ভ্রমণ কাহিনী



পালানোর পাঁচকথা: কেন্দুঝর-গোনাসিকা : পর্ব - খ

মা ন বে ন্দ্র না থ  দ ত্ত


কথা কওয়া ছিল ড্রাইভারের সঙ্গে। সকাল আটটায় তিনি ট্রাভেলার গাড়িতে ২৮ কিমি তফাতে বালেশ্বর স্টেশনে পৌঁছে দেবেন। 

চমৎকার মসৃণ পথে চলতে চলতে দু'পাশের গ্রাম্য শ্যামল দৃশ্যাবলি বেশ লাগে। ওড়িশার পরিবেশের সঙ্গে বাংলার মিল আছে। খেতজমি আর এক-আধ টুকরো জঙ্গল কি পুকুর দেখে কেটে গেল ছোট্ট জার্নিটা।

স্টেশনের বাইরে উপাদেয় লুচি-সবজির স্বাদ নিয়ে হাঁটা শুরু। কিমি দেড়েক বাদে রেললাইন পার করে বাসস্ট্যান্ড। সওয়া দশটার বাসে বারিপদার উদ্দেশে রওনা হওয়া গেল। নামে এসি, ভাড়া এসির। কামে নন-এসি। খারাপ আছে।

বাইরে মুখ রেখে মেলাচ্ছি বহু বছর আগেকার দেখা দৃশ্যের সঙ্গে। পরিবর্তন ঢের। উন্নয়ন ঢের। শুধু সেই সবুজালি, সেই "অবারিত মাঠ গগনললাট'' কার পদধূলি চুম্বন করছে দুর্বোধ্য। ধানখেতের ধারে শান্ত পল্লিগৃহ বা হঠাৎ হঠাৎ ওড়িশার আদর্শ মন্দিরের ছোট ছোট কাঠামো চোখে পড়ছে না। বড় জাঁকের মন্দির, অট্টালিকা, গ্যারেজ, ঝকঝকে শো-রুম, মল হরদম জানলায় ভাসছে। বাইক, গাড়ি, লোকজনের তো সংখ্যা নেই।


এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিটে ৫৯ কিমি পর বারিপদা এসে গেলাম। কেন্দুঝর যাওয়ার গাড়ি এখানেই মিলবে। বালেশ্বর থেকে ট্রেনে ভদ্রক বা যাজপুর-কেন্দুঝর স্টেশনে নেমেও গাড়িতে যাওয়া সম্ভব। আমরা বাসপথ পছন্দ করলাম।

টিকিট কেটে লাঞ্চে যাই লাগোয়া হোটেলে। সাড়ে  বারোটায় বাস ছেড়ে ছুটল। ১৬৩ কিমি পেরোতে সময় লাগবে।

বম্বে রোড ধরতেই নস্টালজিক হয়ে পড়লাম। বহু বছর আগে একজনের স্কুটারে এখান থেকে বাংরিপোসি গিয়েছিলাম। ভারী ভাল জায়গা!

দু'পাশে চেয়ে কিছুই চিনলাম না। গাড়ি এগিয়ে পাহাড় নিল। একটু উঠে বনদুর্গা বা রঙ্কিনী দেবীর মন্দির। সেই রহস্যের জঙ্গুলে পরিবেশ উধাও। জৌলুস বাড়ছে। বনভূমি সংক্ষেপ হচ্ছে। 

চা-জিরেন পেলাম ৯৬ কিমি পর যোশিপুরে। ফাঁকা ফাঁকা সবুজ প্রকৃতি দু'পাশে। মাঝেমধ্যে গ্রাম-জনপদ। বাঁয়ে একটা পথ চলে গেছে করঞ্জিয়া। চেনা চেনা নাম। খিচিং কাছাকাছি। সবখানে পা রাখতে সাধ জাগে। হয় না, সব হয় না। 

ময়ূরভঞ্জ জেলা পার করে কেন্দুঝর জেলার ভিতরে ঢুকে গেলাম। কেন্দুঝরকে কেওনঝড় বলে চিনতাম। ওটা ইংরেজি জিভে হয়েছে।
 
ছ'টা বাজল নামতে। অন্ধকারও নেমেছে। চা-কাপ হাতে দোকানে হোটেলের খোঁজ করতে মালুম হল, ওসব শহরের কেন্দ্রে। এক-দেড় কিমি তফাতে। অটো ছিল। আমরা অভ্যেসমতো হাঁটা লাগালাম আলো-অন্ধকারের রাস্তায়। 

শহরের জেল্লা চোখে পড়তে ভরসা হল, ঠাঁই জুটবে নিশ্চিত। কিছুই জেনে-বুঝে আসিনি। কতদিন হয়নি! অতএব বেরোই তো আগে। তারপর যা হয় দেখা যাবে।

ঠাসা দোকান-বাজার, গলিপথ-রাজপথ ঢুঁড়ে যাচ্ছি পিঠে স্যাক বসিয়ে। যাকে-তাকে পুছি, রাতে থাকার হোটেল...। 

দিশা নেই। কানাগলিতে একটা হদিস মিলল, তো কর্মকর্তা মিলল না। কেউ নেই। আশপাশের জনেরা হরেক রকম তথ্য দিচ্ছে। 
অনেকটা সময় গেল। একজন একটার সন্ধান বাতলাতে নির্দেশিত পথে দেখতে দেখতে জমজমাট পূজামণ্ডপ পেরিয়ে এক চৌরাস্তার মুখে এসে পেয়ে গেলাম। এখান দিয়েই খোঁজা শুরু হয়েছিল।

হোটেল চক্রধরে দু'রাতের আশ্রয় পাকা হল। রাস্তার উপরেই। শুধুমুধু হয়রান হলাম।

ডর্মিটরিতে আরও একজন আছেন। কফি বানিয়ে অফার করতে নিলেন না। তপন জানতে চাইল, আমাদের বকবকানিতে তাঁর অসুবিধা নেই তো। সহাস্যে "একদম না। আপনাদের কোনও অসুবিধা নেই তো?" বলে গ্লাস তুলে ধরলেন।
—"নিশ্চিন্তে খান, নো প্রবলেম।"
মনে মনে বললাম, "বমি কোরো না আর ভাট বোকো না বাপু।" হয়রানি আর মদাল, মদ খেলে 'মদাল' শব্দটা বন্ধুবৃত্তে অ্যাক্সেপটেড। মাতাল সবাই হয় না, আর মদ্যপ, মদ্যপায়ী বড্ড যেন অসম্মানকর। তো হয়রানি আর মদাল একঘরবাসীর জন্য কোনও আক্ষেপ নেই।
পঞ্চলিঙ্গেশ্বর সেরে কেন্দুঝরে এসে মূল লক্ষ্য পূর্ণ হতে চলেছে, এইটেই ঢের। যাব গোনাসিকা। নামটা খানিক খটোমটো লাগে বটে! কিন্তু জায়গাটির বৈশিষ্ট্য চমকপ্রদ। আসছি সে কথায়। আপাতত নৈশাহার। উল্টোদিকের রেস্তোরাঁয় বলা আছে।

সকাল সকাল বেরোনোর প্ল্যান ছিল। থমকে গেল বৃষ্টির জন্য। পুজোর মধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি। বেশ জোরেই এল।

রেডি হয়ে অপেক্ষায় থাকলাম। একটু ধরলেই বেরোব ছাতা সঙ্গী করে।

রাস্তা শুনশান বৃষ্টির কারণে। অটো চাই। স্ট্যান্ডে গেলাম। বুক করতে হবে। গোনাসিকা যাওয়ার কোনও রুট গাড়ি  নেই। পরে জেনেছি, একটি চলে সারাদিনে। তা ছাড়া বাসে গেলেও হাইওয়ে থেকে অনেক পথ।

দামাদামি চলছে। ধারণা দিয়ে রেখেছেন হোটেল মালিক। টিপটিপ অবিরাম ঝরনের মধ্যে ব্যবস্থা হল। তিরিশ কিমি'র জার্নি। ছ'নম্বর হাইওয়ে ধরে ভেজা পিছল পথে অটো ছুটছে। পাহাড়ি উচ্চাবচ কখনও। কখনও সবুজ আবাদি প্রান্তর।

বড় রাস্তা থেকে বাঁয়ে মুড়তে পথ এগিয়েছে দু'ধারে অরণ্যের হাত ধরে। হালকা ধারাজলে গাছপালা প্রকৃতি মনোরম, স্নিগ্ধ। ল্যান্টানা ক্যামারা গাছের বড় বড় ঝোপ। ফুলে ঠাসাঠাসি। ভাল লাগছে। ভাল লাগছে এক ব্যতিক্রমী জনজাতির গ্রামে যাচ্ছি বলে।

বিনবিনে বৃষ্টিদানা ঝরেই চলেছে। আমাদের অটোযানও চলেছে বনপথ ধরে।

এলাম কি? একটা-দুটো ঘরবাড়ি। পাকা, কাঁচা। সরকারি নির্মাণ দু'একটা। পেলাম এক গাঁও। নাম গুপ্তগঙ্গা। গোনাসিকার লাগোয়া। তবে এও গোনাসিকা পাহাড়ি এলাকার ভিতর পড়ে।।


অটোচালক গ্রাম পেরিয়ে খানিকটা এগিয়ে একেবারে নদীর উৎস তথা মন্দিরের কাছে গিয়ে ঝোপজঙ্গলের দেশে দাঁড়ালেন। উঁচু জায়গাটায় মিনিট পাঁচেক আরও উঁচুতে হেঁটে গন্তব্য। মেলা-পুজো হয়। অঞ্চলে মান্য দেবীস্থল। তীর্থপথিকদের জন্য বাঁধানো সিঁড়ি রয়েছে অনেকগুলো। পঞ্চলিঙ্গেশ্বর এর মতো। সংখ্যায় কিছু কম। টিলা-পাহাড়-লতা-গাছগাছালি সর্বত্র। ডানদিকে ঢালু। তার তলদেশে লুকোনো নদী।

হ্যাঁ, গোনাসিকার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যও জনজাতির মতো চমকপ্রদ। গো এবং নাসিকা শব্দের সমন্বয়ে গোনাসিকা। জায়গার অবস্থান ওড়িশার কেন্দুঝর জেলায়। গোমুখে গরুর মুখনিঃসৃত ধারা ভাগীরথী বা গঙ্গা। গোনাসিকায় গরুর নাসারন্ধ্র-নিঃসৃত ধারা বৈতরণী। ওড়িশার অন্যতম প্রধান ও পুরাণখ্যাত নদী।

গোমুখের মতো হিমবাহ নেই। তবে নদী প্রকাশিত হয়ে কয়েক মিটার এগিয়ে পাথর-নুড়ি-বালি ও লালমাটির অতলে হারিয়ে গেছে। গিরিপথে অন্তঃসলিলা নদী পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে দেড় কিমি দূরে। সেখানে প্রবাহ ঝরে পড়ছে ব্রহ্মকুণ্ডে। নদীর এই অদৃশ্য অংশকে বলে গুপ্তগঙ্গা।

দুই উৎসমুখে দুই মন্দির। ঘোর জঙ্গলের ভিতর প্রকাণ্ড গাছ-লতা-গুল্মের লাগোয়া। দ্বিতীয়টি গ্রামের কাছাকাছি। মন্দির, জলকুণ্ড পাকাপোক্ত। মেলা-উৎসবে জমজমাট হয়।‌‌ পুণ্যের আশায় দূরের লোকজন আসে যথেষ্ট।


সিঁড়ি বেয়ে সবুজ উপত্যকায় আলোছায়ার জাফরি পেরিয়ে ছোট্ট মন্দিরদ্বারে পৌঁছলে মূল উৎস দেখা যায়। ফুল বেলপাতা চেলিতে মুড়ে রাখা হয়েছে। গো-নাসিকা থেকে জল ঝরছে। তবে তার অবিকল আকারে মানুষের হাত আছে বলেই মনে হল। পূজ্য বলে সযত্ন সংরক্ষণ।
একটি তথ্যে জানা যাচ্ছে, ব্রিটিশরা এই বনাঞ্চল অধিগ্রহণের সময় একটি ছিদ্রপথে জল, অন্যটিতে বালি নির্গত হত। এখন দু'টিতেই স্বচ্ছ জল।

রহস্যময় পরিবেশে বোল্ডার, জলধারা আর ঝোপঝাড়ে কিছুক্ষণ চরে ফুরফুরে লাগল। ছোটখাটো ট্রেকিং বনমধ্যে বেশ করা যায়। সময়াভাব। তায় বুক্ড অটো। শিশু বৈতরণীর জল পান করে নেমে আসি।

অটো চলল অন্য উৎসমুখে। এক-দেড় কিমি গিয়ে থামল মন্দির চত্বরের কাছে। গোনাসিকা বোর্ড সামনে। দু'চারটে অস্থায়ী দোকান। চা-বিস্কুট আর পূজাসামগ্রীর। বাড়িঘরদোর কাছেপিঠে নেই।

ব্রহ্মেশ্বর মহেশের মন্দির। শৈলী আহামরি লাগেনি। পাথর-বাঁধাই চত্বর পেরিয়ে জলকুণ্ড। সেও তীর্থার্থীদের জন্য আষ্টেপৃষ্টে কংক্রিটাইজড্। একধার দিয়ে ঝরছে অনবরত বৈতরণী। সখিপুতুল খাড়ানো আছে। পিছনপথে ঘুরেফিরে দেখা হল। বিজন বনপরিবেশ।পাখি-পোকাদের ডাকাডাকি চারপাশে।

অটোয় উঠে চা পিয়ে এবার গ্রামের দিকে।

বেশি যেতে হল না। গ্রামের ভিতর দু'কদম হাঁটতে মন করল সবার। সত্যি হল, এটাই বাসনা ছিল খুব। কারণ স্থানীয় আদিজন।

ওড়িশার কেন্দুঝর জেলার গোনাসিকা‌ হিল অঞ্চলে যে অন্যতম প্রাচীন জনজাতির বাস, তাদের 'জুয়াঙ্গ' বলে। ইংরেজিতে 'জুয়াং'। ভারতবর্ষের আর কোথাও জুয়াঙ্গ নেই। এখন অবশ্যি অনতিদূর ঢেনকানলে দু'একটি বিচ্ছিন্ন জুয়াঙ্গ জনপদ গড়ে উঠেছে।

অস্ট্রোএশিয়াটিক জাতিগোষ্ঠীর জুয়াঙ্গরা ব্যতিক্রমী ধরনের। প্রকৃতিপূজায় বিশ্বাসী। প্রাচীন 'অ্যানিমিস্টিক' বা সর্বপ্রাণবাদ বিশ্বাসের মূলে। জুয়াঙ্গদের নিজস্ব উপাস্যদের সঙ্গে হিন্দু দেবদেবীর যথেষ্ট মিলের কারণে তারা মূলত হিন্দু, এমন ধারণা আছে এবং তাকে মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা বর্তমান। যদিও মুন্ডা সাঁওতালদের নয়টি জাতির অন্যতম জুয়াঙ্গরা। এদের স্বাধীন ধর্ম 'সরনা'। সরকারের কাছে স্বীকৃতি চেয়ে দাবি-তদবির চলছে, যাতে সরনা কোড আদায় হয়।

এখন জুয়াঙ্গরা সংখ্যায় ছাপ্পান্ন হাজারের আশপাশে। এরা প্রধানত সূর্যোপাসক। সঙ্গে গাছ পাহাড় নদী ঝরনা এদের পরমপূজ্য। পূজ্য বৈতরণী তথা গুপ্তগঙ্গা নদী। নিজস্ব ভাষার নামও জুয়াঙ্গ। এককালে শুধু বৃক্ষপত্রই ছিল পরিধেয়। পাতার পোশাক ব্যবহার করার কারণে 'পাতুয়া' নামে পরিচিতি ছিল। আজ সময়ের সঙ্গে সে-সব অতীত হলেও নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে পল্লবের বিশেষ স্থান রয়ে গেছে। পশুনৃত্য জুয়াঙ্গদের প্রিয়। ভারতে আদিবাসীদের সেবা ও উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ জন্মসূত্রে ব্রিটিশ, কর্মসূত্রে ভারতীয় ভেরিয়ার এল্যুইন ১৯৪৩ সালে জুয়াঙ্গ নারীদের ময়ূর, হরিণ, হাতি ও শকুনি নৃত্যের শৈলী প্রত্যক্ষ করে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন।

তাঁর আত্মজীবনী 'আদিবাসী জগৎ' গ্রন্থে ভেরিয়ার জানাচ্ছেন, ১৮৭১-এ ব্রিটিশ অফিসাররা 'পাতুয়া' জুয়াঙ্গদের পোশাকবিধি বদলাতে চাপ দেয়। এক সভা ডেকে দু'হাজার বস্ত্র বিলানো হল এবং গাছের পাতা জড়ো করে দেওয়া হল পুড়িয়ে। এই ঘটনা জুয়াঙ্গদের কাছে বিভীষিকার মতো। তাদের পবিত্র পাতা পোড়ানোর করুণ স্মৃতি রয়ে গেল দীর্ঘকাল। লেখকের মূল্যায়ন, যারা পাতা ব্যবহার করত, তারা রীতি বদলে পোশাকের নামে অস্বাস্থ্যকর নোংরা ছেঁড়া ন্যাকড়া পরায় অভ্যস্ত হল। তবে 'সভ্য' বানাবার জুলুম-ভরা প্রয়াস কিন্তু তাদের কষ্টকর ও অভাবী জীবনধারা বদলাতে পারেনি। 'আদিমতম জনগোষ্ঠী' জুয়াঙ্গরা হতদরিদ্র।

নৃতাত্ত্বিক নির্মলকুমার বোস তাঁর 'Tribal Life in India'' বইতে বলেছেন, 'miserably poor'। জুয়াঙ্গরা নাচগান, মাদল বাজিয়ে একটা গোটা ঝকঝকে চাঁদনি রাত কাটানোয় সকালে তিনি এক বৃদ্ধের কাছে জানতে চান, কীভাবে না ঘুমিয়ে নাচগান করে রাতটা কাটাতে পারলেন। নির্মলবাবু যেমন লিখেছেন, "....elderly Juang replied, 'We have enough sorrow all through the day. Why should we waste the night also in brooding over those sorrows?' It was a wise statement." বর্তমানে খানিকটা অবস্থান্তর হয়েছে। গ্রামের চেহারায় কিঞ্চিৎ ভিন্নতা। সরকারি হরেক প্রকল্পের বোর্ড-বিজ্ঞাপন চোখে পড়বে। যদিও এমন বলার কারণ নেই যে, তাদের অভাব ঘুচেছে। বেশ ক'জন যুবক আমাদের জানিয়েছেন, তাঁরা শুদ্ধ বেকার। চাষবাস, শিকার, ছাগল-গরু পালা আর জঙ্গল-নির্ভর জীবনযাত্রার পরম্পরা প্রবহমান।

একালের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পাশাপাশি জুয়াঙ্গদের নিজস্ব সমাজশাসন পদ্ধতি আছে। আছে প্রশাসনিক কাঠামো। তাতে প্রধান, নাগম, সর্দার, নাইক, অধিকারী, ডাঙ্গুয়া'র মতো পদক্রম বর্তমান।
গ্রামকেন্দ্রে থাকে চিত্রিত মন্ডঘর, গ্রামসিরি। দেবতার থান। এদের ধর্মদেওতা-ই সূর্যদেবের রূপান্তর। প্রকৃতিদেবীকে বলে বসুমতীমাতা। কালাজাদু, মোরগবলি প্রচলিত। পুরুষতান্ত্রিক জুয়াঙ্গ-সমাজে বহুবিবাহ ক্বচিৎ।

সীমিত সময়ে বিস্তৃত জানার সুযোগ ছিল না, ইচ্ছে ছিল। গোনাসিকা অঞ্চলের ভিতরে গুপ্তগঙ্গা ছোট গ্রাম। খানিকটা খানিকটা দেখে-জেনে ভাল লেগেছিল বলে, ভ্রমণকথায় এত লিখে ফেললাম।

ইতিউতি ছবি তুলছি। দু'একটা চমৎকার স্মরণযোগ্য মুহূর্ত না-চাইতে জুটে যায়। একজন তরলদ্রব্য-গুণান্বিত তাঁর ভাষায় কী যে এত বলে গেলেন কিচ্ছু বুঝিনি। তবে হাসিমুখে হুঁ-হ্যাঁ করে বোঝাতে হয়েছে, তাঁর যাবতীয় বক্তব্য খুব মন দিয়ে শুনেছি।

এইটুকুনি এক শিশু বাবার কাছে গরুর দড়ি ধরার কায়দা শিখে নিচ্ছে। স্বল্পমুদ্রাসম্বল কিশোর ‌খরিদ্দারের দুর্জ্ঞেয় দৃষ্টি প্রায়শ দেখতে পাই।

দারুণ লেগেছিল সরল শিশুযুগলের হঠাৎ-মিলে-যাওয়া সলাজ আত্মগোপনের প্রিয় ঝলকটি। স্নেহ, ভালবাসা, মজা, পরিচ্ছন্ন আনন্দ এবং বিব্রত করার জন্য মৃদু অন্যায়বোধ মনকে আচ্ছন্ন করে আছে এখনও। দিদি সুমুখে আয়না বসিয়ে একাগ্র মনে কেশচর্চা করছিল। পাশে ভাই। ক্যামেরা তুলতেই সেই কন্যে ভারী লজ্জায় শান্ত ভাবে গুটিয়ে গেল। অনুরোধেও মুখ ফিরাল না যখন, ভাইটিও জিজ্ঞাসু হয়ে পড়ল। বড় স্নিগ্ধ সে ক্ষণ!

বস্তুত, ভ্রমণ মানে জল-পাহাড়-গাছ-প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ইতিহাস-কৃষ্টির হাল হকিকত জানার ইচ্ছেটাও জুড়ে থাকে। অসম্পূর্ণ ভ্রমণে আগ্রহ নেই। রবীন্দ্রগান কানে বাজে যে! "আমি সব নিতে চাই সব নিতে চাই।" তাই খুবই শান্তিপ্রিয়, বন্ধুবৎসল, প্রকৃতি-সংস্কৃতিপ্রেমী জুয়াঙ্গদের গ্রামে আবার এসে সময় কাটানোর স্বপ্ন নিয়ে ফেরার পথ ধরি।

সেই ল্যান্টানা ক্যামারার বিপুল জঙ্গল ফুঁড়ে অটো ছুটে এসে দাঁড়াল বড় সড়কের মোড়ে। গাঁয়ে খাবার দোকান পাইনি।

এখানে ভাঙাচোরা টিন-পলিথিনের দোকানে শুধু ভাজাভুজি। বেশ, খিদে পেটে ও-ই সই।। এই বড় বড় আলুর বোমের মতো চপ, আরও বড় ফুলুরি টাইপের স্থানীয় 'বুলারি'। সঙ্গে আলুমটরের তরকারি। ড্রাইভার দাদার উৎসাহে যেমন খুশি পাঁচজনে খাওয়া হল। অস্বাভাবিক রকমের কম দাম নিলেন দোকানি। যা খেয়েছি বারবার বলেও এক হিসেব! —কীভাবে দিচ্ছেন? সবিনয়ে জানালেন, এর বেশি নিলে এখানকার লোক কিনতে পারবে না।

—"আপনার চলে এতে? কাঁচামালের দাম তো সবখানে প্রায় একই!"

সামান্য মার্জিনে ব্যবসা করে কোনওরকমে চালান মানুষটি। অর্থাৎ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম। ব্যবসায় লাভও কম। কম নিয়েই এঁদের দিন গুজরানো। খাওয়ার গল্প শোনানোর মানে নেই। কিন্তু যে সত্য প্রত্যাশিত নয়, তা প্রকাশিত হলে বিস্ময় জাগে। পঞ্চলিঙ্গেশ্বর চকেও ক'বছর আগে এমন অভিজ্ঞতা লব্ধ হয়েছিল। জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পটে খাবারের দাম সবাই জানি।  একটা রুটিও দশ টাকা। ঠিক-বেঠিক বিচারে যাওয়া উদ্দেশ্য নয়। স্পষ্টত, ওইসব অঞ্চলের স্থানীয়রাও ওটা ব্যয় করতে সক্ষম। খুব শুনি, বাংলায় কি কলকাতায় খাবার খুব সস্তা। এক কাপ চা এখনও পাঁচ-সাত টাকায় বেশ মেলে। হঠাৎ দাম বাড়লে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তা হলে, এখানে কি আমাদের গড় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দুর্বলতর? এসেই পড়ে এমন যুক্তি। প্রতিযুক্তি, কুযুক্তি ঢের আছে। ইকনোমিক্সের কূটকচালি নয়। যার মুখোমুখি বেরোলেই হতে হয়, তা-ই লিখে ফেললাম। দ্বিমত-বহুমত থাকতে পারে।

কেন্দুঝরের হোটেলে ফেরার পথে বড়া ঘাগরা ড্যাম আর সানা ঘাগরা দেখা হল। উন্নয়নের হাত ছুঁয়েছে প্রকৃতির অবয়ব। সুতরাং যেমন হয়ে থাকে। বিশেষ আলোচ্য নয়।
  
রাউন্ড ট্রিপ ভারী পছন্দের। শেষ পর্যন্ত যা দেখি, নতুন। ঠিক হল, পরসকালে বাস ধরে যাওয়া হবে যাজপুর-কেন্দুঝর রোড স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা। সীতাভিঞ্জি যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। হল না। বরং মাঝপথে ঘাটগাঁওয়ে বাস থেকে দেখা হল তারিণীদেবীর মন্দির। ওড়িশায় এদিককার জনপ্রিয় স্থান। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের ধর্মযজ্ঞ-স্থল যাজপুরের পূর্বনাম যজ্ঞক্ষেত্র, সতীপীঠ ও বিরজাক্ষেত্র। বৈতরণী-ধন্য এই জেলায় প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন আছে ইতিউতি। আপাতত সে-সব দর্শনেচ্ছা মুলতুবি থাক। বিকেল-সন্ধ্যে বাজার ভ্রমণে কাটল। এখানে গামছা বলে যেটা সংগৃহীত হল, সেটার কারুকাজ এমনই যে, কলকাতার শীতে দিব্য মাফলার বা চাদর বলে চালিয়ে দিয়েছি।

এবার লেখা থামিয়ে দেওয়ার আগে একটা অদৃষ্টপূর্ব মুহূর্তের কথা না বলে পারা যাচ্ছে না। যাজপুর-কেন্দুঝর রোড স্টেশনের কাছে হোটেলে রাত ন'টা নাগাদ মোবাইল বাজল। ভ্রমণসঙ্গীর। তাড়াতাড়ি ছাদে আসার ডাক পেয়ে ছুটি। পক্ষিসন্ধানী কিশোর আবছা আকাশে আঙুল তুলল।
অভিভূত হওয়ার মতো কাণ্ড সেখানে। হাজারে হাজারে উড়ছে এ-পাশে ও-পাশে। নিরেট কালো আকাশে সাদা ঝলক আর ঝলক।
বড় বড় গাছের মগডালে তারা শান্তির নিশিযাপনে ছিল। পুজোর সময় মানুষ তো উৎসবে। বোম-পটকা কিছু ফাটাতেই হবে অতএব। তার আচমকা সব-কাঁপানো শব্দে দিশাহারা নিরীহ পাখির ঝাঁক। কোন দূরান্তে দিনপাত শেষের আশ্রয়টুকু আর নিরুপদ্রব রইল না।

ভাল লাগল, কালোমাথা কাস্তেচরা, ইংরেজি আইবিস, একসঙ্গে আগে এত দেখিনি বলে। খারাপ লাগল, মানুষের কীর্তিতে এদের এমন হয়রানি! কীর্তিটা আমাদের গ্রাম-নগরে হলে ঝামেলা, থানাপুলিশ, দাদা-উল্টোদাদা, অবরোধ-ভাঙচুর, মিডিয়ার হল্লা, তদন্ত-শুনানি— সব দেখা যেত। ক'বছর পর এরা এখানে থাকবে কি না কে জানে!

ভ্রমণে এই একটুখানি দুঃখ বহুকাল জেগে থাকে। যেমন জেগে থাকবে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর-কেন্দুঝর-গোনাসিকার সার্বিক স্মৃতিটুকুও। 
 
[ছবি: বৈতরণী, পল্লিপথে, মন্ডঘর, সলাজ আত্মগোপন ও কালোমাথা কাস্তেচরা।
  কেন্দুঝর-গোনাসিকা, ওড়িশা। অক্টোবর, ২০২১]






হরিদ্বার ভ্রমণ

চ ন্দ্রা ণী  চৌ ধু রী


এই প্রথম হরিদ্বার এলাম। এখানে চারপাশ পাহাড় ঘেরা। বর্ষার জলধারায় সবুজে মাখামাখি হয়ে একের পর এক পাহাড়ের সারি। আকাশে মেঘ বাদলের খেলা চলছে। উত্তরাখন্ডের গাড়োয়াল হিমালয়। হিমালয়ের গোমুখ থেকে উৎসারিত হয়ে গঙ্গানদী পাহাড়ি পথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে এই হরিদ্বারে প্রথম সমতলে অবতরণ করে। এখানে  গঙ্গা ভীষণ খরস্রোতা। আমাদের হোটেলের সামনে দিয়ে  সশব্দে বয়ে চলেছে গঙ্গা। বিকেলের গোধূলির মায়াময় কমলা আলোয় গঙ্গার পারে বসে ভীষণ ঠাণ্ডা জল মাথায় মুখে হাতে ছিটিয়ে খানিকক্ষণ জল নিয়ে জলকেলি করতে করতে দূরে তাকিয়ে দেখছি দিনের শেষ সূর্যের আলো ঠিকরে পড়েছে জলে গাছে বনাঞ্চলে বাড়িতে আশ্রমে হোটেলে চারিধারে। জায়গাটা খুব শান্ত অচঞ্চল নীরব নির্জন। এরপর গেলাম গঙ্গারতি দেখতে হর কি পৌড়ি ঘাটে। এই জায়গাটাকে বলা হয় ব্রহ্মকুন্ড।  লোকে লোকারণ‍্য। প্রচণ্ড ভিড়। আমাদের সঙ্গে যাঁরা সরকারি লোকজন ছিলেন তাঁরা একটা উঁচু  সিঁড়ির উপর সুন্দর জায়গা করে দিলেন আমাদের। সেখানে বসে দেখতে লাগলাম। সবাই কী নিষ্ঠা ভক্তিতে আপ্লুত। গঙ্গা পুজো হচ্ছে মন্ত্র পাঠ হচ্ছে সবাই সেই মন্ত্র উচ্চারণ করছে।  অঞ্জলি হচ্ছে সবাই হাত জোড় করে চোখ বুজে অঞ্জলি দিচ্ছে। এরপর সন্ধ‍্যা নামার প্রাক্কালে আরতি শুরু হল। আশেপাশের প্রত‍্যেকটা মন্দিরের সামনে থেকে বিশাল ধুনুচি নিয়ে সে আরতি দেখবার মত। অন‍্যত্র যত মন্দির আছে সবখানে প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধ‍্যা দেওয়া হচ্ছে। যতদূর চোখ যায় শুধু প্রদীপ আর প্রদীপ। সঙ্গে জয় জগদীশ হরে গান বাজছে। অজস্র  ঘন্টা শঙ্খধ্বনিতে  মনটা নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। অসাধারণ লাগছে। মনে হচ্ছে পুজো পাঠ আরতি বোধহয় এভাবেই একান্ত আন্তরিকতায় সম্পন্ন করতে হয় যেখানে আত্মনিবেদনই মুখ‍্য। আমরাও গান গেয়ে দু হাত তুলে আরতির ছন্দে মেতে গেলাম। মনটা একরাশ প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল ঐ বর্ষার বাদলের মত। সজল সঘন। 


হরিদ্বারকে দেবভূমি বলা হয়। তার মানে এখানে দেবতারা সশরীরে চলমান, তা নয়। এখানকার পরিমণ্ডল  আবহওয়া এত শান্ত স্নিগ্ধ যে যাঁরা সাধন ভজন করেন তাঁদের সাধনা আরও এগিয়ে যায়।  একাগ্র মনোনিবেশে ধ‍্যান জপ পুজো পাঠ  করতে সুবিধা হয়। আশেপাশে এত মন্দির দেবস্থান আশ্রম মুনি ঋষি যে পুজোপাঠই এখানে মুখ‍্য। তাই মানুষের খুব সহজেই আত্মোপলব্ধি ঘটে যায়। আমাদের শাস্ত্রে বলা হয়েছে আমিই সব। অহং ব্রহ্মাস্মি। যজুর্বেদের বৃহদারণ‍্যক উপনিষদে পাওয়া যায়। আমার জন‍্যই এই জগত। আমিই আমার মত করে আমারই কারণে আমার চারপাশের জগত সাজিয়েছি। এই জ্ঞানলাভ  খুব  সহজ ব‍্যাপার নয়। কিন্তু  যাঁরা একটু অন‍্যরকম, শাস্ত্র জানেন তাঁদের কাছে এই জায়গা দেবভূমিই বটে।   এখানকার পরিবেশ মানুষকে আধ‍্যাত্মিক করে তোলে যেমন আমরা বলে থাকি ছোটবেলার পরিবেশ মানুষকে অনেকটা প্রভাবিত করে থাকে। এখানেও তেমনটি। এখানে এসে সঠিকভাবে সাধনভজন করলে ঈশ্বর প্রাপ্তি ঘটে অর্থাৎ জগতের মধ‍্যে ব‍্যপ্ত আছেন তিনি। প্রত‍্যেকটি প্রাণী জড়বস্তুর মধ‍্যে পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি ভালমন্দ পাপপুণ‍্য সবকিছুর ভিতর তাঁর অধিষ্ঠান। এই বোধ। এই আত্মোপলব্ধি হলে তখন মন্দির মসজিদ গীর্জায় বা কোনো নির্দিষ্ট মূর্তিতে  ঈশ্বর খুঁজবো না। জীব জগত প্রকৃতি ভালমন্দ পাপপুণ‍্য আলো অন্ধকারেও তাঁর স্পর্শ অনুভব করতে পারব। যেটা রবীন্দ্রনাথের ভিতরে ছিল। ছোটবেলায়
 
পিতার সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণ করেছিলেন এবং পিতা ছিলেন ব্রহ্মবাদী। তাই কবির ভিতরে খুব সহজেই সেই বোধোদয় ঘটে গিয়েছিল। তাই তাঁর প্রকৃতি চেতনা প্রেম চেতনা এবং পূজা পর্যায় মিলেমিশে একাত্ম। কেউ কারোর থেকে পৃথক নয়। হরিদ্বারে বহু পৌরাণিক গল্প আছে। এমন কত গল্প ছোটবেলায় মা ঠাকুমার মুখে শুনেছি। সেসব ঐসময়ে ভাল লাগত কিন্তু আজ যখন আমি এখানে ঘুরছি, যা দেখছি বুঝছি, আমি আমার মত করে আমার শিক্ষায় দীক্ষায় এই দেবভূমির মাহাত্ম্য খোঁজার চেষ্টা করে গেলাম।।






রামায়ণের গল্প ছড়িয়ে আছে সুবর্ণরেখা-তীরে রামেশ্বর ও তপোবনে

শ্র য় ণ  সে ন  

“দাদা, ব্রিজ তো ভেঙে গিয়েছে। আপনারা বরং ঘুরে যান গোপী হয়ে।” সুবর্ণরেখার ওপরে মরশুমি ব্রিজটা যে ভেঙে যেতে পারে, সেটা খেয়াল রাখা উচিত ছিল আমাদের। আসলে নদী পারাপারের জন্য অনেক জায়গাতেই ‘ফেয়ার ওয়েদার ব্রিজ’ থাকে, যেগুলো মূলত মাটি, বালির বস্তা, বাঁশ, কাঠ দিয়ে অস্থায়ী ভাবে তৈরি করা হয়। ওর ওপর দিয়ে সাইকেল, বাইক এবং ছোটো গাড়িই যেতে পারে। তবে বর্ষাকালে নদীতে জল বাড়লে সেই ব্রিজ ভেঙে যায়। দোষটা আমাদেরই। আগে থেকে আন্দাজ করা উচিত ছিল যে সেপ্টেম্বরে এই ব্রিজ অক্ষত হয়তো থাকবে না। সে ক্ষেত্রে লোধাশুলি হয়ে রগড়ার দিকে না এসে ফেকো হয়ে গোপীবল্লভপুরের দিকেই চলে যেতাম। 

আমরা এখন যাচ্ছি রামেশ্বর মন্দির আর তপোবন দেখতে। ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুর ব্লকে অবস্থিত এই দুটি জায়গা এখনও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে খুব বেশি পরিচিতি লাভ না করলেও ইতিহাস এবং পৌরাণিক গল্পের বিচারে এই দুই জায়গারই গুরুত্ব অপরিসীম। 


ঝাড়গ্রাম থেকে সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে গিয়েছি। বর্ষা বলে অরণ্যসুন্দরী ঝাড়গ্রাম এখন সবুজের চাদরে ঢেকেছে। সেই সবুজকে ভেদ করে লোধাশুলি পৌঁছে ৬ নম্বর তথা অধুনা ৪৯ নম্বর জাতীয় সড়ককে পেরিয়ে সোজা এগোতে থাকলাম রগড়ার দিকে। জিপিএস জানান দিচ্ছে রামেশ্বর পৌঁছোতে আমাদের আর বড়োজোর পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে। কিন্তু রগড়ায় পৌঁছেই ধাক্কা খেলাম। ব্রিজ যে ভেঙে গিয়েছে সেটা জিপিএস বলেনি। প্রযুক্তি যে সব সময় ঠিক কথা বলে না, আরও একবার প্রমাণিত হয়ে গেল। স্থানীয় গ্রামবাসীর কথামতো তাই গাড়ি ঘুরিয়ে গোপীবল্লভপুরের দিকে চললাম। 
যে সুবর্ণরেখাকে আমরা পেরিয়ে যেতাম রগড়ায়, তাকে গোপীবল্লভপুরে পেরোলাম। স্থানীয়রা এই মফঃস্বল শহরকে আদর করে গোপী বলে ডাকে। এই গোপী থেকে আরও ৪৫ মিনিটের পথ পেরিয়ে যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছোলাম, ভাদ্রের রোদ তখন মধ্যগগনে ছড়ি ঘোরানো শুরু করে দিয়েছে।   
মন্দিরকে এক লহমায় দেখলে মনে হয় যেন ওড়িশায় চলে এসেছি। আসলে মাকড়া পাথরে নির্মিত সপ্তরথ শিখরের এই দেউলে ওড়িশী শৈলীর ছাপ রয়েছে। প্রথম দেখায় মনে হবে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে এই মন্দিরের অদ্ভুত মিল। মন্দির ঘিরে বিশাল ঝামাপাথরের বাঁধানো চত্বর। চারিদিকে ফাঁকা, ধু-ধু করছে আশপাশ। তার মধ্যে অনেকটা এলাকা জুড়ে গর্ভমন্দির, ভোগমণ্ডপ, নাটমন্দির নিয়ে তিরিশ ফুট উচ্চতার মন্দিরটা বিরাজ করছে। তবে মন্দিরে এখন রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে। নতুন মার্বেল বসানো হচ্ছে। কিন্তু আধুনিক মার্বেল বসানোর যৌক্তিকতা আদৌ আছে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

এই মন্দিরকে ঘিরে লোকমুখে একটা গল্প ঘোরে। অখ্যাত রসিকমঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে, বনবাসের সময় রামচন্দ্র, সীতাদেবী ও লক্ষ্মণকে নিয়ে এখানে এসেছিলেন। এর মধ্যে শিবরাত্রি এসে পড়লে সীতাদেবী সুবর্ণরেখার বালি দিয়ে বারোটা শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন। পুজোর পরে এই দ্বাদশ শিবলিঙ্গ নদীর জলে ভাসাতে গেলে দৈববাণী শোনা যায়। ফলে রামচন্দ্র এখানে বিশ্বকর্মাকে দিয়ে মন্দির তৈরি করে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন। রামচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত, তাই এই মন্দিরের নাম হয় রামেশ্বর।
অন্য একটি জনশ্রুতি হল, মরাঠা বর্গিরা এই এলাকায় আত্মগোপন করার জন্য শিবমন্দিরটি তৈরি করেছিল। রাত হলেই সুবর্ণরেখা পেরিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে রোহিনী ও কুলটিকরি এলাকায় লুঠতরাজ চালাত। আবার স্থানীয় গবেষকদের একাংশ মনে করেন, গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের রাজত্ব বিস্তৃত ছিল দাঁতন পর্যন্ত। শশাঙ্ক ছিলেন শিবের ভক্ত। পুরাতত্ত্ব গবেষকদের একাংশের মতে, একাদশ-দ্বাদশ শতকে ওড়িশার চোল গঙ্গদেব রাজাদের আমলে মন্দিরটি তৈরি হয়। ওই সময় এই এলাকাটি ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল। সেই কারণেই এই মন্দিরে ওড়িশা শৈলীর ছাপ স্পষ্ট।


বাস্তবে কোন সময়ে, কে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা পরিষ্কার করে বোঝা না গেলেও মন্দিরটা যে বেশ প্রাচীন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। মন্দিরের নির্মাণ-চাতুর্য মন কাড়ে। গর্ভমন্দিরে কোনো জানলা না থাকা সত্ত্বেও তিনটে অঙ্গনের দরজা সমান্তরাল থাকায় সূর্যোদয় হলেই গর্ভমন্দিরে আলো ঢুকে এসে শিবলিঙ্গকে আলোকিত করে তোলে। রামেশ্বর শিব মন্দিরের গাজন উৎসব কয়েক শতাব্দী প্রাচীন। গাজন উৎসবের অনুষঙ্গ হিসেবে এখানে জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার বহু প্রাচীন রীতি আছে। এই রীতির নাম ‘অগ্নি-পাট’। চৈত্রসংক্রান্তির দিনটিতে ভক্তদের কৃচ্ছ্রসাধনের অন্তিম পর্যায় দেখার জন্য ভিড় করেন মানুষজন। হবেই তো। এ যে সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার মহেন্দ্রক্ষণ।
মন্দিরের ঠিক সামনেই অনেকগুলো সিঁড়ি আছে। সেই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলে সামনে বিশাল পুকুর। এক কালে এই এখানেই সুবর্ণরেখা প্রবাহিত হত। তারই অংশ হিসেবে রয়ে গেছে পুকুরটা। বর্তমানে নদী পিছিয়ে গিয়েছে বেশ কিছুটা। তবে মন্দিরচত্বর থেকে তাকে দেখা যায়। বর্ষাকাল বাদে অন্য যে কোনো সময়ই রগড়া থেকে গরধরা ফেরিঘাট এসে, সুবর্ণরেখা পেরিয়ে এক্কেবারে সরাসরি এই মন্দিরে পৌঁছে যাওয়া যায়। তখন ঝাড়গ্রাম শহর থেকে রামেশ্বরের দূরত্বটা অনেকটাই কমে যায়।  
রামেশ্বরে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফের যাত্রা শুরু। তবে এ বারের গন্তব্য খুব বেশি দূরে নয়। মাত্র কিলোমিটার পাঁচেক। তপোবন। 
মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে রাস্তার শোভা এই রকম ভাবে বদলে যাবে, সেটা ভাবতেও পারিনি। হঠাৎ করে গভীর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেলাম। অথচ রামেশ্বরে সে ভাবে জঙ্গল নেই। এই জঙ্গলে হাতির আনাগোনা আছে, সে কারণেই হাতির উপদ্রব থেকে গ্রামকে বাঁচানোর জন্য বৈদ্যুতিন ফেন্সিং দেওয়া হয়েছে। 


গভীর সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এক রোমাঞ্চকর যাত্রার পর পৌঁছোলাম তপোবন। গাড়ি থেকে নেমে একটা ছোটো খাল পেরিয়ে প্রবেশ করলাম জঙ্গলের ভেতর। সেখানে রয়েছে একটি আশ্রম। বড়ো মায়াবী পরিবেশটা। প্রবল গরমের মধ্যেই শীতলতা দিচ্ছে এই গাছগুলি। ভীষণ আরাম লাগছে। কয়েকজন সন্ন্যাসী রয়েছেন এখানে। তাঁদের মধ্যেই একজন আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। স্বেচ্ছায় এই জঙ্গল এবং এই আশ্রমের ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক মাহাত্ম্যের কথা বলতে শুরু করলেন। লোকশ্রুতি যে মহর্ষি বাল্মীকির দস্যু রত্নাকর থেকে মহর্ষি হয়ে ওঠার পুরো ঘটনাই ঘটেছিল এই তপোবনের  গহন অরণ্যের মধ্যে। যে ছোটো খালটা পেরিয়ে আশ্রমে ঢুকেছিলাম, সেটার নাম মালিনী নদী। আবার অনেকে এটাকে সীতাকুণ্ডও বলে। ওই সন্ন্যাসীর কথায় নিজের সমস্ত পাপ ধোয়ার জন্য এই নদীর জলে স্নান করে ব্রহ্মা এবং নারদের নির্দেশমতো ‘মরা’, ‘মরা’ নাম জপ করতে থাকেন দস্যু রত্নাকর। তার পরের কাহিনী তো আমাদের সকলের জানা। ‘মরা’, ‘মরা’, একদিন ‘রাম’, ‘রাম’-এ পরিণত হয়। নাম জপ করতে করতে রত্নাকর তত দিনে উইয়ের ঢিবিতে পরিণত হয়ে গিয়েছেন। এই ভাবেই মহর্ষি বাল্মীকির জন্ম। তার পরেই রচিত হয় রামায়ণ। এখানে মহর্ষির সমাধি রয়েছে। তার পাশেই রয়েছে সীতার আঁতুড়ঘর। বিশ্বাস, এখানেই নাকি সীতাদেবী যমজ সন্তান, লব আর কুশের জন্ম দিয়েছিলেন। একটা অখণ্ড ধুনি জ্বলছে। কবে থেকে এখানে আগুন জ্বলছে, তা কেউ জানে না। তবে এখানে কাঠ দেওয়ার রীতি আছে। আমরাও সেই রীতির শরিক হলাম। মাঝবয়সি ওই সন্ন্যাসীর গলায় গল্পটা শুনতে ভালোই লাগছিল। তবে উনিই এর পর যেটা বললেন, সেটা আরও বেশি করে মন কাড়ল। তাঁর কথায়, পৌরাণিক গল্প পুরোটাই আমাদের বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। বাস্তবে এমন কিছু ঘটেছিল, সেটা তিনিও জোরগলায় দাবি করতে পারেন না বলে সাফ জানিয়ে দিলেন। 
বাস্তবিক যুক্তি এবং বিশ্বাসের মধ্যে ফারাক তো আছেই। এত যে গল্পগাথা আছে এই তপোবনকে কেন্দ্র করে তা মন বিশ্বাস করতে চাইলেও যুক্তি সেগুলোকে খণ্ডন করবেই। কিন্তু আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে কিছুক্ষণের জন্য সেই যুক্তিকে দূরে সরিয়ে দিতে। আমাদের বাড়ির এত কাছে রামায়ণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়েছে, এটা বিশ্বাস করতে দোষের কিছু নেই। রামেশ্বর বা তপোবন, কোথাওই পর্যটকদের খুব বেশি পা পড়ে না। তবে আশা রাখি একদিন এগুলো পর্যটন সার্কিটে চলে আসবে। বাংলার পর্যটনমানচিত্রে তা বড়ো করে শোভা পাবে।






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪