গল্প



¶¶উপসর্গ∆উপশম----𝙲/𝙾 𝙳𝚒𝚜𝚎𝚊𝚜𝚎----

দে ব ব র্ণা


শোনো তোমায় কিছু বলার ছিলো --মনে আছে সেই কবেকার প্রশ্নটা? আদরা মুদ্রিত শব্দের মধ্যেও যে এতো প্রাণ থাকে, এতো জিজ্ঞাসা থাকে জানা ছিলো না।
তোমার খুচরো উদ্দেশ্যহীন জিজ্ঞাসার মধ্যে খোদাই করা উৎকর্ষ দেখে বেশ বুঝেছিলাম ---শীতের রাতে আঙুলের কোণে রক্ত জমাটের দুর্বিষহ যন্ত্রনা।
ঘুমিয়ে পড়া চোখের কোণেও প্রাঞ্জল দেখা গেলো, অনুসন্ধিৎসু তুমি'র বিবসন আতঙ্ককে।
আমার দেখাটা অস্বাভাবিক নয় যে-- আঘূর্ণিত পৃথিবী জুড়ে গাছেরা ছড়িয়ে দিচ্ছে ছায়া --গহীন সমরূপতায় মানুষ বসে ছাড়াচ্ছে যাবতীয় শব্দাগ্রতার ক্লেশ... চটুল মোড়কে ঢুকে যাচ্ছে অসুখ।
বৈদ্যুতিন সংকেতের মেরু বদল ঘটে যায় এখানে--- প্রৈতি চেটে খেয়ে যায় জাগতিক সংঘাত।।
ভাবতে পারবে না অসুখ কি ভীষণ কাম্য এখানে-- যেসব জিভে শিউলির কষ আজ পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়, সেই মুহূর্তে ফলবতী হয়ে ধরা দিচ্ছে যন্ত্রনা।

পরিচয় খুঁজেছিলে যখন, তখন সময়ের গায়ে জামা ছিলো না --প্রশ্ন শুনে সম্বিৎ ফিরলে হাতড়েছিলো চাদর।
সময় ঢাকছে আঁচিলে সাজানো চামড়া-- চামড়া পোড়া উরোজ আর অস্তিত্ব সংকটে ভোগা মণিপুর, মণিপুর ছাড়িয়ে চাদর চলে যায় স্বাধীষ্ঠানার কাছে সেখান থেকে গতিপথ পাল্টে এসে পড়লো মুলাধারের একেবারে কেন্দ্র অকুস্থলে।
মানুষ পাল্টাতে সময় নেয় না --কিন্তু শ্লথপ্রগতির সূত্র মুখস্ত করে জীবন
         -----অবশেষে এসে আজ উত্তর দিচ্ছি, আমিই সেই যার স্তম্ভবৎ নাদন ছিঁড়ে দেখেছিলে তোমার ব্যক্তিগত অসুখ... আমিই সেই উপসর্গ।
বিশ্বাস না হলে পাড়ার মোড়ে ওষুধের দোকানে কষ্ট করে যাও --দেখবে ওরাই বলে দেবে ধমনী জুড়ে কেমন ছুটোছুটি করছে হত্যাখুনের রূধির।
সংখ্যা সংখ্যা সাজে বেরিয়ে আসবে উত্তর... চিৎকার করে জানিয়ে দেবে আমার নাম।
      ------এই যে গোটা রাত বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ো, এলিয়ে পড়ার দুর্জ্ঞেয় ভয় বয়ে যায় আন্তঃকশেরুকার হায়ালিনে... কখনো বিনিদ্রকালে প্রশ্ন করো... ওই জমাট জমাট যন্ত্রনা, শুকিয়ে আসা ঠান্ডা আসঞ্জক আর ক্রমে বন্ধ হয়ে আসা নিঃশ্বাসে বলে দেবে.... আমার নাম।
    ------সেইসব সন্ধ্যাগুলোয় যে বুকে ভরে দাও যাবতীয় নিকোটিন, ঠোঁট চিরে বেরিয়ে আসে নেশাতুর নিকষ শর্বরী, সম্ভাব্য জীবনে রেখে দাও পুড়িয়ে ফেলা চিঠি, উড়িয়ে দেওয়া ছাই.... কে? সেই তো আমিই।
   -------কষ্ট করে দাঁড় করিও দেহজ পাপ, মনোবিজ্ঞানের পাতা আর অশরীরী মর্মতেজ। কিছুতেই জোগাড় হবে না, গড়ে উঠবে না শ্রেণীবন্ধ বিন্যাসের সেই চূড়ান্ত ইতিহাস... বিশ্বাস করো ছত্রভঙ্গতার অধ্যায় বলে দেবে লেখিকার নাম।
  ------শিরার ফিতে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসুক শীর্ণ কৃশ রক্ত, কত গ্যালন চিন্তায় রক্তও মিষ্টি হয়ে ওঠে দেখতে হবে না? কতরাত না ঘুমোলে, ঠিকানা পদবীর আতিশয্য কোথায় ছিটকে গেলে তবেই রক্ত দিয়ে তৈরী হয় হাওয়াই মিঠাই... একটিবার বরং জেনে নিও।
  -------শুধু কখনো প্রনিধানে পেতো না নিজেকে, বীভৎস আর্তনাদে ছিটকে যাবে শক্তি, চিঠির ভাঁজে লেখা থাকবে এজলাসী ঠিকানা, দেখা হবে আমাদের... তোমার উদ্বিগ্নতার সাথে আমার সময়ের, দোলাচলের নাগরদোলায় বসে কাঁধে মাথা রাখবে অবশিষ্ট সংশয়, চোখের জলগুলো শুকিয়ে গেলেই দোয়াতভর্তি কবিতা ফুটে উঠবে।
 --------অনুমেয় গুলজারী তিনশো অভূতর ধ্বংস দেখেছে গোসলখানার লোকানো নালা, তারাখোদাই আকাশ ঢুকে আসে মধ্যরাতে--- স্ক্রুটিনি হয় জাপটে ধরা কাব্যের।
মনে পড়ে সেইসব জোর গুলোর কথা? যেসব জোর আর কেউ দেখেনি, তোমার মানসচক্ষু ছাড়া... এই এদেরকেই একটিবার জিজ্ঞেস করো।
মানুষ আসলে থিতিয়ে পড়তে চায় --জিভের গোড়ায় যুক্তির স্থৈর্য বসিয়ে নিয়ে প্রমাণ প্রমাণ খেলায় মেতে উঠতে চায়।
    ------পড়ে ফেলা গোয়েন্দা গল্পে পরিমার্জনা ব্রাত্য তাই এতকিছু পেরিয়ে আসার পর আর বলবো না সেইসব পরিশ্রমগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখো যেগুলো নালার জলে ভেসে গেছিলো... নয়তো ওরাও জানে আময়সূচির ফর্দ।

মুকুর জুড়ে তাকিয়ে থেকেও বুঝিনি অক্ষৌহিনী বাদুড় মরলে তবেই ভ্যাম্পায়ার সিনড্রোম দেখা যায়।
হতেই পারি তোমার বানান ভুলের পাতা কিংবা মলিন ক্ষপা উপাখ্যান--অপ্রাসঙ্গিকতার শিরোমনি।
কবিতা পড়াই যেখানে কাজ সেখানে কবির জীবনী জানাটা বোধহয় বাড়াবাড়ি বৈ অন্যকিছু না --গ্রন্থবিবিরণীর মতন ঝুলতে থাকা ইতিহাসের দিকে চায় না সভ্যজন।
সবজির খোসার সাথে পচতে থাকে স্মৃতি তাই থুতুর বিবৃতিই একমাত্র স্বীকার্য, মাঝেমাঝে দেখা যাবে বর্ষা বেরিয়ে আসবে গর্ত, গর্ত চুঁয়ে সাপ --সাপের শরীরে রোজনামচার সর্বনাশ।
ঘন্টা তিনেক আরামে বসে বেশ্যার জীবিনী দেখায় কোনো পাশবিক ঘৃণা নেই তবুও কি আর ওদের জীবন বদলে দিতে পারি?
সভ্যজনেও ভুল করে যখন জ্যালজ্যালে হরমোন আটকে দেয় আপন গতিপথ--- ভুল করে চলে আসে অসামাজিক প্রোফাইল, আঙুল অসাড় হয়ে এলে বন্ধুত্বও সেখানে সস্তা হয়ে ওঠে।
মৃত্যুর প্রহর গোনা শকুন বসে থাকে মৃতপ্রায় শিশুর কাছে--- এ আর এমনকি ব্যাপার। মানুষ দেখার আগে আমিও ভাবতাম একমাত্র শকুনিই বোধহয় এমন অপেক্ষায় থাকে।
শব্দজব্দের ব্যঞ্জনায় প্রত্যয় জুড়ে দিলেই বদলে যায় অর্থ... আমিও খানিক তেমনই।
অভিশাপের চামড়া ফেঁপে বেরিয়ে আসে মহামারী, মহামারীর জল গড়িয়ে ঢুকে যায় নাকে মুখে, চেপে ধরে গলা--- বন্ধ হয়ে আসে জৈবিক নিশ্বাসের পদাবলী।
মধ্যরাতের অসাড় ঘুমের পক্ষপাতিত্ব থেকে শুরু করে--- ঋণাত্বক উপলব্ধি অবধি... যতোকিছু দেখতে পাবে সবের মধ্যেই খুঁজে নিও অসুখ করার কারণ--- শুধু বারণ মেনে চলো।
আসলে কি জানো, অভ্যেস থিতিয়ে পড়লেই কবিতা বেরিয়ে আসে--- শুধু পৌঁছতে পারি না এই যা।

শেষত, আমি তোমার অসুখ হলেও জেনে রেখো--- তুমি আমার দারুন আলো, যেন আকাশ থেকে হাতে করে নামিয়ে আনা সূর্যসিংহ বসিয়েছিলাম বুকে।






মেধা

ছ ন্দা  চ ট্টো পা ধ্যা য়


"মা এতা তুমি থিক কতা বলতো না। ছম্বুর মা পিছি কী মানুছ না? এত্তোগুলো বাছুন মাজে। এত্তু এঁতো লেগে আতে বলে এত্তো বটলে!?" -খুকুমণি বলে তার মাকে। 

ঠাস করে চড় পড়ে খুকুর গালে। 

"এইটুকু মেয়ে, সব কথায় ফোড়ন কাটতে শিখেছে। আমি এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার সামলাতে  হিমসিম খাচ্ছি। এঁটো লাগা বাসনগুলো তুই ধুবি?"

"থিক আতে, দাও ধুয়ে দিত্তি"

 "থাক আমি ধুয়ে দেতেচি মা। খুকিরে বকোনি কো" -শম্ভুর মা বলে। 

খুকুমণিকে কেউ বোঝেই না। পাঁচ বছরের মেয়েটা সব সময়ে অন‍্যায়ের বিরুদ্ধে। শুধু ছোট ভাইয়ের পাতে বড় মাছের টুকরো আর বড় কাঁসার গ্লাস ভর্তি দুধ দেখলে কোন হিংসে নেই। "ও তো ছোতো ভাই। ওকে বেছি ক'লে  দাও মা। থেলে(ছেলে)দের বেছি থেতে দিতে হয়। দিদা বলেতে"। নিজের বঞ্চনাকে সুন্দর যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করতে ওকে কে শিখিয়েছে কে জানে?!

তবে এটা আজ খুকুর প্রথম প্রতিবাদ নয়। তার আড়াই  বছরের ছোট ভাইটা জন্মানোর পর মা সব দিক সামলাতে পারছিলো না। চোদ্দ বছরের বড়দার স্কুল, বাবার অফিসের ভাত, সাত বছরের আদরের দিদির বায়না মিটিয়ে খুকু যেন বাড়তি বোঝা। তখন গ্রামের বাড়ি থেকে ঠাকুমা খুকুর বাবাকে ডেকে পাঠান। "ছোটবৌমার জেদে কোলকাতায় এক কামরা বাসা ভাড়া করলি। এখন সামলাতে  কষ্ট হচ্ছে তো?"- -"তা হচ্ছে মা!"- ঠাকুমা বলেন -"তবে খুকুকে এখানে রেখে যা মণি। নরু, বড়বৌমা আছে। ওদের ছেলে  তাপস আছে।  ওরা সবাই খুকুকে ভালো  রাখবে।"

 তিন বছুরে খুকুর আনন্দেই দিন কাটে। একান্নবর্তী সংসারে ঠাকুমা, জেঠু, বড়মা, দাভাই সবার সাথে। শুধু রাতে ঠাকুমার বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদে। কাঁদার জন‍্য তার মায়ের আঁচলটা কোন দুর্বৃত্ত  কেড়ে নিলো? মা কী করে তাকে ছেড়ে আছে? অভিমানের সঙ্গে জমে রাগ। ঠাকুমাকে বলে, "এবার  মা আসলে ঠুব ব'টে  দিও ঠাম্মা।"

একান্নবর্তী পরিবারের যেমন সুবিধে আছে, তেমন অসুবিধেও কম  নয়। সংসারের রাজনীতি  চাণক‍্যকের নীতিকেও হার মানায়। ঠাকুমা খুকুর কান্নার কথা বলেন জেঠু ও বম্মাকে। কদিন থেকেই খুকু শুনছে তার মাকে নিয়ে নিন্দেমন্দ কথা। বিশেষ  করে জেঠু ও বম্মা সব সময়েই বলতে শুরু  করেছেন খুকুর মা গুণতুক করে স্বামীকে বশ করেছে। খুকুর বাবা "বৌয়ের ভেড়া।"-- সবটাই  খুকুকে শুনিয়েই হচ্ছে। খুকুর শিশুমন বিষিয়ে দিতে। আর সহ‍্য হয় না ঠোঁটকাটা চার বছরের মেয়েটার। "জেঠুমণি,ঠাম্মা তো তোমাল  মা?"- -"হ‍্যাঁ তো সোনা। এ কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?"- -"আচ্ছা জেঠুমণি, তোমাল ছামনে ঠাম্মাকে কেউ খালাপ কতা বললে তোমাল খালাপ লাগবে না? আমাল মা-বাবাল নামে ছুনতে আমালও খালাপ লাগে।"-- শিশুর এমন বিচারবুদ্ধিতে হতবাক হয়ে যান জেঠু।

এটাই ছিলো খুকুর প্রথম প্রতিবাদ। ফলে বাবা পাঁচ বছরের মেয়েকে এনে কোলকাতার স্কুলে ভর্তি করে দিতে বাধ‍্য হন। স্বভাববশতঃ মায়ের আচরণের  ত্রুটি লক্ষ‍্য করে শম্ভুর মায়ের  পক্ষ অবলম্বন করে মেয়ে।  মা তার পাঁচ বছরের কচি গালে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ ফেলে দেন।  বাবা বলেন, "আমার মেয়ের গায়ে আর কখনো হাত তুলবে না। আমার মেয়ে আমার গর্ব। ওকে ওর মূল‍্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠতে দাও সুষমা। দেখবে আমাদের সব সন্তানদের মধ‍্যে ঐ-ই আমাদের  মুখ উজ্জ্বল  করবে।" বাবা স্কুলের খাতায় মেয়ের নাম দিলেন মেধা মুখার্জি।

মেধা বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল  করেছিলো কিনা সেটা অন‍্য গল্প। হয়তো এই সমকালের আগুনে পুড়ে গেছে প্রতিবাদী মেয়েটার ঝলসানো যুক্তি, আবার এমনও আশা করা যায়  দীন দরিদ্র  মূঢ় ম্লান কিছু মুখে সে  জুগিয়ে  যাচ্ছে প্রতিবাদের ভাষা। ন‍্যায‍্য প্রাপ্তির আন্দোলনের মঞ্চে প্রধান মুখ হয়তো সেই মেয়েটাই।






কিছু বন্ধু... শুধু বন্ধু নয়... জীবন হয়...

গী ত শ্রী  সি ন হা 


পিছনের দিকে ছুটছে... ফিরে যাওয়ার দিকে ছুটছে বৃষ্টি। ঘুঙুরের তালের মধ্যে রয়ে যাচ্ছে বিপরীত এক বিষাদ। কোন ছোট্টবেলা থেকে ঘুঙুরের ঘোর যেন তাড়া করে মারছে... সম্মিলিত হাততালির আওয়াজের সাথে বৃষ্টির নামটা বার বার উচ্চারিত হতে থাকছে ভাঙা রের্কডের মতো। 'তা ধিন ধিন না -না ধিন ধিন না' তালির সাথে সাথে সেজদির গলা--- টুপুর হচ্ছে না- হচ্ছে না টুপুর- আমার দিকে দ্যাখ- টো- হিল- টো- ফ্লাট...  দু'কান চেপে খোলা আকাশের নিচে বসে পড়ে বৃষ্টি রায়চৌধুরী। নাচের হাতেখড়ি হয়েছিল বাড়িতে সেজদিদির কাছে... তারপর শরীর জুড়ে শুধুই নাচ। স্রোতা হওয়ার পরও অনেক অনুষ্ঠানে পুরষ্কৃত হয়েছে। আজ টুপুর মানে হু হু বাতাস লাট খাওয়া একটা ফাঁকা বদ্রিপাখির খাঁচা, আর মেয়েদের দুপুরের ঘুমের ক্রমশ শেষ হয়ে যেতে থাকা এক যুগ!  দূর! মগজের পোকাগুলো বড্ড বেশি কিলবিল করে!... যত ভাবে সে অতীতে বন্দী হয়ে থাকবে না, স্মৃতিগুলো যেন তার চারিদিকে প্রাচীর না তুলে দেয়! কখনো- সখনো খুব ভারী হয়ে ওঠে। সেই ভারে মানুষের বর্তমান নুয়ে পড়ে, ভবিষ্যতের দম বন্ধ হয়ে যায়...  আপনমনে ভাবতে ভাবতে বৃষ্টি গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত রাখে। মালকিনের মর্জিতে ছুটে চলে গাড়ি। সকাল গড়িয়ে দুপুর। বাসন্তী হাইওয়ে ধরে এগিয়ে চলে গাড়ি। পাল্টে গ্যাছে পথ, গাড়ি চালিয়ে সুখ পাচ্ছে বৃষ্টি আগের থেকে অনেক। না, এবার কিছু না খেলে কমলের শাসন জড়ানো চোখ তীব্র হবে! প্রশস্ত ব্যস্ত রাস্তা... আর কিছুটা এগিয়ে উপযুক্ত জায়গা দেখে গাড়িকে বিশ্রাম দিতে হবে। এইতো!  একদমই ঠিক! উফ! গাড়ির বাইরে বেরোতেই এক প্রকান্ড অস্বস্তি... গায়ে যেন আগুনের হলকা! সারা বছরই আবহাওয়া গরম থাকে চল্লিশের ডাইনে বাঁয়ে। অথচ শোনা যায়, বছর চল্লিশের আগেও নাকি এ শহরের তাপমাত্রা বারো-তেরো ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসতো। তখন উইন্টার নামে একটা ঋতু ছিল। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে বাড়তে বাড়তে এই অবস্থায়!
লাঞ্চবক্স থেকে কিছু ভেজ পিজা আর ফ্রুটস খেতে থাকে বৃষ্টি, সাথে অবশ্যই ফ্রুটজুস। দূরে চোখ আটকে যায়... বেশ কিছু হিপি- হিপিনি এদিকেই আসছে... জুনের দুপুরে খালি পায়ে ওরা অনায়াসে পিচ গলা রাস্তায় রোঁয়া ওঠা ঝলসানো গা কুকুরের গলার চেনের শিকল বাঁধা। বেশ লাগে বৃষ্টির... জীবনের কতো রকম ছবি! কুকুরটা তার মহিবান হিপিনির গা ঘেঁষে যেন বড় সুখে ল্যাজ নেড়ে নেড়ে চলছে। আহা কী বিন্দাস জীবন এদের! পোশাক বা চলাফেরা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। হাফ প্যান্টের সাথে ফিনফিনে পাঞ্জাবী, কেউ বা বুক খোলা লম্বা শার্ট। অন্তর্বাস পরার প্রয়োজন হয় না... কারণ ওরা নিজেদের নিয়ে মাথাই ঘামায় না! নতুন করে ওদের অতিমানব মনে হতে লাগলো বৃষ্টির। 
সন্ধ্যা হয় হয়, আলোকিত বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামকে বাঁ দিকে ফেলে রবীন্দ্রসদনের দিকে এগোচ্ছে, পার্কিং জোনের পাশেই আইসক্রিম পার্লারে ঢোকে বৃষ্টি। একটা পছন্দের আইসক্রিম অর্ডার দিয়ে বাড়ির জন্য বার আইসক্রিম প্যাক করে দিতে বলে। হাত-কোমর-ঘাড় হেলিয়ে পাবলিকের চোখ লুকিয়ে একটু ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ করে নেয়। 
সারাদিন শেষে মোবাইলটা হাতে নিতে গিয়ে বৃষ্টি রায়চৌধুরী হতবাক! সিনেমার ভাষায় যাকে বলে 'ফ্রিজশট'! এ-ই বৃষ্টি মানে টুপুর না!! সামনে দাঁড়ানো পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি দীর্ঘাঙ্গীকে দেখে বৃষ্টি অবাক!

আ-রে উপমা তুই! হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!

না না এইভাবে না, তোর সেই সংলাপ টা ছাড় প্লিজ!

কোনটা বলতো ? 
ও হ্যাঁ, হ্যাঁ,... বৃষ্টি ডান হাতটা উপমার দিকে বাড়িয়ে মাথা কাত করে বলতে থাকে ইনিই হচ্ছেন  নারী জাতীর উপমা। তারসাথে প্রাণ খোলা হাসি। 
মিষ্টি দারুণ মিষ্টি! তুই পাল্টাসনি রে টুপুর! একটুও না! আমরা কেউ পাল্টাতে চাই না রে, বাধ্য হয়ে বাইরের খোলোসটা বদলে ফেলতে হয়! ভিতরে ভিতরে আমরা কিন্তু একই থেকে যাই... থেমে থেমে বলে বৃষ্টি। ব্যাগ থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে উপমা, বাড়িয়ে দেয় বৃষ্টির দিকে, বলে এতে আমার সব কন্টাক্ট নাম্বার আর বাড়ির ঠিকানা পাবি, প্লিজ রে আমরা কিন্তু আর হারিয়ে যাবো না রে। 

ভিজিটিং কার্ডে চোখ পড়তেই দ্যাখে উপমা মিত্রের নামের পাশে বেশ বলিষ্ঠ অলঙ্কার সাজানো, আরও দ্যাখে নামি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির চিফ এক্সিকিউটিভ পদ বহন করছে। আপ্লুত বৃষ্টি স্কুল-কলেজে একসাথে বেড়ে ওঠার দিনগুলোর কথা ভেবে জাপটে জড়িয়ে ধরে, অস্ফুটস্বরে বলে, সত্যিই রে তুই নারী জাতীর উপমা! তখন মজা করে বলতাম...  আজ গর্বের সাথে বলছি। 

এই উপমা তোর রেসিডেন্স গোলপার্কে দেখছি তো! ঠিক কোথায় বলতো? 
শোন-শোন, খুব জরুরি মিটিং ছাড়া শনিবার আমি ফ্রি রে। 
আরে আমি তো গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারে যাই ! 
ব্যাস হয়ে গেল ! ঠিক ওখানেই! 
বুঝেছি  বুঝেছি গোলপার্কে মৌচাকের পিছন দিয়ে যেতে হবে তো? আর বাড়ির নম্বর তো আছেই ! 
গ্রেট উপমা মিত্রের নীড়! না বাবা তুই-ই বল, নীড় বলবো না খাঁচা বলবো রে? 
আত্মস্থ গলায় বলে, হ্যাঁ রে খাঁচাই বলতে পারিস!

নিজস্ব ভঙ্গিতে জড়িয়ে থাকা এক অচেতন ঘুমের মধ্যে পাশ ফেরার মতন...  একটা টেলিফোন বেজে ওঠে। বিরক্ত হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে, চোখের পাতায় ঘুম লেগে আছে চুম্বকের আলিঙ্গনে। 
উফ! এতো সকালে কে ফোন করছে? কমলটা যে কোথায় থাকে! ফোনটা তো ও-ই ধরে! ঘরের কাচের জানালাগুলো বন্ধ করে ভারী পর্দা টেনে দিতে ঘরটা বেশ ঠান্ডা হয়েছে, গত রাতে বালিশের পাশে পড়ে থাকা রিমোটে এসি টা অফ করে রিমোটে পাখা চালিয়ে শুয়ে পড়েছিল বৃষ্টি। উপমার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুম আসেনি বৃষ্টির গতরাতে। ছবির মতো চোখের পাতায় আলতো ছুঁয়ে ছিল লাস্যময়ী উপমা। শরীর বেয়ে একটা চটক, লুকানো শ্রী ছড়িয়ে আছে চেহারায়। ওর প্রতি একটু মনোযোগ দিলে ভালো লেগে যাওয়ার সম্ভবনা । ঠোঁটের হাসিতে শিকারীর বিজয়, মুক্ত সাজানো বাগান যেন দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে... শরীরের আনাচে-কানাচে তীব্র যৌন মাদকতার ঢেউ ছড়ানো আছে। উপমা মিত্র, ডাক নাম জয়ী। স্কুল কলেজে ছিল উপমা রায়। একটি ভীরু লাজুক মেয়ে। পারিবারিক কড়া শাসনে ছোট্ট গন্ডির মধ্যে বড় হয়ে ওঠা। যে মেয়ের স্বাদ - আহ্লাদ প্রতিনিয়ত ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে আবর্জনার স্তূপে, সে ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন লালন করতে শুরু করেছিল...  যৌবনের শুরুতে বিয়ের মতো একটা ঘটনা দুর্ঘটনার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়... 

আবার ফোনটা বেজে চলেছে, অস্ফুটে একবার বলার চেষ্টা করলো বৃষ্টি, 'কমল ফোনটা ধর না!' যাক, থেমে গেল! বৃষ্টি পাশ ফিরে শুয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়।...  কিন্তু  কয়েক মিনিট মাত্র! চটকে যাওয়া ঘুম আর চুঁইয়ে পড়া বিরক্তি 'রাবিশ যতসব'!  হাতের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরা রিসিভারে প্রতি বিরক্তির প্রকাশ ঘটে। 
------ইয়েস সুপ্রভাত, বৃষ্টি রায়চৌধুরী বলছি!
------আমি যেহেতু ফোন করেছি, আমি জানি তুমি কে! তোমাকে চাই। আজ সারাদিন তুমি কি আমার সাথে কাটাতে রাজি আছো? পুরুষ কন্ঠে ভেসে আসে কথাগুলো। 
------- রাবিশ! রিসিভার নামিয়ে উঠতে যায় বৃষ্টি, বেজে ওঠে আবার। 
-------বেশ লাগে তোমাকে রেগে যেতে দেখলে...  বলো না প্লিজ কোথায় যেতে চাও? শহর থেকে অনেক দূরে...? রাজি তো? পুরুষ কন্ঠ বলে চলে...
         হঠাৎ কোন পথের ভুলে / যদি যাও আমার গ্রামে, 
        দেখতে পাবে সবুজ মাঠে / করছে দু'জন খেলা। 
       অবাক হয়ে উঠবে হেসে / তুমিও ওদের পাশে, 
       দেখবে ওরা তোমার আমার হারানো মেয়েবেলা। 
এই মুহূর্তে বৃষ্টির মুখে কোনো কথা সরে না! কোনোক্রমে বলে, 'উপমা! উপমা তুই! তুই কি রে!
-------আমি? আমি হচ্ছি কর্ণ-কুন্তির কর্ণ আর বাসবদত্তার সন্ন্যাসী উপগুপ্ত... খুব জোরে হাসতে হাসতে উপমা বলে, ভুলে গেলি কি করে রে মাথামোটা!  স্কুল-কলেজে তো একটাও মেয়ের রোল পেলাম না কোনোদিন!  আমি মেয়ে হলে আমার ম্যাচিং পুরুষ জুটতো না!  তাই তো বাধ্য হয়ে ছেলেদের গলা নকল করা শুরু করেছিলাম সেই থেকেই। ভাবলাম, আমার বৃষ্টির সাথে সুপ্রভাতটা সেরে নিই। উপমা আবার বলে, আমি কিন্তু ক'টা লাইন শোনালাম ! উত্তর চাই আমার, দিবি না রে?  না না থাক, সবুজ মাঠে গ্রামের পথে যেতে যেতে তোর উত্তর শুনবো। 
-------বল রে, কখন বেরোবি?
------- এতো ফূর্তি কেন রে? এই ! অফিস যাবি না? 
-------অফিসের কোনো গল্প নেই আজ! আজ শুধু  long drive. খুব স্মল গ্যাপ নয় রে টুপুর!  গ্র‍্যাজুয়েশনের পর তুই বোধহয় এম.এ. করছিলি...  বল টুপুর বল! তারপর কি আমাদের দেখা হয়েছে? সময়ের দংশন ছিলাম রে!
--------তাই বুঝি সাত সকালে ...! 
-------- না, আর কথা নয়। বাকি সব দেখা হলে... আমি ঠিক নটার সময় হাজির হয়ে যাবো তোর গেটের সামনে।  হুম, বল কি ভাবে যাবো?
--------ঢাকুরিয়া ব্রিজ ক্রশ করে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি বাঁ দিকে ফেলে দেশপ্রাণ শাসমল রোড ধরে সেই পুরোনো রাধা স্টুডিও যা নাকি টলিউডের তীর্থ ক্ষেত্র ছিল এক সময়। তাকেও বাঁদিকে ফেলে একটু এগিয়ে মেঘমল্লার অ‍্যাপার্টমেন্ট। তার দশ তলায় আমার বাস। 
--------আমি কিন্তু উপরে উঠবো না 
--------তোর এতো তাড়া কিসের রে? মনে হচ্ছে রেডি হয়ে আছিস আমাকে পেলেই প্রপোজ করবি!  হা হা হা হা... 
--------ঠিক তাই, অনেক সময় নষ্ট করেছি রে... 
--------ওকে ম্যাডাম, নিচে অফিস ঘরে জানালেই আমি নেমে আসবো রে৷ 
পাক্কা ন'টা, উপমা মিত্রের গাড়ি এসে দাঁড়ালো অ‍্যাপার্টমেন্টের বড় গেটের সামনে। মোটামুটি অফিস এবং স্কুল-কলেজের টাইম, দারোয়ান ড্রাইভারের ভীড়ের মধ্যে ছাই রঙের জিন্সের সাথে কালো পাঞ্জাবীতে উপমা যেন অনন্যা। অফ হোয়াইট ও মেরুনের ঢাকাই জামদানীতে বৃষ্টিকেও বেশ চনমনে দেখাচ্ছে। সৌখিন রোদচশমা দু'হাতে নাকের ডগায় নামিয়ে উপমা বলে চলে...  টুপুর... এই টুপুর নষ্ট সময়ে হারিয়ে গেছিলাম রে! হঠাৎ করে বৃষ্টি উপমাকে জাপটে জড়িয়ে ধরে, উপমাও যেন তৈরি ছিল। দু'জনের চোখে জল...
          ছোট্ট বেলার গল্প শোনা /ছোট্ট মনের আশা
          রূপকথার ঐ রাজকুমারীর / ছোট্ট ভালোবাসা
        ছোট্ট অনেক কল্পকথা মনের কোণে রয়
       সেটাই বেশ ভালো ছিল / আজকে মনে হয় 
উপমা মুগ্ধের মত শুনতে থাকে বৃষ্টির সকালের উত্তর। একহাত স্টিয়ারিং-এ রেখে বাঁ হাত দিয়ে বৃষ্টির হাত খুঁজতে থাকে। এই আমরা কেমন কবি হয়ে যাচ্ছি রে, উপমা বাঁ হাতটা কলার তোলার ভঙ্গিতে বলে। দু'জনেই হাসতে থাকে, যেন হাসিতে শার্সি ভাঙার শব্দ।

ছোট্ট নীরবতা... দু'জনের দৃষ্টি সামনের দিকে। হঠাৎ করে উপমার স্টিয়ারিং-এ রাখা হাতটা চেপে ধরে বৃষ্টি, আস্তে করে বলে, 'প্লিজ একটু থামা'! দ্যাখ... দ্যাখ... উত্তেজিত বৃষ্টি দেখাতে থাকে দুটো রঙিন পাখি। 
উপমা -- হ্যাঁ, বেশ মিষ্টি পাখি, কিন্তু দেখার কি আছে ? 
ফুড়ুৎ করে পাখি দুটো এসে বসলো কাছে একটি গাছের ডালে। রীতিমতো উত্তেজিত বৃষ্টি উপমাকে প্রশ্ন রাখে, 'এর আগে কোনোদিন এই পাখি একসঙ্গে দুটো দেখেছিস ! 
---- লক্ষ্য করি নি, তাই দেখি নি ( হাল্কা চালে উপমার উত্তর )। মায়া লাগে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে। না, আসলে কেউ তো এভাবে কোনোদিন... তোর মন দিয়ে, চোখ দিয়ে আমাকে দেখতে শেখাবি রে বৃষ্টি!
আপনমনে বলতে থাকে, পাখিরা একজোড়া হলে দেখতে বেশ লাগে... যেন অল্পবয়সী স্বামী -স্ত্রী বেড়াতে চলছে... 
-----অল্পবয়সী কেন মনে হয়?
-----এমন রঙিন পাখিদের বুড়ো হতে দেখেছিস?
জানিস, পাখিরা অনেক দিন খাঁচার মধ্যে নিশ্চিন্তে খাবার পেতে পেতে, বাইরের আকাশে উড়তে চায় না। অনেকটা সেকেলের হিন্দু বাড়ির মেয়েদের মতন! যেন নিজেরাই স্বাধীনতা চায় না। 

ইয়েস ম্যাডাম, এবার একটু এগোতে পারি? পাখিতে আটকে থাকলে চলবে? হাল্কা ইয়ার্কির ছলে মুচকি হেসে উপমা বলে... 
হ্যাঁ হ্যাঁ প্লিজ চল রে, পাখিদের দিকে তাকিয়ে থেকেই আনমনে বলে বৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসির ঢেউ ফুটিয়ে উপমা বলে, মনে আছে রে বৃষ্টি, হাজরাদের বাগানে খেলতে যেতাম, কত ফড়িং ধরতাম! প্রজাপতি ধরা মানা ছিল, প্রজাপতি ধরলে নাকি বিয়ে হয় না! 'পোড়াকপাল'। এসব সব কথার কথা ! তখন বুঝতাম না! জীবনের অনেকটা পথ পিছনে রেখে বুঝেছি গত দিনগুলো ছিল ধূসর, আর সেই ধূসরতার শরীর থেকে হঠাৎ কোনো এক স্মৃতি টুপ করে নেমে আসে আমার একাকী বিষন্ন ঘরে, সেই শীতার্ত স্মৃতি আমাকে কাঁপায়, ভাবায়!
এক অদ্ভুত বিপন্নতায় আক্রান্ত গৃহবধূটি ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে শেষমেশ নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছিল। দাখিল করতে পেরেছিল আত্মপরিচয়। ভয়ানক নিরাপত্তার ঘেরাটোপ থেকে  নিজেকে মুক্ত করেছিল। বাঁ হাতটা বৃষ্টির হাতে রেখে উপমা বলে চলে... 'আজও ভুলতে পারে নি অসহায় গৃহবধূটি, বেঠিক সময়ের সামাজিক ভঙ্গুর  চালচিত্রের ছবি। 
মনে ভাবে বৃষ্টি,  উপমা কীভাবে গড়গড় করে বলে দিতে পারছে আমার কথাগুলো! গৃহবধূটি কি আমি?  না, ও নিজে! গাড়ির স্টিয়ারিং-এ আলতো করে ডান হাতটা রাখা...  গ্রামের পথে পথে চাকা ঘুরছে...  খুব সম্ভব জায়গাটার নাম ' কামারকুন্ডু '...... 

উপমা আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে যায়, গ্র‍্যাজুয়েশনের পর কোনো গ্যাপ দিতে চাই নি রে, চাকরির জন্য বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা, তার সাথে ছোট বড় কিছু কোর্স করতে শুরু করি। অবশ্যই বাড়ির অমতে। সেই সময় নির্ঝরের সাথে দেখা। চওড়া পুরুষালি বলিষ্ঠ চেহারা, চকচকে নিখুঁত নিকষ আঁধারের মতো গভীর মানুষ। এই প্রথম নিজের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি বোধ করি, যা আগে হয় নি কখনোই। আমার চোখে তখন রূপকথার রাজকুমারীর কল্পনা। একদিন নির্ঝর নিয়ে গেল ওদের নিউ আলিপুরের বিলাসবহুল বাড়িতে। আমি গেছিলাম নির্ঝরের প্রতি মুগ্ধতায়। 
...... বৃষ্টি, ভুলতে পারিনি আমি, নির্ঝরকে। কি করে ভুলবো বল !  ও যে আমার সবটা জুড়ে ছিল রে! আমি সাদামাটা আটপৌরে চেহারার লড়াকু মেয়ে। মামুলি সালোয়ারে লম্বা বিনুনি, নরম করে কথা বলা, আবেগপ্রবণ একটি মেয়ে। নির্ঝরের বাবা খুব গম্ভীর মানুষ। তাঁর গাম্ভীর্য বজায় রেখে আমার অনার্সের নম্বর, এবং লেখাপড়ার খবর নিলেন। ভবিষ্যতের কথা জানতে চাইলেন। 
...... উপমা নির্ঝরের মা কি করলেন রে? তাঁর প্রতিক্রিয়া কি ছিল রে? 
...... অনেকক্ষণ পরে বললেন , তা মা, নাম টা যেন কী?
...... উপমা, উপমা রায়। 
ভাইবোন আছে নাকি, বাবা কোথায় চাকরি করে, রান্নাবান্না কিছু জানি কিনা...  দ্রুত সোজাসাপ্টা জানতে চাইলেন নির্ঝরের মা। 
...... বৃষ্টি, তারপরের প্রশ্ন শুনে তুই ঠিক থাকতে পারবি না, আমি জানি। কিন্তু বৃষ্টি তাও আমি... বৃষ্টি তাকিয়ে থাকে উপমার দিকে... 
...... তা মেয়ে, দুদিন আমার নির্ঝরের সাথে ঘুরেফিরে খেয়ে ফূর্তি করে আবার কোনো বড়লোক দেখে...  ভেবে বলো বাপু !
আমি চুপ... ঘরে পিন পড়লেও ঝংকার উঠবে যেন ! চলে গেলেন সবাই, রইলাম আমি আর নির্ঝর। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম শূন্যের দিকে... 
------ বুঝলাম! তোর ওই প্রেমিকটা কিছু বললো না? উপমা, আমার কিন্তু মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে!!
------- হুম, বললো। মা তাঁর অভিজ্ঞতা থেকেই কথাটা বলেছেন। এটা উচিত কথা, তাই শুনতে খারাপ লাগলেও...  
সেদিনই আরও বলেছিল নির্ঝর, উপমা আমি তোমার রূপে মুগ্ধ, আগে দেখিনি এমন আটপৌরে রূপ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই উপমা। 
বুকের উপর চেপে বসা জগদ্দল পাথরটাকে গড়িয়ে একটু যেন নিচের দিকে নামিয়ে দিলাম, আবেগে তাকিয়েই ছিলাম নির্ঝরের দিকে। 
------- জীবনের পরতে পরতে কতো সঞ্চয়ের ঝুলি পূর্ণ হতে থাকে, উদ্ধত হাসিতে বৃষ্টি বলে চলে, তোর ওই নির্ঝর কোনো প্রেমিকই ছিল না, ভন্ড প্রেমিকের আইডিয়া মাত্র! মোহগ্রস্ত মন, শুধু নারীর প্রতি গন্ধ শুকে বেড়ায়। 
তারপর... তারপর বল কি হলো! বিয়েটা হলো? 
------ না! বিয়েটা কেউ আটকাতে পারলো না, নির্ঝরের বাবা প্রথম থেকেই মত দিয়েছিলেন, মত ছিল না বাকিদের। আমার বাড়ির কেউ রাজি ছিল না। 
------ তারপর? 
 ঘন কালো মেঘের ঘটা, উপমার মুখেচোখে আত্মপ্রত্যয়হীন ভাষা, যেন শব্দ খুঁজে ফিরছে... বৃষ্টি, আমার ভিতরের আমিটা বার বার তর্জনী তুলে শাসন করছিল...  পাত্তা দেই নি সেই মুহূর্তে!
বউভাতের দিন দুপুর। মাথায় কাপড় টেনে বড়দের ভাত পরিবেশন করার কথা। আমাদের চিরন্তন নিয়মের প্রথা মেনে, 'নির্ঝর বলে, আমি তোমার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলাম'। শুরু হয়ে যায় আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে গুন গুন গুঞ্জন , চারিদিকে ফিসফাস কানাকানি...  ভেসে আসা কথা, 'দিনরাত টিউশন করে পেট চালানো মেয়েকে এতো মূল্যবান শাড়ি না দিলেই চলতো ' বৃষ্টি,  বুক কাঁপতে শুরু করেছিল তখন থেকেই। 
সন্ধ্যায় সাজো সাজো রব,নতুন বউয়ের রূপে আলোকিত চারিদিক। কেউ বলছে সুপ্রিয়া, কেউবা মাধবীর সাথে মিল খুঁজতে ব্যস্ত! ততক্ষণে বুঝে গেছি, এটা আমার জায়গা নয়! চারিদিক থেকে টিপ্পনীর ছোবল... 
বিয়ের সাতদিন পর... 
আমার এয়োতি চিহ্ন মুছে ফেলে দেওয়া হলো জোর করে, কপালের সিঁদুর, শাঁখা পলা শাশুড়ি মা নিজে সব করলেন !  কিন্তু শরীর থেকে... !  মুছতে পারে নি কেউ... ! 
বৃষ্টি আর নিতে পারছিল না, দু'কান চেপে বলতে থাকে উপমার উদ্দেশ্যে, প্লিজ উপমা প্লিজ ...! ভুল ছিল উপমা রায় এর, ভুল ওদের না। ঐ অনিবার্য অনিশ্চয়তার কবলের জন্য তুই নিজে দায়ী ছিলি উপমা! সোসাইটির উঁচু মহলের বাসিন্দা ওরা, ওদের শোভা পায় এসব! কিন্তু নির্ঝর?  নির্ঝর কি করলো রে?
আপন মনে বলতে থাকে উপমা, নিজেরই অলক্ষ্যে ঘুণপোকায় আক্রান্ত এক সময়ের উথলানো প্রেম যখন থিতিয়ে তলানিতে চলে যায়...  মিউচুয়াল সেপারেশন ছাড়া উপায় ছিল না। সেই নির্ঝরকে পরে বুঝলাম, প্রেম নামক শব্দের অন্তরালে দুর্বোধ্য কোনো এক অনুভূতি।
------তোকে সোজাসুজি কিছু বলেনি ? 
------বার বার একটি কথা !  আমি নাকি মিডিলক্লাস মেন্টালিটি বিলং করি!
ওরা চেয়েছিল সফিস্টিকেশনের প্রলেপ, আর আমি চেয়েছিলাম উন্নত উদার মানসিকতা। শিক্ষিত ভদ্র ফ্যামিলির মেয়ে আমি। সমস্ত শিষ্টাচার নিয়েই আমার পরিচিত পৃথিবী। ফিরে আসার সময় নির্ঝরকে বলেছিলাম, 'যে সাহেবিয়ানা তোমাদের তথাকথিত সভ্যতার মাপকাঠি, মিডিলক্লাস ফ্যামিলির হয়েও আমি অনেক বেটার জানি। 
-------ভেরি বোল্ড ডিসিশন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে আসতে তোর কষ্ট হয় নি রে উপমা?
------ হয়েছে, খুব হয়েছে। বিয়ের সাতদিনের মধ্যে ভরসা-ভালোবাসা কিছু দেখতে পাইনি নির্ঝরের মধ্যে। দেখতে পেয়েছি শুধুই শারীরিক ভোগ!
অক্টোপাসের অগুনতি শূঁড় হয়ে পেঁচিয়ে ধরে প্রশ্ন করতে থাকে, দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়, শুধু অন্ধকার...  চারিদিকে শুধু অন্ধকার... হাঁকপাঁক করে ওঠা অস্তিত্বের সঙ্কট। সেই সময় আমার চোখ থেকে মুছে গেল... ঘাড়ের কাছে আলতো খোঁপা,কপালে মস্ত টিপ, ছাপা শাড়ির আঁচলে হলুদের দাগ, সদ্য রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে হলুদের গন্ধমাখা হাতে একান্তে নির্ঝরের পাশে আমি।

একটা ধাবার সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালো। নজর কাড়া দুই মহিলাকে আসতে দেখে ধাবার মালিক তো ব্যস্ত ! আসুন, দিদিমণিরা, এ...ই, এ...ই মানকে...  মানকে নামক বাচ্চা ছেলেটি এসে ঘাড়ের গামছা দিয়ে চেয়ার মুছতে থাকে... কি কি কোল্ডড্রিংক্স আছে এক দমে বলতে থাকে। শুধু কি মানকে! সবাই এসে হাজির, একটু যদি দিদিমণিদের সেবায় আসতে পারে... খাটিয়ায় বসে ভোজনে ব্যস্ত মানুষগুলো রিমোটে আটকে যাওয়া মনে হচ্ছে। 
বৃষ্টি এগিয়ে এসে বলে... তোর নাম বুঝি মানকে?
না- হ্যাঁ মানে মানিক চন্দ্র নস্কর। 
কিন্তু নস্কর বাবু , আমরা যে ভাত খাবো! মুহূর্তের মধ্যে দৌড়ে পালিয়ে যায় মানকে, মালিকের কাছে। উপমা আর বৃষ্টি দেখতে থাকে ধাবার মালিকের কান্ডকারখানা। যেন বিনা নোটিশে রেড! অল্প সময়ের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে ছাতা লাগিয়ে টেবিল - চেয়ার পেতে সুন্দর মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করে দেয় ধাবার মালিক। 
আসলে অনেক সাহেব - মেমসাহেব আসেন আমার এখানে, তাই একটু - আধটু ব্যবস্থা রাখতে হয় দিদিমণি...  বললেন ধাবার মালিক দীনবন্ধু বাবু। 
ওরা দীনবন্ধু বাবুর পেমেন্ট মিটিয়ে, বাচ্চা ছেলেদের হাতে কিছু বকশিস তুলে দেয়। এমন সময় ঘোমটা টানা গৃহবধূ এসে ওদের হাতে প্লেটে সাজানো পান দিয়ে বলে...  সাদা পান, জরদা দেয় নাই । বৃষ্টি - উপমা অবাক...  একি কান্ড ! তুমি কে গো ?  বৃষ্টি উৎসাহে ঘোমটা সরিয়ে বলে --- দেখ উপমা কি দারুণ বিউটি রে !  ততক্ষণে দীনবন্ধু বাবু এসে পড়েছেন, বলেন - আসলে দিদিমণিরা কলাপাতায় ভাত খেতে চাইলেন, ভাবলাম কলাপাতায় খাবেন আর খেয়ে উঠে একটা পান খাবেন না, তা কেমন করে হয় ! 
এ হচ্ছে আমার ইস্ত্রি বাতাসী। ঘোমটা আরও টেনে লজ্জায় সে যেন বাতাসের সাথে মিশে যেতে পারলে বেঁচে যায়। 
এবার ফেরার পালা। স্টিয়ারিং - এ বসলো বৃষ্টি। গুন-গুন করে গান গাইতে থাকে উপমা, গলা মেলায় বৃষ্টিও। 
... হ্যাঁ বল উপমা, আজকের উপমা মিত্র হলি কি করে ? 

এবার ফেরার পালা। স্টিয়ারিং - এ বসে বৃষ্টি। গুনগুন করে গান গাইতে থাকে উপমা, বৃষ্টিও গলা মেলায়... 
------- হ্যাঁ বল উপমা, আজকের এই উপমা মিত্র হলি কি করে ? 
লড়াই, নিজের সাথে নিজের লড়াই -- থেকে থেমে উত্তর দেয় উপমা। সেই সাদামাটা আটপৌরে মেয়েটি অনেক যন্ত্রণা বুকে জমিয়ে ফিরে এলো বাপের বাড়ি। চারিদিকে বিদ্রুপের চাপা অট্টহাসি তাকে লক্ষ্য করে। অপমান - অপবাদের কাদায় নামতে হয় প্রতিনিয়ত। উপমা বলতে থাকে, তুই তো সবই জানিস বৃষ্টি, শুধু একটা দিন তোর - আমার দেখা না হলে কতো কষ্ট হতো আমাদের ! স্কুলে সবাই বলতো বৃষ্টি - উপমা, বাড়িতে পাড়ায় আমরা ছিলাম টুপুর - জয়ী। কিন্তু, আমার এতো বড় বিপর্যয়ে আমি তোকে ছাড়াই কাটিয়েছি। 
সব মনে আছে রে আমার উপমা, ---- মাসিমার মুখে শুনেছি বিয়ে হয়ে এসেছিলেন ওই ভাড়া বাড়িতে, সম্পূর্ণ বাড়িটা দশ কাঠার উপর... এখনও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই , প্রকান্ড গেটের পর অনেকটা বাগান, তারপর বিশাল লম্বা বারান্দার পর ঘর শুরু। অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে পর পর বেশ ক'টি ঘরের মধ্যে তোর একটা পড়ার ঘর ছিল। বৃষ্টিকে থামিয়ে উপমা বলে, সেই ছোট্ট অন্ধকার ঘরে একলা বসে কতোদিন ভাবতে ভাবতে ভুরু কুঁচকে উঠেছে আমার !  একটা প্রশ্নে বারবার নিজের কাছে নিজেকে বিব্রত হতে হয়েছে রে ! 'জয়ী' এই নামটা খুবই বেমানান - অস্বস্তিকর !  সুশ্রী জয়ীর জীবনে কানাকড়ি জয়ের দাক্ষিণ্যও দেখা দেয়নি তখন। ভাবতাম, জীবনের শুরু থেকেই হেরে চলা যার অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে, সেই জয়ী জন্ম মুহূর্ত থেকেই যেন পরাজয়ের অভিশাপ নিয়ে জন্মেছে। আমার দাদার পর দুই দিদি, এখানেই তো আদর্শ পরিবারের পূর্ণচ্ছেদ হতে পারতো !  হাল্কা হেসে উপমা বলে, --- কিন্তু না, তা হয় কি করে !  দাদা সবেধন নীলমণি, শিবরাত্রির সলতে, বংশের সলতে মজবুত করতেই তো আরও একটি ছেলের প্রত্যাশায় জয়ী নামক কন্যা সন্তানের আবাহন। অবশ্য, তারপর জয়ির একটি ভাই হয়, আর সাথে সাথে সংসারের নিয়ম অনুযায়ী একটু যেন আলাদাভাবে বড় হতে থাকে জয়ি। 
উপমা প্লিজ, আজ আর... 
থামিয়ে দেয় বৃষ্টিকে উপমা। 
কপট রেগে বৃষ্টি বলে, উপমা আজ তুই সমাজের প্রতিষ্ঠিত মহিলাদের মধ্যে একজন। কারও দাক্ষিণ্যে বা করুণায় তুই প্রতিষ্ঠা অর্জন করিস নি, উপমা তুই আমার অহংকার রে ! 
নারে বৃষ্টি, জন্মলগ্ন থেকে ধেয়ে আসা... সারাজীবন ধরে বয়ে নিয়ে চলতে বাধ্য, আমি বড় ক্লান্ত - অবসন্ন রে।
আমরা যখন স্কুলে, তখন তোর দিদিদের বিয়ে হয়েছিল। তাই নারে উপমা ? 
একটু অন্যদিকে কথা ঘোরাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল বৃষ্টি। 
বিষন্ন হাসে উপমা।হাসির বিষাদ জড়িয়ে যায় পরের কথায়। হ্যাঁ , দিদিদের বিয়ের পর থেকেই পড়ার চাপের সাথে সংসারের চাপও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দাদা লক - আউটে আক্রান্ত, বাবার অল্প পেনশনে সংসারের চাকা আটকে যায়। ডুবে যায় বেলা শেষের ঝলসানো চড়া রোদ,নেমে আসে অদ্ভুত কিম্ভুত অন্ধকার। সেই অন্ধকার খুঁড়ে অশালীন ভঙ্গিতে আঙুল তুলে কে যেন প্রশ্ন করতে থাকে ------ এরপর ? এরপর সামনে তোমার অনেকটা পথ ! 
------ তোর জয়ী লড়াই চালিয়ে গেছে, নিজের সাথে নিজের লড়াই, বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি, তারসাথে অনিবার্য ভাবে কিছু কোর্স করে নিতে থাকলাম। শুধু সাহায্য করেছে আমার মেধা, না হলে... না হলে উপমা মিত্র আজ এখানে পৌঁছাতে পারতো না রে টুপুর ! প্রথমটায় একটি বাণিজ্যিক সংস্থার টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট পদে যোগ দিই , অবশ্য অস্থায়ী পদ। বেতন তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। আকর্ষণীয়া - সুন্দরী অথচ দৈনন্দিন জীবনের সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে ক্লান্ত আমি তখন খুবই সাদামাটা মামুলি মেয়ে। পায়ের তলার মাটি শক্ত করার বীভৎস দীর্ঘশ্বাস দৌড় ! জয়ের উদগ্র খিদে অনেক সময় মানুষকে আমূল-পরিবর্তন করে দেয়। বাইরে থেকে দেখলে একজন মানুষকে যেমন দেখায়, ভেতরে তখন সে সম্পূর্ণ আলাদা,অন্য একজন হয়ে ওঠে। জয়ের জন্য ব্যগ্রতা আমার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি কে বদলে দিতে থাকে। 
টুপুর !  টুপুর ঠিক এই সময়ে বিজন মিত্র, এলাহাবাদের প্রবাসী বাঙালি, বিদেশ থেকে   এনিমেশন কোর্স করে... এদেশে বড় মাপের একটি এনিমেশন স্টুডিও তৈরি করে। অবশ্যই সাথে ওজনদার চাকুরি। 
------- সোজাসুজি বিয়ের প্রস্তাব দেয়। 
আরে বস্!  ইন্টারেস্টিং রে !  জয়ি বল, বল রে! 
উপমা সাঁতরে চলেছে পিছনের দিকে ক্রমাগত, আনমনে বলে... আমার সেই সময়ের বর্তমান অনেকটাই গড়ে তুলেছিলাম অতীতের ওপর নির্ভর করে। না চাইলেও নাছোড়বান্দার মতো অতীত ছায়া ফেলতে থাকে পলাতক হাতিয়ারবিহীন যুদ্ধের সুড়ঙ্গপথের দিকে। 
বিজন আমার অনেক কথাই বুঝতে পারতো না। যখন বিয়ের প্রস্তাব দেয় আমাকে, বলেছিলাম আগে আমার সব কথা শোনার সময় দাও। 
কোনো কথা না শুনে বিজন শুধু বলে, আই লাভ ইউ উপমা। এক জীবনে কতোটুকু জানা যায় !  আমি যে জানতে চাই না উপমা ! 
------ আবার সেই প্রেম ?  আই লাভ ইউ !  উপহাসের ভঙ্গিতে বৃষ্টি... 
----- ঐ কথাটা বলতে পেরে খুশি হয়েছিল বিজন। অনেকদিন নিজের ঘরে, আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রিয়ার্সেল দিয়েছে। 
----- তুই জানলি কি করে ? 
----- পরে শুনেছি। 
----- মানে ?  বিয়ে হয়েছিল তোদের ? 
----- ঐ সময় বেঁচে থাকার নিয়মে বেঁচে ছিলাম !  দ্বৈত সত্তা থাকায় মনের ভিতর দুটি 'আমি' পাশাপাশি চলে... তাই সহজে প্রেমে পড়তে পারিনি। ভালো - মন্দ বাছাই করার সময় ছিল না। 
----- উফ !  বল না... তারপর ! 
----- একদিন বিজন বললো, প্লিজ উপমা,  প্লিজ মনটা শান্ত করো, হ্যাঁ বলো আমাকে উপমা। দেখো উপমা, আয়নার ওপর বাইরের সব ছবিরই প্রতিবিম্ব পড়ে, তাই বলে কি আয়নায় চিড় ধরে! আয়নাকে উদারতায় মুড়ে রাখতে হয়। 
------ তার মানে !  তার মানে তুই উদার হলি জয়ী ? 
------ হ্যাঁ রে, অবশেষে ! একটু থেমে আবার বলে উপমা, বিজন কিন্তু দুর্দান্ত প্রেমিক ছিল। অসম্ভব প্যাশানেট। ও আমার ভিতরটা পড়তে চাইতো, আমাকে ভালো রাখার জন্য। 
একটু সময় চুপ থেকে উপমা চোখ বন্ধ করে বলে... থ্যাংকস বিজন, আমাকে বেশ কিছু এক্সাইটিং মোমেন্টস গিফট করার জন্য। 
গভীর দীর্ঘশ্বাস নিরাপদে লুকিয়ে বৃষ্টি বলে,--- এ এক পরম প্রাপ্তি!
কখনো কখনো মুহূর্ত ভরে যায় সুগন্ধে... কাঙ্খিত সুখ যেন আপনা থেকে ধরা দেয়। আনমনে উপমা বলে চলে--- সে একটা সময় ছিল যখন লোকে চোখ ফেরাতে পারতো না আমাদের থেকে। চাকরির ব্যস্ততার মধ্যেই একটু-আধটু চুরি করে প্রেম জুটে যাচ্ছিল আমাদের কপালে! বিয়ে হয় অনুষ্ঠান ছাড়াই। চেয়েছিলাম বিজনের সাথে চুটিয়ে জীবনকে প্রত্যক্ষ করবো। 
-----করেছিস?
-----হ্যাঁ, কিন্তু ধরণটা আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয়। দক্ষ কর্মক্ষমতা, আত্মপ্রত্যয় বিজনকে ক্রমশ  উন্নতির হাতছানি তাড়না করতো। আরও বড়, আরও উন্নতি... এইভাবে বিজন ছুটে চলতো নতুন নতুন চাকরির ব্যস্ততায়। এইভাবেই একবার চাকরি ছেড়ে আমাকে নিয়ে চলে যায় গোয়ার এক গ্রামে। যেখানে বাংলোটা ছিল কুঁড়ে ঘরের আদলে। পাশেই সমুদ্র। সমুদ্রের জল ছুঁয়ে সকালে হাঁটা। জেলেদের সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল আমাদের। মাছ নিতাম ওদের থেকে। ছুটির দিনগুলো ছিল ভিন্ন স্বাদের। আহা কি জীবন! দিন শুরু আর শেষ হতো সমুদ্রকে সাথে নিয়ে।
------চলে এলি কেন রে জয়ি? তামাটে জীবন কাটাতে? 
-----টুপুর! এই টুপুর! জানিস, ছুটির দিনে পাড়ে রাখা নৌকায় বসে আমরা বিয়ার ফেনি মাছ ভাজা দিয়ে খেতাম...  সমুদ্র বার বার আসতো আমাদের কাছে, আমরাও ফিরে ফিরে যেতাম সমুদ্রের ফেনায়িত লাবণ্যের মোহে। নিজেদের  মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকতেই অভ্যস্ত ছিলাম। বুঝতাম, গ্রামবাসী জেলেরা আমাদের খুব একটা সুস্থ ভাবতো না! তারপর... তারপর বাঁধনছাড়া ঢেউ এর শব্দ শুনতে শুনতে দিনশেষে ঘুমিয়ে পড়তাম। 
অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে বৃষ্টি... 
------আমাদের খামখেয়ালিপনার জন্য চাকরি জীবনে দু'জনেরই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে না তেমনভাবে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা একটু সচেতন হতে শুরু করেছিলাম। মিশর তখন বড় হচ্ছে। 
বৃষ্টি উপমাকে থামিয়ে প্রশ্ন করে , হ্যাঁ রে, মেয়ের এইরকম নাম রেখেছিলি কেন রে?
------মিশর ইজিপ্টে জন্মায়, তখন আমাদের পোস্টিং ইজিপ্টে। 
গাড়ি জানলার বাইরে চোখ রেখে বেশ কিছু সময় চুপচাপ। 
বৃষ্টি বলে ওঠে, কিরে স্মৃতিগুলো বুঝি হ্যাঁচকা টানে টাগ অব ওয়ার চালিয়ে যাচ্ছে????  হাসতে থাকে উপমার দিকে তাকিয়ে।  
------আয়ুর সীমানা কেউ জানে না, অখন্ড নীরবতা... সেই নিথর নৈঃশব্দের হাত ধরে ঢুকে পড়লো কিছু অস্বস্তিকর এলোমেলো হাওয়া, যা মুহূর্তে ওলট-পালট করে দেয় এতোদিনের লালিত নিশ্চয়তার চেনা ছক। দিনটা ছিল সতেরো নভেম্বর। কার এক্সিডেন্ট। বিজন তখন আটচল্লিশ বছরের ইয়াং ম্যান। বিজন মিত্রের চলে যাওয়ার খবরটা কাগজে-নিউজে চোখে পড়ে সবার। ভাবি নি রে বৃষ্টি... ভাবি নি আমার জীবনে এভাবে মিডলাইফ ক্রাইসিস আসবে! মৃত ব্যক্তিদের বয়স বাড়ে না, আজও বিজন আমার কাছে সেই আটচল্লিশ বছরের টগবগে ইয়াং ম্যান। ওর চলে যাওয়াটা এতো বেশি সত্যি যে... মিথ্যে বলে মনে হয়! জীবন যুদ্ধে হেরে  যাওয়া একটা মানুষ! কিছুটা চুপ থেকে, দ্যাখ মনে হয় না স্বপ্ন ছিল শিল্পী হওয়ার, হলো ছবি আঁকার মাষ্টার!

মনে পড়ে বৃষ্টির, কোথায় যেন পড়েছিল--- বিজ্ঞান খুঁজে খুঁজে বার করেছে, মরদ জোনাকিটা জ্বলে আকাশে, আর ঘাসের অন্ধকারে জ্বলে মেয়ে জোনাকির প্রাণটা। বুকের আগুন দেখিয়ে ডাকে একে-অপরকে। ভূমিকাহীন নিছক ঘটনা--- এ কাহিনী নয় ! 
এতোক্ষণে উপমার অলটো মেঘমল্লার এর বিশাল গেটের মুখে। জাপটে ধরে দু'জন দু'জনকে, চেষ্টা করবো রে জয়ি তোর বিজনের অভাব ফিরিয়ে দিতে। 

লিফটে বেগমের সাথে দেখা, হ্যাঁ বেগম সেন, বৃষ্টির সামনা-সামনি ফ্ল্যাট, ভদ্রতা সূচক বানানো হাসি টেনে, ভালো তো মিসেস সেন? 
সেই রাতে বৃষ্টির একটা তীব্র ভয় শিরশিরানি গ্রাস করছিল...  বাজপড়া গাছের মতো প্রতিবাদহীন স্থির অবিচল... এলোমেলো রেখাগুলো দাগ কাটছিল বৃষ্টির জীবনের পরতে পরতে... অপরাধী মনে হতে লাগলো উপমার কাছে, নিজের জীবনের ছিন্নভিন্ন ঘটনার পরম্পরা কিছুই বলতে পারলো! তবে কি বৃষ্টি ভালোবাসার কাছে হেরে না যাওয়া একটা ক্ষতবিক্ষত মানুষ! অলস বারান্দায় আনমনে পায়চারি করতে করতে রাতটা কাটিয়ে দেয়...






অনাহুত অতিথি

আ র তি  ধ র


-ন্যাড়া মাথা, পরনে সাদা ধুতি গায়ে একখানা শাল জড়িয়ে ব্রত সান্যাল ব্যস্ত নিজেই তদারকিতে। ঘোষ বাবু আর ঘোষ বৌদিকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন 'কেমন হয়েছে রান্না বৌদি?'

-সবে কাতলা কালিয়া শেষ করে গলদা চিংড়ি প্লেটে ঢালতে ঢালতে ঘোষ গিন্নি জবাব দেন 'ছোট মাছটা দারুণ হয়েছে ব্রত, কি মাছ এগুলো?'

এগুলো কালজানির বোরোলি বৌদি, পাওয়া যায় না, কয়েকজনকে বলে রেখেছিলাম তাই রক্ষে, বলতে বলতে ব্রত সান্যাল ডাক দেয়, ওই শঙ্কর বোরোলি মাছটা এদিকে নিয়ে আয় দেখি.. বলেই ওদের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি একটু ওদিকটা দেখে আসি বৌদি শেষপাতে ছানার পায়েস আছে খেয়ে দেখবেন কিন্তু...?

-ব্যস্ত মলিও, ছেলের স্কুলের ম্যাম'রা এসেছে, ওর বন্ধুদের মায়েরা এসেছে, এছাড়াও বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজন, নতুন একটা তাঁতের শাড়ি পড়েছে মলি এক ফাঁকে একটু পার্লারও গিয়েছিল। 

-হোক না শাশুড়ির শ্রাদ্ধ, একটা অনুষ্ঠান তো! তবে শ্রাদ্ধ মিটে গেছে গতকাল, আজ মাছ ছোঁয়া, সেই উপলক্ষে এই এলাহী আয়োজন। 

-লোকজন আসছে, সবে এক ব্যাচ উঠেছে, ওনারা না উঠতেই আর এক ব্যাচ এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের পেছনে। 

ব্রত সান্যাল একজন শিক্ষক, শিক্ষিতা মলি এখন গৃহবধূ, ছেলেকে মানুষ করতে ব্যস্ত। 

আর এক ব্যাচ বসে গেছে, মলি একবার চোখ বুলিয়ে নিল এ ব্যাচে বিশেষ কেউ আছে কিনা! নাঃ এখানে কেবলমাত্র পাড়া-প্রতিবেশীদের দেখা যাচ্ছে, একটু যেন স্বস্তি পেল ও! 

ঘরে গিয়ে একটু আরাম করবে ভেবে ও প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে এসে দেখে, দেখতে অনেকটা তার শ্বাশুড়ী বিন্দুবাসিনীর মতো একজন বৃদ্ধাকে ছেলে সাগর হাত ধরে নিয়ে আসছে! 

ছেলের কান্ড দেখে মনে মনে রাগ হলেও এই প্যান্ডেল ভর্তি মানুষজনের সামনে সেটা প্রকাশ না করে ওকে জিজ্ঞাসা করে, এটা কে সাগর? 
 
-ও মা এটা একটা ঠাম্মা, আমার কাছে খাবার চাইছে
বলতে বলতে সেই বৃদ্ধাকে ওখানে রেখে দৌড়ে যায় তার ঠাম্মার ঘরে। একটু পরেই একটা কৌটায় কিছুটা চাল ভর্তি করে ওপরে একটা আলু দিয়ে এনে ওই বৃদ্ধার হাতে দিয়ে বলে, 'ও ঠাম্মা বুড়িদের ভালো কিছু খেতে নেই, আমার ঠাম্মা রোজ এই খেত, তাই না মা?'

হাতের কৌটা নামিয়ে রেখে চলে যান সেই বৃদ্ধা আসার পথ ধরে... প্যান্ডেল ভর্তি মানুষজন মাখা খাবার রেখে তাকিয়ে থাকেন মলির দিকে।
ধবধবে সাদা রঙের গমগম করা প্যান্ডেলে হঠাৎ শান্তি নেমে আসে।







জীবন যে রকম

স ঞ্চি তা  গো স্বা মী


শেষ ভাদ্রের দুপুর। ঝলমলে রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। গরমও খুব। পুজোর আর মাসখানেক বাকি। গড়িয়াহাট মার্কেটে পা ফেলার জায়গা নেই। রীতিমত গলদঘর্ম হয়ে কিছুটা পুজো শপিং সারছে অমৃতা। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন নাম ধরে ডাকলো তাকে। একবার চমকে ওঠে সে। তারপর ভাবে এই ভীড়ে অন্য কেউ ডাকছে কাউকে। এখানে কেই বা চিনবে তাকে। সুদূর উত্তর কলকাতার টালা  পার্কে তার বাড়ি। আবার মন দিয়ে সে তার  চার বছরের মেয়ে তিন্নির জন্য জামা পছন্দ করতে থাকে। কিন্তু, একটু পরে একটা হাত এসে তার পিঠের ওপর পড়ে। মুখ ঘুরিয়ে চমকে ওঠে অমৃতা... তনুশ্রী না? স্কুলে তার সহপাঠী ছিলো তো!! তনু বলে হা করে দেখছিস কী? আমায় চিনতে পারছিস না? অমৃতা একটু অপ্রস্তুত... বলে, একটু কষ্ট হলেও চিনেছি রে। কতোদিন পর দেখা বলতো? আর, তুই কিন্ত ব্যাপক পাল্টে গেছিস ভাই। তনুশ্রী হাসে। বলে, সেটা খারাপ নাকি ভালো দিকে পাল্টেছে? অমৃতা বলে, খুব ভালো লাগছে রে তোকে দেখতে। সেই যে ক্লাস নাইনে পড়তে পড়তে পালিয়ে বিয়ে করলে, আর তোর খবর পেলাম না। এসব বলে অমৃতা আর লক্ষ্য করতে থাকে তনুর গায়ে ভীষন দামী একটা ড্রেস। হাত পা সযত্নে ম্যানিকিওর পেডিকিওর করা। গায়ের রং নিয়মিত ঘষা মাজা করে এতো চকচকে যে মাছি বসলে পিছলে যাবে। গা থেকে দামী বিদেশি পারফিউমের গন্ধ বেরোচ্ছে। সব মিলিয়ে বৈভব ফেটে বেরোচ্ছে তনুর গা থেকে। সেখানে অমৃতা নিতান্ত সাদা মাটা এক সালওয়ার পরে আছে। গরমের জন্য সে এইরকম সুতির জামা বেছে নিয়েছে। তেমন একটা পরিপাটি হয়েও বেরোনো হয়নি। আর, এতো দামী ড্রেস বা সুগন্ধি অবশ্য তার নেই। তবুও, যা আছে আজ তার থেকেও সাদামাটা সে। একগাল হেসে তনুশ্রী বলে, তুই কিন্ত সেই একরকম আছিস। সেই কাটা কাটা নাক মুখ, জ্বলজ্বলে চোখ... আমাদের সেই পুরনো অমৃতা। এখানে ভীষন গরম রে, চল কোথাও একটু বসি গিয়ে। অমৃতা বলে, হ্যাঁ চল। এখানে যা ভীড় আর গরম। তনুশ্রী হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে যায় রাস্তার উল্টো দিকে একটু ফাঁকা জায়গায়। ওখানে গিয়ে আরেকবার অবাক হবার পালা অমৃতার। বিরাট বড় ঝাঁ চকচকে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভার সমেত। তনু বলে চল ওঠ। অমৃতা বোকার মতো বলে, কোথায় যাবো রে? তনু বলে এই যে বললাম কোথায় একটু বসি চল। একটা সি সি ডি দেখি। অমৃতা উঠে পরে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে উঠে কী যে আরাম লাগে। কাছেই এক কফি শপে ঢোকে ওরা। কফি নিয়ে অনেক গল্প হয় দুজনে। বাড়ি থেকে পালিয়ে তনুশ্রী এক কেবল অপারেটর ছেলের সাথে ঘর বাঁধে। ওর আর লেখা পড়া হয়নি। ওর স্বামীও তেমন শিক্ষিত নয়। কিন্ত, ব্যবসা বুদ্ধি দারুন। ওই ব্যবসাতেই বিরাট উন্নতি করেছে। কলকাতা শহরের বিশাল এরিয়ার কেবল ব্যবসা শুধু তার হাতে। এ ছাড়া এখন আরো দু তিন রকমের বিজনেস আছে তার। সবটা ঠিক খুলে বললো না তনুশ্রী। তবে এটুকু বোঝা গেলো বিত্ত বৈভব আর সুখ ওর গা বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। ওরা প্রায়ই বিদেশ বেড়াতে যায়। তিন হাজার স্কোয়ার ফিটের  ফ্ল্যাট আছে কলকাতার সবচেয়ে দামী জায়গা সাউথ সিটিতে। এ ছাড়া আরও নাকি চার পাঁচটা ফ্ল্যাট আছে। ওদের একমাত্র ছেলে লন্ডনে থেকে লেখাপড়া করছে। খুব করে একদিন যেতে বলে তনুশ্রী অমৃতা আর তার বরকে। 

অমৃতা আনমনা হয়ে যায় ওর কথা শুনতে শুনতে। বরাবরের মেধাবী অমৃতা যখন পরীক্ষার আগে দিন রাত এক করে পড়তো, ওদের বাড়িতে কতোদিন এসেছে তনুশ্রী। ওর কাছে অঙ্ক শিখতো। সারাদিন বসে ওর সাথে টেষ্টপেপার সলভ করতো। ওর তেমন একটা মন ছিলো না লেখা পড়ায়। অমৃতার মা কতোদিন আদর করে খাইয়েছেন তনুশ্রী কে। পাঁচ ভাই বোনের সংসারে তনুশ্রীর বাবা কোনো এক বড়ো দোকানে খাতা লেখার কাজ করতেন। খুব কষ্ট করেই ওদের সংসার চলত। সেই মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ার সময় বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে । আর অমৃতা স্কুল পাশ করে কলেজ, কলেজ পাশ করে ইউনিভার্সিটি। সেখানকার সহপাঠী সুজয় কে বিয়ে করে। সুজয় এক সরকারি অফিসের মাঝারি মাপের অফিসার। অমৃতা বিয়ের পর চাকরির চেষ্টা করছিল। পেয়েও যেতো হয়ত..... কিন্ত, হঠাৎ তিন্নি এসে গেলো। ওদের একমাত্র মেয়ে। ব্যাস.... অমৃতা নিজের সব মেধা, পরিশ্রম ভুলে গিয়ে পুরোপুরি গৃহবধূ হয়ে গেলো। ওদের উত্তর কলকাতায় একটি একতলা বাড়ি ছাড়া আর কোনো সম্পত্তি নেই। সুজয়ের মাইনেতে ঐ খাওয়া পড়া আর বছরে একবার একটু বেড়াতে যাওয়া ছাড়া আর কিছু হয় না। তারওপর মেয়ে চার বছরের হলো। ওকে প্লেস্কুলে দিতে হয়েছে। সেখানে মাসে দু হাজার টাকা মাইনে। এরপর পড়াশোনা তো পরেই আছে। একটা ছোটো দীর্ঘশ্বাস পড়ে অমৃতার। বলে, চল আজ উঠি। বাড়িতে মেয়েটা কাজের লোকের কাছে আছে। আমি গেলে সে বাড়ি যাবে। তনুশ্রী বলে আগামী রবিবার তোদের নিমন্ত্রণ আমার ফ্ল্যাটে। তুই আর সুজয়বাবু আসবি ডিনার করতে। আমি বাড়ি গিয়ে তোর বরকে ফোন করে বলবো। অমৃতা বলে, দেখি... ওর আবার কোনো কাজ পরে যায় কিনা। তনুশ্রী হা হা করে ওঠে। ওসব আমি শুনবো না। রবিবার আবার কিসের কাজ? দুই বন্ধু উঠে পড়ে। 

বাড়ি ফিরে দেখে সুজয় এসে গেছে অফিস থেকে। মালতি তাকে চা দিয়েছে। বাড়ি ঢুকেই মনটা খারাপ হয়ে যায় অমৃতার। সেই পুরোনো বাড়ি। রংচটা দেওয়াল। পুরনো সব ফার্নিচার। মনে মনে কল্পনা করে সে ঐ দামী গাড়ি থেকে নেমে কোথায় এসে ঢুকলো আর তনুশ্রী কোথায় ঢুকবে!

রবিবারের সন্ধ্যা জমে গেছে। তনুশ্রীর বিশাল হলঘর , যা কিনা প্রায় মিউজিয়ামের মতো দামী দামী জিনিস দিয়ে সুসজ্জিত... সেখানে চার জন নর-নারীর হাসি গল্পে উত্তাল হয়ে আছে। অমৃতার মনটা খচ্ খচ্ করে। আসার সময় তিন্নি খুব কান্নাকাটি করছিলো সাথে আসার জন্য। ওকে কাজের মেয়েটির কাছে রেখে আসা হয়েছে। কারণ, তনুশ্রী এবং ওর স্বামী ফোন করে সুজয় আর অমৃতাকে বার বার আসার জন্য নিমন্ত্রণ করলেও তিন্নির কথা একবারও বলেনি। তাও সুজয় বলেছিলো, নিয়ে চলো না ওকে। ছোটো বাচ্চা.... ওকে কী আলাদা করে বলতে হবে? কিন্ত, অমৃতা আনেনি। ওর কিরকম এক অভিমান হয়েছিল তনুশ্রীর ওপর। এখানে এসে ওদের রাজ প্রাসাদের মতো সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট দেখে ওরা সত্যিই অবাক। আর, তেমনি দামী দামী সব আসবাবপত্র। ঘর সাজানোর জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে আনা কিউরিও। নামি ইন্টেরিয়র ডিজাইনার দিয়ে সব কিছু করা হয়েছে। সুজয় এমনিতেই খুব সহজ সরল মানুষ। তার ওপর তনুশ্রীর বরের সাথে বসে রঙিন পানীয় পেটে পড়ায় আরো উচ্ছসিত প্রশংসা শুরু করলো সব কিছুর। এরপর এলাহী খাওয়া দাওয়া। এতো কিছু জিনিসের নাম ও জানে না তারা। অমৃতার চোখে জল আসে। কতো খুশি হতো তিন্নি এখানে এলে। আইসক্রিমই আছে আট রকমের। কতো ভালোবাসে মেয়েটা। প্রায় কিছুই মুখে দিতে পারে না অমৃতা। সুজয় ওদিকে প্রচুর খেতে থাকে। মুখে বলে, আজ আপনাদের জন্য এতো ভালো খাওয়া হলো মশাই। এসব তো আমরা চোখেই দেখিনি। বাঁচতে হলে আপনাদের মত বাঁচতে হয়। রাগে গা পিত্ত জ্বলে যায় অমৃতার। সে বলে এবার ওঠো। অনেক রাত হলো। তিন্নি ঘুমিয়ে পড়বে। ফেরার পথে আমি ওর জন্য আইস্ক্রিম নিয়ে যাবো কথা দিয়ে এসেছি। দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। নেশার ঘোরে সুজয় বলে আরে... দোকান কী হবে? এখান থেকে নিয়ে চলো। এখানে এতো আছে। "না" এই একটি শব্দ শুধু উচ্চারণ করে অমৃতা। ওর এই উচ্চারণে এমন কিছু ছিলো, সুজয় তখুনি উঠে দাঁড়ায়। বলে, চলো....। তনুশ্রী আর ওর বর বলে ওঠে, আমাদের গাড়ি গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসুক তোমাদের। অমৃতা বলে ধন্যবাদ। আমরা ক্যাব বুক করে নেবো। অমৃতার পেছনে টলতে টলতে বেরিয়ে আসে সুজয়। অমৃতা বেরিয়ে আগে তিন্নির জন্য আইস্ক্রিম কেনে। তারপর ক্যাব বুক করে ফেরার পথ ধরে। সারা রাস্তায় সুজয় ওদের প্রশংসা করে আবোল তাবোল বকতে থাকে। পাশে পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে অমৃতা। 

বাড়ি ফিরে দেখে তিন্নি ঘুমিয়ে পড়েছে। কাজের মেয়েটিকে শুয়ে পড়তে বলে সে। সুজয় কোনরকমে জামা কাপড় ছেড়েই শুয়ে পরে।

এখন অনেক রাত। হয়তো একটা বা দেড়টা বাজে। গা ধুয়ে রাত পোশাক পরে ছাদে এসে দাঁড়ায় অমৃতা। আকাশে ভর্তি তারা। সারাদিন অসহ্য গরমের পর একটু একটু হাওয়া দিচ্ছে এখন। আজ নিজেকে বড়ো অপমানিত মনে হয়েছে তার। হয়তো সবটাই তার কল্পনা। কিন্ত, তবুও... মনে হচ্ছে তনুশ্রী বা ওর স্বামী আজ নিজের বাড়িতে ডেকে খুব সূক্ষ্ম ভাবে অপমান করেছে তাদের। তখন সুজয়ের বোকামির জন্য খুব রাগ হয়েছিল অমৃতার। আর, এখন... ওপরে আসার আগে দেখে এলো কেমন এক অসহায় শিশুর মতো ঘুমিয়ে আছে সুজয়। বাবার বুকের কাছে লেপ্টে আছে তিন্নি পরম নির্ভরতায়। চোখ ভিজে গেলো দেখে... এরাই তার পৃথিবী। যেমনই হোক, এটাই তার স্বর্গ। সুজয়ের মত সৎ শিক্ষিত মার্জিত মানুষ তার গর্ব। তিন্নির মতো এত মিষ্টি মেয়ে কজন পায়?

আকাশের দিকে তাকায় অমৃতা। কী নির্মল আজ আকাশ। তারাদের রাজত্ব চলছে জমজমাট। অনেক নিচ দিয়ে সাদা পালকের মতো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। আহ্... বেঁচে থাকা কী আনন্দের। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গে মাঝে মাঝে... আবার স্নেহ, মায়া ভালোবাসায় সেই বাঁধ মেরামত করে নিতেও সময় লাগে না। এই তো জীবন!!






অসমাপ্তি: ১৯১৬

সু জা তা  দা স


স্মৃতির মণিকোঠা থেকে ভেসে আসা "মণি" ডাকটা অনেক বছর পরে মনিমালাকে আবার মনে করিয়ে দিল, উৎসবের কথা নতুন করে, যাকে একবারের জন্যও মনে করতে চায় না মণি--- কখনও, কোনও সময়ও, তবে কেন? কেন সে বার বার ফিরে ফিরে এসে মণিমালার সমস্ত হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিয়ে যেতে চায়!! কেন মনে করাতে চায়, না মণির পাওয়াগুলোকে, 
যা সে নিজে হাতে ছেড়ে এসেছে অনেক পিছনে--- ভালোই তো আছে মণি, এখন নিজের ছোট্ট জীবনটা নিয়ে, উৎসবের জীবন থেকে দূরে বহুদূরে, যেখানে "উৎসব" আর কখনও পৌঁছাতে পারবে না।
       
তবু, তবু কেন এমন হয়? তবু কেন মনটা ঘুরে ঘুরে চলে যেতে চায়, সেই ছেড়ে আসা জীবনের দিকে--- আর ভাবতে পারে না মনিমালা, নিজেকে মেলে ধরে নিজের হাতে গোছানো পাট ভাঙা বিছানায়, আজ হসপিটালে প্রচুর খাটুনি হয়েছে, শরীরটাও কেন যেন আলস্যে ভরে আছে, তবু শুয়ে পড়লেও ঘুম আসতে চায় না মণিমালার, ফিরে চলল সেই দিনগুলোয় যা ফেলে এসেছে অনেক পিছনে--- 

অনেকগুলো বছর হয়ে গেল এই হসপিটালে মনিমালার, উচ্চ মাধ্যমিকের পর বাবা সায়েন্স নিয়ে পড়তে বললেও কেন জানি মণির মনে হয়েছিল--- এমন কিছু ওর পড়া উচিত, যেটাতে ও তাড়াতাড়ি প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। সংসারে অনেক লোক, কিন্তু রোজগার করেন শুধুমাত্র বাবা, 
দাদা যে কী করে, কিছুই বুঝতে পারে না মনিমালা!!অনেক রাতে চুপি চুপি ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয় আজকাল, দাদা মনে হয় জানে না, মণি এই সময়টা পড়াশোনা করে, তাই দাদার চলাফেরার এই নিঃশব্দতাটা টের পায় মণি প্রায় প্রতি রাতে। অথচ কত ভালো ছিল ওর দাদা অপূর্ব চৌধুরী, যেমন খেলাতে তেমন পড়াশোনায়, সব কিছুতেই এক নম্বর--- কেন যে পাল্টে যাচ্ছে আস্তে আস্তে দাদা, কে জানে! মাঝে মাঝে ভয় করে মণিরও,
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পড়াতে মন দিল মণি, ওকে দাঁড়াতেই হবে, বাবার দিকে তাকালে কষ্ট হয়, মুখে সর্বদা হাসিটি ফুটিয়ে রেখেছেন, ভেতরটাকে সবার থেকে আড়াল করে।
            
দুটি মানুষই বোধহয় ঐ ভেতরের মানুষটার খবর পায় তবুও, এক মণির মা অমলা চৌধুরী আর মনি নিজে, ভাবতে ভাবতেই মণিমালা ঘুমের দেশে পৌঁছে গেল আজ---
হঠাৎ মণি দেখলো তার খাটের পাশে বাবা এসে দাঁড়িয়ে আছে, সেই হাসি মুখ নিয়ে, অবাক মণি বলল বাবা তুমি!! বাবা বললেন, সবসময় কী এত চিন্তা করিস মণি, আমি আছি তো তোর সাথে, চিন্তা কী তোর? মনিমালা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ বাবার দিকে, তারপর জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো বাবা বলে--- একটু শান্ত হলে মনি বলল, তুমি আমার কাছে  থাকবে বাবা?
আমি তো তোর কাছেই আছি মণি, শুধু তুই বুঝতে পারিস না।   
     
তারপর ঘুরে দাঁড়ালেন তার বাবা ফিরে যাবার জন্য, মণি হাতটা বাড়িয়ে ধরতে গ্যালো বাবাকে,
ঠিক তখনই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল মণির---

অবাক হয়ে, খানিক চুপ করে বসে রইলো মনিমালা, ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগলো তার, এখনও অন্ধকার রয়েছে বাইরে, ভাবতে লাগলো মণি বাবার কথা কথাগুলো। মণিময় চৌধুরী---
মণির বাবা, রাশভারি হলেও মুখে সর্বদা একটা হাসি লেগে থাকতো, মণিরা দুই বোন দুই ভাই, বোনের নাম মায়ের সাথে মিলিয়ে অনুসূয়া চৌধুরী আর ছোট ভাই মহেন্দ্র চৌধুরী--- এই ছয় জনের সংসার। 
মণির ঠাকুরদা চৌষট্টির গন্ডগোলের সময় বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসে, সোজা জলপাইগুড়ি চলে যান--- আর ওখানেই বসবাস করতে শুরু করেন। 

যখন মণির ঠাকুরদা সপরিবারে জলপাইগুড়ি এসে পৌঁছান, তখন জলপাইগুড়ি শহরটা এমন ছিলো না, চারিদিকে জঙ্গল, সন্ধ্যা নামলেই হিংস্র পশুদের আনাগোনা--- মণির ঠাকুরদা এখানকার চা বাগানের বাগানবাবু ছিলেন, মণি অবশ্য ঠাকুরদাকে দেখেনি। মণির ঠাকুরদা মানবেন্দ্র চৌধুরী চাকরি করতে করতেই হাকিম পাড়ায় ছোট জমি কিনে ছিলেন একটা, অবসরের পরে ওখানেই ছোট বাড়ি করলেন তিনি--- মণির বাবা চা বাগানের চাকরি করলেন না, তিনি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টটিভ ছিলেন, তাই তার পরিশ্রমও ছিল খুব, অনেক কষ্টেও মুখের হাসিটা ছিল অমলিন, যা এই কষ্টের সংসারকে শান্তির প্রলেপ দিত।
       
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে চিন্তা ছিন্ন হয়ে সম্বিত ফিরল মনিমালার, দরজা খুলে দেখলো পদ্ম দাঁড়িয়ে আছে--- তোমার কী শরীর খারাপ দিদি? বলল পদ্ম। 
না তো! কেন রে? কখন থেকে তোমাকে ডাকছি, সাড়া না পেয়ে ভাবলাম হয়তো--- ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হল মণি, এতটা বেলা হয়েছে বুঝতেই পারেনি! 
হসপিটালে যেতে দেরি হয়ে যাবে আজ, ভাবলো মনে মনে  মণিমালা---

কত বছর পরে বাবাকে দেখতে পেল, সেই হাসিটা এখনও তেমনই আছে,  সত্যি! বাবা ওর সাথেই আছে? একবার ঘরের চারদিকটা ভালো করে দেখে নিল মণি। 

কী চিন্তা করছো দিদি, কখন থেকে  ডাকছি বলল পদ্ম,
কিছু না রে, কী বলছিলি বল?
কী খাবে? বলল পদ্ম, তুই কেন রোজ জিজ্ঞাসা করিস পদ্ম? বলেই স্নানে চলে গেল মণিমালা।
আজ অনেকগুলো বছর হয়ে গেল পদ্মর এই বাড়িতে, সকালে ঢোকে রাতে চলে যায়, এমন অন্যমনস্ক দিদিকে কোনও দিন দেখেনি পদ্ম, রেডি হয়ে এক কাপ লিকার চা আর একটা বিস্কিট খেয়ে বেড়িয়ে যাবার মুহূর্তে পদ্ম বলল--- এমন চললে শরীর খারাপ কেউ আটকাতে পারবে না, তখন তোমার জন্যই নার্স লাগবে--- ঘুরে দাঁড়িয়ে মনিমালা বলল, তুই তো আছিস পদ্ম, আমার আর চিন্তা কী। 
       
কোয়ার্টার থেকে হসপিটাল দশ মিনিটের রাস্তা, তাই মনিমালা হেঁটেই যাতায়াত করে, বাবার কথা ভাবতে ভাবতে হসপিটালের গেটের কাছে চলে এলো মনিমালা, হঠাৎ সম্বিত ফিরল মঞ্জুরিদির ডাকে, একটু হেসে এগিয়ে গেল মঞ্জুদির সামনে--- শুনেছিস? বলল মঞ্জু, ভেতরে যা তোর জন্যই অপেক্ষা করছেন ডক্টর বাসু। কেন? একটু অবাক হয়েই তাকাল মনিমালা মঞ্জুদির দিকে!! ইশারায় ভিতরে যেতে বলে বেড়িয়ে গেলেন মঞ্জুদি--- মনিমালা O.T. নার্স,  অপারেশন থাকলে ডক্টর বাসু সাধারণত আগে থেকে ফোন করে জানিয়ে দেন মনিমালাকে, কিন্তু আজ তো ফোন করেননি।
 
তবে হঠাৎ তার খোঁজ কেন!! উনি অর্থোপেডিক ডক্টর, হয়তো কোনও পেশেন্ট--- ভাবতেই পা চালালো মনিমালা, এমারজেন্সির সামনে প্রচুর ভিড় দেখে, পাশের রাস্তা দিয়ে ভেতরে ঢুকে, এন্ট্রি করে দোতলায় O.T. সামনে দিয়ে যাবার সময় মনে হল কেউ যেন খুব আস্তে মনিমালার নামটা উচ্চারণ করলো--- এক সেকেন্ড থমকালো মনিমালা, তারপর আরও তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ল O.T.তে। পোশাক পাল্টে যখন টেবিলের সামনে এলো মনিমালা--- অপারেশন টেবিলে রক্তাক্ত অবস্থায় খুব চেনা একজনকে দেখে, উৎসব!! বলে  চিৎকার করে বসে পড়ল টেবিলের সামনে।
        
চোখ দিয়ে ঝরতে থাকলো অঝোর ধারায় জল মনিমালার,
এতবড় এক্সিডেন্ট কেস সচারচর এই হাসপাতালে আসে না--- কিন্তু ডক্টর বাসুর হাতযশের কারণে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে হওয়া দুর্ঘটনার পেশেন্টকে এখানেই নিয়ে এসেছেন পরিবারের সদস্যরা। O.T.র ভেতরে প্রত্যেকেই পেশেন্টকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল যার যার কাজে, হঠাৎ করে মনিমালার কান্নায় সবাই হকচকিয়ে গেল কিছুটা হলেও, কিন্তু সেটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য----  মনিমালা নিজেও ধাতস্থ হয়ে গেল অতি দ্রুত, চোখ মুছে ডক্টর বাসুর সাথে সহযোগিতা করতে থাকলো, একটুর জন্যও নিজেকে ভেঙে পড়তে দিল না।

পুরো সাত ঘন্টা বাদে যখন অপারেশন শেষ হল, ডক্টর বাসু মনিমালার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর একটু হাসলেন সোয়াস্তির হাসি, যতক্ষণ পর্যন্ত না বেডে দেওয়া হল উৎসবকে, ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইল মনিমালা উৎসবর সামনে। তারপর O.T. থেকে কেবিনে নেবার সময় মনিমালা বেড়িয়ে পড়ল  নিজের কোয়ার্টারের দিকে---

সন্ধে পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ, আস্তে আস্তে কোয়ার্টারে ঢুকলো মনিমালা, পদ্ম এসে বলল, আমি সব কিছু গুছিয়ে রেখে গেলাম দিদি, কথাগুলো বলতে বলতেই মনিমালার দিকে তাকাল পদ্ম।

একি চেহারা হয়েছে দিদির এক বেলায় মধ্যে! মনিমালার দিকে তাকিয়ে, কথা শেষ না করেই পদ্ম বলল, আজ আমি থেকে যাচ্ছি দিদি এখানে, কিন্তু তোমার কী হয়েছে দিদি? না রে, তুই বাড়ি যা পদ্ম, আমি ঠিক আছি এখন বলল মনিমালা। মুখে কিছু না বলে ভেতরে ঢুকে গেল পদ্ম, শুধু যাবার সময় বলল, গিজারটা অন করে দিলাম তুমি ভালো করে স্নান করে এসো, আমি চা দিচ্ছি তোমাকে দিদি--- মণি চুপ করে বসে রইলো পদ্ম যাওয়ার পরেও, আর আস্তে আস্তে পিছিয়ে যেতে থাকলো অনেকগুলো বছর পিছনে।
        
দাদার চুপি চুপি আসা যাওয়ার দিকে খেয়াল করলে মণির ভয় লাগতো কিছু খারাপ কাজ করছে কী দাদা!! মাঝে মাঝে বেশ বড় বাক্স নিয়ে ঢুকতে দেখেছে বাড়িতে দাদাকে মণি, কী থাকতে পারে ওর ভেতরে ভাবতো মাঝে মাঝেই। জলপাইগুড়ি থেকে ভুটানের সামচি বর্ডার মাত্র চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার, কোনও খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ছে না তো দাদা? চোরা শিকার--- ভাবতেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যেতো মনিমালার--- না না! দাদা এমন কাজ করতে পারে না, তারপর ভাবতো মণিমালা মনে মনে।

এতটা অসম্মান কী বাবাকে দাদা করবে, অথবা ঠাকুর দাদাকে!! ভাবনারা এলোমেলো করে তুলতে মনিমালাকে সেই সময়--- এরপর নিজের পরীক্ষা  নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মনিমালা।পরীক্ষায় ভালো ফল করে নার্সিং ট্রেনিং নিতে কলকাতায় চলে এল একটা সময়, ছুটিতেও ঠিক মত বাড়ি যেতে পারতো না খরচ বেশি হবে বলে মনিমালা--- এরকমই এক সকালে হস্টেলে খবর এলো, তার দাদা মারা গেছে বর্ডারে মাল দেওয়া/নেওয়ার সময় গুলিতে।
টিকিটের ব্যবস্থা করতে না পেরে, রাতের বাসেই রওনা দিল মনিমালা, এই বাসে যাবার সময় প্রথম দেখা হয়েছিল উৎসবের সাথে।

কদমতলা বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিক্সা নিল মনিমালা, রিক্সাওয়ালা রূপশ্রী সিনেমার সামনে দিয়ে থানাটাকে বাঁদিকে রেখে করলা নদীর পাশ দিয়ে হাকিমপাড়ায় দাঁড় করালো রিক্সা। পৌঁছে দেখলো বাড়ির সামনে অনেক লোক, ওকে দেখে মা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন মণিইইইই বলে, মনিমালা বাবার দিকে তাকাল একবার, ঐ হাসি খুশী মানুষটাকে চেনা যাচ্ছে না আর, 
একদম চুপ হয়ে গেছেন, মণিকে দেখে শুধু বললেন--- একবারের জন্যও বুঝতে পারলাম না! পদ্মর ডাকে সম্বিত ফিরলে অবাক হল মণি।

তুই বাড়ি যাস নি? তোর বাবার শরীর খারাপ, এটা তুই ঠিক করলি না পদ্ম! ---তুমি এখনও বসে আছ দিদি, স্নান করতে যাওনি? মণিমালা মনে মনে ভাবলো, এত ছোট্ট বুকে এত ব্যথা জমে থাকে কেমন করে! আস্তে আস্তে স্নানঘরে ঢুকে গেল তারপর।

স্নান সেরে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে যাবার সময় 
হঠাৎ কলিং বেলটা আওয়াজ করে উঠলো, এ সময়ে কে হতে পারে! ভাবতে ভাবতে দরজার দিকে এগিয়ে চলল মনিমালা---
কেউ তো তার কাছে আসে না সচারচর, আসলে মনিমালা লোকের অহেতুক কৌতুহল থেকে দূরে থাকতেই ভালোবাসে।
ভাবনার মাঝেই এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়ানো  মানুষটির দিকে, আর ঠিক তখনই অস্ফুটেই মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, মণিমা শব্দটি--- বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবো, আমাকে ভেতরে ডাকবি না মালা? হঠাৎ সামনে মণিমাকে দেখে একটু হকচকিয়ে গেছিল প্রথমে মনিমালা, একটু হেসে বলল এসো মণিমা।
 
মণিমা ঘরে ঢুকলে, দরজা বন্ধ  করে মনে মনে ভাবছিলো মণি, O.T তে ঢোকার মুখে অস্ফুটে মনিমালা ডাকটা কী মণিমারই ছিল!! আসলে সেই সময় দেখার সুযোগ হয়নি তাড়াহুড়ো ছিল বলে, কিন্তু কার কাছ থেকে কোয়ার্টার এর খবর পেলেন উনি?
সাত-পাঁচ ভাবার মধ্যেই মণিমা জিজ্ঞাসা করলেন মনিমালাকে---
কী ভাবছিস মালা, কত বছর এখানে আছিস, কতদিন পরে তোকে আবার দেখলাম। কথার উত্তর না দিয়ে মণি বলল, আপনি আসুন আমার সাথে মণিমা--- মণিমাকে ঘরে বসিয়ে মনিমালা ভেতরে চলে গেল, নিঃশব্দ কান্না কী গলার কাছে আটকে আসছে।

বুকের ভিতরে এত কষ্ট হচ্ছে কেন? এমন তো হবার কথা নয়! মনে মনে ভাবলো মনিমালা--- নিজেকে যথা সম্ভব সংযত করে জলের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলো সে। 
মনিমালাকে দেখে আবার বললেন মহিলা, কেমন আছিস মালা? তোকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছোট করবার জন্য আমি তোর কাছে আসিনি রে--- বললেন মণিমা।
মণিমার দিকে তাকাল মনিমালা অবাক দৃষ্টিতে!! বলে চললেন মণিমা, ---ওরা বিষ্ণুপুর যাচ্ছিল গাড়ি করে, গাড়ি উৎসবই চালাচ্ছিল, হঠাৎ এক দেড় কিলোমিটার আগে উৎসব গাড়ি দাঁড় করিয়ে জল আনতে গেল উল্টো ফুটের দোকানে--- জল নিয়ে পার হবার সময় উল্টো দিক থেকে আসা একটা লরি...

কান্নায় ভেঙে পড়লেন মহিলা, কেমন করে যে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কী হয়ে গেল আমি জানিনা মালা, তবে  কিছু বোঝার আগেই সবাই এখানে নিয়ে এলো--- তোকে এখানে দেখতে পাবো, এ যে স্বপ্নেরও অতীত, একটু অবাক হয়েই ঐ অবস্থায় একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে, তুই এই হসপিটালের একজন O.T.নার্স। মিথ্যে বলব না মালা একটু ভয় পেয়ে ছিলাম প্রথমে আমি---

---মণিমা... বলে জোরে কেঁদে উঠলো মনিমালা, আমি এতটাও খারাপ নই। আজ আমি বুঝেছি মালা, ক্ষমা করিস পারলে, তোকে আমি ডেকেছিলাম দেখতে পেয়ে, 
তুই সেই ডাক শুনতে পাসনি বোধহয়। পরে তোকে অনেক খুঁজেছি জানিস, তারপর একজন দেখিয়ে দিল তোর কোয়ার্টার, বলতে বলতে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন ভদ্রমহিলা--- একটু ম্লান হেসে মণি বলল, আমার কোনও কৃতিত্ব নেই এখানে মণিমা, ডক্টর বাসু সত্যিই খুব ভালো, আমাদের কাছে ভগবান, আমি না থাকলেও একই পরিষেবা পেতেন এখানে আপনারা, বলল মনিমালা। একটা সামান্য কারণে আজ তোরা দুজনে দুদিকে, বললেন মণিমা,
সত্যিই কী সামান্য ছিল মণিমা? বলল মনিমালা, সম্পর্কে বিশ্বাসটাই বোধহয় সব কিছু, যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে সম্পর্ক কী ভাবে থাকে? বলল মনিমালা।

এরই মধ্যে জোর করে মণিমাকে খাইয়ে দিল মনিমালা কারণ পদ্ম মহিলাকে দেখেই রান্না বসিয়ে দিয়েছিল, খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলা বললেন, এবার আমি আসি? হয়তো এতক্ষণে সকলেই খোঁজ করতে শুরু করেছে, তাছাড়া উৎসব জেগে যদি আমাকে খোঁজে মালা---

মনিমালাও উঠে দাঁড়ালো তারপর প্রণাম করে মণিমার হাত দুটি ধরে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, শুধু যাবার আগে কথা দাও মা, আর কখনও আসবে না এখানে, আর উৎসবও যেন জানতে না পারে কোনো দিন আমি এখানে আছি।

---ওকে আমি কথা দিয়েছিলাম মা, কোনদিন যদি ভুল করেও দেখা হয়ে যায়, ফিরে যাবো বিপরীত দিকে। 

---মালা!!
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকলেন ফিরে যাবার জন্য ভদ্রমহিলা, ঠিক যেমন এসেছিলেন।







পদ্মা থেকে তিস্তা

রা না  স র কা র      
 
                 
"সোনায় বান্ধাইন‍্যা নাও
  ও রণের গোঁড়া রে
   উড়াইয়া যাও..."

পদ্মার বুকে সারি সারি বাইচ নৌকা থেকে সাম্পান মাঝিদের সমবেত ভাটিয়ালি শোনা যায়।পঁচিশ বছুরে ডবকা জোয়ান ছিদামের বুকে পদ্মার পারা জোয়ার। আরো জোরে, আরো জোরে, আরও। ছিদাম যেন কালো পাথরে কোঁদা মূর্তি। বৈঠা ধরা দুহাতে ফুলে ফুলে ওঠে চকচকে  ঘর্মাক্ত মাংসপেশি। সবল হাতের দাঁড়ের টানে পদ্মার বুক চিরে দ্রুতগামী খেচরের মতো উড়ে চলে নাও।

"কালা ছিদাম নাম মোর, বাপ ছিবাস রায়
পদ্মার দেশে ধাম মোর, জেলা বগুড়ায়।"
মাঝির ব‍্যাটা ছিদাম।বাপ, ঠাকুদ্দার জীবনও কেটেছে জলে জলেই। জল তাদের নিঃশ্বাসে, জল তাদের প্রশ্বাসে। শিরা ধমনীর ভেতর দিয়ে যেন পদ্মা বয়, বয় বুড়িগঙ্গা। জলই যে জীবন--- একথা তার চেয়ে ভালো করে বুঝি আর কেউই জানেনা। আর সেই জলে টলমল করে তার আদরের নাও--- জোচ্ছনাকুমারী, হিজল কাঠে গড়া। দু'পাশে চকচকে করোগেটেড টিন দিয়ে মোড়া। জোচ্ছনা রাতে চাঁদের আলোতে যেন সোনার পারা চমকায়।

                    ***

ঘোর ভাঙ্গে ছিদাম সাধুর। সেই পঁচিশ বছুরে ডবকা জোয়ান আজ অশীতিপর বৃদ্ধ। সেই চকচকে কালো চামড়া আজ আর জেল্লা ছড়ায়না। শুধু শরীরের বিরাট খাঁচাখানা যেন সাক্ষ‍্য দেয় তার যৌবনের। আজ আর সেই পদ্মাও নেই তার দৃশ‍্যপটে। নেই জোচ্ছনাকুমারী নাও। আছে শুধু স্মৃতি। মাঝে মাঝে সেই এসে ফিরিয়ে নিয়ে যায় অতীতে।

একাত্তরে হলো জয়বাংলা।রাজাকার বাহিনীর অত‍্যাচার উঠলো চরমে। প্রমাদ গনলো হিন্দুরা। আগে থেকেই অবশ‍্য আসা শুরু হয়েছিলো, এবার এলো তাদের পালা। আরো গোটাপাঁচেক পরিবারের সাথে বেড়িয়ে পড়লো ছিদাম। সাথে বৌ আর পাঁচবছরের ব‍্যাটা সুবল।বৌটা তখন কচি। দেশ ছাড়ার নামে ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে। কোথায় যাবে এতদিনের শ্বশুড়-শ্বাউড়ির ভিটে ছেড়ে? ইন্ডিয়া? না জানি সে কেমন পারা দেশ!!        

                    ***

রাতের আঁধারে সীমান্তরক্ষীদের চোখে ধূলো দিয়ে বেরুবাড়ি হয়ে এপারে পৌঁছলো তারা। ছিদামের ট‍্যাঁকে শ'পাঁচেক টাকা। আসবার আগে জলের দরে বেচে এসেছে তার সর্বস্ব আর আদরের নাও জোচ্ছনাকুমারী। বৌ-এর গয়নার মূল‍্য করলে দাঁড়ায় আরো শ'পাঁচেক‌। এই দিয়ে জমি কেনা যায়না বেরুবাড়ি বা পাশের গঞ্জ হলদিবাড়িতে। পাশেই তিস্তা। তার ওপারে নাকি আছে আরেক গঞ্জ--- মেখলিগঞ্জ। নদীর ছাওয়াল ছিদামের মন চায় নদীর পাড়ে থাকতে। তখন শুখার সময়। তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে চর--- মাইলের পর মাইল। খবর পেলো, চর চল্লিশের উত্তরে নাকি পড়ে আছে এক চর, এখনো নাই তার কোনো দখলদার। ছুটলো তারা। সাথে আরো গোটা দশেক পরিবারের গোটা পঞ্চাশেক মেয়ে, বুড়া, মদ্দ। দখল নিলো  চরের নাম রাখলো--- "চর বগুড়া"। এ যেন তাদের সেই ছেড়ে আসা প্রাণের "দ‍্যাশ"। সবই তো গেছে।আছে শুধু এই নামটুকুই। পদ্মার মতো মাতন নাই তিস্তায়। বর্ষা ছাড়া বাকি সময়টা জল থাকেনা তেমন। মাছও বড় কম। এদেশের মানুষগুলিও জানি কেমন, নিঝুমপারা! ওদেশে মানুষজনের রক্ত ছিলো উত্তাল। ছিদামরা রাত জেগে গাঁ থেকে গাঁয়ে ছুটে বেড়াতো, কখনো হাসনরাজার গানের আসরে, কখনো বা রূপবান গানের টানে। তারপর বৌ এলো। মালখাগঞ্জের মেয়ে। বাপ কাত্তিক পাল, সাম্পান মাঝি।পাল্টি ঘর। ছিদাম বাঁধা পড়লো রিনরিন চুড়ি, খিলখিল হাসি আর নরম নরম গলার আওয়াজে।ছিদাম তখন উদাম জোয়ান।কালো পাথরে কোঁদা চোখ, নাক, মুখ, চকচকে সবল মাংসপেশী, বুকে বয় পদ্মার গর্জন। মাঝরাতে বৌকে তুলে নিয়ে যেত পদ্মায়।টেনে তুলে নিতো নাওয়ে। বৌ মাঝির বেটি হলে কি হয়, জলে বড় ভয়! ছিদাম অট্টহাসি হেসে বলতো, "মাঝির বৌ, মাঝির বেটি /জলে আবার ডরের কি?" তারপর উজান বেয়ে নাওয়ে তুলে দিতো দুরন্ত গতি। জোচ্ছনা রাতে বৌ এর মুখে ভয় কেটে গিয়ে হাসি ফুটতো। দুইখান চাঁদের আলোতে ঝলমল করতো পদ্মার জল।

সেই চাঁদের পারা বৌ এখন ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধা। দাঁত পড়ে যাওয়া বসা চোয়াল, আর ঘোলাটে চোখে বিশ্বের নৈরাশ‍্য। এ দেশে এসে মন বসেনি তারও। শুধু দিনযাপন করে যায়, করতে হয় বলে।মাছমারা মাঝির ব‍্যাটা ছিদাম। চাষ শেখেনি তেমন। আবার জাল বোনে। কিন্তু মাছ মেরে যে দিন যাবে, উপায় কোথায় তার! তেমন মাছ কই মরা তিস্তায়? অগত‍্যা মাছের আশা ছেড়ে নাও বাঁধে সে।এদেশে হিজল গাছ নাই। এ কেমনপারা দেশ! কাঁঠালকাঠের নাওয়ে তেমন সৌন্দর্য ফোটেনা। বেঢপ আখাম্বা চেহারা হয় নাওয়ের। দেখে বুকে মোচড় লাগে ছিদামের। উত্তাল পদ্মার সাথে লড়াই করে তার বুক থেকে রূপার পারা ইলিশ ছিনিয়ে আনতো যে ছিদাম, সে এখন ফনীচৌধুরী ঘাটের ঘাটপারানি। বড় বাঁশের লগি ঠেলে আখাম্বা নাওয়ে মানুষ, গরু, ছাগল পার করে সারাদিন।ব‍্যাটা সুবল রিক্সা চালায় মেখলিগঞ্জে। বিয়ে করে, বৌ নিয়ে আলাদা থাকে সে। সাম্পান মাঝির বংশের ছাওয়াল, যার বাপঠাকুদ্দার বুকে ছিলো গোটা একখান পদ্মা, সে কিনা মানুষ টানে! না পারে নাও বাঁধতে, না পারে জাল বুনতে! ছিদামের বুকে রক্তক্ষরণ হয়। এই দেশ কেড়ে নিলো সবকিছু। বাপ ঠাকুদ্দার বিদ‍্যাটুকুও রইলো না!

কালা ছিদাম এখন ছিদাম সাধু।ফণীচৌধুরী ঘাটে আছে মাকালীর থান। সন্ধ‍্যায় গিয়ে বসে। পথচলতি লোকজন আসে।টোটকা ওষুধবিষুধের চর্চা করতো ছিদাম। কেউ আসে সেজন‍্যেও।লোকে বলে, ছিদাম সাধু। সাধু কিনা জানেনা ছিদাম। তবে অদ্ভুত এক নিরাসক্ততা জড়িয়ে ধরেছে শরীর, মনে। গাঁজায় বুঁদ হয়ে থাকে সন্ধ‍্যেটা। তারপর কোনদিন ঘরে ফেরে, কোনোদিন ফেরেনা।

ভাদ্দর মাসের গরমের রাতে হোগলার মাদুর পেতে মাকালীর থানে শুয়ে ছিলো ছিদাম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো হঠাৎ।উঠে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ায় সে।চরাচর ধুয়ে যাচ্ছে ভরা পূর্ণিমার জ‍্যোৎস্নায়। মৃদু হাওয়ায় জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর, মন। সেদিকে তাকিয়ে কি যেন হয় তার! ঘাটে বাঁধা নাও খুলে বেড়িয়ে পড়ে তার ঘরের পানে। চরে পৌঁছে, নাও বেঁধে, ঘরে গিয়ে পৌঁছায় সে। একা শয‍্যায় পড়ে রয়েছে তার বৌ। ভাঙা চালের ফুটো দিয়ে জোছনা এসে পড়েছে মুখে।ছিদাম ডাকে, "বৌ, বৌ" বৌ ঘুমচোখে অবাক হয়ে তাকায়।ছিদাম বলে, "চল্।" বৌ নিরুত্তরে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে আসে, যেভাবে উঠে আসতো মাঝরাতে দু'কুড়ি বছর আগে। মায়াবী জোছনায় ধুয়ে যাচ্ছে চর। দুজনে হেঁটে চলে। ছিদাম যেন সেই কালা ছিদাম, কালো পাথরে কোঁদা চোখ, মুখ, নাক। বুকে বয় পদ্মার গর্জন। বৌ-ও যেন ফিরে পেয়েছে তার চাঁদপানা রূপ, খিলখিল হাসি আর রিনরিন চুড়ির আওয়াজ।কাছেই কোথায় যেন রাতচরা পাখিরা একসাথে ডেকে ওঠে।মায়াবী বালুকাপ্রান্তর ধরে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলে দুজন।ঘাটে বাঁধা নাও জোছনার আলোতে ঝলমল করে ওঠে।জোচ্ছনাকুমারী নাও, হিজল কাঠে গড়া। ভাদ্দর মাসের ভরা তিস্তার জলের ঝাপটে খলবল করে ওঠে নাও। দুজনে গিয়ে বসে তাতে। ছিদাম হাতে তুলে নেয় বৈঠা। জোচ্ছনাকুমারী নাও ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে, গোঁত খেয়ে ছোটে দিগন্ত থেকে দিগন্তে।বগুড়ার চর ভরে ওঠে সাম্পান মাঝির ব‍্যাটা কালা ছিদামের দরাজ কন্ঠস্বরে, "সোনায় বান্ধ‍্যাইন‍্যা নাও, ও রনের গোঁড়ারে, উড়াইয়‍্যা যাও।"







চার্লি

স র্বা ণী  রি ঙ্কু  গো স্বা মী


সকলে হাসলেও একটুও হাসি আসছিলো না ওর, বরং পেটের ভেতরটা কেমন খামচে ধরছিলো খিদেতে। মুখের ভেতর একটা অদ্ভুত টক জল জমে যাচ্ছিলো বারবার, শেষ খেয়েছে এক গ্লাস ছাতুর সরবত। তাড়াহুড়ো করে সকালে বেরোনোর আগে দিদি জোর করে ধরিয়ে দিয়েছিলো হাতে, নিচু গলায় বলেছিলো, "খালি পেটে যাস না ভাই, পিত্তি পড়বে।" বাবার ঠোঁটের কোনে তখন একটা নীল ডুমো মাছি বসেছিলো, কাল রাতের খোয়ারির ভাগ নিচ্ছিলো বোধহয়। দেখেই পেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠেছিলো ওর, রোজ রাতে বেহেড হয়ে ফেরে বাবা। স্সালা এই করে নাকি বউয়ের শোক ভুলছে, ইচ্ছে করে একদিন গলাটা টিপে শেষ করে দিতে। মায়ের অসুখে ভোগা রোগা রোগা হাত দুটো থেকে টেনে টেনে সরু ব্রোঞ্জের চুড়িদুটো খুলছে হারামিটা, এই দৃশ্যটা ও এ জন্মে ভুলতে পারবে না আর!

দিদিটার চোখের দিকে কবেই তাকানো ছেড়ে দিয়েছে ও, জানে দুটো অন্ধকার কোটরে জলে টইটম্বুর থাকা মণিদুটো দেখলেই ওর নিজেকে অপদার্থ ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। মা থাকতে বারবার বলতো, "মন দিয়ে লেখাপড়া কর বাবা!" তখন শোনেনি, সেভেনের পর আর অনেক মারধোর দিয়েও ইস্কুলমুখো করা যায়নি ওকে। বাবার স্পঞ্জ আয়রন কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অমনি মদ ধরলো, বলতো অবশ্য বউয়ের শোকে কিন্তু ওরা দুই ভাইবোন জানে তা নয়। আসলে চামারটা জানে মদ খেয়ে এলে ভাগ দিতে হয় না ছেলেমেয়েদের, খিদেয় তখন ওরা কত কিই না খেয়েছে। তারপর একদিন দিদি বাড়ি বাড়ি কাজ ধরলো, বাসন মাজা কাপড়কাচা এইসব। একমুঠো মুড়ি পেলেও ভাইয়ের জন্য নিয়ে আসতো লুকিয়ে আর ঠিক পাখির ছায়ের মতোই বাড়িতে হাঁ করে বসে থাকতো ও দিদির পথ চেয়ে।

গতমাস থেকে সবে এই কাজটা পেয়েছে, বিয়েবাড়িতে চার্লি চ্যাপলিন সাজা। বিশুদা বললো , "তোর যা বডি তাতে এ ছাড়া আর কিছু হবে না, মোটু পাতলু চাইলে নয় তোকে পাতলু করতাম।" তাই সই, ও রকম মাছি গোঁফ লাগিয়ে হাতে ছড়ি নিয়ে এঁকেবেঁকে চলা তো... অসুবিধে নেই। কিন্তু এই প্রচন্ড গরমে কোট টাই প্যান্ট পরে জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে একদম, হলের ভেতরটা এ সি... ওরা কিন্তু আছে গেটের সামনে। সেও না হয় পয়সার কথা ভেবে সহ্য হয়ে যেতো গরম, কিন্তু খিদেটা... আর পারছে না ও।

"অ্যাই চার্লি, আমি তোমাকে ঐ বাচ্চা দাদাটার সঙ্গে সিনেমায় দেখেছি।" ফুটফুটে মেয়ে একটা, ঘাগরা চোলিতে যেন পরী। শুনে হাসলো ও, কোন সিনেমার কথা বলছে কে জানে! কারুর সঙ্গে কথা বলার বা গায়ে হাত দেওয়ার পারমিশন নেই ওদের, না হলে গাল টিপে দিতো ডল পুতুলটার। "এই নাও, আইসক্রিম!" পেছনে লুকোনো হাতটা বেরিয়ে এলো এইবার, মাথা নেড়ে না করলো ও। নেমতন্ন বাড়ির কেউ দেখতে পেলে ওর চাকরি চলে যেতে পারে, কি বুঝলো কে জানে... ছুটে ভেতরে চলে গেলো পরী। আইসক্রিমটা দেখে এবার আরো জ্বালা করছে যেন পেটের ভেতরটা।

"চলো ভাই, ভেতরে বসে খেয়ে নেবে একটু," বর নিজে বেরিয়ে এসেছে বৌভাতের রিসেপশন ছেড়ে। অপ্রস্তুত হয়ে ওর বোকার মতো তাকিয়ে থাকা দেখে সলজ্জ হেসে বললো, "একমাত্র ভাগ্নীর হুকুম, চার্লি না খেলে ও কাউকে খেতে দেবে না আর।" পরীটা উঁকি মারছে মামার শেরওয়ানির পেছন থেকে, চার্লির চোখের জলটুকু যেন ওর চোখে কিছুতেই না পড়ে। চার্লিতো হাসাতেই চায় সকলকে, দুঃখটুকু খালি ওর একলার থাকুক নয়!






দুর্গা সেবা নিকেতন

মে খ লা  ঘো ষ দ স্তি দা র


শিখা, দীপের হাতের উপর হাত রেখে বললো, "আমি ঠিক এই মুহূর্তে তোমার কথায় রাজী হতে পারছি না, বুঝতেই তো পারছো আমি একজনের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ, তুমি কিছু মনে কোরো না প্লীজ।"

দীপ, শিখার হাত চেপে বললো, ঠিক আছে, তবে তুমি যে প্রতিশ্রুতিতে আমার কাছে আঁটকে আছো তা ভুলে গেলে চলবে না, সেটা স্মরণে রেখো।"

সাঁঝ উত্তীর্ণ হয়েছে, চরিদিকে অন্ধকার চেপে বসেছে মনে হয় অমাবস্যা, বাবুঘাটে লোকের ভীড়ও নেই বললেই চলে, ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, আমরা হেঁটে চলেছি নির্জন আঁধারে, দূরে গঙ্গার বুকে নৌকার জাঁকে বিন্দু বিন্দু আলোর সারি, ক্রমশঃ মনটা হারিয়ে যাচ্ছে এক নিকষকালো হাতছানিতে। 

শিখা প্রতিদিন অফিস ফেরতা জ্যোতিকে দেখে তবে বাড়িতে ফেরে, জ্যোতির সঙ্গে ওর পরিচয় কোনো এক কোচিং সেন্টারে, তখন ওরা একাদশ শ্রেণীতে পড়ে, সেই থেকে ওদের মধ্যে এক সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, দুজন দুজনের বাড়িতে যেতো আসতো, জ্যোতির কোনো ভাই-বোন ছিলো না বলে শিখাকে জ্যোতির মা নিজের সন্তানসম স্নেহ ও আদর করতেন, খুব ভালোবাসতেন,
মৃত্যু শয্যায় থাকাকালীন একদিন শিখাকে দুর্গাদেবী (জ্যোতির মা) বলেছিলেন, "শিখা মা আমি যখন থাকবো না তখন আমার ছেলেটাকে একটু দেখিস, ও বড্ড জেদী আর বদরাগী, কিন্তু কি জানিস তো মনটা ওর ভীষণ নরম ঠিক তরমুজের মতোন, আমাকে কথা দে মা বিপদে-আপদে ঠিক জ্যোতির পাশে থাকবি, মারে আমাকে কথা দে।"

শিখা কথা দিয়েছিলো, তাই তাঁর কথা রাখতেই তো প্রতিজ্ঞা পালন করে চলেছে নীরবে, জ্যোতি ওর মাকে হারাবার কয়েক মাসের মধ্যেই যেন কেমন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লো, অবসাদ এসে ঘিরে ধরলো, একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা ওর সঙ্গী হয়ে গেলো, শিখা অনেক বুঝিয়েও কিছু করতে পারলো না, শেষমেশ বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাক্তার দীপক রায়-এর কাছে জ্যোতিকে নিয়ে গেলো, তারপর থেকেই শুরু হলো জ্যোতির ট্রিটমেন্ট, এখন ও দীপক রায়ের আন্ডারেই আছে।

জ্যোতিকে সব সময় দেখাশোনার জন্য এক সিস্টার আছেন, আর বাদবাকি সব কিছু শিখা নিজেই সামলে নেয়।

কিন্তু ইদানীং শিখা লক্ষ্য করছে জ্যোতির শারীরিক অবস্থার দিন দিন অবনতি হচ্ছে কারণটা কোনোমতেই ধরতে পারছেনা,
সব সময় ঝিমিয়ে থাকছে, তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব, যেন নেশায় বুঁদ হয়ে আছে, ঠিক মতো চোখ মেলে কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না, শিখা সব কথা গিয়ে ডাক্তারকে বলার পর ডাক্তারের পরামর্শ মতো শিখা স্থির করলো সে একমাস জ্যোতির বাড়িতে গিয়ে থাকবে, নিজের হাতে ওষুধ দেওয়া থেকে শুরু করে খাওয়ানো, সময়মতো স্নান, ঘুম সব তার তত্ত্বাবধানেই হবে, সে অফিস থেকে ছুটি নিলো ঠিক একমাসের জন্য আর সিদ্ধান্ত নিলো এর মধ্যেই সে জ্যোতিকে সুস্থ করে তুলবে।

পনেরো দিনের মাথায় শিখার নজরে পড়লো জ্যোতির শারীরিক উন্নতি, একটু একটু করে জ্যোতি সুস্থ হয়ে উঠছে, আর সেই ঘোর নেই, ঝিমিয়ে পড়া থেকে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা ব্যাপারটা যেন ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে ওর জীবন থেকে, একুশ দিনে দেখলো জ্যোতি বেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, হতাশাবোধ থেকে যেন নিষ্কৃতি পেয়েছে। এইভাবে আরো বেশ কিছুদিন চলার পরে শিখা আবিষ্কার করলো আগের জ্যোতিকে, সুস্থ, প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল, মনটা বেশ ফুরফুরে ঝলমল করছে, তার ভিতর একটা স্বাচ্ছন্দবোধ কাজ করছে।

শিখা মনে মনে দুর্গাদেবীকে প্রণাম জানিয়ে বললো, "মাসিমণি আমি কথা রাখতে পেরেছি, জ্যোতি ভালো হয়ে উঠেছে, ও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে গেছেন এবং বলেছেন জ্যোতিকে নিয়ে আশংকার কোনো কারণ নেই।  ও পুরো ফিট শারীরিক ও মানসিক ভাবে।"

এবার শিখার বাড়ি ফেরার পালা। হাতে দুদিন বাকি। একদিন শিখা দেখলো একটা মেয়ে জ্যোতির ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলো খুব দ্রুত। ও বুঝে উঠতে পারলো না। ভাবতে থাকলো কে হতে পারে!

ডিনার টেবিলে বসে শিখা জ্যোতিকে বললো, "এবার আমাকে দায়মুক্ত করো। আগামীকাল আমার বাড়ি ফিরতে হবে।" জ্যোতি বললো, "ঠিক আছে, তবে ডিনার করে তবেই যাবি। আমি গাড়ি বলে রাখবো।"

পরেরদিন ঘুম থেকে উঠতে বেশ বেলা হয়ে গেলো শিখার। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো এগারোটা বাজে। সে দরজা খুলে বেরোতেই অবাক হয়ে গেলো সারা ঘর-বাড়ী নানা রঙের ফুলে, আলোর বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। শিখা স্নান সেরে শাড়ি পরে জ্যোতির কাছে যেতেই, কিছু বলতে না দিয়ে জ্যোতি বলে উঠলো, "শিখা বেলা হয়ে গেছে চল্ তোর নিয়মেই মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে ফেলি।"

দুপুরের খাওয়া হয়ে গেলে শিখা ভেবে উঠতে পারলো না জ্যোতিকে সে কি বলবে, কেন এতো আয়োজন! কি উদ্দেশ্যে? সে সুযোগই দিলো না জ্যোতি। 

বিকাল পাঁচটার সময় কলিং বেল বেজে উঠলো, জ্যোতি দরজা খুলতেই প্রবেশ করলো দীপ আর একজন ভদ্রলোক। এবার শিখা সব দেখেশুনে তাজ্জব হয়ে গেলো। দরজা খোলাই থাকলো, খানিক পরে ঢুকলো ওদের কলেজের বন্ধু মোম। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না শিখা।

এমন সময় জ্যোতি বলে উঠলো "আমাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন উকিল মহাশয় রাজেন মল্লিক, ওনার সামনে আজকের এই শুভদিনে আমার পরম বন্ধু শিখার সঙ্গে দীপ-এর রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হবে। কারো কিছু বলার আছে? শিখাকে বললো, তোর কোনো আপত্তি নেই তো? দীপ তোমার?"

ওরা দুজনেই কি বলবে ভেবে উঠতে পারলো না। ওদের রেজিস্ট্রি হয়ে গেলো সুন্দর ভাবে দুজনের মতেই। জ্যোতি আরেকটি পেপার শিখার হাতে দিয়ে বললো, "এটা যৌতুক স্বরূপ তোকে দিলাম আমার সম্পত্তির  একটা পার্ট। তুই এটা গ্রহণ করে আমাকে ঋণমুক্ত কর। শিখা তুই আমার শুধু বন্ধু না, আমার কাছে তুই একজন প্রকৃত আদর্শ সঙ্গী। ভাগ্য করে আমি তোকে পেয়েছি। আমি ধন্য।"

মোমকে বললো, "তোমাকে সত্যিকারের ভালোবেসে আমার জীবন সাথী করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু  তুমি আমাকে ড্রাগের নেশায় বুঁদ করে আমাকে অসুস্থ করে তুলেছিলে, আর সেই সুযোগে আমাকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে দাবী করছো যে তুমি আমার সন্তানের মা। এতো লোভী তুমি! তোমার মতো একজন বিশ্বাসঘাতককে আমি কিছুতেই স্ত্রী-র স্বীকৃতি দেবো না.... এ সন্তান আমি মানি না...." এরপর জ্যোতি বললো, "আমার আরেকটা কাজ বাকী আছে--- মায়ের স্বপ্ন পূরণ করা। আমাদের পৈতৃক ভিটায় মায়ের নামে একটা অনাথ আশ্রম করবো। "দুর্গা সেবা নিকেতন।" বাকী জীবনটা অনাথ-অসহায় ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই কাটিয়ে দেবো, আর শিখা তোরা তো রইলি।"

দীপ ও শিখা গিয়ে জ্যোতির কাঁধে হাত রাখলো।






প্রতিচ্ছবি
 
মা লা  চ্যা টা র্জ্জি


'আয় আয় এতদিন তো আমার সবাক স্ত্রীকে দেখেছিস আজ নির্বাক স্ত্রীকে দেখ’--- কথাগুলি
এক নিঃশ্বাসে বন্ধু বিনায়ক মুখার্জ্জিকে বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সত্যব্রত সান্যাল। সঙ্গে করে আনা রজনীগন্ধের মালা, মিষ্টির প্যাকেট ও ধূপকাঠি একগুচ্ছ নিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন বিনায়কবাবু। ভারাক্রান্ত বোধ করেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে মনে মনে কিছু ভাবেন। তারপর সত্যব্রতবাবু কারো ডাকে সাড়া দিয়ে
এগিয়ে গেলে সাথে আনা জিনিসগুলি নিয়ে বিনায়ক মুখার্জ্জি বন্ধুর মৃত স্ত্রীর ছবির দিকে এগিয়ে যান, পরিয়ে দেন রজনীগন্ধের মালা। ধূপকাঠি জ্বালিয়ে মিষ্টির প্যাকেট একপাশে
রাখেন। দুঃখভরা চোখে তাকিয়ে থাকেন। বিশ্বাসই হয়না মাত্র তেরোদিন আগে এই মানুষটা মারা
 গেছে। খবরটা মৃত্যুর পরের দিন সত্যব্রতর মুখে শুনে চমকে উঠেছিলেন। বলেই ফেলেছিলেন
 ‘কি বলছিস তুই! তোর স্ত্রী মারা গেছে কাল ভোর চারটায়! পেসমেকার কাজ করছিলো না!
 
—হ্যাঁ, তাইরে, আবার পেসমেকার লাগাবার সময় পাইনি। হঠাৎ রাত দুটোর সময় কল্যাণীর গোঙানীর
শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। তাকিয়ে দেখি চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, বিছানায় পেচ্ছাব করে দিয়েছে। বড় মেয়েকে চিৎকার করে বললাম, খুকু দেখে যা তোর মা কেমন যেন করছে!আমার ডাকে বড়, ছোট দু‘মেয়েই ছুটে আসে। খুকু ভয়ার্ত স্বরে মা‘কে ডাকে। কিছুক্ষনের জন্য জ্ঞানও ফিরে আসে। কিন্তু কোন ঝুঁকি না নিয়ে ঝড়, জল, বাজ মাথায় নিয়ে পাশের বাড়ির নিখিলকে নিয়ে খুকু পাড়ার
অভিরাম ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আসে। তিনি পরীক্ষা করে বলেন তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে
যান। পেসমেকার গন্ডোগোল করছে। তাঁর নির্দেশমতো রবীন্দ্রনাথ টেগোর হাসপাতালে নিয়ে গেলে ইমার্জেন্সীর ডাক্তার পাল্স ধরে বলেন উনি কয়েকঘন্টা আগে মারা গেছেন।’ সেদিন কথাগুলি ভাঙাভাঙা গলায় বলে হাউহাউ করে কেঁদেছিল সত্যব্রত মনে পড়ে।

সম্বিত ফেরে তাঁর বন্ধুর বড় মেয়ে খুকুর কথাতে। সে সামনে এসে বলে, 'চলুন কাকু এখন প্রথম ব্যাচ শুরু হবে। তিনি তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে
থাকেন। অবিকল কল্যাণী‘র মতো দেখতে। বয়সটাও ঐরকম হবে। বছর কুড়ি তখন ছিল কল্যাণীর আর সত্যব্রত‘র পঁচিশ। হৈ হৈ করতে করতে পঁচিশজন বন্ধু তাঁরা বরযাত্রী বরিশালে কাশীপুরে গিয়েছিলেন। তখন সত্যব্রতরা থাকতো নোয়াখালী। এক স্কুল, কলেজের বন্ধু তাঁরা। এক
পাড়াতেই থাকে সবাই। ছুটির দিনে শতদল ক্লাবে আড্ডা মারেন। কাজেই বন্ধুদের বরযাত্রী না বললে হয়! সবাইকে সাদরে বরযাত্রী যেতে বলেছিল সত্যব্রত। বন্ধুর স্ত্রীকে দেখে সেদিন
সবাই তারিফ করেছিল। নামও দিয়েছিলেন তাঁরা ‘ডাকসাইটে’ মানে ডাকসাইটে সুন্দরী।

দেশভাগের অনেকদিন পর বিনায়ক মুখার্জ্জি যখন বিজয়গড়ে দু‘নম্বর ওয়ার্ডে থাকেন তখন সত্যব্রত‘র বাড়ির ঠিকানা বহুকষ্টে জোগাড় করে আঠাশ বছর বাদে একদিন তাঁর বাড়িতে বেলা দশটায় উপস্থিত হন। ইতিমধ্যে কল্যাণী‘র চেহারা
অনেক বদলে গেছে। বলিরেখাও মুখে দেখা দিয়েছে। তাঁকে দেখে অবাক হয়ে তিনি বন্ধুকে প্রশ্ন করেন ‘হ্যাঁরে সত্যব্রত, এই কি তোর সেই বউ যার বিয়েতে বরযাত্রী গিয়েছিলাম? হা হা করে অট্টহাসি হেসে সত্যব্রত বলেন, ‘সেই বউ নয়তো কি অন্য বউ!
স্বামীর হাসিতে কল্যাণীও যোগ দেয়। 

এরপর পাঁচ বছর কেটে যায়।বিপত্নীক  বিনয়বাবু কখনওসখনও আসেন বন্ধুর বাড়ি। ছেলের সংসারে তিনিই বোঝা, বন্ধুকে কোনদিনই তাঁর
 বাড়িতে  আমন্ত্রণ করতে পারেন নি। হঠাৎ স্ত্রী শীলার কথা তাঁর খুব মনে হয়। দু‘ চোখ ঝাপসা
হয়ে আসে। তবু তিনি পরিষ্কার দেখতে পান শীলা এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর সামনে। চোখে অসহায় উদভ্রান্ত দৃষ্টি। ঘাড়টা একটু বেঁকে ঝুলে গেছে। বড় টেবিলে  ফোটোফ্রেমে কল্যাণী নয় শীলা
হাত দিয়ে তাঁকে ডাকছে...

বিনয় মুখার্জ্জি খাবার জায়গায় নয় ধীর পায়ে এগিয়ে যান রাস্তার দিকে। খুকুকে দেখতে পেয়ে
বলেন, ’শরীরটা ভালো লাগছে না মা, এক গ্লাস জল দে।' —ভয়ার্ত স্বরে খুকু বলে, ‘কাকু আপনি কিছু খাবেন না?’ —‘না জল আর দুটো বিস্কুট দে, আর কিছু নয়।'
—‘আপনি একা যেতে পারবেন?’
—‘একাই তো সবাই আসে যায় রে, সাথে কি কেউ থাকে? কেউ না। আর একটা কিছু পেয়ে যাব ঠিক। রিকশা তো আছে, তাতেই পৌঁছে যাব বাড়ি। বাবাকে দেখিস মা।' —খুকু দেখল, কাকুর চোখে জল চিকচিক করছে। বিনয় মুখার্জ্জিও বুঝতে পারলেন তাঁর দু‘গাল ছাপিয়ে চোখের জল নেমে আসছে। সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে তিনি নিজের মনে বললেন, আমি আসছি শীলা, আমি আসছি.....







বৈতরণী

শ র্মি ষ্ঠা


আশ্বিনের সকাল। তবুও কাশের দোলা আর সুনির্মল বাতাস নিকুচি করে আকাশের মুখ হাঁড়ি। রাতের আঁধারে দিব্যি পিচের রাস্তায় কেঁদে ভাসিয়েছে। ভিজে কালো রঙ আরও পোক্ত হয়েছে। সুবিমলের আবাসনের সামনের রাস্তায় একটা বড় টগর আর আরেকটা ছাতিমগাছ আছে। প্রকৃতির নিয়মে সারাবছর কমবেশি ফুল ধরে টগরে। খুব ভোরে ঝরে পড়ে নিচের ফুটপাত থেকে রাস্তায়। সুবিমল ঘুম থেকে উঠে প্রাত্যহিক কাজ শুরুর আগে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ান একবার। রোজকার অভ্যেস। নাঃ, সূর্য প্ৰণাম করেন না। কিন্তু দিনের শুরুটা একরাশ বাতাস বুকে না টেনে শুরু করতে চান না উনি। এই ভোরেই একমাত্র দূষণ কিছুটা হলেও কম থাকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলেন এবছর টগরের ফুলগুলো যেন একটু আকৃতিতে বেড়েছে। পাশেই রাস্তায় সাদা-কালো ছিট কাপড়ের থানের মতো ছড়িয়ে ছাতিমের ফুল। এখনও মাঝে মাঝে ঝরছে। জোরে নিশ্বাস টানলেন সুবিমল। নাঃ, কোনও ঘ্রাণ নেই! আজকাল গাছপালাও কেমন স্বাদ-গন্ধ-বর্ণ হারিয়েছে। বড্ড যান্ত্রিক। বরঞ্চ ঘ্রাণে পেলেন তাজা কফির সুবাস। একটু ভেবে সুবিমল মনে মনে বলে উঠলেন, 'যাক, মোহনদার ছেলে তাহলে গতকাল রাতে ঠিকঠাকই এসে পৌঁছেছে!' 

সুবিমলের নিচের তলায় মোহন গাঙ্গুলি সস্ত্রীক থাকেন। একমাত্র পুত্র প্রবাসী গবেষক। কিন্তু নিয়ম করে প্রত্যেক বছর দূর্গা পূজার আগে একবার বাড়ি আসা চাই। গত পাঁচ বছর ধরে একই নিয়ম চলছে। আসার সময় ছেলে বাবা-মায়ের জন্য কফি নিয়ে আসে। ওখানে নাকি গোটা দানার উচ্চমানের কফি পাওয়া যায়। নামের হরেক রকমফেরও আছে তার। একবার সুবিমলকে খাইয়েছিলেন গাঙ্গুলিবৌদি। তার তিতকুটে স্বাদ এখনও করলার বিকল্প রূপে সুবিমল জিভে পান। প্রত্যেকদিনই বারান্দায় এলে কফির গন্ধ পান সুবিমল। তবে আজকের গন্ধটা একটু কড়া। অর্থাৎ নতুন। গাঙ্গুলিদার ছেলের ফ্লাইট প্রতিবার গভীর রাতেই ঢোকে। নিজের নাকের প্রশংসায় মনটা বেশ ফুরফুরে করে উঠলো সুবিমলের। চোখ গেছে। রক্তে শর্করা বেড়ে ভূত! কিন্তু টিকালো নাকখানা অন্তত খাসা আছে! সুবিমলের মনে পড়লো, এই টগরের পাপড়িগুলো পেছনদিকে ভাঁজ করে বোঁটার ভেতরে ঢুকিয়ে ফুলের আকার ছোট করে সেটা কানের দুলের সাথে আটকে দিতেন সুমনার মা। ওর নাচের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সাজে এটা যেন বাধ্যতামূলক ছিল। আর ছাতিমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মন্টুকাকুর রিকশা করেই প্রত্যেকদিন সুমনা নাচের স্কুলে যেত। রিকশা চললেই ছাদ থেকে তারাখসার মতো ঝরে পড়তো ছাতিমের ফুল। সুবিমল একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিয়মমাফিক দেখতেন। আর সেই টগরের গন্ধ পেতেন। ওই আড়চোখের তীক্ষ্ণ বাণে তিনি তো বিধ্বস্ত ছিলেনই! আজকে যেন সুবিমল সেই পুরোনো চেনা গন্ধটা ফিরে পেতে চাইছিলেন। আবারও জোরে নিঃশ্বাস নিলেন। নাঃ! কিস্যু নেই! ফালতু! বিড়বিড় করতে করতে ভেতরে ঢুকে এলেন তিনি।

'চায়ের জল চাপাতে হবে।' অভ্যাসবশত শোবার ঘরে উঁকি দিলেন সুবিমল। সন্দেহজাগরুক মন! এসব ঘ্রাণ-ট্রান পাওয়ার চেষ্টায় আবার দেরি হয়ে যায়নি তো! ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ছয় ছুঁলেই তাঁর মেজাজ সপ্তমে চড়বে যদি না চা রেডি থাকে। পর্দা সরাতেই শুভদৃষ্টি। ইশারায় নির্দেশ সোয়া ছয় পেরিয়েছে মিনিটের কাঁটা। সুবিমল হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে ছুটলেন। 'নাঃ, এই প্রেম করবার বাসনা একদিন আমায় ভিটামাটিহীন করেই ছাড়বে!'... পনেরো মিনিটে চা এনে বেডসাইড টেবিলে রাখতেই প্রভাতী হাসি ঝর্ণার মতো ঝরে পড়লো সুবিমলের স্ত্রীর মুখে। শুভস্য শীঘ্রম! সুবিমল আমতা আমতা করে কথাটা বলেই ফেললেন।

- বলছিলাম, আজ একবার নাচবে সুমন ?

- নাচ! এখন! এই বয়সে!

- হ্যাঁ। কতকাল নাচতে দেখিনি তোমাকে!

- তুমি কি পাগল হলে! বুড়ো বয়সে হাত-পা ভেঙে শয্যাশায়ী করানোর ফন্দি এঁটেছ দেখছি!

- না, না। যাঁরা নাচতে জানে তাঁদের ওসব হয় নাকি! যতই রেওয়াজ, অভ্যাস করুক আর না করুক! এগুলো সুকুমার বৃত্তি। ভেতর থেকে এমনিই বেরিয়ে আসে। হালকা কিছু করো! খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

- হ্যাঁ! আমি বিছানায় পড়লে তো বেশ ভালোই হয়। নিত্যদিন এই চা করার খাটুনিটা বন্ধ হয়। 'সুবিমলদা' করতে করতে নিতু এসে এক্কেবারে গলা জড়িয়ে ধরে আর কী! বাজার বেশ রমরমা!

- সুমন! সত্তরের বুড়োকে নিয়েও তোমার এত আশঙ্কা!

- নয় কেন! গোটা সোসাইটিতে আমার হাসব্যান্ডের মতো একজন হ্যান্ডসাম পুরুষ কেউ দেখাক দেখি! ওসব ছোকরাগুলোও ডাহা ফেল মারবে!


হা, হা শব্দ করে হেসে উঠলেন দু'জনেই। চা খেয়ে বিছানা ছেড়ে নীচে দাঁড়িয়ে দু'একবার হাত পা এদিক সেদিক করে শরীরে জমা রাত্তিরের জট ছাড়িয়ে নিলেন সুমনা। তারপর সুবিমলের দিকে তাকিয়ে বললেন

- তাহলে গাও।

- কী গাইবো ?

- 'আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে...' 


সুবিমল উল্লসিত! দরাজ কণ্ঠের আলাপনের সাথে শুরু হলো সুমনার মুদ্রার আলপনা। যদিও বহু বহুবছরের অনভ্যাস, তবুও মেলবন্ধনে নৌকো এগিয়ে চললো সুখী বৈতরণীর দিকে।







প্রকাশ্য সফলতা

ম ধু মি তা  ভ ট্টা চা র্য


ইচ্ছে করে ফেলে যাওয়া পাঁচ হাজার টাকার বান্ডিলটা তামাং বাবু কুড়িয়ে নিলো কিনা চাদর গায়ে রাতের অন্ধকারে বেড়িয়ে পড়লো বুরুং। কৌতুহল আর চাপতে পারছিল না। এতক্ষনে নিশ্চই তামাং সাহেব নোটের বান্ডিল কুড়িয়ে নিয়েছে, যেটা সে ইচ্ছে করে তামাং সাহেবের সামনে দিয়ে পাশ কাটিয়ে আসার সময় বুদ্ধি করে ফেলে দিয়ে এসেছে। নিশ্চই তামাং সাহেব এতক্ষনে বুরুংকে বড়লোক ভাবতে শুরু করেছে। হুহুক্কাআ, জম্পেশ মজা। তামাং সাহেবের কাছে একসময় মজুরের কাজ করেছে।  
তামাং সাহেব নিশ্চই এতক্ষনে ভাবতে শুরু করে দিয়েছে বুরুং এত বড়লোক হয়ে গেল! তামাং সাহেব জানা মানেই পুরো গ্রামে ছড়িয়ে যাবে এবার বুরুং একজন বড়লোক।

মজুরিতে পাঁচ টাকা বুরুং এখন পনেরো হাজার টাকা মাইনে পায়, বিদেশী বাবুর কোম্পানিতে জিনিসপত্র নজরদারির কাজ করে, একবার সাহেবের দেশ থেকে ঘুরেও এসেছে।
তবে!!! বলছে তো তাই বুরুং, বুরুং এখন অনেক উঁচুতে উঠে গেছে, যেখানে আগে থাকতো, যাদের সাথে মেশামেশি করতো দেখলেই ঘেন্না করে, এখন সে বড়লোক। বড়োলোক মেলামেশা চায়। 
শহর থেকে গ্রামে বেড়াতে এসেছে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে। গ্রামের পুরোনো কাঁচা বাড়িকে পাকাও বানিয়েছে। 
কিছু পুরোনো ইয়ার দোস্ত এসেছিল, দুয়ার থেকেই বিদায় দিয়েছে। তার বড়োলোকি মুখটা এদের সামনে দেখাতে হলো বলে গা জ্বলে যাচ্ছে। ছেলে বউকে বলে দিলো মুখ ঢেকে রাখতে, শুধু বড়লোক দেখলে মুখের ঢাকা সরাতে।
বাড়ির জানলা দিয়ে ওই গাঁইয়া পুরোনো লোকেরা যদি দেখে নেয় পর্দা লাগানো স্বত্বেও জানলা দরজা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলো পরিবারকে। নিজেও মুখে ঢাকা দিয়ে চলাফেরা করতে শুরু করলো।

এমন নানারকম ধরণের কাজকর্ম নিপুণ ভাবে সম্পন্ন করতে থাকলো। ত্রুটি থাকেনা তার, সে যে বড়লোক সেটা প্রমাণের জন্য।
কিন্তু বোকা, কুঁয়োর ব্যাঙ, গাঁইয়াগুলো বুঝলে তো।
কেউ বুঝতেই চায় না। পাড়ায় বেড়ালে কেউ যেন ওকে দেখেনি, বা সাধারণ লোক ভেবে পাশ কাটিয়ে যায়।

সহ্য হয়না, আর সহ্য হয়না বুরুং-এর ওদের এই ব্যাবহার।
এত চেষ্টায় পানি ফেলে দেওয়ার মত লাগছে তার।
তাই সে আজ বুদ্ধি করে তামাং সাহেবের সামনে নোটের বান্ডিল ফেলে দিলো। আফসোস যে হয়নি অতগুলো টাকা ফেলে দিতে তা ঠিক নয়। হয়েছে। কিন্তু আফসোসের থেকেও তার লক্ষ্যে পৌঁছানো প্রধান উদ্দেশ্য।
লক্ষ্য হলো সে বড়লোক সবাই গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে দেখবে। কারুর কাছে টাকা নেই শুধু তার কাছে আছে সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেখবে। তাকে এসে কুর্নিশ করবে।
সে শুধু তাদের দেখে মুচকি হেসে অল্প হাত নাড়বে।
কতদিনের স্বপ্ন তার। এখন স্বপ্নের কাছাকাছি এসেও লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না এই বোকা গাঁইয়া গুলোর জন্য।

এখন তামাং সাহেবই লোকের কাছে প্রচার করে দিতে পারে তার বড়োলোকির কথা।
একটা আশা নিয়েই বুরুং বেড়িয়েছে দেখতে আড়াল থেকে তামাং সাহেবের ওকে নিয়ে প্রচারটা।

কি দেখছে বুরুং তামাং সাহেব তো নেই সেখানে জটলা করে কতগুলো মজুর শ্রমিক বসে ধেনো খাচ্ছে আর নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। মাতাল হয়ে আছে।
ব্যাপারটা বোঝার জন্য আরো একটু কাছে এগিয়ে গেলো আড়াল রেখেই।
"আইজ আইকাশ থিহা টেকার বরষা মুদের লগেই আহিল"
চমকে উঠলো বুরুং। কি বলে এরা?
একজন শ্রমিক উঠে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এসেছিল সেটাকে চেপে ধরলো বুরুং।
কয়েকটা চাপড় মারলো, মজুরশ্রমিক অবাক হয়ে কিছু বোঝার আগেই বুরুং ওর গলায় গামছা টেনে বললো "টেকার বরষা, ইডার ভাষা বল" 
মজুরশ্রমিক গলা ছাড়াতে ছাড়াতে বলে "আইরে ইডার জইন্যে মারস কেনে? আইকাশ থিহা পাঁচ হাইজার লোটের বরষা হইসে আইজ, মোরা পাইসি" 
মজুরকে ছেড়ে ধপ করে বসে পড়ে বুরুং।
মজুরকে সামনে বসিয়ে আবার চিন্তা করতে থাকে বুরুং।
কিছুক্ষন বাদে বুরুং মজুরকে বলতে শুরু করে "আইমার ইকটা কাম কইরা দিতা পাইরলে তরে পাঁইচশ টেকা দিমু" 
-কি কাম? মজুর জিজ্ঞাসা করলো।

পরদিন সকালে বাজারে বুরুং মুখ ঢেকে যাচ্ছে তার আগে আগে মজুর টা একটা ধামসা বাজিয়ে বাজিয়ে হাঁটছে আর চিৎকার করতে করতে যাচ্ছে
"সাইবধান, ই বাবু বুরুং বাবু আইসতাছেন বটেক, ই ইখোন মৈস্ত বুড়ালুক হইছেন" 
দাঁত কটমট করে বুরুং বলে শুয়ার বুড়োলুক কি রা, বুল বড়ড়লুক।
রাস্তায় লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে।
সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারদিকে, 
কেউ সহাস্য কি যেন কানাকানি করছে তার দিকে তাকিয়ে।
বুরুং এবার শান্তি ফিরে পেয়েছে।তবে বোঝাতে পেরেছে সে তার মনের কথা সবাইকে। সফল লাগছে নিজেকে।
কিছু দূর হেঁটে দেখে কিছু লোক তাদের দিকেই দৌড়ে আসছে, এবার গর্বের হাসি বুরুং এর মুখে।
দৌড়ে আসা লোকগুলো বলতে থাকে" রশি দিয়ে বাইন্ধা ফেল দুইডারে, গাইরদে  পুইরা আসি" 
বুরুং থেমে যায়। পায়ের চটিগুলো হাতে খুলে উল্টোদিকে দৌড়াতে শুরু করে, কোনরকমে বাড়ি ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। মুহূর্তে  আবার দরজাটা একটু ফাঁক করে বলে---
"তুরা হইলি নোইচ্ছারের দইল" বলে সপাটে দরজা বন্ধ করে দিলো।







নাইটকুইনের গন্ধ

দে বি কা  চ ট্টো পা ধ্যা য় 


ছেলেমেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে বেলার ভরাভর্তি সংসার হলেও আজকাল ও ব্যক্তিগত একাকীত্বের যন্ত্রণা প্রবলভাবে অনুভব করে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে উঠেছে, তাই তারাও নিজেদের জগতে মশগুল, ফলে তাদের সঙ্গ পাওয়ার সম্ভাবনাও কমছে ক্রমশ। এটা তো মেনে না নিয়ে উপায় নেই। ভালোবেসে দেবুকে বিয়ে করলেও বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই দেবুর আত্মকেন্দ্রিকতা টের পেয়েছিল বেলা। এ নিয়ে অনেক অভিমান অভিযোগ প্রথম দিকে যে বেলা করেনি তা নয়, কিন্তু কোনো ফল না হওয়ায় আস্তে আস্তে সরে গেছে এ থেকে। দেবুকে মনের মত করে ও পায়নি কোনো দিন। দেবু নিজের পছন্দ অপছন্দ নিয়েই ব্যস্ত সবসময়, বেলার দুঃখ বা মনখারাপ ওর চোখেই পড়েনা। অনেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও দেবু নিজের ত্রুটিগুলো কিছুতেই মানতে চায় না, আত্মসমালোচনা বা নিজেকে শুধরে নেওয়া তো দুর অস্ত। ফলে বেলার একাকীত্ব বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে, যে ও আজকাল বিবাহ বিচ্ছেদের কথাও ভাবতে শুরু করেছে। কত দম্পতি বৃদ্ধবয়সে এসে আলাদা হয়ে যাচ্ছে এখন, ও ই বা পারবে না কেন? ভাবে বটে এসব, তবে এ দিকে এগোনোর সঠিক পথ খুঁজে পায়না বেলা। কারো সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে গলা শুকিয়ে আসে। কিন্তু কাছের মানুষ কাছের না হলে দূরত্বই ভালো এটাই ওর মনে হয় এখন। চাকরি থেকে অবসর না নেওয়া পর্যন্ত এই দুর্বিসহ জীবন কাটাতে হবে ভাবলেই ওর বুকের ভিতর প্যালপিটেশন হতে শুরু করে। ছেলেমেয়েরাও বাবার এই উদাসীনতা, বেলার মনখারাপ ও দুজনের মাঝে দুরতিক্রম্য ফাটলের অস্তিত্ব টের পায়, হয়তো চাপেও থাকে। নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায় বেলার। কি অসহায় অবস্থায় ও পড়তো, যখন মা বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে চলে যাবে বলে ব্যাগ গোছাতে বসতো। ভয়ে দুশ্চিন্তায় ঘুম আসতো না ছোট্ট বেলার, মনে হতো ঘুম থেকে উঠে যদি মা-কে আর দেখতে না পায়? ওর ঐ মনকষ্টের কথা কেউ বুঝতো না, ভাবতোও না। সেই দুর্বিসহ জীবনের স্মৃতি আজও ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, সেই একই জীবন নিজের সন্তানদের জন্য ও কখনও চায় নি। তাই আজও বেলা সংসার করে চলেছে, কারো কাছে কোনো প্রত্যাশা না রেখেই। একটা সময় অতিরিক্ত প্রত্যাশা করেছে এবং কষ্টও পেয়েছে বেশী। আজ ও প্রবল সংসারী হয়েও সবকিছু বাদ দিয়ে নিজের পছন্দটুকু আঁকড়েই বেঁচে আছে। সংসারসাগরে অবগাহন করেও ওর গা এখন খটখটে শুকনো। দেবুর প্রতি যে ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েও ওর অতৃপ্তি থেকে যেতো, আজ সেই আবেগ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। যে বেলা ভালোবেসে বেসেও নিজের হৃদয়ের অফুরন্ত ভালোবাসা বিলোনোর জন্য কাঁদতো সেই বেলার হৃদয় এখন শুকনো মরুভূমির মতো রুক্ষ। ভালোবাসার সেই আকুতি হারিয়ে ফেলেছে বেলা, দেবুর আত্ম অহংকার, উদাসীনতা আর হৃদয়হীনতা বেলাকে আজ এই অবস্থায় এনে ফেলেছে। দেবুর প্রয়োজন নেই ভালোবাসার, এটা অনুভব করেই বেলার অফুরন্ত ভালোবাসার স্রোত এখন ঘরের বেড়ালগুলোর উপরে ঝরে পড়ছে অবিরত। বেড়ালগুলো এখন বেলার অবলম্বন, ওদেরকে ভালোবেসে ওদের জড়িয়ে ধরে কেঁদে নিজের না পাওয়াগুলোর কষ্ট ভুলে থাকে ও। আসলে ও মেনে নিয়েছে এই জীবনকে, বাধ্য হয়েছে মেনে নিতে, কেননা চাকরি ছেড়ে তো আর পালাতে পারে না!
আজ ওর এক ছুটির দিনে দুপুরে বই-খাতা ছড়িয়ে বসেছে বেলা, অনেকগুলো বই পড়তে বাকি রয়ে গেছে, কিন্তু পড়া এগোচ্ছে না মোটেই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতাও যেন কমে যাচ্ছে দিনদিন। বেডরুমের দক্ষিণ দিকের জানলার পাশে বসে পড়ছিল, হঠাৎ বৃষ্টি আসায় বাইরে তাকিয়ে নানা গাছগাছালির উপর জলের ফোঁটা ঝরে পড়তে দেখে ছোটবেলার দিনগুলোতে ফিরে যায় ও। ছোটবেলায় যে বাড়িতে থাকতো ওরা, তারও দক্ষিণ দিকে এমনই জানলা ও গাছপালা ছিল। মাঝেমাঝে সেই জানলার সঙ্গে এই জানলাটা গুলিয়ে ফেলে ও, স্থান-কাল-পাত্র সব উল্টে ও গিয়ে পড়ে সেই ছোটবেলায়। দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে কেটে যায় কিছু সময়।  কিন্তু সে স্বপ্ন ভেঙে যায় দেবু অফিস থেকে ফিরে আসায়, এবার চা জলখাবারের ব্যবস্থা করতে উঠতে হবে, নিজের অবসর বিনোদন বলতে তেমন কিছু নেই আর, বই পড়া আর টুকটাক লেখালেখি--- সেটাও যেন আর হয়ে ওঠে না ঠিক মতো। চা বসিয়ে হালকা জলখাবার গোছাতে গোছাতে ও বেড়ালগুলোর রকমসকম দেখতে থাকে। ওদিকে হাত পা ধুয়েই দেবু টিভি খুলে বসে পড়ে, কোনো কথা হয়না দুজনের। বেলার বুকটা মুচড়ে ওঠে কষ্টে, না বলা কথারা ঘুরপাক খায় বুকের ভিতর, এই কষ্ট আর হাহাকারের কথা বোঝার কেউ নেই। দেবুকে চা জলখাবার দিয়ে ও আবার এসে বসলো দক্ষিণের জানলার পাশে, কিছু লেখার কথা ভাবছিল, কিন্তু ভাবনায় ছেদ পড়ল পিঠে একটা হাতের ছোঁয়ায়। বেলা চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখে দেবু হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, ওকে ডাকছে, সেই আগের মতো। কোন অতীত ইতিহাস থেকে যেন ভেসে এলো ঐ হাসিমাখা চোখের আহ্বান। দেবু হাত ধরে টেনে ওকে ছাদে  নিয়ে গেল, পুবদিকের প্যারাপেটের কাছে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে হাত বাড়িয়ে দেখালো আকাশের গোল চাঁদটাকে। সারাটা ছাদ জ্যোৎস্নার আলোয় মাখামাখি হয়ে রয়েছে আর সেই আলোয় ফুটে উঠেছে ধপধপে সাদা সুগন্ধী নাইট কুইন ফুল। চারিদিক ম ম করছে তার গন্ধে। মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে বেলার মনে ও চোখে মুখে।







গো হারা
 
প্র দী প  সে ন 
  

একক চিত্রপ্রদর্শনীর সূত্র ধরে মনোজের সাথে সুতপার পরিচয়। দিন গড়ায়, তার সাথে সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকে সম্পর্কের নৈকট্য। এরপর সূচনা থেকে আরোহী-সম্পর্ক সামনে এগিয়ে চলতে চলতে স্থায়ী গাঁটছড়া। মনোজ একটা আর্ট স্কুল চালায়। খুব ছোটো বয়েস থেকে চিত্রাঙ্কনের ঝোঁক মনোজের। তার মা-ই তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। বাবা মনে করতেন ছবি আঁকাআঁকিতে সময় নষ্ট হয়, পড়াশোনারও ক্ষতি হয়। মনোজ মায়ের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় ছবি আঁকা শিখে নেয়। মা কথায় কথায় বলতেন - যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।

আজ সরকারি চাকুরে মনোজ একটা আর্ট স্কুলও চালায়। এতে সংসারে বাড়তি আয় ঢোকে। তবে শুধু লক্ষ্মীই মনোজের একমাত্র আরাধ্যা নয়, সরস্বতীও। সুতপাকে ভালো রাখা, নিজেও ভালো থাকা সব সহজ হয়েছে মনোজের 'যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে' নীতি মেনে চলার দৌলতে। 

বছর পাঁচেক হল ওদের বিয়ে হয়েছে। সুতপা এখনিই মা হতে চায় না। মনোজেরও এক্ষুনিই বাবা হবার তাড়া নেই। অমরপুরের গাঁয়ের বাড়িতে পুকুর, জমি-জমা ছেড়ে মা-বাবা আগরতলাবাসী হতে চায় না। ফোনে বৌমাকে তাড়া দেয় শাশুড়ি- আর কত? এবার গোপাল না হয় লক্ষ্মী ঘরে আনো। ক'দিন আর বাঁচবো বুড়ো-বুড়ি। 
সুতপা হেসে হেসে বলে- ধৈর্য্য ধরো, মা। অপেক্ষার ফল মিঠে হয়। 

শাশুড়ি হাল ছেড়ে দেয়। -কী জানি বাপু, তোমরা আল্ট্রা মডার্ন। এনজয় ছাড়া কিচ্ছু বোঝো না। আমার বিয়ের এক বছরের মধ্যেই মনোজ আমার পেটে এসেছিল। ইত্যাদি ইত্যাদি....

সামনেই পুজো। একটা নামী ক্লাবের পুজো ম্যাগাজিনের জন্য একটা প্রচ্ছদ ছবির বায়না পেলো মনোজ। এবারের থিম 'ওরা কাজ করে'। মনোজ দু'রাত থিম নিয়ে খুব ভেবেছে। অবশেষে ইউরেকা। ওর বাড়িতে চাঁপার-মা দুবেলা কাজ করে। বছর ত্রিশের চাঁপার মায়ের নিটোল দেহে লাবণ্য চুঁইয়ে পড়ে। মুখে হাসি লেগেই থাকে। অতি সাধারণ কাপড়-চোপড়। মুখের ওপর অবিন্যস্ত চুল। চটপট কাজ করে। মনোজের থিম চাঁপার-মা।

পর্দার ফাঁকে নিজেকে আড়ালে রেখে মনোজ চাঁপার মাকে দেখতো কলতলায় বাসন মাজতে, কাপড়-চোপর ধুতে। হাঁটুর ওপর কাপড়- পরিস্কার নিটোল দুই ঊরু, ব্লাউজের উপর দিয়ে উদ্দাম দুই মাংসপিণ্ড। সামনে ছড়িয়ে থাকা এঁটো বাসন আর বালতি ভরা কাপড়চোপড়। 

ছবি প্রায় শেষ। শেষ টান পড়ে গেছে। আজ কদিন ধরেই মনোজের ধ্যানজ্ঞান ওই ছবিটাই। মাঝে দু’তিন দিন সুতপার চোখে পড়েছে ব্যাপারটা। মনোজ একাগ্র মনে চাঁপার মাকে দেখছে- ওর সুগোল ঊরু, বুকের আকর্ষণীয় নিটোল মাংসপিণ্ড। 

মনে মনে বড্ড হোঁচট খেয়েছে সুতপা। ভাবে- চাঁপার মায়ের কাছে হেরে যাচ্ছে না তো সে? কী নেই তার? কী না দিয়েছে সে মনোজকে? তার পরেও? নাঃ! পুরুষ মানুষগুলোই এমন, বাতিকগ্রস্ত। আকন্ঠ খেয়েও খাবার দেখলে জিভে লালা আসে। এক ঘাটের জলে তেষ্টা মেটে না, খাই খাই ভাব।

মনোজ অফিসে চলে গেলে সুতপা খুব ভেবেছে। না, ঘিয়ের সামনে আগুন রাখতে নেই। ঘিকে তো আর সরানো যাবে না, ওই আগুনকেই সরাতে হবে ঘরে আগুন ধরে যাবার আগে। 

চাঁপার মাকে অগ্রিম মাসের বেতন তুলে দিয়ে বলে - ধরো, চাঁপার মা। পুরো মাসের টাকাটা রাখো। আমরা কাল অমরপুর যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে হয়তো। কবে ফিরবো সিওর করে বলতে পারছি না। ফিরে এসে তোমায় ফোন করবো। 

আসলে ঘাড় থেকে বেতালকে নামাতে ওটুকু অভিনয় না করলেই নয়। কাসুন্দি ঘেঁটে তো লাভ নেই যেখানে ঘরের মানুষটাই এতে জড়িত। সুতপাকে সাপও মারতে হবে আর লাঠিটাও অক্ষত রাখতে হবে। 
চাঁপার-মা অবাক হলো। হঠাৎ কী হলো? কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ল না তো? 
সুতপা হেসে বলে - না, না, বাবা-মা ভালোই আছেন। আসলে অনেকদিন দেখা নেই তো! মনটা কেমন করছে। তাই ভাবলাম গিয়ে দেখেই আসি। তোমার দাদা কি যেতে চায়? এখানে এমন কী মধু আছে যে যেতে চায় না! অনেক বলে কয়ে রাজি করিয়েছি। আজ ছুটির অ্যাপ্লিকেশন করবে। হয়তো কাল সকালেই অমরপুর যাচ্ছি।
কথাগুলো বলে সুতপা শার্লক হোমসের মতো চাঁপার মায়ের রিঅ্যাকশন পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কী ধড়িবাজ মেয়েরে বাবা! নো রিঅ্যাকশন! তলে তলে এতো? পাকা খেলুড়ে কোথাকার! দেখাচ্ছি মজা। হাঁটু আর উদোম বুকে টোপ ফেলা বের করছি। আর ডাকবো না। অন্য কোথাও চাড় ফেলো, টোপ ফেলো, আমার পুকুরে নয়। 
 সাবধানে যেয়ো গো, বৌদি- বলে চাঁপার-মা চলে যায়। সুতপা মনে মনে বলে- আপদ বিদেয় হলো। আমার ঘরে সিঁধ কাটা? আজ একটু রাত করেই বাড়ি ফিরেছে মনোজ। খুব খুশি-খুশি ভাব। হাতে দুটো প্যাকেট। টেবিলের ওপর প্যাকেট দুটো রেখে মনোজ বাথরুমে চলে যায়। মহা কৌতূহল নিয়ে সুতপা প্যাকেট দু'টো খুলতেই তার চোখ কপালে - একটায় একটা দামী শাড়ি। সে নাহয় তার জন্য। অন্যটায়? মোটামুটি একটা ভালো শাড়ি আর বছর পাঁচ বয়েসের মেয়ের জন্য সুন্দর ফ্রক। নিশ্চয় চাঁপা আর তার মায়ের জন্য। তলে তলে এতো? কে জানে কতদিন ধরে চলছে এই লীলাখেলা! গত রোববার সুতপা বাপের বাড়ি মেলাঘর গিয়েছিল। মা পীড়াপীড়ি করায় একরাত থেকে গিয়েছিল। সে রাতে চাঁপার-মা কি থেকে গিয়েছিল? মনোজের সাথে এক বিছানায়? পরদিন সকালে এসে সুতপা দেখে চাঁপার-মা ওদের বিছানায় পাতা বেডশিট কেচে রোদে শুকোতে মেলে দিয়েছে উঠোনে টাঙানো তারে।

মনোজ ঘরে ঢুকে দেখে সুতপা প্যাকেট হাতে করে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকে কেমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। মনোজ হেসে বলে- চাঁপার-মা আর চাঁপার জন্য। ওটা তোমার জন্য। নেভি-ব্লুতে তোমাকে হেভি লাগে। যেদিন তোমার আমার প্রথম দেখা, মনে পড়ে তুমি নেভি-ব্লুতে নীলপরীর মতো লেগেছিলে আমার চোখে? 
সুতপার ভাবান্তর নেই। মনে মনে বলে- পাকা খেলোয়াড়! বৌয়ের প্রশংসা করে আমার মনকে ডাইভার্ট করার চেষ্টা? তুমি চলো শাখায় শাখায় আমি চলি পাতায় পাতায়। তোমার কৃষ্ণলীলা বার করছি। কাল থেকে ঊরু দেখা, মাংসপিণ্ড দেখা হচ্ছে না। মনোজ সুতপার ডান হাতটা ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে বলে- তোমাকে আমার একটা সিক্রেট মিশনের কথা বলা হয়নি। আমি তা না বলা পর্যন্ত মনে শান্তি পাচ্ছি না। সাকসেসফুল হই কি না হই তাই সিক্রেটলি অ্যাডভেঞ্চার চালিয়ে গেছি তোমাকে ইন দ্য ডার্ক রেখে। নবারুণ ক্লাবের শারদীয়া ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ এঁকেছিলাম। থিম ছিল "ওরা কাজ করে"। চাঁপার-মা তো ওই শ্রেণিরই প্রতিনিধি। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে ওকে দেখতাম কলতলায় কাজ করতে। উদোম ঊরু, অর্ধনগ্ন বুক, কপালে ছোটো ছোটো চুলের গোছ, মুখে ঘাম, ক্লান্ত মুখ তবুও খেটে খাওয়ার আত্মগরিমায় বড়ো পবিত্র মুখমণ্ডল। ছবিটা ওদের আজই দিলাম। মুখের আদলটা একটু পাল্টে দিয়েছি ইচ্ছে করে। কাজের মেয়ে হলেও চাঁপার-মায়ের একটা ডিগনিটি তো আছে। ওরা পাঁচ হাজার দেবে বলেছিল। কিন্তু থিমের সাথে ছবিটার সুন্দর মিল দেখে সাত হাজার দিয়েছে। তাই ওর জন্য একটা শাড়ী আনলাম। চাঁপাটাই বা বাদ থাকে কেন? ভালো করিনি? কাল সকালে ও যখন কাজে আসবে তুমি ওর হাতে সারপ্রাইজ গিফটটা তুলে দিও। ও হ্যাঁ, মোবাইলে ছবিটা তুলে রেখেছি। অবসর হয়ে দেখো। হঠাৎ সুতপার চোখে চোখ পড়ে মনোজের। বলে- এ কী! তোমার চোখে জল? কী হলো? আমি বাপু তোমাদের নারী চরিত্রের অতশত বুঝি না। সুতপা বাঁ হাতের চেটো দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলে - চিত্রকর আছো, তাই থাকো। সাইকোলজিস্ট হয়ে কাজ নেই। বড্ড গো হারা হারিয়ে দিয়েছ আমায়। ড্রেসটা চেঞ্জ করো না, একটু বেরুবো। চাঁপাদের বাড়ি যাবো। কাপড়চোপড়গুলো দিয়ে আসবো। আর একটা কথা। ওখানে গিয়ে তুমি মুখ খুলবে না। কোনো ব্যাখ্যা চাইবে না। শুধু আমার কথায় হ্যাঁ-তে হ্যাঁ আর না-তে না মেলাবে, নাথিং মোর। মনে থাকবে? মনোজ কাচ চোখে সুতপার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। বাইকের চাবিটা মনোজের হাতে তুলে দিয়ে কাপড়ের প্যাকেটটা মনোজের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে- ধরো, আমাকে দরজা আর গেটে তালা দিতে হবে। 

সুতপাকে নিয়ে মনোজের বাইক উড়াল সেতু পেরিয়ে ছুটল মিলন চক্র এলাকায় চাঁপাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।







অবসরের বন্ধুরা

ক বি তা  চ ক্র ব র্ত্তী 


দুপুরের পর থেকেই পিছনের বারান্দাটা যেন টানতে থাকে।কখন গিয়ে বারান্দায় যে দাঁড়াবো। গুবলুর স্কুল থেকে ফিরতে প্রায় চারটে হয়ে যায়। বাড়ি ফিরেই কোনরকমে কিছু খেয়েই পার্কে দৌড় দেয় ব্যাট হাতে।

আমার বাড়ির পিছনদিকে যে বারান্দাটা আছে সেখান থেকে পার্কের বেশ কিছুটা খুব ভালোভাবে দেখা যায়। বাড়ির   পাঁচিল শেষ হওয়ার পর একটা সরু রাস্তা। আর তারপরেই পার্কের শেষ প্রান্তটা পড়ে। এখানে একটা ছোটো গেট আছে পার্কের। এদিক থেকে যারা আসে তারা এই গেটটা দিয়েই পার্কে ঢোকে।
প্রথম দিকে বিকেলের কাজ সেরে ওই বারান্দায় গিয়ে মাঝে মাঝে দাঁড়াতাম, গুবলুকে দেখার জন্য। কিন্তু তারপর থেকে অন্য একটা কারণে এই বারান্দায় নিয়ম করে সাড়ে চারটে থেকে সাড়ে পাঁচটা (গরমকালে অবশ্য পাঁচটা থেকে প্রায় ছটা) অবধি এই একঘন্টা কাটানোটা আমার একটা নেশার মত হয়ে গেছে।

কারণটা হলো ,পার্কের এই কোণের দিকের দুটো বেঞ্চে বয়স্ক লোকের একটা দল প্রত্যেকদিন আড্ডা দেয়। সবাই সত্তরের ওপরই হবে। কি সুন্দর প্রাণখোলা আড্ডা হয় সেখানে। দূর থেকে হলেও কবে যে আমিও ওদের আড্ডার শরিক হয়ে গেছি। কেউ কেউ মাঝে মাঝে বৌমা বলে হয়তো একটু জল চাইলো। এমনও হয়েছে, কেউ বাড়ির থেকে কিছু আনলে আমাকে বারান্দায় গিয়ে ঠিক দিয়ে এসেছে। খুব ভালো লাগে আমার। অসমবয়সী হলেও নিজেকে ওনাদের বন্ধু মনে হয় আমার। এখন তো আমি সবাইকে মোটামুটি চিনেও গেছি। চ্যাটার্জীদা (এগুলো ওনারা নিজেরা বলে ডাকেন একে অপরকে) হচ্ছেন সবথেকে শৌখিন মানুষ। সবসময় টিপটপ থাকেন। একটু কম কথা বলেন। আর হালদারদা হলো সব থেকে বেশি কথাবলা মানুষ। ওনার গলাই বেশি পাওয়া যায়। বাসুদা সবসময় অসুস্থ থাকেন। গলায় মাফলার সবসময়। কুণ্ডুদা রোজ দেরী করে আসেন, আর সবার বকা খান। আর চৌধুরীদা হলেন সব থেকে ফেমাস। উনি প্রত্যেকদিন একটা বড় ফ্লাস্ক করে সবার জন্য চা নিয়ে আসেন। চক্রবর্ত্তীদা আনেন বিস্কুট বা চানাচুর। আরো কয়েকজন আছেন। মুখার্জিদা মাঝে মাঝে আসেন। আসলে তিন ছেলের কাছে চারমাস করে ভাগে থাকতে হয়তো। তাই ওই চারমাস তার দেখা মেলে।

পার্কে এসে সবার হাসি ঠাট্টা ইয়ার্কি এসব যেমন শুনতে পাই, তেমন তাদের কষ্টগুলোও শুনতে পাই। কারুর বৌমা কথা শোনায় খেতে দিয়ে। কারুর সন্তান বিদেশে থাকে। একটা খোঁজও নেওয়ার প্রয়োজন হয়না। প্রত্যেকেরই দুঃখের জায়গা আছে। আর সেগুলো এই বন্ধুদের কাছে বলে একটু হালকা হন।

কয়েকদিন হলো দেখলাম চৌধুরদা আসছেননা। আর আড্ডাতেও যেন প্রাণ নেই। সবাই খুব চুপচাপ। হাসি নেই কারুর মুখে। আর  চা'ও খাওয়া হচ্ছে না ওনাদের। ভাবলাম হয়তো অসুস্থ। বয়েস তো হয়েছে। কি মনে করে চা করে নিয়ে পার্কে গেলাম। কাগজের কাপ নিয়ে গেছিলাম। গিয়ে বললাম, কাকু আজ আমি চা নিয়ে এসেছি। দেখছি কদিন চৌধুরী কাকু আসছেন না। আর আপনাদেরও চা খাওয়া হচ্ছে না তাই। চ্যাটার্জীকাকু  মুখ খুললেন। চৌধুরীটা আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। হতভাগা আমরা চা খেতে পাবনা সেটা একবারও ভাবলনা? সবার চোখে জল দেখলাম। কুন্ডুদা বললেন, বৌমা তুমি আজ এনেছ, আমরা খেয়ে নেব। কিন্তু পরদিন থেকে তুমি আর চা এনোনা। আমরা কেউ পারবোনা আর চা খেতে চৌধুরীকে ছাড়া।

এরপর আর চা নিয়ে যাইনি। তবে বারান্দায় বসি। কিন্তু সেই প্রাণবন্ত ব্যাপারটা আর নেই। সবাই আসে ঠিকই, কিন্তু চুপচাপ বসে চলে যায়। আমারও আর ভালো লাগেনা। ভাবি, আর বারান্দায় যাবনা। তাও কিসের একটা টানে ছুটে যাই বারান্দায়। হয়তো এর নাম বন্ধুত্ব।

মাস খানেক পর, একদিন একটু দেরী করেই বারান্দায় গেলাম। কারণ ঘর থেকেই আমার পার্কের বন্ধুদের বেশ কথাবার্তার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। কৌতূহল হলো। গিয়ে দাঁড়াতেই, হালদার কাকু ডাকলেন, বৌমা একবার আসবে একটু। দেখলাম একজন মহিলা ওনাদের সাথে বসে আছেন। তাড়াতাড়ি গেলাম পার্কে। ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার। উনি চৌধুরীদার স্ত্রী। আমাদের বৌদি । আজ উনি আমাদের জন্য চা করে নিয়ে এসেছেন। দেখলাম সেই পরিচিত ফ্লাস্ক। উনি সবাইকে চা দিয়ে আমাকেও এক কাপ চা দিলেন। তারপর নিজেও এক কাপ চা নিয়ে বেঞ্চে বসলেন। বলতে লাগলেন, আপনাদের দাদা প্রত্যেকদিন নিজের হাতে চা করে আমার জন্য এক কাপ চা রেখে, এখানে নিয়ে আসতেন ফ্লাস্কে। শরীর খারাপ হলে যদি বলতাম আজ যেওনা। কিছুতেই শুনতেন না। বলতেন ওদের আজ তাহলে চা খাওয়া হবেনা। কি যে ভালোবাসতেন আপনাদের। বলতেন, আমি না থাকলে ওদের আর চা খাওয়া হবেনা। আমি বলেছিলাম। ঠিকই হবে। কারুর জন্য কিছু আটকে থাকেনা। উনি চলে যাওয়ার পর ভাবলাম, ওনার ভালোলাগাটা আমি কেন রাখতে পারবোনা? একটু তো চা। ওটা আমি পারবোনা ওনার জন্য? সেটা ভেবেই আজ আমি নিয়ে আসলাম। আর এবার থেকে আমি প্রত্যেকদিন এসে আপনাদের চা খাইয়ে যাবো। যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে।

সবাই প্রথমে একটু কিন্তু কিন্তু করলেও রাজি হয়ে গেল। পরদিন দেখলাম কুন্ডুকাকু নিজের স্ত্রীকে নিয়ে পার্কে আসলেন । চৌধুরী কাকিমা আর কুন্ডু কাকিমা নিজেদের মত গল্প করতে লাগলেন। আর বন্ধুরা নিজেদের মতো। বেশ ভালো লাগলো।

দুদিনের জন্য বাপের বাড়ি গেছিলাম। ফিরেছি আজ। ঘর থেকেই পার্কে বেশ আওয়াজ পাচ্ছি। মহিলাদের গলা বেশ পাওয়া যাচ্ছে। বারান্দায় গেলাম। আজ তো সব ভর্তি বেঞ্চগুলো। একদিকে সব কাকুর দল আর একদিকে সব কাকিমার দল। কি সুন্দর গল্প করছে সবাই মিলে। আমি সাথে সাথেই পার্কে গেলাম। সবাই আমাকে বৌমা এসো বৌমা এসো বললো। চৌধুরী কাকিমা চা আর চ্যাটার্জী কাকিমা বিস্কুট খেতে দিল আমাকে। কি যে আনন্দ হলো বলে বোঝাতে পারবোনা। ফেরার সময় বলে আসলাম কাল থেকে কিন্তু আমি এখানে রোজ আসবো। সবাই হইহই করে উঠলো বাচ্চাদের মত। আমার প্রিয় বন্ধুরা।







বিটটুর বিটকেলেমি

ব না নী  চ ক্র ব র্তী


সকাল থেকেই বিটটুর মনটা খারাপ। গরমের ছুটি আজ থেকে পড়ে গেছে। বন্ধুদের সাথে আবার সেই একমাস পরে দেখা হবে আর ঘরে থাকা মানেই নো দুষ্টুমি, মা এর চোখ রাঙানি, কানমলা। মা অফিস চলে গেলে যে একটু দুষ্টুমি করবে তারও উপায় নেই। দেখাশোনা করার দিদুন... মা অফিস থেকে এলেই নালিশ... বিটটু খায়নি,  ঘুমায়নি, সারাদিন ছোটাভীম দেখেছে। তাই কয়েকদিন ধরেই মাথায় ঘুরছে কিভাবে দিদুনকে শায়েস্তা করা যায়। এখানে বলে রাখি বিটটু এবছর ক্লাস ওয়ান এ উঠেছে। মুখে সর্বক্ষণ পাকাপাকা কথা এবং মাথায় দুষ্টুবুদ্ধিতে ভরপুর। অ্যানুয়াল পরীক্ষার কয়েকদিন আগে হঠাৎ স্কুল-এ মাকে ডেকে পাঠালো। কিছুই করেনি সেরকম।সবসময় একনাগাড়ে  ক্লাস করতে কি কারোর ভালো লাগে তাই  ক্লাস চলাকালীন পাশের বন্ধু খুব মন দিয়ে লিখছিল বলে পেন্সিলটা ধরে টেনে দিয়েছিল। তাই বলে ম্যাম ওরকমভাবে বকবেন! ছোট বলে কি প্রেস্টিজ নেই? ম্যামকে গম্ভীরভাবে শুধু বলেছিলাম বাচ্চাদের কেউ এরকমভাবে বকে। তুমি জানোনা বাচ্চাদের এরমভাবে বকতে নেই। এরকম ভাবে রোজই কিছু না কিছু আমাদের বিটটুবাবু করেন কিন্তু সে বুঝতেই পারেনা ভুল না করলেও কেনো বড়োরা ওকে শুধুমুধু বকে। এটাতো তবু মানা যায় গতবার পুজোর সময় যেটা ঘটেছিল সেটাতো কোনোভাবে মানা যায়না। পুজোর সময় প্রতিবছর মা-বাপির সাথে কলকাতার বাইরে বেড়াতে যায়।প্রতি বছরই কোনো না কোনো নির্জন জায়গা- হয় পাহাড়ে, নাহলে অন্যকোনো পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা জায়গাতে যাওয়া হয়। সেখানে না থাকে কোনো খেলার জায়গা না থাকে কোনো বন্ধু। মা বাপি সারাদিন ঐ কাঞ্চন না কি নাম তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বসে থাকে। আমি তাই গতবার বললাম এবছর পুজোতে আমরা ঢোলকপুর যাবো। ওখানে গিয়ে ছোটাভীম, ছুটকি, রাজু সবার সাথে খেলবো। প্রথমে দুজনেই খুব হাসলো। আমিও বেশ খুশি হলাম ঢোলকপুর যাওয়া হবে বলে। কিন্তু পরেরদিনই বুঝতে পারলাম ওদের মনে-মনে কি আছে। ওরা ঢোলকপুর যাওয়ার ট্রেনের টিকিট কাটার বদলে আমায় বোঝাতে এলো ঢোলকপুর, ছোটাভীম কিছু নেই এইসব নাকি কল্পনা। এটা শুনে আমি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে দিলাম। ভাবলাম যদি কাঁদলে ওরা আমার কথা শোনে। কথা শোনা তো দূর, প্রথমে একটু বোঝাবার চেষ্টা করলো যখন দেখল কান্না কমছে না তখন বাপি একটা জোর ধমক দিল। তার উপর নিজেরা আলোচনা করছে এইবছর অবধি আমার ট্রেনফেয়ার ফ্রী। আমি ফ্রী এটা আবার কি কথা। আবার কান্না জুড়ে দিলাম আমি ফ্রী হবোনা এই বলে। আর কি এবারতো আর ধমক নয় জোরসে-জোর একটা কানমলা খেলাম বড়দের মাঝে কথা বলেছি বলে। যায় হোক এখন দিদুনকে শায়েস্তা করার একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে।কিছুদিন ধরেই দেখছে দিদুন হাত-এ ব্যাথা বলে কি একটা বেল্টএর মত বেঁধে আসছে। বিটটু সেরকম কিছুই করেনি বেল্টবাঁধা হাতটা ধরে একটা মোক্ষম টান দিয়েছে। এতে এত হাঁউমাউ করলো দিদুন যে সাথে সাথেই হসপিটালে নিয়ে যেতে হলো।  মা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে পুলিশি জেরা শুরু করলো। কি করে হলো, কি দুষ্টুমি করেছে সে।বাড়ির কারোর কিছু হলেই সবাই যে কেনো ধরে নেই তার পেছনে বিটটুবাবুর হাত আছে সেটা কিছুতেই মাথায় আসেনা। দিদুন এর হাত-এ সাদা মতো কি একটা করে হসপিটাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে। মা আমায় নিয়ে দিদুন বাড়ি গেলো দিদুনকে দেখতে। আমিও কিছু জানিনা এরকম একটা মুখ করে মা-এর সাথে দিদুন এর মুখোমুখি হলাম। মা দিদুনকে নানাভাবে জিজ্ঞেস করতে লাগলো কিকরে ব্যাথা পেলো। দিদুন আমার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে বললো বাথরুম-এ পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছে। আমার এবার সত্যি চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেলো। মা ভাবলো দিদুন ব্যাথা পেয়েছে বলে আমি কাঁদছি। আমি মুখে কিছু না বলে বাড়ি ফেরার সময় মনে-মনে ঠিক করলাম এরপর থেকে একটু-আধটু দুষ্টুমি করলেও কক্ষনো আর কাউকে ব্যাথা দেবোনা।






শিউলি

উ ত্ত ম  ব ণি ক


বাবা ও বাবা, এবারেও কি পুজোয় আমি নতুন জামা পাবনা! বাবার উদ্দেশ্যে দশ বছরের ছোট্ট শিউলির প্রশ্ন, গত দুই বছর থেকেতো কোনো নতুন জামাকাপড় দিতে পারেনি কানাই তা সে ভালো করেই জানে। কতটা অসহায় হলে একজন পিতা তার একমাত্র সন্তানের জন্য বছরের ওই কয়েকটা দিনের আনন্দ দিতে নিরুপায় হন, তা কানাই ছাড়া বুঝি কেউই জানে না... কি জানি একটা মহামারী এসেছিল সারা দুনিয়া জুড়ে, গত দুবছর ধরে, তখন সবাই পূজা করেছিল নম নম করে। কানাই ঢাকীর মতোন কোনো ঢাকীদেরই ডাক পড়েনি কোনো পূজা প্রাঙ্গনে।

অথচ কানাই এর জীবনটা আগে এতটা অন্ধকারে ঢাকা ছিলোনা... ছায়াকে নিয়ে ঘর বাঁধার পর বেশ ভালোই চলছিল জীবনটা... দু'বছর পর ঘর আলো করে শিউলির আগমন... এক শরতের জ্যোৎস্না রাতে- চারিদিক থেকে ভেসে আসছিল শিউলি ফুলের সুমধুর বাতাস, দোলায় দুলছিল কাশফুলগুলি, বাতাসে ভেসে আসছিল আগমনীর সুর... সেই রাতেই ছায়ার কোল আলোকিত করে জন্মনিলো ওদের একমাত্র কন্যা... আদর করে ওরা নাম রাখলো শিউলি। সবাই বললো মা দুর্গা এসেছে...

কিছু জমির চাষাবাদ ও ঢাক বাজিয়ে বেশ ভালোই চলছিল কানাই এর... কিন্তু কথায় বলেনা সব সুখ চিরস্থায়ী হয় না... কানাইদেরও ঠিক তাই হয়েছিল...

চার বছরের শিউলি উঠোনে খেলতে খেলতে পরে গিয়ে হঠাৎ করে অজ্ঞান...  ডাক্তারবাবু বললেন থ্যালাসেমিয়া... রক্ত পালটে পালটে বড়জোর দশ বারো বছর। আকাশ ভেঙ্গে পড়লো ওদের হাসিখুশি পরিবারের ওপর... নিজের বসতভিটেটুকু বাকী রেখে সবকিছু বিক্রি করে চলছিল শিউলির চিকিৎসা... শিউলি এখন অনেকটা সুস্থ... 

শহর থেকে ডাক পাওয়ার পর এবার বেশ ভালোই রোজগার হয়েছে কানাইয়ের, আর উপরি হিসাবে বাবুরা খুশী হয়ে বখশিসও দিয়েছে অনেকটা...
লাল টুকটুকে একটা জামা... ওহ্!  দারুণ মানাবে শিউলিকে, আর সাথে একজোড়া নূপুর, যেটা পরে শিউলি দৌড়াবে সাড়া উঠোন জুড়ে...

দুর্গা মায়ের বিসর্জন দিয়ে এগুলো কিনে নিজের গ্রামে ফিরছে কানাই... চারিদিকে কি অপূর্ব শোভা। শিউলি ফুলের সুবাস, কাশবনের ফুলগুলো যেনো খুশিতে লুটোপুটি খাচ্ছে একজন আরেকজনের গায়ে... মনেহয় ওরা যেনো শিউলির নতুন জামার খুশিতে আনন্দে আত্মহারা...

একি বাড়ির সামনে এতো জটলা কিসের? ভিড় ঠেলে সামনে যেতেই... শিউলির নিথর শরীরে কারা যেন কপালে চন্দন এঁকে দিয়েছে, চোখে তুলসী পাতা... গতকাল দুর্গা মায়ের বিসর্জনের সাথে সাথেই রক্ত বমি করতে করতে শিউলি এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে... হাউ হাউ করে কেঁদে কেঁদে ছায়া কথাগুলো শেষ করতেও পারলোনা তার আগেই জ্ঞান হারালো... শিউলির অন্তেষ্টি ক্রিয়া এইমাত্র শেষ হলো... সবাই যে যার মতো বাড়িতে ফিরছে... কানাই শুনতে পেলো কারো বাড়িতে লক্ষ্মীপূজা হচ্ছে সে গান ধরেছে "এসো মা লক্ষ্মী, বোসো ঘরে...







বংশপ্রদীপ
  
স্ব প ন  কু মা র  স র কা র


"মাগো, মা! তোমার দু'টি পায়ে পড়ি। ওগো, আমায় আর মেরো না। আমি আর সইতে পারছি না।" 

পুনরায় শেফালির কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস।

"মাগী কোথাকার! বেশ ত রাণীর হালে রাখছি। কোন কিছুরই কমতি নাই। চাওয়া বলতে কেবল একটা পুত্রসন্তান! তাও দিতে পারছিস না! দু' দুটো মেয়ে পয়দা করে আরামচে বসে আছিস।আবার মুখে বড় বড় কথার ফুলঝুরি! শেফালির স্বামী রতনের রাগে কম্পমান গলা পাওয়া গেলো।

"ওগো, ছেলে না হলে আমি কি করবো, বলো? আমার দোষ কী? "শেফালি মার খেয়ে মাটিতে পড়ে আছে। সেখান থেকেই অস্ফুটে কথাগুলো বললো।

রতন আর দেরি করলো না।শেফালির চুলের মুঠি ধরে আরো দু'চার ঘা দিয়ে হুঙ্কার ছাড়লো, "তুই এখনও চোপা করিস আমার সাথে? তোর এত সাহস! আমার ছেলে চাই, বংশপ্রদীপ চাই! এবার ছেলে দিতে না পারলে তোকে আমি মেরেই ফেলবো। মনে রাখিস।"

ঠাস করে দরজা খুললো রতন।শরীরটা ঘামে পুরো ভিজে গেছে।পরিধেয় গেঞ্জিটা নিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে হনহনিয়ে বাজারের দিকে চলে গেলো।

"ও রতনের মা, বউ কাঁদে কেন?কি হল আবার? "হঠাৎ রাধা বোষ্টমীর গলা শুনে রতনের মা চমকে ওঠে। পেছনে ফিরে গলার স্বরে তাচ্ছিল্য এনে বলেন, "সে আর কি বলবো, দিদি! সব আমার কপাল! নইলে বুড়ো হয়ে গেলাম, নাতির মুখ দেখার সৌভাগ্য এখনও হবে না কেন?বংশের প্রদীপ দেয়ার মত আর কোন বংশধর রইলো না গো দিদি। উনি তো স্বর্গবাসী হয়ে বেঁচে গেছেন। আমি জ্বলছি জ্বালায়!"

রাধা বোষ্টমী আকাশের দিকে করজোড়ে বললেন, "সব ভগবানের ইচ্ছে, বুঝলে দিদি?ভগবানকে ডাকো। ভগবান নিশ্চয়ই তোমাদের মনের আশা পূর্ণ করবেন।" শেফালির দিকে চেয়ে মায়াজড়ানো কন্ঠে বললেন, "তোমার বউটা কিন্তু বেশ লক্ষ্মীমন্ত!"

"অলক্ষ্মীর ছায়া!" রতনের মা দাঁতে দাঁত চাপলো।

             দুই
বাজারের মধ্যে সবচে' বড় যে মুদির দোকানটা সেটাই রতনের দোকান। মস্ত দোকান। নিজস্ব।কি নেই দোকানে! দৈনন্দিন দরকারি সবই মেলে দোকানটায়।বিক্রিবাট্টা বেশ ভালো। চার চারজন কর্মচারী রেখেছে। প্রচুর জমি-জমা, দুধেল গাই, মাছের বিরাট পুকুর-সব মিলিয়ে স্বচ্ছল গৃহস্থ পরিবার। কোন কিছুরই কমতি নেই। অভাব কেবল একটা পুত্রসন্তান! প্রকৃতির নিয়মে রতনরা একদিন সবাই মরে যাবে।বাপ-দাদা, সাত পুরুষের ভিটায় কে প্রদীপ জ্বালাবে?

এসব ভাবতে ভাবতে রতনের চোখটা বুজে আসে। কর্মচারী হারানের ডাকে চোখ খোলে রতন।হারান দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছে। হাত-মুখ ধুয়ে রতন খেতে বসে। না, কাতল মাছের ঝোলটা আজ যেন নোনতা নোনতা লাগছে! মাছটাও ভালো ভাজা হয়নি, তুলতুল করছে।একগাদা বিরক্তি ঝরলো শেফালির প্রতি, "ছোটলোক কোথাকার! ঠিকঠাক রান্নাটাও করতে পারে না।"

দুপুরে ক্রেতা কম। শরীরের আলস্য দূর করতে রতন একটু পায়চারি করতে বের হয়। অদূরেই দেখতে পায় একটা মাঝবয়সি লোক কিসব মাদুলি আর শেকড়-বাকড় নিয়ে বসে আছে।মুখে অর্নগল কথা বলছে। রতন লোকটার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো। তারপর কি ভেবে যেন কিছু শেকড়-বাকড় আর মাদুলি চড়া দামে কিনে নিয়ে সোজা বাড়ির পথে পা বাড়ালো।

বাড়ি গিয়ে শেফালির খোঁজ করে শেফালিকে মাদুলি আর শেকড়গুলি দিলো। ওগুলোর ব্যবহার বিধিও শেফালিকে বলে দিলো। সর্তকও করে দিলো।ওগুলো মহামূল্যবান! কেননা ওগুলো যে এ বংশের বংশপ্রদীপ রক্ষার প্রধান নিয়ামক!

              তিন
বর্ষা চলছে। হুম, তুমুল বর্ষন হচ্ছে। বৃষ্টির তান্ডবে মাঠঘাট তলিয়ে যাচ্ছে।

শেফালির চোখ শুকিয়ে গেছে।তবে অশ্রু ঝরার প্রমানও চোখে লেগেই আছে।

হুম, আজও রাতে দোকান থেকে ফিরে রতন শেফালিকে খুব মেরেছে। শেফালির দোষ-কবিরাজের দেয়া মাদুলি সে হারিয়ে ফেলেছে। শেকড়গুলিও ক'দিন যাবৎ খায়নি। রতন দোকান থেকে ফিরলে এসব কথা ওর মা-ই ওকে বলে দেয়। রতন আর দেরি করেনি। শেফালিকে ঘরের দরজা বন্ধ করে পিটিয়েছে।না, শাশুড়ী ছেলেকে থামানোটা নিষ্প্রয়োজন মনে করেছেন।প্রতিবেশীরাও কেউ মার থামতে আসেনি। কেননা, প্রচুর বৃষ্টির দাপটে কেউ টেরও পায়নি শেফালি চিৎকার করছে, যন্ত্রনায় মুক্তি চাইছে! হয়ত এসব কেউ না জানায় ভালোই হয়েছে। নয়ত যে অশ্রাব্য ভাষা রতন আজকে শেফালির প্রতি তীরস্বরূপ নিক্ষেপ করেছে, তা যে কেউ শুনলে তার অন্তরটায় বিঁধে নিঃশব্দে রক্ত ঝরাবে- এটা নিশ্চিত। তার চেয়ে এই-ই ত ভালো, সেসব অশ্রাব্য লজ্জা আজ এই বর্ষার ঘনঘটাতেই চাপা পড়ে রইলো। কেউ টেরও পেলো না!

শেফালির মেয়ে দুটি শাশুড়ির কাছে ঘুমিয়েছে। রতনও  না খেয়েই পাশের ঘরে শুয়েছে। আর শেফালি! সে ত নির্বিকার! বোবার মত ঠায় মাটিতে পড়ে আছে।সাড়াশব্দ নেই। দেহে প্রাণের স্পন্দন আছে কি না, সেটা বলাও মুশকিল!

জানি না এভাবে আর কতটা সময় শেফালি পড়ে থাকত। তবে হঠাৎ "ও মা গো" বলে চিৎকার দিয়ে পুরো বিশ্বচরাচরকে জানিয়ে দিলো- তাঁর দেহে এখনও প্রাণ আছে।

রতন চমকে ওঠলো। ওর মা দৌঁড়ে আসলো। প্রতিবেশীরাও আলো নিয়ে পিচ্ছিল কাদা উপেক্ষা করে ছুটে আসলো।

শেফালি মেঝেতে পড়ে কাঁতরাচ্ছে। ওর পুরো শরীরে রক্ত হোলি খেলছে। মেঝেতে রক্তের নালা ছোটেছে। সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে গেলো।

করিম মিয়াকে ডাকা হলো। অটো আসলো। বহু কষ্টে শেফালিকে অটোতে তুললো সবাই। শেফালির গলা ক্ষীণ হলো, "আমি মুক্তি চাই!" সবার চোখ লোনাজলে ভিজে ওঠলো। মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো।

শেফালির মেয়ে দুটি অঝোরে কাঁদছে। ওদের কে বুঝাবে- ওদের মা'র এখনও মুক্তি মেলেনি।

বাদলার রাত। রাস্তার বেহাল দশা।হাসপাতালে পৌঁছুতে বেশ সময় লেগে গেলো।

শেফালি স্তব্ধ! 

শেফালিকে দ্রুত চেকআপ করে ডাক্তার বললো,"বেশ ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন!"

শেফালিকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হলো। বাইরে রতন আর ওর মা নির্বিকার। দেয়াল ঠেস দিয়ে বসে আছে।

অপেক্ষার প্রহর শেষই হয় না।সময় যেন থমকে আছে।

দু' ঘন্টা পরে ডাক্তার বাইরে বের হলো। মুখ গম্ভীর। রতন আর ওর মায়ের প্রশ্নার্ত চাহনি যেন কিছু না বলেই অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়।

ডাক্তার নরম সুরে বললো,"রতন বাবু আপনার ছেলে হয়েছে!"

না, এত খুশির সংবাদটা শুনে কারো মনে কোন খুশির ভাবই দেখা গেলো না। বরং, এখনও যেন তারা আরো কিছু শুনার জন্য কৌতূহলী!

ডাক্তার সুর আরো নরম করলেন।মাথা নিচু করে বললেন,"আই অ্যাম সরি রতনবাবু! আমরা অনেক চেষ্টা করেছি বাচ্চার মা-কে বাঁচাতে। কিন্তু সম্ভব হলো না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ায় তিনি মারা গেছেন।"

রতন আছড়ে পড়লো মাটিতে।ঢুকরে কেঁদে ওঠলো, "শেফালি...!"

রতন কাঁদে কেন! রতনের চাওয়া বংশপ্রদীপ ত শেফালি দিয়েছে।আর শিউলি ফুলের মতো ঠিক সকালবেলায়ই ভবের পালা সাঙ্গ করে, টুপ করে ঝরে পড়েছে।







অখণ্ড অবসর

রু মা না  সো ব হা ন  প রা গ


মেয়ে দুটো যে যার চাকরি আর সংসারে ব‍্যস্ত। তবুও তারা চেষ্টা করে ছুটির দিনগুলোতে  বাচ্চাদের নিয়ে আমার এখানে আসতে। ওদের বাবা আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন দেশে ফেরার কদিন বাদেই। আমাদের আর চুটিয়ে সংসার করা হলোনা। সঙ্গী হারানোর কষ্ট  আমি সামলে উঠেছিলাম। কারণ উনি যতোটা না আমার কাছে ছিলেন তারচেয়েও বেশি ছিলেন মনের কাছে। যেকারণে  আগের মতোই এখনও আমি একা একা নিজেকে সামলে চলতে পারি। ভীষণ সাপোর্টিভ মানুষ ছিলেন। বর্তমান যুগেও এমন উদার, আন্তরিক, মাানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ মেলা ভার।

আমাদের বিয়ে হয় উনিশশো চুরাশি সালে। তখন আমি সবে একাউন্টিং এ মাস্টার্স করে একটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে জুনিয়র একাউন্টস অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি, আর উনি কাতারে 'পাওয়ার সিস্টেম এ‍্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি সেন্টারে 'সিভিল ইঞ্জিনিয়ার' হিসেবে পাঁচ বছর ধরে চাকরি করছিলেন। ওনার সাথে আমার বয়সের গ‍্যাপ ছিল সাত বছরের। আমাদের অ‍্যারেঞ্জ ম‍্যারেজ হয়েছিল। অথচ এতো দারুন বোঝাপড়া ছিল যে উনি কখনই আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি। বছরে দুবার ছুটি পেতেন। প্রতিবার টানা একমাস করে থেকে যেতেন আমাদের কাছে। ওনার অন্য কলিগরা বিভিন্ন দেশে বেড়াতে যেতো এই ছুটি গুলোতে। উনি পরিবারের সাথে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন বলে কখনও কোথাও একলা বেড়াতে যাননি।

উনি কখনোই আমাকে চাকরি ছাড়তে বলেননি। বরং অফিসের কাছাকাছি একটা বাসা ভাড়া করে দিয়েছিলেন আমার যাতায়াতের সুবিধার জন্য। আমাকে সবসময় বলতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছো, এই শিক্ষা যদি কাজেই না লাগে তাহলে মেধা আর সরকারের অর্থ দুটোরই অপচয় হবে, দেবলিনা।আমার ইনকামের একটা টাকাও আমাকে সংসারে খরচ করতে দেননি। সব খরচ একাই বহন করতেন। উনি ভীষন কর্তব‍্যপরায়ন মানুষ ছিলেন।

আমি সব সময় ওনাকে আপনি আপনি করে সম্বোধন করতাম বলে মাঝে মাঝে বলতেন আমি কি তোমার শিক্ষক নাকি অফিসের বস যে আপনি করে বলো! আমি কিন্তু কখনওই আপনি থেকে তুমি তে আসতে পারিনি; এমনকি তার মৃত্যুর  মুহূর্ত পর্যন্ত। আসলে এটা ছিল আমার অভ‍্যাস। আপনি ডাকেও তুমির চাইতে বেশি অধিকার ফলাতাম তার ওপর আমি।

উনি সবসময় বলতেন; তুমি আমাদের মেয়ে দুটোকে তোমার আদর্শে গড়ে তুলবে। তুমিই হবে ওদের রোল মডেল। আমি যতোটা না তোমার রূপে মুগ্ধ হয়েছিলাম তারচেয়েও বেশি মুগ্ধ হয়েছি তোমার ব‍্যক্তিত্বে। আমার মেয়েরা যেন প্রতিদিন সকালে একজন পরিপাটি স্মার্ট মহিলাকে ওদের মা হিসেবে আবিস্কার করে। কখনও অগোছালো থাকবেনা। উনি এগুলো না বললেও আমি যথেষ্ট গোছানো আর পরিপাটিই ছিলাম।

উনি দূরে থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই ল‍্যান্ড ফোনে সব তদারকি করতেন। ফোন ছাড়ার সময় বলতেন, লিনা, আমি আর  কুড়ি বছর কাতারে চাকরি করবো এরপর স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে আমরা দুজনে চুটিয়ে সংসার করবো। আর এর মাঝে তুমি মেয়ে দুটোকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। দেখবে চোখের পলকে এই কুড়িটা বছর পার হয়ে যাবে। আমি কপট রেগে বলতাম গত পাঁচ বছর ধরে কুড়ি বছরই বলছেন আপনার মতলবটা কি শুনি! আমৃত্যু চাকরি করার ইচ্ছে নাকি?

উনি শুধু আমার স্বামীই ছিলেন না; উনি ছিলেন আমার বন্ধু আর অভিভাবকও । কতো কলিগকে বলতে শুনেছি তাদের স্বামীরা তাদের সন্দেহ করে, সাজগোজ করলে বাঁকা চোখে তাকায়। অথচ অরিন্দম  আমাকে ইন্দিরা গান্ধির মতো গেটআপ নিতে বলতেন।  আমার নাক আর চাহনি নাকি ওনার মতো। 

সবচাইতে মজার ব‍্যপার ছিল আমার বাবাও আমাকে ইন্দিরা গান্ধীর আরেক নাম "আয়রন লেডি" বলে ডাকতেন। আমার সম্পর্কে ওদের দুজনারই দৃষ্টিভঙ্গি  একই রকম ছিল। আসলে আমি কখনও  আপোষ করিনি কোনোকিছুর সাথে। 

তবে কর্মক্ষেত্রে টিঁকে থাকার জন্য  আমাকে দাঁতে দাঁত চেপে বৈরী পরিবেশের সাথে আপোষ করে টিঁকে থাকতে হয়েছিল। এটাই ছিল  আমার জীবনের সবচেয়ে কন্টকময় সময়। বহুবার এমন সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম যে আমার মনে হতো  ও রকম পরিস্থিতিতে আমার জায়গায় অন্য কোনো দূর্বল চিত্তের মহিলা থাকলে শ্রেফ রিজাইন দিয়ে ঘরে ফিরে আসতো।  

 একজন মহিলা কর্মকর্তা কমান্ড করবে এটা পুরুষ  এবং নারী সহকর্মী এবং অধস্তনরা মানতে চাইতো না। আমি কাজে মননিবেশ করতে পারতাম না ওদের অসহযোগিতার জন্য ।  সবসময় আমার কাজে বাধা সৃষ্টি করে আমাকে ব‍্যতিব‍্যস্ত করে তুলতো আমার হিংসুটে সহকর্মীরা। তবে সবাই যে এমন অভদ্র ছিল তা কিন্তু না। কিছু গোবেচারা মানুষও ছিল যারা কারও সাতেও নাই পাঁচেও নাই। ওনারা গা বাঁচিয়ে চলতেন সব সময়। ওনাদের আমার মনে হতো মেরুদণ্ডহীন প্রানী।

কিছু পুরুষ সহকর্মীরা তাদের টেবিলের  অর্ধেকের বেশি কাজ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিত। আমি কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতাম অফিসে। নিজের কাজ তো করতাম এমনকি কেউ কোথাও ঠেকে গেলে তাকেও সাহায্য কারার সর্বাত্মক চেষ্টা করতাম। তারপরও  আমাকে একঘরে করে রেখেছিল আমার সহকর্মীরা। কিন্তু কাজের মূল‍্যায়ন তো ঠিকই হয়। তেলবাজি আর পলিটিক‍্যাল পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে  যোগ্যতারও মূল‍্যায়ন হতো আমাদের  অফিসে। যথারীতি বছর শেষে আমার এসিআর ভালো গেল। পরবর্তীতে আমার সহকর্মীদের পিছনে ফেলে আমি সিনিয়র একাউন্টস অফিসারের পদ পেলাম। সেইসাথে বিদেশ ট‍্যুরের জন্য  আমিই মনোনীত হতাম বছর বছর। ভাগ্য ভালো যে আমার বস মহিলা ছিলেন। না হলে নানান কেচ্ছায় ঢি ঢি পরে যেতো অফিসে। নীচু মন মানসিকতায় ঠাসা ছিল আমার সহকর্মীদের মন।

তাদের হিংস্রতার এমন কিছু জঘন্য ঘটনা শেয়ার করবো যা আদৌ বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছিনা। কিন্তু না বলেও পারছি না। আমার বিশ্বাস এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি অনেকেই  হয়েছেন যারা অন‍্যায়ের সাথে আপোষ করেননি; তবে লোকলজ্জার ভয়ে বেশিরভাগ আপোষহীন নারীই তা প্রকাশ‍্যে আনতে সাহস পায়নি। আমার দৃষ্টিতে এটা তাদের দোষ  নয় কারণ সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার খাতিরে জন্মগত ভাবেই আমরা সমস‍্যাগুলোকে কার্পেটের নীচে লুকিয়ে ফেলি সমাধানের চেষ্টা না করে। পাছে লোকে কিছু বলে এই ভয়েই অনেকে মুখ খোলেনা। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি বলবো। আমি বলবো কারণ আমি চাই অনেকেই বলার সাহস পাক কর্মক্ষেত্রে তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া অসম্মানের ঘটনা গুলো বলতে।

আমার প্রমোশনের কিছুদিন পরের ঘটনা বলছি। প্রতিদিনের মতো আমি অফিসের গাড়িতে করে অফিসে পৌঁছানোর পর আমার চেয়ারে বসতে গিয়ে দেখি চেয়ারের সিটের ওপর জঘন্য কিছু আবর্জনা। রাগে ঘৃনায় ডিডি ম‍্যাডামের রুমে গিয়ে সবিস্তারে বললাম। ম‍্যাডাম সব শুনে আমার সাথে আমার রুমে এসে এক নজর চেয়ারের দিকে তাকিয়ে বললেন, "দেবলিনা আপনি হাফ ডে ছুটি চেয়ে ছুটির ফর্মে একটা সই করে বাড়ি চলে যান। আমি এর অ্যাকশন নেবো।

আমি চিৎকার চেঁচামেচি কিচ্ছু করিনি সেদিন । ব‍্যাগটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে এসেছিলাম অফিস থেকে। মাথা কিছুইতে কাজ করছিল না। ঘৃণায় গা রী রী করছিল। খালি ভাবছিলাম আমার সহকর্মীরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত ! শিক্ষা এদের চরিত্রের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি! এরা অন‍্যর সাফল্যকে ধূলিসাৎ করার জন্য, মনোবল ভেঙ্গে দেবার জন্য কতোটা নীচে নামতে পারে যে তৃতীয় শ্রেনীর কর্মচারীদের হাত করে নিজেদের সহকর্মীকে হেনস্থা করার জন্য।

সেদিন আমার বস কনফারেন্স রুমের সবচাইতে ভালো চেয়ারটা আমার টেবিলে সেট করেছিলেন এই বলে যে আমার ব‍্যাকপেইন আছে তাই উনি আমার টেবিলের চেয়ারটা সরিয়ে এটা আমার জন্য বরাদ্দ দিয়েছেন। 

এরপরও আমি সেইসব কুলাঙ্গারদের সাথে একই অফিসে কাজ করেছি। নিজের যোগ্যতায় পাওয়া চাকরি কতিপয় ইতরের ভয়ে ছাড়ার পাত্রি আমি না। পুরুষ ও নারী সহকর্মীদের ব‍্যাঙ্গ বিদ্রুপ উপহাসকে আমি গায়ে মাখিনি কখনও। 

তবে যেবার আমাকে ক্রয় কমিটির একজন সিগনেটরি হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হলো সেবার আমার  উপর নেমে আসলো সবচাইত ভয়ংকর নির্মমতা। আমি দায়িত্ব বুঝে নেবার পর দেখলাম অনিয়মে ঠাসা একটা জায়গা। সব খালি নকল বিল ভাউচারের ডিপো। যা কেনা হয়নি নাই তার জন্যও ভুয়ো বিল সাবমিট হচ্ছে অহরহ । এরা মূল বেতনের চাইতে তিনগুন টাকা তোলে প্রতিমাসে ভুয়ো বিল ভাউচার সাবমিট করে। অফিসটা মনে হচ্ছে  এদের বাপ দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি। 

আমি শক্ত হাতে এই পরিস্থিতি নিজের কন্ট্রোলে নিলাম। আমার কিছু মহিলা সহকর্মী ঠাট্টা বিদ্রূপ করে বলাবলি করতো যে, 'দেবলিনা তো অফিসটাকে নিজের সংসারের মতো আগলে রাখে'। আমি অবশ্য এদের কথা গায়ে মাখিনি কখনও  কারণ  এদের মুখ‍্য উদ্দেশ্য  অন্যর সমালোচনায় কর্মঘন্টার অপচয় করা। এরা আমার চোখে শ্রেফ নীম্ন স্তরের বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন  মানুষ ছাড়া আর কিছুই না ।

একদিন এক রবিবার সকালে ফ্রেশ মুডে কাজে বসেছি। আমার পিয়ন একটা ভাউচার নিয়ে এসে বলল আপা সই করেন।  আমি ভাউচারটা হাতে নিয়ে টাকার অঙ্ক কেটে দিয়ে জিজ্ঞাসা শুরু করবো কেবল তার আগেই সে চিৎকার দিয়ে বলল,"তোর বাপের টাকা দিবি যে এতো কথা জিগাছ?' এরপর সে আমার চুলের মুঠি ধরে ফেলে দিয়ে লাত্থির পর লাত্থি দিল। যে জোড়ে এই জানোয়ারটা চিৎকার করে গালি দিচ্ছিল তাতে অফিসের সবগুলো জানোয়ারের ঘুম ভাঙার কথা। কিন্তু কেউ আসেনি আমার রুমে এই জানোয়ারটাকে ঠেকাতে ।

 যখন কালপ্রিটটা বেড়িয়ে যায় তারপর আমি অনেক কষ্টে উঠে বসতে পেরেছিলাম। এরপর  এক মুহূর্তও দেরি না করে থানায় যাই মামলা করতে। ওসি সাহেব চেয়ার ছেড়ে  উঠে দাঁড়িয়েছিলেন আমার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে। উনি মামলা নেন এবং ওকেও অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে যান। 

আমি ছেড়ে দেবার পাত্রী না; ঐ অবস্থায় আবার অফিসে গিয়েছি। অরিন্দমকে ফোন করে সব জানালাম। 

সে আমাকে এই প্রথম সাহস দেয়ার বদলে বলল, "লিনা যে চাকরি তোমার শান্তি হারাম করে সে চাকরি করার কি দরকার? আর তোমার এতো খবরদারী করারই বা কি আছে? নটা পাঁচটা অফিস করবে, বাড়ি ফিরে মেয়েদের পড়ালেখায় তদারকি করে ভিসিয়ারে অমিতাভ রেখার একটা করে সিনেমা দেখবে। তা না করে কে গাড়ির তেল চুরি করলো, কে ভুয়া ট্রান্সপোর্ট এলাউন্স সাবমিট করলো; কে প্রতিদিন ছুটির আগে অফিস থেকে চলে যাচ্ছে, কে সরকারি দলের কর্মী বলে সুবিধা নিচ্ছে এগুলো নিয়ে ব‍্যতিব‍্যস্ত থাকবে; এখন ফল পেলে তো হাড়ে হাড়ে ! কাল থেকে আর অফিস করার দরকার নেই। মেয়েরা বড় হয়েছে এখন ওদের তোমাকে দরকার বেশি। আমি চাইনা তুমি আর অফিসে যাও। তুমি আমাদের কাছে অনেক মূল্যবান। আজকে যদি তোমার কিছু হতো তাহলে আমার পুরো সংসারটা এলোমেলো হয়ে যেতো। ভগবানের দয়ায় তোমার কোনো ক্ষতি হয়নি এই ঢের।"

ওর এসব কথায় আমি কষ্ট পেয়েছি কিন্তু  মনোবল হারাইনি। এতোবড় অপমান আমাকে সারা জীবনে কেউ করেনি। ঐ একটা দিনই শুধু  আমি রাতভর কেঁদেছিলাম। কিন্তু পরদিন সকালে ঠিক সময়ে অফিসে  হাজির হয়েছি। পুরো অফিসে থমথমে নীরবতা। কেউ আমার সাথে কথা বলছেনা। যেনো পিয়নকে আমি ক্ষমতা বলে থানা হাজতে পাঠিয়েছি। 

বেলা এগারোটার সময় ডিডি ম‍্যাডাম ডেকে পাঠালেন। উনি অনেক সমবেদনা জানালেন। শেষে বললেন এরা ফোর্থ ক্লাস এমপ্লয়ী। এরা চাকরি পায় রাজনৈতিক পরিচয়ে। এদের সাথে সরাসরি কনফ্লিক্টে না জড়ানোই ভালো। এছাড়া এদের হাত অনেক লম্বা; এরা এমপি, মন্ত্রীদের কাছের লোক। এদের ইউনিয়ন অনেক স্ট্রং। আপনি থানায় যাওয়ার আগে একবার আমার সাথে পরামর্শ করতে পারতেন। তাছাড়া এই ঘটনার কোনো আই উইটনেস নাই। এরা পরিকল্পিত ভাবে এই কাজটা করেছে। আপনি মামলায় হেরেও যেতে পারেন।

দুটো মেয়ে নিয়ে একলা থাকেন। ভাই থাকেন বিদেশে। এরা আপনার বা আপনার মেয়েদের যে কোনো ক্ষতি করবেনা তার নিশ্চয়তা কে দেবে? পুলিশ তো জোশের ঠেলায় ওকে ধরে নিয়ে গেছে। ওর পরিচয় জানলে পুলিশ নিজেরই প‍্যান্ট নষ্ট করে ফেলতো।

প্রতিশোধের চাইতে জীবনের মূল্য অনেক বেশি; দেবলিনা। আমি বলি কি ওকে কোর্টে চালান দেবার আগে  আপনি মামলাটা উইথড্র করে ফেলেন। আমি বদমাশটাকে অন্য ডিপার্টমেন্টে পাঠানোর জন্য সুপারিশ করছি। যাতে ওকে আর আমাদের দেখতে না হয়। আপনি আবার আগের মতো অফিস করবেন। আপনার নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব আমাদের।

একদিকে আমার ইগো আরেকদিকে আমার বাচ্চা দুটো মেয়ের চেহারা চোখে ভাসছে । আমি ভয়ংকর এক মানসিক চাপে পড়লাম। এতোবড় একটা শারীরিক মানসিক নির্যাতন হলো আমার উপর যা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। বারবার মনে হচ্ছে আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো। একই সাথে চরম নিরাপত্তাহীনতায়  ভুগছিলাম। যেখানে  আমার মতো একজন কর্মকর্তা  এতোগুলো সুশিক্ষিত মানুষের সামনে শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয় সেখানে এই দুটি কন‍্যা শিশু যদি আবার আমার প্রতিশোধপরায়ণতার বলি হয়! ম‍্যাডামের কথাগুলো মানতেও পারছিলাম না আবার ফেলতেও পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম ম‍্যাডামের উপর চাপ এসেছে ওপর মহলের।

সেদিন আমি আমার চারপাশে কাউকে পাইনি এমনকি অরিন্দমকেও।  আমার মহিলা কলিগরা একবারও সমবেদনা জানাতে আসেনি । বেলা তিনটার দিকে ডিডি ম‍্যাডাম আমার রুমে এসে বললেন, লিনা চলেন আমরা থানায় যাই। আমি কথা দিচ্ছি  ওকে দিয়ে আপনার পা ধরে মাফ চাওয়াবো। আমি উত্তরে শুধু বলেছিলাম আপা প্লিজ আমি আর ওর মুখোমুখি হতে চাই না সেরকম ব‍্যাবস্থা করেন। আপা শক্ত করে আমার হাতটা ধরেছিলেন; বুঝেছিলাম এটা ওনারও পরাজয়।

সেদিন আমার সবচাইতে বড় মাশুল দিতে হয়েছিল একজন মা হিসেবে। মেয়ে দুইটা না থাকলে আমি জানের পরোয়া করতাম না। ওর শাস্তি দিয়েই ছাড়তাম। কিন্তু আমি মামলা উইথড্র করে  নিতে বাধ্য হলাম মেয়ে দুটোর কথা ভেবে।

 সেই অপমানের গ্লানি এখনোও আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে । তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভুগি।  অরিন্দমকে মনে মনে ধিক্কার দেই সেদিনের বিরুদ্ধ আচরণ  আর সাপোর্ট না করার জন্য। আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনা এই ভেবে যে আমি কেন সেদিন  মামলা উইথড্র করেছিলাম । আমিতো অন‍্যায়ের সাথে আপোষ করে অন‍্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছিলাম সেদিন। অখন্ড অবসরে আমি একটা কথাই ভাবি সততার বলিদান কি এভাবে দিতে হয় একজন আপোষহীন সুশিক্ষিত নারীকে!







যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই
  
মি ঠু ন  মু খা র্জী


জয় থাকতেন ইউক্রেনের কিয়েভে। ডাক্তারি পড়ার জন্য ভারত ছেড়েছিলেন তিন বছর আগে। স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি আজ তার এমন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হবে। পূর্ব ইউরোপের দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ ইউক্রেনে দুচোখে স্বপ্ন নিয়ে হাজার হাজার ভারতীয়রা ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তাদের বাঁচা-মরার লড়াই। নিজেদের ইগোর লড়াই চলছে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার বড়ই অভাব। তারা যুদ্ধ চায় না, চায় শান্তি।

এই মহাযুদ্ধের সময় নিজের প্রাণ বাঁচাতে জয় আশ্রয় নিয়েছিলেন বাংকারের মধ্যে। হাজার হাজার মানুষের থাকার একমাত্র ভরসার স্থল‌। কলকাতায় মাঝে মাঝে ফোনে পাচ্ছিলেন না বাবা-মাকে। মনের কোণে মৃত্যুভয় আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল। খাবার ও খাবার জলও ফুরিয়ে এসেছিল তার।

যুদ্ধ কবে থামবে তা কারো জানা নেই। যুদ্ধ নয় শান্তির পক্ষে রায় দিয়েছে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ। সেখানে নিজেদের সামরিক শক্তির পরীক্ষায় নেমেছে রাশিয়া। ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়া নিয়ে তাদের এই বিবাদ। কেউ কাউকে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করে যুদ্ধে নেমে গেছেন দেশকে রক্ষার জন্য। বন্দুক হাতে লড়াই করতে এগিয়ে এসেছেন সাধারণ মানুষ‌। মানবিকতার চরম লাঞ্চনা চলছে এখানে। ২রা মার্চ রাষ্ট্রপতি ভবনের সন্নিকটে খাবার ও জল কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন জয়‌। হঠাৎ করে রাশিয়ার সেনাদের ছোড়া মিসাইল এসে পড়ে সেখানে। একটা বিকট আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে বিশাল বিস্ফোরন। মুহুর্তের মধ্যে জায়গাটা শ্মশানে পরিণত হয়। তরতাজা বেশ কয়েকটা প্রাণ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তাদের মধ্যেই চির নিদ্রায় ঢলে পড়ে ডাক্তার পড়ুয়া জয়। বাবা-মার সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্বপ্ন মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে খান খান হয়ে যায়। আর বাড়ি ফেরা হলনা তার। বন্ধুরা বেশ দূর থেকে সমস্ত ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করেছিল। আবেশের বাড়ি মহারাষ্ট্রে। কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সে। ভেবেছিল তারও মনে হয় বাড়ি ফেরা হবেনা। বিকেলে হঠাৎ ভারত সরকারের বিদেশমন্ত্রকের থেকে ফোনে মেসেজ আসে--- 'বিকেল পাঁচটার মধ্যে কিয়েভ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী পোল্যান্ড, হ্যাঙ্গেরী ও রোমানিয়া বর্ডারের  মধ্যে যেকোনো একটি জায়গায় আসার কথা।" এও বলে দেয়-- 'যদি কোন বাস বা গাড়ি না পায়, তবে পায়ে হেঁটে যেন সেখানে পৌঁছানো হয়।' আবেশ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বাসে করে পাঁচটার আগে হাঙ্গেরির বর্ডারে এসে উপস্থিত হন। সেখান থেকে সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ ভারতের সামরিক টিম তাদের উদ্ধার করে। ভারত সরকারের এই প্রশংসনীয় কাজে আবেশের প্রাণ বেঁচে যায়। পরদিন ভোরে তারা দিল্লীর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছোয়। প্রত্যেক ভারতীয়র চোখে-মুখে তখনও আতঙ্কের ছাপ লক্ষ করা গিয়েছিল। মার্চের তিন তারিখে আবেশ দিল্লি থেকে মুম্বাইয়ের ফ্লাইট ধরে মহারাষ্ট্রে পৌঁছোন। তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মিডিয়ার সামনে তিনি তুলে ধরেন। তিনি জানান--- "ইউক্রেনের সেনারা ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের উপর অকথ্য অত্যাচার করছে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে তারা ঢুকতে দিচ্ছেনা। লাথি মারছে, ঠেলে ফেলে দিচ্ছে, এমনকি মেরে ফেলার ভয় দেখাচ্ছে। আমি তো ভেবেছিলাম, আমার হয়তো বাড়ি ফেরা হবেনা। তবে ভারত সরকার যেভাবে 'মিশন গঙ্গা' চালাচ্ছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। শুধু আমি নই, আমার মত প্রায় চোদ্দ-পনের হাজার ভারতীয় এখনো পর্যন্ত দেশে পৌঁছেছে---তারা প্রত্যেকেই খুব ক্লান্ত, মৃত্যুকে খুব সামনে থেকে দেখেছে। প্রত্যেককে জীবন দান করেছে সরকার। আমরা সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ।"

আবেশকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে এসেছিল বাবা, দিদি ও জামাইবাবু। এয়ারপোর্টে প্রথম তাকে দেখে তার দিদি দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। অনবরত চোখ দিয়ে জল ঝরে তার। বাবাও কাঁদছে তাকে দেখে। তাদের কাঁদতে দেখে আবেশ চোখের জল চেপে রাখতে পারেননি। তিনিও কেঁদে দেন। আনন্দ যেমন তার মুখে লক্ষ্য করা গিয়েছিল, তেমনি ছিল একরাশ হতাশা ও আতঙ্ক। প্রাণ হাতে নিয়ে একপ্রকার জন্মভূমিতে ফিরেছেন তিনি। গাড়ি করে বাড়িতে ফিরে আবেশ অবাক হয়ে যান। পাড়ার সমস্ত মানুষ যেন তাদের বাড়িতে। তার তৎক্ষণাৎ নিজের জীবনটাকে অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। তার মা চোখের জলে মালা পরিয়ে ছেলেকে বরণ করে ঘরে তোলেন। দেখে মনে হয়, ছেলে যেন যুদ্ধ জয় করে বাড়িতে ফিরেছে।

আবেশ বাড়ি ফিরেও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বন্ধু জয়ের মুখ ও বিস্ফোরণের দৃশ্য। জয়ের বাড়িতে আবেশ ফোন করেছিলেন কিন্তু কেউ ফোন তোলেনি। নিউজে দেখেছেন ভারত সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জয়ের মৃতদেহ দেশে ফিরে ছিল। তার বাড়ি নিউ দিল্লি।  ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন সেখানে পৌঁছোয়, তখনকার দৃশ্য ভোলার নয়। "জয়ের মা তীব্র চিৎকারের সাথে সাথে মাঝেমাঝেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। বাবা বুক চাপড়ে কাঁদছিল। বোন জয়ের মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে কান্না করছিল। পাড়ার সমস্ত মানুষ তাদের বাড়িতে। সকলের চোখে জল। আধা ঘন্টার মতো সেখানে তার মৃতদেহ রাখেন ভারতীয় সেনারা। তারপর শ্মশানে নিয়ে গিয়ে শেষকৃত্য সম্পন্ন করে।"

বন্ধুর বাড়ির প্রিয়জনদের এই অবস্থা দেখে আবেশের চোখে জল এসেছিল। মাকে বলেছিলেন--- "মা, জয়ের মৃত্যু আমি মন থেকে মেনে নিতে পারছিনা। ওর মতো মানুষ হয় না মা। আমার যেকোনো সমস্যায় ও সব সময় আমার পাশে থেকেছে। আমার ওর পরিবারের পাশে থাকার খুব প্রয়োজন। কোনদিন সুযোগ পেলে ওর ঋণ আমি শোধ করে দেবো মা।" এই কথাগুলো বলতে বলতে আবেশ বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আবেশের মায়ের চোখে জল দেখা গেল। এই আবেগঘন মুহূর্তে ছেলেকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

রাশিয়া-ইউক্রেনের এই যুদ্ধকে আবেশ কখনো সমর্থন করেন না। ভারত যতই রাশিয়ার মিত্রদেশ হোক, সে চায় এই যুদ্ধ বন্ধ হোক‌। হাজার হাজার নিষ্পাপ মানুষের বিনা কারণে এই মৃত্যু চোখে দেখা যায় না। যার মধ্যে আছে আবালবৃদ্ধবনিতা। সে চায় জয়ের মতো আর কোনো মায়ের কোল এভাবে ফাঁকা যেন না হয়ে যায়। রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে মানবিকতার এইভাবে অপমৃত্যু সে মেনে নিতে পারেন না। সে শান্তির পক্ষে। রাশিয়ার মানুষ সহ সমগ্র পৃথিবীর সচেতন মানুষ শান্তি স্থাপনের পক্ষে, যুদ্ধের পক্ষে নয়। একে তো করোনার করাল থাবায় সমগ্র পৃথিবী মুহ্যমান, এখনো প্রতিনিয়ত আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে অনেক দেশের মানুষ। তার মধ্যে এই যুদ্ধ গোদের ওপর বিষফোঁড়া স্বরূপ। এরইমধ্যে আবেশের মতো অসংখ্য ইউক্রেনের যুবক-যুবতীরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রচণ্ড চিন্তিত। এই যুদ্ধ তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্নকে ভেঙে খানখান করে দিয়েছে।







কান্নারও শেষ আছে

অ র ণ্যা নী


শুভমিতার যে বয়স বাড়ছে, ধীরে ধীরে ক্রমশ তিনি তা টের পেতে থাকলেন। চেহারায় নয়, মনের বয়স। মেয়েরা এতদিন সব সময় মাকে ঘিরে থাকত। সবকিছুতেই তাদের মাকে প্রয়োজন হতো। এমনকি খেলাতেও। আর দুই মেয়ের সঙ্গে খেলতে খেলতে তাদের বন্ধু হয়ে গিয়ে শুভমিতা কৈশোরে ফিরে গিয়েছিলেন। এখন মেয়েরা তার বড় হচ্ছে। খেলার বয়সও তাদের নেই। সেছাড়া বাইরের জগৎ থেকে বন্ধু পাচ্ছে তারা। মাকে এখন আর আগের মতো প্রয়োজন হয় না তাদের। আর তার থেকেই শুভমিতার মনে একাকীত্ব জন্ম নিয়েছে কখন। তাই তার মনের বয়স হঠাৎ করে অনেকটা বেড়ে গেছে।

সব সময় একটা একাকীত্ব বোধ শুভমিতাকে যেন তাড়া করে বেড়ায়। স্বামীও যেন অমনোযোগী তার প্রতি। ভীষণ একটা মানসিক কষ্টে ভুগতে থাকেন শুভমিতা। দীর্ঘ বেশ কিছু বছর পর হঠাৎ তার দু'চোখ ভরে জল আসতে থাকে! কোন স্বর্গে তিনি বাস করতেন যে এতদিনের মধ্যে একবারও কাঁদেননি? ছুটির দিন। মেয়েরা বাড়িতে। স্বামী চিরকালই একটু বহির্মুখী। কোথাও কোনো আড্ডায় গেছেন। মেয়েরা নিজেদের ঘরে বসে কেউ গান শুনছে, কেউ বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছে। শুভমিতাকে কেউ ডাকছে না। সকালের রান্নাবান্না কাজকর্ম সেরে এই অবসর তার মেয়েদের সঙ্গে কাটত। মেয়েরা স্কুলে গেলে তাদের খেলনা পুতুল সাজিয়ে রেখে শুভমিতা অপেক্ষা করতেন।

চোখ থেকে জল পড়তে থাকলে ধীরে ধীরে শুভমিতা ড্রয়িংরুম থেকে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। নিজের অসহায়তা প্রকাশ করতে চান না তিনি। কারণ এটা অন্যায্য দাবি তার। বাথরুমের বেসিনে চোখের জল ধুতে গিয়ে হঠাৎ নীরব কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সেই কান্নার যেন কোনও শেষ নেই। চোখের জল বেরিয়েই চলেছে। দীর্ঘ সময় ধরে শুভমিতা প্রতীক্ষা করতে থাকলেন কান্না থামার জন্য। অনেক অশ্রু দু'চোখ থেকে দীর্ঘক্ষণ ধরে নির্গত হওয়ার পর এক সময় শুভমিতার কান্না থামল। কোথাও যেন একটু স্বস্তি বোধ করলেন তিনি। চোখে মুখে জল দিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে, গামছায় মুখ চোখ মুছে ড্রয়িংরুমের সোফার উপর উদাসীন ভাবে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। না, দুঃখ বোধ বা কোন কিছু বোধই যেন তার কাজ করছে না। তবে ভেতর থেকে একটা প্রশান্তি অনুভব করছেন তিনি। এমন অনুভূতিটা খুব অচেনা শুভমিতার কাছে।

একটু পর ড্রয়িংরুমের জানলার দিকে চোখ যেতে একটি অশত্থ গাছকে দেখতে পেলেন। বসন্তের হাওয়ায় দোল খাচ্ছে তার ডালপালাগুলি। চোখে পড়ল দুটি লাল ঝুঁটি কাঠঠোকরা ওই অশথ গাছের ডালে ঠোঁট ঠুকে ঠক ঠক করে শব্দ করছে। দীর্ঘদিন পর বোধহয় এভাবে তিনি দেখছেন গাছটিকে। সবুজ পাতার ফাঁকে দুটি চঞ্চল হলুদ পাখি খেলে বেড়াচ্ছে। দৃষ্টি যাচ্ছে বিশাল গাছটির বিভিন্ন অংশে। ধীরে ধীরে দুটি থেকে চারটি হলুদ পাখি। আরে, কোলকাতা শহরে আবার পাখি আছে নাকি? কোনদিনই তো লক্ষ্য করে দেখেননি তিনি! আরো বিস্মিত হলেন দুটি কাঠবিড়ালিকে গাছের ডাল বেয়ে উঠতে দেখে। শুভমিতার দৃষ্টি আরও দূরে, অশত্থ গাছ ছাড়িয়ে একটি নিম গাছের দিকে গেল। সেখানে অনেক রঙে রঙিন পাখিটিকে দীর্ঘকাল পর দেখে চিনলেন, এ তো মাছরাঙা! এরাও থাকে এখানে? ধীরে ধীরে দৃষ্টি গেল আকাশের দিকে। রোদ ঝলমল দুপুরের নীল ঘন নীল আকাশের এক কোণে কিছুটা সাদা মেঘ হাওয়ায় উড়ছে। হঠাৎ সবকিছুর মধ্যে শুভমিতা যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছেন আজ। এক বাড়ির ছাদ থেকে পায়রার ঝাঁক অন্য বাড়ির আলসেতে উড়ে গিয়ে বসল। মুক্ত এ বিশাল পৃথিবীর সঙ্গে এক করে নিজেকে জীবনে প্রথম অনুভব করলেন শুভমিতা। তখনই হঠাৎ একে একে কত গানের প্রথম দু কলি মনে আসতে থাকল। কিন্তু কেন? এই গানগুলি তো কোনদিনই মনোযোগ দিয়ে না শোনার জন্য পরের লাইনগুলো মনেও পড়ছে না। ঘরে এসে গীতবিতান খুলে গানগুলির পরের অংশে কী আছে খুঁজতে লাগলেন। খুঁজলেন "ও তার অন্ত নাই গো যে আনন্দে ভরা আমার অঙ্গ", "মহাবিশ্বে মহাকাশে", "কবে আমি বাহির হলেম" ইত্যাদি কিছু রবীন্দ্র সঙ্গীত। পুরো গানের বাণী পড়ে বিস্মিত হয়ে শুভমিতা ভাবতে লাগলেন, এভাবে কী করে তার অনুভূতির সঙ্গে গানের কথাগুলো মিলে যাচ্ছে! তিনি তো কোনদিনই এই সকল গানগুলো খুব একটা পছন্দ করতেন না। তবে গানগুলোর প্রথম লাইন মনে এলো কী করে? অবচেতন মন কি এতই অজান্তে তার কাজ করে চলে?

কোথায় দুঃখ, কিসের কষ্ট, কিছু আর মনে আসে না। অন্যমনস্কভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে চারিদিকে যেন কোন নতুন অজানা আনন্দের স্বাদ পান শুভমিতা। মেয়েদের বন্ধু কখন চলে গেছে। স্বামী কখন বাড়ি ফিরে এসেছেন, কিছুই খেয়াল করে উঠতে পারেননি তিনি এতক্ষণ। শুধু বড় মেয়ে কাছে এসে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, "মা, তুমি ওদিকে কী দেখছ?" শুভমিতা মেয়েদের দেখাতে লাগলেন অশথ গাছের ডালে বসে থাকা পাখি, নীল আকাশ। মেয়েরাও বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। 

এরপর থেকে রোজই কাজকর্মের শেষে শুভমিতা ড্রয়িংরুমের জানলা খুলে বাইরে চেয়ে থাকেন। কোথা দিয়ে যে তার সময় কেটে যায় তা টেরই পান না। একাকীত্ব বোধ তাকে আর কষ্ট দেয় না। বরং নতুন একটা জগতের সন্ধান দেয়। আবার শুভমিতা আগের মতোই হাসি খুশি। একাকীত্বকে অনুভব করার পর এখন সব সময় একাও তিনি কাটান না আর। আবার আগের মতো মানুষ জনের সঙ্গে কথা বলতেও ভালো লাগে। মেয়েদের সঙ্গে গল্প করেও সময় কাটান। স্বামীর সঙ্গেও কখন যেন আবারও আগের মতো নাহলেও কোন এক নতুন সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে ধীরে ধীরে। শুভমিতার স্বামীও যেন নতুন কোন এক শুভমিতাকে আবিষ্কার করেন। মেয়েরা পায় অন্য নতুন এক বন্ধু মাকে।







কিন্নরী 

র ত্না দা স


শৈলশিখরের মনে পড়ে যাচ্ছে সেইদিনের কথা, যেইদিন একরাশ রাগ ও ঘেন্নার সাথে কমলিনীর মুখের ওপরে বলে উঠেছিলেন, তুমি কিন্নরী! ছিঃ...
কমলিনীর মুখটা থরথর করে কাঁপছিল, চোখ ভেসে যাচ্ছিল কিন্তু কোনো কথা ছিল না।

তীব্র আগুনের হল্কা ছিটকে বেরোচ্ছিল শৈলশিখরের গলা থেকে, কমলিনী পুড়ে যাচ্ছিল।কেন তুমি প্রথম দিনেই আমাকে তোমার আসল সত্যিটা বলোনি, তবে তো আমাদের রিলেশনটা এতদূর গড়াতো না! কাঁপা কাঁপা গলায় কমলিনী বলেছিল, তোমার চোখে ভালোবাসার ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম তাই সাহস হয়নি। ভেবেছিলাম আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে ঠিক বাঁধতে পারব।

ভালোবাসা কী শুধু মন ধুয়ে জল খায়, আর অন্যকিছুর প্রয়োজন হয় না! দুজন সমকামীও তো একসাথে ঘর বাঁধে কোনোমতে বলে কমলিনী। গে পার্টনার ব্যাপারটা আলাদা কিন্তু হিজড়ে! চাবুকের বাড়ি পড়ে যেন কমলিনীর পিঠে! ছোট থেকেই একথা শুনে শুনে কানে জ্বালা ধরে গেছে।

কিন্তু এতে তো ওর কোনও হাত ছিল না। আর মন তো শেকলে বাঁধা নয়, সে তো কাউকে বাঁধতে চাইতেই পারে। সে অধিকারও কী থাকতে নেই! চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গিয়েছিল কমলিনী।

চুপচাপ রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শৈলশিখর। আজ মনে হচ্ছে, অত কঠিন না হলে কী চলছিল না! আজও তো সে কাউকে পায়নি অমন আপন করে ভালোবাসার জন। কতজন মা হতে পারে না, কারও ইরেক্টাইল ডিসফাংশন থাকে তবে! দুটো জীবন শুধু ভালোবাসায় কী বাঁচতে পারে না! কাঁচাপাকা চুলগুলো উড়ছে শৈলশিখরের সাথে উড়ছে ভাবনা।

"দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না, সেই যে আমার নানারঙের দিনগুলি"...





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪