স্মৃতিকথা

শারদ বেলায় আমার মা

দে ব যা নী  ঘো ষা ল


বিয়ের বছর দুই পর।
শারদ সন্ধ্যা কেটেছিল বিষন্নতায়।
মা হাসপাতালের আই সি সি ইউতে দশ নং কেবিনে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
করোনারি হার্ট এ্যাটাকে এ্যাঞ্জিওগ্রাফি করতে গিয়ে তিনটে আর্টারি নাকি ছিঁড়ে গেছে।
সন্ধ্যে বেলা ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে মায়ের ঐ ঘুমন্ত চোখ দুটো মনের মধ্যে কেমন ঢিপঢিপ করছে অহরহ।
কানে যাচ্ছে না ঢাকের বাদ্যি।
কানে আসছে না মাইকের নতুন বাংলা গান।
একদিন রাত বারোটার পর কন্টিনিউয়াস ফোনটা বাজছিল।
মনে হচ্ছিল এই বুঝি শেষ খবরটা পেলাম!
বোন বলছে আমাকে, তুই ধর।
আমি বলছি না তুই ধর।
বার কতক বলাবলি করে সাহস করে আমিই ধরালাম।
ওপাশ থেকে নারী কন্ঠ।
মায়ের হস্টেলে থাকাকালীন প্রিয় বান্ধবী বাসনা মাসি।
এক বছরের সিনিয়ার হলেও বন্ধুর থেকেও যেন বেশী ছিল।
আমাদের দুই বোনের বিয়েতে একবারে গার্জেনের মত মায়ের পাশে পাশে ছিল।
এক হসপিটালে ডিউটি করতো না।
কিন্তু হৃদ্যতা ছিল অটুট একটানা।
বললেন "এই ভীষণ ভীষণ সরি রে, এত রাতে ফোন করার জন্য। এইমাত্র খবর পেলাম অনিতা আই সি সি ইউতে। এখন কেমন আছে রে?"
বললাম ডাক্তার বাইপাস না করে ছাড়বেন না বলেছেন।
হ্যা রে তোদের খুব টানাপোড়েন চলছে। নে ঘুমা। আমি কালই আসছি।
সেই রাতগুলো যে কি আতঙ্কে কেটেছে বলবার না।
নির্ঘুম এক একটা রাত যেন গ্রাস করে আছে কোন এক অভিশাপ!
মাস পরার আগেই মা ফিরলো নিজে বন্ডে সই করে।
"আমি না গেলে আমার ছোট মেয়ের বিয়ে হবে না। ওর আশীর্ব্বাদ হয়ে গেছে। আমাকে কদিনের জন্য ছাড়ুন স্যার।"
অনেক আকুতি মিনতির পর ছুটি পেয়েছিল লক্ষ্মী পূজোর পর।
প্রিয় গোপাল বিষয়ী, অঞ্জলি জুয়েলার্স থেকে প্রয়োজনীয় সব শাড়ি গয়না কিনতে গেলাম আমরা মা মেয়েরা মিলে।
মা বুঝতেই দিচ্ছে না বুকের ভেতরের যন্ত্রটার যন্ত্রনা। চোখ দুটোর কোনা লাল। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছি না। ধমকের ভয়ে।
সব কেনাকাটা কম্প্লিট।
সমস্ত আত্মীয় সমারোহে বিয়ের সানাই বেজে বিয়ে হয়ে গেল বোনের। মায়ের যন্ত্রনাকাতর শরীরটা যেন এক নিমেষে শীতল হল মেয়ের সিঁদুর দানের পর।
পুরো বিয়ে দেখার আগেই বিয়েবাড়ি থেকে মাকে নিয়ে বাড়ি চলে এলাম।
উপোষ করতে দিই নি।
টিফিন কেরিয়ারে করে মটন বিরিয়ানী, চিকেন চাপ, মিষ্টি এনেছিলাম।
এই বিয়ে কি আনন্দের বিয়ে?
মায়ের ট্যালট্যালে মাছের ঝোল ভাতের সাথে আমি বিরিয়ানী চিবোচ্ছিলাম। গলা দিয়ে যেন নামতে চায়না।
প্রতি মুহুর্ত যেন এই নেই এই নেই মন বলেই যাচ্ছে।
মা বললো আমি বিরিয়ানী খাব।
আমি আর এক মুহুর্ত দেরী করি নি।
একটু দিলাম।
শিশুর মত খেল।
ভাবলাম হয়তো জীবনের শেষ বিরিয়ানী খাওয়া!
বাইশে নভেম্বরের দিনটা এইভাবেই শেষ হল।
হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো মা চব্বিশে নভেম্বরের দুপুরবেলা।
থাইতে নিজেই ইনসুলিন দিতে দিতে।
কখনো কাঁদতে দেখিনি মাকে।
সেদিনই দেখলাম।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছো কেন মা?
"আমার বুকটা একেবারে খালি হয়ে গেল!" মা আর্তনাদ করে উঠলো।
আসলে হসপিটাল থেকে ফেরার পর বোনই ইনসুলিন দিয়ে দিত মাকে।
সেদিন দেখেছিলাম সর্বহারা মাকে।
দুই মেয়েকে রত্ন মনে করতো।
প্রাণ ভরে শিখিয়েছে নাচ গান আঁকা পড়া।
কটা দিন গুনতে গুনতে চলে গেল।
আটই জানুয়ারী।
দুপুরে মা বললো একটু শ্যাম্পু করবো।
আমিই করিয়ে দিলাম। বাইপাসের জন্য মা প্রোভিডেন্ট ফান্ডের ফর্ম ফিলাপ করছিল। বললো, মামাবাড়ির পাশে আমাদের যে জায়গাটা আছে, ওটা বিক্রি করে যা হয় তার থেকে কুড়ি হাজার টাকা ছোটমামাকে  দেবে। বড়মামাকে কিছু দিতে হবে না। ওকে তো চাকরিটা পাইয়ে দিয়েছি। আর পাঁচ হাজার টাকা বড় মাসির নাতিকে দেবে। আর বাকি সব তোমাদের।
আমি বললাম, এসব কথা এখন বলার দরকার কি? পরে ভেবো।
একসাথে খেতে বসলাম। অল্প খেয়ে বললো পটি করতে যাব। গেল। কিন্তু আসছে না অনেকক্ষন হল।
আমার এক বছরের দুধের শিশুকে নিয়ে আমি যে দৌড়ে যাব সে উপায় নেই।
বাবাকে বললাম।
বাবা গিয়ে দেখলো মা বাথরুমে অচৈতন্য আধ শোওয়া।
ধরে ধরে ঘরে নিয়ে এসে সোফায় শোয়ালো।
চোখ বন্ধ।
মা বলছে, পচা গন্ধ পাচ্ছি।
চোখে সব ঝিলমিল দেখছি।
পিঠটা যন্ত্রনায় ফেটে যাচ্ছে। আমি যে মাকে পিঠটা ম্যাসেজ করে দেব তার উপায় নেই। ছেলে কাঁদছে কোলে। তাও চেষ্টা করতে লাগলাম। মা বলছে এত যন্ত্রনা হচ্ছে যে আমার ম্যাসেজ কোন কাজেই লাগছে না। ছেড়ে দাও মামন। এক চামচ চিনি চাইলো। দিলাম। জল দিয়ে খেল। এইভাবে দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল চারটে গড়ালো। আমি বাবাকে বললাম তুমি ডাক্তার ডাকো।
বাবা ডাক্তার ডাকলো।
ডাক্তার দেখে বললেন, সুগার প্রেসার সব ডাউন।
এক্ষুনি হসপিটালে ভর্তি করুন।
মা কিছুতেই রাজী না।
আমি বোনকে ফোন করলাম। ও গাড়ি নিয়ে এসে মাকে পাঁজাকোলা করে গাড়ি অবধি যখন নিয়ে যাচ্ছিল মন যেন বলে উঠলো আর ফিরবেনা।
না হসপিটাল কতৃপক্ষ মাকে সেদিন জেনারেল বেডেই রেখেছিল। বুঝেই রেখেছিল। কিছু আর করার নেই।
হয়তো করার ছিল।
আসলে আমরা অপদার্থ অবোধ। কিছুই তো বুঝিনা। ডাক্তাররা যা বোঝান তাই বুঝি। 
রাতে আমার হাজব্যান্ড, মাস্তুতো দাদা, মামাতো দাদা আর বোন ছিল।
ভোর  বেলা সব ঠিক আছে শুনে ওরা বাড়ি ফিরতেই ফোনের রিং টোন। 
ওপাশ থেকে এক নার্সদিদি বললেন, "তোমার মা বমি করে সব ভিজিয়ে ফেলেছে। এক্ষুনি জামা কাপড় নিয়ে আসো। 
সাথে সাথেই ওরা আবার গেল। কি যেন মনে হল, আমি বাবাকে বললাম তুমিও যাও।
সকাল সাড়ে ন'টা থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। বোনকে পেয়ে মা ঐ অবস্থায় বলে উঠলো "এত দেরী করে এলে?" 
বোন তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ডাকলো।
সব শেষ। তখন সকাল দশটা। বেশ কয়েকজন ডাক্তার বুকে পাম্প করলেন। নাহ্!!
জানুয়ারীর নয় তারিখ।
সব কর্তব্য সেরে মা চলে গেল ডিউটিরত অবস্থায়।
আরও দু'বছর বাকি ছিল।
কি দরকার আর!
সবাইকে কাঁচকলা দেখিয়ে চলে গেল।
নির্বাক ঘুমন্ত চোখে মৃদু হাসি।
নিথর নির্জীব কপালটা যখন বাড়িতে নিয়ে আসার পর স্পর্শ করলাম, মা যেন বলে উঠলো, আমার জন্য তোমাদের কিচ্ছু করতে হবে না।
সেদিন ছাদের টবে লাগানো ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা আর গাঁদারা শেষ বারের মত ফুটেছিল বড্ড বেশী রঙিন হয়ে। আমার ছোটমাসি সেইগুলো দিয়ে মালা গেঁথে মাকে পরিয়ে দিয়েছিল। বোনের অশৌচ ছিল। এক তারিখ ওর শাশুড়ি চলে গেলেন। আর আমার ছোট বাচ্চা। তাই সাথে যেতে শেষবারের মত পারিনি। 
কত রাত নির্ঘুম হয় মায়ের ডাকে। জানলা দিয়ে ডাকছে যেন, "মামন!!" একলা বাবাকে রেখে মায়ের এখনো খুব চিন্তা। তাই বাবাকে আমার কাছে এনে রেখেছি। এখন মা নিশ্চিন্ত। একুশটা শরৎ এলো গেল। মা আর এল না। বিষন্ন শরৎ আর হাসবে না। হয়তো হাসি লেগে থাকবে ঠোঁটে। পরিণত মনের আশ্বাসে।






বাংলাদেশ ভ্রমণের স্মৃতিকথা
 
নি ভা  চা ক লা দা র 


বছর চার আগের কথা, ঠিক করোনার প্রাদুর্ভাব এর আগে আমরা স্বামী স্ত্রী দুজন বাংলাদেশ
বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমরা দুজনেই জন্মেছিলাম সেই দেশে। আমি ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে আর উনি স্বাধীনতার আগে।জন্মভূমির টানেই যাওয়া এবং বর্তমান বাংলাদেশ দেখা একই সাথে। আমরা চ্যাংরাবান্ধা থেকে বাসে করেই যাই। এক আত্মীয় আমাদের নিতে ভোর বেলায় ময়মনসিংহ বাস স্ট্যান্ড এ অপেক্ষা করছিলেন, পরিচিত ছিলেন আগেই। আমরা বাস থেকে নামার পর মুহূর্তেই গাড়ি করে নিয়ে নেত্রকোণার বাড়িতে পৌঁছান। এমন আপ্যায়ন, খাতির যত্ন , সে ভুলতে পারিনি আজও। 
দু'দিন সেখানে কাটিয়ে আমার কর্তার জন্মভিটার উদ্দেশ্যে রওনা হই। কিছুটা বাসে গিয়ে  রিক্সা করে চলেছি গাঁয়ের পথে। ইট পাতা এবড়ো থেবড়ো সেই পথ, মাঝে মাঝেই নেমে পার হতে হচ্ছে ভাঙা পথের কল্যাণে। বিকেল হয়ে গেছে তখন। আমার তো এখানে সবাই অপরিচিত। প্রত্যন্ত এক গ্রাম, কাঁচা ঘরবাড়ি, দু'একটি টিনের চালার ঘর। আমার কর্তার পূর্বপুরুষের ভিটা এখানেই, কিন্ত সেখানে অন্য মানুষজন বাস করছে। একজন আত্মীয় এখনও এখানেই বাস করেন, তার ঘরেই আমাদের পরম যত্ন সহকারে ঠাঁই দিলেন। অসচ্ছ্বল পরিবার কিন্ত অন্তরে ধনী। সেখানে দু'দিন থাকতে বাধ্য হলাম। শ্বশুর বাড়ির পুরাতন ভিটা, বাড়ির সেই পুকুর, জমি, পাড়া-পড়শির বাড়ি সব ঘুরে ফিরে দেখে চোখের জলে বিদায় নিই। ওখানে প্রাণের পরশ ভুলবার নয়। বারবার ঐ মানুষগুলো মনের ক্যানভাসে ভেসে বেড়ায় যখন তখন। মুক্ত বাতাস আর মুক্ত মনের সন্ধান পেয়ে পথের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। 
এবার এলেম মদন, এখানেই কর্তার শিক্ষালয় আর পেলাম সেই গাঁয়ের আর একজন ভাই। একরাত এখানে কাটিয়ে পরদিন 
কর্তার বিদ্যালয়ে হাজির হলাম স্কুল-এর সময়। প্রধান শিক্ষিকার সাথে সাক্ষাৎ এ মুগ্ধ, পুরাতন ছাত্রের পরিচয় পেয়ে আপ্রাণ সমাদর করেন। গোটা স্কুল বাড়ি ঘুরিয়ে দেখান, মোবাইল এ বন্দী করেন আমাদের। অমায়িক ব্যবহার তাঁর কাছ থেকে পেয়ে আমরা অভিভূত। 

ফিরে আসি নেত্রকোণা। আত্মীয়, অনাত্মীয় অনেকের সাথে এক নিবিড় বন্ধন অল্প সময়ের মধ্যেই। এ কি কখনও মন থেকে মুছে যাবে, না  কিছুতেই না। ইচ্ছে জাগে আবার ও যদি যেতে পারতাম। বাংলাদেশের সোঁদা মাটির গন্ধ, নদী, পুকুর, খাল বিল যেন আজও হাতছানি দেয়। এই মধুর স্মৃতি জীবন থাকতে ভুলতে পারবো না।





মায়াপুর ইস্কনের মূল মন্দিরের আরতি

অ শো ক  ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়


গত বছর জন্মাষ্টমীর ভোরের আরতি দেখতে মূল মন্দিরের রাধা কৃষ্ণ ও অষ্ট সখী বৃন্দের সুসজ্জিত দন্ডায়মান মূর্তি শোভিত মঞ্চের সামনের হলে প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে বসে কীর্তন ও খোল করতাল বাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে অপূর্ব আরতি দেখে ওখান থেকে সরে আবার নিতাই গৌরের আরতি দেখতে উপস্থিত হই পাশের হলে। বিগ্রহের মঞ্চে ঊর্দ্ধবাহু হয়ে প্রেমের ঠাকুর শ্রীচৈতন্য তথা নিতাই গৌরের সাথে ষড় গোঁসাই পাশাপাশি দন্ডায়মান। প্রত্যেকেই অনাবৃত ঊর্দ্ধাঙ্গে উত্তরীয় ও ধুতি পরিহিত অবস্থায় যেন মহানন্দে হরি নাম সংকীর্তনে ও কৃষ্ণ নাম ভজনে মাতোয়ারা। শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ। শ্রী অদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাদি যতো ভক্ত বৃন্দ।

এদিকে ইস্কনের সন্ন্যাসী মোহন্তরা যথাবিধি উপচারে নিষ্ঠাপূর্ণ ভক্তি সহকারে শ্রীখোল খঞ্জনী, কাঁসর ঘন্টা বাদ্য সহযোগে সুমধুর নাম সংকীর্তনের তালে ছন্দে আরতি করে চলেছেন ধূপ দীপ শঙ্খ ঘন্টা পুস্প ও চামর ব্যাজন অনুষঙ্গে। সমবেত ভক্ত ও দর্শনার্থীদের যেন ঢল নেমেছে মন্দির চত্বরে। পাশের প্যাসেজে ইস্কনের তরুণ, যুবক, প্রৌঢ় সন্ন্যাসী ও শিষ্যবৃন্দ নানা ধরনের ভজন কীর্তনের তালে তালে ছন্দে বিভঙ্গে হেলে দুলে ঘুরে ঘুরে নৃত্য রত। দুই হাত তুলে উপস্থিত সকল নরনারী ও ভক্তবৃন্দ হরি নামে, ভজনের গানে ভক্তির আবেশে বিভোর। দোলায়িত ছন্দে তারাও দলে দলে নাচছে গাইছে সুরে সুরে কন্ঠ মিলিয়ে অনির্বচনীয় আনন্দ সুধা উপভোগ করছে। কখন যে ঐ প্রেম ভক্তির জন জোয়ারে ভাসতে ভাসতে আমিও বিগ্রহ মঞ্চের কাছাকাছি গিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। মঞ্চের সেই আরতি দেখতে দেখতে ভাব বিহ্বল হয়ে সমবেত সবার অন্তর্জগতের সঙ্গে যেন একাত্ম হয়ে পড়েছিলাম। প্রেমের ঠাকুর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও তার ভক্ত সঙ্গী বৈষ্ণব পার্ষদদের কৃষ্ণ প্রেমের আনন্দ ঘন রূপ দেখে মনের ঘোরে আবিষ্ট হয়ে সেই অসাধারণ আরতি দেখে যাচ্ছি। হঠাৎ করেই খেয়াল হলো আমার ঠিক পাশটিতেই এক অপূর্ব সুন্দরী যুবতী একই ভাবে ভাবাবেশে আরতি প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত সেই মঞ্চোপবিষ্ট বিগ্রহ মূর্তিগুলির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সবিস্ময়ে ও কৌতূহলে লক্ষ্য করি যে সেই গৌরবর্ণা রমণী দোহারা গড়নের এবং মাঝারি উচ্চতার। রঙ্গীন ও কারুকার্যময় বসনে ভুষণে অপূর্ব সুন্দর সজ্জায় সজ্জিতা। এক হলঘর ভর্তি জনসমাগমের কারণেই হয়তো তার কপালে, নাকে ও চিবুকে বিন্দু বিন্দু ঘাম মুক্তোর মতো আঁধারে যেন আলো ছড়াচ্ছে। 

সেই ভক্তিমতী সুন্দরী যুবতী বঁধুর কোন দিকে যেন কোন লক্ষ্য নেই ভক্তি বিনম্র চিত্তে নয়ন মনোহর বেশে কৃষ্ণ নামের প্রেমের বন্যায় ভেসে যাওয়া নিতাই গৌরের পবিত্র আরতি দেখা ছাড়া। কখন যে সে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, না কি আমি দাঁড়িয়েছি তার পাশে তা জানি না। ঐ ভীড়ের মধ্যে একেবারে গায়ে গায়ে লেগে না থাকলেও সেই দিব্য প্রতিমা মূর্তির রমনীর পরিধেয় বস্ত্রের আঁচল ছুঁয়ে আছে আমার শরীরে পোশাকে। তার পরিপাটি করে বাঁধা কেশরাশিও হালকা বাতাসে মাঝে মধ্যে ধেয়ে আসছে আমার মুখমন্ডলে। এমনকি তার অঙ্গ রাগের প্রসাধনীর মিষ্টি সুঘ্রান ভেসে আসছে আমার নাকে। এতো কাছে ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে আমরা দু'জন দাঁড়িয়ে যেন কতো দিনের কতো আপন, অথচ কেউ কাউকে আদৌ চিনি না। সে আমাকে লক্ষ্য করে দেখেছে কি না জানি না তবে স্বাভাবিক কৌতুহলে এক-আধবারই দুয়েক সেকেন্ড সময় তাকিয়ে দেখেছি তাকে। ঐ বিশাল মন্দিরের সুবিস্তৃত প্রাঙ্গণে দেশী বিদেশী হাজার মানুষের ভীড়। দেশের বা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এমনকি বিদেশিনী ইস্কনের ভক্ত শিষ্যা সহ কতো না আকর্ষণীয় চেহারার বিভিন্ন বয়সের নারী ছড়িয়ে আছেন তাদের মধ্যে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ হয় বিশেষ ধরনের মানে স্পেশাল। এই পার্শ্ববর্তী যৌবনদীপ্তা নারীও তেমনি এক অনন্য সাধারণ। যেন কোন দীপশিখা, অন্ধকারেও দীপ্যমান। তার অপূর্ব অঙ্গ সৌষ্ঠব, দেব দুর্লভ দ্যূতির জন্যই কি না জানি না, এতো মানুষের মধ্যেও ঐ ভীড়ে শুধুমাত্র তার দিকেই দৃষ্টি পড়া মাত্র এক অনাস্বাদিতপূর্ব স্নিগ্ধ আকর্ষণ অনুভব করেছি। তারপর যতোটুকু আলগা দৃষ্টি গেছে আমার সে শুধু সেই ভুবন মোহিনী রমনীর প্রতিই, আর কারোর দিকে নয়। অদ্ভুত ব্যাপার, এতোটা সময় আমরা কি যে জাদুর মায়ায় মোহাবিষ্ট হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে এক জায়গায়। সরেও যাচ্ছি না কেউ কারোর কাছ থেকে। তবে এসব সত্ত্বেও ঐ সমগ্র ভক্তমন্ডলীর দেবতার প্রতি ভক্তি প্রেমের ভাব সমুদ্রের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে আমিও কোন ব্যাক্তি মানবীর প্রতি অনুভূতি শূন্য হয়ে দিব্যি নিশ্চিন্ত নির্বিকার ছিলাম আত্মসমাহিত অবস্থায় দীর্ঘ সময়। সত্যি বলতে এমন এক প্রেম মাধুর্য্যময় পবিত্র মন্দিরের নব বৃন্দাবনের শ্রী অঙ্গনে দাঁড়িয়ে কোন মানব মানবীর প্রতি ব্যাক্তিগত আকর্ষণ অনুভব করাও রীতি বিরুদ্ধ অধর্মের সমতুল।

শুনেছি কৃষ্ণের প্রেমিকা শ্রীরাধা ছিলেন গৌরাঙ্গী, অসাধারণ সৌন্দর্যময়ী, খানিক বেঁটে বা মাঝারি উচ্চতার। ইনিও যেন ঠিক সেই রকম দেখতে, শান্ত, সুখী, মধুর ভাবের। দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। হঠাৎ কেমন একটা অনুভুতি হলো, আচ্ছা স্বয়ং সেই রাধা, না কি তার অসাধারণ সুন্দরী কোন প্রিয় সখী নেমে এসেছেন বিগ্রহ মঞ্চের থেকে আমার মতো ভক্ত প্রেমিককে খানিক সান্নিধ্য সু
ধায় সিক্ত তৃপ্ত করতে! অপূর্ব সুন্দরী সেই অচেনা, ক্ষণিক সঙ্গীনীর চেহারার মধ্যে কেমন দিব্য ভাব যেন সত্যি সত্যি কোন দেবী মূর্তি। না, এই মোহাবিষ্ট স্থবিরতা থেকে মুক্ত হয়ে এবার বরং দেখি কোথায় স্ত্রী ও ছেলে রয়েছে এই ভীড়ের মধ্যে। আর দেরি না করে বেরিয়ে আসি পাতলা ভীড়ের দিকে। সেই রমনীও আমার সরে যাওয়ার চিন্তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই যেন ঠিক তার পরেই ঐখান থেকে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যান আরতির শিখা নিতে। 

পিছনে খুঁজে পাওয়া যায় আমার স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে। মজার ব্যাপার হলো যে ঐ ঘটনার পরের দিন যখন একটা দলের সঙ্গে আমার স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে নব নির্মিত বিশাল চন্দ্রোদয় মন্দিরে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলাম এবং মন্দিরের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিলাম সেদিনও অবাক হয়ে লক্ষ্য করি যে ঐ রকম গৌরবর্ণা খানিক খাটো আকারের  এক হিন্দুস্তানী যুবতী গৃহবধু অল্প ভীড়ের মধ্যে মাঝে মধ্যেই কিভাবে যেন আমার পাশটিতেই এসে পড়ছে। এমন কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। এ কি তবে প্রেমের ঠাকুর রাধা কৃষ্ণের ভক্তের প্রতি অযাচিত অপূর্ব কোন দৈবী প্রেম? যেভাবে হোক আনন্দ দেবার ছলে কোন নূতন লীলা খেলা, কে জানে!






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪