলেন রান্নার মেয়ে মিতালীকে তার ঘরে ব্রেকফাস্ট আর ব্ল্যাক কফি পাঠাতে বলে। নিলীমাদেবী বউমার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখে ছেলে শ্রীমন্তকে কড়া গলায় বললেন--- "শ্রীমন্ত, বউমা এখনও বদলানো না"!!

সে যাই হোক, নাতির সাথে ঠাম্মার রসায়ণ বেশ ভালোই জমে উঠলো। রণিত তার মা'য়ের স্নেহের যে অভাব সব সময় অনুভব করত, তার ঠাম্মাম বাড়ি আসায় অনেকটাই কমে গেলো। 
 
একদিন সন্ধ্যাবেলা রণিতের বেডরুমের লাগোয়া বারান্দায় বসে, ঠাম্মা আর নাতি দুজনে মিলে গল্প করছে। বাইরে অনবরত বৃষ্টি হচ্ছে। শ্রীমন্তবাবু আর সোমদত্তা ম্যাডাম গিয়েছেন এক বন্ধুর বিবাহবার্ষিকীর পার্টিতে।অবশ্য রণিতের সেখানে যাওয়ার কথা ছিলো। অন্য দিন হলে নয় রণিত তার বাবা-মার সাথে পার্টিতে যেতে, আর সমবয়সীদের সাথে হইহুল্লোড় করে রঙিন মেহেফিলে মেতে নেশা করে পার্টির আমেজ উপভোগ করত। কিন্তু আজ রণিতের তার ঠাম্মামকে ছেড়ে পাটিতে যেতে ইচ্ছে হলো না। তাই রণিত পার্টিতে যায়নি।

তা বেশ, নিলীমাদেবী নাতিকে বললেন--- "দাদুভাই এবার তো পড়াশুনা শেষ করে বাবার সাথে সেন ক্রিয়েশানের ব্যবসার দায়িত্ব নিতে হবে"। আর তার সাথে এও বলেন--- একজন সুশিক্ষিত, নম্র-ভদ্র, রুচিশীলা মেয়েকে তার নাতবউ করে আনতে। রণিত মুচকি হাসলো।

এরপর কথায় কথায় রণিত তার কলজের সহপাঠীদের কথা বলার সময়, কথা প্রসঙ্গে রূপাঞ্জনার কথা বলল। নিলীমাদেবী নাতির মাথায় হাত রেখে বললেন--- দাদাভাই তোমার কথা শুনে আমি যা বুঝলাম--- তার থেকেই বলছি, মেয়েটি খুব সিরিয়াস ওর ক্যারিয়ারের বিষয়ে, এবং ও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাবা-মার দায়িত্ব নিতে চায়।সাহসী মেয়েই বলতে হবে।যেখানে  তোমার পিছনে এত মেয়ে পড়ে থাকে, সেখানে এই মেয়েটি তোমাকে একদম পাত্তা দেয় না।তার মানে--!!!! কি যে বলো ঠাম্মাম!!। হ্যাঁ রে দাদুভাই আমাকে মেয়েটার সাথে একবার পরিচয় করিয়ে দিবি? রণিত অবাক হয়ে বলে--- তুমি খেপেছো ঠাম্মাম! সেটা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। 

এরপর কেটে গেলো বেশ কয়েক মাস--- তারপর একদিন কলেজের থেকে বাড়ি ফিরে রণিত, তার ঠাম্মামকে জানালো--- কলেজের ফেস্ট উপলক্ষ্যে আগামী জানুয়ারী মাসে, কলজে তার সহপাঠীরা সকলে মিলে আয়োজন করছে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। যেখানে অনুষ্ঠিত হবে চিত্রঙ্গদা গীতিনাট্য। আর তাতে না কি অভিনয় করতে হবে--- অর্জুনের চরিত্রে রণিতকে আর তার বিপরীতে চিত্রাঙ্গদা আর কেউ নয় ঠাম্মাম!! ঠাম্মাম মুচকি হেসে বললেন--- কে নাতবউ! রণিত বিরক্ত হয়ে বলল কি যে বলল না তুমি ঠাম্মাম---
        
                  পঞ্চম পর্ব

রণিতের কলেজের ফেস্ট উপলক্ষ্যে চিত্রঙ্গদা গীতিনাট্য অনুষ্ঠিত হবে আগামী জানুয়ারী মাসে কলেজেরই নিজস্ব অডিটোরিয়ামে। প্রতিদিন তাই রিহার্সালের মধ্য দিয়ে চলছে তারই প্রস্তুতি পর্ব। রণিতকে যদিও বা রিহার্সালের জন্য বন্ধুরা রাজি করাতে পেরে ছিলো চট করে কিন্তু রূপাঞ্জনাকে রণিতের সাথে রিহার্সালের জন্য রাজি করাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় ওর বন্ধুদের। রূপাঞ্জনা শর্ত দেয়ে রণিত সেন যেন রিহার্সালের সময় ছাড়া অন্য কোন সময় তার ধারে কাছে আসার কোনো রকম চেষ্টা না করে। ঐ রিহার্সালের সময় যা কথোপকথন ওই টুকই ব্যস!তাতেই সকলে রাজি হয়ে যায় ওদের দুজনকে দিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার।

পৌষমাসের মাঝামাঝি সময়, মানে বড়দিনের ছুটির শেষে সবে দুদিন হলো রণিতের কলেজ খুলেছে। চলছে ফাইনাল রিহার্সাল। শীতকাল শহরে বেশ জমিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। আর মাত্র চার/পাঁচ দিন বাদেই ওদের কলেজের ফেস্ট, তাই জোর কদমে চলছে ফাইনাল রিহার্সাল।আজ একটু দেরি করেই রিহার্সাল শেষ হলো ওদের--- প্রায় আটটা বেজে গেলো রূপাঞ্জনার--- রিহার্সাল শেষে কলেজ থেকে বার হতে। শহরের যে প্রান্তে ওদের কলেজ সেখানে সাধারণত সন্ধ্যা সাতটার পর প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া তেমন কিছু সাধারণ যানবাহনের দেখা খুব একটা পাওয়া যায় না। যদিও বা দু একটা অটো ও টোটো চলছে তারা কেউ রূপাঞ্জনার বাড়ির রাস্তা, মানে সিঁথির মোড় পর্যন্ত এত রাতে যেতে রাজি হচ্ছে না ।যাও বা একটা টোটো যাবে বলল--- তাও সে আবার ঠান্ডা আর এত রাতের দোহাই দিয়ে এবং খালি টোটো নিয়ে ফেরার নানা কথা বলে পাঁচশ টাকা ভাড়া চাইলো রূপাঞ্জনার কাছে। ওর কাছে স্বাভাবিক ভাবেই এতগুলি টাকা ছিলো না। তাই ও বাড়ি ফেরার জন্য কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে আর কিছুটা অটো বা টোটা করে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলো। যেমন ভাবা তেমন কাজ। রূপাঞ্জনা সাহসী মেয়ে, তবুও যেনো আজ ওর এই শীতের রাতে একা একা, প্রায় ফাঁকা এই রাস্তা দিয়ে, যদিও রাস্তায় নিয়ন আলোর দৈত্যাকার ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলি জ্বলছে, তবুও ওর কেমন একটা ভয় ভয় করতে লাগলো। ওর পাশ দিয়ে একটা হুডখোলা জিপগাড়ি স্বশব্দে তীব্র হর্ণ দিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। তা দেখে রূপাঞ্জনা আরো দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে গাড়িটি অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে গিয়েই বাঁধা প্রাপ্ত হলো। তার যাওয়ার রাস্তা অবরোধ করে গাড়ি থেকে নেমে এলো জনাচারেক মদ্যপ বেল্লিক যুবক।তারা রূপাঞ্জনার চরিত্র  হননের চেষ্টা করতে উদ্যত হলে রূপাঞ্জনা প্রাণপণ ঐ শীতের রাতে ঐ হাইওয়ে দিয়ে ছুটতে লাগলো।

আজ রণিতেরও দেরি হলো কলেজ থেকে বার হতে।রিহার্সালের শেষে বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দিয়ে রণিত কলেজ থেকে বার হলো। এখানে বলি রাখি--- কলকাতার এই এম.বি.এ কলেজে রণিতের একজন খুব ভালো বন্ধু ছিলো--- অভি। সেদিন কলেজ থেকে বার হওয়ার সময় রণিত, অভিকে বলল আজ তুই আমার সাথে আমার বাড়িতে চল, রাতে তুই আমার বাড়িতেই থাকবি'খন আজ।আমি ফোন করে আন্টি আর আঙ্কেলকে জানিয়ে দেবো যে কলেজের রিহার্সাল শেষ হতে আজ রাত হয়েগেছে বলে তোকে আমি আমার সাথে আমার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি--- কাল একবারে কলজে করে তুই বাড়ি ফিরবি। অভি তাতে সায় দিলো, রণিতও অভির বাড়িতে ফোন করে আজ রাতে রণিতের বাড়িতে অভির থাকাটা কনফার্ম করে ফেলল।

রণিত কলেজে তার প্রিয় পশ গাড়িটি নিয়েই যাতায়াত করে। সে নিজেই ড্রাইভ করে। দুই বন্ধু গাড়ি নিয়ে হাইওয়ে দিয়ে ফিরছে। অভি রণিতকে বলল--- ভাই আজ ঠান্ডা বেশ পড়েছে, সাথে আবার দেখছি কুয়াশাও পড়তে শুরু করেছে রাত বাড়ছে বলে; তার থেকে বড় কথা এই দিকটা শহরের থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় ঠান্ডাটাও যেন একটু বেশী, রাস্তাটাও ফাঁকা, ফাঁকা। 

অভি একটু মজার স্বভাবের, হাসিখুশি ছেলে। সে রণিতকে বলল--- হ্যাঁ রে তুই আর রূপাঞ্জনা ম্যাডাম তো একটু সক্ষ্যতা করে নিলেই মিটে যায়।তা নয় সব সময় টম এন্ড জেরির মত বিবাদ করেই চলেছিস। এই সখ্যতাটুকু থাকলে আজ এতটা রাতে ম্যাডাম তোর সাথে তোর গাড়ি করে ওর বাড়ি ফিরতে পারতো। তোর পাশের সিটে আমি নয় বসতো রূপাঞ্জনা ম্যাডাম, বলেই অভি হো, হো করে হেসে উঠল। রণিত গাড়ি থামিয়ে বলল--- এই আর একটাও বাজে কথা বলবি তো তোকে আমি এই রাতে এই নির্জন রাস্তায় একা ফেলে গাড়ি নিয়ে বাড়ি চলে যাবো।তারপর তুই একা একা বাড়ি ফিরিস কি করে আমিও দেখবো!! অভি, রণিতকে বলল--- খামোকা চটো কেনো বন্ধু!! কুল, কুল, বি কুল এ ম্যান।আমি তো তোর সাথে একটু মশকরা করছিলাম ভাই।চল চল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে অনেক রাত হয়ে গেছে।

ওরা রওনা হলো--- আর ওদিকে ঐ পাশবিক শয়তানগুলোর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রূপাঞ্জনা সেই হাইওয়ে দিয়ে প্রাণপণ ছুটছে----
        
                  ষষ্ঠ পর্ব 

রণিত আর অভি গাড়ি নিয়ে হাইওয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরছে। গাড়ির হেড লাইটের আলোয় রণিত ও অভি দুজনেই দেখলো প্রায় জনা চার-পাঁচেক ছেলে একটি মেয়ের পিছনে ধাওয়া করছে। রণিতকে অভি বলল--- ভাই কি ব্যাপার বল তো?রণিত বলল- কিছুই তো বুঝতে পারছিনা ঠিক করে!! ঐ মেয়েটাই বা কে? আর ছেলেগুলো কেনো ওর পিছনে ধাওয়া করেছে? আশেপাশে তো কোনো বাড়ি ঘরও তো নেই!! নেই পুলিশি পাহাড়া!!! অভি বলল--- চল রণিত নেমে গিয়ে দেখি কি ব্যাপার!রণিত অভিকে থামিয়ে বলল--- না এখনই গাড়ি থেকে আমাদের নামাটা ঠিক হবে না; চল ওদের পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গিয়ে দেখি মেয়েটা কে? আর এটাও বোঝা যাবে মেয়েটাকে কেনোই বা ওরা ধাওয়া করছে?
          
যেমন ভাবা তেমন কাজ। অভি চিৎকার করে বলে উঠলো--- আরে গাড়িটা থামা রণিত, এ যে রূপাঞ্জনা। রণিত বলল কি করবো বল অভি! ও তো আমাকে একদম সহ্য করতে পারে না। অবশ্য আমিও যে ওকে সহ্য করতে পারি তা কিন্তু নয়।তবুও বন্ধু হিসাবে এই রকম একটা পরিস্থিতিতে ওর পাশে দাঁড়ানোটা দারকার। কিন্তু!!! আর কোনো কিন্তু নয় বস; চল রণিত রূপাঞ্জনাকে আমাদের হেল্প করতেই হবে, চল চল, তাড়াতাড়ি নাম গাড়ি থেকে।

রণিত বেশ হিরোইজিম ভাবেই ঐ বাজে, দুষ্ট, ছেলেগুলোর হাত থেকে রূপাঞ্জনাকে রক্ষা করলো এবং ঐ রাস্তা দিয়ে দৈবক্রমে রাতের পেট্রোলিং করা পুলিশের জিপ পাশ করার সময় এই ঘটনা দেখে সেখানে থামে ও ডিউটিরত পুলিশ অফিসার ওদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে বেয়াদপ ছেলেগুলোকে গ্রেফতার করে। 

রণিত রূপাঞ্জনাকে ওর বাড়িতে ছেড়ে দিতে চাইলে প্রথমে আপত্তি করলেও অভি ওকে বোঝায় এ জায়গাটা মোটেই ওর পক্ষে সেভ নয়, এতরাতে ও আর বাড়ি ফেরার জন্য তেমন কোনো যানবাহনের দেখা পাবে না। তার থেকে রণিতের গাড়ি করে আজ রূপাঞ্জনাকে ওরা ওর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

ওদিকে মেয়ের বাড়ি ফিরতে এত রাত হচ্ছে দেখে রূপাঞ্জনার বাবা দীনেশবাবু ও মা তৃণার বেশ চিন্তা হতে লাগলো। দীনেশবাবু পায়চারী করে কেবলই ঘরবার করতে লাগলেন। তৃণা মেয়েকে ফোন করলে কেবলই বলছে সুইচ অফ। ভয়ে ওদের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। অগত্যা তৃণা, মেয়ে রূপাঞ্জনার সকল পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের ফোন করেও রূপাঞ্জনার কোনো খোঁজ পেলো না, তখন রূপাঞ্জনার বাবাকে থানায় যেতে বললেন মেয়ের খোঁজের জন্য। 
      
                  সপ্তম পর্ব

রূপাঞ্জনার বাবা স্ত্রী তৃণার কথায় যখন হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চৌরাস্তার কাছাকাছি প্রায় এসে পড়েছেন--- ঠিক সেই সময় একটি পশ গাড়ি তার সামনে এসে দাঁড়ালো। গাড়ির দরজা খুলে একটি মেয়ে নেমে এলো। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দীনেশবাবু মেয়েকে দেখে চিৎকার করে বলে উঠলেন রূপা'মা এতক্ষণ তুই কোথায় ছিলি। আমি আর তোর মা তোর জন্য চিন্তা করে অস্থির হয়ে উঠেছি। আর এখন যাচ্ছিলাম থানায় তোর খোঁজ করার জন্য পুলিশের কাছে।তোর ফোনটাও তো সুইচঅফ বলেছিলো। কি হয়েছে মা খুলে বল আমাকে।

গাড়ি থেকে এবার অভি ও রণিত নেমে এসে বলল--- প্লিজ কাকু ওকে এখন এত কিছু প্রশ্ন করবেন না।ও এখন একটা ট্রমার মধ্যে আছে। আসতে আসতে ট্রমাটা কেটে গেলে রূপাঞ্জনা একটু স্বাভাবিক হলে তারপর ওর কাছে যা জানার আছে ধীরে ধীরে জেনে নেবেন। দীনেশবাবু ছেলে দুটির কাছে জানতে চাইলো তোমরা কারা? অভি বলল--- আমি অভি ও রণিত।আমরা রূপাঞ্জনার কলেজের সহপাঠী।কাকু আপনাকে এইটুকুই বলতে পারি আজ রণিত না থাকলে রূপাঞ্জনাকে বাঁচানো যেতো না। রণিত অভিকে থামতে বলে--- রূপাঞ্জনার বাবা নমস্কার জানিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো।

রূপাঞ্জনা চৌরাস্তার থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটি কথাও বলল না তার বাবার সাথে। যেনো সে বোধীর হয়ে গেছে।রূপাঞ্জনাকে দেখে তৃণা, তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। আর জানতে চাইলো সে এতক্ষণ কোথায় ছিলো? কোনো বিপদ ঘটে ছিলো কিনা রাস্তায়? সেইসব কথা।দীনেশবাবু স্ত্রীকে ইশারা করে চুপ করতে বললেন। রূপাঞ্জনাকে তিনি ঘরে গিয়ে ফ্রেস হয়ে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়তে বললেন। 

স্ত্রী তৃণাকে দীনেশবাবু রূপাঞ্জনার কলেজের দুই সহপাঠীর কথা জানালেন এবং এও জানালেন যে ঐ ছেলে দুটিই তাদের মেয়েকে উদ্ধার করে সাবধানে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে আজ। তৃণা স্বামীর কাছে ওদের নাম জানতে চাইলে--- দীনেশবাবু বলেন--- একজনের নাম অভি আর একজন রণিত। তৃণাকে দীনেশবাবু বললেন রূপাঞ্জনাকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করো না তৃণা ও একটু স্বাভাবিক হলে দেখবে নিজে থেকেই সব ঘটনা খুলে বলবে আমাদের। তবে এটুকু নিশ্চিত যে আমাদের মেয়ে ঐ ছেলে দুটির জন্যই আজ কোনো বড়সড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে।

পরে দু একদিনের মধ্যে রূপাঞ্জনা একটু স্বাভাবিক হলে মা'কে সেদিন রাতে যা যা ঘটেছিল তা আদ্যপান্ত জানালো।তৃণা মেয়েকে বলল তুই আর রণিতের সাথে কোনো ঝগড়া করিস না মা। ওর সাথে বন্ধুত্ব করে নে।ওরা ছিলো বলেই কিন্তু তুই ঐ শয়তানগুলোর থেকে রক্ষা পেলি।ওরা ভালো ছেলে না হলে এইভাবে তোকে বিপদ থেকে রক্ষা করতো না। শোন রূপা একদিন ওদের আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসিস। ওদের একটু যত্নআত্তি করা উচিত। অন্তত একটু ভালো মন্দ কিছু রান্না করে নয় খাওয়াবোক্ষণ ওদের।কি বলিস!

রূপাঞ্জনা মা'কে বলল--- মা রণিত যে সে বাড়ির ছেলে নয়।যে তুমি বলবে আর ও অমনি আমাদের মত এই রকম একজন সামান্য মধ্যবিত্ত মানুষদের বাড়ি তোমার হাতের রান্না করা খাবার খেতে মানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে চলে আসবে!! 

কেনো রে রূপা? ও কোন বাড়ির ছেলে, যে তুই এত ভনিতা করে কথা বলছিস? মা ও আমাদের শহরের বিখ্যাত ব্যবসায়ী শ্রীমন্ত সেনের পুত্র ও সেন ক্রিয়েশানের উত্তরাধিকারী বিখ্যাত এলিজিবেল ব্যাচেলর, যার নাম হাজার হাজার মেয়ে ক্রাস খায় সেই রণিত সেন-মা সেই রণিত সেন। তৃণা রণিত সেন নামটা শুনে একটু যেনো চকিত হলো মূহুর্তের জন্য। তারপর স্বাভাবিক ভাবে ঠান্ডা গলায় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল--- দেখিস তুই ওকে আমাদের বাড়ি নিমন্ত্রণ করলে ও ঠিকই আসবে। রূপাঞ্জনা মা'কে বলল--- এত কনফিডেন্সলি কি করে বলছো মা--- যে রণিত সেন এ বাড়িতে আসবে। ও তুই বুঝবি না রূপা। মা'য়ের মন কখনোই মিথ্যা ভাবে না আর বলেও না। তুই মিলিয়ে নিস আমার কথা। রণিত ঠিকই আসবে আমাদের বাড়িতে। আর ঐ অভিকেও যেনো নিমন্ত্রণ করতে ভুলিস না রূপা।ওদের নিমন্ত্রণ করে বলে দিস আগামী রবিবার দুপুরে আমাদের বাড়িতে আসার জন্য। 

                  অষ্টম পর্ব

রূপাঞ্জনা কলেজে গিয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলো যে সে রাতের তার জীবনের সেই অভিজ্ঞতার কথা কেউ তেমনভাবে কিছুই জানতে পারেনি। রূপাঞ্জনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশ্চিত মনে বেঞ্চিতে বসলো। তখন ওকে রাই, মানে রূপাঞ্জনার বেষ্টফ্রেন্ড আর রণিতের বেষ্টফ্রেন্ড অভির বিশিষ্ট বান্ধবী বলল রূপাঞ্জনা ক্যানটিনে চল,তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। রূপাঞ্জনা বলল এখানেই বলল না রাই। রাই বলল এখানে বলা গেলে তো আর তোকে আলাদা করে ক্যানটিনে যেতে বলতাম নারে। রূপাঞ্জনা আর রাই ক্যান্টিনে এসে হাজির হলে, রাই একটা নিভৃত টেবিল বেছে নিয়ে রূপাঞ্জনাকে বসতে বলে রমেশদাকে--- মানে ওদের ক্যান্টিনের মালিকে দুকাপ কফি পাঠিয়ে দিতে বলল। রূপাঞ্জনাকে রাই বলে--- আমি সে রাতের সব ঘটনা জানিরে রূপা। তুই নিশ্চিন্তে থাক কোনো দিনও সে রাতের কথা কেউ জানতে পারবে না আমার থেকে, আমি তোকে এই কথা দিলাম। রূপাঞ্জনা বুঝতে বাকি রইল না রাইকে কে এসব কথা কে বলেছে। রাই এবার রূপাঞ্জনাকে বলল তুই আর খামোকা রণিতের উপর রাগ করে থাকিস না। রণিত যদি ভালো ছেলে না হতো তাহলে তোর অসহায়তার সুযোগ সে রাতে ওতো নিতে পারতো। কিন্তু ও তা করেনি। বরং তোকে সম্মানের সাথে তোর বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলো।

রূপাঞ্জনা এবার বলল, রাই আমার মা'ও সেকথা আমাকে বলেছে।আর মা এও বলেছে--- কি রে আন্টি আর কি বলেছে তোকে? মা বলেছে আগামী রবিবার রণিত আর অভিকে আমাদের বাড়িতে দুপুরের মধ্যহ্নভোজের জন্য নিমন্ত্রণ করার জন্য। রাই এবার রূপাঞ্জনারকে বলল--- তাহলে চল।রূপাঞ্জনা--- কোথায় যাবো রাই।আরে চলনা। রূপাঞ্জনাকে নিয়ে রাই কলেজের অডিটোরিয়ামে যায়--- যেখানে রণিতরা চিত্রাঙ্গদা নাটকের ফাইনাল রিহার্সালের শেষ প্রস্তুতির বন্দোবস্ত করছিলো।অভি ও রণিতকে রাই গ্রীনরুমে ডেকে নিয়ে গেলো। রণিত আর অভি রূপাঞ্জনাকে সেখানে দেখে একটু চমকে গিয়ে বলল--- তুমি এখানে।রাই বলল--- রূপাঞ্জনা এখানে এসেছে তোদের ওর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে। কিন্তু কেন রে রাই? অভি তুই চুপ কর।রূপাঞ্জনা রণিত ও অভিকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলো ওর সম্মান রক্ষার জন্য আর রবিবার মধ্যহ্নভোজের জন্য নিমন্ত্রণ করলো। রাই তুইও কিন্তু নিমন্ত্রণ ঐ দিন। এসব কথা বলে সেদিন ফাইল রিহার্সালের পর্ব সমাধা করে ওরা যে যার বাড়ি ফিরে গেলো।

যথা সময়ে অর্থাত রবিবার দুপুরে রণিত, অভি আর রাই আসলো নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে রূপাঞ্জনার বাড়িতে। রূপাঞ্জনা ওদের অভর্থনা করে ওর ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো। এবার বাবা-মার সাথে ওর বন্ধুদের পরিচয় করার জন্য রূপাঞ্জনা বাড়ির ভিতর গিয়ে বাবা-মাকে ওর ঘরে ডেকে নিয়ে এলো।রণিত, অভি ও রাই ওরা রূপাঞ্জনার বাবা-মাকে প্রণাম করতে গেলে দীনেশবাবু ও তৃণাদেবী বললেন এসবের কোনো দরকার নেই তোমাদের সবাইকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করি--- সকলে মানুষের মত মানুষ হও।

রণিত যেন তৃণাদেবীকে কি যেন একটা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। তৃণাদেবী সে কথা বুঝতে পেরে রণিতকে বললেন--- কি গো রণিতবাবু তুমি কি আমায় চিনতে পারছো? সকলে যেন বিস্মিত হয়ে গেলো রূপাঞ্জনার মা'য়ের এই কথায়।রূপাঞ্জনার মা'য়ের কাছে সকলের সামনে এর কারণ জানতে চাইলে--- তৃণাদেবী যা বললেন--- তাহলো রণিতের তিনি তৃণাআন্টি--- যে কিনা রণিতকে দীর্ঘ পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত গভর্নেস হয়ে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলেন--- রণিত বোর্ডিং স্কুলে পড়তে যাওয়া পর্যন্ত। রণিত তাকে নিজের মা'য়ের মত ভালোবাসাতো আর তৃণাদেবীও তাকে নিজের সন্তান রূপাঞ্জনার মতই স্নেহ, ভালোবাসা ও আদর দিতেন। ছোটবেলায় রণিত রূপাঞ্জনার মাঝে মধ্যে দেখা হয়েছে কিন্তু মিসেস সেন সেটা ভালোভাবে মেনে নিতে পারতেন না--- যেহেতু রূপাঞ্জনা তৃণার মত একজন গভর্নেসর মেয়ে আর ওরা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার বিলং করে তাই। এই অসম বন্ধুত্ব মানতে তিনি একদম নারাজ ছিলেন। তাই কর্তার সাথে তড়িঘড়ি পরামর্শ করে তিনি এতটুকু ছোট্ট ছেলেটাকে বোডিং স্কুলে পাঠিয়ে ছিলেন।

রণিত এবার বুঝতে পারলো সে সত্যিই ঠিক চিনতে পেরেছে আর শুধু কেনো এত বছর পর তার তৃণাআন্টিও রণিতকে ঠিক চিনতে পেরেছেন। 

                  নবম পর্ব

কলেজের ফেস্ট উপলক্ষ্যে আয়োজিত গীতিনাট্য চিত্রাঙ্গদা মঞ্চস্থ হলো যথা সময়ে।এরপর থেকে রূপাঞ্জনা ও রণিতের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠলো। রণিত বাড়িতে এই সম্পর্কের কথা ও রূপাঞ্জনার পরিবারের সকল বিষয় তার ঠাম্মাম নিলীমাদেবীকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলো। রণিতের পচ্ছন্দের মনের মানুষটিকে নিলীমাদেবীরও বেশ পচ্ছন্দ হয়।তিনি আদরের নাতিকে বলেন--- দাদুভাই তুই এতদিনে আমার মনের মতো একটা কাজ করেছিস। রূপাঞ্জনা খুব ভালো, শক্ত ধাতের অথচ দৃঢ়চেতা, ব্যক্তিত্বময়ী একটি মেয়ে। এ বাড়ির উপযুক্ত বৌ হবে ও, দেখিস।

রূপাঞ্জনার সান্নিধ্য এসে রণিত অনেকখানি বদলে গেলো। তার সেই বাউন্ডুলে জীবন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘনঘন পার্টি করা, সর্বোপরি যে সকল মেয়েরা এক সময় রণিত বলতে ক্রাস খেতো তারাও ওর থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো।ঈশ্বর হয় তো যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।এরপর রণিত, অভি,রূপাঞ্জনা ও রাই সকলে ভালো রেজাল্ট করে কলজ পাশ করলো। রণিত তাদের পৈত্রিক ব্যবসায় যোগ দিল বাবা শ্রীমন্ত সেনের সাথে।সোমদত্তা স্বামীকে এবার জানালেন তাঁর বান্ধবী মধুরীমার মেয়ে লিজার সাথে অতি সত্তর তিনি তার ছেলের বিয়ে দিতে চান।শ্রীমন্তবাবু এর কারণ জানতে চাইলে--- সোমদত্তা স্বামীকে জানান--- বর্তমানে তাদের ছেলে যে মেয়েটির সাথে মেলামেশা করছে- সে একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ মেয়ে, যার মা তৃণা রায়, যে কিনা এক সময় তাদের ছেলে রণিতের গভার্নেসের কাজ করত ও মেয়েটির বাবার একটি ছোট বইয়ের দোকান আছে কলেজস্ট্রিটে। আর বর্তমানে যদিও মেয়েটি নিজ দক্ষতায় একটি মাল্টিনেশ্যালান কোম্পানিতে চাকরি করছে।শ্রীমন্তবাবুকে সোমদত্তাদেবী এও জানালেন তোমার মা'ও তোমার ছেলে আর ঐ মেয়েটির সম্পর্কের ব্যপারে সব কিছুই জানেন। শ্রীমন্ত সেন এবার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন এত খবর তুমি পেলে কার কাছ থেকে।আরে আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে মালতি তো ঐ পাড়াতেই থাকে ও নাকি মেয়েটির কি যেনো নাম--- ও হ্যাঁ রূপাঞ্জনা, ওদের বাড়িতে রণিতকে যেতে দেখেছে এবং তোমার মায়ের সাথে রণিতের এই সব বিষয়ে কথা বলতেও শুনেছে সে।

রণিতকে ওর বাবা-মা লিজাকে বিয়ের কথা বললেন। রণিত সব শুনে একটাই উত্তর দিলো--- জীবনে যদি বিয়ে করতেই হয় তবে রূপাঞ্জনা ছাড়া দ্বিতীয় আর কাউকেই নয়।ওর জন্য আজ এই রণিত সেনকে তোমারা দেখতে পাচ্ছো। আমার এই পরিবর্তন একমাত্র ওর জন্যই সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সোমদত্তাদেবী বাঁক ধরলেন লিজার সাথে ছেলের বিয়ে দেওয়ার জন্য---।

রণিত সেই রাতেই অভি, রাই ও আরও দুচারজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে কালীঘাটের মন্দিরেই ওদের বিয়েটা সারলো এবং রূপাঞ্জনাকে নিয়ে বাড়ি গিয়ে বাবা-মার ও ঠাম্মামের সামনে হাজির হলো।সোমদত্তা কিছুতেই রাজি নয় রূপাঞ্জনাকে পুত্রবধূ বলে মানতে। এবার নিলীমাদবী প্রতিবাদী কন্ঠে ছেলে শ্রীমন্ত ও বৌমা সোমদত্তাকে রূপাঞ্জনাকে বরণ করতে বলেন। সোমদত্তা প্রায় অগত্যাই ছেলের পচ্ছন্দ করা পাত্রীকে বরণ করে সেন প্যালেসে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। পর দিন শ্রীমন্ত সেন অফিস থেকে ফোন করে স্ত্রী ও মা দুজনকেই জানালেন যে মিত্তাল দের সাথে তাদের যে পাঁচ কোটি টাকার ব্যবসায়ীক ডিলটা প্রায় হাত ছাড়া হতে বসে ছিলো সেই ডিলটাই আজ দিল্লি থেকে মিত্তাল গ্রুপের কর্ণধার ডি.কে.মিত্তাল ফোন করে অফিসে ফ্যাক্স করে কনফার্ম করেছেন।

এবার নিলীমাদেবী শান্ত চোখে সোমদত্তার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন আর রণিত সেই সময় অফিস যাবে বলে ব্রেকফাস্ট করছিলো--টেবিল থেকে উঠে এসে মা'কে বলল--- দেখেছো তো মা রূপাঞ্জনা আমাদের জন্য কতটা লাকি, এবার বুঝতে পারছো তো আমার কথা--- আমি বলেছিলাম না তোমাদের আজ আমার যা পরিবর্তন তা কেবল ঐ মেয়েটার জন্যই সম্ভব হয়েছে মা। সোমদত্তা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন।বুকে জড়িয়ে ধরলেন রণিত আর রূপাঞ্জনাকে।




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

চতুর্থ বর্ষ || দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল ও বাসন্তী সংখ্যা || ৯ চৈত্র ১৪৩১ || ২৩ মার্চ ২০২৫

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪