প্রবন্ধ
ফ্রয়েবেলের শিক্ষাচিন্তা
ড রো থী দা স বি শ্বা স
জার্মান শিক্ষাবিদ্, পেডাগগি--- ফ্রেডরিখ উইলহেম অগাস্ট ফ্রয়েবেলের জন্ম- ২১শে এপ্রিল, ১৭৮২, স্থান- থুরিঞ্জিয়ার শোয়ার্জবার্গ রুডলস্টাড্ট। পিতা- জোহান জ্যাকব ফ্রয়েবেল, একজন অর্থডক্স লুথেরান প্যারিসের যাজক ছিলেন। মা- জ্যাকবিন এলিওনোর ফ্রাইডেরিক। ফ্রয়েবেলের জন্মের পর থেকেই তাঁর মায়ের স্বাস্থ্য ক্রমশঃ খারাপ হতে থাকে। মাত্র নয় মাস বয়সে ফ্রয়েবেল মাতৃহারা হন। পিতার মৃত্যু হয় ১৮০২ সালে।
ওবারওয়েব্যাক থুরিঞ্জিয়ার বনসংলগ্ন একটি সমৃদ্ধশালী গ্রাম প্রাকৃতিক ভেষজ গাছগাছড়া থেকে প্রাপ্ত টিংচার, বোতলজাত তেতো ওষুধ, সাবান- এসব সংগ্রহ করে এবং ফসল ফলিয়ে প্রতিটি পরিবার নিজেদের সংসার নির্বাহ করত। পুরো ইওরোপ জুড়ে বংশপরাম্পরায় এই ব্যবসা বানিজ্যপথ ধরে চলতো। এদের বলা হত রুকস্যাক ফার্মাসিস্ট। ফ্রয়েবেলের এমনই একটি রুকস্যাক ফার্মাসিস্ট পরিবারের সন্তান, যাঁর ছিলো লুথেরান খ্রিস্টান গির্জার শিক্ষা ও প্রাকৃতিক ভেষজ সম্পদের জ্ঞান। তিনি প্রকৃতির কাছে থাকতেন বলে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখেছিলেন। বাণিজ্যের জন্য ভ্রমণ থেকে অর্জিত শিল্প দিয়ে গির্জাটিকে এমনভাবে সজ্জিত করা হতো যা পরবর্তীকালে অনন্য এক নির্মানশৈলির জন্ম দেয়, অন্যান্য গির্জা সংস্কারের ক্ষেত্রে এই নির্মানশৈলি কাজে লাগে। প্রকৃতিপ্রেমিক ফ্রয়েবেল মাত্র পনেরো বৎসর বয়সে একজন ফরেস্টারের কাছে শিক্ষানবিশ হলেন। পরে এই শিক্ষানবিশী ছেড়ে গণিত ও উদ্ভিদবিদ্যায় অধ্যয়ণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮০২ সাল থেকে ১৮০৫ সাল পর্যন্ত ভূমি জরিপকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন। ১৮১৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর ফ্রয়েবেল বার্লিনে উইলহেলমাইন হেনরিয়েট হফমিস্টারকে বিয়ে করেন। তাঁদের সন্তানাদি হয়নি। ১৮৩৯ সালে ফ্রয়েবেলের স্ত্রী মারা গেলে উনি পুনরায় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ছিল--- লুইস লেভিন।
এই হল ফ্রয়েবেলের সংক্ষিপ্ত ব্যক্তিগত জীবনী। এবারে জানবো--- পেডাগগি কি? বিদ্যাশিক্ষার সাথে শৃঙ্খলার ভারি যোগ। শিক্ষাদানের প্রেক্ষাপটে কিভাবে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রদান করা হয় শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে এবং শিখনের সময় যে মিথস্ক্রিয়া ঘটে তা বিবেচনা করে তার যে অধ্যয়ন, তাকে পেডাগগি বলে। যেহেতু শিক্ষার প্রেক্ষাপট বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট দ্বারা প্রভাবিত, সেহেতু শিক্ষাবিজ্ঞানের তত্ত্ব এবং অনুশীলন উভয়েই ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়।
ফ্রয়েবেল-এর চিন্তাধারা আধুনিক শিক্ষাক্ষেত্রকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। ফ্রয়েবেলের শিক্ষাচিন্তার মধ্যে দার্শণিক, আধ্যাত্মবাদ, বৈজ্ঞানিক অভিব্যক্তিবাদ এবং মনোবৈজ্ঞানিক কর্মবাদ মিলেমিশে গেছে। তাই বোধ হয় তাঁর শিক্ষাচিন্তা এত সার্থক।
ফ্রয়েবেলের জীবনদর্শণ
ফ্রয়েবেলের জীবনদর্শণ একদিকে যেমন কান্ট, হেগেল প্রভৃতি ভাববাদী দার্শণিকদের চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত আবার অন্যদিকে ল্যামার্ক প্রমুখ বৈজ্ঞানিকদের অভিব্যক্তিবাদ দ্বারাও প্রভাবিত। ফ্রয়েবেল বিশ্বাস করতেন, মানবজীবন ও সমস্ত বস্তুজগতের মূলে আছে এক একক আধ্যাত্মশক্তি। এই শক্তির দ্বারা অন্তরের সঙ্গে বাইরের সংযোগ স্থাপন করা যায়। এই শক্তির উপর সর্বব্যাপী নিয়মানুবর্তিতা ভিত্তি করে আছে। ঐ শাশ্বত একক শক্তিই ঈশ্বর। ঈশ্বর থেকেই সব কিছুর সৃষ্টি। প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় ভাবে মনের যোগ স্থাপনের মাধ্যমেই তাঁর এই জীবনদর্শণ গড়ে উঠেছিলো। ফ্রয়েবেলের এই জীবনদর্শণ ও ভগবৎপ্রীতি পরবর্তীকালে তাঁর শিক্ষাচিন্তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে।
ফ্রয়েবেলের শিক্ষাদর্শণ ও শিক্ষার লক্ষ্য
ফ্রয়েবেলের শিক্ষাদর্শণ সাধারণ দর্শণ দ্বারা সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত। তাঁর মতে শিক্ষার লক্ষ্য হবে দুটি। যথা: ১) শিক্ষার লক্ষ্য বিশ্বজগতের ঐক্য উপলব্ধিতে সহায়তা করা: --- মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ঐক্যকে উপলব্ধি করা। তাই শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিশুকে বিশ্বজগতের ঐক্য উপলব্ধিতে সহায়তা করা।
২) শিক্ষার লক্ষ্য শিশুর সম্ভাবনার বিকাশে সহায়তা করা:--- বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী ফ্রয়েবেল মনে করতেন, শিশু সব গুণ নিয়েই জন্মায়। শিক্ষার লক্ষ্য হবে, এই সব গুণের বা সম্ভাবনার উন্মেষণ (Unfoldment). শিক্ষা বাইরে থেকে চাপানো কোনো শক্তি নয়, এটি আসবে অন্তর থেকে।
ফ্রয়েবেলের শিক্ষাচিন্তার মূল বৈশিষ্ট্য হলো: শিক্ষার সব কিছুকে একটি কথার দ্বারাই প্রকাশ করা যায়: তা হলো বিকাশ বা উন্মেষ।
তাঁর মতে শিক্ষা প্রক্রিয়ার প্রকৃতি ও লক্ষ্য হল বিকাশ। তিনি ব্যক্তির বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিলেও সামাজিক বিকাশকে অবহেলা করেননি।
ফ্রয়েবেলের পাঠক্রম:
জীবনের চরম সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য তিনি বিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয় শিক্ষাদানের কথা বলেছেন। যেমন:
১]গনিত
ফ্রয়েবেল গণিত শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কারণ: গণিত মানুষের যুক্তি-শক্তির বিকাশ ঘটায় যা বিশ্বজগতের ঐক্যের সূত্র খুঁজে বের করতে সহায়তা করে।
২] ভাষা
ফ্রয়েবেলের মতে ভাষা হল সাংকেতিক ভাব যার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে বিশ্বসত্তার সাথে একীভূত করতে পারে। তাই ভাষা শিক্ষার উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। "পড়া"-র চেয়ে "কথা বলা"-র উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কারণ প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কথোপকথনের মাধ্যমেই সম্ভব। "লেখা"কে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেননি। বিশেষ ধরণের অঙ্কন হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
৩] প্রকৃতি পরিচয়
প্রকৃতিজগত শিশুর কাছে এক বিরাট ঐক্যের সংকেত বহন করে নিয়ে আসে। এই সংকেতের দ্বারা শিশু উদ্বুদ্ধ হয়, তার নৈতিক জীবনের বিকাশ স্ব-ইচ্ছায় ঘটে। এইজন্য ফ্রয়েবেলের পাঠক্রমে প্রকৃতি পরিচয়কে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
৪] অঙ্কন
অঙ্কন দ্বারা শিশুর জ্ঞানের প্রকাশ ও সৌন্দর্যবোধের বিকাশ হয়। তাই অঙ্কনবিদ্যাকে ফ্রয়েবেল পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।
৫] মাটির কাজ
মাটির সাহায্যে বস্তু গঠনের দ্বারা শিশুর আত্মসক্রিয়তা চরিতার্থ হয়, বিভিন্ন বস্তুকে মাটির মধ্য দিয়ে রূপদান করে সে সৃষ্টির আনন্দ পায়, স্রষ্টাকে উপলব্ধি করতে শেখে।
৬] কায়িক শ্রম
আত্মসক্রিয়তা চরিতার্থ করার জন্য ফ্রয়েবেল কায়িক শ্রমকে পাঠক্রমে প্রধান স্থান দিয়েছেন।
৭] ইতিহাস ভূগোল ইত্যাদি
ফ্রয়েবেল ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান ইত্যাদি পাঠের কথাও বলেছেন এবং এই বিষয়গুলির মধ্যে অনুবন্ধ স্থাপন করে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত করার কথাও তিনি বলেছেন।
৮] নাচ গান ইত্যাদি
"গান" "নাচ" "খেলা"- ইত্যাদিকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত করার কথাও তিনি বলেছেন। এইসব কাজের মধ্য দিয়ে শিশুরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিশ্বজগতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।
৯] ধর্মীয় বিষয়
শিশুদের মধ্যে ঈশ্বর চেতনা জাগ্রত করার জন্য পাঠক্রমের মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অন্তর্ভূক্তির কথা বলেছেন।
ফ্রয়েবেলের শিক্ষণ পদ্ধতি
ফ্রয়েবেলের শিক্ষণ পদ্ধতি কিণ্ডারগার্টেন পদ্ধতি নামে পৃথিবী বিখ্যাত। "কিণ্ডারগার্টেন"- কথার অর্থ হল শিশু উদ্যান। বিদ্যালয় হল একটি উদ্যানস্বরূপ এবং শিক্ষক হলেন সেই উদ্যানের মালী। ফ্রয়েবেলের মতে শিশু তার স্বাভাবিক আগ্রহ ও চাহিদা অনুযায়ী স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের মধ্য দিয়ে শিক্ষালাভ করবে। শিশুর ভিতর আত্মসক্রিয়তা দেখা দেবে। শিশুর শিক্ষা হবে এভাবেই।
(১) খেলাচ্ছলে শিক্ষা
শিশুর আত্মসক্রিয়তার প্রকাশ হয় পরিবেশের সাথে অভিযোজন করতে গিয়ে। আত্মসক্রিয়তার বিকাশ হয় খেলার মাধ্যমে। খেলার মাধ্যমেই মানবশিশু ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে।
(২) প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষা
ফ্রয়েবেল তাঁর কিণ্ডারগার্টেন পদ্ধতিতে প্রকৃতির সাহায্যে শিক্ষা দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। শিশুকে সামাজিক পরিবেশ থেকে সরিয়ে এনে প্রকৃতির কোলে স্বাধীন করে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
(৩) বস্তুভিত্তিক শিক্ষা উপহার ও বৃত্তি
ফ্রয়েবেল কিণ্ডারগার্টেন পদ্ধতিতে বস্তুভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতি এবং হাতের কাজের মাধ্যমে শিক্ষাদান পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। বস্তুগুলোর নাম দিয়েছেন "উপহার" (Gift) এবং কাজগুলোর নাম দিয়েছেন "বৃত্তি" (Occupation).
ফ্রয়েবেল উপহার
ফ্রয়েবেল উপহার (জার্মান: Fröbelgaben) হল ছোট বাচ্চাদের জন্য শিক্ষামূলক খেলার উপকরণ, মূলত ব্যাড ব্ল্যাঙ্কেনবার্গের প্রথম কিন্ডারগার্টেনের জন্য ফ্রেডরিখ ফ্রয়েবেল এ ধরণের উপহারের ডিজাইন করেছিলেন। এই উপহারের সাথে খেলা, গান গাওয়া, নাচ, এবং গাছপালা বৃদ্ধি ঘটানো- এসব ছিলো শিক্ষার শিশু-কেন্দ্রিক পদ্ধতির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। উপহারের সিরিজটি পরবর্তীতে মূল ছয় থেকে অন্তত দশ সেট উপহারে বর্ধিত করা হয়।
ফ্রেডরিখ উইলহেলম অগাস্ট ফ্রয়েবেল-এর এক জার্মান ছাত্র ছিলেন হেনরিখ পেস্তালোজি (১৭৮২), যিনি ফ্রয়েবেলের শিক্ষানীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আধুনিক কিণ্ডারগার্টেন শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। শিশুদের অনন্য চাহিদা এবং ক্ষমতা আছে, এই ধারণার সত্যতা সম্পর্কে তিনি নিঃসন্দিহান হন এবং বলা যায় ফ্রয়েবেলের এই ধারণা তাঁর দ্বারা স্বীকৃত হয়। তিনি আধুনিক কিন্ডারগার্টেনের ধারণা তৈরি করেন এবং এই "কিন্ডারগার্টেন" শব্দটি ইংরেজি ভাষায়ও প্রবেশ করে। তিনি Froebel উপহার নামে পরিচিত শিক্ষামূলক খেলনাও তৈরি করেছিলেন।
ফ্রয়েবেল তারকা (জার্মান: Fröbelstern) হল কাগজ দিয়ে তৈরি নক্ষত্রাকৃতি সজ্জা, এটি জার্মানিতে প্রচলিত একটি ক্রিসমাস সজ্জা। ইংরেজিতে এটির সাধারণভাবে কোনো স্বীকৃত নাম নেই; এটিকে অ্যাডভেন্ট স্টার, ড্যানিশ তারকা, জার্মান তারকা, নর্ডিক তারকা, পেনসিলভানিয়ান তারকা, পোলিশ তারকা, সুইডিশ তারকা, ক্রিসমাস তারকা, বা ফ্রয়েবেল তারকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এটিকে কখনও কখনও মোরাভিয়ান তারকাও বলা হয়, যদিও মোরাভিয়ান তারকা জ্যামিতিক আকারের একটি সাধারণ বিভাগ এবং অরিগামির ষোলটি টিপযুক্ত অংশকেই বিশেষভাবে ফ্রয়েবেল তারকা বলা হয়।
বস্তুমাধ্যমে শিক্ষাদানের দ্বারা শিশুর ঘনবস্তু সম্পর্কে ধারণা জন্মে, এর থেকে গণিতের ধারণা জন্মে এবং বিশ্বপ্রকৃতির সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য সম্বন্ধে সে অবগত হয়, কাগজের সাহায্যে বিভিন্ন ধরণের জিনিস নির্মাণ করা, কাঠের কাজ, তাঁত বোনা, ছবি আঁকা- ইত্যাদিকে বৃত্তি হিসেবে নির্বাচন করেছেন। এই ধরণের কাজের মাধ্যমে শিশু নিজের সত্তাকে প্রকাশ করার সুযোগ পায়।
(৪) ছড়া ও গানের মাধ্যমে শিক্ষা
শিশু মাত্রই ছন্দ এবং সুর ভালোবাসে। গানকে তিনি দু'ভাগে ভাগ করেছেন- মায়ের গান এবং খেলার গান। তিনি সাতটি মায়ের গান ও পঞ্চাশটি খেলার গানের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেছেন। গানের উপযোগিতার দিক থেকে তাদের তিনি চারটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। ১৷ ছোট শিশুদের জন্য রূপকথার গান- এ দ্বারা শিশুর কল্পনা শক্তিকে জাগ্রত করা হয়; ২৷ অপেক্ষাকৃত বড়দের জন্য বিভিন্ন বস্তুর সঙ্গে পরিচিতি লাভের জন্য গান; ৩৷ চন্দ্র, সূর্য, তারা এবং নৈসর্গিক ঘটনাসম্বলিত গান; এবং ৪৷ নৈতিক চরিত্র গঠনের উপযোগী উপদেশমূলক গান। এইসব গান গাইবার সময় উপযুক্ত অঙ্গ সঞ্চালন করা হয় এবং ছন্দময় নাচেরও ব্যবস্থা থাকে।
ফ্রয়েবেল ও শিক্ষালয়
ফ্রয়েবেলের শিক্ষালয় একটি ছোট সমাজ (Miniature Society). বিদ্যালয়ের সমাজজীবনে বসবাসের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা জীবনের প্রয়োজনেই কৌশলগুলো আয়ত্ত করবে। শিক্ষালয় সম্পর্কে তাঁর এই ধারণা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করা হয়েছে।
শিক্ষকের দায়িত্বের নবমূল্যায়ণ
ফ্রয়েবেল বলেছেন- শিক্ষকের কাজ গতানুগতিক ধারণা অনুযায়ী জ্ঞানের ভাণ্ডারকে শিক্ষার্থীর সামনে উন্মুক্ত করা নয়, তার আত্মসক্রিয়তাকে নির্দিষ্ট পথে পরিচালনা করা।
উপসংহার তথা আলোচনা
রুশোর চিন্তাধারার সঙ্গে ফ্রয়েবেলের চিন্তাধারার মিল দেখতে পেলেও রুশোর মত ফ্রয়েবেল সমাজ বর্জনের পক্ষপাতী ছিলেন না। ফ্রয়েবেল পেস্তালাৎসীর মনোবিদ্যাভিত্তিক শিক্ষার মধ্যে যে ত্রুটি ছিলো, তাকে দূর করেছেন। ফ্রয়েবেল শিশুর শিক্ষা তার স্বতঃস্ফূর্ত কর্ম থেকে শুরু করার কথা বলেছেন। ফলে শিশুর কর্ম নির্বাচনের মধ্যে অবাধ স্বাধীনতা তিনি দান করেছেন। বৃত্তিগুলির মাধ্যমে কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষারও তিনি সার্থক প্রবর্তন করেছেন।
সাম্প্রদায়িকতা, নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ
প্র ল য় ব সু
বর্ধমানের এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া, মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করা, জীবনের তাগিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করা কবি বলে ওঠেন-
" মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়
কোনো মন্দির কাবা নাই।"
কবির বেড়ে ওঠার সময়টাতে বিশ্বরাজনীতিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঝড়। ১৯২৬ সালের তৎকালীন দাঙ্গা কবিমানসে গভীর রেখাপাত করে যার উদ্গম আমরা দেখতে পাই "প্রলয় শিখা" কাব্যগ্রন্থে-
"ভাঙ্গি মন্দির, ভাঙ্গি মসজিদ
ভাঙ্গিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত।"
যে হাতে তিনি গজল লিখেছেন সেই হাতেই ভজন, শ্যামা সঙ্গীত। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান ও করাচিতে বসবাসকরাকালীন ওনার সাথে ওমর খৈয়াম ও রুমির সাহিত্যকর্মের পরিচয়। কলকাতার কম্যুনিস্ট নেতা মুজাফফর আহমেদ ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সাহচর্য তাঁকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানবধর্মে দীক্ষিত করে। কবি লেখেন-
"তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড
গাহে স্বার্থের জয়।"
আজ থেকে ১০০ বছরেরও আগে যেভাবে উনি সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের মূলে কষাঘাত করে গেছেন তাতে সহজেই ওনাকে বিদ্রোহী যুগকবি বলাই যায়।
রক্ষণশীল মুসলিম নেতারা তাঁকে কাফের আখ্যা দিলেও তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবির স্বীকৃতি পান। তিনি ভারতবর্ষ এবং বাঙালীর প্রাণের কবি, মানুষের কবি। "অগ্নিবীণা", "সঞ্চিতা", "কুহেলিকা", "পাগল পথিক", "বিষের বাঁশী" ইত্যাদি নানা কাব্যগ্রন্থে, অজস্র গীতিকবিতায় তিনি বিশ্বমানবতার জয়গাথার অমর রচনা করে গেছেন।
এবারে আসা যাক কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথের সাথে ওনার সম্পর্কের বিষয়ে দু'চার কথায়।
একজন সঞ্চয়িতার কবি আর একজন সঞ্চিতার। বয়সের ৪০ বছর ব্যবধান যথেষ্ট হলেও সম্পর্কের আঙ্গিক ছিল বড় মধুর। ১৯১৯ সালে নজরুলের প্রথম বই ছাপা হয় আর ১৯২০ সালে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ওনাকে কবি সম্বোধন করে তাঁর বিরচিত "বসন্ত" নাটকটি উৎসর্গ করেন কারণ রাজদ্রোহের অপরাধে কুচক্রী ব্রিটিশ শাসকদের জন্য ওনাকে ওইসময় কারাবরণ করতে হয়।
গীতাঞ্জলির সব কবিতা নজরুলের কণ্ঠস্থ ছিল আর ওনার "সঞ্চিতা" কাব্যগ্রন্থ কবিগুরুকে উৎসর্গ করা।
১৯২০ সালে শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে গিয়ে নজরুল তাঁর "আগমনী" কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান। দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ১৯২২ সালে রামমোহন লাইব্রেরী হলে। সেখানে অনেক রথী মহারথীকে অগ্রাহ্য করে মঞ্চে ওনার পাশের চেয়ারে বিশ্বকবি ডেকে নেন উদীয়মান নবীন সূর্যকে। এই গুরু শিষ্যের সম্পর্ক ছিল চির অম্লান।
এইবার দৃকপাত করা যাক সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে কবিগুরুর সাথে নজরুলের ভাবনার সামঞ্জস্য কোথায় সে বিষয়ে।
১৩১৪ সনে কবি ‘প্রবাসী’ প্রবন্ধে লিখছেন- "আমরা এক দেশে, এক সুখদুঃখের মধ্যে একত্রে বাস করি, আমরা মানুষ, যদি এক না হই তবে সে লজ্জা, সে অধর্ম।"
আরো উল্লেখ করা যায় সাম্প্রদায়িক সংঘাতের দুঃসময়ে কবি কিভাবে সতর্ক করছেন আমাদের- "তর্ক করিবার বেলায় বলিয়া থাকি কি করা যায়, শাস্ত্র তো মানিতে হইবে। অথচ শাস্ত্রী হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করিয়া ঘৃণা করিবার তো কোনো বিধান দেখি না।"
পরিশেষে মৃত্যুর দিনকয়েক আগে জীবনের শেষ কবিতায় শব্দচয়ন এইরূপ-
"তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা-জালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।"
জন্মসূত্রেই একটি মুক্তি জড়িয়ে ছিল কবিগুরুকে, অন্য অর্থে আপাত বন্ধনও বলা যায়। সমাজ চিহ্নিত করেছিল যশোরের কুশারী বংশকে পীরালি ব্রাহ্মণ বলে। যশোর থেকে কলকাতা—কুশারী থেকে ঠাকুর। সাধারণ অবস্থা থেকে ধনসমৃদ্ধি, পীরালি ছাপ তো ঘুচল না। এমনকি দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করার পরেও নয়। এই ইতিহাস তো গোড়া থেকেই সংবেদনশীল মনে জাতপাতের সংকীর্ণতা নিয়ে বিরুদ্ধতা জাগাবে এটাই স্বাভাবিক। শুধু জাতপাত নয়, গোড়া থেকেই আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের মনে একটা বিরূপতা লক্ষ্য করা যায়।
জৈষ্ঠ ১৩৩৮ কবিশ্রেষ্ঠ লেখেন -
‘আমার ঠাকুর মন্দিরেও নয়, প্রতিমাতেও নয়, বৈকুন্ঠেও নয়,—আমার ঠাকুর মানুষের মধ্যে—সেখানে ক্ষুধাতৃষ্ণা সত্য, পিত্তিও পড়ে, ঘুমেরও দরকার আছে—যে দেবতা স্বর্গের তাঁর মধ্যে এসব কিছুই সত্য নয়।’
আদি ব্রাহ্মসমাজের বেদীতে অব্রাহ্মণ আচার্যের বসা উচিত কিনা এই নিয়ে বিরোধটি পাকিয়ে উঠেছিল ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দে। রবীন্দ্রনাথ তখন তত্ত্ববোধিনীর সম্পাদক। সেই পত্রিকায় বিরোধটি বিধৃত হয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথ একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছেন -
‘শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত কৃষ্ণকুমার মিত্র মহাশয়কে কোন এক বুধবার আদি ব্রাহ্মসমাজের বেদীগ্রহণ করিতে দেখিয়া আদি সমাজের একজন উপাসক ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া আমাদিগকে পত্র লিখিয়াছেন।--- বেদীগ্রহণ সম্বন্ধে একদিন ব্রাহ্মসমাজে বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানি। সে সম্বন্ধে পিতৃদেবের পত্র পাঠ করিলেই জানা যাইবে যে, অব্রাহ্মণ বা উপবীতত্যাগী আচার্য্য বেদী গ্রহণের অধিকারী নহেন এরূপ প্রস্তাব তাঁহার ছিল না। তিনি বলিয়াছেন, ব্রাহ্মণ বা অব্রাহ্মণ, উপবীতধারী বা উপবীতত্যাগী সকলেই যোগ্যতা অনুসারে বেদীর কার্য্য করিতে পারেন। এ সম্বন্ধে অপরপক্ষে যে অনৌদার্য্য ছিল তাহা তাঁহার ছিল না।’
বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধে রবীন্দ্রনাথ সক্রিয় রাজনীতিতে পরিপূর্ণ ভাবে অংশগ্রহণ করে বক্তৃতা দিয়েছেন, গান বেঁধে গেয়েছেন, মিছিলে পা মিলিয়েছেন। তবে বিপ্লবীদের আত্মত্যাগকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন কিন্তু তিনি সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করেননি।
তিনি আরো জানান -
'হিন্দু নিজেকে ধর্মপ্রাণ বলে পরিচয় দেয়, মুসলমানও তাই দেয়। অর্থাৎ ধর্মের বাহিরে উভয়েরই জীবনের অতি অল্প অংশই অবশিষ্ট থাকে। এই কারণে এরা নিজ নিজ ধর্ম দ্বারাই পরস্পরকে ও জগতের অন্য সকলকে যথাসম্ভব দূরে ঠেকিয়ে রাখে। এই যে দূরত্বের ভেদ এরা নিজেদের চারিদিকে অত্যন্ত মজবুত করে গেঁথে রেখেছে, এতে করে সকল মানুষের সঙ্গে সত্যযোগে মনুষ্যত্বের যে প্রসার হয় তা এদের মধ্যে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।’
এই আচার ও বাহ্যবিধান সর্বস্বতাকে রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছেন ধর্মতন্ত্র, মানবের নিত্যধর্মের সঙ্গে এর কোনো সংযোগ নেই।
২১ জৈষ্ঠ্য ১৩৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ হেমন্তবালা দেবীকে লিখছেন, ‘বৈষ্ণব যেখানে বোষ্টম নয় সেখানে আমিও বৈষ্ণব, খৃষ্টান যেখানে খেষ্টান্ নয় সেখানে আমিও খৃষ্টান’।
এই ভাবে বার বার সহিষ্ণুতার পক্ষে একলা দাঁড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্কিমচন্দ্রের বিপক্ষতা করেছেন। মহাত্মা গাঁধীকে গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করলেও তাঁর সব কথা মেনে নেননি। কিন্তু সেই না-মানার মধ্যেও একটি শান্ত সহনশীলতা বজায় রেখেছেন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা তাঁর ‘সত্যের আহ্বান’ আজও রবীন্দ্রনাথের সেই একলা মূর্তিটি মনে পড়ায়।
মনে পড়ে কবির রচনা -
"যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে..."
এবার নজরুল প্রসঙ্গে আসা যাক। নজরুলের সারা জীবনের সংগ্রাম ছিলো ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে। তিনি বারবার তার কবিতায়, গানে, গল্পে লিখে গেছেন যে ধর্মীয় শক্তি মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে বা পরস্পরের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে, তা ধর্ম নয় অধর্ম। সংগ্রাম করেছেন সেই অপশক্তির বিরুদ্ধে। তিনি মনে করতেন অসাম্প্রদায়িকতা মানে ধর্মহীনতা নয়, বরং সকল সম্প্রদায়ের ধর্মমতকে শ্রদ্ধা করা। কবি তাই অসাম্প্রদায়িক চেতনার মাধ্যমে বারংবার মানবধর্মের কথাই বলেছেন। কবি তাই লিখেছেন-
"মানুষেরে ঘৃণা করি
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কিতাব সেই মানুষেরে মেরে।
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! -মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;- গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”
ছোটবেলায় মুয়াজ্জিনের কাজ আর মক্তবে পড়ে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যেমন জেনেছেন আবার ঠিক তেমনি যখন লেটো গানের দলে যোগ দিলেন তখন শিখলেন জানলেন রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত আর পুরাণ।
দুটো ধর্মকেই মোটামুটি নিবিড়ভাবে জানতে পেরেছিলেন বলেই তিনি এক হাত দিয়ে লিখতে পারতেন গজল আর ইসলামি গান, আবার ঐ একই হাতে লিখতেন শ্যামা সঙ্গীত, ভজন আর কীর্তন অঙ্গের গান। পরবর্তীতে তিনি যখন প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেন তখন তিনি হিন্দু ধর্মের আরও খুঁটিনাটি বিষয় জানতে পারেন।
নজরুল তার সারাজীবনে কখনো ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি, করেছেন ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। তিনি সারাজীবন চেষ্টা করেছেন ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার আর তার কারণেই মানবধর্মের উপর তিনি বারবার জোর দিয়েছেন, বলেছেন শোষণহীন সমাজের কথা। তার মতো করে এতো সুন্দর করে এতোটা সাহস করে আর কে কবে বলেছে:
“মোরা এক বৃত্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।”
অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পর্কে লিখেছেন-
‘উপনিবেশকে আঁকড়ে রাখার মানসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুচতুর কৌশলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করেছিল ভারতবর্ষে ভারতের দুই বৃহৎ ধর্ম-সম্প্রদায় পরস্পর বিভেদে জড়িয়ে পড়েছে বার বার। এর পশ্চাতে ছিল একাধিক রাজনৈতিক দলের ইন্ধন। এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ নজরুলকে ব্যথিত করেছে। তাই তিনি সচেতনভাবে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ সম্প্রীতি প্রত্যাশা করেছেন। সত্য-সুন্দর-কল্যাণের পূজারি নজরুল চেয়েছেন সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানুষের মুক্তি। বস্তুত, সাম্যবাদী চিন্তা তাঁর মানসলোকে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ মানবসত্তার জন্ম দিয়েছে- হিন্দু ও মুসলমান বৈপরীত্যের দ্যোতক না হয়ে তাঁর চেতনায় হতে পেরেছে জাতিসত্তার পরিপূরক দুই শক্তি।’ (উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব ও নজরুলসাহিত্য, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩৬)
১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম এডুকেশন (মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা, রুদ্র-মঙ্গল) সোসাইটির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে অনুষ্ঠানের সভাপতির ভাষণে নজরুল বলেছেন:
‘ভারত যে আজ পরাধীন এবং আজো যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয়নি শুধু আয়োজনেরই ঘটা হচ্ছে এবং ঘটাও ভাঙছে তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা।’
‘হিন্দু-মুসলমান’ লেখাতেও রবীন্দ্রনাথের বরাত দিয়ে নজরুল বলেছেন, ‘যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজ কাটবে কে?’ টিকি আর দাড়ি হচ্ছে মানুষের সেই ন্যাজ। এ ন্যাজ মাথায় আর মুখে নয়, গজিয়েছে মনের গভীরে; তা থেকেই এত বিদ্বেষ।'
এভাবেই রবীন্দ্র নজরুল সাম্প্রদায়িকতা বিরোধে সোচ্চার ও সহমত প্রকাশ করে গেছেন। নজরুল সেই গুরুপ্রদৃষ্ট পথে অনায়াস গমনকালে লিখেছেন -
"ঘরে ঘরে তার লেগেছে কাজিয়া,
রথ টেনে আন, আন রে তাজিয়া,
পূজা দে রে তোরা, দে কোরবান।
শত্রুর গোরে গালাগালি কর,
আবার হিন্দু-মুসলমান।
বাজাও শঙ্খ, দাও আজান।"
অথবা
"গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহিয়ান।"
এভাবেই গুরুশিষ্যের ভাব বিন্যাসের একত্রীকরণ। রবীন্দ্রনাথ যেখানে impressionistic, নজরুল হয়ত অপেক্ষাকৃত exhibitionistic অ্যাপ্রোচে বিশ্বাসী, কিন্তু মূলভাব সাম্প্রদায়িকতার বিরোধ, ধর্মভেদের ঊর্ধ্বে মানবতার জয়গান।
১৯২৬-২৭ সালে প্রায়ই কবি চণ্ডীচরণের বাড়িতে স্থানীয় বন্ধুদের সাথে সাহিত্যের আড্ডায় মেতে উঠতেন কবি। ওই একই সময়ে কামারহাটি পৌরসভার কমিশনার বৈদ্যনাথ ঘোষালের বাড়িতে "রসচক্র" নামক এক আলোচনা চক্রে অন্যান্য কল্লোল গোষ্ঠীর কবিদের সাথে সাহিত্যের আলোচনা, ধর্মান্ধতার আলোচনা, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধের সম্ভাষণ করতেন তিনি। একবার অসুস্থ অবস্থায় বিটি রোডের প্রায় মাঝখান বরাবর হাঁটতে গিয়ে প্রায় লরিচাপা পড়ার উপক্রম হয়। ১৯৪২ সালের পর কবি ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লে উত্তরের জনপদ এবং অন্যান্য কবিদের সাথে ওনার যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে পড়ে।
আগামী ১২৫ তম পুণ্য জন্মদিবসে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী, রবীন্দ্র স্নেহধন্য, বিদ্রোহী, ধর্মনিরপেক্ষ শাশ্বত কবিকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্য নিয়ে এই ছোট্ট প্রতিবেদনের সমাপন।
কবিতা লেখা
শং ক র ব্র হ্ম
সব বিদ্যে শেখানো যায়, কবিতা লেখা শেখানো যায় না। কবিতা আসে আবেগতাড়িত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, ছন্দ মাত্রা তাল লয় ভেবে আসে না। কবি অনেক সময় তা নিয়ন্ত্রণ করেন, তার জ্ঞান বুদ্ধি শিক্ষা ও রুচি দিয়ে, সে নিয়ন্ত্রণে কবিতা অনেক সময় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
বিদেশে কবিতা লেখা শেখাবার কিছু স্কুল আছে অবশ্য, সেখানে লেখা শিখে কেউ বড় কবি হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
সুনীল গাঙ্গুলী সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত প্রমুখেরাও কৃত্তিবাস পত্রিকার পক্ষ থেকে আশির দশকে সে রকম একটা প্রচেষ্টা করেছিলেন, তা সফল হয়নি।
কবিতা লেখা যার হয় তার হয়, ভিতরের ব্যাপার (অনুভূতির তীব্র আবেগে, প্রকাশের তাগিদে)। সকলের হয় না। তাই কবি হবার প্রচেষ্টায় আজকাল বানানো কবিতার ছড়াছড়ি চোখে পড়ে।
কবিতার নিজস্ব একটা ভাষা আছে, তা আয়ত্ব করতে বহুদিন সময় লাগে, দেশী বিদেশী ভাল ভাল কবিতা পড়তে হয় বারবার, অনুসন্ধিৎসু থাকতে হয় মনে মনে, পূর্বসূরীদের লেখা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা একান্ত জরুরী। দীর্ঘদিন এ'রকম প্রচেষ্টার ফলে, তা কিছুটা আয়ত্বাধীন হয়। তারপর চলে নিজের মতো করে তার উপর পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ। সেটা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়।
যারা এ'কথা মানেন না, তাদের কবিতা লেখার প্রচেষ্টা, ছন্দ মিলিয়ে পদ্য লেখা ছাড়া আর কিছু নয়।
আক্ষেপের কথা সে'রকম লেখাই আজকাল চোখে পড়ে বেশী, যাতে কোন প্রাণের সাড়া মেলে না। মূর্তি গড়া হয় বটে, তবে তা কখনই প্রতিমা হয়ে ওঠে না। প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায় না।
কবিতা মানে তো তাই, যা সহজেই মানুষের চিত্তে চাঞ্চল্য ঘটায়, মনে করুণার উদ্রেক করে, নর নারীর বন্ধনকে মধুর করে কিংবা বিরহকে করুণ সুরে মনে অনুরণন সৃষ্টি করে এবং হিংস্র ক্রুদ্ধ যোদ্ধার মনেও সান্ত্বনা ও স্বস্তি এনে দেয়।
মানুষ কাব্যে সান্ত্বনা খোঁজে, জীবনের দিকদর্শন চায়, আনন্দ খোঁজে এই নিরানন্দময় জীবনে। নতুবা পাঠক অযথা কবিতা পড়তে যাবেন কেন, আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে, যেখানে মানসিক উপভোগের সব রকম সামগ্রীই সহজলভ্য।
বস্তুতঃ বহু শতাব্দী ধরে এ'কারণেই, কবিতা টিঁকে আছে আজও তার নিজস্ব সত্তা ও অস্তিত্ব নিয়ে। ভবিষ্যতেও থাকবে। ফরাসী কবি মালার্মে বলেছেন, 'কবি আসলে নিজের সাথে কথা বলেন, পাঠক শ্রোতারা আড়ি পেতে তা শোনেন।'
কবিতায় কবি কথা বলেন। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলেন? কবি মালার্মে কথিত, শুধু নিজের সঙ্গে? তাই যদি হবে, তবে কবি আর পাগলের বিশেষ তফাৎ থাকে না।
কবি নিজের সঙ্গে কথা বললেও, সে চায় তার কথাগুলি পাঠকের দরবারে পৌঁছে দিতে। আর তা করতে গিয়েই তাকে কবিতার ভাষার আশ্রয় নিতে হয়। আশ্রয় নিতে হয় উপমা, চিত্রকল্প, ছন্দ, রূপক, উৎপ্রেক্ষণ, ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার।
কবিতার একটা নিজস্ব ভাষা আছে, সে ভাষা ইঙ্গিতময়। আনন্দ বর্ধন বলেছেন, 'যে- বাক্যবদ্ধ থেকে নিতান্ত আক্ষরিক অর্থ ছাড়া আর কিছুই আমাদের লভ্য নয়, কাব্য বলে গণ্য হবার কোনও যোগ্যতাই তার নেই।'
অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ কবি টমাস গ্রে বলেছিলেন, কবিতা কখনও তার সমকালীন ভাষায় রচিত হয় না। কবিতাকে তিনি বিশেষ এক ধরণের ভাষার শিল্প বলে মনে করতেন, তিনি এমনও ভাবতেন যে, কবিতা হচ্ছে এমনই সুকুমার একটি শিল্প, যা তার উপাদান হিসেবে শুধু সুকুমার শব্দই দাবি করে। সমস্ত শব্দই যে কবিতায় ব্যবহৃত হবার যোগ্য, এবং যোগ্যজনের হাতে পড়লে, কোনও শব্দকেই যে কবিতার মধ্যে অনধিকার-প্রবেশকারীর মতো অধোবদন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না, এই উদার ধারণা তাদের কাছে প্রশ্রয় পায়নি।
রবীন্দ্রনাথও এই ভাবনার অংশীদার ছিলেন প্রথমদিকে। তিনি তাঁর কবিতায় কোথাও আটপৌরে শব্দ ব্যবহার করেননি, কিন্তু পরবর্তী কালে, তাঁর কবিতায় নিত্য ব্যবহার্য 'হাঁড়ি’ ‘সরা’ থেকে শুরু করে ‘গুড়ের পাটালি’ আর ‘ঝুনা নারিকেল’ পর্যন্ত এমন-সমস্ত শব্দের উল্লেখ ঘটেছে, তার কবিতায়। যদিও তিনি কবিতায় আটপৌরে শব্দ কবিতায় ব্যবহার করার পক্ষপাতী ছিলেন না।
পরবর্তী কালে ওয়ার্ডসওয়র্থ বললেন যে, শুধু সেই ভাষাতেই কবিতা লেখা উচিত, যা কিনা মানুষের নিত্যব্যবহার্য মুখের ভাষা। শঙ্খ ঘোষ যাকে বলেছেন, বাকছন্দ।
কার কাছে কবিতা কি ভাবে আসবে, সেটা নির্ভর করে কবির ব্যক্তি সত্তার উপর। তার মানসিকতা, রুচি, পাঠাভ্যাস, অধিত বিদ্যা, প্রিয় কবির প্রভাব, পারিপার্শিক পরিস্থিতি, সহযোগী সঙ্গ যাপন প্রভৃতি জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
এটা একটা রহস্যময় ব্যাপার, যেটা কোন কবিই বোধহয় পুরোপুরি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারেন না। কারণ তারা নিজেরাও বোঝেন না সবটা পুরোপুরি এই কুহেলিকার।
কবিতায় পাঠকের প্রবেশের জন্য দরজা জানলা খোলা না থাকলে, পাঠকেরও কোন দায় থাকে না, সে বদ্ধ গুদামে প্রবেশের।
কবিতায় কবি নিজের সঙ্গে যতই না কথা বলুক, তার একটা সংযোগ যদি পাঠকের সঙ্গে না ঘটে, কারও কোন দায় থাকে কি, সেসব কথা শোনার?
কবির লেখা যদি পাঠকরা পড়ে কিছুই না বুঝতে পারে, তবে তারা আগ্রহ বোধ করবে কেন কবিতা পাঠে? তবে সে লেখার সার্থকতা কোথায়?
এই প্রসঙ্গে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপের কথা মনে পড়ছে। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চাইতেন, পাঠকের অলস মনের জড়তা কাটাবার জন্য কবিতায় অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার। তার যুক্তি ছিল, শব্দ-বাধায় ঠোক্কর খেয়ে, অনেকেই হয়তো ঘরে ফিরবে, কিন্তু তার পরেও যারা এগোবে, তারা অন্তত চলবে চোখ খুলে, কান মেলে প্রতি অগ্র পশ্চাৎ ঊর্ধ্ব অধঃ দেখতে দেখতে। এখানে অলঙ্কারের কথাও বলে নিই, কেননা অলঙ্কার চিন্তাকে পরিস্ফূট করার বিশেষ সহায়ক।
উপমানের সঙ্গে উপমার এত নিবিড় সম্পর্ক যে প্রথমটির স্বভাব অন্তত আংশিক ভাবে হলেও এসে পড়ে। কাজেই উপমার ভিতরেও একটা সামঞ্জস্য, একটা ন্যায় সঙ্গতি না থাকলে মুস্কিল। কিন্তু তাই বলে উপমাগুলিকে গতানুগতিক হতে হবে তার কোন মানে নেই, বরং উল্টোটা হলেই ভালো। সত্যকে নতুন ভাবে দেখতে গিয়ে নূতন রূপকের দরকার হওয়া স্বাভাবিক।
তিনি আরও বলেছেন, যারা কবিতাকে ছুটির সাথী বলে ভাবে, কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃদকম্পন অনুভব করতে চায়, তাদের কবিতা না পড়াই উচিৎ। কবিতার গঠন যেমন প্রত্যেক লাইন বিশ্লেষণ করে ধরা যায় না, তার ভাবাবেশও তেমনি খন্ডাকারে দেখা যায় না, বিরাজমান থাকে সমগ্রের মধ্যে। ভাব শুধু মেঘ বাঁশি প্রিয়া বিরহ মিলন ইত্যাদি জরাজীর্ণ শব্দের করতলগত নয়, শুধু প্রেম বেদনা ও প্রকৃতিকে নিয়েই কাব্যের কারবার চলে না, তার লোলুপ হাত দর্শন- বিজ্ঞানের দিকেও আম্তে আম্তে প্রসারিত হচ্ছে। এই "বিশেষ জ্ঞানে"র দিনে কাব্যের তরফ থেকে আমি পাঠকের কাছে, সেই নিবিষ্ট ভিক্ষা করি যেটা সাধারণভাবে অর্পিত হয় অন্যান্য আর্টের প্রতি।
রবীন্দ্রনাথের এ'মতে সায় ছিল না। তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে জানিয়ে ছিলেন, "মানুষের মধ্যে, যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবীর দিকে না তাকিয়ে, যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করার চেষ্টা কর। বুদ্ধিমানদের জন্য আছেন আইনস্টাইন, ব্রার্টান্ড রাসেল, প্রশান্ত মহালনবিশ, সুনীতি চাটুজ্জে মস্ত মস্ত সব লোক ।
অথচ তিনি পাঠকরুচির কাছে আত্মসমর্পণের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাতে সস্তা সাহিত্যের আমদানী ঘটে এই বোধ তার তীব্র ছিল। তার ভাষায়, "আদর্শ রক্ষা করতে গেলে প্রায়াসের দরকার, সাধনা না হলে চলে না।
কবি জীবনানন্দ দাশের কথায়, "কাব্যে কল্পনার ভিতর, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা থাকবে।"
কবির যেমন চিন্তা ও চেতনারএক নিজস্ব জগৎ আছে। বাস্তব অভিজ্ঞতাও তার চিন্তা চেতনাকে আলোড়িত করে, প্রভাবিত করে, এবং কবি তা প্রকাশ করেন, তার নিজস্ব কল্পনার মাধ্যমে। এবং সে কল্পনাকে জাগরুক করতে হলে, তাকে আশ্রয় নিতে হয়, কখনও চিত্রকল্পের, কখনও রূপকের, কখনও উৎপ্রেক্ষণের, কখনও ছন্দ মাধুর্যের, কখনও ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার, কখনও যথার্থ শব্দ ব্যবহারের আশ্চর্য দক্ষতার। সব মিলিয়েই কবিতাটা রূপ পরিগ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত।
জীবনান্দ দাশ যখন লিখলেন,
‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা;/নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;’ এখানে আমরা লক্ষ্য করলেই দেখব, ‘নক্ষত্র, রূপালি, আগুন, ভরা, রাত’-এ সবই আমাদের কাছে অতি পরিচিত শব্দ। কবি তাকে সাজিয়ে তুললেন। এবং শব্দ হয়ে উঠল ব্রহ্মময়ী! শক্তিময়! কী অপরূপ শব্দ দ্যুতি-দীপ্ত! কী অসামান্য কল্পনা-জাগানিয়া! প্রতিটি শব্দ যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল। নতুন অর্থ-বলয় তৈরি করে হয়ে উঠল অসামান্য। এমনতর-কবিতায় আলাদা কোনও ইঙ্গিত না-থাকলেও, জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাবনা অনুযায়ী, 'তা আমাদের কল্পনার ও সৌন্দর্যবোধের পরিতৃপ্তি ঘটাচ্ছে।'
শব্দ মহৎ শক্তিমান, কিন্ত যখন রূপ-তপস্বীর হাতে না-পড়ে, তা কোনো আনাড়ি খোদাইকরের হাতে পড়ছে, তখন তা হয়ে উঠছে শব্দের জঞ্জাল। যেহেতু যে কোনও শব্দের সাথে যে কোনও শব্দ যুক্ত করে দেবার অধিকার তাঁর আছে, এবং আলাদাভাবে কবিতায় গভীর কোনও ইঙ্গিত সঞ্চারের দায় থেকেও তিনি মুক্ত, নতুন এই নৈরাজ্যের চরাচরে তিনি হয়ে উঠছেন একজন শব্দ-দাস কিংবা শব্দ-দানব। এবং শব্দের সাথে শব্দের এতসব বিয়ের আয়োজন অন্তে তাঁকে দেখাচ্ছে আত্মবিশ্বাসী, সদা-স্মিতহাসির সফল ঘটকের মতো। কিন্তু তাতে এ জগতে কার ক্ষতি? এ-প্রশ্ন করা যেতেই পারে। যেহেতু অসফল শব্দ-ঘটকের সংখ্যাই বেশি এবং তাঁদের উৎপাদনই বেশি পরিমাণে দৃশ্যমান, দ্বান্দ্বিকতার সূত্র অনুযায়ী, পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসছে বৈকি। এটাই হয়ে উঠছে কবিতার একমাত্র মার্গ-সাধনার পথ। অন্ততঃ নতুন লিখিয়েরা তাই ভেবে নিচ্ছে। এভাবে চলছে এক অচ্ছেদ্য দুষ্টু-চক্র।
তলস্তয় তাঁর ‘What is art?’-এর শুরুতেই যে প্রশ্ন করেছিলেন, সে প্রশ্ন, বিশেষ করে, এখন, এসব কবিতার শব্দ-জঞ্জাল সম্পর্কে করা যায়, ‘যে শিল্পের বেদীতে লক্ষ লক্ষ মানুষের শ্রম, মানুষের জীবন, সর্বোপরি মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসা সবই বিসর্জিত হয় সে শিল্পই ক্রমশঃ অস্পষ্টতর এবং মানুষের বুদ্ধির কাছে বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠছে।’ এবং আরো বিশেষ করে বললে, প্লেটোর ‘Allegorical cave’এর সেই মানুষদের মতো একটা ছায়া-সত্যকে সত্য জেনে কাটিয়ে দিচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের লিখিয়েরা। কত মহৎ প্রতিভার সীমাহীন অপচয়! ‘কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে!’ এবং ইতোমধ্যে আমরা জেনে গেছি, এই দুষ্টু-চক্র কীভাবে সভ্যতার এই সময় গ্রন্থিতে প্রধান স্থান অধিকার করে নিতে চাইছে।
শব্দে যদি ব্যুৎপত্তি থাকে, তা'হলে অকবির পক্ষেও সাজানো কবিতা নির্মাণ করা অসম্ভব নয়।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, "শব্দকে ব্রহ্ম বলা হয়। কবিতায় কথাই (শব্দ) সব। কথায় কি না হয়? কবিতায় কথা মন্ত্রের মতো কাজ করে। কথার নড়চড় হলে কবিতা একদম দাঁড়ায় না। শব্দের মূল তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত আছে কবিতার মূল কথা। কেননা, শব্দই হল কবিতার মূলাধার।"
মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কবিতার কথা বলতে গিয়ে একেই বলেছেন, 'শব্দে শব্দে বিবাহ বন্ধন।' বিবাহ বন্ধন সুন্দর হলে যেমন সংসার সুখের হয়ে ওঠে , তেমনি শব্দ ও শব্দের মিলন সুন্দর হলে, কবিতাও সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে।
বস্তুত, শব্দ বাছাইয়ের উপর নির্ভর করে, এর পার্থক্য থেকেই এক কবিকে অন্য কবির থেকে আলাদা করে চেনা যায়। মরা শব্দকেও ব্যবহারিক পারদর্শিতায় কোন কোন কবি জ্যান্ত করে তুলতে পারেন। অবশ্য সকলে নয়। সেজন্যই বুঝি কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।'
যথার্থ কবির কাছে কথার খেলাই কবিতা হয়ে ওঠে, যা ম্যাজিক সৃষ্টি করতে পারে পাঠকের মননে। তার জন্য প্রয়োজন হয়, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "কঠিন সাধনার"।
অনেক সাধনার ফলে, সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব হয়। মহৎ চালাকির সাথে ফাঁকি দিয়ে এই কাজ কখনই করা সম্ভব নয়, বলে আমার বিশ্বাস।
বইমেলার বিকল্প বইমেলাই
শৌ ভি ক রা য়
স্বপ্নটা দেখেছিলেন জোহান ফাউস্ট আর পিটার স্কোফার। তাঁদের ব্যবসা-বুদ্ধি বলেছিল, গুটেনবার্গের আবিষ্কৃত যন্ত্র যথেষ্ট কাজের। তাই সেই যন্ত্র ব্যবহারের অধিকার নিয়ে আইনি লড়াইয়েও পিছপা হননি তাঁরা! ভাগ্য সহায় ছিল। রায় গেল তাঁদের পক্ষে। ফল? একের পর এক মুদ্রিত বই। ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেল এতদিনের চেনা হাতে লেখা বই। আর সেই মুদ্রিত বই নিয়ে বসতে লাগল মেলা।
সেদিনের এই বইমেলার অংশীদার ছিলেন মূলত ব্যবসায়ী ও গবেষকরা। সময়টা ছিল পঞ্চদশ শতক। মোটামুটিভাবে সকলেই মেনে নিয়েছেন, সেটিই প্রথম বইমেলা। একবারে নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও, ১৪৬২ সালের মধ্যেই ফ্রাঙ্কফুর্টে সেই মেলা শুরু হয়ে গিয়েছিল। অষ্টদশ শতকে শুরু হয় লিপজিগের বইমেলা, যা ইউরোপের দ্বিতীয় প্রাচীনতম।
এসব তথ্য কমবেশি সকলেই জানেন। যেমন অনেকেই জানেন, ১৯৭৪ সালে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে বসে কিছু তরুণ প্রকাশক ফ্রাঙ্কফুর্টের ধাঁচে বইমেলা করবার কথা ভেবেছিলেন। অবশ্য প্রবীণ প্রকাশকেরা তাঁদের ভাবনাকে পাত্তা দেননি। হয়ত সেটাই শাপে বর হয়েছিল। জেদ চেপে গিয়েছিল নবীনদের। সেই জেদ থেকেই ১৯৭৫ সালে তৈরী হয়েছিল পাবলিশার্স ও বুকসেলার্স গিল্ড। ১৯৭৬ সালের ৫ই মার্চ তাঁরা শুরু করেছিলেন কলকাতার প্রথম বইমেলা। তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী মৃত্যুঞ্জয় বন্দোপাধ্যায়ের উদ্বোধন করা সেই মেলায় ৩৪ জন প্রকাশক যোগ দেন। স্টল হয়েছিল মোট ৫৬টি।
সদ্য শেষ হওয়া জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা বইমেলা এবং শুরু হওয়া আলিপুরদুয়ার জেলা বইমেলার কথা ভেবে মনে হয়, বইমেলা নামের 'আন্দোলন' সার্থক। আজ এই রাজ্যের সব জেলা তো বটেই, আপাতভাবে ছোট ছোট জনপদেও যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে বইমেলা হচ্ছে। এই ব্যাপারে কলকাতার হালতু বা কোচবিহারের ঘোকসাডাঙ্গা যেন এক সারিতে বসে গেছে। পিছিয়ে নেই কেউই।
পুস্তক বিপণনে, সাহিত্য আড্ডায়, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ছোট বড় সব বইমেলার চরিত্রই এক। মহানগর-কেন্দ্রিকতার যে ঝোঁক দীর্ঘদিন সাহিত্য জগৎকে ঘিরে রেখেছিল, বইমেলা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আজ তা উধাও। স্থানীয় পর্যায়ের এই বইমেলাগুলির হাত ধরে প্রবীণ ও পরিচিত লেখকদের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে নবীনদের। তারা রীতিমতো টক্কর দিচ্ছে তথাকথিত বিখ্যাত `হাউস` ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে। তাদের আগ্রহ ও উৎসাহ দেখলে বোঝা যায়, বইমেলার উদ্দেশ্য সত্যিই সার্থক হয়েছে। সংখ্যায় তারা কম হতে পারে ঠিকই, কিন্তু বইয়ের প্রতি ভালবাসায় তাদের কোনও খাদ নেই।
তবে আর সব বিষয়ের মতোই বইমেলাতেও রাজনীতির অনুপ্রবেশ যথারীতি গোদুগ্ধে একবিন্দু চোনার মতোই! ফলে বইমেলার স্থান নির্বাচন নিয়েও যেমন বিতর্ক বাঁধে, তেমনি বিভিন্ন বইমেলায় পুরস্কার প্রাপকদের তালিকা দেখেও অনেকের ভ্রু কুঞ্চিত হয়। বইমেলা উপলক্ষ্যে প্রকাশিত সুভেনিরে স্থান পান না অনেক যোগ্য লেখক। আবার, অলিখিত নিয়মে বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি ক্রেতাকে যে পরিমান ছাড় দিতে হয়, পুস্তক বিক্রেতাদের তা নিয়েও ক্ষোভ থাকে।
তবু সব বিতর্ক সরিয়ে রেখে বলা যায়, উত্তরের সর্বত্র বইমেলাকে ঘিরে এমন এক সহজাত আবেগ সৃষ্টি হয়েছে যা কিছুদিন আগেও ছিল অকল্পনীয়। নির্দ্বিধায় তাই বলা যায়, এই মুহূর্তে বইমেলার বিকল্প নেই।
জানা-অজানা কথা
অ নি ন্দি তা না থ
শারদ মানেই কাশগুচ্ছ, নীল আকাশ, শিউলির গন্ধ, প্রকৃতির রূপরস উপভোগ করা। বাঙালির অন্দরমহলে শারদীয়া পুজো সংখ্যা। ভাবলেই শিহরণ! জানা-অজানা কথা নিয়ে আজকের আড্ডার প্রসঙ্গ বাউল-গীতি।
বৌদ্ধ ধর্মের ভাবধারা কৃষ্ণবাদ, বৈষ্ণব, সহজিয়া তত্ত্ব ও সুফি দর্শনের প্রভাবে ২০০৫ খ্রীষ্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্য সমূহের মাঝে বাউল গানকে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষনা করেন। শৈলীগত বুৎপত্তি কুষ্টিয়া জেলা। প্রথাগত বাদ্যযন্ত্র- একতারা, দোতরা, ডুগি, বাঁশি, করতাল ও খঞ্জনী। বাংলা দেশের সাধিকা সৃজনশীল তানিয়া। লালন সাঁইয়ের গানের মাধ্যমে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বাউল গান ব্যপক জনপ্রিয়তার অর্জন শুরুকরে। রবীন্দ্রনাথ বাউল গান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। দুই শ্রেণীর বাউল লক্ষ্য করা যায়, গৃহত্যগী ও সংসারী বাউল। যারা গুরুর নিকট দীক্ষা নেন তাঁরা গৃহত্যাগ করেন।
তাদের ত্যাগী বা ভেকধারী বলা হয়। এ শ্রেনীর বাউলরা পুরোপুরিই সংসার ও সমাজ বিমুখ, ঈশ্বর কে পাবার তীব্র ব্যাকুলতা! সাধন পথ বলতে বুক ভরা সুর আর গানকে বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে মুষ্টি ভিক্ষায় ক্ষুধা নিবৃত্তি। এই গান গ্রামাঞ্চলে 'ভাবগান' বা 'ভাবসঙ্গীত নামে পরিচিত। বাউল নাকি শুধু গান নয়, বিশ্বাস, চেতনার একপ্রকার জীবন যাপন, দেহ সাধনা। বহমান বাউল জগতের সঙ্গীত ধারার জাঁক-জমকের আসর নয়। কারণ বাউল গানে উদাসী ভাব বেদনার সুর নিহিত। গোপ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন "বুঝি কী আজও শুধু শুনি প্রকৃতির সকল গোপন শক্তির সঙ্গে শরীরের গোপন শক্তির সংযোগ নিয়েই দেহ তত্ত্বের সাধনা।"
ভিন্ন মতবাদে বাউল কথার উল্লেখ পাওয়া যায়- "সংস্কৃত বায়ু থেকে বাউল শব্দটির উৎপত্তি। শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার সাহায্যে সাধনার মাধ্যমে আত্মীক শক্তি লাভ। পূর্বে উল্লেখ করেছি বাউল দুই শ্রেণীর। পুরুষ বাউলরা সাধারনত সাদা লুঙ্গী বা সাদা আলখাল্লা পরিধান করেন। মহিলারা সাদা শাড়ি পরেন।তারা সন্তান ধারণ করেন না। এধরনের জীবনকে বলে জীবন্মৃত। পুরুষ বাউল একাধিক সেবাদাসী রাখতে পারেন, সাধন সঙ্গিনী হিসেবে। এই বাউল শ্রেনীর মিল খুঁজে পাওয়া যায় পীর-মুসাফিরদের সাথে। বাউল গানের সঙ্গে যাদের নাম জড়িয়ে আছে, তাঁদের অনেকে প্রসিদ্ধ গায়ক-গায়িকা, যেমন-সহজ মা, পূর্ণদাস বাউল, নির্মলেন্দু চৌধুরী, পার্বতী দাসী, প্রাঞ্জল বিশ্বাস প্রমুখ। এঁদের গানগুলো মন কাড়ে। বিভিন্ন গান, যেমন---এক) "সাগর কূলের নাইয়া," দুই) "ভাল ক্যইরা বাজাও গো দোতরা, তিন) বুক পাঁজরে বন্দী রাইখ্যা। লালন গীতি ও বাউল গীতি আবার ফিরে এসেছে, মাতিয়ে দিচ্ছে মন প্রাণ। যে কোন গান মানুষের হৃদয়ে যন্ত্রনা প্রশমিত করে। বাউল গানও এর ব্যতিক্রম নয়, বরং বেশি অপরিহার্য। বন্ধুরা আজ এখানে ইতি টানার।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন