সাহিত্য সমালোচনা
পুস্তক আলোচনা : দহন : সুজাতা মিথিলা
[সমিধ
মুর্শিদাবাদ জেলা বইমেলা ২০২০
৫০/-]
আলোচক :
নি র্ম লে ন্দু কু ণ্ডু
কবিতা, এক নিরুচ্চার আবেগের নাম। আমার কাছে কবিতা এক অন্তর্লীন প্রবাহ, যাতে আমি অবগাহন করি চুপি চুপি। কখনো হই আনন্দে আত্মহারা, কখনো বিষাদঘন, কখনো বা প্রতিবাদী। কবি সুজাতা মিথিলার প্রথম কবিতার বই 'দহন' আমার সেই তিন আবেগকেই প্রশ্রয় দিল।
কবিতার বইয়ের নামকরণের একটা খুব চেনা গত আছে। সংশ্লিষ্ট নামের কোন কবিতা সেই বইয়ে থাকবে। কিন্তু 'দহন' তার ব্যতিক্রম। এর কবিতাগুলি কবিমনের অন্তর্লীন দহনের বহিঃপ্রকাশ। কবিতাগুলি জুড়ে সেই দগ্ধ অনুভবের ছোঁয়া। ভালোবাসা শব্দটা হয়তো কবির কাছে ফিকে হয়ে এসেছে, হয়তো জাগতিক বা সাংসারিক পারিপার্শ্বিকতা ভালোবাসাকে করে তুলেছে দূর নক্ষত্রপুঞ্জের বাসিন্দা। তাই কবি বলে ওঠেন- "যত বার ভালোভালো বলো- ঠিক ততবারই খটকা লাগে, দ্বন্দ্বে ভুগি।" (শব্দবিধি); কবি দেখেছেন, প্রেম যেন বড়ই ভঙ্গুর, তাই তিনি বলে ওঠেন- "শরীর মুখস্থ হলেই পাখি ঠিকানা বদলায়... প্রেম সব পলকা শারীরিক ঠিকানায়।" (বিসর্জন); কবি জানেন, এ জগতে সময়ের থেকে করাল কেউ নেই। তাই তিনি বলে ওঠেন- "সময় বড়ো অদ্ভুত প্রশাসক।" (সময়); সেই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বদলাই আমরা, আমাদের চরিত্র ও নীতিবোধ। এই বদলের আহ্বান শুনি কবির কণ্ঠে- "নীতি বদলায়, বদল আসে আমার আমিতে, বদল ঘটে তোমার তুমিতে।" (মেহের আলি একা হেঁটে যায়); কবি একজন নারী, একজন মা ৷ আর সেই মাতৃত্বের প্রতিটা কণাই তিনি উপভোগ করেন, তার কাছে আর সব কিছুই হয়ে পড়ে তুচ্ছ। তাই তিনি বলতে পারেন- "এখনও ঢের দায়িত্ব বাকি- মা-পাখিদের অনেক কাজ। ছোট্ট ছানাটার ডানাটা পুষ্ট করতে হবে সততা, সাহস ও প্রত্যয়ের পুষ্টিগুণে৷" (এক অন্য অনাক্রমতা);
তাহলে কি কবি আশাবাদী নন, ভালোবাসার প্রতি কি তাঁর কোন বিশ্বাস নেই? উত্তর খুঁজতে বসলে দেখি, কবি ভালোবাসার যেন সংজ্ঞা নিরূপিত করেছে- "ভালোবাসা মানে... দূরে থেকেও ভীষণ কাছে, শূন্যতায় এক অনুভবী পূর্ণতা।" (নিরীক্ষণ); কিংবা "ভালোবাসা এক বিভূতি, অন্তরের বৈভব।" (অনাদি); কবি দৃঢ় প্রত্যয়ী, তাঁর কাছে পারস্পরিক বিশ্বাস অনেক বেশি দামি ৷ তাই তিনি বলে ওঠেন— "বিশ্বাস মরে গেলে মন সাদা থান পরে।" (বৈধব্য);
এভাবেই কবি সুজাতা মিথিলার কবিতাগুলি হালকা আঁচে দগ্ধ করে চলে পাঠক-হৃদয় ৷ তাঁর জীবনবোধ, তাঁর মাতৃত্ব, তাঁর পারিপার্শ্বিকতা ছুঁয়ে যায় পাঠককে। দু'য়েকটি বানানগত ত্রুটি ব্যতিরেকে ছিমছাম ছোট্ট এই বইটি পাঠকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সমিধ-কেও জানাই আন্তরিক অভিবাদন।
একটি মনোযোগী অধ্যয়ন..."চকাচকী"
গী ত শ্রী সি ন হা
কোথাও পড়েছিলাম, সতীনাথ ভাদুড়ী ছিলেন লেখকদের লেখক। আমি নিজেও এমনটিই মনে করি। আজ আর ঠিক মনে পড়ছে না, একটু-আধটু সাহিত্য চর্চার শুরুতেই, কাছের মানুষরা বলেছিলেন, কমল কুমার মজুমদার, সতীনাথ ভাদুড়ী, জগদীশ গুপ্ত, অমিয় ভূষণ মজুমদার খুব মন দিয়ে পড়তে। পড়েছি, আর মনে হয়েছে, এঁরা সকলেই লেখকের লেখক। হ্যাঁ, বলা বাহুল্য তারও আগে আমার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, সবটা নাহলেও খানিকটা পড়া হয়ে গেছে। কিন্তু উপরিউক্ত চার লেখকের লেখা যখনই পড়েছি, এঁদের স্বকীয়তা, রচনাশৈলি আমাকে বারবার নতুনভাবে চিন্তামগ্ন করেছে। তাই আজ যখন এরকম একটি লেখার কথা ভাবনায় আসে... সতীনাথ ভাদুড়ীর "চকাচকী" গল্পের নিবিষ্ট পাঠের মর্ম উদঘাটন করতে চেষ্টা করছি। হয়তো-বা আমার ধৃষ্টতা, তবুও ইচ্ছে জাগে নিজের মতো করে চেষ্টা করতে। "চকাচকী" প্রকাশিত হয়েছিল দেশ (১৫ই শ্রাবণ, ১৩৬১) পত্রিকায়। অর্থাৎ ঐ সময়ের লেখা। ঐ সময়টাতে ছিল বাংলা কথাসাহিত্যের উজ্জ্বল দীপ্ত নক্ষত্রদের সহবস্থান। কল্লোল- কালিলকম গোষ্ঠীর কবি লেখকেরা তো ছিলেনই, সেই সঙ্গে ছিলেন বিভূতিভূষণ, মানিক, তারাশঙ্কর- এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায়। এরকম এক স্বর্ণযুগে সতীনাথ ভাদুড়ীর লেখকদের লেখক হয়ে ওঠার কাজটা তত সহজ ছিল না। কিন্তু হ্যাঁ, তিনি ছিলেন এক স্বতন্ত্র মেজাজের লেখক। ফরাসি সাহিত্যে ছিল তাঁর অগাধ পান্ডিত্য। সে-সব তাঁকে স্বতন্ত্র মেজাজের মননশীল লেখক হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। বিষয় নির্বাচন ও বোধের স্বতন্ত্র তাঁকে করে তুলেছিল অনন্য। ১৯৪৫ থেকে ১৯৬৫... এই একুশ বছরের সময়সীমায় প্রকাশিত হয়েছে সতীনাথের সমস্ত উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাগরী, ঢোঁড়াই-চরিতমানস, অচিন রাগিনী, সংকট, দিগভ্রান্ত, গণনায়ক, চকাচকী ইত্যাদি।
ঔপন্যাসিক সতীনাথের "জাগরী"(১৯৪৫) ও "ঢোঁড়াই চরিত মানস"(১৯৫১) অনবদ্য সৃষ্টি। এই দুটি রাজনীতি আশ্রিত উপন্যাসই তাঁকে খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দেয়। গান্ধীজীর বিয়াল্লিশের আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা "জাগরী"। জেলকক্ষে রচিত জেলেরই অভিজ্ঞতা "জাগরী"-র উপকরণ। "ঢোঁড়াই চরিত মানস" প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কাহিনী হলেও ঢোঁড়াই কোথাও থিতু হতে পারে না। এক মানসিক দ্বন্দ্ব তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। গান্ধীজীর পথ ও মতে তার সন্দেহের অবকাশ থাকে। আসলে সে আক্ষরিক অর্থে এক নতুন পথের সন্ধানী ।
কিন্তু বাষট্টিটি গল্পের সার্থক রূপকার সতীনাথ ভাদুড়ী বিষ্ময়করভাবে গল্পকার হিসেবে অনালোচিত রয়ে গেছেন। কারণ যাই হোক, তাঁর উপন্যাসের উজ্জ্বল দ্যুতির তুলনায় গল্পগুলি মলিন করা যাবে না। বাস্তব অভিজ্ঞতা, অর্ন্তদৃষ্টি, অসাধারণ চিত্রকল্প ও নির্মিতিতে গল্পগুলি অনন্য, তা সে গল্প প্রেমের, হাস্যরসের অথবা সময় সচেতনতার--- যাই হোক না কেন। তাঁর গল্পে আরও লক্ষ্য করা যায় সমসাময়িক চিন্তা আর সামাজিক মূল্যবোধের মেলবন্ধন। "অপরিচিতা"-কে সতীনাথের একমাত্র প্রেমের গল্প বলা হলেও, "চকাচকী" গভীর এক প্রেমের গল্প ভিন্ন অন্য কিছু নয়। বরং দেহজ কামনার উর্ধ্বে প্রৌঢ়- প্রৌঢ়ার অবৈধ গভীর প্রেমই বিষয়। "জাগরী"-র হরদাহাটের দূবে-দূবেনীকে দেখি "চকাচকী" গল্পে। লোকশ্রুতি অনুযায়ী "চকাচকী" নামকরণেও প্রেমেরই প্রকাশ। দেহজ কামনার উর্ধ্বে দূবে-দূবেনীর নিঃশব্দ প্রেম লেখক এ-ই গল্পে ব্যক্ত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বিদেহী প্রেমের গল্প ও পরবর্তীকালে ফ্রয়েডতাড়িত প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, শৈলজানন্দকে আমরা পাই। জগদীশ গুপ্তর প্রেম, বিদ্রূপাত্মক, আরো, প্রেমে ফাঁকি ও প্রতারণা। তাঁর মরবিড চেতনা প্রভাব ফেলে তাঁর গল্পে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখি দেহজ কামনাকে প্রাধান্য দিতে। যদিও তিনি যৌন-আকর্ষণ ও মানবিক স্ফূরণের এক অদ্ভুত মিশেল তৈরি করে উতরে যান। তারাশঙ্করের লেখায় যৌন প্রকোপ না থাকলেও বুভূক্ষা আছে। রাঢ বাংলার আদিমতা তাঁর বিষয়। প্রেমের মাধূর্যে বৈষ্ণবীয় ভাব তাঁর "রাইকলম"। বিভূতিভূষ্ণণের লেখায় পাওয়া যায় গার্হস্থ প্রেমের ছবি।... এই সমস্ত ছাপিয়ে একটা স্বতন্ত্র ভাব, ঠিক ন্যাচারালিজম নয়, পাওয়া যায় সতীনাথের গল্পে উপন্যাসে। তাঁর প্রেম - মনস্তত্ত্বের উপন্যাস "অচিন রাগিণী"-তে হালকা যৌনতার প্রকাশ থাকলেও লেখকের রুচি ও লেখনশৈলিতে তা পরিমার্জিত। অন্য কোন কাঁচা হাতে এই উপন্যাস একটি অন্যধরণের উপাখ্যান হয়ে উঠতে পারতো। বাংলা সাহিত্যে প্রৌঢ় প্রেমের উল্লেখযোগ্য কাহিনী বিমল কর ভিন্ন আর কারো লেখার তেমন ভাবে দেখা যায় না। সেদিক থেকেও সতীনাথের "চকাচকী" উল্লেখযোগ্য। আপাতদৃষ্টিতে গল্পটিকে উপন্যাসাক্রান্ত মনে হলেও, উপলব্ধি ও আঙ্গিকে নৈপুণ্যে তা হয়ে ওঠে সার্থক রচনা। শেষ দৃশ্যের অসাধারণ চিত্রকল্প গল্পের মোটিভ।
'এ আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি, একটি প্রেমের প্রতি' -বলেন লেখক। আসলে সমাজ অনুমোদিত প্রেমের প্রতি এটি তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদন। গল্পটি উত্তমপুরুষে লেখা।
'চকাচকী'-নামটি আমারই দেওয়া--- ঠাট্টা করে নয়, ভালোবেসে। ---মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। 'অদ্ভুত অবস্থায় তাদের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ।' কী সে অদ্ভুত অবস্থা, তারা কারা ? হালকা হাস্যরসের মধ্য দিয়ে চরিত্রের বীজ বপন করেন সতীনাথ। "তখন সেখানে ঘোড়ার দড়ি নিয়ে, হাসি চেঁচামেচির মধ্যে, পুরোদমে টাগ- অব-ওয়র খেলা চলছে। দড়ির একদিকে দূবেজী, অন্যদিকে দূবেনী আর অবাধ্য ঘোড়াটি। হেঁইল জোয়ান।----- বলেই দূবেজী হঠাৎ দড়ি ছেড়ে দিল। দূবেনী একেবারে চিৎপাত। তঅবু হাসি থামে না।"
"দূবেজী নির্দোষিতার ভান করে। ---- 'জানোয়ারেরা সুদ্ধ তোর দিকে, তোর সঙ্গে কি আমি পারি। তাই হার মেনে ছেড়ে দিলাম।'...
"দাঁড়াও না! তোমার জানোয়ারগিরি বার করছি!" দূবেনীর বর্ণনায় লেখক কী বলেছেন?.... "দূবেনীর বয়স তখন বছর ষাটেক। তবু কী সুন্দর দেবী প্রতিমার মতো চেহারা! যেমন রূপ, তেমনি গায়ের রঙ। আর কী আপন করে নেওয়া ব্যবহার। আমার সবচেয়ে অবাক লেগেছিল বিয়ের পঞ্চাশ বছর পরও এ-ই দম্পতি, বিয়ের সময়ের মনের উপছে পড়া ভাব বজায় রেখেছে দেখে।"... নামকরণের সার্থকতা। লেখক বলেছেন, "তাই নাম দিয়েছি চকাচকী।" রাজনৈতিক সহকর্মী বিশ্বনিন্দুক মুসাফিরলালের পছন্দ হয়নি নামটি। কূটিলতায় ভরা তার ভালো চোখটি একটু টিপে, ঠোঁটের কোণে একটা ইঙ্গিতের ছাপ ফুটিয়ে তুলে সে বলেছিল, "চকাচকী না বলে, চড়ুই চড়ুইনী বলুন। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে বুড়ির, এখনও কী চমক! ছেঁদো কথার কী বাঁধুনী! দেখেন না নেচে চলে। ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে বেড়াতে চায় চড়ুই পাখীর মতো।" হয়ে যায় চরিত্রায়ন। এমন কী মুসাফির লালের পর্যন্ত। মুসাফির লালের মধ্যে একটু ঈর্ষাও কাজ করে। প্রমাণ মেলে ওরা দু'জন কতো সুখি। আরও জানা যায় দুবেজী প্রথম যখন রোজকারের ধান্দায় সেখানে আসে, একটা লোটা আর দুবেনীকে সঙ্গে করে।"... তখন এই হাটের মালিক বিনা সেলামীতে বাজারের মধ্যে ঘর তুলবার জন্য জমি দিয়েছিল, শুধু দুবেনীর কোমরের নাচন দেখে। সে বয়সে দুবেনী...।"
মুসাফিরলালকে লেখক থামিয়ে দেন। এটি লেখকের সংযমের প্রকাশ। তবু সেই সময়ে রূপসী দুবেনীকে, তার তন্বী শরীরটাকেও মনশ্চক্ষে একঝলক দেখে নিতে অসুবিধা হয় না আমাদের। অথচ কোনো অতিরিক্ত মন্তব্য বর্ণনা নেই।
তারা দু'জন দলনিরপেক্ষ ভাবে অতিথি সেবা করে থাকে।" তার কুঁড়েতে যা জুটবে, চারটি না খেলে রক্ষা নেই। "রামজীকে খুশি করার জন্য তাদের এই অতিথি সেবা। রামজী খুশি হলে তাদের পাপ খন্ডন হবে।" এমন সরল নিষ্পাপ দম্পতিও পাপের ভয়ে থাকুক।" পাপ মোচনের জন্য তারা জেলে যেতে চায়। "জেলে গেলে পাপ মোচন হয় রামজীর চোখে। "কিন্তু কেবল দুবেনীকে পুলিশ জেলে পুরলে, দুবেনী মাপ চেয়ে মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসে। তখন 'একেবারে ঢিঢিক্কার পড়ে গেল।" কিন্তু দুবে-দুবেনী এর কোনো জবাব দিল না। এমনকি তারা নিজেদের সরিয়ে নিলো সবার কাছ থেকে। দুবেলা বাড়িয়ে দিলো পুজোর সময়। সেটাও রামজীকে খুশি করার জন্য। রামজী কিছুতেই তাদের প্রতি খুশি হচ্ছে না, মনে হয় দুবেনীর। নইলে সে একা কেন জেলে যায়। দুবেনী একা তো আর নিজের পাপ মোচন করতে চায়নি। এখানে তাদের ধর্মভীরুতা ও পরস্পরের প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পায়। কিন্তু লেখকের মতো আমরাও অবাক হই পাপের ভয়ে ওদের আকুল হতে দেখে। মনে প্রশ্ন জাগে, কী সেই পাপ, কী সেই অপরাধবোধ, যা যা আপাত নিষ্পাপ দম্পতি বয়ে বেড়াচ্ছে? এ সমস্তই আসলে ছোট গল্পের নিয়মে সেই বীজবপন যার উত্তর আমরা কৌতূহলের সঙ্গে পাঠের পর শেষ' পর্বে পৌঁছে পাব। লেখকের লিখনশৈলি ও নৈপুণ্য এখানে।
আরও একবার দুবেনীর প্রতি দুবেজীর দরদী মন ও গভীর ভালোবাসার পরিচয় পাই আমরা, যখন দুবেজীর হঠাৎ খেয়াল হয় দুবেনী বড় রোগা হয়ে গেছে। অসুস্থ দুবেজী ঘোড়ার পিঠে বোরা চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ে রোজগারের জন্য। কিন্তু সন্ধ্যায় সমস্ত ঘোড়া ফিরে এলো খালি পিঠে। কিছুক্ষণ পরে পুরানদাহার লোকে বেহুঁশ দুবেজীকে গোরুর গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়ে যায়। ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট লেগেছে তার। দুবেজী আর সুস্থ হয়ে ওঠেনি। এর আগে গো- দান পর্ব। দুঃস্থ রাজনীতিক কর্মীদের সাহায্যের জন্য যে 'ফান্ড' ছিল সেখান থেকে লেখক দু'শো টাকা দেন দুবেনীকে। দুবেনী সেই টাকায় ওষুধ- পথ্য না কিনে একটা নধর গাই কিনে ফেলে। বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা তাদের গো- দান করার। পুরুতের মন্ত্র পাঠে গো-দান হয়। রামজীকে খুশি করার জন্য, অর্থাৎ পাপ- মোচনের জন্য। বেশ নাটকীয় ভাবে কাজ শেষ হয়। লেখক সামান্য কয়েকটি বাক্যে একটি চমৎকার ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। শেষ পর্বে, দুবেজী মৃত্যু শয্যায়। স্তম্ভিত হতে হয় আমাদের। জানতে পারি আমরা সেই চরম সত্য। কেন এই পাপবোধ ওদের তাদের তাড়া করে ফিরছিল। সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে এবার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে। আমরা মুগ্ধ প্রেমের আড়ালে এরকম ব্যথাও টের পাই। সেটা আমাদের অভ্যস্ত নৈতিকতার সংকীর্ণতা। দুবেনীর স্বীকারোক্তিতে জানতে পারি, দুবেজীর স্ত্রী পুত্র সংসার সবই থাকা স্বত্বেও, নিকট আত্মীয়া দুবেনীকে নিয়ে চল্লিশবছর আগে ঘর ছেড়েছে সে। সমাজবিধির গর্হিত এই প্রেম তাদের মধ্যে পাপবোধের জন্ম দেয়। সহজ সরল এই মানুষদুটিকে দেখি এই পাপমুক্তির জন্য তাদের কতই না প্রচেষ্টা। প্রায় সমস্ত গল্প জুড়ে গভীর প্রেম ও পাপবোধের মানসিক দ্বন্দ্ব চমৎকার পরিস্ফুটিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে, বলাবাহুল্য, গল্পের সেই সময়টাকে আমাদের মনে রাখতে হবে। তখনকার রক্ষণশীল সমাজে এরকম অবৈধ প্রেম গর্হিত অপরাধ ছিল। কিন্তু তাদের প্রেম এতটা গভীর ছিল যে, সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে একটা 'লোটা ' সম্বল করে বেরিয়ে আসে তারা। এরপরেও আমরা আবার চমকে উঠি, যখন অসুস্থ মৃতপ্রায় দুবেজীকে ছেড়ে দুবেনী নিরুদ্দিষ্ট হয়। এই চাঞ্চল্যকর খবর গল্পকারকে শোনায় মুসাফির লাল। এটা তার সন্দেহপ্রবণ মনের স্বপক্ষে একটি ঘটনা। কিন্তু লেখক জানেন, আমরাও বুঝতে পারি, "...দুবেকে মৃত্যুশয্যায় ফেলে চলে যাবার সময় তার বুক ফেটে গিয়েছে। তবুও নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে মুছে দিয়ে, সে দুবের একার পাপমোচনের ব্যবস্থা করে গিয়েছে।"
"...ছেলের হাতের জল পেলে সে পাপ থেকে মুক্তি পেয়ে স্বর্গে যেতে পারে।"...সুতরাং লেখককে রাজি করিয়ে সে দুবেজীর প্রথম পক্ষের ছেলেকে আনতে পাঠিয়েছিল। কিন্তু সে উপস্থিত থাকলে ছেলে দুবেজীর মুখে আগুন নাও দিতে পারে। এটিও গভীর ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগের ছবি।
"...নিজের জন্য ভাবি না, আমার বরাতে যা লেখা আছে তাই হবে। কিন্তু ওর যে রাস্তা রয়েছে পাপ খন্ডাবার।"
সুতরাং ছেলের হাতের জল পায় দুবেজী। অন্ত্যেষ্টি সে-ই করে। কিন্তু দুবেনী কি কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে থেকে চোখের জল ফেলতে ফেলতে দুবেজীর স্বর্গযাত্রা দেখতে চাইছিল? নইলে হঠাৎ নদীর ওপারের কাশবন দুলে উঠলো কেন? "...স্পষ্ট দেখা যায় না কিছুই... সমুদ্রের মধ্যে খসখসানির ঢেউটা মিলিয়ে গেল।" তখন শবযাত্রীরা কৌতূহল প্রকাশ করলে মুসাফির লাল বলে, "শিয়াল টিয়াল হবে বোধহয়। "কানা মুসাফির লালের পরিচিত কুটিল দৃষ্টিও দরদে ভরে ওঠে। আলোকিত হয়ে ওঠে তার চোখ। মহৎ প্রেমের প্রতি তার শ্রদ্ধা প্রকাশ পায়।
এইভাবেই সতীনাথ ভাদুড়ী প্রেমের শাশ্বত রূপকেই অভিনন্দিত করেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন