শ্রুতিনাটিকা
একটা অন্যরকম দিন
ঝু মা পা ল
বিষয়বস্তু: সামাজিক
নাটকের চরিত্রগণ-- 'ঠাম্মা এবং নাতবৌ'
ঠাকুর ঘরের দৃশ্য :
ঠাম্মা: হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে... হরি হরি ...এত ডাকছি শুনতে কি পাও... অনেক হইছে, আর ইচ্ছা করে না... অহন আমারে কেউ চায় না... কেউ না... হরি হরি হে...
নাতবৌ: ঠাম্মা ও ঠাম্মা...একটু চুপ করো তো। এই দু'দিন আগে তোমার মুখে অপারেশন হলো।পড়ে গিয়ে দাঁত ভেঙে কি রক্তারক্তিই না করেছিলে! বাপ রে! কি রক্ত কি রক্ত! আমি এত ভয় পেয়েছিলাম। মুখের ভেতর অনেকগুলো সেলাই পড়েছে, এখনও গলা খাবার খাচ্ছো। অথচ এখন এমন চেঁচাচ্ছো... এতে চাপ পড়বে তো সেলাইয়ে।
ঠাম্মা: চেঁচাই কি আর সাধে! চান করতে যাওয়ার আগে ঐ মহারানীকে বলে গেলাম ঠাকুরের বাসনটা একটু মেজে আসনটা সাজিয়ে রাখতে। তা সে হাড় বজ্জাত মেয়ের ছাত্তর পড়িয়ে আর সময় হয় না। রাতদিন খালি ইংরেজি বুলি কপচাচ্ছে আর ট্যাঁকস ট্যাঁকস কথা। জ্বালিয়ে খেলে গা...
নাতবৌ: ঠাম্মা... বলছি না চুপ করতে! সেলাইয়ের জায়গা খুলে গেলে কি সাংঘাতিক কান্ড হবে বলো তো!
ঠাম্মা: ভালোই হবে... বুঝলি নাতবৌ ভালোই হবে। এই সংসারকে টা টা করে চলে যাবো। দেখিস তখন ঐ বজ্জাত মেয়েটা খুশিতে ডগমগ হবে।
নাতবৌ: ঠাম্মা... ঠাম্মা গো একটু চুপ করো... মামনি শুনতে পাবে তো! আর বাপিও আজ বাড়িতেই আছে। শুনতে পেলে বাড়ি সুদ্ধ হুলুস্থুলু হবে... লক্ষ্মী ঠাম্মা আমার... হয় চুপ থাকো নয় আস্তে বলো... প্লিজ
ঠাম্মা: তুই থামতো বাপু... কানের কাছে আর ভ্যাজর ভ্যাজর করিস না। আমি একে ব্যথায় মরছি... তার ওপর সকাল সকাল ভাবলাম এট্টু হরিকে ডাকি মন দিয়ে... তা কি আর হলো! সবই আমার কপাল আর কি! কি ভেবেছিলাম আর কি হলো! হুঃ! ঠাডা পইরা বগা মরছে আর ইদিকে ফকিরের কেরামতি বাড়ছে!
নাতবৌ: আরে! ও ঠাম্মা বগা কে? আর ফকির! সেই বা কে? কোথা থেকে এলো? কি যে বলছ!
ঠাম্মা: বলছি তোর মাথা আর আমার মুন্ডু! অত বুঝে কাজ নাই! দেখস না একজনেরে বিদ্যে বোঝাই মেমসাহেব হইছে! তা সেই মহারানী ভিক্টোরিয়া কি করছে রে?
নাতবৌ: আরে বাবা তুমি দেখছি আজ ঝামেলা না পাকিয়ে ছাড়বে না। আস্তে বলো...
ঠাম্মা: ক্যান! আস্তে ক্যান! ওঃ....ওরে আমি ভয় পাই নাকি!
নাতবৌ: আচ্ছা ছাড়ো তো... একবার আমার দিকে তাকাও...
ঠাম্মা: নাতবৌ... ও নাতবৌ... বাঃ তোরে আজ কি সোন্দর লাগতাছে রে! কি সোন্দর সেজেছিস! আবার নতুন শাড়িও পইরেছিস! বাঃ বাঃ আমার সোনা নাতবৌ।
নাতবৌ: তাই ! সুন্দর লাগছে আমাকে( হাসির আওয়াজ)
ঠাম্মা: হ্ হ্... খুউব সোন্দর দেখাচ্ছে! হ্যাঁ রে নাতবৌ কই যাবি গিয়া? কিসের লগে এত সাজছস?
নাতবৌ: একটা নেমতন্ন আছে... আমার এক বান্ধবীর ছেলের জন্মদিন। আগে সেখানে যাবো তারপর সেখান থেকেই সন্ধ্যের শো তে সিনেমা দেখে আসব গো সিনেমা! তোমার নাতি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছে।এই এলো বলে... ও এলেই বেড়িয়ে পড়ব।
ঠাম্মা: আইচ্ছা... যা যা ঘুইরা আয়। ঘরের মধ্যেই তো থাকস রাতদিন। একটু আনন্দ না করলে হয়। খুউব ভালো খুউব ভালো।
নাতবৌ: এইজন্যেই তোমাকে এত্ত ভালোবাসি। আমার সোনা ঠাম্মা... উমমম( আদরের শব্দ)
ঠাম্মা: অ্যা হ্যা হ্যা...দিলি তো লিপিসটিক আমার গালে লাগায়ে... ধ্যাৎ (আদুরে স্বরে)।হ্যাঁ রে মহারনীরে কইছস?
নাতবৌ: মামনিকে! আমি জিজ্ঞেস করব? ওরে বাপ রে! আমার ঘাড়ে কটা মাথা আছে শুনি। ও কাজ আমার দ্বারা হবে না। প্লিজ আমার সোনা ঠাম্মা, তুমি একটু বলে দাও না মামনিকে।
ঠাম্মা: জানি তো তুই কইলে কাজ হইব না। তোরে খুউব হিংসা করে। দেখলি না সেবার তোরা ঐ ভাই..জা ....কি যেন ছাই ! ধুত মনে পড়ে না..
নাতবৌ: ভাইজ্যাগ
ঠাম্মা: হ্ হ্ ভাইজ্যাগ... ঘুরতে যাবি ঠিক করেছিলি। ওরে কইতেই কি রাগ দেখাইল! তোদের যাওয়ার দিন কত অশান্তি করল! জানস তোরা চলে যাওয়ার পর আমারে কি চোপা করল! ক্যান আমি তোদের হয়ে ওরে কইছি! কত কথা শুনাইল!
নাতবৌ: আচ্ছা আচ্ছা থাক ঠাম্মা... ছেড়ে দাও। ঐসব কথা মনে করে কি লাভ বলো! মাঝখান থেকে মামনির কানে গেলে আর এক দক্ষযজ্ঞ হবে। আসলে কি বলি বলতো! মামনিও একদিন দুঃখ করে বলছিল, এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসা থেকে তার ভালোলাগা ভালোবাসার জিনিসগুলোকে নাকি ভুলতে বসেছে। শুধু স্কুল আর বাড়ির কাজ এতেই আটকে গেছে মামনির জীবন। বিয়ের আগেই যা ঘুরেছে একটু, বিয়ের পর থেকে কোথাও আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।তোমার শরীর, বাপির চাকরি তারপর তোমার নাতির জন্মের পর আরও ব্যস্ততা...মানুষটাকে কর্তব্যের গন্ডীতেই আটকে দিয়েছে।
ঠাম্মা: কিইইই! তোরে কইছে এসব! দেখছস মহারানীর সাহস দেখছস! আমার শরীর খারাপের কথা কয়ে নিন্দা করে।আমার জন্য সে কোথাও যাইতে পারে নাই! ক্যান, আমি তারে ভালোবাসি নাই... নাতি হওয়ার সময় যত্ন করি নাই! একটা কাইজও করতে দিই নাই। আর সে কিনা এই কথা কয়! তুই বিশ্বাস কর নাতবৌ, তারে আমি খুউব ভালোবাইসেছিলাম। হ্যাঁ এইটা কয়েছিলাম আমি সারাদিন ঘরে একলা একলা কাটাই... তুমিও চাকরিতে থাকো।এরপর ছুটিছাটায় সবাই ঘুরতে গেলে বাড়িটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। তাইতেই মহারনীর এমন গোঁসা হয়েছিল যে আর কোনদিন সুযোগ আইলেও কোথাও যায় নাই। আমিও তো বিয়ার পর থেকে সেই সংসারের হাঁড়িই ঠেলে গেলাম রে নাতবৌ...আমারও কত ইচ্ছে ছিলো কিছুই পাইলাম না কিচ্ছু না।তাই তোদের লইয়াই একটু ভালো থাকার চেষ্টা করি। (কান্নার শব্দ)
নাতবৌ: ঠাম্মা ও ঠাম্মা... আর কেঁদো না ঠাম্মা... আর কেঁদো না।আচ্ছা একটা কাজ করলে তো হয়। আজ নেমতন্ন বাড়িটায় না গিয়ে সবাই মিলে বরং কোথাও ঘুরে আসি। এই কাছেই কোথাও একটা! অনেকদিন তো কোথাও বেরোও না। আজ যাবে? মামনিও খুব খুশি হবে!
ঠাম্মা: যাবি নাতবৌ...সত্যি বলছিস! যাবি!!
নাতবৌ: হ্যাঁ গো হ্যাঁ..বলছিতো যাবো... সবাই মিলে যাবো।
ঠাম্মা: কই যাবি? কিন্তু তোর সিনেমায় যাওয়া!
নাতবৌ: সে অন্য একদিন হবে
ঠাম্মা: কিন্তু... নাতির আবার রাগ হইব না তো ?
নাতবৌ: আরে না! তুমি চেনো না তোমার নাতিকে! বরঞ্চ খুশিই হবে। যাই ওকে ফোন করে বলি।
ঠাম্মা: কিন্তু যাবি কই? ভিক্টোরিয়া না বাবুঘাট?
নাতবৌ: ( হাসি) তুমিই বলে দাও... কোথায় যাবে?
ঠাম্মা: অনেকদিন আগে একবারই গিয়েছিলাম ভিক্টোরিয়াতে। মাথার ওপর পরিটারে দেইখ্যা খুউব দুঃখু হয়েছিল। কেমন একা একা ঘোরে! চল না নাতবৌ, পরিটারে আইজ একবার দেইখ্যা আসি!
নাতবৌ: ঠিক আছে... তাহলে আজ বিকেলবেলা সবাই ভিক্টোরিয়ায় যাচ্ছি। যাই মামনিকে বলি... দেখবে খুব খুশি হবে। আর ঠাম্মা ঐখানে গিয়ে তুমি মামনিকে একটা গান করতে বলবে। মামনি একসময় নাকি খুব সুন্দর গান গাইত।
ঠাম্মা: হ্ হ্ বলুম খনে গান করতে।
নাতবৌ: আমি নীচে যাচ্ছি ঠাম্মা... মামনি আর বাপিকে বোলতে (কন্ঠস্বর দূরে চলে গেলো)
নাতবৌয়ের ঘরে---
নাতবৌ: যাক, আজ অনেকদিন বাদে এই বাড়ির মানুষগুলো একটু খোলা আকাশের তলায় একসাথে গিয়ে দাঁড়াবে। আজকের দিনটা হোক একটু অন্যরকম...
তুমি ছুঁয়ে দিলে মন মেঘলা আকাশ মায়াবী সেইক্ষণ! তোমার ছোঁয়ায় আমি ভোরের পাখি খোলা আকাশ তুমি আমার বন্ধু হবে আজীবন। তুমি ছুঁয়ে দিলে মন জাগিয়েছিলে অচেনা শিহরণ!
তাই অন্তহীনতায় হারিয়েছি আমি
অন্তরে অন্তরে আছ তুমি শুধু তুমি।
এ যেন আমার কথা... আসলে শাশুড়িমা নিয়ে ঘর করা চাকুরীজীবি নারীমনের আফসোস
উত্তরমুছুন