পত্রসাহিত্য
শশী
ম ধু মি তা ভ ট্টা চা র্য
প্রিয় পাঠক,
লেখার অভ্যাস নেই আমার। বিশেষতঃ পত্র।
তোমাদের বর্ণনায় এক পাড়াগেঁয়ে মেয়ে আমি।
কিন্তু অপরিণত কলমটা ধরতে ইচ্ছে করলো।
তোমাদের কাছে পত্র এক আত্মীয়তা বলতে পারো।
আত্মীয়তা, আত্মার সাথে সম্পর্ক আলাপন। এক আত্মীয়তাই বটে!
ইতি পূর্বেই রবিঠাকুরের বলিষ্ঠ কলমে আমার পরিচয় পেয়েছ তোমরা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "দিদি" ছোটগল্পের এক নারী চরিত্র শশী। রবিবাবুর অসির মসিতে আমি প্রথম ধরা দিয়েছিলাম ছোটগল্পের আকারে।
কিন্তু তারপরেও গগণবিহারী রূপে ভেসে চলছে আমার জীবন বিহার। যেটা তোমরা জানোনা।কেননা আর খোঁজ পাওনি আমার। জনান্তিকে আরেক কলমে আবার ধরা দিলাম। আমার খোঁজ আমি নিজেই দিলাম।
আমি শশী
পড়ন্ত বিকেলে আলো কেমন সোনালী রঙের হয়ে গেছে, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে। গাঙের জলে সেই আলো ছড়িয়ে পড়ে গাঙকে যেন মোহময়ী করে তুলেছে।
সূর্য ডুবলেই আকাশে নরম আলোতে মাখামাখি করে আসবে চাঁদ, চাঁদ! আমি!
হ্যাঁ আমি চাঁদই বটে, নাম যে শশী, চাঁদের নরম পেলব আলোতে না, শুধু কালো আঁধারে জর্জরিত আমার সংগ্রাম। আমার জীবন।
সূর্য নেই আমার নামে, চাঁদ নামে। আমার নাম শশী। কিন্তু পেলবতায় নয় সূর্যের দাবদাহে বয়ে যাচ্ছি আমি, আমার জীবন।
জীবন যতই আমাকে পরাজিত করেছে, আমি তত জেতার বিশ্বাসে জিততে চেয়েছি। আমি পরাজিত হয়েও আবার জ্বলে উঠে বাঁচতে চেয়েছি, বাঁচাতে চেয়েছি আমার নীলকে।
জীবন যখন সংগ্রামের রূপ দেখায় কোনো না কোনো নিবিড় একজন বা কয়েকজনকে কেন্দ্র করে, আমার এই সংগ্রাম আমার সহোদর, আমার ভাইকে নিয়ে।
আমার মা বাপ মরা অসহায় আপন ভাই। নীল, নীলমাধব আমার ভাই।
পল্লীগ্রামের অশিক্ষিতা এক সামান্য মেয়ে আমি। হিসাব কিতাব, শহর, নগর, কিছুই বুঝিনা। কাকে কি বলতে হয় জানিনা। তবুও আমি দৌড়ে গেছি বিচারের আশায় শহরে, বিভিন্ন জায়গায়, কখনো ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, অ্যাডিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছেও এই ভাইয়ের জন্য। সবার কাছে গিয়েও লাভ হয়নি। জয়গোপাল আর তার অর্থবল ব্যর্থ করে দিয়েছে আমার সব চেষ্টা, হেরে গেছি।
হেরে গেছি জীবনের কাছে।
হারিয়ে দিয়েছে আমার স্বামী নামের এক জীব- জয়গোপাল। গোপালের জয়ধ্বনি নামে থাকলেও মানুষের চেহারায় একটা আস্ত হিংস্র পশু, লোভী, অত্যাচারী এক মানুষ। আমার স্বামী হয়েছিল বিধাতার নির্দেশে। অথবা আমার ভাগ্যের পরিহাসে।
সে অনেক ঝড় অনেক কদর্য রূপ অনেক অত্যাচারের পরে এই আমি আজ আবার নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। লাঠিতে ভর দিয়েই। প্রায় খুন হয়ে যাওয়া জীবনটাকে বাঁচিয়ে আবার নেমে পড়েছি সংগ্রামে।
আমি শশী। সূর্যময়ী শশী।
লাঠিতে ভর দিয়ে ভাঙা হাড়গোড় নিয়ে হেঁটে হেঁটে চলেছি আমার একমাত্র লক্ষ্যের দিকে।
হাঁটতে হাঁটতে আমার কথা বলে চলেছি তোমাদের। ভালো লাগলে শোনো, ভালো না লাগলে শুনো না। নিজের কথাগুলো মুখ ফুটে খুব বলতে ইচ্ছে হয় গো আজকাল। সদরে যেতেই হবে আমাকে।
নীল বিশ্বাস আজও অটুট করে রেখেছে আমাকে। নিভু নিভু প্রাণ এই জন্যই আমাকে ছেড়ে যেতে পারেনি।
ধনী ঘরের আদরের একমাত্র মেয়ে ছিলাম। একমাত্র সন্তান। বিয়ের পরে আমার এক ভাই হয়। বুঝিনি আমি আমার স্বামীরূপী দেবতার অন্তরের কদর্য রূপ। তার যে নজর আমার পিতার বিষয়ের ওপর ছিল। তার লোভ যে কত নিকৃষ্ট! আমার এই ভাইকে বঞ্চিত করে কখন আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি নিজের অধীন করবে এটাই ছিল তার উদ্দেশ্য। ফলে এই ভাই হওয়ার পরে তার ক্রোধ যে অবুঝ শিশুটির ওপর পড়বে, এটা বুঝতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিলো আমার।
ভাইয়ের জন্মের পর আমার পিতার মৃত্যু হয়। তার ক'দিন আমার কোলে মা ও আমার ভাইকে রেখে দিয়ে চলে গেলেন স্বর্গে। নাবালক অসহায় ভাই। ওর যে আমি ছাড়া কেউ থাকলো না। আমার সন্তানদের সাথে ওকেও বুকে তুলে নিলাম। বরং একটু বেশী স্নেহধারা বর্ষণ করে ফেলেছিলাম ভাইয়ের প্রতি। আমি ছাড়া বাপ মা মরা অবোধ শিশুটির আর যে কেউ নেই।
আমি ওর আধো আধো বোলে জিজি, জিজিমা, দিদি। ওর একমাত্র আধার। আমার নীলমাধব, আমার নীল। নিজের সন্তানদের থেকেও একটু বেশী আশ্রয় দিয়ে ওকে কাছে রেখে দিলাম। মা বাপ মরা অসহায় এক শিশু। আমার কোলে আলো করা আমার সহোদর নীল।
এদিকে আমার স্বামী জয়গোপাল আমার আর আমার ভাইয়ের অসহয়তার সুযোগ নিয়ে, আমার ভাইয়ের সুবিশাল পৈতৃক সম্পত্তি নিজের নামে করে নিলো। বঞ্চিত করে দিলো অসহায় এক নাবালক শিশুকে। অসহায় শিশুটিকে পথে বসিয়ে দিতে একটা বার বুক কাঁপলো না। ও অসুস্থ হলে মিথ্যে কথা বলে ডাক্তার ও আনত না। ওর মৃত্যু কামনা করে। এক নরাধম স্বামী আমার।
আমি স্বামী নিন্দাকারী মহাপাতকী শশী।
পল্লীগ্রামের অশিক্ষিতা হয়ে আমি দৌড়ে গেছি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে, স্বামীর নালিশ নিয়ে, আমার অসহায় নীলমাধবের ন্যায্য বিচার চেয়ে।
ফিরে আসতে হয়েছে আমাকে। কেউ কোনো কথা শোনেনি আমার। ফিরে আসতে হয়েছে এই নরপিশাচ স্বামীর কাছে। জয়গোপালের অর্থবল, লোকবলের কাছে হেরে গিয়েছিলাম।
একটাই কাজ করতে পেরেছিলাম এই অশিক্ষিতা বুদ্ধি নিয়ে। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে আমার নীলমাধবকে, নীলকে বুকে পাথর বেঁধে রেখে এসেছিলাম। নইলে আমার মত আমার নীল কেও নরপিশাচটা...
বিচার চেয়ে পেলাম তো নাই। উল্টে ফিরিয়ে দিল সবাই আমাকে। আমি ঘরে ফিরে আসতেই একদিন রাতের দিকে নরপিশাচ জয়গোপাল নামের স্বামী আমার আমাকে মুখ বন্ধ করে, হাত বেঁধে রেখে দিয়ে বেদম মার মারতে থাকে, মার খেতে খেতে অজ্ঞান হয়ে যাই, তারপর আমাকে মৃত মনে করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়।
রাখে হরি মারে কে!
ভেসে ভেসে মৃতপ্রায় শশী জললগ্না হয়ে চলেছি। কয়েকজন জেলে দেখতে পেয়ে তাদের নৌকায় তুলে নেয়। তাদের সেবায় প্রাণ ফিরে পাই, কিছু সময় পরে স্মৃতি ফিরে পাই, জেলেরা ও সাহায্য করে আমাকে। বেঁচে উঠলাম আমি।
একটু সুস্থ হয়ে আমি সর্ব প্রথমেই আমার নিখোঁজ ভাইয়ের খোঁজ করতে থাকি। আবার আমার পরাজয়ের শিবিরে জেতার আশ্বাসে সংগ্রাম শুরু হয়ে গেলো।
আমি অনন্তময় এক প্রাণ- শশী।
-দিদিগো- এই ডাক আমাকে কোথায় কোথায় নিয়ে যায়। খুঁজে চলি আমার নীলকে। কোথায় তুই নীল, কোথায় হারিয়ে গেলি আমার ভাই? খুঁজে যে পাইনা তোকে।
নিজেকে লুকিয়ে ও রাখতে হয়। জয়গোপাল আর ওর দল যদি দেখে ফেলে এবার আর কোনো সুযোগই দেবে না। পুঁতে ফেলবে আমাকে।
স্বামীর নাম ধরলাম। ঘৃণা করলাম তবুও হাতে সিঁথিতে সধবার চিহ্ন গুলো মুছে ফেলতে পারলাম না।
আমি পল্লীগ্রামের অশিক্ষিতা শশী।
খোঁজ নিয়েছিলাম। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব দেশে ফিরে গেছেন, আমার নীলকেও নিয়ে গেছেন। নীল আমার পড়াশোনা করে শিক্ষিত হবে, অশিক্ষিতা দিদির ভাই নীলমাধব বিলেতে পড়াশুনো করবে। কিন্তু যদি আর এদেশে না ফেরে? ছেলেবেলার স্মৃতি যদি ভুলে যায়? ভুলে যায় যদি আমাকে?
ও নীল আমি যে কথা দিয়েছিলাম তোকে আমাদের দেখা ঠিক হবে!
তোর দিদি যে তোর আশায় আজও লড়াই করে যাচ্ছে, তুই কবে আসবি ভাই দিদি বলে ডেকে আমার কাছে?
কেটে যায় অনেক কথায় অনেক অপেক্ষায় অনেক আশায় অনেক দুরাশায় কয়েকটা বছর। জেলেদের ফাই ফরমাস খাটি, দুবেলা অন্ন জুটে যায়। এইভাবে কাটতে থাকে আমার দিন আর মাঝে মাঝেই নীল অন্বেষণ চলে আমার।
আমি যেন অন্বেষা শশী।
এবার শুনবে কি হলো?
আমি এবার কাহিনীকার হয়ে উপস্থিত হচ্ছি আমারই জীবনকথায়।
আহা! শোননা!
মন্দ লাগবে না তাতে।
শোনো তারপর!
অনেকটা পথ হেঁটে এবার এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে এবার শশী। হাঁপাচ্ছে। ভঙ্গুর শরীরটা টেনে টেনে লাঠিতে ভর দিয়ে খুটখুট করে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে।
যতবার নতুন ম্যাজিস্ট্রেট আসে ততবার সদরে যায়। চাপা এক উচ্ছ্বাস নিয়ে।
এক নীল উচ্ছ্বাস নিয়ে।
আজও এক নতুন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আসছেন। শশী চলেছে সদরে। যেতেই হবে তাকে, নদীর উৎস স্রোতের মত, কোনো বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে, যেতেই হবে তাকে।
এক নীল আকাশের শশী।
"- ভাই!"
পিছন থেকে অবগুন্ঠনবতী এক নারীকণ্ঠে পিছন ফিরে তাকালেন ম্যাজিস্ট্রেট Neil Fraser ওরফে নীল সাহেব। চারিদিকে গণ্যমান্য ব্যক্তি পরিমন্ডলিত সাহেব কে ঘোমটা দিয়ে ঢাকা মুখ, ময়লা কাপড় পরিহিতা বয়স্কা এক মহিলা সম্বোধন করার সাহস কি করে পায়! গণ্যমান্যরা বিরক্ত হয়ে উঠলো। সিকিউরিটিরা তৎপর হয়ে গেল। ছদ্মবেশী কোনো অপরাধী নয়তো?
হুঙ্কার দিয়ে উঠলো অনেকে। মহিলা অনঢ়,
আবার কান্না ভেজা কণ্ঠে ডেকে উঠলো
"ভাই! নীল!
Neil fraser এর চোখ কুঁচকে উঠলো। হাতের ইশারায় হুঙ্কার থামালেন। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলেন মহিলার দিকে।
দু'হাত মুখে চেপেছেন কান্না আটকাতে ঘোমটা থাকলেও বোঝা যাচ্ছে। Neil Fraser ও আরো কাছে এগিয়ে গেলেন।
এইরকম অনেকবারই সন্দেহ বশতঃ এগিয়েছেন Neil Fraser, ব্যর্থ হয়ে ফিরতে ফিরতে আশাহত হয়ে গেছেন। একটা এইরকম মানুষ, আবছা হয়ে যাওয়া মুখাবয়ব, আর তীব্র করুণ আকুতি খুঁজছেন বহুবছর ধরে, হতাশ হয়েই ফিরেছেন। তাই ওই আশা হারিয়েও ফেলেছেন।
বড়ো বড়ো চোখ নিয়ে প্রবল বিস্ময়ে সাহেবের লোকজন দেখছেন বোঝার চেষ্টা করছেন। বিলাতি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ময়লা কাপড় পরিহিতা অশিক্ষিতা এক ভারতীয় গ্রাম্য নারীর ভাই সম্বোধনে কি করে এগিয়ে গেলেন।
খুব কম বয়সের নবীন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। ইংরেজ হলেও পরিষ্কার বাংলা ভাষায় কথা লিখতে বলতে পারেন। অনেক ইংরেজ পারেন সেটা। এই সাহেবের ভারতীয়দের ওপর একটা নরম মন কাজ করে সাহেবের আশেপাশের লোকেরা জানেন। সাহেব ইংরেজ হলেও চেহারাটাতেও অদ্ভুত ভাবে ভারতীয় ছাপ পরিদর্শীত হয়।
"কে? তুমি কে? তুমি কি কিছু বলবে?"
মহিলা আওয়াজ করে কেঁদে উঠলেন।
সাহেব আবার বললেন তোমার সমস্যা আমাকে বলতে পারো, অথবা আমার অফিসে আসতে পারো, সেখানেও তোমার সমস্যা শুনবো।
মহিলা নড়াচড়া করছেন না, সাহেব লক্ষ্য করলেন মহিলা লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াচ্ছেন মাঝে মাঝেই। শারীরিক অসুবিধা আছে তার মানে।
সাহেব তাঁর লোকজন কে আদেশ দিলেন ভদ্রমহিলাকে যত্ন করে ওনার বাংলো তে নিয়ে আসতে।
অবাক বিষয় মহিলা কিন্তু আপত্তি করলেন না। ঘোমটা সরালেন না, আর অনবরত অশ্রুপাত করে যাচ্ছেন।
সাহেবের লোকেরা ধরে ধরে ভদ্রমহিলা কে সাহেবের গাড়িতে বসালেন। নিয়ে গেলেন সাহেবের বাড়িতে। বৈঠক খানায় বসিয়ে দিলেন মহিলাকে। মহিলার পায়ের কোমরের হাড়ে হয়তো খুব বড়ো সমস্যা আছে। চলতে বসতে খুব অসুবিধা হয় ওনার। সাহেব সবই লক্ষ্য করলেন।
সাহেব নিজের বাংলোয় ফ্রেশ হয়ে এসে মহিলার সামনে বসলেন।
মহিলা এতটাই অন্যমনস্ক সেটা হয়তো খেয়াল করেননি। যদিও এখনো অবগুণ্ঠনে আবৃতাই হয়ে আছেন। মাথা নীচু করে লাঠির ওপর ভর রেখেই বসে আছেন।
সাহেব একটু গলা ঝাড়লেন। চমকে উঠলেন মহিলা। বলুন কি বলতে চাইছেন- সাহেব বললেন।
মহিলা একটু চুপ করে থেকে বললেন- জল, একটু জল...
সাহেব নিজে table থেকে জলের জগ থেকে গ্লাসে জল ঢেলে মহিলার সামনে এগালেন। কিছুটা দাঁড়িয়ে থেকে মহিলার হাতের দিকে এগিয়ে দিলেন।
বাম হাতে ঘোমটা ধরে শীর্ণ ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন জল নেওয়ার জন্য। হাতটা সামান্য দেখা গেল।
জলটা ধরলেন। শাঁখা পলা পরিহিতা হাত, কাঁপছে জলের গ্লাসটা ধরে, সাহেবের ভ্রূ কুঁচকে গেল হাতের চেটোর উল্টোদিকে তর্জনীর নীচে একটা জরুল, আর তার আকৃতিও সেই তরোয়ালের মতো। খুব হালকা স্মৃতির অবশিষ্ট নিয়েই কত খুঁজেছেন এইরকম জরুল চিহ্নের ডান হাত, তাও তর্জনীর নীচে।
সাহেব কিছু বলার আগেই জল খেতে গিয়ে মহিলা বিষম খেলেন, সাহেব তাড়াতাড়ি করে ওনাকে সুস্থ করতে গিয়ে মহিলার ঘোমটা খুলে গেল।
বৃদ্ধা। মাথায় কালোচুলের থেকে সাদা চুল বেশী। বলিরেখা ছড়িয়ে আছে। কপালে পুরানো গভীর ক্ষতচিহ্নের দাগে গভীর গর্ত হয়ে আছে। ঝাপসা চোখগুলো অনবরত অশ্রু নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
কিছুক্ষন অবাক হয়ে দেখছেন সাহেব ওই মুখটা... চেনা খুব চেনা...
কয়েক মুহূর্ত পরে, ডেকে উঠলেন সাহেব মহিলা কে, - দিদি, দিদি মা, দিদি, তুমি তো আমার সেই দিদি, আমার মা , দিদি...
বসে পড়লেন মহিলার পায়ের কাছে।
বাকরুদ্ধা বৃদ্ধা সাহেবের মাথাটা ধরে স্নেহবর্ষণ করে যাচ্ছেন। অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে মহিলার মুখ, হাত...
দিদি গো, তুমি,... কত খুঁজেছি তোমাকে, পাইনি, আশা তো ছেড়েই দিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম তুমি বুঝি....
- মরেই তো গিয়েছিলাম রে নীল,
বলতে বলতে শরীর কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান মত হয়ে গেলেন মহিলা।
সাহেব দ্রুত তার দিদিকে পাঁজা কোলে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ডাক্তার ডাকলেন।
ডাক্তার এসে দেখলেন। অপুষ্টি আর শরীরের বিভিন্ন জাগায় মারাত্মক জখম যেগুলো পুরোনো, সেগুলোর ট্রিটমেন্ট আগে করতে হবে- এই কথা বললেন। সেই ট্রিটমেন্ট দীর্ঘ সময় ধরে করতে হবে। ওষুধ দিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষন পরে জ্ঞান এলো সাহেবের দিদির।
-নীল...
-বলো দিদি।
-কাছে আয় ভাই।
-দিদি! তোমার এই অবস্থা কেন?
আমাকে সেই সাহেবের কাছে রেখে দিয়ে আর এলেনা... তুমিতো এক মুহূর্ত আমাকে ছাড়া থাকতে পারতে না। তোমারতো নিজের সন্তানদের থেকেও আমার ওপর টান ছিল, এই নিয়ে জামাইবাবু ও কম অশান্তি... জামাইবাবু কোথায়? তোমার সন্তানরা?
-নীল ! আমার কাছে এসে বোস। তোকে দেখি।
সাহেব দিদির কাছে এসে বসলেন।
-ভাই তোর দিদিকে মনে আছে? ভেবেছিলাম অতো ছোটবেলার স্মৃতি তুই হয়ত ভুলেই গেছিস।
জীবন আমাকে এইরকম পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়ে দেবে ভাবতেই পারিনি রে, তোকে আবার সেই ছেলেবেলার মত পাবো সেটাও ভাবতে পারিনি।
কথা দিয়েছিলাম তোকে আমাদের দেখা হবে। দেখ পারলাম তো কথা রাখতে!
ভাইবোনের মিলনের মূর্ছনায় আকাশে চাঁদ ধরা দিলো।
আমি আজীবন স্নেহময়ী শশী।
কদিন বাদে শশী গিয়ে দাঁড়ালো জয়গোপালের জমিদারিতে সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে। জয়গোপাল এসে দাঁড়ালো শশীর সামনে।
শশী এতদিন পরে হেসে উঠলো।
-ভাই আয় এবার, তোর জমিদারি তুই দেখে নে, আয় ভাই আয়।
সন্তান রা এলো শশীর সামনে। এতবছর পরে মায়ের এহেন রূপে ভীত হয়ে গেছে তারা। আর তাদের তো কোনো দোষ ও নেই। বরং তাদের বাপের জন্য শৈশবেই মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে।
মা আর সমবয়সী মামা তাদের সামনে এসে আশীর্বানী দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। নীলমাধবের দিদিকে নিয়ে নিজের পৈতৃক ভিটেতে নিজের পৈতৃক সম্পত্তিতে আজ গৃহপ্রবেশ হলো।
হারতে হারতে পরাজয়ের রণক্ষেত্রে জিতে যাওয়ার উচ্ছ্বাসে জয়মালা এবার শশীর পড়ার পালা। ভাইয়ের হাত ধরে নিজের পিতৃগৃহে প্রবেশ করলো শশী।
এই হলো পরবর্তী কথা শশীর।
একদম গল্পের মতো, তাই না?
গল্প তো গল্পই।
ক্ষতি তো নাই তাতে, কি বলো?
এই হলাম আমি। এক সাধারণ নারী শশী।
কেমন লাগলো তোমাদের শশীর পরবর্তী বিহার?
সত্যি কথা বলতে আমি ভালো আছি। তোমরাও ভালো থেকো। পত্র ফেরতে জানিও তোমাদের কথা। অযাচিত ভাবেই জানিয়ে ফেললাম নিজের অজানা কথা তোমাদের কাছে। অনেকটা হালকা লাগছে এখন। আমি অপেক্ষা করে থাকলাম তোমাদের কলমের, আর ডাকপিওনের।
সবাই যত্ন নিও নিজের
আজ এইটুকুই।
আসছি।
বিনীতা তোমাদের শশী।
[অনেক পুরোনো টিনের একটি বাক্স থেকে প্রাপ্ত।]
একটি খোলা চিঠি
শ্যা ম ল কু মা র মি শ্র
(আজকের এই এস এম এস- র যুগে যখন পত্রসাহিত্য হারিয়ে যেতে বসেছে তখন রাত্রির মধ্যযামে এক পিতা তার পুত্রকে পত্র লিখে চলেছে। জানি না পাঠকদের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে কিনা তবু যদি কেউ পড়েন সেই আশায়...)
স্নেহাষ্পদেষু
নিছক কিছু লেখার জন্য এ লেখা নয়, এটি আমার অভিজ্ঞতার নির্যাস। জানি না তুমি এটা পড়বে কিনা কিন্তু পড়লে আমার ভালো লাগবে শুধু এই কারণে এটি লেখা নয়। এটি একটি সর্বজনীন উপলব্ধি যা মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। এটি কোন এক পিতার বা মাতার তার পুত্র বা কন্যাকে লেখা কারণ প্রতিটি সন্তানের মধ্যেই লুক্কায়িত আগামীর পিতা বা মাতা যা যুগ থেকে যুগে উৎসারিত। আমি কে? কি আমার উপলব্ধি? আমার ভালো লাগা মন্দ লাগা সব নিয়ে একটা গোটা আমি, যে ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত। তবুও আমি আমাকে ভালোবাসি।
আমরা কি চাই?
আমরা কি চাই সে সম্পর্কে আমাদের সঠিক এবং সুস্পষ্ট কোন ধারণাই নেই। যা ভালো, যা কাঙ্ক্ষিত বলে মনে হয়, তখনই আর একটি ভালো এসে পথরোধ করে, হাতছানি দেয়। তারপর আরেকটি। আর একটি... অনেকটা মরীচিকার মতো। ফলে চাওয়াটা ও ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায়। মনে হয় এমনটি তো চাই নি। কিংবা এই চাওয়া তো আমার স্বপ্নের মতো নয়। আসলে আমাদের চাওয়া ও পাওয়ার সঠিক স্বরূপ আমাদের জানা নেই। আর তখনই জন্ম নেয় অস্থিরতা। কখনও কখনও তা বিষণ্ণতা বয়ে আনে। ফলে স্বরূপায়িত জীবনের সংজ্ঞায়িত রূপ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা দরকার। আর তাই আমাদের লক্ষ্যে স্থির থাকাটা ভীষণ জরুরী।
কাঙ্ক্ষিত ফল
কাঙ্খিত ফল সবাই চায় কিন্তু সব সময় যে সেটা পাওয়া যায় তা হয়তো নয় কিন্তু এই না পাওয়াই মানুষের মধ্যে যেন হতাশার সৃষ্টি না করে। মানুষ তার ভাবনায় অবিচল থেকে এই কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে চায়। একেবারে ১০০/১০০ কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় তা কখনই সম্ভব নয়। কিন্তু চেষ্টাটা যেন আমরা কখনও ত্যাগ না করি। কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মেই তোমার মুক্তি। প্রতিকূলতাই আমাদের লড়াই করতে শেখায়। স্থিতধী হতে হয়। নিজেকে বারংবার প্রশ্ন করতে হয়। দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক অক্ষে নিজের অবস্থান চিহ্নিত করতে হবে।
সাফল্য লাভের উপায়?
বারংবার চেষ্টা। হার না মানা মনোভাব। বিষয়ের গভীরে গিয়ে বিষয়টি আত্মস্থ করা। কিন্তু তাতে ও সাফল্য সবসময় আসবে তা নাও হতে পারে কারণ জীবন যদি একটি গতিময় স্রোতস্বিনী হয় সেখানে ভিসকাস ফোর্স থাকবেই। আর তাকে অতিক্রম করার মধ্যেই আনন্দ। মাঝ দরিয়ায় যে মাঝি নাও ভাসায় সে জানে যতই ঝঞ্ঝা আসুক সময় শেষে সে ঘরে ফিরবে। আর সেখানেই তার আনন্দ। ফলে একাগ্রতা, গভীর অধ্যবসায়, হার না মানা মনোভাবই তোমায় এগিয়ে দেবে।
লিখতে লিখতে রাত্রির মধ্যযামে পৌঁছে গেছি। তুমি হয়তো তোমার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তির যন্ত্রণায় কখন ঘুমিয়ে পড়েছ। রাতজাগা পাখিটা শিস্ দিয়ে বলে গেল-- এবার ঘুমোও। তোমার সন্তানকে বলো-- আগামীকাল একটা নতুন সকাল। নতুন করে ভাবার মধ্যেই জীবন স্পন্দিত। অপ্রাপ্তির গহীনেই প্রাপ্তির আনন্দ। তাকে বরণ করে নিতে হয়। সেখানেই আনন্দ। হারতে নেই, হেরে গেলে হারিয়ে যায়।
ধীরে ধীরে ঘুম নেমে আসে। আমি এক নতুন তোমায় দেখার প্রত্যাশা নিয়ে বিছানা অভিমুখী হই।
ভালো থেকো। আনন্দে থেকো।
বাবা।
পত্রগুচ্ছ
মৌ মি তা চ্যা টা র্জি
(২)
প্রিয় পঞ্চম,
জানো সেদিন চিঠিটা শেষ করেছিলাম অকারণ লৌকিকতা নিষ্প্রয়োজন এই লিখে, তবু কোথাও যেন মনের কোণে একটা প্রত্যুত্তরের ক্ষীণ আশা রয়েই গেছিল। মাঝে মাঝে অবচেতন মনে যখন স্মৃতির ঝড় ওঠে, তখনই কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসি তোমাকে। হয়ত খুবই বালখিল্যতা বলে মনে হবে তোমার। তাও লিখছি।
জানো, এখনও সময়ে অসময়ে তোমার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করে খুব। মেঘাচ্ছন্ন বৃষ্টিপথে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে, অতীতের কোনো বৃদ্ধ বটের নীচে, তোমার কাঁধে মাথা রেখে, দুদন্ড জিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে খুব। বৃষ্টির মতো, ঘুমভাঙা শিউলি ভোরে হিমের ওশের মত আমাদের গল্পেরা টুপটাপ ঝরে পড়বে, তারপর মিলিয়ে যাবে তোমার আমার মাঝে। কেউ কোনোদিনও সেই পান্ডুলিপির নাগাল পাবেনা।
আজকাল, কখনও আবার কথা বলতেই ইচ্ছে করে না। মনে হয় নীরবতাকে আঁকড়ে যদি সারাজীবন কাটত! কি অদ্ভুত না?
সোনালী রূপোলী জলের ছায়ায় পানকৌড়ির ডুব, ঝিরঝিরে হাওয়ায় সুপুরী গাছগুলোর রিনিকঝিনিক মাথাদোলানো, দূর আকাশে উড়ে যাওয়া গাংচিলের ডানাভাসানো রোদ আর তোমার উষ্ণ, নরম করতল- এটুকুই যথেষ্ট ছিল না কি? বাকী দুটো ভাতে ভাত যোগাড় হত ঠিকই!
মাটির কাছাকাছি থাকাই আমার বরাবরের পছন্দ যে!
এখন মনে হয়, আমার সীমিত চাহিদাই বোধ হয় ছিল আমার সবচেয়ে বড় অক্ষমতা। বহুমূল্য উপহারের থেকে সবুজশ্যামল বনানীর রং, অনাম্নী বুনো ভাঁটফুলের সুগন্ধী ফুল, আসমানী কাজলের উপহারেই একটা মাদকতা খুঁজে পেতাম। এটাই ছিল তোমার অপচ্ছন্দের। তুমি চাইতে চাঁদের বুকে নাম খোদাই করতে, আমি চাইতাম মাটিতে থেকে শিকড় আঁকড়ে ধরতে, চাঁদের টুকরো আলোয় উঠোন নিকোতে। বিস্তর ফারাক ছিল দুই পৃথিবীর। আমার ইচ্ছেরা খন্ড বিখন্ড হয়ে যেত, তোমার অদম্য পৌরুষের প্রতিপত্তির মাঝে।
থাক্! সেসব কালো দিনরাতের কথা আর মনে রাখতে চাই না। তুমিও রেখো না। খবর পেয়েছি, তোমার এখনকার বাড়ীটা নাকি মেঘ ছুঁতে পারে! বিকেলে কফিকাপ নিয়ে টেরেসে হাঁটতে হাঁটতে তুমি তাদের সাথে গল্প করো! যাক্ এই ভালো।
আমিও ভালোই আছি আমার মাটির স্বপ্ন নিয়ে। চাঁদ, মেঘ নিজেরা নেমে না এলেও পলকছোঁয়া বৃষ্টি, রূপোলী জ্যোৎস্না নামে নিয়ম করে। আমি এতেই খুশী।
শরীরের যত্ন নিও।
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, বিবর্ণ শাড়ীটার হলদে রঙখানাকে এখনও বশ মানিয়ে রেখেছি নানা অজুহাতে।
ভালোবাসা মন্দবাসার বন্ধনে ভালো থেকো চিরকাল।
ইতি-
ময়ূরাক্ষী
58, টাওয়ার হিল
লন্ডন
15ই অক্টোবর 2007
(৩)
প্রিয় পঞ্চম,
বেশ অনেকদিনের বিরতির পর চিঠি লিখতে ইচ্ছে হল তোমায়। যদিও, বহুদিন ধরেই তোমাকে চিঠি লেখার লোভটা বায়না সাজাচ্ছিল, আজ কলমটাকেও বাগে আনতে পারলাম না। তাই একখানা ফুটিফাটা সাদাবুকে সে কালির আঁচড় দিয়েই ফেলল।
না। আজ কোনো অভিযোগ নয়, আক্ষেপ নয়। অভিমান... তা হয়ত থাকতে পারে। অভিযোগের গলি ভুলেছি বহুকাল। তুমি প্রথম থেকেই চওড়া রাজপথের বুকে পা ফেলে অভ্যস্ত। আর আমি! এঁদো গলি ছাড়িয়ে তোমার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে গিয়ে কতবার যে হোঁচট খেয়েছি তার হিসাব নেই। শেষটায় বুঝলাম, ও পথ আমার জন্য নয়। তুমিই বুঝিয়ে দিলে। আমি হোঁচটের ক্ষতে সান্ত্বনার প্রলেপ দিচ্ছিলাম, তুমি ততক্ষনে আমার চোখের নদীর সীমানা ছাড়িয়ে অন্য সাগরে সপ্তডিঙা মধুকর ভাসিয়ে দিলে। আর কোনো ঠিকানার কথা জানতে চাইনি কোনোদিন। তারপর থেকে আমার রোমন্থনের পাতায় তোমার নাম লিখে রেখেছি। এখনও নির্ঘুম, নির্জনতায় তোমাকে অভ্যাস করি একান্তে।
জানো, এখনও কিছু হিজিবিজি লিখতে বসলেই আমার সব অক্ষর, শব্দ তুমি হয়ে যাও। পংক্তিগুলো পরপর নিপাট তোমাকেই রচনা করে যায়।
আমার ব্যালকনিতে শখ করে রাখা ভিনদেশী পাতাবাহার বা বাগানে অযত্নে বেড়ে ওঠা জংলাফুলগুলো বৃষ্টি হলেই অকারণে ভীষন চঞ্চল হয়ে ওঠে। ঠিক পুরোনো তুমিটার মত। বড় বড় ফোঁটার ভীড়ে, কল্পনায় আজও আষ্টেপৃষ্ঠে ধরি তোমার নীল আস্তিনখানা। খুব জানতে ইচ্ছে করে লন্ডনের বর্ষা মন ভেজায়? হাইড পার্কের সবুজে হারানো কথারা উঁকি দেয় কখনও? টেমসের জলে কোনো পুরোনো প্রতিচ্ছবি দেখতে পাও? এমন কত কথা জানতে আর জানাতে ইচ্ছে করে তোমায়। কলকাতার অসহ্য গরম আজকাল সব ইচ্ছে অনিচ্ছেকে পুড়িয়ে দেয়। যদিও পরিপাটি জীবনে সে খবরে তোমার কাজ নেই। আমিও বুঝেছি অপারগতা মানুষের মূল্য কতটা কমিয়ে দেয়। আমাদের মাথার ওপরের বাস্তবের আকাশ বুঝিয়ে দিয়েছে স্বপ্নরা বন্ধ চোখেই সুন্দর, পবিত্র। চোখ খুললেই সেগুলো যন্ত্রণা হয়ে যায়, সহিষ্ণুতার গায়ে কলঙ্কের ছাপ আঁকে।
একদিন সব বোঝাপড়া শেষ হবে জানি। ফুরিয়ে যেতে যেতেও অভিমানটুকু গচ্ছিত রাখব কথা দিলাম। একটা অনুরোধ করব, রাখবে? চিরতরে মুছে যাবার আগে তোমার অপ্রেমের স্বরূপখানার কোনো একটা উদাহরণ পাঠিও। নিজেকে অন্ততঃ এটুকু প্রবোধ দিতে পারব, যাকে প্রেম বলে আজও জড়িয়ে আছি তা নিতান্তই অসচেতন করুণা।
ভালো থেকো।
ইতি-
ময়ূরাক্ষী
58, টাওয়ার হিল
লন্ডন
27শে নভেম্বর 2007
(৪)
চিঠির উত্তর:
প্রিয় ময়ূরাক্ষী,
তোমার সব চিঠিই পাই। প্রতিবারই ভাবি জবাব পাঠাব কিন্তু শুরুতেই হোঁচট খেয়ে পড়ি। কি লিখব? কি জবাবদিহি করব? তার কতটুকুই বা তুমি গ্রহণ করবে এইসব ভেবে। তোমার বহু অভিমান, অনুযোগের অশ্রু, বিনির্মিত অক্ষর হয়ে ঝরে পড়েছে একেকটা চিঠির বুকে, তা আমি উপলব্ধি করি। কিন্তু অনেকটা দেরী হয়ে গ্যাছে হয়ত………………..!
তোমার কাছে চাইবার অধিকার আমি হারিয়েছি বহুযুগ। তবুও জানতে ইচ্ছে করে- কপালের বাঁকা ভ্রূর মধ্যিখানে আধফালি চাঁদ উঁকি দেয়? গাঢ় কাজলের ভালোবাসায় আজও ভরে দীঘল চোখের বাঁকা চাহনি? আধোঘুমে, ভোরের প্রথম প্রেমের লালে রাঙানো, তোমার মুখখানা দেখার সাধ আজও হয়। যদিও বহুকাল তোমায় স্বচক্ষে দেখিনি, কিন্তু তুমি আমার মানসপটে আজও সেই কুড়ির দোরগোড়ার রাইকিশোরী হয়েই ধরা আছ।
তুমি লিখেছিলে, কুসমী হলুদখানাকে নানা বাহানায় এখনও বশ মানিয়ে রেখেছ। ঠিক সেভাবেই, আমিও প্রথম যৌবনের রোদটুকু আজও তুলে রেখেছি পাঁজরের ভাঁজে, তোমার নামের পাশে।
আমার টেরেসে শখ করে সাজানো আছে তোমার পছন্দের রডোডেনড্রন। এছাড়াও দু একটা জেরানিয়াস, গোল্ডেন রড, গোলাপও রেখেছি। ‘শেষের কবিতা’ র ঐ অংশটা তোমার খুব প্রিয় ছিল, প্রায়ই আবৃত্তি করতে ..’অরুণ মেঘেরে তুচ্ছ,/ উদ্ধত যত শাখার শিখরে/ রডোডেনড্রনগুচ্ছ।’ দেখো আমি কিন্তু ভুলিনি। যখন এখানকার আকাশ ছেয়ে যায় বিরহের মেঘে, দু একটা মেঘ নেমে এসে পাশে বসে। জানো- গাছ, ফুল, দলছূট মেঘেদের আমি আমাদের গল্প শোনাই। আমাদের ঘুমভাঙা শিউলি ভোরের গল্প, হলুদ আঁচলে লুকোনো প্রথম উষ্ণতার গল্প আরও কত কি!
তোমার উঠোন ছুঁয়ে আসা জ্যোৎস্নার কাছে শুনেছি তুমি এখন পাকা গিন্নীটি হয়েছ! আমার পাগলীটা আর নেই। চাল, ডাল, মাসকাবারির ফর্দের মায়ায়, সোহাগের রাত্রিবাসের চাদরে তুমি খুঁজে পেয়েছ সত্যিকারের ঘর। হৃৎপিন্ডটা উপড়ে ফেললেও বোধ হয় এতটা রক্তক্ষরণ হতনা, যতটা তোমার হৃদয়ের তারে অন্যসুর বেজে ওঠার খবরে হয়েছে।
ময়ূর, তোমাকে আমি কিছুই দিতে পারিনি শুধু আক্ষেপ ছাড়া, স্বীকার করি। আসলে কি জানো কিছু মানুষ থাকে যারা একাকীত্বের যন্ত্রণা আর আজীবনের অপেক্ষার মধ্যেই খুঁজে নিতে চায় সত্যিকারের ভালোবাসার সুখ। বাঁধাধরা জীবনে তারা নির্লিপ্ত। আমিও হয়ত তাদেরই দলের লোক।
শেষ চিঠিখানায় তুমি কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলে, তবে তার রেশ ধরেই বলি… তোমাকে হারানোর পর থেকে আমি ভেজা আকাশ জড়িয়েই বেঁচে আছি। তাই লন্ডনের বর্ষা নতুন করে আর ভেজায় না। 58, টাওয়ার হিলের আইরিশ অ্যাপার্টমেন্টের ফিফথ্ ফ্লোরের একদম শেষের ঘরখানার দেওয়ালের প্রত্যেকটা ইঁটের ভাঁজে গুছিয়ে রেখেছি আমাদের ছেড়ে আসা দিনরাতের প্রতিশ্রুতির লিপি। একদিন যে ছিল সত্ত্বার প্রতিরূপ তার প্রতিচ্ছবি টেমসের জলে আলাদা করে ফুটে ওঠা নিষ্প্রয়োজন।
জানো ময়ূর, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বাঁধভাঙা বন্যার মত, মেঘভাঙা ভালোবাসা এঁকে দিই তোমার স্থাবর, অস্থাবর পবিত্রতার খাঁজে খাঁজে। উপেক্ষা করি সব কলঙ্কের দুর্নাম। তুমি রাগ করবে? বিদ্রোহ করবে? নাকি সমর্পণ করবে অভিমানের অঞ্জলি? তোমার ভালোবাসার সব অভিশাপের ভাগীদার এখনও শুধু আমিই।
আমি চাইনা আমাদের বোঝাপড়া মিটে যাক্। আমরা একদিন ফুরিয়ে যাব, কিন্তু আমাদের অক্ষরেরা বেঁচে থাকবে টেমসের কুলকুল জলে, হাইড পার্কের ঘাসেদের মেহেফিলে, আর আমাদের স্বপ্নময় অসমাপ্ত ঘরে।
ময়ূর আমি পুড়তে চাই। তোমার আগুনে। তোমাকে না পাওয়ার তাড়নায় জ্বলে খাঁক হয়ে যাক আমার সাফল্যের সজীবতা এই প্রার্থনা করি।
ভালো থেকো। পারলে কখনও স্বপ্নে এসে জানিও অপূর্ণ হৃৎস্পন্দনের কথা। নিদারুণ উদ্দীপনা নিয়ে আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব।
ইতি-
আজও তোমার
‘পঞ্চম’
হেমন্তিকার "পত্র সাহিত্য"
ক ন ক কা ন্তি ম জু ম দা র
প্রেরকঃ বঞ্চিত প্রেমিক
বিপর্যস্ত গ্রামের, পশ্চিমবঙ্গ
প্রেরিতঃ সুখ স্মৃতির তাকে
বরিশাল, বাংলাদেশ
২৬ শে নভেম্বর ২০২৩
প্রিয়তমা,
তোমাকে সম্বোধন ছাড়াই ডাকি। থাকনা মোহ মাখানো আদরের ডাকটুকু এখন তোলা। যদি সত্যিই তোমার হতে পারি সেদিন আবার নামটি নতুন করে উপহার দেবো। জানি এজন্যে রাগ করবে না। এখন তো সেই উন্মাদনা তোমার রুচির বাইরে। বেশী কথা বলাতেও (কথা মানে ম্যাসেজ) অনীহা।
একদিন কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে যেমন বলতে আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাবে। তুমিই তো আমার স্বামী শুধুই আনুষ্ঠানিক বিয়েটা বাকী। তখন তোমার আমার সুখের নীড় হবে। আমার পৃথিবী তোমার পৃথিবীতেই বিলীন হবে। দ্যাখো তা কিন্তু হয়নি। এখন তাই বুঝি সেইভাবে ভাবোইনা। আমিও তাই কবিতার ভালবাসায় সমর্পিত প্রাণ। কবিতাতেই বাঁচি। তুমি ছেড়ে যাবার পর (হঠাৎই তো বলা নেই কওয়া নেই হারিয়ে যাওয়া) কবিতার কাছেই কেমন শান্তি খুঁজে পাই। তুমি এসব কথায় হয়ত বিরক্ত বোধ করছ, রেগে যাচ্ছ। নাকি বীতরাগের অভিমান। নীরব আগমন নিশ্চুপের গমন। দেখো এটা স্বাভাবিক এটাই নাছোড় প্রেমের প্রকাশ। মানে আমি পুরোপুরি বাতিল হইনি। ছেদ্দা-আচ্ছেদায় আমার অস্তিত্ব তোমার অবচেতনে এখনও আছে। তাই জানান দেওয়া আর এটাই সান্তনা।
জানিনা তুমি কতটা ভাল আছো। আমি কিন্তু ভাল নেই। কেন জানো? না জানো না। যেমন আমি জানিনা তোমার মনের ভিতর কি ভাবনার আনাগোনা। বলার জন্য তাইতো ভাষা। যাতে একে অপরকে জানতে বুঝতে পারে। তুমি তো বললে না, ভাষায় প্রকাশ করলে না মনের চেপে থাকা মনের কথা। কিন্তু কেন?
আচ্ছা এই যে আমার থেকে আড়াল, কথার উত্তর না দেওয়া, এর কারণ কি বিশ্বাস যোগ্যতার অভাব, নাকি নিজের করে ভাবতে কষ্ট হয়?
থাক্ অস্বস্তিকর উত্তর নাইবা দিলে। ভাল থেকো নতুন ভালোর দুনিয়ায়।
তোমার হতে চাওয়া সেই আমি---
বন্ধুকে
অ র ণ্যা নী
প্রিয় সখা,
ছেড়ে যেও না। শৈশব থেকে তোমার সঙ্গে আমার নাড়ির টান। চোখ ফুটতেই তোমার হাত ধরে চলেছি। কোন পথে চলেছি, তা কখনো ভেবেই দেখিনি। নিশ্চিন্তে তোমার সঙ্গে খেলতে খেলতে এগিয়ে গেছি। কবে যে শৈশব, কৈশোর, যৌবন, অতিক্রম করে গেলাম, খেয়ালই করতে পারিনি। আজ প্রৌঢ়ত্বে এসে বড় ভয় হয়। যদি তোমাকে হারাই - - - তুমি যে আমার সবচেয়ে আপনার জন। অনেক ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে গড়েছি। মাঝে একটা সময়ে ভুলে ছিলেম তোমায়। আবারও খুঁজে পেয়েছি কিনা বুঝি না। আচ্ছা, তুমিই বলো, জীবনের এতটা পথ পার হতে গিয়ে পরিবর্তন তো কিছু ঘটবেই। শিশুর সেই সহজতা কি আর থাকে? থাকতে তো কেউ দেয় না। আমিও তাই কিছু বদলেছি। কিন্তু তোমাকে ভুলিনি। তুমিও সেই যে শৈশবে আমার হাতটা ধরেছিলে, কোনদিন আর হাত ছাড়োনি। তাই আমি এতটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারি।
আচ্ছা বন্ধু, একটা কথা তোমায় জিজ্ঞেস করি। এই শিশুর দুনিয়াটা সারা জীবন থাকে না কেন? এ কেমন জগৎ তুমি রচনা করেছ? বড় এখানে হতেই হবে? শিশু থেকেও তো খেলার ছলে দায়িত্ব কর্তব্য পালন করা যেতে পারত। কেন এতো জটিলতা সৃষ্টি করলে? নাকি তুমি করোনি। মানুষই ধীরে ধীরে বুদ্ধির বৃদ্ধি ঘটিয়ে এতো জটিল হয়ে গেছে? তুমি তো আজও শিশুর মতোই সরল আছো। তাই তো কষ্ট পেলে তোমার কাছে চলে আসি। জীবনের শেষ পর্যায়টা এখনো বাকি। এই পরিবর্তিত আমাকে ভালো লাগবে তো তোমার? আর কিছু দিন অপেক্ষা করো। বার্ধক্যে এসে আবারও আমি আমার ভেতরের শিশুটিকে ঠিক খুঁজে পাবো। এখন থেকেই সেই খোঁজার কাজ শুরু করে দিয়েছি। আবার যখন শিশু হবো, তখন তোমার সঙ্গে শিউলি তলায়, পুকুর পাড়ে আবার আমি খেলবো। অনেক দূরে আমরা একদিন খেলতে খেলতে হারিয়ে যাবো।
আমার অন্তরের ভালোবাসা নিও প্রিয়। এ চিঠি খানি মন দিয়ে পড়ো। আমার মনের এটুকু আশা পূরণ করো। আর কিছুই চাই না। তুমি আমার সঙ্গে থেকো।
ইতি - তোমার সখী
প্রিয় কবিকে
দে ব যা নী ঘো ষা ল
প্রিয় কবি,
তোমার লেখায় মুগ্ধ হয়ে ফেসবুকে কতই না কথালাপ কমেন্ট বক্সে হত। তারপর ম্যাসেঞ্জারে কোন একটা লাইনের মানে বোঝাতে কতই না বাস্তবতার সাথে লড়তে হতো। নিয়মিত লেখাগুলো বড় প্রাণময় ছিল তোমার। তুমি একদিন আমার হোয়্যাটস্ অ্যাপ নং চেয়ে বসলে। দিনকাল ভাল নয়। যতই তুমি জ্ঞানী বুদ্ধিমান স্বল্প পরিচিত হও না কেন। বিশ্বাসে একটু নাড়া দিল। দিতে না চেয়েও দিয়ে ফেললাম। যখন কথালাপ কবিতা থেকে বাস্তবিক টানাপোড়নকে ঘিরে চলতে লাগলো। ম্যাসেঞ্জারেই ইংরেজী শেখাচ্ছিলে। কিন্তু আমার মত নিরেট মস্তিষ্ককে তুমি পারলে না বাগে আনতে। আমার অনুরোধ রাখতেই সেই নং চাইলে। দেবনা দেবনা করেও দিয়ে দিলাম সি.ভি চেয়েছিলে বলে। কেন এমন প্রতারণা করলে কবি? আজ তো ছ বছর অতিক্রান্ত। প্রমান দিতে দিতে আমি ক্লান্ত অবসন্ন। একটা কর্মসংস্থান তুমি করে দিতে পারলে না আজও তুমি একজন ম্যানেজার পোস্টে চাকরি করেও! কেবলই তোমার আমার রোজনামচার কথা তিন চারমাস অন্তর কয়েক মিনিটের কথায় পর্যবসিত হল। অথচ প্রথম প্রথম যে কবিতাটা তুমি ফেসবুকে দিতে সেটা আগে আমাকে দিতে হোয়্যাটস্ অ্যাপ এ। নিজেকে বোঝাতে চেয়েছো কবিতার আকারে। যখনই এই বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছি, চেয়েছি তোমার যন্ত্রনামুখর জীবনের অতল জানতে, সন্তর্পনে এড়িয়ে গেছো। একদিন বলেছিলে ভালবাসো আমাকে। কিন্তু এত বছর পরে জানলাম ভালবাসার অর্থ তুমি জানোনা। তুমি আমার মনই জানোনা। ভালবাসবে কি করে? না হয় অভুক্তই থাকলাম একবেলা। তবু বিশ্বাস হারালো বহুগামীতায়। হ্যাঁ সরাসরি তুমি আমার কর্মসংস্থান করোনি বটে। তবে বিরহ দিয়েছো। করেছো প্রতিবাদী কবি। যার লেখনীতে শতভাগ তোমার প্রতি অকৃত্রিম ক্ষোভ প্রকাশ। প্রচুর সম্মাননায় পূর্ণ আমার সুসজ্জিত শোকেসটি। মধ্যগগনে এসে এমন প্রেম কজন দিতে পারে?
বলেছিলে ভাল থেকো। আজ আমার ব্লকলিস্টে তুমিও। তোমার সাথে আমার ডিভোর্স হয়েছে বছর খানেক। মানে ব্লক করে তোমার না পারি কবিতা পড়তে না পারি তোমাকে দেখতে। অনেক চোখের জল আর রাত্রিযাপনে আমি ভালই আছি।
তোমাকে মুক্তি দিতে পেরে আমিও বলবো ভাল থেকো।
তোমার
অনামী
প্রিয় মনকেমন
সু মা গো স্বা মী
প্রিয় মনকেমন,
আজ খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে একটিবার ছুঁয়ে দেখতে। উহু শরীরী স্পর্শে নয়। অক্ষর মালার আদরে তোমাকে ছুঁতে চাইছে এ মন। তাই একটা ছোট্ট চিঠি লিখবো, তবে সে চিঠি ডাক পিয়নের হাতে দেব না। হয়তো তোমার প্রিয় কোয়েল নদীর চড়ায় আলতো করে রেখে আসবো।
ঝিম ধরা দুপুরটা যখন রায় বাড়ির রোয়াক ছেড়ে যেতে চাইতো, সেই সময় একদৌড়ে ছুটে আসতাম তোমাকে দেখবো বলে। বিনুনি বাঁধা একদল মেয়ের সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত থাকলেও উঁকি দিয়ে বারবার দেখতাম তোমাকে। বেলা পড়ে আসতো, বাড়ি ফিরতাম।
সন্ধ্যায় মা শাঁখ বাজাতো, আমি আনমনে কতো কিছু ভাবতাম। হয়তো তোমার সাথে পথ চলা সারাদিনের ছবিগুলোর সঙ্গে মনে মনে কথা বলতাম। এরপর পড়তে বসা আর রোজের রুটিন।
যতোদিন তুমি সাথে ছিলে বুঝতে পারিনি বিচ্ছেদের যন্ত্রণা। কোনোদিন জানতেও চাইনি তুমি কেমন আছো। হয়তো ভাবতামই না তোমার কথা অথবা ভাবতাম তুমি তো চিরদিন আমার সাথেই থাকবে, আমার সুখেই সুখী আবার আমার দুঃখেই দুঃখী হবে।
আজ এই পড়ন্ত বেলায় এসে অনুভব করছি তোমার অনুপস্থিতি। খুব জানতে ইচ্ছে করছে তুমি এখন কেমন আছো? মনে কি পড়ে তোমার সেই পোশাকি নামটি? উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে আমিই বলছি তোমার পোশাকি নাম 'আমার মেয়েবেলা'।
ইতি
আমার পড়ন্ত বেলা।
কবি তোমাকে
মা লা চ্যা টা র্জ্জি
প্রিয় কবি,
অনেকদিন বাদে তোমার বাড়িটা দেখলাম। বাড়ির সামনে বটগাছটা কিন্তু এখনও ডালপালা
ছড়িয়ে আছে। তার ছায়ায় বেড়ে উঠেছে একটা ডুমুর আর একটা ফলসা গাছ। আগে তোমার
বাগানে বেশ কিছু ফলন্ত গাছ ছিল। পেয়ারা,আম, কাঁঠাল। তরুণ লেখক, কবিরা কলকাতা থেকে এলে কতবার পেড়ে খেয়েছে, সাজানো-গোছানো
বাগানে দোলনা চড়েছে। বাগানের মধ্যে সেই পরীটা এখন আর নেই?ভেঙেচুরে গেছে? গদাই বলে সেই মালিটা এখন বুঝি আর কাজ করে না?
তোমার তো শুনেছি হার্টের ব্যামো। বাগানে ফুলেদের গায়ে হাত বোলাও না এখন আর! সব অযত্নে নষ্ট হয়ে গেছে!আগে তো ফুলেরা তোমার বাগানে খুব হাসতো। নাম না জানা কত পাখি এসে এডালে ওডালে ঘুরে বেড়াত। তারা ঠোঁটে খড়কুটো বুনতো। চৈত্র দুপুরে পাতা ঝরে গেলে সন্ধ্যাবেলাতে দেখেছি শূন্যডালে বেনে-বউকে একলা দাঁড়াতে।
অনামা নদীর একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে তোমার বাড়ি। নদী বাঁক নিতে নিতে তীরে বালি জমিয়েছে। কতদিন দেখেছি কবিতা লিখে লিখে তুমি জলে ভাসিয়ে দিয়েছো। জিজ্ঞাসা করলে
বলতে ওটাই তো আমার সুখ। ওটাই আমার অসুখ। এখনও মাঝে মাঝে বলো?
“আমি এই বনপথে একা উদাসীন
কতক্ষণ থাকতে পারি কতক্ষণ থাকা যায়
অচঞ্চল !”
কবি, তুমি একদিন ঠিক দেখতে পাবে তোমার লেখার খসড়াগুলি বই আকারে ছেপে অজস্র
হাততালি কুড়োচ্ছে। আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি---
ইতি---
তোমার কবিতার ভক্ত একজন পাঠিকা।
অস্তিত্বের অধিকার
অ ন্ন পূ র্ণা দা স
প্রিয় ম্যাডাম,
কেমন আছেন ম্যাডাম? আমি ভালো আছি। অনেক কিছু সময়ে শিখেছি। আর প্রতিনিয়ত শিখে চলেছি। এটি এখন জীবনের পাঠশালা। বাস্তব জীবন শিক্ষা দিচ্ছে। তবে কিভাবে চলা উচিত, তা আপনার কাছে ছোটবেলায় কিছু মন্ত্র পাঠ এর মধ্যে দিয়ে শিখেছি। তবে আজ একটি আপনার গুড মর্নিং ম্যাসেজ পেলাম। আমার চলার পথটি আরও সহজ হলো। আমি কোনটি কল্পনা দিয়ে গল্প সাজাই আর কোনটি আমার বাস্তব সমস্যা, তা ঠিক আপনি ধরে ফেলেছেন। তাই আমি কিছু না বললেও এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার পথ আপনি দেখিয়ে দিলেন। আমি অবাক হলাম। আর বসে বসে ভাবতে শুরু করলাম। কি করে আপনি সব বুঝতে পারেন? আমার না বলা কথা, আপনি কি করে ধরতে পারেন? তখন ছোটবেলায় ফিরে গেলাম, আর মনে পড়ে গেলো, সেই সব পুরোন স্মৃতি, যা মনে করিয়ে দেয়, আপনার হাসি মুখের স্নেহ, ভালোবাসা আর তা থেকে পাই এগিয়ে যাওয়া প্রেরণা শক্তি। আপনি তো ম্যাডাম। তাই আপনি বুঝতে পারেন, কোথায় ছাত্র-ছাত্রীদের সমস্যা হচ্ছে। আজ যখন সংসার জীবনে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে যখন প্রশ্ন তুললাম নিজের কাছে; এবং যখন ভীষণ রকম মানসিক যন্ত্রণায় ঘুমোতে পারছিলাম না। ঠিক তখন আপনার, ম্যাসেজ অন্তরে শান্তি প্রদান করলো। এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পেলাম। আমি আপনার ঠিকানায় এই চিঠি দিতে পারবো না। আমি আপনাকে বলতেও পারবোনা। এটি আমার একান্তই ব্যক্তিগত। তাই এই চিঠি ফেসবুকে দিলাম। আমি জানি আপনি ঠিক বুঝতে পারবেন। আপনাকে আমি আমার স্নেহ, ভালোবাসা, প্রণাম দিলাম।
তবে আপনাকে একটা কথা দিলাম, সমস্যা দেখে চিন্তিত হব না। বরং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবো। ছোটবেলায় যখন দৌড় প্রতিযোগিতায় নাম দিতাম আর প্রথম হতাম তখনই বুঝতে পেরেছিলাম পেছন থেকে আপনার এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহই আমাকে প্রথম করতো। আমার সফলতায় আপনি খুশি হতেন। আজ এই বাস্তব জীবনে নিজের অধিকার, অস্তিত্ব রক্ষা করার লড়াইয়ে আমি জেতার জন্য বদ্ধপরিকর, লড়াই না করে পথ ছাড়বো না।
ইতি,
আপনার ছাত্রী রূপকথা।
এসো নববর্ষ
সু স্নি গ্ধা রা য় চৌ ধু রী
সুধী নতুন বছর,
প্রথমেই জানাই তোমাকে স্বাগত, নতুন ভাবে পুরাতন খোলসে নতুনের আহ্বান।
আজ আর কিছুক্ষণের মধ্যে নতুন বছরের আভাস পাবো, কিন্তু পুরাতন সে কি রয়ে যাবে মনের বাইরে? পিছু হটবে সে স্মৃতি হয়ে? আমি বলি, না---। সে রয়ে যাবে মনের গহীনে যেখানে রয়েছে অনেক অতৃপ্ত বেদনা। নতুন বর্ষ, তুমি আসছো তোমাকে বরণ করছি আলোয়, ফুলে। আর বিদায়ী বর্ষ, তোমাকে বিদায় না বলে বলতে চাই তুমিও স্বাগত তবে সংশোধিত রূপে, সেও তো নতুনেরই নামান্তর। গত বছরের শুরুটা হয়েছিল প্রতিবারের মতো শ্রীশ্রী ঠাকুরের কল্পতরু উৎসব দিয়ে যা প্রতি বছর হয়ে থাকে আমাদের গৃহে। তবু দেখেছি প্রথম থেকেই চলেছিলো বিভিন্ন টানাপোড়েন ও টালবাহানা--- সে আমার জীবনে ও পারিবারিক জীবন এমনকি আমাদের সাহিত্য সাংস্কৃতিক জীবনেও। কিছু ভুল বোঝাবুঝি কিছু মানুষের ভুলের শিকার হতে হয়েছে আমার মত আরো অনেককেই। লেখালেখির ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি ঘটলেও কিন্তু মানসিক অশান্তি ঘিরে রেখেছিল চতুর্দিক। চলতি বছরের মাঝখানে পারিবারিক দুর্ঘটনায় জীবন দুর্বিসহ হয়েছিল, তার থেকে মুক্তি পাওয়া যায় নি। শিক্ষা বলো চাকরী বলো কোনো দিকেই শান্তি নেই। মানুষের লোভ লিপ্সা মাত্রারিক্ত বেড়ে গেছে। এছাড়াও মানুষের রোগভোগ, অকাল মৃত্যু--- সবার জীবনের এক দীর্ঘ ছন্দপতন ঘটিয়েছে। এই বছরের সাহিত্য ও বিনোদনের ক্ষেত্রে নক্ষত্র পতনে ব্যথিত আমরা। এককথায় বলতে চাই গত বছর কোনোভাবেই সুখকর হয় নি। তাই আগত বর্ষকে বলি, এসো মহা সমারোহে যেমন মহা সমারোহে আসছো তেমনি উদ্দীপনায় পরিপূর্ণ জীবন সবাইকে দাও।
দাও সুষ্ঠু শিক্ষা ও সংস্কৃতি, দাও সুন্দর জীবন, দাও লোভ লিপ্সাহীন জীবন। পরিশেষে বলি, মানুষের মধ্যে চিরশান্তি বিরাজ করাও যাতে তারা সুন্দর ভাবে জীবন নির্বাহ করতে পারে ।।
ইতি -----
সুস্নিগ্ধা
শেষ চিঠি
স ন্দী প সা হু
শুধু দেখলে আমি তোমায় ছেড়ে চলে এসেছি! মনে মনে ভেবে নিলে আমার ভেতরে আনন্দ সুখ আহ্লাদ ফল্গুর মতো নয় একেবারে নির্লজ্জ বেহায়া নদীর মতো উচ্চ পেশার স্বামীর বাহু লগ্ন হয়ে ঝর্নার মতো, উচ্চগতিতে বয়ে চলেছে। তোমার চোখ তা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে। তোমার দেখা আমার সুখ ফল্গু-অশ্রু হয়ে তোমাকে সুখ দিয়েছে!
তুমি নিজেকে দেবদাস ভেবেছো। ভেবে ভেবে আনন্দ পেয়েছো। করুণায় মাখো মাখো হয়ে বন্ধুদের সহানুভূতি কুড়িয়ে আনন্দ পেয়েছো। সবাই, সব্বাই আমাকে বাজে মেয়ে বলেছে। তোমার বন্ধুরা, তোমার বৌদি কতবার না বলেছে, মেয়ের কী অভাব? ওর থেকেও ভালো সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবো! তুমি মনে মনে রসিয়ে রসিয়ে নিজেকে মহান বানিয়েছো।
সাত বছর কম সময় নয়। রাজনীতির ঝাণ্ডা ধরে মস্তানি করতে। মদ সিগারেট প্রায়ই চালাতে ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে। আমাকেও মিথ্যা বলতে। কতবার বলেছি পড়াশোনা করো। প্রতিযোগিতায় বসো। তুমি হেলায় হেসে বলেছিলে, চাকরি নাকি তুমি যখন তখন পেতে পারো! শিবুদাকে বললেই চাকরি হয়ে যাবে! এই করে করে সাত সাতটা বছর কাটালে! আমার বাবা মা শুধু চেয়েছিল মোটামুটি একটা চাকরি। তুমি সুন্দর মাউথ অর্গান বাজাতে। ওতেই আমি মজে ছিলাম। মাউথ অর্গানে সুর উঠলে নিজেকে যেন রাধা রাধা মনে হতো। আমি তোমাকে খুব ভালোবেসে ছিলাম। আমার বাবা মা-কেও খুব ভালোবাসি। সাত, সাতটা বছর সময়, কম নয়। আমাকে ভালোবাসলে একটা কিছু লাগাতেই। আসলে আমাকে ভালোবাসনি!
এই যে আদিখ্যেতা করে বলছো, এখন অনেক প্রেমিকার যোগ্য হয়েছো তুমি! কিন্তু কাউকে স্থান দাওনি মনে। আমার জন্যই নাকি তোমার মনশূন্য।
আর কত ঠকাবে মানুষকে। নিজেকেও।
এই রকম আর কোনো দিন চিঠি লিখবে না। আমার স্বামী আমাকে খুব ভালোবাসে। সবসময় তটস্থ থাকি, আমি ঠিক মতো ভালোবাসা ফিরিয়ে দিচ্ছি তো! দোহাই তোমার, আমাকে আর চিঠি লিখবে না। ওই সহজ সরল লোকটাকে মন থেকে ভালোবাসতে দাও। শান্তি দাও।
ইতি
শেষবারের মতো তোমার ...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন