অণুগল্প
রাখে হরি, মারে কে
শ্যা ম লী ব্যা না র্জী
গাঁয়ের নামটি বড় সুন্দর, বড় মায়াময়। সোনাঝুরি। গাঁয়ের পাশ দিয়ে কুলু কুলু শব্দে বয়ে চলেছে সুবর্ণলতা নদী। যেমন মিষ্টি তেমন পরিষ্কার তার জল। ঘাটের পথের দুধারে কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি। গুচ্ছ গুচ্ছ লাল ফুলে পথটি ছেয়ে থাকে। বসন্ত সমাগমে গ্রামের পথে প্রান্তর হলুদ সূর্য্যমুখী ফুলে ভরে আছে। ঘাটে সেদিন বিকালে গা ধুতে এসে অভিরাম গয়লার স্ত্রী বিমলা বামুনবৌ সরলাকে ডেকে বলে--- "শুনেছ বামুন দিদি? চোত মাসের শেষে গাঁয়ের সবাই বীরভূমের চড়কের মেলায় যাচ্ছে যে"। কথাটা নিয়ে ঘাটের মেয়েবউদের মধ্যে কানাকানি পড়ে গেল। জানা গেল গাঁয়ের পুরুষ জনাদশেক নাকি সেখানে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছে। সে দলে ঘরের মেয়েবউদের যাবার সম্ভাবনা নেই। কথাটা শুনে একেকজন একেকটি মন্তব্য করতে লাগল।যেমন "মেয়েমানুষের তো সাধ আহ্লাদ থাকতে নেই। তারা কেবল বিয়োবে আর ঘর সামলাবে"। বড় দুঃখে টিপ্পনি কাটে কামার বউ। আসলে নিস্তরঙ্গ গ্রাম্য জীবনে মেলা ইত্যাদির আকর্ষণ সকলকেই টানে। চৈত্রমাসের শেষ রবিবার যাত্রার দিনস্থির হল। নয় জনের দলটিতে গ্রামের প্রবীণ
জ্যোতিষী নিতাই খুড়ো নেতৃত্ব
দেবেন। দলে সর্বকনিষ্ঠ হল
পিতৃমাতৃহীন চোদ্দ বছরের অভি। অনাথ ছেলেটি তার দূরসম্পর্কের মামা বলাইয়ের বাড়ি থাকে। বলাইকে চাষের কাজে সাহায্য করে। বলাইয়ের বউ অভির সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করে। অধিকাংশ দিন অভির ভাত জোটে না। গাছের ফল পাকুড় খেয়ে পেট ভরাতে হয়। অভি দলের সকলের মালপত্র পেটভাতায় বহন করবে এই কড়ারে সকলে তাকে সঙ্গে নিতে রাজি হল। শুভদিন দেখে চাল চিঁড়ে বেঁধে পায়ে হেঁটে রওনা হল সকলে। দুপুর নাগাদ সামনে পড়ল বিশাল তেপান্তরের মাঠ। মাঠের শেষে ইস্টিশান। সেখান থেকে ট্রেনে দুঘন্টার পথ বীরভূম।। চৈত্রমাসের চাঁদি ফাটা রোদে মাঠের মাঝামাঝি আসতেই জিভ বেরিয়ে গেল সকলের। অভির অবস্থা আরও কাহিল। মাথায়, পিঠে সকলের মালের বোঝা নিয়ে গলগল করে ঘামতে ঘামতে মাটিতে শুয়ে পড়ে আর কি। হঠাৎ সামনে একটা খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘর দেখতে পেয়ে সকলে সেখানেই আশ্রয় নিল। কালু ময়রা গায়ের জামা খুলে হাওয়া খেতে খেতে বললো " আঃ! এখানে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেওয়া যাক।
সকলের সম্মতিতে সেখানেই সাময়িক বিশ্রামের ব্যবস্থা হল।
কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশ কালো হয়ে ঘন ঘন মেঘের গর্জন ও বজ্রপাতের আওয়াজ শোনা গেল। কেউ কেউ অবাক হল "অসময়ে কালবৈশাখী নাকি"। প্রবল বর্ষণ আর কড়কড় করে বাজের শব্দ। কুঁড়েঘরটির মাথার ওপর যেন বজ্র পড়িপড়ি করছে। সকলের মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল। জ্যোতিষী নিতাই কর গুনে বলল এই কুঁড়ের কোনো একজনের বজ্রপাতে মৃত্যু যোগ আছে। একজনের দোষে তো সবাই মরতে পারে না। তাই একজন একজন করে ঘরের বাইরে যেতে হবে। তাহলে যার মৃত্যুযোগ আছে সে ছাড়া বাকিরা বেঁচে যাবে। মৃত্যুভয়ে কেউ বাইরে যেতে চাইছিল না। কিন্তু অন্যান্যদের তাড়ায় সকলেই রাজি হল। এক এক করে আটজন বাইরে গেল কিন্তু কেউ বজ্রপাতে মরল না। কিন্তু কুঁড়েঘরের মাথায় তখনো বজ্র পড়ি পড়ি করছে। এবার সকলে অভির দিকে তাকিয়ে বলল "এবার তোর পালা"। অভি মৃত্যুভয়ে
কাঁপতে কাঁপতে বলল সে কিছুতেই ঘরের বাইরে যাবে না। বাকি সবাইয়ের মুখ তখন
প্রাণের ভয়ে ভ্রূকুটি কুটিল হয়ে উঠেছে। ভানু কামার বলল "ব্যাটা এমনি যেতে না চায় ওকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দিচ্ছি।" নিতাই খুড়ো বলল "মগের মুল্লুক নাকি!! ওর একার জন্য বাকি সবাই মরবে?" ভীত, সন্ত্রস্ত
ক্রন্দনরত অভিকে বাকি সবাই
জোর করে ঘরের বাইরে ঠেলে বার করে দিল। পর মুহূর্তে প্রচণ্ড শব্দে কুঁড়ে ঘরের উপরে বজ্রপাত হল। মূর্খ গ্রামবাসীরা বুঝতে পারেনি যে অভি এতক্ষণ ওই
কুঁড়ে ঘরটিতে ছিল বলেই তারা সবাই জীবিত ছিল। অভি ছাড়া সেদিন বাকি আটজনের বজ্রপাতে মৃত্যুযোগ ছিল।
মাতৃরূপেন সংস্থিতা
মৌ সু মী পা ল
সপ্তমীর সন্ধ্যায় বাড়তি চমক প্রজাপতি। উঠতি খ্যাতনামা রক গায়িকা। শরীরে নেশা ঝলমলে উন্মাদনা। রোশনাই মঞ্চে গমাগম মিউজিক। নেশায় বুঁদ ভক্তের দল। মা এসেছেন অসুর বধ করে মর্তধামে। যুদ্ধং দেহি!
মাতৃরূপেন সংস্থিতা !
গোঁয়াচ্ছে মাতলি বুড়ি । তার গায়ের উপর হুড়মুড়িয়ে পড়েছে কতক। ছুঁচোলো জুতোয় চামড়া ছিঁড়ে অনর্গল রক্ত গড়াচ্ছে। গান গাইছে প্রজাপতি---
" অসুর মেরে রক্ত খাবো মা---
অস্ত্র দে ! অস্ত্র দে "...।।
অকাল বোধন
কা বে রী রা য় চৌ ধু রী
বাল্মীকি রামায়ণে দুর্গোৎসব বসন্ত কালে অনুষ্ঠিত হতো। বাঙালি কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাবণকে পরাস্ত করতে না পারায় রামচন্দ্র যখন উদ্ভিগ্ন, সেইসময় দেবশ্রেষ্ঠের পরামর্শে শরৎকালে শারদীয়া পূজোর প্রচলন। রাবণ পার্বতীর বরপুত্র, দেবী চন্ডীকে সন্তুষ্ট করার জন্যই দুর্গতিনাশিনী দুর্গা পুজো বাঙালির কাছে পূজিত।
সুনয়নীর এক পুত্র ও কন্যা সন্তান। পুত্র ও কন্যা উভয়কেই সমান ভাবে মানুষ করতে বদ্ধপরিকর। সমাজের চারিদিকে যা দিকভ্রান্ত অবস্থা, এরমধ্যে সৎপথের দিক নির্নয় বাবা মায়ের দায়িত্ব।
সামনেই শারদীয়া ষষ্ঠী থেকে ছেলেমেয়ের ঠাকুর দেখার বায়না। ছেলে নবম শ্রেণীতে পড়ে, বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যেতে চাইছে, মায়ের চোখ রাঙানি- তোমার সব বন্ধুদের এখনও তুমি বাইরে থেকে বুঝতে পারবে না, আগে ভাল মন্দের বিচার বুদ্ধি আসুক তখন আর বাধা দেবো না। মেয়ে ক্লাস সেভেনের ছাত্রী চেহারায় অলক্ষ্যে সৌন্দর্যের রূপটান, লাবণ্যে ভরে উঠেছে দেহতনু।
বয়োঃসন্ধির এই সময়টা সঠিক ভাবে সামলাতে পারলে নিজেদের মধ্যে বোঝার ভাব আসবে, নিজেকে রক্ষা করার কৌশল আয়ত্ত হবে। নিজের জীবনের ছবি ভেসে উঠল অতীতের আয়নায়, মা বাবা গুরুত্বপূর্ণ কাজে একদিন বাইরে যেতে হয়েছিল, পরিচিত পড়শি এক দাদা খোঁজখবরের বাহানায় ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে, নিজের উপস্থিতি বুদ্ধির দৌলতে মা কালীর খড়্গটা হাতে নিয়ে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিল।
অকাল বোধন শুধু শারদীয়া দুর্গা পুজোর ক্ষেত্রে নয়, যাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শৈশব থেকে শিশুদের ঘুম ভাঙানোর সচেতনতা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বর্তমান সামাজিক ভয়াবহ পরিস্থিতির মোকাবিলায়। মেয়েরা দশভূজা দুর্গারূপিনী আর ছেলেরা বিষ্ণু রূপে নর নারায়ণ হয়ে সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে চেতনার জাগরণে সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন সার্থক হয়ে উঠুক।।
বিসর্জন থেকে বোধন
সু মি তা চৌ ধু রী
আদিম রিপুর উল্লাসের হিংস্রতায় বাধা দিতে গিয়ে মুন্নিমাসির ঠেকের প্রায় হাফ ডজন মেয়ে গুলিবিদ্ধ। উন্মত্ত খরিদ্দাররা যখন এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ছিল, তখন তাদের আটকাতে গিয়ে মুন্নিমাসির ঠেকের পাহারাদার তথা নিজের দুই ছেলেও নিদারুণভাবে জখম হয়েছে। কাছে-দূরে বিসর্জনের ঢাকের বোলে যেন, মুন্নিমাসিদের জীবনেরও বিসর্জনের বোল উঠেছে।
অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় সবার জখমে ঠিকঠাক বাঁধন দিতে দিতেই, এখানের পরিচিত ডাক্তারকে ফোন করল লছমি। মুন্নিমাসি যদিও ততোক্ষণে নিজের হুঁশ খুইয়েছে সর্বোপরি নিজের দুই ছেলের শোকে। এক লহমায় তার সাজানো বাগান, সাজানো পসার শ্মশানে পরিণত হবে, এ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি মুন্নিমাসি।
আধঘণ্টার মধ্যে ডাক্তারের পরামর্শে যখন লছমি সবাইকে নিয়ে কোনোমতে দুটো ভ্যানে চাপিয়ে সেই ডাক্তারের নিজস্ব নার্সিংহোমে নিয়ে গেল, তখন প্রায় মাঝরাত। বেশিরভাগ নার্সই ছুটিতে। এতোজনকে এরকম রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে ডাক্তার অনিরুদ্ধ কর নিজেই দিশেহারা। যা দু-একজন নার্স ছিলেন ডিউটিতে, তাঁরাও শঙ্কিত। ঠিক সেই সময় লছমি বলে উঠল, "ডাক্তারবাবু, দেরী হয়ে যাচ্ছে। যা বলবেন, আমি একাই সব পারবো, তাড়াতাড়ি করুন আপনারা। সময় নষ্ট করবেন না।" ডাক্তারের যেন হুঁশ ফিরল লছমির কথায়।
তারপর কোথা দিয়ে গোটা একটা দিন কেটে গেল, কেউ বোঝার ফুরসৎ পেল না। পাঁচটা মেয়েকে নিয়ে মুন্নিমাসি আজ তার আস্তানায় ফিরেছে। কিন্তু তার ছেলেরা এখনো নার্সিংহোমেই আছে, বিশেষত লছমির তত্ত্বাবধানে। তাদের একটু সুস্থ হয়ে ফিরতে আরো দিন-দুয়েক লাগবে, ডাক্তারের কথায়।
ডাক্তার অনিরুদ্ধ কর শুধু নয়, মুন্নিমাসিরা সকলেই অবাক হয়ে গেছে লছমির সেবায়, তৎপরতায়, উপস্থিত বুদ্ধিতে। আজ মুন্নিমাসি যখন ছেলেদের নিতে এসে ডাক্তারের নার্সিংহোমের খরচাপাতি মেটাতে চাইল, তখন অনিরুদ্ধ বললেন, "টাকার অঙ্কে এর হিসেব হবে না মাসি। আমি লছমিকে চাই, আমার নার্সিংহোমের নার্স হিসেবে। ও, ওর বাবার কাছ থেকে অর্ধেক শিখেছিল, বাকি পাঠ, পড়াশুনা আমি করাবো ওকে, মেয়ে হিসেবে দত্তক নিয়ে। তারপর ও ওর মনের ইচ্ছে মতোই, নার্স হয়ে সেবা করবে বহু আর্তজনের। আজ তোমার বাড়ির এই মেয়েকে আমি তোমার থেকে কিনে নিলাম। যদিও এই মেয়ের দাম এই নার্সিংহোমের বিলের থেকে অনেক বেশি। তাই আমি ওর পালিত বাবা হিসেবে, তোমাকেই সেই দাম দেবো।"
বহু-বহু বছর পরে মুন্নিমাসি আবেগে ভেসে কাঁদল। ধরা গলায় বলল,"না ডাক্তার। তুমি একাই সব পুণ্যটা নিবে, তা তো হয় না। আমার মেয়েদের আর আমার দুই ছেলের জানের দাম এতোটাও সস্তা নয়। এই মেয়েকে আমি বেচতে পারবো না। তবে খাঁচায় ভরে ভি রাখবো না। দিলাম ওকে স্বাধীন করে। করুক ও সবার সেবা। শুধু আসছে ভাইদ্যুজে ওকে একবার ভেজবে আমার ওখানে, যে ভাইদের বাঁচালো জানের বাজি লাগিয়ে, তাদের তিলক পরিয়ে আজন্মের ভাই বানাতে। আর একটা কথা মনে রেখো, ওর এই দুই ভাই, আজ থেকে শপথ নিল ওর রক্ষার। হরবার রাখিতে আসবে, ফির শপথ নিতে ওর আজন্মের রক্ষার। সিখানে কিন্তু আনবন করলে, তোমারও নিস্তার নেই ডাক্তার। তোমাকে বাবা হিসেবে বিশওয়াস করেই রেখে দিয়ে গেলাম আমার লছমিকে। আমার আঁখ কিন্তু থাকবে মরার আগে অবধি আমার মেয়ের উপর। কোনো উঁচ-নিচ যেন না হয়।" সজল চোখে লছমিকে বুকে জড়িয়ে, কপালে স্নেহচুম্বন এঁকে দিয়ে, মুন্নিমাসিরা চলে গেল।
দুর্গা মায়ের বিসর্জনের বাদ্যির মাঝেই যেন লক্ষ্মীর বোধনের সূচনা হলো এভাবেই, মনের শঙ্খধ্বনিতে।
নিঁখুত নকল
প্র দী প কু মা র দে
উমিচাঁদ চাকরিটা খোয়ালো। গিন্নির তো মুখভার। ---যাও আগে গিয়ে কাজ খোঁজো।
কোথায় গেল চাকরি পাবে? সবাই যে তার খোঁজেই ব্যস্ত! নিরুপায় কর্তা উমিচাঁদ ব্যবসার ফন্দি আঁটে। গিন্নি ঘরে ধুপ তৈরী করে।
উমিচাঁদ ঘুরে ঘুরে বেচে। খুব কষ্টের ব্যাপার। তাও চালাতে হয়।
একদিন গিন্নি ঠাকুরের দেউলে গিয়ে মানত করে।
---কিছু করো, ভালো হলে, পুজো দেবো।
ফেরার পথে গিন্নি চন্ডী একটা সুন্দর থলে পড়ে থাকতে দেখে। উল্লসিত হয়ে তুলে দেখে ভিতরে
কিছুই নাই। মনটা খারাপ হয়ে যায়। ভগবানের উপর রাগ হয়।---খালি ব্যাগ ক্যানে দিলে?
ব্যাগটা নতুন তবে ব্যবসার কাজে লাগবে ভেবে সে কুড়িয়ে আনে। উমিচাঁদ বলে, ---ভালোই হয়েছে এই ব্যাগে করে ধুপের প্যাকেট নিয়ে যাওয়া যাবে।
গিন্নি চন্ডী ভাবে, তা ভাল বলেছে। ব্যাগে ধুপের প্যাকেট ভরে দেয়। উমিচাঁদ বেচতে যায়। সেদিন প্রচুর বিক্রি হয়। অনেক টাকায় তার পকেট ভরে যায়। কিন্তু ধুপের প্যাকেট কমে না, ব্যাগ
ভরেই থাকে। আশ্চর্য ব্যাপার!
বাড়ি ফিরে গিন্নিকে এই আশ্চর্যের কথা বলে ব্যাগটা দেখায়। গিন্নির কি মনে হয়, ব্যাগ থেকে সব একই রকম ধুপের প্যাকেট বার করে মাত্র একটি ধুপের প্যাকেট ব্যাগে রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরের দিন সকালে উঠে গিন্নি চন্ডী ব্যাগ দেখে তো অবাক! ব্যাগ ভর্তি হয়ে গেছে একই রকমের নিখুঁত অনেক ধুপের প্যাকেটে। চন্ডী গিন্নি কর্তা উমিচাঁদকে বলে, ---আজ থেকে আর ধুপ বেচতে হবে না।
---সে কি খাবো কি?
---টাকা খাবো। টাকা হবে।
রাতে একটি একশো টাকার নোট ব্যাগে রেখে দেয় গিন্নি। রাতে দুজনার উত্তেজনায় আর ঘুম আসে না। সকালে উঠে ব্যাগ দেখে দুজনের চক্ষু চড়কগাছ। একি দেখছে তারা? এক ব্যাগ একশো টাকার নোট!
উমিচাঁদ দেবতার উদ্দেশ্যে গড় করে। গিন্নিকে বলে, ---আগে যাও মানতের পূজা চড়াও!
---ক্যানে যাবে? উনিতো খালি ব্যাগ দেছেন। বুদ্ধি তো আমার আছে। কিচ্চু দিবো নি।
একশো টাকার নোট বার করে, আবার ব্যাগ ভরে যায়। যতোই বার করে ততোই ভরে। বেশ মজার ব্যাপার তো?
গিন্নির ঘর ভরে যায় একশো টাকার নোটে। গিন্নি বুদ্ধি খাটায়। এক ব্যাগ টাকা দিয়ে কর্তারে কয়,
---ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে আইসো।
গিন্নির বুদ্ধি খারাপ নয়। তারিফ করতেই হয়। কর্তা একব্যাগ টাকা নিয়ে ব্যাঙ্কে ছোটে। কিছুক্ষণ পরেই বাড়িতে পুলিশ আসে এবং গিন্নি চন্ডীকে ধরে নিয়ে যায় থানায়। গিন্নি গিয়ে দেখে লকআপে দাঁড়িয়ে কাঁদছে উমিচাঁদ। চন্ডীকেও ঢুকিয়ে দেয় সেখানে।
ও সি অভিযোগ লেখে--- কেস জাল টাকার। জালিয়াতির। দুজনেই অবাক!
ওসি দেখায় সবকটি নোটেই ছাপা রয়েছে কিন্ত ওই একই নম্বর!
প্রাপ্তি
উ প মা বে গ ম
ছোট্ট পরিবার, বাবান আর ওর মা। বাবা নেই, ঠিক নেই না আছে কোথাও ওদের সাথে থাকে না। ছোট্ট বাবানের পৃথিবীই ওর মা। লোকের বাসায় কাজ করে। বাসি তরকারি আর পুরনো জামা কাপড়ে বেশ চলে যাচ্ছে। ঘরের অবস্থা ঠিক ততটা ভালো না, বর্ষায় উপর থেকে জল পড়ে। বাবানের মা বেতনের জমানো প্রায় হাজার বিশেক টাকা দিয়ে ঘর মেরামতে ব্যস্ত এখন। ভেবেছিল সরকারি আবাস যোজনায় ঘরটা পেলে জমানো টাকা দিয়ে বিদ্যুত সংযোগ করবে আর বাকি টাকা দিয়ে ভালো কোন স্কুলে বাবানকে ভর্তি করিয়ে দেবে। কিন্তু ওই যে যুবতী মেয়ে মানুষ... পঞ্চায়েত প্রধান, মেম্বার থেকে শুরু করে গণ্যমান্য সভায় চোখ দিয়ে গিলে খায় বা অন্য কিছু চায়। ওর নিজের নাম যে ঊর্মি সে নিজেই ভুলে গেছে। সে শুধু এখন বাবানের মা। তাই এখন আর সরকারি ঘরের আশা করে না, নিজেই মেরামতে ব্যস্ত। বাবানকে কয়েকদিন পর পাশের এক সরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। দুপুরবেলা বাবান স্কুলের মিড ডে মিল খেয়ে আসে। কয়েকদিন পর বাবান তার মাকে বলে একটা টিফিন বক্স কিনে দিতে। ঊর্মি ভেবে পায় না টিফিন বক্স দিয়ে কি করবে, স্কুলেতো খাওয়া যায় ওই যে মিড ডে মিল। ঊর্মি ওকে বোঝায় বাবা টিফিন বক্স এগুলো বড় লোকেদের জন্য আমাদের জন্য না।
দুজনের দুই রকম ভাবনা। ঊর্মি ভাবছে বর্ষার আগে কি করে ঘরটার পুরো কাজ শেষ হবে আর বাবান ভাবছে টিফিন বক্স কি করে কিনবে। হঠাৎ গলির মুখে স্কুলে যাওয়ার পথে শুনতে পায় এক লোক ভেঁপু বাজাচ্ছে আর বলছে "চুল দিয়ে বিভিন্ন রকমারি জিনিস নিয়ে যান," বাবান এইবার একটা বুদ্ধি পেল। ঊর্মি চুলগুলো আঁচড়ানোর পর যেখানে ফেলে বাবান সেখান থেকে লুকিয়ে এনে জমিয়ে রাখে, প্রায় তিন মাস পর ওই ভেঁপুওয়ালার কাছে যায় আর চুলের বিনিময়ে টিফিন বক্স পেয়ে যায়।
বাবানের সে কি খুশি, ওর জীবনের প্রথম জিনিস যা মন থেকে চেয়েছে, পেয়েছে। চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। আর এই তিন মাসে ঊর্মি আরো তিনটে বাড়িতে কাজ নেয়। আগের দুটো বাড়ি আর এখন তিনটে, ঊর্মি হাঁপিয়ে উঠে, বাড়িতেও তো কাজ কম না। বাবান তো ছোট, মাকে খুব একটা সাহায্য করতে পারে না। প্রায় রাত্রে ঊর্মি হিসেব মিলায় জীবনের, প্রাপ্তির খাতাটা যে একেবারে শূন্য। কাল রাতে ওই হিসাবটাই করছিল কিন্তু পরদিন যখন বাবান স্কুলে যায় আর মিড ডে মিলে ডিমটা টিফিন বক্সে করে ঊর্মির জন্য নিয়ে আসে তখন ঝাপসা চোখে বুকে জড়িয়ে ধরতেই হিসাবটা ঠিকমত বুঝতে পারে ওর প্রাপ্তিটা সর্বোচ্চ।
মা দুগ্গা
স র মা দে ব দ ত্ত
আট বছরের রিনি আর বছর পাঁচেকের ভাই রিন্টু। পাড়ার প্রাইমারি স্কুলেই পড়ে। ঠিক সময়ে দুই ভাইবোনে হাত ধরাধরি করে স্কুলে যায়। স্কুলে গেলেই তো দুপুরের গরম ভাত ডাল পেট ভরে খেতে পাবে। মা তো সেই সকাল বেলায় বেড়িয়ে যায় বাসাবাড়ির কাজে।তার উপর এক পায়ে শক্তি পায় না ভালো করে কথাও বলতে পারে না। কোনো রকমে দুটো বাড়ি চালাচ্ছে।
জ্ঞান হওয়া অবধি রিনি শুনেছে বাবা কাজে গেছে এইকদিন পরেই আসবে। কিন্তু বাবা তো আসেই না। বাবার চেহারা প্রায় ভুলতেই বসেছে। এখন বাবার কথা বললে মা চোখ মোছে। "তাহলে কি বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে আর কোনোদিনও আসবে না"- মনে মনে ভাবে রিনি। ভাইকে সে আগলে রাখে। ভাইতো কিছুই বোঝে না।
এদিকে পূজোও এসে গেছে সবাই বলছে। বৃষ্টি আর নেই আকাশে রোদ উঠতে দেখে মনটা আনন্দে মেতে উঠতে চাইছে। পাড়ার সবাই বিকেল হলেই বাবা-মায়ের হাত ধরে বাজারে যাচ্ছে, পরের দিন সবাই কে জামা দেখাচ্ছে। স্কুলে ও সবাই জামার গল্প করে, কার কটা হল কে কে দিল। এসব দেখেশুনে ভাই একদিন বলল---"দিদি আমাদের নতুন জামা হবে না?" গম্ভীর হয়ে রিনি বলেছিল --"হবে। বাবা পূজোতে আসবে তখন নিয়ে আসবে। এত আগে জামা কিনলে জামা পুরনো হয়ে যায়।"
এসব শুনে শুনে রিনির আর ভালো লাগে না। স্কুলেও আর আসতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু খাবে কী? বাড়িতে তো দুপুরে রান্না হয় না। ভেবে ভেবে কান্না কান্না পায় রিনির।
আজ ষষ্ঠী পূজো আজ থেকে স্কুল বন্ধ। একদিকে দুপুরের খাবারের চিন্তা আর একদিকে নতুন জামার চিন্তা।
স্কুলে যাওয়া আসার পথেই আছে মা কালির মন্দির আসার পথে রিনি ভাইকে নিয়ে মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করে
---"মা কালি আমার বাবা যেন এবার পূজোর সময় বাড়িতে আসে ভাইয়ের নতুন জামা নিয়ে একটু দয়া করো মা, তুমি তো জানো আমার মায়ের কত কষ্ট। তুমি আমার বাবাকে পাঠিয়ে দিও মা নইলে ভাইয়ের নতুন জামা কোথায় পাবো।"
পরদিন সপ্তমী পূজা। রিনির মনে আনন্দ নেই। ভাইটি খালি গায়ে উঠোনে খেলে বেড়াচ্ছে।
দুপুর বেলা হঠাৎ দেখল--- মা আজকে এত তাড়াতাড়ি চলে আসলো কেন? তবে কী শরীর খারাপ? হাতে ওগুলো কী? মাকে কি ওরা কাজের থেকে ছাড়িয়ে দিল??? একসঙ্গে অনেক গুলো প্রশ্ন জট পাকিয়ে গেল।
মা লেঙড়ে লেঙড়ে ঘরের দিকে গেল। বাচ্চারাও পিছে পিছে গেল। ঘরে গিয়ে মায়ের কথাগুলো যেন দুচোখে গিলছে রিনি---
রায়গিন্নি বলেছেন আজ থেকে যতদিন তোদের স্কুল বন্ধ থাকবে ততদিন পর্যন্ত একবেলা করে কাজ করলেই চলবে। দুপুরে বাড়ি চলে আসতে বলেছেন। আর এই দেখ তোদের জন্য নতুন জামা পাঠিয়েছেন। দেখ দেখ পড়ে দেখ। রায়গিন্নি যেন সাক্ষাৎ মা দুগ্গা।
রিনি মনে মনে ভাবল মা কালি ওর কথা শুনেছেন। মা কে বলল--- "মা আমিও বড় হয়ে রায়গিন্নির মত মা দুগ্গা হব।" মা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরল।দুজনেরইচোখ ছলছল।
পাড়ার দুর্গামণ্ডপ থেকে ভেসে আসছে---
"য়া দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতা
য়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃ রূপেন সংস্থিতা
নমোস্তসৈ নমোস্তসৈ নমোস্তসৈ নমো নমোহঃ"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন