প্রবন্ধ
ছড়ার বিবর্তন : প্রাচীন থেকে আধুনিক
সু জা তা দা স
কবিতা হলো শব্দের ছন্দময় বিন্যাস যা একজন কবির আবেগ অনুভূতি উপলব্ধির চিন্তাকে প্রকাশ করে এবং শব্দের ছন্দায়িত ব্যবহারের কারণে কবিতা ছান্দিক ও শ্রুতিমধুর করে। ছড়া হলো মুখে মুখে উচ্চারিত ছন্দময় ঝংকারিত পদ্য, যাহা বাংলা ভাষায় মহাকাব্যের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যা রামায়ণ ও মহাভারত নামে খ্যাত- এই দুটি ভারতবর্ষ উপমহাদেশের যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনীর সমন্বিত লোকগাথা। মানব মনের কল্পনা যখন অনুভুতি রঞ্জিত শব্দসমূহে ছন্দাময় রূপ লাভ করে তা হলো কবিতা।
বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি বিশেষ দিক হল ছড়া, "বঙ্গীয় শব্দকোষ" অনুসারীদের লৌকিক বিষয় নিয়ে রচিত শব্দের গ্রাম্য রূপ কবিতা। ছড়া সাধারণত মৌখিক আবৃত্তির জন্য মুখে মুখে রচিত হয়, এর একটা বিশেষ ছন্দও থাকে। যুগে যুগে এটি বহু সংগ্রাহক সংকলক ও সম্পাদককে আকর্ষণ করেছে,
এর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিচয় লোক সাহিত্যের অন্যান্য বিষয় থেকে ছড়াকে স্বতন্ত্র ও মনের অনায়াস সৃষ্টি বলে মনে করেছে।
ছড়া মূলত শিশুতোষ রচনা, কোনও বার্তা বা মনোভাব প্রকাশ হয় না ছড়াতে, শিশুদের ঘুম পাড়ানো বা কান্না ভোলানোর জন্য প্রথমে ছাড়ার জন্ম--- যেমন "খোকা ঘুমালো/পাড়া জুড়ালো/ বর্গি এলো দেশে" অথবা "আয় আয় চাঁদমামা টি দিয়ে যা--- এই জাতীয়। ছড়া মূলত মৌখিক আবৃত্তির জন্য, আর ঐ কারণেই ছড়াতে সহজ শব্দ প্রয়োগ করা হয় যা শুনতে ভালো লাগে এবং সহজে মনে থাকে, তাই সকল যুগে এবং সব ভাষাতেই ছড়ার ভান্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ যা লোক সাহিত্যের বিশেষ সম্পদ।
প্রাচীন লোক সাহিত্যের অন্তর্মূলে ছড়ার জন্ম লালন ও বিকাশ ঘটলেও বর্তমানে তা সাহিত্যের ভাব প্রকাশের আধুনিক রূপ।
এই সময় ছড়া লোক সাহিত্যের বিশেষ ধারাকে অতিক্রম করে ছেলে ভোলানোর গন্ডিকে ছাড়িয়ে এক নতুন রূপ প্রকাশ করেছে।
কবি সচেতন ভাবে নিজের ভাবনায় ও ছন্দে ছড়া রচনা করছেন এবং সেগুলো মানব মনে জায়গাও করতে পেরেছে বলে মনে করা হয়। ছড়া শিশু মনোরঞ্জনের জন্য রচিত হলেও আধুনিক ছড়া কিশোর যুবক বয়স্ক সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই তার গ্রহণ যোগ্যতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।
ছড়া শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত হুড়া শব্দ থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়, এই শব্দটি দেশজ শব্দ হিসেবেও বিবেচিত, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছড়া শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করেছেন সংস্কৃত ছটা> প্রাকৃত ছড়া> প্রা ম-ছিটা> ছড়া। রাজ শেখর বসু যোগেশচন্দ্র রায় এই মতের সমর্থন করেন।
অপরদিকে নগেন্দ্রনাথ বসু বলেন এটি দেশজ শব্দ, ওয়াকিল আহমেদ ছট শব্দ থেকে ছড়া শব্দের উৎপত্তি মনে করেন।
ছড়ার ভাব অসংবদ্ধ অবস্থায় থাকে তাই অভিধানিকরা ছড়াকে গ্রাম্য কবিতার রূপ বলেছেন,
আসলে দৈনন্দিন সামাজিক পারিবারিক উৎসব অনুষ্ঠান পার্বণ গার্হস্থ বিষয়ে নিয়ে বিনোদনকে কেন্দ্র করে মুখে মুখে রচিত বিষয়টিই ছড়া। ছড়ার কাল নির্ণয় করা মুশকিল কারণ এটি পরিবর্তনশীল, লোকবিজ্ঞানী এম ব্লুমফিল্ডের মতে মানুষের স্ট্রাইকিং এক্সাম্পেল অফ দ্যা পোয়েটিক প্রিমিটিভের সূচনা অলমোষ্ট অফ দ্যা প্রিমিটিভ আরচাইসির কালে।
রবিঠাকুরের মতে ইহা শিশুর মতোই পুরাতন যাহা মানব মনে আপনিই জন্মেছে, যারা শোনেন তারা অর্থেও অতীত রস পান,
ছড়া ছন্দে ও ছবিতে মিলে একটা মোহ তাই নামজাদা কবিতার থেকেও ছড়ার আয়ু বেশি।
যেমন "জল পড়ে/পাতা নড়ে/পাগলা হাতির /মাথা নড়ে।
অথবা "ছোট খোকা বলে অ আ/ শেখেনি সে কথা কওয়া।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতে ছড়া যদি কৃত্রিম হয় তবে সেটা ছড়া নয় হালকা কবিতা, তাতে বাহাদুরি বা কারিগরি থাকতে পারে কিন্তু আবহমানকাল চলে আসা ছড়ার সাথে মেলে না। তার "তেলের শিশি ভাঙলো বলে/ খোকার প'রে রাগ করো/ তোমরা যে সব বড় খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো/তার বেলা--- আজও কালজয়ী।
বুদ্ধদেব বসুর মতে আধুনিক কবির হাতে ছড়া বেরতে পারে এই শর্তে, তিনি বক্তব্য কিছু দেবেন যা হালকা ছোট্ট চটুল শরীরে ধরে যায়, সারাংশ না থাকলে ছন্দের টুংটাং হয়ে পড়ে, সেটা ছড়া থাকে না।
ডক্টর সুকুমার সেন, দীনেশচন্দ্র সেন, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ছড়া হাজার বছরেরও বেশি পুরাতন।
কারও কারও মতে ছড়া মুসলিম আমলেরও আগের এবং সেই সময়েই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে,
ছড়া বিশেষ কোনও একজনের সৃষ্টি নয় ইহা সমষ্টি মনের ভাব, গাম্ভীর্য বা কথার মারপ্যাচ নয় সুরময় ধ্বনিই ছড়ার প্রাণ।
সুকুমার সেনের মতে লোক সাহিত্যের যে শাখাটি অন্তপুরের আঙিনায় স্নিগ্ধ ছায়া ছড়ায় তা ঘুমপাড়ানি ও ছেলে ভুলানো ছড়া,
এর মাঝেই লুকানো সর্বকালের কবিতার বীজ, যেটা মুখে আবৃত্তি করা যায় সেটাই ছড়া আর যেটা তাল ও সুর সহ উচ্চারিত হয় সেটাই সঙ্গীত।
ছড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অকারণ তথ্য নয়, একটি অংশের সাথে অন্য অংশের সহজ মিলন, তাই ছড়াতে ভাব ও চিত্রগত বিভিন্নতা দেখা যায় রসগত অখন্ডনীয়তা বজায় রেখেই।
ছড়া হলো লঘু ভাষার প্রাকৃত ছন্দবদ্ধ আনুপূর্বিক ভাব ও কাহিনীবিহীন ধ্বনিরস বা চিত্র প্রধান সুরাশ্রয়ীর সামিল।
"ডক্টর ওয়াকিল আহমেদের মতে ছড়া মূলতঃ আবেগ অনুভূতি জাত বুদ্ধিপ্রসুত নয়, ছড়া সবাই রচনা করতে পারেন, ছড়ার বিষয় বৈচিত্র্য আছে এখানে লঘুগুরু হাস্য ব্যঙ্গ করুন নানা ধরনের রস আছে, ছড়ার নিজস্ব ছন্দ আছে যা স্বরবৃত্ত নামে পরিচিত, ছড়া আবৃত্তি সুখকর, ছড়ার ভাষা ও প্রকাশ ভঙ্গি সহজ, ছড়া চিত্রবহুল ও ধ্বনি স্পন্দিত তাই স্মৃতিতে ধরে রাখা যায়, ছড়াতে কৌতুক ও ব্যঙ্গ থাকলেও অশ্লীল নয়, ছড়াতে চিরত্ব আছে তাই পুরাতন হয়েও তা সর্বকালের, ছড়া জীবন্ত ও আন্তর্জাতিক।
ছড়ার বৈশিষ্ট্য হলো, ছড়াতে বুদ্ধির থেকেও আবেগের প্রাধান্য বেশি, শিশুদের উপযোগী হলে তা সব বয়সের গ্রহণযোগ্য, ছড়া বৈচিত্র্যধর্মী বিষয়ের দিক থেকে এর নিজস্ব ছন্দ আছে, ছড়ার একটি বৈশিষ্ট্য হল এর একটি অংশের সাথে আর একটি অংশ অতি সহজেই জুড়ে যায়,
যার ফলে ছড়ার মধ্যে ভাব ও চিত্রগত বিভিন্নতা দেখা যায় এর পদগুলো পরস্পর সংঘবদ্ধও নয়, তাই একটি পদ থেকে আরেকটি যেমন ছাড়ে তেমন নতুন পদ ছড়ার সাথে জুড়েও যায়।
কবিতার সবটুকুই ব্যক্তি মনের প্রতিনিধি এবং নিজস্ব হয়েও সর্বজনীন হিসাবে পরিব্যপ্ত,
কবিতার সৃষ্টি ভালোবাসা বা তার বিপরীত অনুভূতি অথবা দর্শন থেকে, ব্যক্তি মনের দাগ যখন বিন্যাসে বাণীবদ্ধ হয় তখন সেই দাগটি কবিতা হয়ে ওঠে শব্দের বাগানে।
ছড়ার ছররা
শং ক র ব্র হ্ম
ছেলেবেলার মা-ঠাকুমাদের মুখে ছড়া শুনে আমরা বড় হয়েছি। প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে ভারতে ছড়া চর্চা হয়ে আসছে। সেই সময়ের অধিকাংশ ছড়াই ছিল নীতিকথা বা উপদেশমূলক কিংবা ভবিষ্যৎ গণনার নির্দেশিকা হিসাবে, যেমন, খনার বচন। এছাড়াও বাঙালির নিজস্ব বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব, অনুষ্ঠান, ব্রত-পার্বণ উপলক্ষে বিশেষত নারীদের রচিত রচনাগুলির মধ্যেও ছড়ার উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। যে’গুলি লোকসাহিত্যের অন্তর্গত।
মানুষ যখন থেকে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখেছে তখন থেকেই নানান ছড়ার সৃষ্টি হয়েছে। শব্দের ব্যবহার এখানে স্বতঃস্ফূর্ত। যুগ থেকে যুগান্তরে এইসব ছড়াগুলি মুখে মুখে চলে এসেছে। রচয়িতার নাম অজানা হলেও, তাঁদের সৃষ্টি রয়ে গেছে আজও। গ্রামীণ জীবনের সরল সাধারণ মানুষ, তাদের চারপাশে দেখা জগৎ থেকেই জ্ঞাতসারে ও অজ্ঞাতসারে মুখে মুখে এই ছড়াগুলি সৃষ্টি করেছেন। লোকের মুখে মুখেই ছড়াগুলি প্রচারিত হয়ে এসেছে। এগুলির কোনও লিখিত রূপ তখন ছিল না। ফলে এগুলির কিছু রাপান্তরও ঘটেছে। অঞ্চলভেদে বাংলা ভাষাভাষী বিভিন্ন জায়গায় একই ছড়ার বিভিন্ন পাঠও প্রচলিত ছিল। যখন থেকে এগুলি লিপিবদ্ধ করা শুরু হল, তখন থেকে এই রূপান্তরের পথ বন্ধ হয়ে গেল এবং ধীরে ধীরে কম জনপ্রিয় পাঠগুলি যায় হারিয়ে।
অনেকের মতে, ১৮৭৩ সালে ভাষাতত্ত্ববিদ 'স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন্' ইংরাজি অনুবাদসহ যে বাংলা ছড়া-সংগ্রহ প্রকাশ করেন তার ‘দুগ্ধ মিঠা, চিনি মিঠা, আরো মিঠা ননী…’ ছড়াটিই বাংলা ভাষার প্রাচীনতম ছড়ার সংগ্রহ। তবে ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত দুর্গাচরণ চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বিক্রম’ নাটকে ছড়াটি পাই – ‘নিম তিতো, কল্লা(করলা) তিতো, তিতো মাকাল ফল।/ তা হইতে অধিক তিতো দু’সতীনের ঘর।।’ এর থেকে বোঝা যায়, ১৮৬৫ সালে দুর্গাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের উদ্ধৃত ছড়াটিই বাংলাভাষায় প্রাচীনতম মৌখিক ছড়া।
বহুল প্রচলিত একটি ছড়া -
"খোকা গেল মাছ ধরতে
ক্ষীর নদীর কূলে
মাছ নিয়ে গেল কোলা ব্যাঙে
ছিপ নিয়ে গেল চিলে।"
আমরা যারা বোকা খোকারা, কাছের জলের নদী ছেড়ে,
ক্ষীর নদীর কূলে মাছ ধরতে যাই (আরও বেশী সুখের সন্ধানে), কোলা ব্যাঙে মাছ নিয়ে চলে যায় আর ছিপ নিয়ে যায় চিলে, মানে ঘটি-বাটি দুই-ই হারাতে হয়।
এই ভাবে প্রাচীন প্রচলিত ছড়াগুলির আধুনিক ব্যাখ্যা, ভাবা যেতে পারে।
অন্য আর একটি ছড়া -
“খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো বর্গি এল দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?
ধান ফুরল, পান ফুরল খাজনার উপায় কী?
আর ক’টা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।।
ধনিয়া পিঁয়াজ গেছে পচে সর্ষে ক্ষেতে জল।
খরা-বন্যায় শেষ করিল বর্ষ এর ফসল।।
ধানের গোলা, চালের ঝুড়ি সব শুধু খালি।
ছিন্ন কাপড় জড়িয়ে গায়ে শত শত তালি।।”
ছড়াটির মধ্যে লুকিয়ে আছে আঠারো শতকে মারাঠাদের বাংলা আক্রমণের ইতিহাস। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত একাধিকবার বাংলায় লুটতরাজ চালায় মারাঠা বর্গিরা। এই বর্গি শব্দটির অর্থ ‘অশ্বারোহী মারাঠা যোদ্ধা’। বাংলায় তখন চলছে আলিবর্দি খাঁ’র শাসন। মারাঠা আক্রমণ ঠেকাতে তিনি ব্যর্থ হন। ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বর্গিরা বাংলায় নিরীহ মানুষের ওপর নির্মম অত্যাচার চালাতে থাকে। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের নামে জোর করে তারা লুঠতরাজ করত। ‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে’— এখানে সেই লুঠতরাজ ও খাজনার কথাই বলা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যও তখন মন্দা অবস্থা, তার সাথে অজন্মা আর খরা মিলে অবস্থা আরও ভয়াবহ উঠেছিল, সেই বর্ণনাও পরের লাইনগুলোয় আমরা পাই। বলে রাখা ভালো, এই মারাঠা বর্গিদের ঠেকাতেই কলকাতায় ‘মারাঠা খাল’ কাটা হয়। তা'তেও বাংলা থেকে তাদের তাড়ানো যায়নি, শেষে ১৭৫১ সালে আলিবর্দি খাঁ সন্ধিচুক্তি করে মারাঠাদের হাতে উড়িষ্যা ছেড়ে দেন এবং বাংলা নিস্তার পায় বর্গি জুলুমের হাত থেকে। পরে ‘মারাঠা খাল’ ভরাট করে 'আপার চিৎপুর রোড' তৈরী করা হয়। বর্তমানে তার নাম 'চিত্তরঞ্জন এভিনিউ'(সেন্ট্রাল এভিনিউ)। বর্গিদের আক্রমণের ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে, বর্গি হানার সেই ভয়াবহ স্মৃতি বাংলার ছড়া গানেও ঠাঁই পেয়ে গেছে।
ছোটোবেলায় বন্ধু-বান্ধব বা ভাই-বোনেরা মিলে আঙুল গুনে-গুনে ‘ইকিড়-মিকিড়’ আমরা অনেকেই খেলেছি।
“ইকিড় মিকিড় চামচিকির
চামে কাটা মজুমদার।
ধেয়ে এল দামোদর।
দামোদরের হাঁড়িকুড়ি
দুয়ারে বসে চাল কুড়ি।
চাল কুড়িতে হল বেলা
ভাত খায়নি দুপুরবেলা।
ভাতে পড়ল মাছি,
কোদাল দিয়ে চাঁছি।
কোদাল হল ভোঁতা
খ্যাঁকশিয়ালের মাথা।”
এখানেও ধরা আছে বাংলা ইতিহাসের একটি অনালোচিত পর্ব। ১৫৯৯ সালে প্রতাপাদিত্য বাংলার একজন স্বাধীন রাজা হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করেন। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর সেনাপতি মানসিংহকে বাংলায় পাঠান প্রতাপাদিত্যকে শায়েস্তা করতে। জলঙ্গি নদী পার হতে গিয়ে মানসিংহ ঝড়ের কবলে পড়েন। এই সময় মানসিংহকে সাহায্য করেন বাংলার তিন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, তাদের সকলেরই পদবি ছিল ‘মজুমদার’ – লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার, ভবানন্দ মজুমদার আর জয়ানন্দ মজুমদার। ভবানন্দ মানসিংহকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাতির-যত্ন করেন, তার বিশাল সেনাবাহিনীর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন এবং নৌকা জোগাড় করে দিয়ে তাকে নদী পার হতেও সাহায্য করেন।
প্রথম লাইনে ‘চামচিকির’ কথার অর্থ চামার। পরের লাইনে ‘চামে কাটা’ কথার মানে ‘গায়ে চামড়া নেই’ যার অর্থাৎ নির্লজ্জ–বেহায়া। আর দামোদরের বন্যা তো সেই সময় প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। বর্ষায় তার ফুঁসে ওঠা দামোদরের সেই ভয়ঙ্কর রূপে ধেয়ে আসার সঙ্গেই তুলনা করা হয়েছে। এখানে ঝড়বৃষ্টির রাতে ফুঁসে ওঠা জলঙ্গিকেই দামোদরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে মনেহয়। ভবানন্দ মজুমদার প্রভাব-প্রতিপত্তির লোভে মানসিংহ ও তাঁর বিশাল সৈন্যবাহিনীর তোষামোদ করলেও তার কর্মচারী বা রাঁধুনি-ঠাকুররা কেনই বা বাংলা আক্রমণ করতে আসা দুর্বৃত্তদের সেবাযত্ন করবেন! তাই বাধ্য হয়েই এতোজনের খাবার আয়োজন করতে গিয়ে তাদের বেলা গড়িয়ে যেত। এভাবেই বাংলায় মুঘল আক্রমণের ঘটনা ও সাধারণ মানুষের দুর্দশার কথাও উঠে এসেছে এই ছড়ায়।
আরও একটি সুপরিচিত ছড়া –
“আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে।
ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজে।।
বাজতে বাজতে চলল ঢুলি।
ঢুলি গেল সেই কমলাফুলি।।
কমলাফুলির টিয়েটা।
সুয্যিমামার বিয়েটা।।
আয় রঙ্গ হাটে যাই।
এক খিলি পান কিনে খাই।।
পানের ভিতর ফোঁপড়া।
মায়ে ঝিয়ে ঝগড়া।।
হলুদ বনে কলুদ ফুল।
মামার নামে টগর ফুল।।”
প্রাচীনকালে, অভিজাত পরিবারের বিয়ের শোভাযাত্রা যুদ্ধযাত্রারই মতোই ছিল। কারণ একটা সময় পর্যন্ত জোর করে তুলে আনা বিজিত গোষ্ঠীর মেয়েদের বিয়ে করতো বিজয়ী গোষ্ঠীর ছেলেরা, এমনটাই নিয়ম ছিল। ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’-তে দেখা যায় তখনকার বিয়েতে জয়ঢাকও বাজানো হত। এই ছড়াটিতে তেমনই একটি বিবাহযাত্রার কথা বলা হয়েছে। মূল ছড়ার প্রথম অংশটি ‘ডোম চতুরঙ্গের’ বর্ণনা।
সপ্তগ্রামের বাগদি রাজা হরিবর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, তাঁর ছিল বাগদি আর ডোম সেনা। বাগদি সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করে, আর ডোম সেনারা রাস্তা তৈরি করে, শত্রুর উপর নজর রাখে। রাজনগরের সামন্তরাজাদের এবং বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের এই ডোম সেনা ছিল। এখানে ‘আগডোম’ মানে অগ্রবর্তী ডোম সেনাদল, ‘বাগডোম’ মানে পার্শ্বরক্ষী ডোমসেনা আর ‘ঘোড়াডোম’ মানে অশ্বারোহী ডোম-সেনাদল। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলেই এই ডোম-সেনারা আগে গিয়ে রাস্তার অবস্থা দেখে আসতেন, পথ তৈরি করতেন এবং ঘোড়ায় চড়ে সমস্ত পরিস্থিতি নজরে রাখতেন আর সেই খবর পৌঁছে দিতেন রাজাকে। এরা হলেন রাঢ় অঞ্চলের অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর শরিক, যাদের নির্ভীক আত্মবলিদানের জোরেই সমাজের ওপর তলার রাজা-মহারাজারা যুদ্ধজয় করছে। ইতিহাসে রাজারাজড়ার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকলেও, ডোমসেনাদের মতো মাঠে নেমে যুদ্ধ জেতানোর কারিগরদের বীরগাথা ঠাঁই পায়নি সেখানে। তাদের বীরত্বের কথা, যুদ্ধের ফলে সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতির কথা তুলে ধরা আছে এই সব ছড়ায়, প্রবাদে, বাংলার লোকসঙ্গীতে আর লোকগাথায়।
দেশে ইংরেজ শাসন কায়েম হওয়ার পর বাংলার একান্ত নিজস্ব ছড়াগুলিতে বিদেশি শব্দ, বিশেষতঃ ইংরাজি শব্দের অনুপ্রবেশও ঘটেছে। এমনই একটি পরিবর্তিত রূপ নীচে দেওয়া হল। এটিও আমাদের খুব চেনা একটি ছড়া, তবে ইংরাজি কথাগুলো বোঝার সুবিধার্থে ইংরাজি হরফেই লেখা হল, যা থেকে এর অর্থ খুব সহজেই অনুধাবন যোগ্য হয় –
“I COME, ভাই COME তাড়াতাড়ি,
যদু MASTER শ্বশুরবাড়ি।
RAIN (/RAIL) COME ঝমাঝম,
পা পিছলে আলুর দম”।
সময়ের চালচিত্র এভাবেই ধরে রেখে আমাদের সমাজজীবনের জীবন্ত দলিল হয়ে আছে এইসব ছড়াগুলি।
তথ্যসূত্র :
বাংলার লোকসাহিত্য (দ্বিতীয় খণ্ড) - ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য
সুররিয়ালিজম (Surrealism)
দে বা শী ষ ভ ট্টা চা র্য্য
কেবলমাত্র গঠনগত নয়, ভাবনা ও আদর্শগত বহু বিভাগে বিন্যস্ত কবিতার অলিগলি। আজকে যে আলোচনার বিষয় তা হলো সুররিয়ালিজম (Surrealism) । শুনতে সুরেলা মনে হলেও এমন সুরেলা বিষয় নয়। বরং জটিল চরম এক মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। বাস্তবের সাথে আবাস্তবতার সংমিশ্রণ।
সুররিয়ালিজম, কথাটা মূলত ফরাসি, যদিও ইংরেজি ও অন্যান্য ইউরোপীয় এবং বাংলাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ভাষাতেও শব্দটা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত। ফরাসিতে ‘সুর’ (sur) মানে হলো ‘উপরে’, আর ‘রিয়ালিজম’ (realism) মানে ‘বাস্তববাদ’। অর্থাৎ, সুররিয়ালিজম বলতে বাস্তববাদের ঊর্ধ্বে কিছু বোঝায়। এর বাংলা প্রতিশব্দ করা হয়েছে– ‘পরাবাস্তববাদ’। সংস্কৃত ‘পরা’ শব্দের অর্থও হলো ‘উচ্চতর’ বা ‘শ্রেয়তর’।
তার মানে, পরাবাস্তববাদ বাস্তব সত্যের ঊর্ধ্বের বা বাইরের কোনো সত্যের কথা বলে। এ মতবাদ বিকশিত হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)-এর সময়ে উদ্ভুত দাদাবাদ (Dadaism) থেকে।
এ আন্দোলনের সূচনা ১৯২০-এর দিকে প্যারিসে, যার মূল প্রবক্তা ছিলেন ফরাসি কবি-সমালোচক আঁদ্রে ব্রেতঁ (André Breton)। দাদাবাদীরা চেয়েছিলেন প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ বাতিল করে এমন একটি নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী হওয়া, যার সাহায্যে ছিন্ন করা যাবে প্রচলিত নিরর্থক রীতিনীতি আর ভণ্ডামির বেড়াজাল, পৌঁছে যাবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে। পরাবাস্তববাদীরা আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বললেন, প্রকৃত সত্যের অবস্থান শুধুমাত্র অবচেতনেই।
পরাবাস্তববাদী চিন্তাধারা ক্রমশ ঢুকে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও ভাষার কাব্য-সাহিত্য, নাটক বা দৃশ্যকাব্য, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতে। এমনকি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রচিন্তা ও চর্চা, দর্শন এবং সমাজতত্ত্বেও পরাবাস্তববাদ জায়গা করে নেয়।
এমনকি বাংলা সাহিত্যে যার প্রভাব লক্ষ্যনীয়- ওই সময়ে পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো বাংলা কবিতার সেরা পরাবাস্তববাদী জীবনানন্দ দাশ; বিনয় মজুমদার , আলোকরঞ্জন প্রমুখ আরো অনেকেই, যাদের কবিতায় তখন প্রবল পরাবাস্তববাদী প্রভাব পরিদৃশ্যমান।
এই বিষয়টা আলাদাভাবে কোনদিনই দেখিনি। এতোগুলো বছর সম্পাদনা করছি বর্তমান বিভিন্ন কবিতায় পরাবাস্তববাদ কিংবা বাস্তববাদ সবকিছু একসাথে মিলেমিশে যাচ্ছে । সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে কবিতা ভাবনার গঠনগত বৈচিত্র্য যথেষ্ট পৃথক আকার ধারন করছে। তবু কিছু কিছু লেখায় এখনো এই পরাবাস্তববাদ পাই। বিশেষত বামপন্থী চিন্তাধারা কলমে এই মতবাদের প্রচার সবচেয়ে বেশী লক্ষ্যণীয়।
আঁদ্রে ব্রেতঁ বাদে পরাবাস্তববাদী কাব্য-সাহিত্যের মূল প্রবক্তা ও পথিকৃৎ হিসেবে আমরা আরো যাঁদের গণ্য করি, তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য কয়েকজন হলেন পল এলুয়ার, লুই আরাগঁ, অঁরি মিশো ইত্যাদি।
এই পথ ধরে আমিও চেষ্টা করবো বেশ কিছু পরাবাস্তববাদের কবিতা রচনা করতে পরবর্তীতে। আসলে সৃষ্টির বিভিন্ন ধারায় বিচরণ করার নেশাটা আজও পরিত্যাগ করতে পারিনা। আমার ভালোলাগে মানুষের সাইকোলজির এই বিভিন্নতাকে বিশ্লেষণ করতে জানতে শিখতে। আজ আপনাদের সাথে সংক্ষিপ্তভাবে তা শেয়ার করলাম।
বিশ্বায়ন
ত প ন ম ন্ড ল
১৮৭০ থেকে ২০২৩, এই একশো চুয়ান্ন বছরে, বিশ্বব্যবস্থা বদলে গেছে বারবার। উপনিবেশবাদী বিশ্ব থেকে দুই মেরু বিশ্ব, তার থেকে পরমাণু বিশ্ব আবার অর্থনীতির ঐক্যায়নের বিশ্ব--- কত ব্যবস্থার আসা-যাওয়ায় বিশ্ব ব্যবস্থার ইতিহাস আকর্ষক হয়ে উঠেছে । ১৮৭০ এর দশকের 'জাতি' নিয়ে ভাবনা, তার থেকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার চিন্তা, সেসব এখন আর মুখ্য নয়। এখন প্রধান হলো অর্থনৈতিক বিশ্ব, আন্তর্জাতিকতায়নের চেয়েও বড় হল বিশ্বায়ন বা Globalization বা Economic Integration of the World.
বিশ্বায়ন বা গ্লোব্লাইজেশন হলো এমন একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া যার মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রের সাবেকি ধারনার অবসান ঘটিয়ে একটি' সীমারেখা হীন' বিশ্ব গড়ে তোলা, যেখানে অর্থনৈতিক- সামাজিক- রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বময় অবাধ আদান-প্রদান চালানো সম্ভব। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কৃতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক সবদিক থেকে অবাধ অন্তঃসংযোগেই হলো বিশ্বায়ন।
বিশ্বায়ন কোন নতুন ধারণা নয়। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া বহু পূর্বে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বজায় ছিল। তবে এই শব্দটির বহুল প্রচলন ঘটে গত শতাব্দীর ১৯৮০ থেকে ৯০ এর দশকে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি যুগে বিশ্বায়ন শব্দের নতুন প্রয়োগ শুরু হয়। বিশ্বায়নের অন্য নাম Neo- liberal Globalization। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার(IMF), বিশ্ব ব্যাংক (World Bank), বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা(WTO) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নকে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে।
গত শতাব্দীর ৮০ দশকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রেগন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থ্যাচার যে মুক্ত বাজার অর্থনীতির গোড়াপত্তন করেন তা ক্রমশ আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার এবং বিশ্ব ব্যাংকের গৃহীত নীতিতে পরিণত হয়। ১৯৯৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যাংক গঠিত হলে অবাধ মুক্ত বাণিজ্যের মূলনীতিকে গ্রহণ করে বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা হয়। চীন সহ বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৬০ টি দেশ এর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
প্রখ্যাত নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ মন্তব্য করেছেন,-- বিশ্বায়ন হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনগণের মধ্যে এক নিবিড় সংযোগ সাধন প্রক্রিয়া। যা পরিবহন ও যোগাযোগের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস করে এবং খাদ্য সামগ্রী, পরিষেবা, পুঁজি, জ্ঞান, এমনকি পৃথিবীজুড়ে মানুষের অবাধ যাতায়াতের অধিকারের উপর আরোহিত কৃত্রিম বাধাগুলিকে দূর করেছে।
বর্তমান বিশ্বে মানুষের জীবনের চলার পথের এমন কোন বিষয় নেই যা বিশ্বায়নের দ্বারা প্রভাবিত হয় না। বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠান গত দিক থেকে বহুজাতিক সংস্থা (MNC), আন্তর্জাতিক কোম্পানি সমূহ (Global companies), আন্তর্জাতিক পৌর সমাজ(Global civil society) এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অবাধ মুক্ত বাণিজ্য ও পুঁজি রপ্তানি, ভোগ্য পণ্যের বিশ্ববাজার, মনস্তাত্ত্বিক ও সংস্কৃতিক দিক থেকে এক বিশ্বের ধ্যান-ধারণা প্রভৃতির প্রসার ঘটেছে।
বিশ্বায়নের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক যেমন, তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি, সংস্কৃতি সমতা, ভূখণ্ডকেন্দ্রিক জাতীয় রাষ্ট্র গুলির সীমানা বা ভূখণ্ডের বিলয়, বেসরকারিকরণ ও উদারীকরণ, মুক্ত বাজার অর্থনীতি, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ, আমদানি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত অবাধ বাণিজ্য, বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে অভিগমন ও নির্গমন, এক দেশ থেকে অন্য দেশে পুঁজির অবাধ আদান-প্রদান, উৎপাদনের একত্রীকরণ ও কেন্দ্রীভবন।
বিশ্বায়িত ভোগ্যপণ্য সংস্কৃতি এবং কেন্দ্রীয় উৎপাদন ব্যবস্থা অন্যতম শর্ত অবশ্যই তথ্যপ্রযুক্তি। বিশ্বায়ন গতি পেয়েছে Information Technology এর হাত ধরে New International Information Order -এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এই তথ্যপ্রযুক্তির মূল্যায়নের তিন দিক থেকে করা যেতে পারে। (এক)তথ্য সঞ্চায়ন, তথ্য সঞ্চালন ও তথ্য বাজারের সংরক্ষণ ও প্রসারণ। (দুই) তথ্য মাধ্যমিক পণ্যায়ন এবং (তিন) উদ্বৃত্ত মূল্যজনক প্রযুক্তি।
১৯৮০ দশক থেকে উন্নতি বিশ্বের অর্থনৈতিক এজেন্ট গুলো স্যাটেলাইট কম্পিউটার ভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা চালু করেছে। তার ফলে গোটা বিশ্বের সম্পদ, চাহিদা, জনসংখ্যা, দারিদ্র্য বা স্বাচ্ছল্য, সমাজের ক্রয় ক্ষমতা, আঞ্চলিক সৃজনশীলতা, এইসব তথ্যই দ্রুত বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যায়। প্রয়োজন মত পুঁজির বিশ্বায়নে ব্যস্ত 'ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট'এর বা টেকনোক্রাফদের কাজে লেগে যায়। সাধারণ অবস্থায় এই তথ্য বাজারের সবচেয়ে দরকারি যোগাযোগ প্রযুক্তি হল ইন্টারনেট। এদের দৌলতেই পৃথিবীর ভোক্তারা আজ আর কোন বিশেষ রাষ্ট্রের Citizen নন, তারা সকলেই হয়ে পড়েন নেটিজেন।
তথ্যপ্রযুক্তিই এখন গোটা পৃথিবীর অন্য বাজারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এর মাধ্যমেই তৈরি হয় ক্রেতা। গড়ে ওঠে তার চাহিদা আর তার যোগাযোগ হয় বিক্রেতার সঙ্গে। ১৯৯০ এর দশকে স্যাটেলাইট সম্প্রচারে ছাড়পত্র দিয়ে ভারতে এই ব্যবস্থার সূচনা করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ডক্টর মনমোহন সিং। মানুষের খাওয়া -পরা-প্রসাধন বা শরীর চর্চা সবই ঠিক করে দেয় এই স্যাটেলাইট পণ্যায়ন।
তথ্য সংগ্রহ আর তার উৎপাদনমুখী ব্যবহার এর নানা কৌশল উদ্ভাবন করে উদ্বৃত্ত মূল্যও সৃষ্টি করতে পারে তথ্যপ্রযুক্তি। বিভিন্ন রকমের সফটওয়্যারই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সারা বিশ্বে যে নেট ভিত্তিক বাণিজ্য চলে ই- কমার্স, ই- ব্যাংকিং, ই -শপিং এর হাত ধরে তার মূলেও এই সফটওয়্যার।
বিশ্বায়নের অর্থনীতি, প্রযুক্তির হাত বদল এবং তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার এর কারণে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে মুশকিলে ফেলে দিয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি ও পুঁজির দ্রুত চলাচল নিচু মজুরির দেশের শ্রমকে উন্নত অর্থনীতির দেশে আমদানি সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে উন্নত দেশেই নিচুমজুরির সমান্তরাল উৎপাদন কাঠামো তৈরি হয়ে গেছে। মুক্ত বাণিজ্যের আপেক্ষিক সুবিধার তত্ত্ব এই ভাবেই উন্নত দেশের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে। এ এক নতুন ধরনের পুঁজির উপনিবেশায়ন।
কিন্তু শুধু বাণিজ্যেই এর শেষ নয়। নিয়ন্ত্রিত জগতের সংস্কৃতির উপরেও বিশ্বায়নের প্রভাব গভীর। একধরণীকরণ (uniformity), আত্তীকরণ (appropriation), বিনির্মাণ( deconstruction) এই তিনটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে প্রভাবটিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
একদিকে বাজার -দেশের লোকসংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে এক রকমের সমাজ মানসিকতা তৈরি হয়, যাতে দুনিয়া জুড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে একই ধরনের পণ্যের চাহিদা। তাতে সুবিধা হয় পণ্য উৎপাদক দেশের বা বহুজাতিক কোম্পানির। অন্যদিকে গণতন্ত্রমুখী সাংস্কৃতিক স্রোতটা বয়ে চলে পশ্চিম থেকে পূর্বে, পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে, উন্নত জগত থেকে অনুন্নত বিকাশমান জগতে। গ্রহণের প্রান্তে পড়ে থাকে যে সমাজ সে সমাজ সহজেই এটা মেনে নেয়। কেননা পণ্যভিত্তিক আধুনিকতার মোহ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আধুনিকতার পণ্যরূপটির শিকড় অবশ্যই পশ্চিমে সংস্কৃতিতে। এটা হল একধরনীরকরন।
তবে কিছু কিছু সামাজিক প্রবণতা থেকেই যায়, যেগুলিকে এই একধরনীরকরন প্রক্রিয়ার ভিতরে আনা যায় না। বিশ্বায়নের উৎপাদন ব্যবস্থা সেই প্রবণতাকেও নিজের সঙ্গে জুড়ে নেয়। এই ভাবেই বহুজাতিক উৎপাদক সংস্থাগুলো ভারতের আয়ুর্বেদকে ব্যবহার করে। কিংবা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যোগা শাস্ত্রকে আধুনিক পণ্যের মোড়কে বিক্রি করে। এমনকি যে হিন্দুত্বের স্লোগান ভারতে একসময় দাঙ্গার কারণ হয়ে উঠেছিল, সেই হিন্দুত্বকেই পণ্য করে পুঁজি বাড়িয়ে নেয় বিশ্বায়িত চলচ্চিত্র শিল্প। একেই বলে বিশ্বায়নের ব্যাকরণে আত্তীকরণ।
বিশ্বায়নের তৃতীয় প্রভাবটি সবচেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক। সামাজিক মূল্যবোধের স্থায়িত্ব বিশ্বায়ন সহ্য করে না। কেননা সেই মূল্যবোধ একরূপী পণ্যকাঠামোর সঙ্গে খাপ খায় না। হিংসা, সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, অপহরণ, প্রেমহীন যৌনতা সবেই বিশ্বায়নের পণ্য। তাই সে এমন মূল্যবোধের পক্ষে সওয়াল করে, যে মূল্যবোধে এগুলো মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে বিশ্বায়নের ফলে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বেড়েছে। এ কথা ঠিক যে ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে ভারতের গ্রামে দারিদ্র্য হার নেমেছে ৩৭ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে এবং শহরে ৩২ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশে। কিন্তু দুটো ক্ষেত্রেই ধনী বা মধ্যবিত্তের স্বাচ্ছল্য বেড়েছে প্রায় দ্বিগুনেরও বেশি হারে। স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গেছে, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যকার বৈষম্য। সেইসঙ্গে বর্তমান গ্রাম ও শহরের মধ্যে ফারাক।
বিশ্বায়ন পুরোপুরি পণ্য নির্ভর ও শিল্পমুখী হওয়ায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমে গেছে, বেড়েছে রপ্তানিযোগ্য কৃষি পণ্যের উৎপাদন, ফলে বিপদে পড়েছে প্রান্তিক কৃষি সমাজ। এই বিপদ আরও বেড়ে গেছে কৃষিতে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার ব্যাপারে চাপ আসতে থাকায়। অর্থনৈতিক সংস্কার চালু হওয়ার পর ভারতে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠার চেয়ে মধ্যস্বত্বভোগী শিল্প পণ্য সংস্থা গঠনের প্রবণতা বেড়েছে। ফলে আসল শিল্পে বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমতে শুরু করেছে।
একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়ন অপরিহার্য আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। বাজার অর্থনীতি, উদারীকরণ ও বাণিজ্যিক বিশ্বায়ন থেকে কোন দেশ বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে না। অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলির দুর্বলতার কারণেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে এক বৈষম্য মূলক নীতি গৃহীত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত দেশগুলির মোকবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় বিশ্বায়নকে কাজে লাগানো দরকার। যদিও ২০০৩ সালে মেক্সিকোর কানকুনে উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রতিনিধিরা এই মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিল। আশা করা যায় উন্নয়নশীল বিশ্বে আগামী ভবিষ্যতে কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্যকে মুছে ফেলে উন্নত দুনিয়ার বিশ্বায়নকে উন্নয়নশীল দুনিয়ার আঞ্চলিক বিশ্বায়ন-এ রূপান্তরিত করে এক নতুন বিশ্বায়ন সূচিত করতে পারবে।
মানুষের কল্যাণে মরণোত্তর দেহ দান
সি রা জু ল ই স লা ম
জন্মের পর থেকে বুদ্ধি হওয়ার পর মনে রাখার মতো কোনো ভালো কাজ করেছি বলে মনে পড়ে না। তবে আজকে যে কাজটি আমি করতে পারলাম সেটার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। পঞ্চাশোর্ধের মানুষটি আজও পর্যন্ত মানুষের কল্যাণে কতটুকু আসতে পেরেছি তা আমি জানিনা তবে মনে প্রাণে মানুষের কল্যাণ করার জন্য সবসময় মনটা কাঁদে। হয়তো সঠিক সময়ে নিজেকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি দেখে দেশের প্রচলিত ধারায় উচ্চমানের চাকরি, অর্থ, প্রতিপত্তি অর্জন করতে পারিনি। কিন্তু কখনই মন্দের পক্ষে ছিলাম না।
তবে জীবনে বন্ধুর পথে চলতে গিয়ে কিছু মানুষের সহযোগিতা যেমন পেয়েছি তেমন আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধবের কাছে তিরস্কারও কম পাইনি। তারা যদি ঢিল মেরে, আমার সমালোচনা করে তাদের আত্মতৃপ্তি হয় তাতেও আমি ধন্য। কেন না কবি তাই তো বলেছে- "নিন্দুকেরে বাসি আমি ভালো" আমিও ঠিক কবির সুরে সুর মিলিয়ে বলছি আমিও নিন্দুকের নিন্দা ভীষণ ভাবে ভালো মনে করি।
যখন আমার আম্মাজি মারা যায় আমি দেখেছি মানুষের ধর্মের নামে নিজেকে জাহেরি করার কতগুলো পন্থা। আমি বিশ্বাস করি প্রতিটা ধর্মই সত্যের কথা বলে। ন্যায়ের কথা বলে। কেননা আমরা মানুষ এই পৃথিবীতে স্বল্প সময়ের জন্য আসি বলেই সবকিছু ভোগ করার একটা প্রাণবন্ত চেষ্টা থাকে। এতে করে পথ ভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। বিধায় ধর্মের শাসন অনুশাসন দিয়ে মানুষগুলোকে একটি নিয়মতান্ত্রিক জীবন পরিচালনা করার জন্যই ধর্মের প্রয়োজন। আর ধর্মটা যদি কর্মের সঙ্গে সশ্লিষ্ট হয় তাহলে তো অনেকটা পথই পরিছন্ন থাকে। আমরা কতটা মানুষ পেরেছি এ পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতে।
মানুষ হিসেবে নিজেকে দেখি। আমি সব ধর্মকে যেমন শ্রদ্ধা করি সব ধর্মই আমার কাছে নিজের ধর্ম। ধর্মকে কর্মের সঙ্গে তুলনা করেছি। যেহেতু আমি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি তাই ইসলাম ধর্মেই আমার ধর্ম। পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, " লা কুম দ্বীনুকুম ওয়ালা ইয়া দ্বীন। অর্থঃ- যাঁর যাঁর ধর্ম তাঁর তাঁর।
অসহায় মানুষের চিৎকার, কান্না আমাকে এত বেশি ব্যথিত করে, তখন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যেসব ক্ষেত্রে মানুষ একেবারে অসহায় তাদের যদি একটু সহায় হতে পারি দোষ কি? আমিও পরিবারের সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এই পৃথিবীটা চার হাজার কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয়েছে। আমরা যেখানে বাস করছি সেখানে প্রচুর মানুষের আর্তনাদ আছে। তাহলে আমি মারা যাওয়ার পর আমার দেহটা দান করে যদি মানুষের কল্যাণে আসে সেটাই তো বড় ইবাদত।
পৃথিবীতে কেউ কি কখনো স্থায়ী করে কোন জায়গা করতে পারবে, না পেরেছে। মৃত মানুষের আত্মা যখন বের হয় তখন ওটা একটি আবর্জনা মাত্র। সেটা যেন পরিবেশ দূষণ না করে তাই বিভিন্ন ধর্ম বিভিন্ন ভাবে আচরণ অনুষ্ঠান করে থাকে। আমি খুব আনন্দ সহকারে তাদের সেই অনুভূতিগুলি মন দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম। বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম অসংখ্য অসহায় মানুষের ব্যথা বেদনার আর্তনাদের ভাষা।
আসুন আমরা মানুষের কল্যাণে মানুষের জীবন রক্ষার্থে নিজেকে জীবিত থেকে যেমন সহযোগিতা করতে পারি, তেমনি মানবিকতাকে উজ্জীবিত করতে পারি।
"প্রভাত সময়ে শচীর আঙিনা মাঝে গৌরচাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে!" -নাম সংকীর্তন করতে করতে ভোরের আলোয় যখন সাধুসঙ্গ পরিবেষ্টিত গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে শিউলি ফোটা ভোরের বাতাসে। ঠিক তখন আমি আপনি হয়তো আবেশে জড়সড়ভাবে পড়ে আছি বিছানায় নরম বালিশে মাথা রেখে। সত্যি কি তাই? সকলেই কি এমন আবেশীত স্বপ্নালোকে ঘুমঘোরে পড়ে থাকেন! হয়তো, কিম্বা হয়তো না। কারো কারো পাশের টেবিলে রাখা ওষুধের স্ট্রিপগুলো ছুঁয়ে যায় বিমূর্ত আর্তনাদে। দিকচক্রবাল ফেটে পড়ে যন্ত্রণাকাতর গুমরে কাঁদা অসহায় মানুষের আহাজারি রোদনাজারিতে। চেতনার বিস্তারে মাতাল সমুদ্র থেকে উঠে আসা ঢেউ মুষড়ে পড়ে ছন্দহীন জীবনে। শতাব্দীর কষ্ট উঠে আসে শরীরে। একটু আদর যত্ন সহানুভূতির জন্য বড্ড বেশি ছেলেমানুষীটা উথলে ওঠে।
এ কাহিনী আমাদের জন্য যাপিত জীবনের সকরুণ বাস্তবতা। রাস্তাঘাটে প্রায়শঃ উচ্চারিত হচ্ছে নীরববাণী। হাসপাতাল থেকে মর্গ অব্দি চিলচিৎকার। সুস্থ সুন্দর জীবনে অসুস্থতার কালোমেঘ নেমে এলেই স্বাভাবিক জীবনে ঘটে যায় বিপত্তি। বেঁচে থেকেও কেউ কেউ যেন মরে আছে স্থবিরতা জীর্ণতা নিয়ে।
হ্যাঁ! আমি সেইসব মানুষের ব্যথা নিরাময়ের কাজে আসবে বলে আপনার মতন সুধীজনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলছি মরণোত্তর দেহ দান এর কথা।
আমরা সকলেই জানি আমাদের ঘরের অব্যবহৃত মালামাল আমরা ডাষ্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিই প্রতিনিয়ত, ভাবি সেসব অপ্রয়োজনী ধ্বংসস্তুপ ডাঁই করে রেখে কি হবে?
প্রযুক্তিগত আধুনিক বিশ্বের অন্যতম দেশগুলোতে এখন সেসব বর্জ্য থেকে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন কিছু। জাপানিরা তাদের ভেঙে যাওয়া কাপ-পিরিচ পেয়ালাগুলি আঠা লাগিয়ে জোড়া দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে শো-পিস হিসাবে। আর সেসব আঠা বা গ্লু তৈরি করতে ব্যবহার করে সোনা গলানো ধাতুতে।
আর আমরা? একজন মৃত্যু পথযাত্রিকে চোখের সামনে ধুঁকেধুঁকে মরতে দেখেও নিস্পৃহতা দেখাই। ভাবি মনেমনে ওসবে আমার কি দায়! যার অবস্থানে সে থাকুক পড়ে। তাই না!
দায় এড়িয়ে যাওয়া যায় না গো বন্ধু। আমরা সৃষ্টির সেরা জীব। জ্ঞান বুদ্ধি বিবেকবান মানুষ। যুগে যুগে জয়ের গান গেয়ে বলে গেছেন ঋষি মনীষীগণ, "মানুষ মানুষের জন্য।"
আমরা কি আমাদের পচনশীল দেহখানা নিথর হয়ে যাওয়ার আগে কোন সৎ কাজে উজাড় করে দিয়ে যেতে পারি না?
প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় পৃথিবী এগিয়েছে বহুদূর। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা আমাদের মরণোত্তর দেহ দান করে যেতে পারি কি না! মৃত্যুর পরে দেহটা শুধু ময়লা আবর্জনা স্তূপ হয়ে যাবে বলে ধর্মীয় প্রচলিত নিয়মানুসারে সৎকার করা হবে। কিন্তু আমরা যদি একটু মানবিক হই, দান করে যেতে পারি আমাদের দেহটাকে। আমার মৃত্যুর পর সেই দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে উপকৃত হতে পারে কিছু অসহায় মানুষ। আসুন আমরা আমাদের মরনোত্তর দেহ দান বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ী হই। সমাজে বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করি সর্বসাধারণকে। আলোচনায় বের হবে উৎকৃষ্ট ফলাফল। সে প্রত্যাশা রেখে গেলাম বন্ধু।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আশরাফুল মাখলুকাতের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ হিসেবে তাকে দেয়া হয়েছে বিবেক বুদ্ধি। জ্ঞান গরিমা। সেই জ্ঞানতাপস মনীষীগণ মানব সেবার লক্ষ্যে আবহমানকাল থেকে চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্নরকম গবেষণা। সে সবই মানব সম্প্রদায়ের কল্যানের জন্য। তারই ধারাবাহিকতায় চূড়ান্তপর্বে আমরা আমাদের আশেপাশের মানুষের কল্যানে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় পৌছে গেছি আজ অনেক দূর। মানবতার কল্যাণে কাজ করার অদম্য আগ্রহের কারণে প্রতিনিয়ত সমাধান হচ্ছে অনেক জটিল কঠিন রোগ নিরাময়ের।
কথা বলছিলাম, মরণোত্তর দেহ দান প্রসঙ্গে। এসব নিয়ে নানা মুনির নানা মত। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মগুরুদের এক দলের অভিযোগ, ধর্মীয় ভাবে কড়া নির্দেশণা দেওয়া আছে কোন মৃতের দেহ দান করা অনৈসলামিক। কারণ দেহটা মরে পচে যাওয়ার পরে সেটা সৎকার করা হয়। এবং সেই দেহাবশেষ "আমলে বারজাখ" নামক একস্থানে রেখে দেন স্বর্গীয় দেবদূত ( ফিরিস্তাগণ) শেষ বিচারের দিন হাশরের মাঠে তাদেরকে ওঠাবেন বিচারের জন্য। তাই দেহ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করা শরিয়তের পরিপন্থী।
আর এক দল বলছেন, মানবিক মর্যাদায় মানবতার কল্যানে সেসব গবেষণা করা যায়।
ধর্ম নিয়ে আলোচনা করলে তর্কাতর্কি চলতে থাকবে এবং বহুদূর গড়াবে সে প্রসঙ্গ। থাক তা।
আধুনিক বিশ্বের জ্ঞানতাপসের অভিমত, ধর্ম সব সময় মানবতাকে পিছনে টেনে ধরে। আর বিজ্ঞান মানব সমাজকে আলোকিত করতে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আজ আমরা আমাদের ধর্মীয়বিশ্বাসের আলোকে এখনও অনেক কুসংস্কার আঁকড়ে ধরে নিয়ে বসে আছি। ফলে অনেক বাধা বিপত্তির বেড়াজালে আটকে গেছি। কিন্তু বিশ্বের বিজ্ঞানের কল্যাণে সাম্প্রতিককালে আমরা অনায়াসে পৌঁছে গেছি চাঁদের বুকে। যা ছিলো আমাদের পূর্ব পুরুষের মনে চরকাকাটা এক অশীতিপর বৃদ্ধার কল্পনার জগৎ।
তাই বিজ্ঞানের জয় হোক এ কথা বলা যেতেই পারে। মরণোত্তর দেহ দান, চক্ষু দান এসব নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ সরিয়ে এগিয়ে আসতে হবে মানবতার কল্যাণে। আমাদের জটিল কঠিন রোগ নিরাময়ের কাজে আসবে বলেই শুধুমাত্র উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞান কাজ করে চলেছেন অবিরত। আমাদের মানবিকতার চর্চায় আমরা আমাদের কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে যাবো অনেকটা পথ।
আলোচনা হোক সমাজের গণ্যমান্য মানুষের সাথে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো গবেষণা শুরু হোক। সর্বসাধারণের জন্য উন্নতির আলোকপাত করা হোক সর্বস্তরে। প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করে গড়ে তুলতে হবে নতুন সমাজব্যবস্থা। দূর করতে হবে কুসংস্কার নামক সামাজিক ব্যাধি।
আসুন আমরা আমাদের আশেপাশের মানুষের সাথে কথা বলে তৈরি করে নিই নিজেদের কল্যানের পথ। সকলের সুস্বাস্থ্য মঙ্গলময় জীবন কামনা করি।
মন্দ নারীর মন্দ কথা
কা ক লী পা ল
আমরা শিক্ষা, সংস্কৃতিতে অনেক এগিয়ে আছি। এখন আর আগের সামাজিক ধ্যানধারনার পরোয়া করি না আমরা। আমরা গর্ব করে বলি আগের থেকে অনেক ভালো আছি। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে যখন দেখি একটি ডিভোর্সি মেয়েকে নিয়ে আজও আমরা চর্চা করতে পছন্দ করি। ডিভোর্স এমন একটা শব্দ যা আমাদের শিক্ষা, মনোভাব, ধ্যানধারনার ভিতটা নাড়িয়ে দেয়। ডিভোর্স একজন মানুষের মধ্যে হয় না। নারী-পুরুষের মধ্যে হয়। এর জন্য উভয়েই দায়ী। কিন্তু আজও যখন দেখি ডিভোর্সের জন্য শুধু মাত্র মেয়েকেই দায়ী করা হয়। এর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ অবশ্যই কেউ দিতে পারে নি। কিন্তু আঙুলটা উঠছে মেয়েদের দিকেই। কিন্তু কেন? যেখানে দুটো মন এক সাথে থাকতে পারবে না সেখানে সম্পর্ককে বেঁধে রাখতে গেলে কেউই বাঁচতে পারবে না। সমাজ, পরিবারের কথা ভেবে নিজের বাঁচার রাস্তা নরক করার জন্য তো মানুষের জন্ম হয় না। প্রত্যেকের সুস্থ ও সুন্দর ভাবে বাঁচার অধিকার আছে। যখন আর সম্পর্কে প্রাণ থাকে না সেই সম্পর্ক মূল্যহীন অথর্ব। কিন্তু প্রশ্ন হল এর দায় শুধু মাত্র নারীর কেন হবে? আমরা এটা ভাবি না যে কতটা কঠিন জীবন হলে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় মানুষ! একজন ডিভোর্সি পুরুষের দিকে কেউ তার চরিত্র, তার সমালোচনা করে না কখনো। নারী ডিভোর্সের পর কতটা মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয় কেউ ভাবে না। পুরো সমাজটাই সেই নারীর প্রতি ঘৃণিত দৃষ্টি হানে। হয়ত ভেবেছিল যে এই যন্ত্রনা, অবজ্ঞার, শারীরিক, মানসিক শান্তি পাবে।কিন্তু এর পর অধিক পরিমাণে মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়।বাড়িতে যদি পরিবারের সাপোর্ট থাকে তো কিছুটা বাঁচার অক্সিজেন পায়। পরিবারের বাইরে পরিজনদের থেকে তাঁকে কিভাবে বাঁচতে হয় তা সেই মেয়েটিই জানে।
কি এমন হলো? একটু তো মানিয়ে নিয়ে থাকতে পারতি? এত বড়ো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের জানালিও না? কোন অনুষ্ঠানে গেলে সেই যেন দ্রষ্টব্য বস্তু। কত প্রশ্ন! পরচর্চার একটা নতুন টপিক। আবার যদি সন্তান সহ ডিভোর্স হয় তো সেই বাচ্চাটিকে নিয়েও সকলের কত আদেখলামো। কিরে তোর বাবার কাছে যাস না? তোকে দেখতে আসে না? তোর পড়ার খরচ কে দেয় রে? তোর বাবা মায়ের মধ্যে কি হয়েছিল রে? এরা কতটা নীচ নিষ্ঠুর হলে এমন কথা সেই ছোট শিশুটিকে বলতে পারে!
নারীবাদী নই আমি মানবতাবাদী।মানুষ মানুষের জন্য। একটু ভালভাবে বাঁচার অধিকার কি সেই ডিভোর্সি মেয়েটির থাকতে পারে না? সে তো আমাদের কাছে সাহায্য চায়নি। তাকে তার মতো করে বাঁচার জন্য আমরা একটু সহানুভূতির দৃষ্টিতে না হোক তাকে কটু কথা বলার আগে ভাবতে হবে যে সে কোন্ মানসিক পরিস্থিতির শিকার। একটা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর যে সে বেঁচে আছে এটাই তো অনেক। এই সব অমানবিক পরিস্থিতির চাপে পড়ে কত নারী নিজের জীবন শেষ করে দেয়। একটা বন্য পশুর সাথেও এমন অমানবিকতা কেউ করে না। যতটা যন্ত্রনা সেই ডিভোর্সি মেয়েটিকে সইতে হয়।
আমাদের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমানাধিকার দিয়েছে। ধর্মেও তাই। যখন একটা সুন্দর সম্পর্কের অপমৃত্যু ঘটে আর কিছুই করার থাকে না। আইন স্বীকৃতি দিয়েছে দুটি মানুষকে আলাদা ভাবে বাঁচতে। সেখানে অনধিকার অপমান, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে নারীকে অপমান করবে কেন?
আমরা যতই বলি না কেন সবাই সমান, নারী পুরুষ কোন ভেদ নেই--- কিন্তু সমাজ একটা অদৃশ্য দেওয়াল তুলে দিয়েছে এদের মাঝে। একটা গন্ডী এঁকেছে যার বাইরে কোন পদক্ষেপ নিতেই তোমার দিকে হাজারো আঙুল উঠতে বাধ্য। এটাই আমরা।মানবতার ভেক ধরে অমানবিক কাজ করতেই সিদ্ধহস্ত।
একটু ভাবুন! সময় পেলে! এমনটা করে আমরা কী প্রমাণ করতে চাইছি? যা চাই তাই হয় কি? সবাই নিজের মতো করে জীবন যাপন করে। তাহলে দোষটা কোথায়? মানবিক হতে হবে সকলকেই। তবেই না মানুষ হবো। পরিস্থিতি সবার সমান হয় না। সবাই সবটা পায় না। সবার দ্বারা সবকিছু পাওয়া যায় না।ডিভোর্সি ও একজন মানুষ। অন্য গ্রহের বাসিন্দা নয়। মানবিকতায় ভরে উঠুক পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ জীবনপথ। অনেক আশা ভরসায় বাঁচুক সেই অবহেলিত অপমানিত নারীরাও যারা শুধু একটু ভালভাবে বাঁচতে চায়।
তার পরিচয় হোক সে মানুষ।ডিভোর্স তার অলংকার নয়। অনেক ডিভোর্সি মেয়ে মনের কষ্টগুলোকে বলতে পারে না। সহ্য করতে পারছি না বলতে পারে না। কি যে সে নিদারুণ যন্ত্রনা তাকে কুরে কুরে শেষ করে। মানবতার জয় হোক। আমরা তো পারি তাকে একটু হলেও ভালো মানসিকতার পরিচয় দিতে যাতে সে নিজেকে গুটিয়ে না রেখে অন্যদের মতো স্বাভাবিক জীবন অতিবাহিত করতে পারে।।
প্রত্যেক মেয়ের উচিত নিজের ও পরিবারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার, সেই সাথে নিজের একটা সম্মানজনক পরিচিতি তৈরী করা।কারণ--- জন্ম থেকে বিয়ের আগে পর্যন্ত পিতার পরিচয়ে। বিয়ের পরে স্বামীর পরিচয়ে। সন্তান সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার পরে পুত্রের পরিচয়েই একটা নারীকে তার পুরো জীবনচক্র অতিবাহিত করতে হয়। তবে আশ্চর্যের হলেও এটা ১০০% বাস্তব যে কোনো মেয়ে যদি ডিভোর্সি হয় তাহলে সে যে সামাজিক পরিস্থিতিতেই থাকুক না কেনো তাকে একটা অতিরিক্ত পরিচিতি দেয় আমাদের অতি উন্নত এই সমাজ--- কি দারুন ব্যাপার! তাই না? সেই ডিভোর্সি মেয়েটা যেন এক গর্হিত অন্যায় করে ফেলেছে আপনাদের নিয়মনিষ্ঠ সমাজে বাস করে। যে সমাজের ধারক ও বাহকেরা এটা কোন ভাবেই চান না মেয়েটা বাঁচুক। কারণ সে যে সামাজিক নিয়ম-নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অত্যাচার, অবহেলা, অন্যায়, অপবাদকে সহ্য না করে নিয়ম ভেঙে একা বাঁচতে চেয়েছে। অতএব এটা তো কোন ভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। তাই কি করে তাকে বিভিন্ন ভাবে হেনস্তা করা যাবে সে উপায় করতে হবে!
বিভিন্ন সামাজিক বিধি নিষেধের বেড়াজাল যেমন- কোনো শুভ কাজে, উৎসবে তাকে ব্রাত্য রাখা। সে কেমন পোষাক পড়বে! কেমন আচরন করবে! কোনো জব বা কর্মে যুক্ত থাকলে সে কখন বেরোচ্ছে, কত রাত করে বাড়ি ফিরছে! এত সাজবে কেনো? এত জ্ঞান তাহলে সংসারটা গুছিয়ে করতে পারলো না? নিশ্চিত কোনো অন্য রকম কিছু ছিল?--- কথাগুলো খুব হাস্যকর মনে হচ্ছে তাই তো! একটু চোখ কান খোলা রাখুন আশেপাশে রোজই এমনটা ঘটে চলেছে।
ডিভোর্সি মানে দুঃখের সমুদ্রের মাঝে চিরকালের জন্য নিমগ্না হতে হবে। মুখে সব সময় একটা দুঃখ দুঃখ ইমোজি ঝুলিয়ে হতাশাকে সঙ্গী করতে হবে।কোনভাবেই নিজের মতামত ব্যক্ত করা যাবে না। সব সময় পরমুখাপেক্ষী হয়ে চরম অপমানে দিন কাটাতে হবে। কোনো আনন্দ উৎসবে আপনি কোনো ভূমিকা নেবার চেষ্টাও করবেন না ভুলেও। অন্যকে কোন বিষয়ে ভুলেও উপদেশ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করবেন না। সোস্যাল মিডিয়া বা অন্য কোন প্ল্যাটফর্ম এ নিজেকে এক্সপোজড্ করবেন না কখনোই .................
সব সময় মনে রাখতে হবে যে আপনি সমাজের বাইরের অংশ, অন্য কোন গ্রহের বাসিন্দা। তাহলে আপনি বা আপনারা হয়ত বা কিছুটা হলেও সমাজের রক্তচক্ষু থেকে ছাড় পেলেও পেতে পারেন। আমি, আপনি বা আপনারা যে সমাজের অন্যান্য মানুষের মতোই, অনুভূতি, অনুভব, রাগ, বিতৃষ্ণা, ঘৃণা, আনন্দ, ক্ষোভ--- নিয়ে গড়া রক্তমাংসের একটা মানুষ!
ডিভোর্সি কারো পরিচয় হতে পারে না। ওটা দাম্পত্যের একটা সাধারন অবস্থান। সমাজ, শিক্ষা, ধারনা, পরিবেশ, মানুষ, সম্মান, বিজ্ঞান, ন্যায়, নীতি, আইন, সংবিধান সময়ের সাথে সাথে বদলায় সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে কিন্তু মনোভাবের কোনো বদল হয় না!!
যখন আমার সাথে তোমার একটা সম্পর্ক ছিলো তখন আমার খারাপ অংশটাও মধুময় মনে হোতো তোমার। তারপর পুরোনো হতে হতে যখন নূতন সেই আমাকে আর খুঁজে পাও নি সে সময় থেকে ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়িয়ে দু'জনের পথটা আলাদা করে নিয়েছো। সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিলো। বিচ্ছেদ হওয়ার পর নতুন কাউকে পেয়ে ভাবলে পুরোনো যত ক্ষত, যা কখনো পাও নি তা পেয়ে গেলে। সে তোমাকে তার জীবনে আবেগের বশে গ্রহণ করলো না কি বাধ্য হল তা জানতে পারল কি তোমার মন? কিন্তু তুমি ভীষণ খুশি হলে এই ভেবে যে তুমি হারোনি জিতে গেছো আমার কাছে। তোমার সব চাওয়া পাওয়া পূরণ করতে চায় সে। সেটা কি ভালোবাসার টানে?না কি ভালো লাগা? তারপর আস্তে আস্তে তোমাকে ইমপ্রেস করার জন্য যা করত তার আধিক্য কমতে থাকবে। আরো কিছুদিন পর থেকে সে তোমার অতীত নিয়ে কথা বলবে। চোখের খিদে আর শারীরিক মোহে আটকে গেলে তো এমনটাই স্বাভাবিক। যখন তোমার অতীত তোমার সামনে সে নিয়ে আসবে প্রতিনিয়ত তখন বুঝতে পারবে; যে খুশির জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেলে সে আনন্দ তুমি প্রতিদিন খুঁজতে থাকবে আর তোমার চারপাশের সব আগের মতো থাকলেও সেই তুমি টা আর আগের মতো থাকতে পারছো না........
জীবন বহমান স্রোতস্বিনী।মহাজাগতিক পরিবেশের মতোই সব সময় শূন্যস্থান পূর্ণ হয় স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু কিছু কিছু হিমশৈলের ভগ্ন অবশেষের আঘাত আমৃত্যু বহন করতে করতে শ্রান্ত অবসন্ন মনের মৃত্যু সময়ের পূর্বেই ঘটে যাওয়া অনাবশ্যক বিপন্নতা।
উপহার
স্নে হা বা রি ক
আজ বর্ষশেষের রাত।ষশুরু হচ্ছে নতুন একটা বছর। সব পুরোনো খারাপ জিনিসগুলো এবার নাহয় ভালো হোক। সব ভালোকিছু নতুন করে শুরু হোক।
সেই বেকার ছেলেটা যার বাবার ওষুধ কেনার টাকা ফুরিয়েছে হন্যে হয়ে একটা চাকরির খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার জন্য একটা ইন্টারভিউয়ের ডাক আসুক। যে মা-টা অপেক্ষা করছে তার ছেলের ফিরে আসার, সেই ছেলেটা যেন সত্বর সীমান্ত থেকে বাড়ি ফিরে মাকে চমকে দেয়।নতুন উপহার দিয়ে খুশি করুক কেউ তার সবসময়ের ক্রাইম পার্টনার ছোটো বোন কিংবা ভাইকে। ভালো হয়ে উঠুক সেই মা-টা যার জন্য ওনার মেয়ে ভগবানের কাছে প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করছে। মেয়ে আর স্ত্রীর এতোদিনের অপেক্ষার প্রহর শেষ- বাড়ি ফিরুক ভিনরাজ্যের শ্রমিক সেই বাবা, সেই স্বামী। সেই প্রত্যেক পরীক্ষায় অসফল হওয়া মেয়েটার নয় রেজাল্ট এবার ভালো হোক। অভাবের তাড়নায় প্রত্যেকদিন ঝগড়া হওয়া সংসারগুলোতে শান্তি ফিরে আসুক না হয়। কাজের চাপে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্বগুলো হঠাৎ ফিরে আসুক ফেসবুকের হাত ধরে। একটু সময় কাটাক ওরা, ফিরে আসুক ওদের সেই ছেলেবেলা যেটা অনেকদিন আগেই শেষ হয়েছে। সেই মেয়েটা যাকে তার এতো বছরের চেনা মানুষটা ঠকিয়েছে, তার হাত ছেড়ে চলে গেছে সেও যেনো বাঁচার আশা ফিরে পাক। সমাজের প্রত্যেক অবহেলিত শ্রেণীর মানুষ খুঁজে পাক তাদের স্বপ্নপূরণের দিশা।
সেই মুখচোরা মেয়েটা যে বন্ধুদের গ্রুপে থাকা ছেলেটাকে নিজের মনের কথা এখনো বলতে পারিনি সে নয় বলেই ফেলুক। ভালো থাকুক সেই অভিমানী ছেলেটা যার চোখে ফুটে ওঠে একটা চশমা পরা মেয়ের মুখ। ভালো থাকুক সেই লোকটা যার স্ত্রী কদিন আগেই মারা গেছে। না, সে পারেনি তার সাথীকে আগলে রাখতে। ভালো থাকুক সেই মেয়েটা যে ছোটো থেকে বড়ো হয়েও কিশোরীবেলার বন্ধুত্ব আর ভালোবাসাটার সমীকরণ বুঝে উঠতে পারেনি, অনেকটা ভালোবাসার পরেও তার ঝুলি ফাঁকা। ভালো থাকুক সব ভালোবাসার মানুষেরা তাদের কল্পনায়, তাদের অনুভবে।
আজকের সকালটা একটু অন্যরকম হোক। যেখানে সূর্য উঠার সাথে সাথেই পাখিরা খুশির খবর পৌঁছে দেবে সবার ঘরে ঘরে। এই নতুন বছর নতুন করে সব ভালো করে দিক। এই নতুন বছরটা হোক সবার জন্য। সেই ব্যর্থ, মন্দবাসা মানুষদের নিয়েও গল্প লিখুক কেউ। নতুন করে শুরু হোক সবকিছু। কয়েকটা গল্প থাক তাদের জন্যেও, সান্টাক্লজ তাদেরকে একমুঠো ভালোথাকা উপহার দিক।
প্রকৃত জীবন
অ ভি জি ৎ দ ত্ত
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। তাই তার জীবনচর্চায় শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন থাকা দরকার। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রে বলা হয়েছে, 'আত্মনং বিধি' অর্থাৎ নিজেকে জানো। আবার স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে অনন্ত সম্ভাবনা। সবই ঠিক। আসল ঠিক হল নিজেকে তৈরী করা বা প্রকৃত মানুষ হওয়া। নিজেকে তৈরী করা বা সঠিক মানুষ হওয়া মুখের কথা নয়। সেই জন্য আমাদের একজন বিখ্যাত মনীষী মন্তব্য করেছেন, মুরগির বাচ্চাকে মুরগি হতে অত কষ্ট করতে হয় না, কিন্ত মানুষের বাচ্চাকে মানুষ করতে গেলে অনেক কষ্ট করতে হয়। যে কোন স্বপ্নকে সফল করতে গেলে যেমন প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়, সেইরূপ প্রকৃত মানুষ হতে গেলে অনেক সংযত ও নিয়মমাফিক জীবনচর্চা করতে হয়।
আজ মানুষে, মানুষে এত ভেদাভেদ, হিংসা, খুনোখুনী, পরশ্রীকাতরতা, ব্যাভিচার মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। আজ মানুষের প্রধান শত্রু মানুষ। আজ মানুষ, মানুষকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কেন মানুষের এত অধঃপতন দশা? এর উত্তর নিহিত রয়েছে মানুষের জীবনচর্চার মধ্যেই। উন্নত জীবনচর্চার মধ্যে যে বেড়ে উঠেছে, তার সঙ্গে একজন অনুন্নত জীবনচর্চার মধ্যে বেড়ে উঠা মানুষের মূল্যবোধ বা জীবনদর্শন কখনোই এক হবে না বা মিলবে না। 'সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস/অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।' 'জন্মিলে মরিতে হবে/ অমর কে কোথা কবে', এই বাক্যগুলি ধ্রুব সত্য। কজনই তা মনে রাখে। মানুষের জীবনে চারটি স্তর আছে- শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্য। তার মধ্যে শৈশব ও কৈশোর খুব মূল্যবান। বাড়ির ভিতের মতো মানুষের জীবনের ভিত হল শৈশব ও কৈশোর। এই সময় সঠিক শিক্ষা ও উন্নত জীবনাদর্শ মানুষকে উন্নত মানুষে পরিণত করে। অনেকেই বলবেন সঠিক জীবনাদর্শন কী? এক কথায় এর উওর দেয়া মুশকিল। মোটামুটি বলা যায় সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে পথ চলা, সকলের ভালো চিন্তা করা। নেতিবাচক চিন্তা বা কুচিন্তাকে প্রশ্রয় না দেয়া এবং পরমশক্তির প্রতি আস্থা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, চারটি যোগের মাধ্যমেই মানুষের মুক্তি সম্ভব। এই চারটি যোগ হল কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, ও ভক্তিযোগ। এছাড়া বিবেকানন্দ একটি সুন্দর কথা বলেছেন, মানুষের মন কোন ডাষ্টবিন নয়, যে ক্রোধ, হিংসা,কুচিন্তা প্রভৃতির ন্যায় বাজে জিনিস দিয়ে ভরিয়ে তুলতে হবে।
আমাদের ভারতবর্ষ এক সুপ্রাচীন ও মহান দেশ। অনেকেই বলেন আধ্যাত্মিকতার পীঠস্হান। অনেক মহাপুরুষ ও এদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। অনেক ভালো, ভালো উপদেশ তারা দিয়ে গেছেন। যেমন বুদ্ধদেবের আর্যসত্য ও অষ্টাঙ্গিক মার্গ, মহাবীরের পঞ্চ মহাব্রত, গুরু নানকের উপদেশ প্রভৃতি। আবার হজরত মহম্মদ বা যীশু খ্রিষ্ট ও অনেক মূল্যবান উপদেশ পৃথিবীবাসীকে দিয়েছেন। আমরা কি তা অনুসরণ করি? আজ যদি আমরা মহাপুরুষদের জীবন ও বাণী সম্পর্কে সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে পারতাম তাহলে পৃথিবীটা একটা স্বর্গের দেশ হতো।সেইজন্য কবি বলেছেন, কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক/কে বলে তা বহুদূর/মানুষের মাঝেই স্বর্গ নরক/মানুষেতেই সুরাসুর।
মানুষ আজ প্রচন্ড ব্যস্ত। কিন্ত একটা কথা সকলকেই মনে রাখতে হবে মানুষ খালি হাতেই পৃথিবীতে এসেছে আবার খালি হাতেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে।মানুষকে স্মরণীয় করে রাখবে তার ভালো কাজ। জীবনের মূল্য আয়ুতে নয়, কল্যাণময় কর্মে। কাজেই নিজেকে ভালোভাবে তৈরী করতে না পারলে তার পক্ষে কী ভালো কাজ করা সম্ভব?সকলেরই উচিত এই ব্যাপারটি নিয়ে ভাবা। আমাদের দেশ যখন পরাধীন ছিল তখন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেশকে স্বাধীন করা, ইংরেজদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করা। কিন্ত শুধু স্বাধীনতা অর্জনই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লক্ষ্য ছিল না। এরসঙ্গে তারা একটি উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই উন্নত ভারতবর্ষ কাদের নিয়ে গড়ে উঠবে? আমি, আপনি সহ আপামর দেশবাসীকে নিয়ে।কাজেই দেশের ভালো-মন্দ নির্ভর করবে দেশবাসী কেমন শিক্ষা বা জীবনাদর্শ নিয়ে বড়ো হচ্ছে তার উপরে। আজ দুঃখের সঙ্গেই বলতে বাধ্য হচ্ছি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে, রাজনৈতিক সুবিধাবাদ সবকিছুকেই শেষ করে দিচ্ছে। এর থেকে উদ্ধার পেতে গেলে একটিই উপায় নিজেকে শিক্ষিত করা ও উন্নত জীবনাদর্শ মেনে চলা। মহাপুরুষ ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আর্দশে অনুপ্রাণিত হওয়া ও তাদেরকে মেনে চলা।নাহলে উন্নত জীবন ও উন্নত দেশ তথা বিশ্বের আশা সুদূরপরাহত। এইজন্য শ্রীরামকৃষ্ণদেব জগতের শ্রেষ্ঠ কথাটি বলে গেছেন- তোমাদের চৈতন্য হোক। আর সাধক রামপ্রসাদ আক্ষেপ করে বলেছেন, এমন মানব জমিন রইল পতিত/আবাদ করলে ফলতো সোনা। পরিশেষে কবির উক্তি দিয়েই শেষ করি। সেই ধন্য নরকুলে/লোকে যারে নাহি ভুলে/মনের মন্দিরে সেবে/সদা সর্বজন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন