প্রবন্ধ
হুমায়ূন আহমেদ---[ লেখক, কবি, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, গীতিকার, নাট্যকার।]
শং ক র ব্র হ্ম
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোণা মহুকুমার মোহনগঞ্জে তার মাতামহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা ফয়েজ। তাঁর পিতা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমার উপ-বিভাগীয় পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হন। তার বাবা সাহিত্যনুরাগী মানুষ ছিলেন। তিনি পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। বগুড়া থাকার সময় তিনি একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেছিলেন, গ্রন্থের নাম 'দ্বীপ নেভা যার ঘরে'। তার মা'র লেখালেখির অভ্যাস না থাকলেও শেষ জীবনে একটি আত্মজীবনী গ্রন্থ রচনা করেছেন যার নাম 'জীবন যে রকম'। পরিবারে সাহিত্যমনস্ক আবহাওয়া ছিল। তার অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের একজন শিক্ষাবিদ এবং কথাসাহিত্যিক; সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা আহসান হাবীব রম্য সাহিত্যিক এবং কার্টুনিস্ট। তার তিন বোন হলেন সুফিয়া হায়দার, মমতাজ শহিদ, ও রোকসানা আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদের স্থানীয় নাম কাজল।
তার রচিত আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে ছোটকালে হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান। ডাকনাম কাজল। তার পিতা (ফয়জুর রহমান) নিজের নামের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন শামসুর রহমান। পরবর্তীতে আবার তিনি নিজেই ছেলের নাম পরিবর্তন করে হুমায়ূন আহমেদ রাখেন। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, তার পিতা ছেলে-মেয়েদের নাম পরিবর্তন করতে পছন্দ করতেন। তার ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম আগে ছিল বাবুল এবং ছোটবোন সুফিয়ার নাম ছিল শেফালি। ১৯৬২-৬৪ সালে চট্টগ্রামে থাকাকালে হুমায়ুন আহমেদের নাম ছিল বাচ্চু।
তার দাদা আজিমুদ্দিন আহমেদের বাবার নাম জাঙ্গির মুনশি। জাঙ্গির মুনশির এলাকায় পীরসাহেব হিসেবে খ্যাতি ছিল। তার দাদার বাড়ি মৌলভী বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। তার বড় মামা ফজলুল করিমের কাছ থেকে তিনি ছবি আঁকা শেখেন।
বগুড়া জিলা স্কুল--- আহমেদ এই বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন।
তার বাবা চাকরি সূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেছেন। তাই হুমায়ূন আহমেদ দেশের বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯৫৫ সালে সিলেটের কিশোরী মোহন পাঠশালায় (বর্তমান কিশোরী মোহন (বালক) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়)। সেখানে তিনি ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি ১৯৬৩ সালে বগুড়া জিলা স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে তিনি এই বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ৫৬৪ নং কক্ষে তার ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেন (নন্দিত নরকে উপন্যাসটি মুহসীন হলেই লেখা)।
স্বগৃহে বৈঠকী আড্ডায় হুমায়ূন আহমেদ--- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনে একটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য জীবনের শুরু। এই উপন্যাসটির নাম 'নন্দিত নরকে'। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপন্যাসটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২-এ কবি-সাহিত্যিক আহমদ ছফার উদ্যোগে উপন্যাসটি খান ব্রাদার্স কর্তৃক গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত বাংলা ভাষাশাস্ত্র পণ্ডিত আহমদ শরীফ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দিলে বাংলাদেশের সাহিত্যমোদী মহলে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। বইটির প্রচ্ছদ করেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ভাস্কর শামীম শিকদার। উপন্যাসটি লেখক শিবির হতে বর্ষসেরা উপন্যাসের পুরস্কার লাভ করে। 'শঙ্খনীল কারাগার' তার লেখা প্রথম উপন্যাস, কিন্তু প্রকাশিত ২য় গ্রন্থ। তার রচিত তৃতীয় উপন্যাস বিজ্ঞান কল্পকাহিনীমূলক 'তোমাদের জন্য ভালোবাসা'। বিজ্ঞান সাময়িকী সাপ্তাহিক পত্রিকায় উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন এবং নর্থ ডাকোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিমার রসায়ন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে দীর্ঘকাল কর্মরত ছিলেন।
১৯৭৩ সালে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তার বেতন ছিল ৬৫০ টাকা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় তিনি তার প্রথম ছোটগল্প রচনা করেন। 'সৌরভ' নামক গল্পটি বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে যোগদান করেন। এই বছর বিচিত্রা পত্রিকায় ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় তার রচিত উপন্যাস 'অচিনপুর'। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন। পরবর্তীতে লেখালেখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বার্থে অধ্যাপনা ছেড়ে দেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে আটক করে এবং নির্যাতনের পর হত্যার জন্য গুলি চালায়। তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। হুমায়ূন আহমেদ রচিত প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে, ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয়। সত্তর দশকের সময় থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি তিনি ছিলেন বাংলা গল্প-উপন্যাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কারিগর। এই কালপর্বে তার গল্প-উপন্যাসের জনপ্রিয়তা ছিল তুলনারহিত। তার অভূতপূর্ব সৃষ্টি হিমু এবং মিসির আলি ও শুভ্র চরিত্রগুলি বাংলাদেশের যুবকশ্রেণীকে গভীরভাবে উদ্বেলিত করেছে। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীও তার সৃষ্টিকর্মের অন্তর্গত, তার রচিত প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী তোমাদের জন্য ভালোবাসা। তার টেলিভিশন নাটকসমূহ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সংখ্যায় বেশি না হলেও তার রচিত গানগুলোও জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার রচিত অন্যতম উপন্যাসসমূহ হলো - মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাতাল হাওয়া, লীলাবতী, কবি, বাদশাহ নামদার ইত্যাদি।
বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস শাখায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার অবদানের জন্য ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।
তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক। তার বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত। মিসির আলি এবং হিমু তার সৃষ্ট অন্যতম দুটি জনপ্রিয় চরিত্র।
তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো সর্ব সাধারণ্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। ১৯৯৪-এ তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক আগুনের পরশমণি মুক্তি লাভ করে। চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সহ আটটি পুরস্কার লাভ করে। তার নির্মিত অন্যান্য সমাদৃত চলচ্চিত্রগুলো হলো শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯), দুই দুয়ারী (২০০০), শ্যামল ছায়া (২০০৪), ও ঘেটু পুত্র কমলা (২০১২)। শ্যামল ছায়া ও ঘেটু পুত্র কমলা চলচ্চিত্র দুটি বাংলাদেশ থেকে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কারের জন্য দাখিল করা হয়েছিল। এছাড়া ঘেটু পুত্র কমলা চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭৩ সালে গুলতেকিন খান কে বিয়ে করেন। গুলতেকিন প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর নাতনী। এই দম্পতির তিন মেয়ে এবং এক ছেলে। বড় মেয়ে নোভা আহমেদ, মেজো মেয়ে শীলা আহমেদ এবং ছোট মেয়ে বিপাশা আহমেদ। তার বড় ছেলের নাম নুহাশ হুমায়ূন। বাবার মত নুহাশও পরিচালনায় মনোনিবেশ করেন। অন্য আরেকটি ছেলে সন্তান অকালে মারা যায়। তিনি তার নাম রেখেছিলেন রাশেদ হুমায়ূন। ১৯৯০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যভাগ থেকে শীলা আহমেদের বান্ধবী এবং তার বেশ কিছু নাটক-চলচ্চিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী শাওনের সাথে হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। এর ফলে সৃষ্ট পারিবারিক অশান্তির অবসানকল্পে ২০০৫-এ গুলতেকিনের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয় এবং ঐ বছরই শাওনকে বিয়ে করেন। এই ঘরে তাদের তিন সন্তান জন্মগ্রহণ করে। প্রথম ভূমিষ্ঠ কন্যাটি মারা যায়, যার নাম ছিলো লীলাবতী। তার স্মরণে নুহাশ পল্লীতে একটি জলাধারের নাম 'লীলাবতী', যার পাশেই একটি এপিটাফে দুটি চরণ উল্লেখ রয়েছে- "নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে/রয়েছো নয়নে নয়নে"। আর শাওনের গর্ভজাত ছেলে সন্তানের নাম নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ুন।
টেলিভিশন নাট্যকার হিসেবে হুমায়ূন আহমেদকে আবিষ্কার করেন নওয়াজিশ আলী খান। হুমায়ূন আহমেদের "নন্দিত নরকে" ও "শঙ্খনীল কারাগার" পড়ার পর তিনি একদিন ধানমন্ডির দখিন হাওয়াতে "রত্নদ্বীপ" নাটকের চিত্রায়নকালে নওয়াজিশ আলী খান হুমায়ূন আহমেদ এর সাথে পরিচিত হন। তিনি আহমেদকে টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখতে আহ্বান জানান। টেলিভিশনের জন্য হুমায়ূন আহমেদের প্রথম কাজ হল টেলিভিশন নাটক 'প্রথম প্রহর'। এটি ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়। নাটকটি পরিচালনা করেন নওয়াজিশ আলি খান। মানুষের সততাকে কেন্দ্র করে নির্মিত নাটকটি প্রচারের পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তীতে খান আহমেদ রচিত অসময়, অযাত্রা, বিবাহ, এসো নীপবনে, নিমফুল নাটক প্রযোজনা করেন। হুমায়ূন আহমেদ এর রচিত প্রথম ধারাবাহিক নাটক 'এইসব দিনরাত্রি' (১৯৮৫)। নাটকে লিউকোমিয়া আক্রান্ত শিশু চরিত্র 'টুনি'কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য হুমায়ূন আহমেদের কাছে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে দর্শকের প্রচুর চিঠি আসে, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ তার চিত্রনাট্য এর ধারায় অটল থাকেন।
নওয়াজিশ আলি খানের প্রযোজনায় হুমায়ূন আহমেদ এর রচনায় প্রথম টেলিভিশন ধারাবাহিক নাটক 'বহুব্রীহি'। এটি ১৯৮৮-৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এই ধারবাহিকটির প্রতিটি পর্ব ছিল বিষয়ভিত্তিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, যা ছিল বাংলাদেশের টিভি নাটকের অভিনব অধ্যায়। এই ধারাবাহিকের মাধ্যমে কিছু সামাজিক বিষয় যেমন- মিথ্যা না বলা ও পুষ্টি সংরক্ষণের জন্য সপ্তাহে এক দিন মাছ না খাওয়া, এবং মুক্তিযুদ্ধ এর চেতনা নতুন ভাব জাগিয়ে তোলা ইত্যাদি। ধারাবাহিকের একটি সংলাপ "তুই রাজাকার" এটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ওই সময়ে নির্মিত হয় টেলিভিশন ধারাবাহিক নাটক অয়োময়। এই নাটকেই তার কন্যা শীলা আহমেদের অভিনয়ে অভিষেক হয়। শীলা আহমেদের অভিনীত আরেকটি জনপ্রিয় নাটক হচ্ছে "আজ রবিবার''। আহমেদ এই নাটকের মহড়া, চিত্রায়ণ ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন, যা তাঁকে পরবর্তীতে পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। তাঁর রচিত আরেকটি অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিক হল 'কোথাও কেউ নেই' (১৯৯০)। এই ধারাবাহিকের বাকের ভাই চরিত্রটি তুমুল দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সাংস্কৃতিক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রুখতে দর্শক 'বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে' স্লোগান দিয়ে মিছিল বের করে। এমনকি-হুমায়ূন আহমেদের ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে দর্শকেরা আক্রমণ করে। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে তিনি রমনা থানায় জিডিও করেছিলেন।পরবর্তী সময়ে তিনি বহু এক পর্বের নাটক নির্মাণ করেছেন। যার মধ্যে খেলা, অচিন বৃক্ষ, খাদক, একি কাণ্ড, একদিন হঠাৎ, অন্য- ভুবন উল্লেখযোগ্য।
মিসির আলি চরিত্রটি আহমেদের মাথায় আসে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটার ফার্গো শহরে স্ত্রী গুলতেকিনের সাথে গাড়িতে ভ্রমণকালে। এই ঘটনার অনেকদিন পর তিনি মিসির আলি বিষয়ক প্রথম উপন্যাস 'দেবী'(রহস্য উপন্যাস) লিখেন ১৯৮৫ সালে উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তিনি এই চরিত্রকে কেন্দ্র করে রচনা করেন 'নিশীথিনী' (১৯৮৭), 'নিষাদ' (১৯৮৮), 'অন্য ভুবন' (১৯৮৯) ও 'বৃহন্নলা' (১৯৮৯)। এছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলিকে নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস 'দেবী' থেকে ২০১৮ সালে নির্মিত হয় দেবী নামের একটি চলচ্চিত্র। যেটির মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মিসির আলির বড় পর্দায় অভিষেক হয়। ছবিটি পরিচালনা করেন অনম বিশ্বাস। এতে মিসির আলির ভূমিকায় অভিনয় করেন চঞ্চল চৌধুরী।
হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট হিমু চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে 'ময়ূরাক্ষী' উপন্যাস দিয়ে। ১৯৯০ সালে মে মাসে অনন্যা প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে চরিত্রটি পাঠকদের, বিশেষ করে তরুণ সাহিত্যপ্রেমীদের মাঝে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে একে একে প্রকাশিত হতে থাকে 'দরজার ওপাশে' (১৯৯২), 'হিমু' (১৯৯৩), 'পারাপার' (১৯৯৪), 'এবং হিমু' (১৯৯৫), 'হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম' (১৯৯৬), 'হিমুর দ্বিতীয় প্রহর' (১৯৯৭), 'হিমুর রূপালী রাত্রি' (১৯৯৮), এবং 'একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁ ঝিঁ পোকা' (১৯৯৯) ইত্যাদি। এছাড়া এই উপন্যাসগুলো নিয়ে হিমু সমগ্র ( প্রথম খণ্ড) (১৯৯৪), হিমু সমগ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) (১৯৯৮), এবং হিমু অমনিবাস (২০০০) প্রকাশিত হয়। হুমায়ূন আহমেদ এর লেখায় রাজনৈতিক প্রণোদনা অনুপস্থিত, এরকম কথা বলাও হলেও হিমুর লেখাগুলোর ক্ষেত্রে তা সত্যি নয়।
শুভ্র চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে 'দারুচিনি দ্বীপ' উপন্যাস দিয়ে। যদিও শুভ্র চরিত্রটি প্রথম আসে তার লেখা একটি ছোটগল্পে, যার নাম 'শাদা গাড়ি।' দারুচিনি দ্বীপ বইটি অনুপম প্রকাশনী থেকে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয়। শুভ্রকে নিয়ে রচিত তার দ্বিতীয় উপন্যাস হল 'মেঘের ছায়া'। এটি ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়। দারুচিনি দ্বীপ উপন্যাসের গল্পের শেষ থেকে শুরু হয় পরবর্তী উপন্যাস 'রূপালী দ্বীপ' (১৯৯৪)।
১৯৯২ সালে হুমায়ূন আহমেদ রচিত 'শঙ্খনীল কারাগার' উপন্যাস অবলম্বনে মোস্তাফিজুর রহমান একই নামের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ছবিটি নির্মাণের জন্য পরিচালক বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুদান পান এবং আহমেদ চিত্রনাট্য লেখার সম্মানী হিসেবে ১০,০০০ টাকা পান। মুক্তির পর চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মধ্যে ছবিটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে, কিন্তু শাকুর মজিদ কাহিনী, কাহিনীর সময়কাল, সেট ও পোশাকে গরমিল খুঁজে পান।তবে 'শঙ্খনীল কারাগার' শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ চারটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে এবং আহমেদ শ্রেষ্ঠ কাহিনীকারের পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে 'আগুনের পরশমণি' চলচ্চিত্র দিয়ে তার পরিচালনায় অভিষেক হয়। এই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তিনি ২৫,০০০ টাকা সরকারি অনুদান পান। তিনি মূলতঃ তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু চলচ্চিত্রকার আনিস সাবেতের অকাল মৃত্যুর খবর শোনার পর চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হন। চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকতার চাকরি থেকে অব্যহতি দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক চমৎকার গল্প ও দুর্দান্ত নির্মাণশৈলী দিয়ে তিনি দর্শকের মন জয় করেন। চলচ্চিত্র পরিচালক কবীর আনোয়ার বলেন, "এতো বড় মাপের ছবি বাংলাদেশে আগে কখনো হয় নি, জানি না সামনে কেউ আসবেন কিনা এরকম ছবি বানানোর মেধা নিয়ে।" চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে এবং আহমেদ শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও সংলাপ রচয়িতা বিভাগে পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তার উপন্যাস 'কবি'। এতে তিনজন কবির গল্প বিবৃত হয়েছে। ১৯৯৫ সাল থেকে ছোটদের কাগজ পত্রিকায় 'কালো জাদুকর' উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে থাকেন। পার্ল পাবলিকেশন্স ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একুশে বইমেলায় বইটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে।
১৯৯৯ সালে তিনি নির্মাণ করেন লোক-নাট্যধর্মী 'শ্রাবণ মেঘের দিন'। এটি তার নিজের রচিত একই নামের উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ। চলচ্চিত্রটি সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে এবং ২০০২ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অধিভুক্ত সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনের করা জরিপে সমালোচকদের বিচারে এটি সেরা দশ বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের তালিকায় নবম স্থান অধিকার করে। এছাড়া ছবিটি সাতটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। হুমায়ূন আহমেদ মূলত গান রচয়িতা বা গীতিকার নন। কেবল নাটক ও চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে তিনি গান রচনা করে থাকেন। এই চলচ্চিত্রের জন্য তার রচিত "একটা ছিল সোনার কন্যা" এবং "আমার ভাঙা ঘরে" গান দুটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রথম গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে গায়ক সুবীর নন্দী শ্রেষ্ঠ পুরুষ কণ্ঠশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
হুমায়ূন আহমেদ তার নিজের সৃষ্ট হিমু চরিত্র লেখা সম্বলিত পেয়ালায় চা পানরত ২০০০ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয় তার রচিত উপন্যাস 'বৃষ্টিবিলাস'। মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েন নিয়ে লেখা বইটি তার সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের একটি। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই বইটির দ্বাদশ মুদ্রণ বের করতে হয়। ২০০১ সালে 'দুই দুয়ারী' চলচ্চিত্র সকল শ্রেণীর দর্শকদের কাছে দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পায়। ছবিতে জাদু বাস্তবতার প্রকাশ পায় রিয়াজ অভিনীত রহস্য মানব চরিত্রের আশ্চর্য উপায়ে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে। এই চরিত্রে অভিনয় করে রিয়াজ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ২০০৩-এ নির্মাণ করে জমিদারদের কঠোর মনোভাব, বিলাসিতা আর শিল্পকর্মের প্রতি গভীর অনুরাগ নিয়ে চিত্রিত চলচ্চিত্র 'চন্দ্রকথা'। এই ছবিতে তিনি একই সাথে মানবতা ও নিষ্ঠুরতার প্রতিফলন ঘটান। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রটি। এটি ২০০৬ সালে শ্রেষ্ঠ বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এছাড়াও চলচ্চিত্রটি কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় তার রচিত যুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস 'জোছনা ও জননীর গল্প'।
২০০৬ সালে হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র, সেগুলো হল মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত 'দূরত্ব', বেলাল আহমেদ পরিচালিত 'নন্দিত নরকে' এবং আবু সাইয়ীদ পরিচালিত 'নিরন্তর'। ২০০৬ সালে অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয় তার ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস 'মধ্যাহ্ন'-এর প্রথম খণ্ড এবং পরের বছর এর দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। ২০০৭ সালে তার উপন্যাস অবলম্বনে শাহ আলম কিরণ নির্মাণ করেন 'সাজঘর' এবং তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন 'দারুচিনি দ্বীপ'। চলচ্চিত্র দুটি ৩২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে একাধিক বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে। এ সময়ে তিনি হাস্যরসাত্মক 'নয় নম্বর বিপদ সংকেত' (২০০৭) এবং ত্রিভুজ প্রেমের গল্প নিয়ে 'আমার আছে জল' (২০০৮) নির্মাণ করেন।
'ঘেটুপুত্র কমলা' (২০১২) তার পরিচালিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি ৮৫তম একাডেমি পুরস্কারে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগের জন্য বাংলাদেশ থেকে নিবেদন করা হয়েছিল। ২০১২ সালের মে মাসে দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িক 'দেয়াল' উপন্যাসের দুটি অধ্যায় প্রকাশিত হয়। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনার বিবরণে তথ্যগত ভুল থাকায় আদালত তা সংশোধনের নির্দেশ দেয় এবং কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে। এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ভাষ্যমতে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে খন্দকার মোশতাক আহমেদ জড়িত ছিলেন বলে মামলার সাক্ষ্য প্রমাণে উঠে এসেছে। কিন্তু মোশতাক আহমেদ কিছুই জানতেন না, এমনটাই তুলে ধরা হয়েছে ঐ উপন্যাসে। তবে এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, "দেয়াল কোনো রাজনৈতিক উপন্যাস নয়, এ এক ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস৷ এতে ইতিহাসের খলনায়কদেরকে খলনায়ক হিসেবেই দেখানো হয়েছে"। পরবর্তীকালে হুমায়ূন আহমেদ কর্তৃক সংশোধিত বইটি অন্যপ্রকাশ ২০১৩ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশ করে।
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৮৭ সালে ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের পিজুলিয়া গ্রামে ২২ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত বাগান বাড়ি নুহাশ পল্লী গড়ে তুলেন। বাড়িটির নামকরণ করা হয় স্ত্রী গুলতেকিন ও তার প্রথম পুত্র নুহাশ হুমায়ূনের নামে। বর্তমানে এর আয়তন আরও বৃদ্ধি করে ৪০ বিঘা করা হয়েছে। অভিনেতা এজাজুল ইসলাম তাকে এই জমি কেনা ও ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করেন। বাড়িটির সর্ব উত্তরে একটি পুকুর রয়েছে। পুকুরটির নাম 'লীলাবতী'। এর নামকরণ করা হয় শাওন ও তার অকালপ্রয়াত কন্যার নামে, যে পৃথিবীর আলো দেখার পূর্বে মৃত্যুবরণ করে। পুকুরে একটি কাঠের পুল রয়েছে। পুকুরের মাঝখানে একটি কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে তাবু পোঁতা আছে।
যেখানে হুমায়ুন আহমেদ অবসরে লেখালেখি করতেন তার নাম 'সমুদ্র বিলাস'।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনা করেছেন। তার রচনার প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো 'গল্প-সমৃদ্ধি'। এছাড়া তিনি অনায়াসে ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে অতিবাস্তব ঘটনাবলীর অবতারণা করেন যাকে একরূপ যাদু বাস্তবতা হিসেবে গণ্য করা যায়। তার গল্প ও উপন্যাস সংলাপপ্রধান। তার বর্ণনা পরিমিত এবং সামান্য পরিসরে কয়েকটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে চরিত্র চিত্রণের অদৃষ্টপূর্ব প্রতিভা তার রয়েছে। যদিও সমাজসচেতনতার অভাব নেই তবু লক্ষ্যণীয় যে তার রচনায় রাজনৈতিক প্রণোদনা অনুপস্থিত। সকল রচনাতেই একটি প্রগাঢ় শুভবোধ ক্রিয়াশীল থাকে; ফলে 'নেতিবাচক' চরিত্রও তার লেখনীতে লাভ করে দরদী রূপায়ণ। এ বিষয়ে তিনি মার্কিন লেখক জন স্টাইনবেক দ্বারা প্রভাবিত।
হুমায়ূন আহমেদের তৈরি নুহাশ পল্লীতে "বৃষ্টি বিলাস", যেখানে হুমায়ূন আহমেদ বসে কাব্যিক মেজাজে বৃষ্টি উপভোগ করতেন।
অনেক রচনার মধ্যে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস 'মধ্যাহ্ন' তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরিগণিত। এছাড়া 'জোছনা ও জননীর গল্প' আরেকটি বড় মাপের রচনা, যা ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বন করে রচিত। তবে সাধারণত তিনি সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে লিখতেন।
নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস হুমায়ূন আহমেদের সামগ্রিক প্রভাব মূল্যায়ন করে বলেন, "হুমায়ূনের কাজসমূহ সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গভীর ভাবসম্পন্ন ও সবচেয়ে ফলপ্রসূ।" একই রকমভাবে, বাংলাদেশী কবি আল মাহমুদ তার সম্পর্কে বলেন, "ঠাকুর ও নজরুলের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের একটি স্বর্ণযুগ শেষ হয়েছে এবং আরেকটি শুরু হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের মধ্য দিয়ে।" বাংলাদেশী লেখক ইমদাদুল হক মিলন তাকে "বাংলা সাহিত্যের সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকারী" বলে উল্লেখ করেন, যিনি তার সৃষ্ট চরিত্রের সকল কাজ ও চিন্তা-ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করেন।" বাঙালি লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাকে "বাংলা সাহিত্যে একটি শতাব্দীর সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক" উল্লেখ করেন, এবং তার মতে "আহমেদ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধায়ের চেয়েও জনপ্রিয় ছিলেন।" বাঙালি লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাকে "উপমহাদেশের অন্যতম সেরা লেখক" বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশী লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, "তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন।" পাকিস্তানের প্রাচীনতম ও সর্বাধিক পঠিত ইংরেজি সংবাদপত্র ডন তাকে "বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কিংবদন্তি" বলে উল্লেখ করে।
এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিনের যৌথ উদ্যোগে "হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার" প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রতি বছর আহমেদের জন্মদিনে ১২ই নভেম্বর দুজন সাহিত্যিককে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২০১৭ সালে তার জন্মদিনে গুগল তাদের হোমপেজে হুমায়ূন আহমেদের গুগল ডুডল প্রদর্শন করে উদ্যাপন করে। গুগল ডুডলটিতে দেখা যায় চায়ের টেবিলে বই হাতে বসে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার তৈরি জনপ্রিয় চরিত্র হিমু হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। আর চারপাশে প্রকৃতির আবহ দিয়ে সাজানো হয়েছে ইংরেজি গুগল লেখাটি।
হুমায়ূন আহমেদের তুমুল জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিক 'কোথাও কেউ নেই" থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাতা রেদওয়ান রনি নির্মাণ করেন সাত পর্বের একটি মিনি-ধারাবাহিক বাকের ভাই, হিমু। এর গল্প শুরু হয় কোথাও কেউ নেই-এর পর থেকে, যেখানে হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র হিমু মুনাকে কথা দেয় সে বাকের ভাইকে খুঁজে বের করবে। ঘটনাপ্রবাহে একদিন সত্যি সত্যি বাকের ভাইয়ের সাথে দেখা হয় হিমুর। ধারাবাহিকটি ২০১০ সালের ঈদুলফিতরে দেশ টিভিতে প্রচারিত হয়।
লেখক ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ অসংখ্য গান রচনা করেছেন। গানগুলো তিনি তাঁর নাটক ও চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন। গানগুলোর সুরকার ও শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন মকসুদ জামিল মিন্টু, সেলিম চৌধুরী, সুবীর নন্দী, এস আই টুটুল, মেহের আফরোজ শাওন, সাবিনা ইয়াসমিন, খান আসিফুর রহমান আগুন, হাবিব ওয়াহিদ, ফজলুর রহমান বাবু প্রমুখ। তাঁর সর্বাধিক পরিচিত গান দুটো হলো "একটা ছিল সোনার কন্যা" ও "যদি মন কাঁদে"। এছাড়া রয়েছে "চলো বৃষ্টিতে ভিজি", "আমার আছে জল", "নদীর নাম ময়ূরাক্ষী", "চলো না যাই", "আজ জরির বিয়ে', ও "আমার রসিক বন্ধু রে", "ও আমার উড়াল পঙ্খী রে", "আমার ভাঙ্গা ঘরের ভাঙ্গা চালা", "মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ', "কন্যা নাচিল রে", "ঠিকানা আমার নোটবুকে আছে", "বাজে বংশী", "বরষার প্রথম দিনে", "আমি আজ ভেজাব চোখ সমুদ্র জলে", "চান্নি পসরে কে আমায় স্মরণ করে", "চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়" ইত্যাদি।
হুমায়ুন আহমেদ তার অসংখ্য বহুমাত্রিক সৃষ্টির জন্য নানা পুরস্কারে ভূষিত হন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলি হলো-
* বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১)
* শিশু একাডেমী পুরস্কার
* একুশে পদক (১৯৯৪)
* জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
(শ্রেষ্ঠ কাহিনী ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ১৯৯৪)
* লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩)
* মাইকেল মধুসুদন পদক (১৯৮৭)
* বাচশাস পুরস্কার (১৯৮৮)
* হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০)
* জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক
১৯৯২ সালের শঙ্খনীল কারাগার চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে তার প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৯৪ সালে দেশের দ্বিতীয় বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। একই বছরের 'আগুনের পরশমণি' চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা বিভাগে তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। 'শ্রাবণ মেঘের দিন' (১৯৯৯) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার ও শ্রেষ্ঠ গীতিকার বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া চলচ্চিত্রটি সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনের জরিপে সমালোচকদের বিচারে সেরা দশ বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের তালিকায় নবম স্থান লাভ করে।
তার উপন্যাস অবলম্বনে তৌকির আহমেদ নির্মিত 'দারুচিনি দ্বীপ' (২০০৭) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। 'আমার আছে জল' (২০০৮) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ১১তম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে সমালোচক পুরস্কার শাখায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক বিভাগে মনোনয়ন লাভ করেন। তার উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম নির্মিত 'প্রিয়তমেষু' (২০০৯) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। 'ঘেটুপুত্র কমলা' (২০১২) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক এবং শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।এই চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ১৫তম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে সমালোচক পুরস্কার শাখায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালকের পুরস্কার লাভ করেন। তার উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম নির্মিত অনিল বাগচীর একদিন (২০১৫) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ৪০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে মরণোত্তর শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতার পুরস্কার লাভ করেন।
নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের কবর।
জীবনের শেষভাগে ঢাকা শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডির ৩/এ রোডে নির্মিত দখিন হাওয়া ভবনের একটি ফ্লাটে তিনি বসবাস করতেন। খুব ভোর বেলা ওঠা অভ্যাস ছিল তার, ভোর থেকে সকাল ১০-১১টা অবধি লিখতেন তিনি। মাটিতে বসে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। কখনো অবসর পেলে ছবি আঁকতেন।
২০১১-এর সেপ্টেম্বের মাসে সিঙ্গাপুরে ডাক্তারী চিকিৎসার সময় তার দেহে মলাশয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। তিনি নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোয়ান-কেটরিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। তবে টিউমার বাইরে ছড়িয়ে না-পড়ায় সহজে তার চিকিৎসা প্রাথমিকভাবে সম্ভব হলেও অল্প সময়ের মাঝেই তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১২ দফায় তাকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর তার কিছুটা শারীরিক উন্নতি হলেও, শেষ মুহূর্তে শরীরে অজ্ঞাত ভাইরাস আক্রমণ করায় তার অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যায়। মলাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। কৃত্রিমভাবে লাইভ সাপোর্টে রাখার পর ১৯শে জুলাই ২০১২ তারিখে তিনি নিউ ইয়র্কের বেলেভ্যু হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে নুহাশ পল্লীতে দাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে সাহিত্য ও সিনেমা জগতে শূন্যতার সৃষ্টি হয়।
পাঠকদের জন্য হুমায়ূন আহমেদের স্মরণীয় বাণী ও উক্তি আশিটি।
১) প্রত্যেক ভালবাসায় দুইজন সুখী হলেও তৃতীয় একজন অবশ্যই কষ্ট পাবেই, এটাই হয়তো প্রকৃতির নিয়ম।
২) নোংরা কথা শুনতে নিষিদ্ধ আনন্দ আছে, কথা যত নোংরা তত মজা। -হুমায়ূন আহমেদ
৩) যে ভালবাসা যত গোপন, সেই ভালবাসা তত গভীর।
৪)এই পৃথিবীতে চোখের জলের মতো পবিত্র তো আর কিছু নেই । এই পবিত্র জলের স্পর্শে সব গ্লানি- সব মালিন্য কেটে যায় ।
৫)বাস্তবতা এতই কঠিন যে কখনও কখনও বুকের ভিতর গড়ে তোলা বিন্দু বিন্দু ভালবাসাও অসহায় হয়ে পড়ে।
৬)হাসি সবসময় যে সুখের প্রকাশতা নয়, আপনি কতটা দুঃখ লুকাতে পারেন তাও বুঝায়।
৭)ভালো মানুষের রাগ থাকে বেশি। যারা মিচকা শয়তান তারা রাগে না। পাছায় লাথি মারলেও লাথি খেয়ে হাসবে।
৮)প্রেমের ক্ষমতা যে কি প্রচন্ড হতে পারে প্রেমে না পড়লে তা বুঝা যায় না।
৯) যে একদিন পড়িয়েছে সে শিক্ষক। সারাজীবনই শিক্ষক…. আবার যে একদিন চুরি করেছে সে কিন্তু সারাজীবনই চোর না। তাহলে পৃথিবীর সব মানুষই চোর হত…!
১০) সাহসী মানে সবসময় গর্জে উঠা নয়। অনেক সময় সাহসী তারাই যারা দিন শেষে শান্ত গলায় বলে আমি আবার কালকে চেষ্টা করবো।
১১) যার ওপর মায়া পড়েছে তার সঙ্গে শুধু কথা বলতে ইচ্ছে করে এই ইচ্ছেটিই বিপজ্জনক, কথা বলা মানেই মায়া বাড়ানো।
১২) মেয়েদের মন পৃথিবীর সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা। এই মন অনেক কঠিন বিষয় সহজে মেনে নেয়, আবার অনেক সহজ বিষয় সহজে মেনে নিতে পারে না।
১৩) অপেক্ষা হলো শুদ্ধতম ভালোবাসার একটি চিহ্ন। সবাই ভালোবাসি বলতে পারে। কিন্তু সবাই অপেক্ষা করে সেই ভালোবাসা প্রমাণ করতে পারে না!!
১৪) যার রাগ বেশি সে নীরবে অনেক ভালোবাসতে জানে, যে নীরবে ভালোবাসতে জানে তার ভালোবাসার গভীরতা বেশি, আর যার ভালোবাসার গভীরতা বেশি তার কষ্টও অনেক বেশি।
১৫) পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ সম্ভবত কষ্ট পাবার জন্যই জন্মায়। টাকা পয়সার কষ্ট নয়, মানসিক কষ্ট।
১৬) পুরুষ মানুষকে চোখে চোখে রাখতে হয়। চোখের আড়াল হলেই এরা অন্য জিনিস।
১৭) অধিকাংশ মানুষ কল্পনায় সুন্দর, অথবা সুন্দর দূর থেকে। কাছে এলেই আকর্ষণ কমে যায়। কারো সম্পর্কে যত কম জানা যায়, সে তত ভাল মানুষ।
১৮) আমার হারিয়ে ফেলার কেউ নেই, কাজেই খুঁজে পাওয়ারও কেউ নেই, আমি মাঝে মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলি, আবার খুঁজে পাই।
১৯) সাধারন হওয়াটা একটা অসাধারন বিষয়, সবাই সাধারন হতে পারে না।
২০) স্বপ্নটা কেমন ছিল, তা ঘুম ভাঙ্গার পর বুঝা যায়। ঠিক তেমনি কাছের মানুষ কেমন ছিল, তা শুধু হারিয়ে যাবার পর বুঝা যায়।
২১) কাউকে প্রচন্ডভাবে ভালোবাসার মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা আছে। নিজেকে তখন তুচ্ছ এবং সামান্য মনে হয়। এই ব্যাপারটা নিজেকে ছোট করে দেয়।
২২) ভালোবাসার মানুষদের খুব কাছে কখনো যেতে নেই!
২৩) যদি আপনি অন্তর থেকে কাউকে চান, জেনে রাখুন সেই মানুষটিও আপনাকে ভেবেই ঘুমাতে যায়।
২৪) খুব বুদ্ধিমান মানুষদের এটা একটা সমস্যা। নিজেদের তৈরি কথা ছোট ছোট ফাঁদে তারা নিজেরা ধরা পড়ে।
২৫) লাজুক ধরনের মানুষ বেশির ভাগ সময়ই মনের কথা বলতে পারে না। মনের কথা হড়বড় করে বলতে পারে শুধু মাত্র পাগলরাই। পাগলরা মনে হয় সে কারণেই সুখি।
২৬) আবেগ লুকাতে হয়, অতি আবেগ মানুষকে সামনে এগোতে দেয় না।
২৭) মেয়েদের তৃতীয় নয়ন থাকে। এই নয়নে সে প্রেমে পড়া বিষয়টি চট করে বুঝে ফেলে।
২৮) তুমি একটা খারাপ কাজ করেছো তার মানে তুমি একজন মানুষ, তুমি সেই খারাপ কাজটার জন্য অনুতপ্ত তার মানে তুমি একজন ভাল মানুষ।
২৯) মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে মাঝে মাঝে তার সবকিছু পেছনে ফেলে চলে যেতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সে যেতে পারে না। তাকে অপেক্ষা করতে হয়। কিসের অপেক্ষা তাও সে ভালমত জানে না।
৩০) জীবনটা আসলেই অনেক সুন্দর, এতো বেশি সুন্দর যে, মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে।
৩১) ভালবাসার মানুষের সাথে বিয়ে না হওয়াটাই বোধ হয় ভাল। বিয়ে হলে মানুষটা থাকে, ভালবাসা থাকে না।
৩২) ধরা যাক, এক কঠিন নাস্তিক মঙ্গল গ্রহে গিয়েছেন। সেখানকার প্রাণহীন প্রস্তরসঙ্কুল ভূমি দেখে তিনি বলতে পারেন- এ কেউ সৃষ্টি করেন নি। অনাদিকাল থেকে এটা ছিল। তার এই বক্তব্যে কেউ তেমন বাধা দিবে না। কিন্তু তিনি যদি মঙ্গল গ্রহে হাঁটতে হাঁটতে একটা ডিজিটাল নাইকন ক্যামেরা পেয়ে যান তা হলে তাকে তখন বলতেই হবে, এই ক্যামেরা আপনা আপনি হয় নি। এর একজন নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা আছে। মনে করা যাক, ক্যামেরা হাতে তিনি আরো কিছু দূর গেলেন। এমন সময় তার সামনে দিয়ে একটা খরগোশ দৌড় দিল। যে খরগোশের চোখ নাইকন ক্যামেরার চেয়েও হাজার গুণ জটিল বা ভাল। তখন কি তিনি স্বীকার করবেন যে, এই খরগোশের কেউ একজন সৃষ্টিকর্তা আছে?"- রঙপেন্সিল।
৩৩) তার ডাক নাম হিমু। ভালো নাম হিমালয়। বাবা আগ্রহ করে হিমালয় নাম রেখেছিলেন যেন বড় হয়ে সে হিমালয়ের মত হয়- বিশাল ও বিস্তৃত, কিন্তু ধরা-ছোঁয়ার বাইরে নয়। হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়। ইচ্ছে করলে তিনি ছেলের নাম সমুদ্র রাখতে পারতেন। সমুদ্র বিশাল এবং বিস্তৃত। সমুদ্রকে হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়। তার চেয়েও বড় কথা, সমুদ্রে আকাশের ছায়া পড়ে। কিন্তু তিনি সমুদ্র নাম না রেখে রাখলেন হিমালয়। কঠিন মৌ পর্বতমালা, যার গায়ে আকাশের ছায়া পড়ে না ঠিকই কিন্তু সে নিজেই আকাশ স্পর্শ করতে চায়।-দরজার ওপাশে।
৩৪) যারা বুদ্ধিমান, তারা সাধারণত অহংকারী হয়। এটা দোষের নয়। যে জিনিস তোমার নেই, তা নিয়ে তুমি যখন অহংকার করো, সেটা হয় দোষের। -অন্যভুবন।
৩৫) একটা পরিবারে মায়ের ভূমিকা খুবই অদ্ভুত। পরিবারের যে কোন সদস্য যখন হাসে, মাকে হাসতে হয়। পরিবারের যে কোন সদস্য যখন দুঃখিত হয়, মাকে দুঃখিত হতে হয় । এটা হল পরিবারের দাবি। পরিবার এমন অন্যায় দাবি মা ছাড়া অন্য কারো ওপর করে না।"-মীরার গ্রামের বাড়ী।
৩৬) তুমি স্বাধীন হওয়ার যোগ্য হলেই স্বাধীনতা পাবে। ভিক্ষা করে কখনও স্বাধীন হওয়া যায় না।"-আমি কেউ না।
৩৭) বড়দের পোষ মানানো সহজ, শিশুদের পোষ মানানো কঠিন। ভয়ঙ্কর কঠিন। কারণ শিশুরা অনেক কিছু বুঝতে পারে, বড়রা পারে না।"-বাঘবন্দি মিসির আলি।
৩৮) মায়ের চেয়ে যদি অন্য কারোর প্রতি বেশি দরদ হয় তারে বলে ভান। ভান হলো শয়তান।"-আসমানীরা তিন বোন পৃথিবীর নিয়মই হচ্ছে ক্ষমতাবানকে ভয় করা।"-অন্যভুবন।
৩৯) আমার শৈশবটা কেটে গেছে দুঃখমেশানো আনন্দে-আনন্দে। যতই দিন যাচ্ছে সেই আনন্দের পরিমাণ কমে আসছে। আমি জানি, একসময় আমার সমস্ত পৃথিবী দুঃখময় হয়ে উঠবে। তখন যাত্রা করব অন্য ভুবনে, যেখানে যাবতীয় আনন্দ বেদনার জন্ম।"-আমার ছেলেবেলা।
৩৯) 'না' বলতে পারাটা খুব বড় গুন রে, মা। বেশিরভাগ মানুষ 'না' বলতে পারে না। এতে তারা নিজেরাও সমস্যায় পড়ে, অন্যদেরও সমস্যায় ফেলে। আমার বাবা কখনো না বলতে পারতেন না। যে যা বলত- তিনি বলতেন আচ্ছা। শুধু এই কারনেই সারাজীবন তিনি একের পর এক সমস্যার ভেতর দিয়ে গেছেন।-মেঘ বলেছে যাব যাব।
৪০) কেউ কারো মত হতে পারে না। সবাই হয় তার নিজের মত। তুমি হাজার চেষ্টা করেও তোমার চাচার বা বাবার মত হতে পারবে না। সব মানুষই আলাদা।"-অপেক্ষা।
৪১) একটা বয়সে প্রতিটি যুবক কিছু দিনের জন্য কার্ল মার্কস্ হয়ে যায়। নিপীড়িত অবহেলিত মানুষের জন্য কিছু করতে হবে- এই ভূত মাথায় ভর করে। এইটা হলো এক ধরণের ভাইরাস সংক্রমণ। ভাইরাসের কোনো ওষুধ নেই। এই অসুখেরও কোনো ওষুধ নেই। কিছু দিন পর আপনাআপনি ভাইরাস মারা যায়। রোগী সেরে ওঠে।"-শুভ্র গেছে বনে।
৪২) নামীদামি রেস্টুরেন্টের চায়ের চেয়ে রাস্তার পাশের সস্তা দোকানগুলোর চা ভালো হয়।"-হরতন ইশকাপন।
৪৩) যারা মিথ্যা বলে না তারা খুব বিপদজনক। তারা যখন একটা দুইটা মিথ্যা বলে তখন সেই মিথ্যাকে সত্য হিসাবে ধরা হয়। এক হাজার ভেড়ার পালের মধ্যে একটা নেকড়ে ঢুকে পড়ার মতো। একহাজার সত্যির মধ্যে একটা মিথ্যা। সেই মিথ্যা হবে ভয়ংকার মিথ্যা।"-মেঘের উপর বাড়ি।
৪৪) কবি শুনে মেয়েরা খানিকটা দ্রবীভূত হয়। পুলিশে কখনো হয় না। পুলিশের সঙ্গে কবিতার নিশ্চয়ই বড় ধরনের কোন বিরোধ আছে।"-ময়ূরাক্ষী।
৪৫) ছেলেদের চেহারা তেমন একটা পাল্টায় না। মেয়েদেরটা পাল্টাতে থাকে। কুমারী অবস্থায় এক রকম, বিয়ের কথা পাকাপাকির সময় অন্য রকম, বিয়ের পর আরেক রকম, আবার মা হবার সময় এক দফা পাল্টায়। দ্বিতীয় দফা পাল্টায় শাশুড়ি হবার পর।"-বৃষ্টিবিলাস।
৪৬) কোনো পুরুষ মানুষের পক্ষে একা একা সারা জীবন কাটানো সম্ভব না। পুরুষদের নানান ধরনের চাহিদা আছে। ভদ্র চাহিদা, অভদ্র চাহিদা। ওদের চাহিদার শেষ নেই। -মেয়েরা কি তার থেকে মুক্ত? -মেয়েরাও তার থেকে মুক্ত না। তবে মেয়েরা ব্যক্তিগত চাহিদার কাছে কখনো পরাজিত হয়না। পুরুষরা হয়।"-আমিই মিসির আলি।
৪৭) ফিকশন রাইটারের ফিকশন বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য একটা ঘটনার এমন বর্ণনা হতে হবে, যেন মনে হয়- এটাই তো হবে।"-বলপয়েন্ট।
৪৮) মেয়েরা পুরাপুরি পানির মত। নিজের আকৃতি নেই। যে পাত্রে রাখা হচ্ছে সে পাত্রের আকার ধারণ করছে"-ছায়াবিথী।
৪৯) হাতে মশাল থাকলেই আগুন জ্বালাতে ইচ্ছা করে। হাতে তলোয়ার থাকলে কোপ বসাতে ইচ্ছা করে। বন্দুক থাকলে ইচ্ছা করে গুলি করতে। মানব চরিত্র বড়ই অদ্ভুত! আচ্ছা, কারোর হাত ভর্তি ফুল দিয়ে দিলে সে কী করবে? ফুল বিলাতে শুরু করবে?"-জোছনা ও জননীর গল্প।
৫০) মেয়েরা দুশ্চিন্তা করতে খুবই পছন্দ করে। দুশ্চিন্তার কোনো বিষয়ই না, এসব নিয়েও তারা দুশ্চিন্তা করে।"-আজ চিত্রার বিয়ে।
৫১) খারাপ সংবাদের নিয়ম হলো, একটা খারাপ সংবাদের পর পর দ্বিতীয় খারাপ সংবাদটা আসে। খারাপ সংবাদ কখনও একা আসে না।"-আজ আমি কোথাও যাব না।
৫২) একজন মানুষের জন্য অন্য একজন মানুষের অস্থিরতা দেখতে এত ভালো লাগে। এই অস্থিরতার নামই কি ভালোবাসা? 'আমি তোমাকে ভালোবাসি' এই বাক্যটার মানে কি? আমি তোমার জন্য অস্থির হয়ে থাকি? কে জানে ভালোবাসার মানে কী?"-আজ আমি কোথাও যাব না।
৫৩) সব মানুষের অন্তত একবার করে হলেও জীবন গোড়া থেকে শুরু করার সুযোগ থাকলে ভাল হত। বড় ধরনের ভুলগুলোর একটি অন্তত শোধরানো যেত।"-সাজঘর।
৫৪) মৃত্যু হচ্ছে একটা শাশ্বত ব্যাপার। একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আমরা যে বেঁচে আছি এটাই একটা মিরাকল।"-কবি।
৫৫) যে পাখি যত সুন্দর তার কণ্ঠস্বর তত কুৎসিত। যেমন ময়ূর। সে দেখতে সুন্দর কিন্তু তার কণ্ঠস্বর কর্কশ। একমাত্র ব্যতিক্রম কাক। সে নিজে অসুন্দর, তার কণ্ঠস্বরও অসুন্দর"-জোছনা ও জননীর গল্প।
৫৬) মৃত্যু ভয় বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ। শুধু মাত্র নির্বোধদেরই মৃত্যু ভয় থাকে না।"
৫৭) কোন মানুষই মহাপুরুষ না! এই পৃথিবীতে শুধু একটা জায়গাতে মহাপুরুষরা বাস করেন। আর কোথাও বাস করেন না। মহাপুরুষরা কোথায় বাস করেন? ডিকশনারিতে!-যদিও সন্ধ্যা।
৫৮) আত্মহত্যা সহজ পথ, তবে খুবই নিম্নমানের পথ। আত্মহত্যা খুনের চেয়েও খারাপ। খুন করার পর অনুশোচনার একটা সুযোগ থাকে। আত্মহত্যার পর সেই সুযোগও থাকে না"-মেঘের ছায়া।
৫৯) জগতের যত বড় বড় Crime তার সবের পেছনে একটা মেয়ে মানুষ থাকবে। শুরুতে সেটা মাথায় রাখলে সুবিধা হয়। ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়ে গেল হেলেন নামের নাকবোঁচা এক মেয়ের জন্য"-মাতাল হাওয়া।
৬০) কিছু কিছু পুরুষ আছে, যারা রূপবতী তরুনীদের অগ্রাহ্য করে এক ধরনের আনন্দ পায়। সচরাচর এরা নিঃসঙ্গ ধরনের পুরুষ হয় এবং নারীসঙ্গের জন্য তীব্র বাসনা বুকে পুষে রাখে।"-অনীশ।
৬১) আমরা মুখে অনেক কথা বলি না, কিন্ত আমাদের শরীর বলে। মনের ভেতরের কথা শরীর প্রকাশ করে দেয়। আমাদের মন অনেক কিছু বলতে চায় না। কিন্ত শরীর বলে দেয়"-মিসির আলি! আপনি কোথায়?
৬২) ব্যবহার না করলে বুদ্ধি কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়। তোমাকে যদি একমাস একটা ঘন অন্ধকার ঘরে আটকে রাখা হয়, একবারও যদি সেই ঘরে আলো না জ্বালা হয়, তাহলে একমাস পর দেখা যাবে তুমি চোখে কিছুই দেখছ না। তুমি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেছ। এটা বৈজ্ঞানিক সত্য।-শুভ্র গেছে বনে।
৬৩) সুখ এবং দুঃখ আসলে একই জিনিস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুখ বদলে গিয়ে দুঃখ হয়ে যায়। দুঃখ হয় সুখ। জীবনের প্রবল দুঃখ ও বেদনার ঘটনাগুলি মনে পড়লে আজ আমার ভালো লাগে। প্রাচীন সুখের স্মৃতিতে বুক বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়।"-অচিনপুর।
৬৪) বড় ধরনের বিপদের সামনেই একজন মানুষ অন্য একজনের কাছে আশ্রয় খুঁজে। তাই পৃথিবীতে ভয়াবহ বিপদ আপদেরও দরকার আছে"-পারাপার।
৬৫) একজন ঘুমন্ত মানুষের সঙ্গে আরেকজন ঘুমন্ত মানুষের কোন প্রভেদ নেই। জাগ্রত মানুষই শুধু একজন আরেকজনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়।" -আঙুল কাটা জগলু।
৬৬) আলো যেমন চারপাশ আলো করে তোলে একজন পবিত্র মানুষও তার চারপাশ আলো করে তুলবেই"-পারাপার।
৬৭) মিথ্যা কখনো এক লাইনে বলা যায় না। মিথ্যা বলতে হয় আটঘাঁট বেঁধে। সত্যি কথার কোন ডিটেল ওয়ার্কের প্রয়োজন হয় না, কিন্ত মিথ্যা মানেই প্রচুর ডিটেল কাজ।" -আকাশ জোড়া মেঘ।
৬৮) যে জিনিস চোখের সামনে থাকে তাকে আমরা ভুলে যাই। যে ভালোবাসা সবসময় আমাদের ঘিরে রাখে তার কথা আমাদের মনে থাকে না। মনে থাকে হঠাৎ আসা ভালোবাসার কথা।"-বহুব্রীহি।
৬৯) লজিক হচ্ছে সিঁড়ির মতো। লজিকের একটা সিঁড়িতে পা দিলে অন্য সিঁড়ি দেখা যায়।"-হরতন ইশকাপন।
৭০) মদ না খেয়েও মানুষ মাতাল হতে পারে। একটি ভালো কবিতা পড়ে মাতাল হতে পারে, একটি সুন্দর সুর শুনে মাতাল হতে পারে, প্রেমে পড়েও মাতাল হতে পারে।"-দিনের শেষে।
৭১) ঘরে খাবার পানি না থাকলে সঙ্গে সঙ্গে পানির পিপাসা পেয়ে যায়। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি শুকিয়ে আসে। ঘরে পানি থাকলে কখনো এত তৃষ্ণা পেত না।"-বাঘবন্দি মিসির আলি।
৭২) অনেকদিন পর মেয়ে বন্ধুরা একত্রিত হলে একটা দারুণ ব্যাপার হয়। আচমকা সবার বয়স কমে যায়। প্রতিনিয়ত মনে হয় বেঁচে থাকাটা কি দারুণ সুখের ব্যাপার।"-নির্বাসন।
৭৩) লেখালেখি এক ধরনের থেরাপি। ব্যক্তিগত হতাশা, দুঃখবোধ থেকে বের হয়ে আসার পথ। আমি এই থেরাপি গ্রহণ করে নিজের মনকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করি।"-বলপয়েন্ট।
৭৪) গাঁজা গাছের স্ত্রী-পুরুষ আছে। দুই ধরণের গাছেই ফুল হয়। তবে শুধু স্ত্রী গাছই গাঁজা, ভাং এবং চরস দেয়। পুরুষ গাছের মাদক ক্ষমতা নেই। ধিক পুরুষ গাঁজা বৃক্ষ!"-বৃক্ষকথা।
৭৫) মেয়ে জাতটা বড় অদ্ভুত। কী বললে পুরুষ মানুষের মন ভালো হয় সেটা যেমন জানে, আবার কী বললে পুরুষ মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায় সেটাও জানে।" -জনম জনম।
৭৬) আধুনিক সমাজে বাস করার এই অসুবিধে। মনের কথা খোলাখুলি কখনো বলা যায় না। একটি মেয়েকে ভালো লাগলেও সরাসরি তাকে সেই কথা বলা যাবে না। অনেক ভণিতা করতে হবে।"-আকাশ জোড়া মেঘ।
৭৭) মানুষ পৃথিবীতে দুই হাত নিয়ে এসেছে কাজ করার জন্যে ভিক্ষা করার জন্যে না। আল্লাহ্ যাদি চাইতেন মানুষ ভিক্ষা করবে তাহলে তাকে একটা হাত দিয়েই পৃথিবীতে পাঠাতেন। ভিক্ষার থালা ধরার জন্য একটা হাতই যথেষ্ট।"-বাঘবন্দি মিসির আলি।
৭৮) মানুষের সব শখ মেটা উচিত নয়। একটা কোনো ডিসস্যাটিসফেকশন থাকা দরকার। তাহলে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। সব শখ মিটে গেলে বেঁচে থাকার প্রেরণা নষ্ট হয়ে যায়। যে সব মানুষের শখ মিটে গেছে, তারা খুব অসুখী মানুষ।" -দেবী।
৭৯) বিবাহ এবং মৃত্যু এই দুই বিশেষ দিনে লতা-পাতা আত্মীয়দের দেখা যায়। সামাজিক মেলামেশা হয়। আন্তরিক আলাপ আলোচনা হয়।” একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁ ঝিঁ পোকা।
৮০) পুরুষের হচ্ছে ভালোবাসা ভালোবাসা খেলা। মেয়েদের ব্যাপার অন্যরকম, তাদের কাছে ভালোবাসার সঙ্গে খেলার কোন সম্পর্ক নেই। একটা মেয়ে যখন ভালোবাসে তখন তার ভালোবাসার সাথে অনেক স্বপ্ন যুক্ত হয়ে যায়। সংসারের স্বপ্ন, সংসারের সঙ্গে শিশুর স্বপ্ন। একটা পুরুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন সে শুধু তার প্রেমিকাকেই দেখে আর কাউকে নয়।"- সে আসে ধীরে।
[সংগৃহীত ও সম্পাদিত। তথ্যসূত্র - উইকিপিডিয়া।]
কু-সংস্কার
ক ন ক কা ন্তি ম জু ম দা র
কিছু বোদ্ধা হিন্দুদের দ্বারাই কু-সংস্কার নিয়ে চেঁচামেচি বেশী। কোনো ধর্মাচরণ না করেও একজন হিন্দু জীবন-যাপন করে করতে পারে। অন্য কোন ধর্মের এতটা ছাড় দেওয়া নেই। মুসলমান বা খ্রীষ্টান এরা কিন্তু এত উদাসীন থাকে না থাকতে পারেনা। সহনশীলতা এতটাই হিন্দুধর্মে। তাই এত নাচন-কোঁদন।
কু-সংস্কার এই কথাটি বহুল প্রচলিত শব্দ। আমার জিজ্ঞাস্য কোনটা কু আর কোনটি সু তার বিচার করা কি হয়েছে? মুখে মুখে প্রচারের আলোকে আলোকিত। তাই ফাঁকা আওয়াজ না করে চিন্তান্বিত ব্যাখ্যায় আসি। শুরু করি সরস্বতী পূজোর আগে কুল খাওয়া নিয়ে। অতীতে যখন এই প্রবচন চালু হয় তখন ঐসময় কুল আজকের মতো বেটাইমে মিলতো না। গাছের কুলের স্বাদ তখন কষা, যা খেলে কাশি হোত। তাই বাচ্চাদের বাধা বিধিনিষেধ দেওয়া সরস্বতী পূজোর আগে কুল খেলে বিদ্যে হয়না। এটি কি কু-সংস্কার না বিজ্ঞান ভিত্তিক কথা। আসি পিতা-মাতার প্রয়াণে সন্তানের হবিষ্যি পালণ প্রসঙ্গে- যে পিতা-মাতার সন্তান তাঁদের দ্বারা প্রতিপালিত, পিতা বা মাতার মৃত্যুর পর ঐ আচার-আচরণ সন্তানের দ্বারা পালণ করার মধ্য দিয়ে স্মরণ করা তাঁদের উপযোগিতা, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্পণ করা, মনে করিয়ে দেওয়া তাঁদের অবদান। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে স্মরণ করাই হচ্ছে শ্রাদ্ধ। এবার আসি
উপোস করা প্রসঙ্গে- পূজোআর্চায় উপোস করার কারন- ঐ সময়টুকুতে যাতে প্রস্রাব পায়খানায় যেতে না হয়, বায়ু নিঃসরণ না হয় তাই এই বিধান। এর মাধ্যমে মনকে নির্মল রাখা। পূজোর কাজ করার সময় কথা বলা নিষিদ্ধ। কিন্তু কেন? কথা বললে মুখ দিয়ে থুতু ছিটতে পারে। আর তা পূজার সামগ্রীতে যাবে। প্রসাদে জীবাণু আসবে। খেতে বসে কথা বলতে নেই। কারন সেই একই। আগে পংক্তি ভোজ ছিলো। পার্শ্ববর্তী অন্যের খাবারে মুখের থুতুসহ খাবার ছিটকে যেতে পারে। বিষম খেতে পারে। এরচেয়েও বড় কারণ খাওয়ার সময় কথা বললে হাওয়া প্রবেশ করে পেটে হজম ব্যঘাত ঘটাবে। এটি আমি ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞায় জেনেছি।
জপ-ধ্যান করার পেছনেও কোন ধর্মীয় সংস্কার নেই, আছে বিজ্ঞানসম্মত কারণ। জপ ধ্যানের মাধ্যমে সারাদিনের পরিশ্রান্ত ক্লান্ত মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেওয়া। অর্থাৎ মেডিটেশান। বিস্তারিত করতে চাইছি না। কেউ না বুঝতে চাইলে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জেনে নেবেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে একটু মহাকাব্য রামায়ন মহাভারত ছুঁয়ে যাই। শেষ করি। পুষ্পকরথ আর কিছু নয়। পরবর্তীতে প্লেন আবিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে। অগ্নিবান আসলে গালফ্ কান্ট্রিতে সাদ্দাম নিধনকালীন মিশাইল নিক্ষেপ বুঝিয়েছে। ভারতের মেধা প্রযুক্তি সেকালে কতো উন্নত ছিল এতে বোঝা যায়। হাঁড়িতে শত পুত্রের জন্ম কিন্তু টেস্ট টিউব বেবির ইঙ্গিত দেয়। এখন এক নারীর পঞ্চস্বামী-- মনুষ্য চাহিদার প্রতিফলন। এর অর্থ সর্বগুণান্বিত একজনকে স্বামীরূপে পাওয়া। কিন্তু বাস্তবে একটি মানুষের মধ্যে সর্বগুণের প্রকাশ তো সম্ভব নয়। কল্পনার চেয়ে কোন আকার আকৃতির দ্বারা বস্তু বা দেবতার আরাধনা সহজতর হিন্দুধর্মের বহু দেবতার ব্যাখ্যায়িত ব্যাখ্যান তো তারই প্রতিফলন। নিরাকার কোন কিছুই ধ্যানে আনা বা পূজার্ঘ্য সম্ভব নয়। তাই হিন্দুধর্মের শৌর্য-বীর্যের নানারূপ দ্বারা আরাধনা নানা দেবতা রূপে। পৌঁছনো সেই একের কাছেই। এরপরও যারা কু-সংস্কার নিয়ে চেঁচামেচি করবেন করুন। কবির কথায় "আমার হাতে নেই ভুবনের ভার"।
চর্যাপদ কাব্যের ছন্দ ও অলংকার
ছ ন্দা চ ট্টো পা ধ্যা য়
রাণারের গত শারদীয়া সংখ্যায় আমি বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের কাব্যমূল্য নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এবার হিমেল সংখ্যায় চর্যার কাব্যের ছন্দ ও অলংকার সম্বন্ধে আলোচনা করব।
চর্যার ছন্দোরীতি প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মতবিরোধের অবকাশ আছে। তবে এটুকু বলা যায় যে, চর্যার ক্ষেত্রে অপভ্রংশ এবং অবহট্টেরই প্রাধান্য দেখা যায়। সংস্কৃত জাতিছন্দের প্রভাবও আছে। কিন্তু চর্যার মাত্রাচ্ছন্দের প্রকৃতি স্বতন্ত্র। কারণ, এগুলি গেয় কবিতা বলে অক্ষরে মাত্রা পূর্ব থেকে সুনির্দিষ্ট নয়। চর্যার ছন্দে পর্ব গঠনের রীতি পৃথক। অক্ষরমাত্রিক বৈদিক ভাষায় অক্ষরের সংখ্যা এবং স্বরের উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়েই ছন্দ নিয়ন্ত্রিত হতো। কিন্তু প্রাকৃতের সমকালে অক্ষরের নির্দিষ্টতার পরিবর্তে অক্ষরের ওপর যতিপাতই ছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলো। সংস্কৃতে প্রাধান্য পেতো জাতিচ্ছন্দ, এখানে মাত্রাচ্ছন্দ। প্রাকৃতের পরবর্তী অপভ্রংশের স্তরে মাত্রাচ্ছন্দ পরিবর্তিত হয়ে মাত্রাসমকতার সৃষ্টি ও যথেষ্ট পরিমাণে অন্ত্যানুপ্রাসের ব্যবহার প্রচলিত হলো। প্রাকৃত পৈঙ্গলে পাদচূকলক, পজঝাড়ি, আড়িল্লা, উল্ললো প্রভৃতি বহু ছন্দের বহু দৃষ্টান্ত চর্যাপদাবলীতে পাওয়া যায়। এগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এখানে মাত্রাপ্রধান পাদাকুলক ছন্দ ব্যবহারেরই প্রবণতা বেশী। এই রীতির ছন্দে প্রতিটি চরণে ষোলো মাত্রা। তেরো অক্ষর। যেমন-- আড়িল্লা রীতিতে-- করণা পিহাড়ি খেলহুঁ নঅবল"-- পজঝড়ি রীতিতে-- "রবিশশী কুণ্ডল কিউ আভরণে"--। এইভাবে দেখা যায় যে, মাত্রাপ্রধান পাদাকুলক ছন্দের এই অক্ষর অভিমুখীনতাই পরবর্তীকালের অক্ষর-বৃত্ত পয়ার ছন্দের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে। ত্রিপদী ছন্দরীতির পূর্বাভাসও এখানে অল্পস্বল্প পাওয়া যায়। যেমন-- -"গঙ্গা জউনা মাঝেরে বহই নাই।। তঁহি বুড়িলী মাতঙ্গী জোইআ
লীলে পার করই।।"--
উল্লাল রীতিতে (৮+৮+৮+৪)।
মরুমরিচি। গন্ধবণঅরি। দাপণ পড়িবিম্বু। জইসা। ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন--
-"গীতগোবিন্দর ছন্দ পরবর্তীকালে বাংলা পয়ার ত্রিপদীকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করিয়াছে সন্দেহ নাই। কিন্তু চর্যার রচনাকাল গীতগোবিন্দ অপেক্ষাও প্রাচীন বলিয়া বাংলা ছন্দের বিবর্তনে চর্যাগীতির ছন্দ বিশেষ মূল্যবান প্রভাব বিস্তার করিয়াছে।"
চর্যার অলংকার-- চর্যাগীতি সিদ্ধাচার্যদের গুহ্য সাধনমূলক কবিতা। এর ভাষার নাম সন্ধ্যা--, অর্থাৎ গুঢ়ার্থব্যঞ্জক প্রহেলিকাময় সাংকেতিক ভাষা। সুতরাং এক কথায় বলা যায় যে, চর্যাগীতিগুলি অলংকৃত কাব্যকলা। অর্থ প্রকাশের জন্য এখানে যে শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়েছে তা শ্লিষ্ট অর্থাৎ শ্লেষ অলংকারের সৌজন্যে দ্ব্যর্থবোধক। অলংকার শাস্ত্রের বিধি-বিধান অনুসারে কবিগণ বিভিন্ন অলংকার প্রয়োগ করে তাঁদের উপলব্ধির বিষয়কে প্রকাশ করেছেন। চর্যাপদের টীকাকার মুনিদও তাঁর -"নির্মলগিরা"- টীকায় ব্যাজ রূপক এবং উৎপ্রেক্ষা অলংকারের উল্লেখ করেছেন।- "সোনে ভরিতী করুণা নাবী"- এর ব্যাখ্যায় টীকাকার বলেছেন--"করুণেতি সন্ধ্যাভাষয়া ত্বমেব বোধিচিত্তং নাবীতি উৎপ্রেক্ষালংকার পরং বোদ্ধব্যম্ "- সুতরাং চর্যার অলংকার কৃত্রিম কাব্যকলা মাত্র মনে করার কারণ নেই। পদগুলিতে অনুপ্রাস, রূপক, বিরোধাভাস, অতিশয়োক্তি প্রভৃতির প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে।
ব্যাজোক্তি,ব্যাজস্তুতি প্রভৃতিতে শ্লেষ অলংকার ব্যবহার করে দ্ব্যর্থবোধক সৌন্দর্য প্রকাশ করা হতো চর্যাপদে। যেমন- "কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল"--, -" মনতরু পাঞ্চইন্দি তসুসাহা"- ইত্যাদি পদে যেমন প্রচলিত অর্থ বোঝা যায়, তা তেমনই গুঢ়ার্থের ক্ষেত্রেও ইঙ্গিত দেয়।
চর্যাপদে নৌকাযাত্রার চিত্রগুলির মধ্যে উৎপ্রেক্ষার প্রকাশ আছে। যেমন-"সোনে ভরিতী করুণা নাবী"-- এখানে এক কোটিক সংশয় আছে, অভেদ কল্পনার সম্ভাবনা আছে। সাধকের চিত্ত যেন একখানি নৌকা। মুনিদও লিখেছেন যে, উৎপ্রেক্ষা অলংকার দিয়ে নৌকাচালনার বর্ণনাচ্ছলে কবি মহা সুখরূপ সমুদ্রে গমনের ব্যাঞ্জনা দিয়েছেন।- "মনতরু পাঞ্চইন্দি তসু সাহা"- পদটিরও উৎপ্রেক্ষায় রূপকের প্রাধান্য। পদটিকে সাঙ্গ রূপকের দৃষ্টান্তও বলা চলে। গাছ, শাখা, পাতা, ফল ইত্যাদি রূপকধর্মে ইন্দ্রিয়, আশা, বাসনা, কামনাদি অভেদে কল্পিত হওয়ায় বৃক্ষের তথা মনের অঙ্গে অঙ্গে রূপক বিন্যাস হয়েছে।
বিশুদ্ধ অভেদ কল্পনার রূপক ধর্ম চর্যাপদের বহু পদে দেখা যায়।- "কাআ তরুবর"- -"মুসা পবণা"- -" -"মন-পবন"- -"গঅন সমুদ্র "- প্রভৃতি প্রচুর রূপক সমাস ও অলংকার চর্যাপদে আছে।অতিশয়োক্তি অলংকার রূপকধর্মে উপমেয়গ্রস্ত হয় এবং অপ্রস্তুত প্রশংসা উপমানের বর্ণনার সাহায্যে ইঙ্গিতপূর্ণ হয়। হরিণ শিকার এবং ইঁদুর হত্যার কাহিনী অতিশয়োক্তি রূপে দৃষ্টান্তগ্রাহ্য। দাবা খেলার বিবরণ ও ডোমরমণীর প্রণয় প্রসঙ্গের বর্ণনার মধ্যে বহুস্থলেই উপমেয় তত্ত্ব আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
বিরোধমূলক অলংকার প্রয়োগ করা হয়েছে প্রহেলিকা চর্যার মধ্যে। ইংরেজি Epigram ও Oxymoron যেমন বাচ্যার্থে অসংগত, তাৎপর্যে গভীর চর্যার বহু পদই তদ্রুপ।-"রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ"-, -"বিহেঁ সম সুঝঅ "- -"মারমি ডোম্বী লেমি পরাণঅ"-- ইত্যাদি অজস্র পংক্তিতে বিরোধাভাস ও অসংগতির চমক সৃষ্টি করা হয়েছে। অতএব বলা যায় সাধক কবিরা অলংকার প্রয়োগের নৈপূণ্য দ্বারা কাব্যগুলির উৎকর্ষ সাধন করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের উৎস সন্ধানে চর্যাপদের কাব্যমূল্য।
বর্তমানে বাংলা সাহিত্যচর্চার উৎসাহ ব্যাপক হারে দেখা যাচ্ছে। এটা খুবই ভালো লক্ষ্মণ। কোন্ বিবর্তনের ফলে সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হলো, তা বাংলা সাহিত্যের মনোযোগী সব ছাত্র, পাঠকই জানেন। আজ আমি আদিযুগের বাংলা ভাষার সর্বাংশে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন -"বৌদ্ধগান ও দোহা"- নামক গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত চর্যাপদগুলি নিয়ে কিছু আলোচনা করবো। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছিলেন পণ্ডিতপ্রবর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়। বাংলা সাহিত্যের আদিগ্রন্থ এখনো চর্যাপদকেই বোঝানো হয়।
প্রাচীনতম বাংলা পদসঙ্কলন চর্যাগীতিকা মূখ্যতঃ তত্ত্ববাদের বাহক, গৌনতঃ কাব্য। যা মূলতঃ তত্ত্বদর্শনের মধ্যে বিধৃত এবং মুমুক্ষু চিত্তের কাছে অধ্যাত্ম আশ্বাসের ইঙ্গিত বহন করে। চর্যাপদ বিশুদ্ধ কাব্যের আদর্শে বিচার্য নয়। চর্যাপদ গুলি ছোট ছোট গীতিকবিতারই সমষ্টি। এদের বয়স প্রায় হাজার বছরের কাছাকাছি। বৌদ্ধতান্ত্রিক সহজিয়া সাধকগণই এই পদ গুলির রচনাকার। ঠিক সাহিত্যসৃষ্টির প্রেরণা নয়, রচনাগুলির সক্রিয় উদ্দেশ্য ছিলো সহজিয়া মতবাদের প্রচার। তার তান্ত্রিক ভাবধারা ও গুহ্য যোগসাধনার প্রকাশ। চর্যার সংখ্যা ৪৬/৪৭ টি। মোটামুটি ২৪ জন পদকর্তার নাম উল্লেখ করেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়।
চর্যাপদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত রসের আবেদন এবং বাক্ নির্মানের শিল্পকৌশল রক্ষিত হয়। কেউ কেউ কাব্যনির্মাতার পারিভাষিক রীতি অর্থাৎ আলঙ্কারিক বিচারপ্রক্রিয়ার সাহায্যে চর্যার ছন্দ, অলংকার
ধ্বনি, বক্রোক্তি, রস বিশ্লেষণ করে এর কাব্যধর্ম প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। এই রীতির কাব্যবিচার নিতান্তই বাহ্যিক। চর্যাকারগণ সচেতনভাবে কাব্য রচনার প্রয়াস পাননি। তাঁরা একটা বিশেষ ধরনের তত্ববাদ ও গুহ্য সাধনাকে প্রাকৃত অপভ্রংশের প্রকীর্ণ কবিতার মতো স্বল্পতম আয়তনের মাধ্যমে নানা সংকেতের সাহায্যে ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন।
যে ভাষায় চর্যা লেখা হয়েছিল তাকে বাংলা তো নয়ই, একটা অপরিচিত ভাষার মতো সন্দেহ হয়।কারণ বাংলা ভাষা তখনো সৃজ্যমান, সবেমাত্র অপভ্রংশের খোলস ছেড়ে স্বতন্ত্র একটি রূপ নিতে শুরু করেছে। তাই এর বিশেষ আদল বুঝতে গেলে ভাষাতাত্বিক গবেষণার প্রয়োজন হয়। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন চর্যাপদগুলির বহিঃরূপ ও অন্তর্নিহিত রূপের অর্থবৈষম্য আছে। চর্যাগীতির আসল রহস্য তাঁরাই বুঝবেন, যাঁরা বৌদ্ধ সহজপন্থা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। একটি পদ উদ্ধৃত করলে বোঝা যাবে,
-"চিঅ সহজে শূন সংপুন্ন।
কান্ধবিয়োএঁ মা হোহি বিসন্না।
ভন কইসে কাহ্ন নাহি।
ফরই অনুদিন তৈলোএ পমাই।
মূঢ়া দিঠ নাঠ দেখি কাঅর।
ভাগ-তরঙ্গ কি সোষই সাঅর।
মূঢ়া অচ্ছন্তে লোঅ ন পেখই।
দুধ-মাঝে লড় অচ্ছন্তে ন দেখই।
ভব জাই,ণ আবই এথু কোই।
অইস ভাবে বিলসই কাহ্নিল জোই।।"- পদটিতে ব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে একালের বাংলা ভাষার বিস্তর প্রভেদ। এর আদল অনেকটা ভারতীয় মধ্যযুগের আর্যভাষা,পালি ও প্রাকৃতের শেষ স্তর অপভ্রংশেরই মতো। আর রূপক-উপমাদি প্রয়োগের মাধ্যমে এই পদে যা প্রচারিত হয়েছে, তা সহজসিদ্ধাদের গুঢ় তত্বকথাই বটে। এতে সহজসাধক কৃষ্ণাচার্য সিদ্ধাবস্থায় তাঁর অনুভবের কথা বলেছেন। জগতের অনিত্যতা সম্বন্ধে তিনি জ্ঞানলাভ করেছেন।
দেখা যাচ্ছে, তত্বদর্শনের কথা বলতে গিয়ে চর্যাগীতিকার নানা রূপক, প্রতীকের ও চিত্রকল্পের সাহায্যে উদ্দিষ্টার্থকে মনোরম করে তুলতে চেয়েছেন। এই চিত্র প্রতীক গুলি একদিকে যেমন উদ্দিষ্ট অর্থকে সংহত আকারে প্রকাশ করেছে, তেমনই চিত্রকল্প ও রূপকল্পকেও আবার অজ্ঞাতসারে একটা শিল্পমর্যাদা দিয়েছে। অনেক সময় রূপক ও প্রতীকের সাহায্যে দূরূহ তত্বকেও স্পষ্টতর করা হয়েছে। যেমন-- শরবৃক্ষ (১),ভবনদী পারাপার (৫), হরিণশিকার(৬),ডোম্বী ও শবরীর আৎষঙ্গ(১০,২৮),শবর ও শবরীর মদমত্ত উল্লাস(৫০), দরিদ্রা গর্ভিনী রমনীর মনোবেদনা(২০), গৃহদাহ(৪৭),জলদস্যুর আক্রমণ (৪৯), প্রভৃতি বাহ্যিক রূপকের সাহায্যে আচার্যগণ চর্যার গুঢ় রহস্য অদীক্ষিতের নিকট সংবৃত রাখলেও দীক্ষিতের নিকট বিবৃতই করেছেন। এর মধ্যে কোথাও বা চিত্রকল্প, সৌন্দর্যানুভূতি, কোথাও বা লোকজীবনের প্রতিচ্ছায়া ধরা পড়েছে। একটি চিত্র দেখা যাক-- যখন চারদিক ঘিরে হাঁক পড়ে, মাংসলোলুপ শিকারীর দল হরিণকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়, মৃগের নিজের মাংসই যে তার শত্রু!! তখন আর্ত হরিণ আশ্রয় খুঁজে পায়না।-"হরিণা হরিণর নিলঅ ন জানী"- তবু হরিণী হরিণকে পথ দেখিয়ে দেয়। হরিণ মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়ে ছুটে বনান্তরে চলে যায়। এর মধ্যে হরিণীর যে প্রেমিকা সত্তার চিত্রটি ফুটে উঠেছে তার মানবিক মূল্য অনস্বীকার্য। আবার একটি ছবি বা মুভি দ্রুতধাবমান যদি দেখি? দ্রুত ধাবমান মৃগের আত্মরক্ষার জন্য উদ্দাম পলায়নের চিত্রটি সহজেই নান্দনিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
কাহ্নপাদ ডোম্বীকে বিবাহ করার জন্য পটহ, মাদল বাজিয়ে যাত্রা করলেন।বিবাহ অন্তে যৌতুক লাভ করলেন,-
-"অমুত্তর ধন্ন"-। সারারাত কেটে গেল -" অপহঁরহেঁ"- এর নিহিতার্থ যাই হোক না কেন, এর মধ্যে দিয়ে প্রেমের উল্লাসই উপলব্ধি হয়।পদ (১৯)।
চর্যাগীতিকার সবশেষ পদটি নরনারীর তীব্র আশক্তিপূর্ণ জীবনলীলা স্বল্পতম পরিবেশে চমৎকার ফুটিয়েছেন। যেমন--- শবরের বাড়ির চতুর্দিকে কাপাস ফুল ফুটেছে, রাত্রির আকাশ বেয়ে জ্যোৎস্না নেমেছে, কাঁকনিদানা পেকেছে। শবরী ও শবর কাঁকনিদানা থেকে প্রস্তুত আসব পানে মত্ত হয়ে উঠেছে। -"কভু না পাকেলারে শবরা শবরী মাতেলা, অনুদিন শবরো কিম্পি ন চেবই মহাসুঁহে ভোলা।"- একটি গৃহবধু টিলার ওপর বাস করে, পাড়াপড়শি নেই, নিরন্ন সংসার, তবুও অতিথি এসে ভীড় করে। ভেকের সংসারের মতো বহু অপত্যবিশিষ্ট দুঃখের জীবন। পদ(৩৩) এর ৩/৪ পর্ব গুলি তত্ত্বানুসন্ধিৎসুর নিকট গভীর অর্থবহ সন্দেহ নেই। কিন্তু দারিদ্রক্লিষ্ট গৃহিনীর জীবনটি স্বল্পতম রেখার সাহায্যে যেন ছোটগল্পের উপাদানে পরিণত হয়েছে। পদ (১০) এও তত্ত্বরসের অতিরিক্ত একটি আখ্যানের ইঙ্গিত করছে। কোথাও কোথাও পদকর্তা দুইচারিটি রেখার সাহায্যে অতি সহজেই পূর্ণতর চিত্রাঙ্কনে সক্ষম হয়েছেন। শুঁড়িনী চিকন বাকলে মদ বেঁধে রাখে।দুয়ারে সাংকেতিক চিহ্ন দেখে মদ্যপায়ীর দল হাজির হয়। সারি সারি চৌষট্টি সরায় সুরা ভরা আছে। তারা মদ গিলতে শুরু করলে আর উঠতেই চায়না। ছোট ছোট ঘড়ায় সরু নল দিয়ে মনের সাধে মদ গিলেই চলে। পদ(৩)। লক্ষ্যণীয় যে, কত সহজে স্বল্পতম বর্ণনায় শুঁড়িবাড়ী ও মদ্যপায়ীদের পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
শুধু চিত্রধর্মই নয়, গোটাকয় প্রহেলিকাজাতীয় চর্যার রচনাকৌশলও প্রশংসনীয়। কাছিম জাহিয়া পাত্রে ধরছে না। গাছের তেঁতুল কুমিরে খেয়ে ফেলে। উঠানকেই ঘরের মতো ব্যবহার করে।পদ(২)। কিংবা শাশুড়ি, ননদ, শালীকে মোর নাকে আনাত( অনাথ) করে কাহ্নপাদ কাপালিক হলেন।পদ(১২)। -"বলদ বিয়ালো, গাই বন্ধ্যা থাকলো।"- -"তিন সন্ধ্যা পাত্র ভরে ভালোই দোয়া হয়।"- -"যে বুদ্ধিমান সেই বুদ্ধিহীন"-। -"যে চোর সেই সাধু।"- -"রোজই শেয়ালে সিংহের সঙ্গে শোয়।"- এই রহস্য সংকেত করে চর্যার ঢেন্ঢনপাদ বলেছেন -"ঢেন্ঢনপাদর গীতি বিরলে বুঝঅ।"- চর্যা(৩৩)। অর্থাৎ তাঁর গান কম লোকেই বোঝে।
এই কারণেই চর্যাপদের ভাষাকে সন্ধ্যাভাষা বা সান্ধ্যভাষা বলা হয়।সন্ধ্যাবেলায় দিনের আলো নিবে গেলেও আঁধার পুরোপুরি নামে না। আলো আঁধারে একটা রহস্যময় অদ্ভূত সংমিশ্রণ ঘটে।চর্যাগীতি তেমনই এক রহস্যঘন দুর্বোধ্য ভাষা। যে ভাষাকে বুঝতে সম্যক ধ্যানের প্রয়োজন হয়। যদিও চর্যাকার গণ সম্পূর্ণ ধর্মীয় চেতনাবশে এগুলি রচনা করলেও তাঁদের মধ্যে রীতিমতো কবিত্বশক্তি ছিল।প্রতীকরূপের সাহায্যে চিত্রসৃষ্টি, আখ্যানের ইঙ্গিত, মানবচরিত্রের মধ্যে, সুখ-দুঃখ, বিরহমিলনের দৈনন্দিন জীবনচিত্রগুলি চর্যার দর্শন ও তত্বের নিষ্প্রাণতাকে কাব্যরসের স্পর্শে সজীবতা দান করেছে। অতএব প্রাচীনতম বাংলা সাহিত্যে নিদর্শন হিসেবে চর্যাগীতির মূল্য অসামান্য।
(এই প্রবন্ধ লেখার জন্য আমি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের সম্পাদিত বৌদ্ধগান ও দোহা এবং চর্যাচর্যবিনিশ্চয় গ্রন্থে উল্লেখিত কিছু তথ্য এবং ডঃ শহীদুল্লাহ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেনের মতো পণ্ডিতগনের লেখা, ভাষাতত্বের ইতিহাসের ওপর বিভিন্ন বই থেকে তথ্যঋণ গ্রহণ করেছি। তাঁদের আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।)
ছড়া ও শিশুকথা
অ নি ন্দি তা না থ
ছড়ার উৎপত্তি বা উদ্ভব, সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের প্রায় দেড় হাজার বছর পিছিয়ে যেতে হবে। বলা যায় সাহিত্যের আদি যুগে জনমানসের ভাব প্রকাশের মাধ্যম ছিলো লোকমুখে রচিত ছড়া। তাই বলা যায় লেখ্য সাহিত্যেরও পূর্বে ছড়াকারেরা লৌকিক সাহিত্য রচনা করেছিলেন এভাবেই। বাংলা সাহিত্যের আদিছড়ার উদাহরণ: চর্যাগীতির প্রথম পদ। ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে লৌকিক ছড়াগুলি কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকার প্রণীত 'খুকুমণির ছড়া' বইএ স্থান পায়। এই বইএর ভূমিকায় রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী ছড়াকে সাহিত্যের একটি অন্যতম শাখা হিসেবে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেন।
সাধারণ মানুষ ভাবেন ছড়া শুধুই শিশুদের কাব্যকথা। কিন্তু আধুনিক সাহিত্যিকেরা মনে করেন ছড়া- পদ্য, কবিতা, গীতিকবিতা, গল্প, নাটকের মতো সাহিত্যের অন্যান্য মূখ্য শাখাগুলির একটি।
ছড়ার বৈশিষ্ট্য: ১) ছড়া সাধারণতঃ স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। ২) এটি সুরঝংকারময় পদ্য। ৩) ছড়া অর্থপ্রধান নয়, ধ্বনিময়তা এর বৈশিষ্ট্য। ৪) ছড়ায় অন্ত্যমিল থাকবে। ৫) অর্থপ্রধান না হয়ে ধ্বনিময়তার আড়ালে ছড়া কিছুটা রহস্যময়, ভাব বা বক্তব্য সহজবোধ্য নয় বলে অর্থাৎ স্পষ্ট নয় বলে ছড়া পদ্য থেকে পৃথক।
ছড়ার প্রকারভেদ প্রসঙ্গে ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের 'লোক সাহিত্য' গ্রন্থের উল্লেখ করা যেতে পারে। এই গ্রন্থে ছড়াকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা: ১) লৌকিক ছড়া, ২) সাহিত্যিক ছড়া, ৩) আধুনিক ছড়া। এছাড়া অন্যভাবেও ছড়ার প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়, যেমন: ১) শিশুতোষ ছড়া, ২) রাজনৈতিক ছড়া, ৩) ছড়ার ছন্দাশ্রিত কিশোর কবিতা। কালক্রমে ছড়ার বিকাশ ও বিবর্তন ঘটার ফলে সাহিত্যে উন্নীত হলে ছড়াগুলিকে আরও সুসংহতভাবে শ্রেণীবিভাগ করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে আধুনিকভাবে বলা যেতে পারে ছড়া দু'প্রকার: ১) লোকজ ও সমাজসচেতনতায় সমৃদ্ধ ছড়া- এই প্রকার ছড়া অন্নদাশঙ্কর রায়ের মত সাহিত্যিকের হাত ধরে বিকশিত, যেমন: তেলের শিশি ভাঙল বলে/খুকুর পরে রাগ করো/তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ভারত ভেঙে ভাগ করো!/তার বেলা?/ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা/জমিজমা ঘরবাড়ী/পাটের আড়ত্ ধানের গোলা/কারখানা আর রেলগাড়ী!/তার বেলা?/চায়ের বাগান কয়লাখনি/কলেজ থানা আপিস-ঘর/চেয়ার টেবিল দেয়ালঘড়ি/পিয়ন পুলিশ প্রোফেসর!/তার বেলা?/যুদ্ধ জাহাজ জঙ্গী মোটর/কামান বিমান অশ্ব উট/ভাগাভগির ভাঙাভাঙির/চলছে যেন হরির-লুট!/তার বেলা? ২)অসংলগ্ন বা অর্থহীন শব্দসজ্জায় সজ্জিত হাস্যরসাত্মক ছড়া- এ ধরণের ছড়া সুকুমার রায়ের মতো সাহিত্যিকের হাত ধরে উৎকর্ষতা লাভ করেছে। যেমন: হাঁস ছিল সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)/হয়ে গেল "হাঁসজারু" কেমনে তা জানি না/বক কহে কচ্ছপে- "বাহবা কি ফুর্তি!/অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।"/টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারি শঙ্কা-/পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে কাঁচা লঙ্কা?/ছাগলের পেটে ছিল না জানি কি ফন্দি,/চাপিল বিছার ঘাড়ে, ধড়ে মুড়ো সন্ধি!/জিরাফের সাধ নাই মাঠে ঘাটে ঘুরিতে,/ফড়িঙের ঢং ধরি সেও চায় উড়িতে।/গরু বলে "আমারেও ধরিল কি ও রোগে/মোর পিছে লাগে কেন হতভাগা মোরগে?"/হাতিমির দশা দেখ,- তিমি ভাবে জলে যাই,/হাতি বলে এই বেলা জঙ্গলে চল ভাই।"/সিংহের শিং নেই, এই তার কষ্ট-/হরিণের সাথে মিলে শিং হল পষ্ট।
পৃথিবীর নানা ভাষায় ছড়ার প্রকাশ ঘটেছে। প্রাত্যহিক কাজে বের হবার সময় সংশ্লিষ্ট কাজের ভার লাঘব করার জন্য যখন সে বিষয়ে মুখে মুখে ছন্দ মেনে সহজ কথায় ছোট্ট কবিতা রচনা করে মনে মনে বা দলগতভাবে আওড়ানো হয় তখন সৃষ্টি হয় ছড়া। যেমন: মাছ ধরার কাজে বের হবার সময় হয়তো সৃষ্টি হয়েছিলো: "আয় রে আয় ছেলের পাল মাছ ধরতে যাই,/মাছের কাটা পায়ে ফুটিলে দোলায় চেপে যাই,/দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি গুনতে গুনতে যাই..." ছড়া যখন সুরে নিবদ্ধ হয়ে গুনগুন করে গাওয়া হয় তখন মিষ্টি ছন্দে মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। শিশুকে যখন আদর করে বলা হয় "খোকা যাবে রথে চড়ে..." তখন তার আনন্দ দেখে কে! ছড়া বিষয়টাই বেশ মজা ও আনন্দের। এসব ছড়া শুনলে শিশুরা হাসে খিলখিলিয়ে, আর হাতে তালি আর তালি। নিস্পাপ শিশুরা অথৈ আনন্দে আত্মহারা।
আগেই বলেছি ছড়ার প্রধান সম্পদ হলো ছন্দ। ডাঃ অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় বলেছেন-"ছড়া সাথে ঢাক ও ঢোলের মিল আছে "। ছড়ার বিষয় বস্তু নানা প্রকারের, যেমন: ছেলে ভোলানো, কান্না থামানো, ঘুম পাড়ানো, পশু-পাখি নিয়ে লেখা। মা-মাসী, দিদা-ঠাম্মারা এসব শুনিয়ে বিলিয়ে দেন তাঁদের স্নেহ ও ভালোবাসা। ছড়া শুনে শিশু মনে ভেসে ওঠে কল্পনার ছবি। এটা কে মেয়েদের গার্হস্থ্য জীবনের সাহিত্য বলা যেতে পারে। অর্থহীন শব্দ গুলোর ধ্বনিঝংকার শিশুর চিত্তকে আকৃষ্ট করে। এর যাদুধর্মিতা ওদের কাছে আর্কষনীয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- 'ছড়াগুলি শিশু সাহিত্যে, তাহারা মানব মনে আপনি জন্মিয়াছে'। এ যুগের ছড়া সাহিত্যিক হলেন- রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর, যোগীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, সুখলতা রাও প্রমুখ কবিগণ। ওঁনারা সাহিত্যের এই শাখাটির যাত্রাপথ কে সুগম করেছেন।
বিজ্ঞানসম্মত ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে সৃষ্ট ছড়া শিশুর ভাষা শিক্ষাকে সহজ ও সার্থক করে।
কবি ও কবিতা
ড রো থী দা শ বি শ্বা স
বর্তমানে যত কবি দেখি তত কবিতা পাইনা।
যিনি অন্তরের ভাব ও আবেগকে ছন্দে বর্ণে ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন তিনিই কবি। শিল্পীর মতই কবিও তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে অন্যের হৃদয়ে জায়গা করে নেন। এভাবে মানুষের হৃদয় মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অমরতা প্রার্থনা করে অজান্তেই। এই প্রার্থনা ক্ষণকালীন প্রয়োজন মেটানোর জন্য নয়, এ যে চিরকালীন প্রার্থনা। নিরন্তর অনুশীলণের দ্বারা স্থায়িত্ব লাভের প্রয়াস, তাই তো কবিদের কলম থামে না। তাই বলে সব লেখা কবিতা নয় ঠিকই। কিছু কিছু লেখাই কবিতা হয়ে ওঠে।
যেমন আমরা পুষ্টিলাভের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় নানাবিধ শস্য ও সব্জীর বীজ বপন করি। কিন্তু দেখেছি, স্থায়ী অরণ্য সৃজনের জন্য বনস্পতির বীজ সংগ্রহ করতে হয়। সাহিত্যও চিরস্থায়িত্ব পাক্, এটাই সাহিত্যপ্রেমীরা চান। তাই সাহিত্য-সমালোচকরা যতই বলুন "বর্তমানে যত কবি দেখি, তত কবিতা পাইনা" অর্থাৎ বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উচ্চমানের কবিতার বড় অভাব, ততই এই মত প্রতিষ্ঠিত হয় "সারবান সাহিত্যে উপস্থিত প্রয়োজন মেটে, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় সাহিত্যে স্থায়িত্বের সম্ভাবনা বেশী।"
শুধু যা মনে আসে অবলীলায় তাই লিখে গেলেই কিন্তু লেখা শিল্পগুণসমৃদ্ধ হয় না, পাঠকের প্রতি বার্তা থাকতে হবে, প্রাঞ্জল ভাষায় সঠিক তথ্য পরিবেশনার ক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হয় ভীষণভাবে।
প্রকাশভঙ্গীর চারুত্ব বজায় রাখতে হবে, অর্থাৎ কাব্যরচনা বা কবিতার প্রসাদগুণ যা পড়লেই পাঠকের ভালো লাগবে। তবেই কবি হবেন ব্যতিক্রমী। তাঁরই কলমে বাংলা সাহিত্যের যুগসন্ধিক্ষণের মুহূর্ত সৃষ্টি হবে, পাঠকের মননে তা ধরা পড়বে, তবেই তিনি ব্যতিক্রমী কবি।
প্রকৃত কবিও কোন না কোন বিখ্যাত কবির উত্তরসূরী হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করে থাকেন। উনার কবিতার প্রথম প্রেরণা হিসেবে কোন কবির কাব্য,তার সবিশেষ স্বীকারোক্তিও সেই উত্তরসূরী কবি করে থাকেন।
প্রত্যেক কবিই বিশেষ ধরণের সংবেদনশীলতার অধিকারী, তাই যিনি কাব্যের বিধিবদ্ধ ভাষার প্রয়োগে স্বতন্ত্রতা বজায় রাখেন, কাব্যে স্বচ্ছন্দে বিমূর্ততার প্রকাশ ঘটাতে পারেন তিনিই প্রকৃত কবি।
তিনিই কবি, যিনি পারিপার্শ্বিকতা থেকে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষায় কোন্ বিশেষ শৈল্পিক সত্তা ও উৎকর্ষতাকে কাজে লাগিয়ে মৌলিক কাব্য রচনায় পারদর্শিতা দেখান, যদিও সময়ের সাথে সাথে সেই কাব্যভঙ্গিমা বিবর্তিত হতেই পারে।
সার্থক কবি কবিতা লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষায় লেখা বিভিন্ন কবির কবিতাও পড়বেন। অর্থাৎ, ভালো কবিতা লিখতে গেলে পাঠক হতে হবে। তবেই তিনি কবিতার এক স্বতন্ত্রধারার উদ্ভাবন করতে সক্ষম হবেন, ফলে সহজেই কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারবেন।
কবি কাব্যসাধনায় নিমগ্ন থাকবেন অর্থাৎ জীবনের সবচেয়ে কর্মময় সময় অতিবাহিত করবেন কবিতা লিখেই। কবির সৃষ্টির জগৎ বৈচিত্র্যময়। তার সমস্ত চিন্তা চেতনা মনন জুড়ে থাকবে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বা কোন ব্যক্তিপ্রভাব, যেখান থেকে তিনি নিজেকে তুলে ধরবেন নিজস্ব দ্যোতনায়, তার সুললিত উপস্থাপনাই কবিতা।
কবির সৃষ্টি কোন বিশেষ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ব্যক্ত হলে, তা হবে তাঁর জীবনমুখী সৃষ্টি। সে সৃষ্টিতে বিজ্ঞান ও সমাজমনস্কতার যে স্বাক্ষর পাই তা পাঠককে দিশা দেখাতে সমর্থ হয় সবসময়।
সার্থক কবির নিজস্ব কাব্যকথা থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে পাঠক আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পায়।
প্রকৃত কবিমন কাব্যজগতে বিচরণের সময় সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সামিল হন। তাঁর সৃষ্টিতে চিরজাগরুক থেকে যায় এই আন্দোলনের ভাবধারা।
ব্যক্তিজীবনে এই সমাজসচেতন কবি কতোটা আত্মমগ্ন, আত্মস্থতার পথে কবি তাঁর সৃষ্টির ভান্ডারকে কতোটা পরিপূর্ণ করতে পেরেছেন, সেক্ষেত্রে পাঠক তথা সমালোচকই শেষ কথা বলবেন।
কাউকে কবি আখ্যায়িত করতে গেলে সমকালীনতায় বিরাজ করে নিজস্ব হৃদয়বেত্তার জেরে তিনি শিল্পকে কতোটা কালোত্তীর্ণ করতে পেরেছেন, তার সাথে সৃষ্টিকে কতোটা রসোত্তীর্ণ করতে পেরেছেন, তাঁর সৃষ্টিতে কতোটা জীবনমথিত ভালোবাসার স্ফূরণ ঘটাতে পেরেছেন, জীবন থেকে জীবনের গহীনে ডুব সাঁতার দিয়েও আবেগের কতোটা উত্তরণ ঘটিয়ে অনিঃশেষ জীবনের সন্ধানে ফিরেছেন এ সবই পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন।
অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ
রা না স র কা র
আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। মূলতঃ কবি হলেও সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতেও ছিলো তার অবাধ বিচরণ। রচনা করেছেন ষাটটির মতো বিভিন্ন স্বাদের এবং আঙ্গিকের নাটকও। তবে তাঁর প্রতিভার যে ক্ষেত্রটি নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়না, তা হলো "অভিনয়"। নাটক রচনার পাশাপাশি তিনি করেছেন নাট্যপ্রয়োগ (নির্দেশনা) ও অভিনয়ও। দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নিজের লেখা বহু নাটকে তিনি বিভিন্ন চরিত্রে দক্ষতার সাথে অভিনয় করেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক নাট্যমঞ্চে মাত্র ষোলো বছর বয়সে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখা "হঠাৎ নবাব" (মলিয়ের লা বুর্জোয়া 'জাঁতিরোম' অবলম্বনে রচিত) নাটকে রবীন্দ্রনাথ একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করে সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরই "অলীকবাবু" নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি।
১৮৮১ সালে তাঁর প্রথম গীতিনাট্য "বাল্মীকি প্রতিভা" মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকে তিনি "ঋষি বাল্মীকি"র ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৮৮২ সালে নিজেরই লেখা "কালমৃগয়া" গীতিনাট্যে করেন "অন্ধমুনি" চরিত্র। ১৮৮৯ সালে "রাজা ও রাণী" নাটকে তিনি ছিলেন "বিক্রমদেব"এর ভূমিকায়। ১৮৯০ সালে "বিসর্জন" নাটকে যুবক রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করেন বৃদ্ধ "রঘুপতি" চরিত্রে। আবার ১৯২৩ সালে ঐ নাটকটিতেই বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করেন যুবক "জয়সিংহ" চরিত্রে। এই ঘটনা থেকে তাঁর অভিনয়দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাসেরই প্রমান মেলে। ১৮৯৭ সালে "বৈকুন্ঠের খাতা" নাটকে রূপদান করেন "কেদার" চরিত্রটি।
এই নাটকগুলো ছাড়াও শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন সময়ে শারদোৎসব, রাজা, ডাকঘর, অচলায়তন, ফাল্গুনী, মুক্তধারা, রক্তকরবী, তাসের দেশ, কালের যাত্রা ইত্যাদি নাটকগুলো তিনি শান্তিনিকেতনে মঞ্চ তৈরী করে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অভিনয়ের দল তৈরী করে মঞ্চস্থ করতেন। আবার মাঝেমাঝে দল নিয়ে কোলকাতায় এসেও মঞ্চস্থ করে যেতেন। নিজে একাধিক চরিত্রে অভিনয়ও করতেন। যেমন, "শারদোৎসব" নাটকে "সন্ন্যাসী", "রাজা" নাটকে "রাজা" ও "ঠাকুরদাদা"র যুগ্ম ভূমিকায়, "অচলায়তন" নাটকে "অদীনপূণ্য"র ভূমিকায়, "ফাল্গুনী" নাটকে "অন্ধ বাউল", "ডাকঘর" নাটকে "ঠাকুরদা", "প্রহরী" এবং "বাউল" এর ভূমিকায় অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ।
এতো শুধুমাত্র অভিনয়ের ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।তাঁর নাট্যরচনা, নাট্যপ্রয়োগ (তখনকার যুগে "নির্দেশনা" বলা হোত না) আলাদা আলাদা করে গবেষনার বিষয়। যেখানে সেক্সপীয়ার রচনা করেন ৩৯টি নাটক, সেখানে রবীন্দ্রনাথের নাটকের সংখ্যা ৬০ এবং সেগুলি গুনগত মানেও বিশ্বমানের। সত্যিই এই বিরল প্রতিভাধর মানুষটির প্রতিভার ব্যপ্তি দেখলে আশ্চর্য হতে হয়।
শিল্প বোদ্ধা রামমোহন
শু ভ জি ৎ স র কা র
'রাজা'র জন্মের সার্ধ-দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষ্যে তাঁর রাজকীয় কর্মকান্ড ও চিন্তাভান্ড নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। কারন রামমোহন তো ভারতের জাগরণের সাম্রাজ্যেও 'রাজা।' আমাদের নবজাগরণের নায়কেরা শুধুমাত্র সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তাঁরা শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ও ছিলেন। রামমোহন ও দ্বারকানাথ এই দুই জুড়ি ঘোড়ার টানেই আধুনিক সভ্যতার রথ বাংলাদেশে প্রথম প্রবেশ করেছিল। রামমোহনের ভাবশিষ্য তথা তাঁর 'দক্ষিণ হস্ত' দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন শিল্পসংগ্রাহক, তাঁর বেলগাছিয়া ভিলা ছিল আর্ট গ্যালারির দৃষ্টান্ত অথচ রামমোহনের শিল্পভাবনা সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে যখনই এ বই ও বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছি তখন একদিন সন্ধান পেলাম রামমোহন রায়ের লিথোচিত্রটির স্রষ্টা ফরাসি মিনিয়েচার শিল্পী জঁ জ্যাক বেলনসের সহধর্মিনী সোফি শার্লোট বেলনস- এর
"Twenty four plates Illustrative of Hindoo and European Manners in Bengal" ছবির বইটার।১৮৩০ খ্রীস্টাব্দে লন্ডন থেকে বইটি প্রকাশ করেন পর্তুগীজ জাতীয়া বেলনস। বেলনসের এই ছবির অ্যালবামটি বড়ো আকারের, দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০ ইঞ্চি, প্রস্থে ১১ ইঞ্চি। পাথরে আঁকা ২৫টি ছবির প্রতিলিপি এই বইতে আছে। ছবিগুলোর বর্ণনা ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় দেওয়া আছে। এক পৃষ্ঠায় ইংরেজি অন্য পৃষ্ঠায় ফরাসি। বেলনস ভারতীয় না হলেও তাঁর রেখায় ভারতীয় জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি- এদেশের উৎসব, যাত্রা ও দৈনন্দিন জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ধরা আছে। ছবিগুলো বাঙালী জীবনের ছবি, বাঙালীর বিবর্তন যাত্রার ইতিহাসে ছবিগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য আছে। বইখানির ইংরেজি ভূমিকায় বেলনস গৃহিণী নিজেকে 'a native of the Country' 'এতদ্দেশবাসী' অথাৎ ভারতবর্ষের অধিবাসী বলে বর্ণনা করেছেন। বইটি বিলাতের রয়াল- এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছিল। সোসাইটির তরফ থেকে Graves C. Haughton হটন সাহেব একখানি অনুমোদন পত্র দিয়েছিলেন। হটন সাহেবের সেই পত্রের সঙ্গে রাজা রামমোহন রায়ের লেখা নিম্নলিখিত পত্রখানি বেলনস গৃহিণী তাঁর বইতে প্রকাশ করেছিলেন। রামমোহন তখন লন্ডনের ৪৮ বেডফোর্ড স্কোয়ার-এ ডেভিড হেয়ার-এর ভাইদের কাছে থাকতেন। সেখান থেকে ১৮৩২ সালের ৫ ই মার্চ রামমোহন মিসেস বেলনস কে লিখছেন- "I have with great pleasure looked over your drawings, and read your descriptions of them, and I now have the satisfaction to inform you, that they are true representations of nature, so much that they have served to bring to my recollection, the real scenes alluded to of that unhappy country.
The drawings are so expressive in themselves, that the descriptions, however excellent, are scarcely necessary to any acquainted with India.
I have retained the copy handed over to me, and wishing you every success in your present undertaking."
উপরোক্ত চিঠি পড়ে রামমোহনের শিল্পসচেতন মনের পরিচয় পাওয়া যায়, শত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তিনি তাঁর শিল্পী সত্তাকে উপবাসী রাখেননি তার প্রমাণ এই চিঠি। রামমোহন যে 'অসুখী' পরাধীন ভারতবর্ষের প্রজা ছিলেন সেই দেশের প্রাকৃতিক বর্ণনা বেলনসের তুলিতে কতটা জীবন্ত হয়ে উঠেছিল তা বোঝা যায় রামমোহনের লেখায়।
এবার আমরা রামমোহনের প্রতিকৃতি ও প্রতিমূর্তি তে রামমোহনের শিল্পচেতনা খোঁজার চেষ্টা করব।রামমোহনের জন্মের সার্ধ-দ্বিশতবর্ষে রামমোহন লাইব্রেরি অ্যান্ড ফ্রি রিডিং রুম" যে "রামমোহন ২৫০ স্মারকগ্রন্থ" প্রকাশ করেছে সেখানে রামমোহনের সর্বমোট ২২ টি প্রতিকৃতি বিস্তারিত বিবরণ সহ তুলে ধরা হয়েছে। ২২ টি প্রতিকৃতির মধ্যে ৪ টি প্রতিকৃতিতে রামমোহনের সাক্ষর আছে। ২২টি প্রতিকৃতির মধ্যে ৪ টি প্রতিকৃতির জন্য শিল্পী বরাত পেয়েছিলেন না নিজের আগ্রহেই এঁকেছিলেন তা বলা শক্ত কারন তা স্পষ্ট করে উল্লেখ নেই। তবে একথা নিশ্চিত সেই সময়ে প্রতিকৃতির নিচে সাক্ষর প্রমাণ করে যার প্রতিকৃতি আঁকা হচ্ছে তাঁর সম্মতিতে যে আঁকা হত এবং তিনি যে সিটিং দিয়েছিলেন, কল্পিত চিত্র নয় তা সুস্পষ্ট।রামমোহনের এতে পূর্ণ সম্মতি ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রামমোহন প্রতিকৃতি দেখে নিশ্চিত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন তাই সম্মতি দিয়েছিলেন।রামমোহনের সম্মতি দেখে ধরা যেতেই পারে প্রতিকৃতি আঁকানো তাঁর পছন্দের বিষয় ছিল। ইংরেজ শিল্পী হেনরি পেরোনেট ব্রিগস এর আঁকা রামমোহনের তৈলচিত্রটি রামমোহন রায়ের একমাত্র পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি হিসেবে ধরা হয়, যে প্রতিকৃতিতে দেখা যায় রামমোহন বই হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল মিউজিয়াম এন্ড আর্ট গ্যালারিতে রক্ষিত এই প্রতিকৃতি সম্পর্কে 'রামমোহন লাইব্রেরি অ্যান্ড ফ্রি রিডিং রুম' থেকে প্রকাশিত রামমোহন ২৫০ স্মারক গ্রন্থে লেখা হয়েছে- "রামমোহন রায়ের প্রয়াণের পর প্রকাশিত এই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রামমোহন রায় তাঁর এই প্রতিকৃতিটি পচ্ছন্দ করেননি। সম্ভবত ছবিতে তাঁর গাত্রবর্ণ তাঁকে খুশি করতে পারেনি, তিনি এ বিষয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ছিলেন।" এই কথার প্রাথমিক উৎস হিসেবে ১৮৩৩ সালে The Asiatic Journal and Monthly Register-এর New Series, Vol.XII . No.47( September-December 1833 ) সংখ্যার পাদটীকার উল্লেখ করা হয়েছে- "The best portrait of him extant is a full-sized one by Briggs. It is good picture as well as an admirable likeness; but the deceased always felt an accountable aversion to it. Perhaps it did not flatter him sufficiently in respect to complexion, a point on which he was very sensitive."
এই উত্তি রামমোহনের শিল্প সত্তার পরিচয় বহন করে।রামমোহন কেবলমাত্র ফরমাইশ করে তাঁর ছবি আঁকতে শিল্পী কে বরাত দেননি, ছবির প্রতিটি বৈশিষ্ট্য তাঁর শৈল্পিক চোখ এড়ায়নি।তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছেন। ছবি শুধুমাত্র ব্যক্তির হয় না, সমসাময়িক মুহূর্তকথা ও ছবিতে ধরা থাকে। রামমোহন রায়ের জীবন- প্রেক্ষাপটে "কর্নেল ব্রেরেটনের বিচার" ছবিটি তেমনই এক ঐতিহাসিক ছবি। শিল্পী রোলিন্ডা শার্পলস কর্নেল এর আঁকা ব্রেরেটনের বিচারের দৃশ্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- "১৮৩১ সালে ব্রিস্টলে রিফর্ম বিল নিয়ে যে দাঙ্গা হয়, সেটি রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় কর্নেল ব্রেরেটনের বিচার শুরু হয় ৯ই জানুয়ারি ১৮৩২ সালে ব্রিস্টলের মার্চেন্ট হলে।বিচারের কার্যধারা চারটি বৈঠকের পর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়, এক আসামীর আত্মহত্যার কারনে। বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি সেই বিখ্যাত বিচার শুনতে মার্চেন্ট হলে উপস্থিত ছিলেন। রামমোহন রায়ও ছিলেন। ইংল্যান্ডের রিফর্ম বিল নিয়ে চরম আগ্রহী ও কৌতূহলী রামমোহন রায়ের ছবিটি তাঁর আগ্রহ ও কৌতূহলের উজ্জ্বল সাক্ষর। শিল্পী বেলনস রামমোহন রায়কে মুখোমুখি বসিয়ে তাঁর প্রতিকৃতিটি আঁকেন।রামমোহন রায়ের লিথো-প্রতিকৃতিটিতে শিল্পী বেলনস তাঁর চরিত্রের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য 'রেনেসাঁস বিষণ্ণতা' খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বেলনসের এই প্রতিকৃতি অঙ্কনে রামমোহনের পূর্ণ সমর্থন ছিল কারন ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি রামমোহন চিঠিতে বেলনসের সহধর্মিণীর শিল্পসত্তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ভারতীয় রেনেসাঁসের জনক বেলনসের "রেনেসাঁস বিষণ্ণতা"-য় অমর হয়ে রইলেন।
প্রতিমূর্তি বিষয়ে রামমোহনের মনোভাব প্রসঙ্গে শিল্প-ইতিহাসবেত্তা উইলসন বলেছেন- "Rammohun Roy had a dislike of portraits and personal adulation. " তবুও আমরা দেখেছি রামমোহন সম্মত হয়েছিলেন। উইলসন বলেছেন রামমোহন "agreed to sit to the sculptor as a favour to Basil Montagu, whose own bust had earlier been carved by Clarke. Montague was a friend of Rammohan Roy, and held literary soirees at his house in Bedford Square, very near to the house of the Hare bothers at which Rammohun Roy lived while in London." রামমোহন রায়ের জীবিতকালে তাঁর একটি মার্বেল পাথরের আবক্ষ মূর্তি তৈরি করেছিলেন ইংরেজ ভাস্কর জর্জ ক্লার্ক। কিন্তু সেই আবক্ষ মূর্তি পাওয়া যায়নি। তবে জর্জ ক্লার্ক কৃত সেই আবক্ষ মূর্তি সম্পর্কে রামমোহনের মনোভাব জানা যায় উইলসন যখন বলেন- "Rammohun Roy had a dislike of portraits and personal adulation--." কিন্তু উইলসনের বক্তব্যের পরের অংশটি গুরুত্বপূর্ণ- "Rammohun Roy had his features immortalised by one of the greatest artists of the day, George Clarke, and therefore Cheverton's exact replica in ivory of Clarke's missing bust is very significant in the iconography of Rammohan Roy. "বোঝা যাচ্ছে ছবির মত ভাস্কর্যেও রামমোহনের আগ্রহ ছিল এবং শিল্পের এই দুই বাহুর বিষয়ে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। ইতালীর নবজাগরণের নায়কদের মত আমাদের জাগরণের পথিকৃৎ রামমোহন ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
সমাজ সংস্কার, ধর্ম, শিক্ষা, রাজনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক আন্দোলনে রামমোহনের অগ্রণী ভূমিকার কথা বহুচর্চিত।রেনেসাঁসে স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ভূমিকা অনস্বীকার্য। নবজাগরণের নায়কেরা সকলেই যে চিত্রকলা বা ভাস্কর্যে তাঁদের সৃজনশীলতার ছাপ রেখেছিলেন তা কিন্তু নয়, নীরবে, পর্দার পিছনে থেকে তাঁরা শিল্পীদের উৎসাহ দিয়ে, সাহায্য করে পৃষ্ঠপোষকতার কাজ করেছিলেন। রামমোহনের চাইতে বাইশ বছরের ছোট দ্বারকানাথ ঠাকুরের এই ভূমিকার কথা বহু আলোচিত না হলেও তথ্য প্রমাণের অভাব নেই যে তিনি শিল্প সংগ্রাহক ছিলেন, বিখ্যাত শিল্পীদের দিয়ে ছবি আঁকিয়ে নিয়েছিলেন, নিজের মত তাঁর গুরু রামমোহনের মূর্তিও তৈরি করিয়েছেন বিদেশী শিল্পী কে দিয়ে। রামমোহনের শিল্প ভাবনা নিয়ে কোন কাজ চোখে পড়ে না, কারন উপযুক্ত তথ্য প্রমাণের অভাব। অথচ দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে তাঁর পত্র বিনিময় হত। উদাহরণ হিসেবে শিল্পী বেলনসের মতো আমেরিকার প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী রেমব্রান্ট পিল এর কথা বলা যায়। এই বিষয়ে রামমোহনের লেখা বিভিন্ন চিঠিপত্র বা নানা আর্কাইভে রাখা কাগজপত্রের যদি সুলুক সন্ধান করা যায় তবে বোধহয় এই বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কাজ করা সম্ভব।
তথ্যঋণ- "বাঙ্গালীর সংস্কৃতি" সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, "রামমোহন ২৫০ স্মারকগ্রন্থ" রামমোহন লাইব্রেরি অ্যান্ড ফ্রি রিডিং রুম।
লেখার সঙ্গে দেওয়া ছবি পরিচিতিঃ
১) রামমোহন রায়ের লিথোচিত্রটির স্রষ্টা ফরাসি শিল্পী জঁ জ্যাক বেলনস।
২) মিসেস বেলনস এর লেখা "Twenty four plates Illustrative of Hindoo and European Manners in Bengal" বইয়ের প্রচ্ছদ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন