স্মৃতিকথা
কাশ্মীর ভ্রমণ সপ্তম পর্ব
শু ভ্র জী ৎ বি শ্বা স
কোনো একটা জায়গায় আমরা দীর্ঘদিন অতিবাহিত করলে সেখানকার অন্তত কিছু মানুষদের সাথে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক। কিন্তু কশ্মীর আমাদের বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রীদের কাছেই ছিল তার ব্যাতিক্রম। হয়তো আমাদের কাছে সংবাদপত্র বা খবরের বিভিন্ন চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে যে তথ্যগুলো কাশ্মীর সম্পর্কে উঠে আসে সেগুলো আমাদের মনে সেই জায়গাটা সম্পর্কে একটা বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করেছিল। অনেক সময়েই আমরা এক রিং এ ফোন তোলার অবস্থায় থাকি না। সেক্ষেত্রে আপনজনেরা কিন্তু ততটা চিন্তিত হন না। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে কিন্তু তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া ছিলো। এক রিং এ ফোন না তুললে পরের ফোনটা ওখানকার বন্ধু বান্ধবদের কাছে যেত। কেন? সেই কারণটা আশা করি আর খুলে বলতে হবে না। একটা চাপা ভয় প্রতি মুহূর্তে তাড়া করে বেড়াতো। আমি যে সময়টায় সেখানে ছিলাম তখন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বা ভারতের অন্যান্য জায়গার সিম কার্ড সেখানে কাজ করতো না। যখন আমরা প্রথম জম্বু কাশ্মীরের এলাকায় ঢুকি তখনই সেটা বন্ধ হয়ে গেছিল। সে সময় দু এক বার নব্বইয়ের দশকের শেষের মতো টেলিফোন বুথ খুঁজে বেঁচে আছি বিষয়টা জানিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে যা বিল এসেছিল তা ছিল ধারণার চেয়ে বেশি। যাই হোক সেখানে গিয়ে সিম কার্ড কেনার একটা মজার ঘটনা উল্লেখ না করলে বোধহয় একটা দারুণ অভিজ্ঞতা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমরা তখনও শ্রীনগর থেকে প্রায় ৬৭ কিমি দূরে। একটা ধাবার সামনে খাওয়া দাওয়া চলছে। আমি আর ক্যান্ডেল একটা বুথ দেখে ফোন করতে গেছি। ঠান্ডায় প্রাণ যাওয়ার উপক্রম। ক্যান্ডেল ফোন সেরে চা খেতে গেছে। ওর কোনো এক পরিচিত দাদা তখন সেখানেই সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তার একটা সিমও সেই ক্যাম্পের সামনে থেকে কালেক্ট করবে। আমি ফোন করে যা বলার মিনিট শেষ হবার আগে বলেই ফোন রাখলাম। বুথের মালিক বিল ধরালো। দিলাম। দেখি বেশ কিছু সিম কার্ড আর পুরোনো দিনের কিছু কিপ্যাড ফোন দোকানে ছিলো। সেই ভদ্রলোককে প্রয়োজনেই জিজ্ঞেস করলাম এখানে সিম কার্ড নিতে গেলে তার উপায় কি। উনি তার ভাঙাচোরা হিন্দিতে বোঝালেন চার কপি পাসপোর্ট সাইজের ফটো, ভোটার কার্ডের জেরক্স, ইউনিভার্সিটির ছাত্র হবার প্রমাণপত্র প্রভৃতি লাগবে। তবে সিম অ্যাকটিভ হতে প্রায় দিন চার পাঁচেক লাগবে। এসটিডি বুথের বিলের কথা চিন্তা করে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এবার মনে প্রথম যে চিন্তাটা এলো সেটা ছিলো ডকুমেন্টস দিয়ে সিম নেবো ভালো কথা কিন্তু আমাদের রাজ্যে সিম নিতে তো এত ফটো, পরিচয় পত্র লাগে না! তাহলে বাকিগুলো দিয়ে আবার সিম ইশু হয়ে অন্য কারও হাতে পড়লে তো মহাবিপত্তি হবে। তাই নিজের ডকুমেন্ট দেবোই না। দরকারে সিমই নেবো না। তাও ভালো। একেতো এর আগেও বিনা ডকুমেন্টে সিম তোলার অভিজ্ঞতা ছিলো। অন্য দিকে বাঙালি মাথা। শেষকালে ভাবলাম ওটাকেই কাজে লাগাতে হবে। সেই ভদ্রলোককে নানা কথা বলে রাজি করালাম। ওনার কাছে একটা ভোডাফোনের সিম নিলাম। যার নামের ডকুমেন্ট তার নাম এই মুহূর্তে মনে নেই তবে তিনি অনন্তনাগের বাসিন্দা ছিলেন। গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে গেছে তাই কোনো রকমে তিনশো টাকায় কেসটা মিটিয়ে বাসে চড়ে উঠছি । সিমের প্যাকেটের মধ্যে একটা নাম, বাবার নাম ও ঠিকানা লিখে দিয়েছিলেন ঐ ভদ্রলোক। যদিও সেটা তখনও নজরে আসে নি । সিম লাগানোর পর টাওয়ার আসলো। কিন্তু কল হয় না। কি যে সমস্যায় পড়লাম ভেবে কুল পাই না। তারপর ইউরেকা। মাথায় আসলো হয়তো ভেরিফিকেশন করা নেই। নির্দিষ্ট নাম্বারে ফোন করতেই সন্দেহ বাস্তবে বদলে গেছে। কিন্তু ভেরিফিকেশন যে করবো তার জন্য তো যার ডকুমেন্ট তার নাম ঠিকানা চাই। অবশেষে প্রায় মিনিট পনেরো পর চোখ পড়লো ঐ প্যাকেটে লেখা নাম ঠিকানার দিকে। সাহস করে কল করলাম। ওপার থেকে এক মহিলার কন্ঠে ভেসে আসলো কৃপায়া আপকা নাম অউর এড্রেস বাতাইয়ে। প্যাকেটে লেখা নামটা আর ঠিকানা বলতেই ভ্যারিফিকেশন পর্ব শেষ। তার কিছুক্ষণ সময়ের মধ্যে সিমটায় এফআরসি-ও চলে আসলো। এবার বাস থেকেই বাড়িতে ফোন করলাম। অন্য দিকে ক্যান্ডেল ও নিজের নির্ধারিত ঠিকানা থেকে সিম নিয়ে নিলো। জানালা দিয়ে দূরে শ্রীনগর শহরের তারার মতো আলোগুলো দেখতে দেখতে পরিবারের মানুষদের সাথে কথা বলার কি যে আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
আমার মা
ম ঞ্জি রা ঘো ষ
অত্যন্ত মিতভাষী, স্নিগ্ধ এবং আক্ষরিক অর্থে খুবই সুন্দরী ছিলেন আমার মা, মাধুরিকা দেবী। তবে তাঁর যে দিকটি আমাকে প্রতিনিয়ত তাঁর প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল করে তোলে, তা হ'ল তাঁর অন্তর্গত আলো। জন্মসূত্রে ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে। আধুনিক মনস্ক, সপ্রতিভ এবং যুগোচিত নয়, যুগের থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকা মানুষ। পাশাপাশি, ভীষণ ভাবে দায়িত্বশীল, কর্মঠ, সেবাপরায়ণ, সহিষ্ণু ও কোমল ব্যক্তিত্বময়ী। তাঁকে দেখলে অনবধানে যেমন সম্ভ্রম জাগতো তেমনি ভালবাসতে ও ইচ্ছে করতো।
সতের বছর বয়সে ব্রাহ্ম গার্লস বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পর, কুমিল্লায় পিসির বাড়ি বেড়াতে যান। আর সেখানেই আমার ঠাকুমা পুত্রবধূ নির্বাচন করেন। ঠাকুমার ছিল জহুরীর চোখ। হিন্দু জমিদার বাড়ির বৌ হয়ে সম্পৃর্ণ নতুন পরিবেশে নিজেকে মানানসই করে তৈরি করে নিলেন তিনি। ঠাকুমার বর্তমানে ও অবর্তমানে পরিবারের সবরকম দায়িত্ব যথাযথ পালন করে গেছেন আমৃত্যু। দেশভাগের পর, পাকাপাকি ভাবে কলকাতাবাসী হলেন, পরিবারের অন্যান্যরা। তাদের এই পরবাস যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছিলেন নিজের ধৈর্য্য, ত্যাগ ও সেবায়। প্রতিদিন সতের জনের দেখভাল, সন্তানদের লালন পালন ও আত্মীয় অনাত্মীয়দের বিপদের দিনের দিশা হয়ে ও প্রাইভেটে স্নাতক হয়েছিলেন। সাহিত্য মনস্ক, শিল্পানুরাগী মায়ের সান্নিধ্যেই বড় হয়েছি আমরা। বাবা ছিলেন সৃজনশীল এবং অবশ্যই সেলিব্রেটি। তাই, সংসারের আনাচকানাচ সবটুকু সামলাতে হত মা'কে। এছাড়া ছবি, সেলাই ইত্যাদি বিষয়ে মুন্সিয়ানা ছিল। গান ও শিখেছিলেন, তবে চর্চা রাখতে পারেননি।
তাঁর জীবন যে খুব মসৃন ছিল, তাই নয়। মাত্র আট বছর বয়সে মাতৃহারা। স্নেহশীলা কাকিমার কাছে বড় হয়েছেন। আমার ঠাকুমার খুব প্রিয় ছিলেন, দিদুনের তো বটেই। ষোলো বছর বয়সে আমার বড় দাদা মারা যায় ভুল চিকিৎসায়। এই শোক আমার বাবা, মা কে ভীষণভাবে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ঐ সময় আমাদের মাসি ও পিসির সহৃদয় সাহচর্য, সমবেদনা মা'কে সংসার জীবনমুখী করেছিল।
সন্তানশোক ভোলা অসম্ভব। তবু সবসময় ব্যস্ত রাখতেন নিজেকে এবং নিঃশব্দে সবকিছু করে যেতেন সুচারু ভাবে। নিজে রীতিমতো পড়াশোনা করতেন, অতন্দ্র প্রহরায় সব সন্তানকে সঠিক ভাবে শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন। মা চাইতেন, মেয়েরা অবশ্যই নিজের পায়ে দাঁড়াবে এবং যথার্থ আত্মনির্ভরশীল হবে।বাবার মতাদর্শ ছিল, simple living, high thinking. মা ও সেই পথ অনুসরণ করেছেন। স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, তবু আমাদের মেয়েবেলা কেটেছে অত্যন্ত সাধারণ ভাবে। বিশেষ কোন চাহিদাও ছিল না আমাদের।
প্রসঙ্গত বলি, স্বামী লোকেশ্বরানন্দ তাঁকে পুরস্কৃত করেছিলেন, সমাজ সেবামূলক কাজের জন্য। সেই পুরস্কার আমি মঞ্চ থেকে গ্রহণ করেছিলাম মায়ের প্রতিনিধি স্বরূপ। এমনই নিঃশব্দচারিনী ছিলেন আমার মা।
বড় বেলায়, মা রীতিমতো বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। আমাদের বাড়িতে পড়ার বইয়ের ফাঁকে লুকিয়েচুরিয়ে অন্য বই পড়তে হত না। স্বাধীন ভাবে সাহিত্য চর্চা করা যেত। নানা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা ও করা যেত। তবু লাগামটি ধরে রেখেছিলেন নিঃশব্দ নিজের হাতে। বাবা মায়ের প্রতি সাংসারিক ব্যাপারে খুবই নির্ভরশীল ছিলেন। তাঁদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সুষ্ঠু বোঝাপড়া এবং ত্যাগ আমাদের পরিবারে স্নিগ্ধ বাতাবরণ তৈরি করেছিল।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, আমি ছেচল্লিশ বছর পর্যন্ত মাকে পেয়েছি, কোনভাবেই, কোনকারণে তাঁকে মিথ্যাচার করতে বা সাংসারিক জটিল আবর্তে জড়িয়ে পড়তে দেখিনি।
আমি তাঁর অষ্টম গর্ভের সন্তান এবং সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনিই আমার ধ্রুবতারা।চেষ্টা করি তাঁকে সর্বোতোভাবে অনুসরণ করতে, তবে ততটাও পেরে উঠি না।
মায়ের প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে, সহজে থামতে পারি না। হয়তো কিছু বলি, তবে না বলা থেকে যায় অনেকটাই।
পরিশেষে বলি, মা চেয়েছিলেন আমার জীবনের ধারা গতানুগতিক না হয়ে একটু ব্যতিক্রমী হোক্। আক্ষেপ এটাই যে তাঁর এই চাওয়া আমি পূরণ করতে পারলাম না।
জয়গাঁর স্মৃতি
আ র তি মি ত্র
ফুন্টশোলিং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সম্ভবত ৭০০ ফুট ওপরে। কি করে উঠব অতটা উপরে ভেবে, এখন নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে, কেন যে রাজী হলাম না ওদের কথায়; ওরা অনেকগুলো জায়গার নাম বলেছিল। অবশ্য সবই সমুদ্রতীর।
আমার সমুদ্রর থেকে পাহাড়ই ভাল লাগে, তাই মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল, না না ওখানে নয় পাহাড়ে যাব।
ওরা বলল, কোথায়?
আমি বললাম, জয়গাঁ যাবো। ভুটান সীমান্ত লাগোয়া শহর, পাহাড়ে ঘিরে রেখেছে যাকে।
কিন্তু এখন যে নানা চিন্তা ভিড় করছে মনের কোণে আমার। সারারাত ট্রেনে থাকতে হবে। সব থেকে বড় সমস্যা হল বাথরুম ব্যবহার করা। যা একদম অসহনীয় আমার কাছে।
এতদিন মনটা আনন্দে ময়ূরের মতো নাচছিল। যত দিন এগিয়ে আসছে দুশ্চিন্তার ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে মন। কিছু তো আর করার নেই।
কামিনী রায়ের কবিতায় সান্ত্বনা পেলাম---
" কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে
দুঃখ বিনা সুখলাভ হয় কি মহীতে?"
নাহ্ , এবার গোছানোর পালা। বেশী কিছু নেবার দরকার নেই। কম বয়সে সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে ছবি তোলার শখ ছিল। এখন তো শরীরে বার্ধক্য এসে গ্রাস করেছে। মনটাই যা সবুজ করে সজীব রাখার চেষ্টা করা। সেকথা ভেবেই পাঁচ ছ দিনের জন্য কোথাও যাওয়া।
কয়েকটা দিন গেল সবকিছু গোছগাছ করে নিতে।
অবশেষে এসে গেল প্রতীক্ষিত সেই দিন। স্টেশনে পৌঁছলাম, এবার ট্রেনের অপেক্ষা। আমার ভেতরে একটা উদ্বেগ কাজ করছে, ঠিকঠাক উঠতে পারব তো ট্রেনে? একেকজন যা তাড়াহুড়ো করে ওঠেন ট্রেনে, দেখে মনে হয় যেন তারা একাই যাবেন ওই ট্রেনে।
যাই হোক ওঠা গেল। সিট নম্বর খুঁজে বসলাম। একটা অসুবিধে ছিল। মিডল আপারে সিট। কি করে যে উঠবো? চিন্তার যেন শেষ নেই। ভাল্লাগে না। কেউ শেয়ার করতে রাজী নন। আজকাল বয়স্কদের প্রতি কারও যেন মায়া মমতা নেই একেবারে। কি আর করা যাবে? মনকে বললাম, একদম এসব ভাববে না মন,
যা হবার হবে।
ঠিক সাড়ে আটটায় ট্রেন ছাড়লো। ট্রেন চলতে শুরু করলে মাঝে মাঝে বাইরের আলোর ঝলক দেখা গেলো, তারপরেই গাঢ় অন্ধকার।
এবার পাশাপাশি যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় শুরু হল। আমার নিজের আপন জনেরা বলেন, আমি নাকি বেশী কথা বলি।
আমি ভাবি, কটা দিন তো আছি পৃথিবীতে, বোবা হয়ে থাকবো নাকি? ক্রমশ রাত বাড়ছে, অন্যান্য সঙ্গীদের খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ার ইচ্ছে। কি আর করা? আমরাও খেয়ে নিলাম। আমি তো খেলাম হাল্কা সামান্য কিছু। এবার ধরে টরে মাঝের স্লীপারে তুলে দিল পাশের যাত্রী একজন।
ট্রেনে দুলুনিটা আমি বেশ উপভোগ করি। এতো ভাল লাগে যে কী বলি! কিন্তু তার মধ্যেই আবার ভাবছি, ভালভাবে নামতে পারব তো?একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ জানালার পর্দার আড়াল থেকে ঊষা মুখ বাড়াল। কী যে ভালো লাগল !
একটু একটু করে সূর্য উঠছে
ট্রেনের চলার সঙ্গে সেও চলছে আমাদের সঙ্গে।
সারা কামরায় ছড়িয়ে পড়ছে আলোর রোশনাই। দু'পাশের প্রকৃতিও যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ধাত্রী মাতার মতো কোল পেতে রয়েছে সবুজের সমারোহ।
মাঝে মাঝে স্বচ্ছতোয়া নদীর দেখাও পেলাম। তবে বালির ভাগ বেশী। তির তির করে কাঁচের মতো শীর্ণস্রোতা তটিনী বয়ে চলেছে কোন অজানার পথে
সকাল হতেই চাওয়ালার হাঁকাহাঁকি বেশ ভাল লাগে শুনতে।
' চা এ ---'
লিকার চা
দুধ চা
কফি
নানা ধরণের খাবার।
কেনা-কাটার জিনিস নিয়ে হকার হাজির
'দিদি চা খাবেন?'
যতক্ষণ না পৌঁছচ্ছি ঠিক করেছি আমি কিছুই খাবো না। তাই না বলেই দিলাম। এখন মনের খিদে মেটাচ্ছি। আবার কবে দেখব, কে জানে? কোথাও সবুজ ধানক্ষেত
কোথাও বা অন্য সবজীর চাষ হচ্ছে। মাঠের সমান্তরাল পথ চলে গেছে দূর-দূরান্তে, সেখানে সাইকেল সওয়ারী যাচ্ছে।
ট্রাক দুরন্ত বেগে ছুটে চলেছে।
কখনও চোখে পড়ছে নাম না জানা বুনো ফুলের শোভা রোদ্দুরের তাপ জানান দিচ্ছে বেলা বাড়ছে। মনের এককোণে চিন্তার মেঘ উঁকিঝুঁকি মারছে ঠিকঠাক নামতে পারব তো?
আগে থেকেই গাড়ি বলা আছে, হোটেলে যাবার। না না, কেন এসব ভাবছি?
আবার কাছাকাছি এল ক্ষীণস্রোতা নদী। মনে হল ওর গন্তব্যস্থল তো জানা নেই। কত জনপদ পেরিয়ে সে ছুটছে, সাগরে মিলিত হতে। হঠাৎ আনমনা হয়ে ভাবতে ভাবতে চলে গেলাম সাগরতীরে। দূর থেকে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে, ফেনিল জলরাশি ভিজিয়ে দিচ্ছে পা। আঃ, কি আরাম ! আবার ছুটে আসছে ঊর্মিরাশি, মনে হলো আলিঙ্গন করি। অপূর্ব অনুভূতি সারা অন্তর ছুঁয়ে দিল। লাল, লাল চিংড়ি বালির উপরে হেঁটে বেড়াচ্ছে,
ঝিনুকের ছড়াছড়ি। কুড়োতে শুরু করলাম, আঁচল ভর্তি হয়ে গেল।
মনের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠলো ঝিনুকের ভেতর মুক্তো নেই তো?
জলের স্রোতে অনেকটা দূরে চলে এসেছি, একরাশ ভালোলাগায় আচ্ছন্ন মন ---
'ও দিদি,ও দিদি কি ভাবছেন?'
যাঃ, আনন্দটাই মাটি করে দিল, এক মুহূর্তে বাস্তবের কঠিন আবর্তে পড়লাম মুখ থুবড়ে।
আগে খোলা জানালা দিয়ে আসা স্নিগ্ধ বাতাসে সারা শরীর, মন দুইই আবেশে ভরে উঠত, এখন তো আমরা এসি কামরা ছাড়া যেতেই পারি না। কাঁচ বন্ধ, পর্দাতেই আবদ্ধ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবই পরিবর্তন হয়। মেনেও নিতে হয়। আমরা বড়ই আরামপ্রিয় হয়েছি যে, তাই কৃত্রিমতা গ্রাস করেছে। প্রকৃতিকে দিয়েছি দূরে সরিয়ে। শহরে তো গাছপালা উচ্ছেদ করে ইঁট, কাঠ, পাথরের বহুতল বাড়িতে ঢেকেছে আকাশ। তাই তো ছুটে ছুটে আসা
অরণ্য জীবনের আনন্দ উপভোগ করতে। এত সবুজের সমারোহ নগরজীবনে কোথায় মিলবে?
মনে পড়ল কবিগুরুর কবিতা, কত দূরদর্শী ছিলেন তিনি। কত যুগ আগেই উপলব্ধি করেছিলেন বনসংরক্ষণ, বনভূমির প্রয়োজনীয়তা। তাই বলেছিলেন,
"দাও ফিরে সে অরণ্য
লও এ নগর --"
আমরা বুঝিনি। আজ প্রকৃতিও সরে গেছে অনেক দূরে। আবার ভাবনার গভীরে ডুবে গেলাম। শ্যামলীমায় ঘেরা পাহাড়ের সৌন্দর্য মানসচক্ষে ভেসে উঠল।
উহ্, কি অনির্বচনীয় অনুভূতি !
শুধু দেখা তাতেই মনপ্রাণ ভরে যায়। বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টির কথা ভাবলে, শিহরণ জাগে।
পাহাড়ের গায়ে গায়ে বাসস্থান। নানারঙের ফুলে ফুলে সজ্জিত। আশ্চর্য করে দিয়ে হঠাৎ,
এক ঝলক সুরভিত হাওয়া যেন সমস্ত হিয়া আকুল করে তুলল।
দু'পাশে চা বাগান। তার মাঝখান দিয়ে চলছে ট্রেন। কী ভীষণ ভালোলাগা!
মনে হচ্ছে সবুজ গালিচা পেতে রাখা। কে যেন অদৃশ্য হাতে পরম মমতায় প্রকৃতিকে সাজিয়ে রেখেছে। এক ছুটে গিয়ে সারা গায়ে তার আদুরে স্পর্শ নিতে ইচ্ছে করছে। বাগানের মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ, ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছে। শ্যামল বাগিচা যেন দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে। পিছনে অতন্দ্র প্রহরীর মতো ছোট বড় বাড়ি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাহাড়। ওর গায়ে অজস্র গাছপালা, লাল নীল নানারঙের পতাকা উড়ছে যেন হাওয়ায়।
সকাল সাড়ে এগারোটায় হাসিমারা স্টেশনে এলাম। একবুক আনন্দ নিয়ে সকলে একে একে নামলাম। যদিও অনেকটা আগেই সব জিনিস নিয়ে দরজার কাছে চলে এসেছি। যাই হোক সব দুশ্চিন্তার অবসান হল।
দেখলাম বেশ খানিকটা হাঁটতে হবে, কিছু করার নেই। তাই ধীরে ধীরে গিয়ে একটা দোকানের আড়ালে অপেক্ষা করতে লাগলাম। রিজার্ভ গাড়ি কিছুক্ষণ পর এলো। উঠলাম তাতে। হোটেলে গিয়ে স্নান খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রামের কথা ভেবে মনটা কিছুটা নিশ্চিন্ত হল।
গাড়ীর দুপাশেও সেই একই দৃশ্য।
খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে মন-তটিনী ছুটছে হিয়ার গভীরে শুধু সুরের মাতন। হোটেলে পৌঁছে টুকি-টাকি সব কাজ সেরে গা এলিয়ে দিলাম। কিন্তু সর্বদাই মনে হচ্ছে চারপাশের পাহাড় যেন ডাকছে আমাকে ফিসফিস করে।
হোটেলটা বেশ বড়সড়। ঘরগুলোও মনোরম। কিন্তু বাইরের দিকে তাকিয়ে হতাশ হতে হল। ওমা এখানেও সব বহুতল বাড়ি ! এত দোকানপাট! যদিও আমি আর একবার অনেক বছর আগে এসেছিলাম। পরিবর্তন তো স্বাভাবিক। দোকান, বাড়ির পেছনে তাকিয়ে আনন্দে মন ভরে গেল। তবু প্রত্যাশা পূরণ হতে আরও প্রতীক্ষা। কেন যে এতো আকুলতা, বুঝতে পারি না
মনে হয় কি এক রহস্যের হাতছানি।
দিবানিদ্রা ভাঙতে ভাঙতে বিকেল গড়িয়ে গেল, মনটা হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে গেল, চারিদিকে জ্বলে উঠেছে সাঁঝবাতি, যার জন্য এতদূর ছুটে আসা তাকে একটিবার দুচোখ ভরে দেখবো না
নিজের উপর নিজেরই রাগ হতে লাগলো। সবাই বেরোনোর তোরজোর করছে, তড়িঘড়ি তৈরী হয়ে সিঁড়ি পার করলাম ডানদিকে একটু হেঁটে গেলেই আমার চির আকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টিগোচর হবে,
উঃ! ভাবতেই আনন্দে ভরে গেলো মন, সবাই বলে উঠলো 'দেখো দেখো, এতক্ষণ তো গজগজ করছিলে, দেরী হয়ে গেল, ভালো লাগে না, কেন যে ঘুমোতে গেলাম'
একি এ কি দেখছি আলোর মালায় সজ্জিত আমার চারপাশ ঘিরে রেখেছে-
"ধ্যানগম্ভীর ঐ যে ভূধর --"
বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। দু নয়ন অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। যে দিকেই দৃষ্টিপাত করি, সেই একই দৃশ্য। মনেহল সেও যেন আমায় বেষ্টন করে রেখেছে। মনেহল তাকে জড়িয়ে ধরি। গা-টা একবার ছুঁয়ে দেখি। কিন্তু আরও অনেকটা কাছে যেতে হবে যে। রাত নামছে, আজ আর হবে না। মনে মনে বললাম, 'কাল আসব তোমার স্পর্শসুখ অনুভব করব'।
হোটেল থেকেই চা খেয়ে বেরিয়েছিলাম। এবার গন্তব্যস্থল রাতের খাবারের দোকান খোঁজা। অবশ্য বেশীদূর যেতে হলো না।
মোটামুটি সবই চেনা। তবে অনেক বছর পরে আসার জন্য বেশ পরিবর্তন হয়েছে। রাজস্থানী থালিতে অনেক ধরণের খাবার পরিবেশন করেছিল। সবই নিরিমিষ। আমি তো ঠিকই করে নিয়েছিলাম বাইরে মাছ, মাংস খাব না। তাই ওই থালিতে আমার কোন আপত্তি রইল না। খাওয়া শেষ করে মৌরী চিবোতে চিবোতে পথে নামলাম।
সন্ধ্যের জ্বলে উঠা সারি সারি অজস্র দীপের আলোয় মন এখন আলোকিত হয়ে আছে।
পাহাড়ের উপর, আঁকাবাঁকা রাস্তা। সোপানের পর সোপান। শীতল হাওয়ায় মমতার স্পর্শে শিহরণ জাগল শরীরে। নক্ষত্রখচিত দূর গগনের দিকে তাকিয়ে আলোকে আঁধারে আমার জীবনদেবতাকে উপলব্ধি করলাম। পরম প্রাপ্তিটুকুর জন্য প্রণতি জানালাম তাঁর চরণে।
ইঁট, কাঠ, পাথরে ঘেরা শহরের এক চিলতে আকাশ। সে তো সবটুকু নয়, এই মুহূর্তটুকু অক্ষয় হয়ে রইল মনে আমার।
হঠাৎ অমিতার ডাকে ফিরে এলাম বাস্তবের জগতে। 'কি রে তোর আবার ভেতরের কবিমন জেগে উঠলো নাকি?' স্মিত হেসে বললাম, 'এই পরিবেশে সেটা কি স্বাভাবিক নয়?'
সাঁঝের মায়াময় জাল ছিঁড়ে ধীরে ধীরে রাত নামছে চারপাশে আমাদের। পেটের তাগিদে যা হোক তো কিছু খেয়ে নিলাম। মনের খিদে যে মিটছে না সবটুকু।
দু'হাত দিয়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আহ্বান উপেক্ষা করি কি করে? চেতনায় আকাশ-পাতাল ভাবনার ভিড়। হোটেলের করিডোরে এসে চেয়ারে বসলাম। নিশীথের বুকে কত ব্যথা, কত কান্না জমে আছে। সব ব্যথাভারের উপর যেন নিঃশব্দে স্নিগ্ধ প্রলেপ বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ।
চিত্ত আমার আকুল পারা, সেখানে বাউলের একতারার সুর, ঘুম নেই আমার চোখে।
রাতের খাবার খেতে খেতেই আগামীকালের পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। কোথায় যাওয়া যায়?
ঠিক হলো জলপাইগুড়ি ছাড়িয়ে ফুলবাড়ী, গাজলডোবা হয়ে সতীর একান্ন-পীঠ রয়েছে। যেখানে মায়ের একটি পায়ের পাতা পড়েছিল।খুব সকাল সকাল বেরোত হবে।
হোটেলে ফিরলাম।আবার সিঁড়ি ভাঙতে হবে, সেই তিনতলা। ভাল লাগে না আর। কি আর করা? ধীরে ধীরে উঠে চাবি খুলে ঘরে ঢুকলাম। প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে এবার বিছানায় গিয়ে উঠলাম। আমার তো সেই এক দুশ্চিন্তা, সব কাজ ঠিকঠাক করে বেরোতে পারব তো কাল সকালে? যেতে যে হবেই। এ সুযোগ তো বারবার আসবে না। আগে এলেও এই তীর্থস্থানে যাওয়া হয়নি আমার। ভাবতে ভাবতেই ঘুম এসে গেল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।
সকাল পাঁচটায় ঘুম ভাঙতেই প্রাতঃকর্ম সেরে নিলাম।এবার মনটা চা চা করছে। সবাই পাশাপাশি ঘর নিয়েছিলাম। সকালের চা-টা খুব ভালো লাগে আমার। আদা, দারুচিনি আরও কত কি দিয়ে তৈরি করে। আমি তো দুধ চিনি ছাড়া শুধুই লিকার খাই বাড়িতে। কিন্তু এখানেও খুব আয়েশ করে খেলাম সেই মশলা-চা। শুকনো খাবার সঙ্গে ছিল। চা খেয়ে উঠে, গিজার চালিয়ে দিলাম। একজন একজন করে স্নান সারতে হবে এবার।
সাড়ে আটটায় গাড়ি বলা আছে। তার মধ্যেই তৈরি হয়ে নামতে হবে হোটেলের নীচের ফ্লোরে।
স্নান সেরে জামাকাপড় পরে নিলাম। সঙ্গে অবশ্যই জল নিতে হল, খাওয়ার জন্য। সকলে ঠিক করলাম যেতে যেতে পথে কোথাও হালকা কিছু খেয়ে নেবো। ন'টায় রওনা দিলাম। রাস্তা বেশীর ভাগ খুবই সুন্দর। কোথাও কোথাও একটু ভাঙাচোরা। সবুজ গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা পথ। কখনও বনবীথির মধ্য দিয়ে চলছি। ভাললাগার যেন শেষ নেই। সবটা পুষিয়ে নিতে হবে যে।
ফিরে গিয়ে তো আর এ'সব চোখেই পড়বে না। ওমা একী ! এখানেও দুপাশে নদী মন্থরগতিতে চলছে। সেই আকাশনীল স্বচ্ছ সলিল, সামান্য স্রোতে বহমান। মনেহয় এখানেই দাঁড়িয়ে থাকি।
কিন্তু দেরী হয়ে যাবে যে।
এবার চা বাগানের মধ্য দিয়ে চলছি। চোখ, মন দুইই জুড়িয়ে গেল। কি অপার সৌন্দর্য ! বিস্ময় আর মনে ধরে না।
কেন যে আমার এত ভালোলাগে, নিজের কাছেই কোন উত্তর পাই না। মনেহয় ওদের সঙ্গে মিশে থাকি। ওদের মিষ্টি ছোঁয়া উপভোগ করি। মনের খিদে মেটানোর জায়গা যে বড়ই কম।
তাই, মন চায় সবটা উশুল করে নিতে। কতটা পেলে যে তৃপ্তিতে ভরে উঠবে অন্তরের অন্তস্থল বুঝতে পারি না। গাছপালা, নদনদী, পাহাড়ের সঙ্গে যেন জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক আমার।
শেষ হয়েও হয় না শেষ, আরও চায় মন। কখন যে চা বাগানের প্রান্তর শেষ করে অন্য পথ দিয়ে চলে এসেছি, খেয়াল করিনি।
বাস্তব জগতে ফিরে এলাম।
ঘন্টার পর ঘন্টা মাইলের পর মাইল চলছি, কিন্তু কোন ক্লান্তি নেই। মন তো উড়ছে। আনন্দের যেমন শেষ নেই তেমনি শ্রান্তিও নেই। পথের পর পথ পাড়ি দিচ্ছি।
কোমরটা একটু ব্যথা করছে,তাতে কি? ওসব ভাবলে তো চলবে না এখন আমার।
ঐ তো আবার ক্ষীণস্রোতা তটিনী, নিজের মনে চলছে। কত গ্রাম গঞ্জ পার হয়ে। কত ক্ষেতে জল সিঞ্চন করে মিলনের আনন্দে ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টিনন্দন কতসব দৃশ্য। মাঝে পথ ভুল করে নানা পথচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। একবার তো একটা ভুল রাস্তায় চলে গেলাম। সেখানেও নদীর তীরে এক মন্দির। কীর্তন গান চলছে।
গাড়ি থেকে নেমে বাঁধানো একটা গাছতলায় বসলাম। পরে জানলাম এটা আমাদের গন্তব্যস্থল নয়। আবার সেখান থেকে সঠিক পথের উদ্দেশ্যে চলা শুরু।
কখনও অরণ্যঘেরা পথ, আবার
কখনও প্রিয় চা বাগান। কখনও বা আলুর ক্ষেত। প্রচুর আলুর ফলন হয়েছে দেখলাম। চাষীরা বস্তাবন্দী করে রেখেছেন। মাঠভর্তি শুধুই আলুর বস্তা। আরও কিছু রাস্তা যাবার পথে চোখে পড়ল- সারি সারি আলুর বস্তা ভর্তি ট্রাক হিমঘরে রাখার জন্য অপেক্ষারত। কোথাও বা ভ্যানগাড়িতে করেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আলুর বস্তাগুলি। ভাবলাম, অনেক হাত ঘুরে আমরা কতই না বেশী দামে কিনি। অথচ যাদের রক্তজল করা পরিশ্রমের ফসল, তারা সামান্য অর্থ রোজগার করে। সংসারের বোধহয় এই নিয়ম।
কত অজানা নামের জায়গা পার হয়ে আমার আকাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছলাম। কী অপূর্ব সে তীর্থস্থান। সাদামাটা, অনাড়ম্বর মন্দির। ছোট ছোট কয়েকটি মন্দির একসাথে পাশাপাশি আছে অথচ জাঁকজমক, হৈচৈ নেই। সকলেই ধ্যানমগ্ন। একমনে প্রার্থনা জানাচ্ছে। প্রবেশ পথের বাঁদিকে। বিশাল মহাদেবের মূর্তি, আকাশ ছোঁয়া--- স্নিগ্ধ, শান্ত, সৌম্য আনন। দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে মঙ্গলময় আশীষ।
মনে হল,
"কে বসিলে আজি হৃদয়াসনে ভুবনেশ্বর প্রভু,--
জাগাইলে অনুপম সুন্দর শোভা হে হৃদয়েশ্বর।।
সহসা ফুটিল ফুলমঞ্জরী শুকানো তরুতে,
পাষাণে বহে সুধাহারা॥"
প্রাণ চাইল সমস্ত দেহমন লুটিয়ে পড়ুক তাঁর চরণপদ্মে।
অনিচ্ছাকৃতভাবে এগোতে হল সম্মুখের মন্দিরের উদ্দেশ্যে।
দু'পাশে তারের বেড়া মাঝখানে পথ। এগোচ্ছি সম্মুখে মাতৃকৃপা লাভের উদ্দেশ্যে। প্রথমেই যে মন্দিরে প্রবেশ করলাম, দেখলাম সুসজ্জিতা মা স্মিত হাসি, স্নেহমাখা দৃষ্টিতে ভক্তদের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশীষ বিলিয়ে দিচ্ছেন। প্রবেশপথের বাঁদিকে পূজোর উপাচার নিয়ে দোকানী বসেছিল। সেখান থেকে পূর্বেই ফুলমালা মিষ্টি সংগ্রহ করা হয়েছিল। পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে আমরাও আমাদের ভক্তি মায়ের চরণে নিবেদন করলাম। কয়েক পা এগিয়ে দু তিনটি সিঁড়ি দিয়ে নেমে আবার মাতৃদর্শন, তাঁর সামনেই মায়ের চরণ সিঁদূরে রঞ্জিত। সধবা মহিলারা ঐ সিঁদূরে সীমন্ত রাঙা করলেন, বলা বাহুল্য মনে মনে সিঁথির সিঁদূর নিয়ে ওপারে যাবার আশায় মাকে প্রণাম জানালেন
আমি কিছুটা সিঁদূর সংগ্রহ করে নিলাম, আমার প্রিয়জনের জন্য।
এরপরে উপবেশনরত বাবা মহাদেবের মূর্তির কাছে প্রণত হয়ে, প্রার্থনা করলাম। বাইরে এসে দেখলাম বিশাল গাছের নীচে বাঁধানো বেদী রয়েছে। যেখানটায় মাটি আছে সেখানে সকলে ধূপকাঠি, মোমবাতি জ্বেলে মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার জন্য প্রার্থনা করছে। আমিও প্রণাম জানালাম। হঠাৎ ট্রেনের কয়েকজন সহযাত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। কিছুক্ষণ বাক্যালাপ করে পুনরায় গাড়িতে উঠলাম।
এবার উদরপূর্তির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পথিমধ্যে এক সাদামাটা খাবার জায়গায় নেমে খেয়ে নেওয়া হল। খাবার খুব একটা খারাপ নয়, মোটামুটি চলনসই।
তখন বিকেল পাঁচটা বাজে, তবে শরীরে কিন্তু কোন ক্লান্তি নেই, কোন কষ্ট উপলব্ধি হচ্ছে না।
মনে হচ্ছে এক পরম প্রাপ্তি ঘটল আজ।
হোটেলে ফেরা হল। সবাই একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সন্ধ্যের আলো জ্বলছে। পাহাড়ও দীপ জ্বেলে এক মায়াজগতের হাতছানি দিয়ে ডাকছে, মনে মনে আমিও চললাম তার পানে।
একজন এসে বলল, মনটা কেমন চা চা করছে। বেশ। চায়ের ব্যবস্থা হোক। হোটেলে বলে দিতে, ওরা এসে একটু পরেই চা দিযে গেল।
সবাই মিলে গল্প করতে করতে চা খেতে লাগলাম। সঙ্গে পরের দিনের অভিযান সম্বন্ধেও ছক কষে নেওয়া হোল। হাতে সময় খুব কম। ফুন্টশোলিং যাওয়া বাকি রয়ে গেছে এখনও।
যদিও এর আগে চার/পাঁচবার গিয়ে থেকেছি ওখানে। এবারে আর থাকা হবে না। শুধু ঘুরে আসব। এখন খুবই কড়াকড়ি নিয়ম। নানা আলোচনা করে যে যার ঘরে চলে এলাম রাতে হোটেলেই খাওয়ার পর্ব সেরে নেবো ঠিক হোল।
সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন যেন ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে গিয়েছিল। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে উঠতে হোল। নৈশভোজের সময় হয়ে গেল। ঠিক করলাম আর সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামব না।
পা দু'টো চলতে চাইছে না।
যার যার ঘরেই খাবার দিতে বলা হোল।
যা হোক করে খাওয়া সেরে বাকি কাজকর্ম করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। পরদিনের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। ঘুম ভাঙল ভোর পাঁচটায়। নটায় বেরোবো প্রাতঃকর্ম সেরে, সকালের চা দিতে বলা হোল। এই চা-টা ওরা বেশ ভালো করে। অনেক কিছু মিশিয়ে দারুণ স্বাদের হয়। বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে চা খেলাম।৷ এবার স্নানের পালা।
পাহাড়ের অনেক কাছে যেতে পারব ভাবতেই একটা রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। খুব তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
হোটেল থেকে হাঁটা পথ। তবে এখন বেশী হাঁটতেও পারি না। বয়স বাড়ছে। খুব রাগ হয় নিজের উপর তখন।
ন'টা নাগাদ বেরিয়ে কাছেই এক কালী মন্দিরে গেলাম। শুনলাম খুব জাগ্রত দেবী।
মনে মনে মাকে বললাম,
' মাগো আর তোমার কাছাকাছি যেতে পারলাম না। দূর থেকেই প্রার্থনা করছি, শরীরটা সুস্থ রেখো, যেন হাঁটার ক্ষমতা থাকে'।
এবার আসল লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে এগোতে লাগলাম- 'ওমা একি ভুটান গেট দিয়ে ঢুকতে পারবো না!' ঐ জায়গাটা পার হয়ে দেখছি বিশাল দেওয়াল তুলে দিয়েছে।
সবটা অতিক্রম করে এবারে প্রবেশপথ। রাস্তায় নানা দোকান, সবজীর পসরা। কী সুন্দর বেতের বড়ো বড়ো ঝুড়িতে বিভিন্ন রকমের সবজী! আলুগুলো লালচে। অবশ্য এই ধরণের আলু আগে যখন এসেছিলাম তখন পায়ের জোর ছিল জয়গাঁর বাজার থেকে কিনে নিয়ে যেতাম।
এখন আর ঘুরে ঘুরে সেই কাজ করার ক্ষমতাও নেই। যাই হোক ভেতরে ঢুকলাম। ঐ অঞ্চলের মেয়েরা একধরণের হলুদ পোশাক পরে আইনি কাজকর্ম করছে। খুব সুন্দর থাম, তাতে কারুকার্য করা। দারুণ সাজানো গোছানো জায়গা। ভাবলাম ছবি তুলে নিলে হয়। শুনলাম ছবি তোলা নিষেধ।
তেমনি কঠোর বিধিনিষেধ। আমাদের ভোটার কার্ড দেখল। প্রত্যেকের ছবি তুলল। প্রবেশ করার সময় দশ টাকা করে নিল। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে তবে সব কাজ শেষ করে ভুটানের পথে পা রাখলাম।
এবার কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে এ দোকান সে দোকান ঘোরার পালা। আগেকার এক পরিচিত দোকানে গিয়ে কয়েকটি জিনিস কিনলাম। নানা কথাবার্তার মাধ্যমে জানা গেল, লক ডাউনের পর এখানেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিছু বদল হয়েছে। আগেকার মতো জিনিস পাওয়া গেল না।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে হঠাৎ মনে হোল, দুটো পা আর চলতে চাইছে না
সামনেই বৌদ্ধ গুম্ফা। যদিও পূর্ব পরিচিত তবুও অপূর্ব সুন্দর, শান্ত, সমাহিত সে স্থানে গিয়ে বুদ্ধের পায়ে নিজেকে সঁপে দিতে মন আকুল হয়ে উঠল। গাছগাছালি বেষ্টিত, অতীব মনোরম জায়গা। সুদক্ষ কারুকার্যে চতুর্দিক আলোকিত। ভেতরে গিয়ে প্রণতি জানালাম।
বাইরে আর একটি ঘরে প্রদীপ-দানিতে ভক্তদের জ্বালানো দীপিকা উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ভক্তদের মধ্যে অশীতিপর বৃদ্ধ /বৃদ্ধারাও কেউ বাগানে, কেউ বা গুম্ফার চারদিকে ঘুরে ঘুরে মালা জপ করছেন। বাগানে বড়ো বড়ো গাছে চারপাশে বেদী করা রয়েছে। সেখানেও ভক্তদের সমাগম হয়েছে। নিস্তব্ধ, নিরিবিলি স্থানে শুধুই প্রার্থনা মন্ত্র নীরবে উচ্চারিত হচ্ছে। গুম্ফার চারপাশ প্রদক্ষিণ করে আমরাও ঐরকম একটি সিমেন্টের বসার জায়গায় বসে,
ভগবান বুদ্ধের চরণে নিজেদের সমর্পণ করে দিলাম।
সে এক পরম শান্তিপূর্ণ আশ্রয়। এখানে নেই কোনও কলরব নেই। কোনও কথামালা। পরিচিত জনের সঙ্গে দেখা হলে কেবলমাত্র স্মিত হাসির বিনিময়। তারপরেই মালা জপায় মগ্ন, কী প্রশান্তি সবার আননে। আমাদের মতো পর্যটকেরা ছবি তুলছেন। দু' একটি কথার বিনিময় হচ্ছে। কিন্তু সকলের মধ্যেই যেন সেই একই ছোঁয়া। কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হল বুঝতেই পারলাম না।
দেখলাম স্কুল ফেরত কিছু কিছু ছাত্র /ছাত্রী মায়ের সঙ্গে এসেছে। তারাও ধীর, স্থির। ছোট থেকেই ভক্তি তাদেরকেও স্পর্শ করেছে।
কিন্তু এবার যে উঠতে হবে, পাহাড় ডাকছে যে। একটা গাড়ি নিয়ে আমরা কজন ফুন্টশোলিংয়ের অদূরে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট হয়ে দামদরা-য় গেলাম, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩০০ ফুট ওপরে।
দামদরা থেকে জয়গাঁওয়ের তোরসা নদীর তলদেশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য চমৎকারভাবে দেখার জন্য খুবই উপভোগ্য। তাছাড়া পাহাড়ের চূড়ায়, নদীর তল থেকে কয়েক গজ এগিয়ে পাহাড়। জলবায়ু প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। সূর্য এবং মেঘের মধ্যে ক্রমাগত লুকোচুরি খেলা হয়, যা পাহাড়ের এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য। ওপরের মেঘগুলো বিভিন্ন কোণ থেকে নড়াচড়া করে। কখনও আবহাওয়া বিষণ্ণ হয় আবার কয়েক মিনিটের মধ্যে আবার তা উজ্জ্বল পরিষ্কার দেখায়। এটাই পাহাড়ের আসল সৌন্দর্য। কী অপূর্ব মনোহর দৃশ্য! দেখে মনে হলো জীবন সার্থক হোল।
এবার উদরপূর্তির প্রয়োজন। ফেরার সময় আবার সেই কঠোর বিধিনিষেধের বেড়াজাল পেরিয়ে,
দশ টাকা দক্ষিণা দিয়ে জয়গাঁ ফিরলাম।
বর্তমানে এই নিয়ম অনেকটাই শিথিল হয়েছে। এখন শুধু যাবার সময়ই দশ টাকা দিতে হচ্ছে। আমরা যখন ভুটানে গিয়েছিলাম তখন ওখানে একটা রাত থাকতে হোটেল খরচা এবং খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে একটা রাত থাকতে ১২৫০ টাকা লাগত। এখন প্রথম দুদিন ঐ টাকাটা দিতে হচ্ছে না।
তবে এখনও কিছু দেখা বাকি।
টোটোপাড়া। ঠিক হোল আগামী কাল যাবার দিনে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে হবে।
টোটোপাড়া দেখাটা সেরে নিতে হবে। আর কি আসা হবে? শরীরের অবস্থাও ভালো নয়।
মন ছুটে চলে নদীর মতো। কিন্তু পা দু'টো চলে কই?
হোটেলে পৌঁছে চা খেলাম। স্থির হোল, আজ রাতে নীচে খাবার ঘরে গিয়ে খাওয়া হবে। এবার একটু বিশ্রামের পালা। ঘরটার ওপর কেমন যেন মায়া পড়ে গিয়েছে। অবশ্য ঘরটাকে কেন্দ্র করেই তো নানা জায়গায় যাওয়া-আসা। তাই হয়তো এই আকর্ষণ। ছেড়ে যেতে হবে ভাবতেই বুকের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে উঠল। বারান্দায় বসলেই তো আমার ভালোলাগার অনুভূতি। এই অভাববোধ থেকেই বোধহয় যন্ত্রণা, আকুতি। রাত নামতেই খাবার ঘরে সবাই এলাম। বেশ বড়ো ঘর। খুবই সাজানো গোছানো। সব বোর্ডাররা টেবিল আলো করে বসেছেন।
খাওয়ার সঙ্গে গল্পগুজবও চলছে। খাবার আয়োজন ভালই। খুব একটা দামও নয়। আমরা যে যার পছন্দসই খাবার নিলাম।
আগামীকাল ট্রেন ধরতে হবে, তার আগে টোটোপাড়ায় অবশ্যই যাব সেই কথা ঠিক হল।
শেষপর্বে মশলা চিবোতে চিবোতে ঘরে এলাম। কিছু কাজ সেরে শোবার পালা। দেরী করা চলবে না। বিছানায় শুয়ে পড়ার পর, সারাদিনের শরীরের ক্লান্তিতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম, টের পেলাম না। খুব ভোরে ঘুম ভাঙল।
ঘুম ভাঙতেই মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ফিরতে হবে ঘরে, এই মায়াময় জগৎ ছেড়ে।
সকাল সকাল বেরোতে হবে।
সকালের কাজ সারা হতেই এসে গেলো সেই পছন্দসই চা। গল্প করতে করতে চা পানের পর্ব শেষ হল। কমবেশী সবারই মন খারাপ।
দুপুরে ট্রেন। তাই ঠিক হল হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে হাসিমারা ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে। পথে টোটোপাড়া হয়ে যাব। গাড়ির ড্রাইভারকে আগেই বলা ছিল।
খেয়েদেয়ে গাড়িতে উঠলাম। মনে মনে বললাম 'বিদায় জয়গাঁ, বিদায় আমার প্রিয় ফুন্টশোলিং'।
এখনও পাহাড় দূরে সরে যায়নি। পথে যেতে যেতে প্রকৃতিকে দু'চোখ ভরে অবলোকন করতে লাগলাম। নৈসর্গিক সৌন্দর্য- সে যেন আমার মনপ্রাণকে সর্বদাই আকুল করে তোলে। প্রকৃতির সঙ্গে পরমপুরুষের একটা অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক অনুভূত হয় আমার মনে।
আবার সেই শ্যামলে-সবুজে মেশামেশি আরও এক প্রিয় চা-বাগান। দুটি পাতা একটি কুঁড়ি নিয়ে সেও যেন প্রফুল্ল দৃষ্টিতে
তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।
পথে পড়লো নদী, নানা গাছপালা ঘেরা প্রান্তর লোকালয়। সব বাড়িতে নানারঙের ফুলগাছ।
এখানকার জনমানসের সঙ্গে প্রকৃতিও ওতপোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
এভাবে চলতে চলতে, অন্য এক জনপদের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
বাড়িঘরগুলোকে অসংখ্য গাছপালা বেষ্টন করে রেখেছে। জানলাম এটাই টোটোপাড়া।
এখন প্রায় ৩৪৫/৩৫০ জন বসবাসরত টোটো। এদের স্বভাব খুবই শান্ত। চাষবাস করেন। এখন অনেকেই শিক্ষিত হচ্ছেন। শিক্ষামূলক কাজে নানা অফিসেও যুক্ত রয়েছেন। সরকার এঁদের উন্নতির জন্য খুবই তৎপর।
আরও একটু থেকে এঁদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সময় কম থাকায়
ধীরে ধীরে এই জনপদ ছাড়িয়ে গন্তব্যস্থলের দিকে এগোতে লাগলাম।
এবার হাসিমারার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। আবার সেই প্রিয় দৃশ্য। মনে হচ্ছিল গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে, বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি সবুজের শ্যামলীমাকে।
কবিগুরুর "বলাকা" কবিতা মনে পড়ল --
"----ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,
আধ-মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।"
"চিরযুবা তুই যে চিরজীবী,
জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে
প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি।
সবুজ নেশায় ভোর করেছিস ধরা,---"
এই ক'টা দিন সবুজের নেশার ঘোরে চোখ মেলেছিলাম। কী শান্তির প্রলেপ মাখিয়ে দিয়েছিল পাহাড়, অরণ্য আর নীল আকাশ।
সূর্য ওঠার পর হীরকোজ্জ্বল আলোকচ্ছটা--
ওহ্, এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কোন তুলনাই হয় না।
আমার না হয় অবসরজীবন। কিন্তু অন্য সকলের তো কাজকর্ম রয়েছে। প্রথম যেবার এসেছিলাম, তখন আমি চাকুরিরতা। মনে হয়েছিল, এখানে যদি কেউ চাকুরি দিত
জীবনটাই পাল্টে যেত।
মাঝে মাঝে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি, কেন এতো ভালোলাগা?
গাছপালা, পাহাড় এরা তো কথা বলে না। তবে এদের নীরবতারও একটা ভাষা আছে। সেটা পড়ে নিতে হয়। আবারও সুনির্মল বসুর কবিতা মনে পড়ে গেল।
"সবার আমি ছাত্র "কবিতার মর্মার্থ অনুধাবন করলাম---
"আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর কাছে পাই রে।
পাহাড় শিখায় তাহার সমান
হই যেন ভাই মৌন মহান,
খোলা মাঠের উপদেশে
দিল-খোলা হই তাই রে।"
তাই তো এদের মাঝেই আমার পরম শান্তি। আমার স্বর্গ-সুখ। সব পেছনে রেখে চলছি। ট্রেনের টিকিট কাটা আছে। হঠাৎ মনের কোণে মেঘের আনাগোনা শুরু হল। ফিরতে হবে যে। আবার সেই গতানুগতিক জীবন। তিন/চারটে দিনের সোনালী সঞ্চয় নিয়ে ঘরে ফেরা। সেই সঞ্চয় ভাঙিয়ে বাকীদিন যাপন।
দীঘা ভ্রমণের কিছু স্মৃতি কিছু কথা
সং ঘ মি ত্রা ভ ট্টা চা র্য
টাইম মেশিনের কাঁটাটা পেছনে ঘুরতে ঘুরতে পিছিয়ে গেলো অনেকগুলো বছর। স্মৃতির অতলে ডুব দিতেই দেখতে পেলাম একটা সাদা কালো ছবি ধীরে ধীরে রঙীন হচ্ছে। সেখানে একটি ছ-সাত বছরের মেয়ে বাবার হাত ধরে সমুদ্রসৈকতে হাঁটছে আর বাবাকে প্রশ্ন করছে "আমরা ওই পারে যাবো না?" তার বাবা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে যে ওই পারে যাওয়া যায় না। তার আবার কৌতুহলী জিজ্ঞাস্য "আমাদের বাড়ির কাছে যে গঙ্গা আছে সেখানে তো আমরা নৌকো করে ওপারে যাই।" তার বাবা হেসে বলে "ওটা তো নদী। এটা সাগর।" সেই ছোট্ট শিশুমন প্রথম দেখলো সমুদ্রকে জানলো সমুদ্রকে দেখা যায় স্পর্শ করা যায় কিন্তু তার সীমাকে লঙ্ঘন করা যায় না। কারণ সে অসীম। মনে পড়ে বেড়াতে যাবো বলে সকাল থেকেই আমার সে কি আনন্দ! আমি মা বাবা আর বাবার অফিসের এক কলিগ (কাকু ) মিলে এসপ্ল্যানেড থেকে দীঘাগামী লাক্সারী বাসে করে দীঘা যাওয়া হয়েছিল। সময়টা ছিল শীতকাল। আর মাসটা জানুয়ারী। বাসে করে নানান দৃশ্য দেখতে দেখতে দীঘা রওনা হলাম। দীঘা পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ সন্ধ্যে নেমে গেছিলো। আর বেশ মনে পড়ে আমাদের বাসের হেড লাইটটাও মাঝপথে খারাপ হয়ে গেছিলো। তাই বেশ একটা গা ছম ছমে ভাব আর চিন্তা নিয়েই দীঘা পৌঁছেছিলাম। বাস যতই দীঘার কাছে এগোচ্ছিল ততই সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম। এখনো ভাবলে বেশ নস্টালজিক লাগে। দীঘাতে আমরা একটা সরকারি গেস্ট হাউসে উঠেছিলাম। বাস থেকে নেমে আমরা বেশ ক্লান্ত ছিলাম। আর সকালের পর কিছু খাওয়া হয়নি বলে দীঘা পৌঁছে প্রথমে আমরা গেস্ট হাউসে গিয়ে লাগেজ রেখে তারপর সমুদ্রের ওপরে রাস্তায় ঘর করে অনেক দোকান ছিল খাবারের--- সেখান থেকে চপ মুড়ি কিনে গেস্ট হাউসে গিয়ে একটা মনোরম সন্ধ্যা কাটিয়েছিলাম। তারপর একটু রেস্ট নিয়ে আবার বেরোনো হয়েছিল। শীতের রাতের যে একটা আলাদাই আকর্ষণ আছে তাতে আরও আবেগের মাত্রা বাড়িয়েছিল সমুদ্রের অমোঘ টান। সেই ছিল আমার প্রথম ঝাউবনের সাথে পরিচয়, যা অপূর্ব এক অনুভূতি আজও ভাবলে মনকে নাড়া দিয়ে যায়। সরকারি গেস্ট হাউসে শুধুমাত্র থাকা আর ব্রেকফার্স্ট এর ব্যবস্থা ছিল। লাঞ্চ আর ডিনার আমরা দীঘার নামকরা একটা হোটেলে করতাম। যেহেতু বাবা প্রায়ই দীঘা যেতেন তাই সেই হোটেলের স্টাফরা বাবার খুব চেনা পরিচিত ছিল। সেদিন ক্লান্ত থাকার জন্য আর খুব একটা ঘোরাঘুরি হয়নি। কিন্তু পরের দিন ব্রেকফার্স্ট সেরে শীতের রোদ গায়ে জড়িয়ে আমরা সমুদ্র সৈকতে নেমে পড়লাম। এতো প্রশস্ত সৈকত যে গাড়ি চলছিল। এতো স্বাস্থকর জায়গা ছিল যে আমাদের সবার লাঞ্চ এর সময় খিদে পেয়ে যেত। তিন দিনের ট্যুর ছিল। কিন্তু দিন যে কিভাবে কেটে যেত সেটা বুঝতেই পারিনি। পরের দিন দুপুরে লাঞ্চ সেরে আমি তো কাকুর সাথে সৈকতে এ মাথা ও মাথা ঘুরেছি। বিকেল হলেই সমুদ্র এগিয়ে আসতো। রাস্তার ওপরে চা কফি আরও কত দোকানের পসরা বসত। আমিও বড়দের সাথে পাল্লা দিয়ে আনন্দ করেছি। প্রথম কফির কাপে চুমুক দিয়েছি, আর বিকেলে অবাক চোখে সমুদ্রকে তাকিয়ে দেখেছি। প্রশ্ন করেছি তুমি এগিয়ে এসেছো কেন? কাকে খুঁজছো? আবেগ কল্পনা ভালোলাগা মুগ্ধতা সব জড়ো করে যে বালি দিয়ে ঘরটা বানিয়েছিলাম--- সেটা এখনো স্মৃতির অতলে রয়েছে। যেখানে তাকালে এক একটা ঘরে আমি নিজেকে দেখতে পাই। মা বাবা কাকু সবাইকে দেখতে পাই। যে হোটেলে আমরা খেতাম তার নাম আর মনে নেই। তবে খাবারের স্বাদ ছিল অমৃত। সেটা উড়িয়া ঠাকুরের হাতের গুণ না আমাদের ভালোলাগার অনুভূতি সেটা বলা কঠিন। ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে যখন হাঁটতাম তখন ওই বয়েসেই একটা অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করতো। দিনের শেষে যখন সূর্য অস্ত যেত তখন এক আলাদাই মাদকতা ঘিরে থাকতো আমায়। আর মনে আছে জেলেরা নৌকো নিয়ে মাছ ধরার জাল নিয়ে ঘরে ফিরত। সে এক আলাদা দৃশ্য। যেন ক্লান্ত দেহে ঘরে ফেরা আরেকটা সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়।
ঠাকুরবাড়ীর স্মৃতিকথায়
প্র দী প ব সু
রবি কবিকে শ্রদ্ধা নিবেদন:
তখন আমি সাত আট বছরের, সালটা ছিল ১৯৫৫-৫৬ যত দূর মনে পড়ছে, আমার বাড়িতে বাবা খুবই অল্পতে রেগে যেতেন, কিন্তু ঈশ্বরের প্রতি আস্থা অবিচল, আর সাহিত্যিক ছোট কাকা সংস্কৃতির ধারক, ওনার লেখা বহু গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে, রেডিওতে নাটক হতো শুক্রবার রাত আট ঘটিকায়, কি ভালো লাগতো বেতারে নাটক শুনতে, তখনকার দিনে ভাষ্যকারের সুমিষ্ট ভারী গলায় "আজকের রাত আটটার নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে, লেখা শ্রী রমাপতি বোসের "তপতির তৃষা" বা "দ্বিতীয় বিবর" ও আরো কত জনপ্রিয় লেখা। যাই হোক ঐ সময় ঘরের নারীদের বাইরে বেরোনোর চল ছিল না এখনকার মত।
আগেরদিন রাতের খাবার সময় মা আর কাকিমার কথোপকথন শুনতে পেলাম, আগামীকাল ভোরে উঠে শাশুড়ী মা-র কাছে ঠাকুর বাড়ী যাবে বলে সম্মতি আদায় করার চেষ্টা করবে।
ঠিক তাই আমিও ভোরে উঠে দেখি মা কাকিমা স্নান সেরে রেডি হয়ে গেছে এবং ঠাকুমাকে বলছে "মা আমরা দুই জা মিলে ঠাকুরবাড়ির থেকে ঘুরে আসছি", বেলা বাড়লে ভীড় হবে ফিরতেও দেরী হয়ে যাবে। এসেই দুজনে মিলে রান্না করে নেবো। আমিও কান্না জুড়ে লেজুর হলাম ঠাকুরবাড়ির যাত্রায়। উপায়ান্তর না দেখে অবশেষে আমাকেও একটি ভালো প্যান্ট শার্ট পরিয়ে রওনা হলেন মা কাকিমা, কানে ভেসে এলো ঠাকুমার গলায় দুর্গা দুর্গা, বৌমারা তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবে, নইলে বড় খোকা রাগ করবে। তখন আমরা বাবা-কাকা যৌথ পরিবারে থাকতাম পৈত্রিক বাড়ী সাবেক কলকাতার এন্টালির আনন্দ পালিত রোডে।
পথে বেরিয়ে কাকিমা বললে হাত ছাড়বি না একদম, জানি না কোন কোন বাসে উঠা নামা করে চিৎপুরের ট্রাম লাইনের উপরে একজায়গায় নামলাম।
সামনে দেখি লাল তোরণ, জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ী, ছেলেরা সবাই প্রায় ধুতি পাঞ্জাবী আর মেয়ে বৌয়ের দল লালপাড় সাদা শাড়ি ও লাল টুকটুকে ব্লাউজ পড়েছেন। অল্প কিছু মানুষের ভীড়, তার মধ্যে হাত ধরে কাকিমা ভিতরে ঢুকে এলেন সেই বড় মাঠের সামনে, কি বিশাল বাড়ী অবাক হয়ে দেখছিলাম। সামনেই কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গলায় মালা পরাচ্ছেন কেউ কেউ। সেখানে প্রণাম করেই কাকিমা আর মা দ্রুততার সঙ্গে পায়ে পায়ে এলেন সিঁড়ির সামনে দোতলায় রবি ঠাকুরের ঘরে। অবাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখছি সবকিছুই। কি সুন্দর করে আল্পনা দিয়ে গোল করে মাঝখানে একটি পিতলের ঘড়া জুঁই ফুলের মালা জড়ানো, আর অনেক অনেক রজনীগন্ধা ঘড়ার ভিতরে গোঁজা রয়েছে। ধূপের সুগন্ধি আর ফুলের সুবাসে মন পবিত্র হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে কিছু লোকের ত্র্যস্তপদে এলেন সাথে কাগজের রিপোর্টাররা, ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক করে ওঠা। চোখের উপর বাল্বের আলো ঝলকানি দিলো বার বার। চিনি না কাউকেই। শুনলাম আমার পাশে যিনি মাল্যদান করছিলেন তিনি নাকি রাজ্যপাল শ্রী হরেন কুমার মুখার্জী, পাশে মুখ্যমন্ত্রী শ্রীযুক্ত বিধান চন্দ্র রায়, মা কাকিমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন ওনারা। গোলকরে সবাই দাঁড়িয়ে প্রণাম সেরে বেরিয়ে গেলেন। ঐ সময় আমি লম্বায় যা সাইজ প্রায় তার থেকে ও বড় গোলাকার জায়গা ফুলের তোড়া মালা ভরিয়ে তুলে ছিলো, অতো সুন্দর আলপনা চাপা পড়ে গেলো জুঁই রজনীগন্ধা সূর্য্যমুখীর তলায়, পাশে সুগন্ধি ধূপের সুবাসে মন মাতাল যখন, তখনই আমার হাতে হ্যাঁচকা টান মেরে কাকিমার দ্রুতপদে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামা, ভীড় ঠেলে পিছনে মা প্রায় দৌড়াচ্ছে।
লাল বিশাল বাড়ী আর সবুজ খিড়কি দেওয়া অপরূপ সুন্দর ঠাকুরবাড়ির থেকে ফিরে এলাম আগের সেই লাল তোরণের নীচে রাস্তায় বাস স্টপে। দুই জা'য়ের স্বাধীনতায় জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ী দর্শনের জয়, কতই না হাসিমাখা উল্লাস দেখলাম প্রাণভরে সারাটা ফিরতি পথে। বাড়ীর সামনে এসে শুনলাম দুই জা ফন্দি করছে আর বলছে আমাকে বলবি "ঠাকুর বাড়ী ঘুরে এলাম, একদম বলবি না রবিঠাকুরের বাড়ী, না বললে বিকেলে উপেনের এক পয়সা ঘুগনি কিনে দেবো"। আমিও মুখে হাতচাপা দিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে সায় দিয়ে বললাম কাউকে কিচ্ছু বলবো না উপেনের এক পয়সার ঘুগনি দিলে।
বাড়ী ফিরে হাতে হাত দিয়ে সংসারের কাজ করছিল মা কাকিমা। ঠাকুমা হেঁশেলের কাছে আসতেই ঠাকুর ঘরের প্রসাদ থেকে গুঁজিয়া দিলো হাতে। ঠাকুমা কপালে ছুঁইয়ে মুখে পুরে দিয়ে বললো, ঠাকুরবাড়ী খুব ভীড় ছিল না কি বৌমা? চটপট কাকিমার উত্তর "না তেমন কিছু না তাইতো দশটার আগে ফিরতে পেরেছি", বলেই পিছন ফিরে মুখ ঘুরিয়ে মায়ের দিকে মুচকি হাসি। আমিও মুখে কুলুপ এঁটে চুপচাপ ছিলাম উপেনের ঘুগনির লোভে।
পরের দিন বাজার ফেরত ছোট কাকা সকালে আনন্দবাজার পত্রিকা আর যুগান্তর পত্রিকা হাতে করে ঠাকুমার কাছে চা খেতে খেতে বললে " মা তোমার দুই বৌমা দেখছি খুবই ঠাকুরের ভক্তি ", ঠাকুমা বললে হুম কালকেই তো ভোর ভোর উঠে দুজনে মিলে ছোটনাতির হাত ধরে ঘুরে আসলো ঠাকুরবাড়ী। কেন রে কি হয়েছে বল ??? ছোটকাকা আর বাবা কাগজ হাতে হাসছিলো। ঠাকুমা বললে কি রে তোদের হাসির কি হয়েছে ??? তখন হাতের কাগজের প্রথম পাতায় বড় বড় করে ছবি কাকিমা আর মায়ের কোলের কাছে আমি, পাশে মুখ্যমন্ত্রী শ্রীযুক্ত বিধান চন্দ্র রায় ও আরেকদিকে রাজ্যপাল শ্রী হরেন কুমার মুখার্জী। বাবা বললো ঠাকুমাকে দেখো এরা এতো ঠাকুরের ভক্ত যে খবরের কাগজে প্রথম পাতায় ছবি বেরিয়েছে। ঠাকুমা নাকে চশমা এঁটে বললো দেখি দেখি বৌমাদের ছবি। ছবি দেখে ঠাকুমা আপ্লুত হয়ে পড়লো আর বললে দেখ দেখ খোকারা আমার দুই বৌমাই পাড়ার মধ্যে জিনিয়াস, অন্য কারোর তো ছবি বের হয় না রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রীর সাথে।
তাই বৌমাদের সাত কেন সত্তর গুণ ক্ষমা করে দিলাম। তবে ওরা একটি গুঁজিয়া দিয়ে ভালোই ম্যানেজ করেছিল গতকাল সুগারের শাশুড়ী মাকে। শোন তোদের বলছি বেশ অনেকটা বড় করে ছবি দুইখান বাঁধিয়ে কালকেই আনবি অফিস থেকে ফেরার পথে। বাইরের দালানে পাড়ার সবাই এসে দেখবে আমার দুই বৌমার ছবি রাজ্যপাল আর মুখ্যমন্ত্রীর সাথে। আমার কথার অন্যথা হয় না যেন এই আমি বলে রাখলাম।
আজও আমার পৈত্রিক বাড়িতে ৬৭ বছর আগের সেই বাঁধানো ছবি মলিন হয়েই হয়তো আছে।
কিন্তু আমার স্মৃতিতে প্রথম দেখা রবি ঠাকুরের বাড়ি আজও অমলিন।।
(রবি কবির জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমার এই লেখা)
তোমাকে শত সহস্র কোটি প্রনাম....
টাইম মেশিনে করে পিছিয়ে দিলাম মন
লেখনীতে ভর করে ছেপে দিলাম এখন।
রবি কবির বাড়ী দেখা সেই শৈশবে,
বর্তমানে মা কাকিমারা আর যায় না ঐ উৎসবে।
গল্প লিখতে না পারার গল্প
রু মা না সো ব হা ন প রা গ
আজকে বহুদিন যাবৎ লেখার কোনো তাগিদ অনুভব করছিনা। মনে হচ্ছে লেখার মনটা আমার হারিয়ে গ্যাছে। বহুদিন তার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই আমার। তার জায়গায় এক ভীত গৃহী মন আমায় দখল করে নিয়েছে। এ আমার মাঝে এক অন্য আরেক আমাকে দেখছি আমি। এই দুই চোখে আগে যা ধরা পরেনি এখন তাই এসে ধরা দিচ্ছে।
হঠাৎই য্যানো জীবনের প্রতি ভীষণ মায়া বেড়েছে। বড্ড বেশি লোভী মনে হয় নিজেকে। বেঁচে থাকার বাইরে আর কিছুই ভাবতে পারছিনা এখন আর।
অথচ একসময় আমি মুখিয়ে ছিলাম জীবনের পরের জীবনের সাথে মুখোমুখি হবার জন্য। মৃত্যুর প্রতি এই অকারণ আকর্ষণ বোধ যে জীবনের প্রতি কোনো ঘৃণা থেকে এসেছিল তা কিন্তু নয়। এটা একটা বোধ যা সবসময়ে আমাকে জানাতো যে এ যাত্রা আমার সাময়িক। কোনো কিছুই এখানে চিরস্থায়ী না। যে কোনো সময়ই থেমে যেতে পারে আমার এই পথ চলা। এই ভাবনাই আমাকে নিরাসক্ত করেছিল জীবনের প্রতি।
অথচ এখন প্রতি মুহূর্তে প্রার্থনায় পরিবারের সকলের দীর্ঘ জীবন কামনা করছি। শুধু জীবনটাকেই উপভোগ করতে চাইছি। একসময় যার অস্তিত্ব নিয়ে আমি সন্দিহান ছিলাম, যার অস্তিত্বকে কখনও আমি স্বীকার করিনি সেই আমিই আজ তার কাছেই কিনা নিজেকে সমর্পণ করছি! সেই এক ঈশ্বর; যার কাছ থেকে এসেই তার কাছেই যে প্রত্যাবর্তিত হবো আমরা।
নিজেকে মেলাতে বড় কষ্ট হয় আমার। এই আমি কি সেই আমি যে একসময় বিশ্বাস করতাম ধর্ম টর্ম বলে কিছু নেই। এ শুধু এক জীবনাচার মাত্র। আমি তো খোদ ঐ হিন্দু বা খ্রিষ্টানের মতোই দেখতে! আমার শরীরের কোথাও তো কোনো ধর্মের চিহ্ন নিয়ে আমি জন্মাইনি। আমার এই যে শরীরের কোনো কিছুই তো আমি না; না আমার ধর্মের প্রপার্টি। তাহলে ধর্মের লেবাস কেন আমায় পরতে হবে? সদাচারনই তো মানুষের একমাত্র ধর্ম হওয়া উচিৎ।
একসময় আমি বিশ্বাস করেছি আমিই আমার একমাত্র মালিক; যে এই দেহের মাধ্যমে এই পৃথিবী ভ্রমণে এসেছি। এসেছি লিঙ্গীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষ হিসেবে জীবনটাকে দেখতে।
কিন্তু এখন আমি তাঁকে স্মরণ করি। যে নামেই তাঁকে ডাকি না কেন তিনি মিশে আছেন আমার প্রতিটা শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে। তাঁকে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বা নির্দিষ্ট কোনো স্থানে বসে স্মরণ করবার জন্য শিকেয় তুলে রাখিনা আমি। এই দেহে আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ তিনিও মিশে আছেন। যার কাছ থেকে এসেছি তাঁর কাছেই সমর্পিত হবো; এটাই এখন মনে প্রানে বিশ্বাস করি আমি।
আমি এগুলো কেন ভাবছি! হঠাৎ কি ঘটলো যে আমার এতোদিনের জীবন বোধ পাল্টে গেল! আচ্ছা আমার মনটা কি খুবই খারাপ! না তো। তাহলে লিখতে পারছিনা কেন? লেখার মতো বহু ঘটনা তো আমার চোখের সামনে হুটোপুটি খাচ্ছে অথচ আমার লিখতে ইচ্ছা করছেনা!
বেশ কিছুদিন আগের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমি চাইলেই তো একটা ভীষণ রোমান্টিক পরকীয়া প্রেমের গল্প লিখতে পারতাম। যেখানে একজন অভিনেত্রী যে কিনা ভয়ানক ভাবে স্নেহের কাঙাল ছিল। যে বার বার বিভিন্ন পুরুষের কাছে গেছে একটু ভালোবাসা পাবার জন্য অথচ সবাই তার মনটাকে নয় বরং শরীরটাকেই ভালোবেসেছিল। অবশেষে একজন চৌকস বিবাহিত পুলিশ অফিসারের প্রেমে পড়ে সেই অভিনেত্রী। তাদের মাঝে এক স্বর্গীয় সম্পর্ক যখন তৈরী হয় তখনই বাধ সাধে রাষ্ট্রযন্ত্র!
আমি এই একটা রোমান্টিক পরকীয়া প্রেমের গল্পের মধ্যে দিয়ে একটা দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারসাম্যহীনতা, সামাজিক অবক্ষয়, নারীর প্রতি সহিংসতার একটা সুস্পষ্ট চিত্র তুলে ধরতে পারতাম। কিন্তু হঠাৎ আমার কি হলো যে মনটা আর লিখতে চাইছে না।
ঠিক আছে প্রেমের গল্প বাদ। একটা কষ্টের গল্পও তো লিখতে পারতাম। গত সপ্তাহে টাঙ্গাইলের কান্দাপাড়া পতিতালয়ে যে অষ্টাদশী যৌনকর্মীটি আত্মহত্যা করেছিল; তার জীবনের উপর ভিত্তি করে।
খবরে দেখলাম মেয়েটা পতিতালয়ের ছোট্ট একটা ঘরে ভাড়া থাকতো। একটা চৌকির উপর একটা পাতলা তোষক আর দুটো তেলচিটচিটে বালিস। জামা কাপড় গুলো চৌকির পাশে রাখা আলনায় থরে থরে সাজানো। মেয়েটার গোলাপি রং বোধহয় প্রিয় ছিল। বিছানার চাদর, দেয়ালের রং, আলনায় ঝুলিয়ে রাখা কাপড় গুলোর বেশীরভাগই গোলাপি রংয়ের। চৌকির নীচে কিছু থালা বাসন আর আনাজপাতি রাখা। যেদিন মেয়েটি বাজার করেছিল সেদিনও হয়তো তার মনে মৃত্যু ভাবনাটা তেমন ভাবে আসেনি। কিংবা এসেছিল। জীবনটা তার কাছে হয়তো বহু আগে থেকেই বোঝা মনে হয়েছিল। শুধু পরিবারের অন্য সকলের আহার যোগাড়ের কথা ভেবে আত্মহত্যার পথকে সে বেছে নেয়নি।
তাহলে হঠাৎ কি হলো যে মেয়েটি আত্মহত্যা করল? এমনও হতে পারে, বেঁচে থাকার একমাত্র পুঁজি হিসেবে সে নিজের দেহটাকে ব্যবহার করেছে কিন্তু দিনের পর দিন পুরুষের বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্ত হতে না পেরে মৃত্যুতেই বেঁচে থাকার অমিয় সুধা পেতে বিষ পানে আত্মহত্যা করল সে।
এমনও হতে পারে মেয়েটি এতো সব অনাচার সহ্য করেছিল শুধু একটি বিশ্বস্ত কাঁধে মুখ গুঁজে সারারাত পার করবে বলে। কিন্তু সেখানেও স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল বলে হয়তো মেয়েটির বেঁচে থাকার প্রতি অনাগ্রহ তৈরী করেছিল।
এই মেয়েটির দুঃখ বেচেও তো আমি লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু কি এমন বিষাদ আমায় ছেয়ে ধরল যে আমি গল্প লেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম!
হতে পারে আমি হয়তো ভয় পেয়েছি সমানাধিকারের মোড়কে মোড়ানো এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় শত শত তাজা প্রান; যাদের বেশিরভাগই অপঘাতে কিম্বা রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রান হারাচ্ছে। হয়তো আমিও অনুধাবন করতে পেরেছি প্রকৃতির বিরুদ্ধে বা অন্য কোনো শক্তির বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচারণ করে টিঁকে থাকার জন্য আমার মতো ক্ষুদ্র জীবের ক্ষমতা অতি সামান্য।
যদিও জানি একদিন না একদিন মহাকালের অনন্ত যাত্রা পথে যেতে হবে আমাদের সবাইকে তবুও মনটা আমার প্রিয়জনদের আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় অনন্তকাল এই মায়ার ভুবনে। স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের বলয়কে নিয়েই বাঁচতে চাইছি আমি। কার কি হলো কিংবা কে রসাতলে গেল তা আমাকে ভাবায় না আর। জীবনের পরের জীবনের সাথে এখনই নয় বরং বহু কাল পর দেখা করতে চাই। সেই মহাকালের অনন্ত যাত্রায় যেন প্রিয়জনের অশ্রুতে সিক্ত হয়ে যেতে পারি আমি, কথাগুলো হড়বড় করে বললেন ফারহা তার সাইকোথেরাপিস্টের কাছে।
সাইকোথেরাপিস্ট তাকে কোনো প্রশ্ন না করে শুধু বললেন আপনার মতো আমিও এখন নির্ঝঞ্ঝাট নির্বিবাদী জীবন ছাড়া আর কিচ্ছু চাইনা সৃষ্টিকর্তার কাছে।
এই শহর ঘিরে
ই মা ম মে হে দী আ শ ফী
মুন্সীগঞ্জ, ধলেশ্বরী, পদ্মা, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা সহ শত নদী বয়ে চলেছে এই ছোট্ট জেলাকে ঘিরে। আমার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা সবই এই শহরকে ঘিরে। এই শহরের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে আমার জীবন বোনার প্রতিটা গল্প, আমার জীবনের প্রতিটা উত্থান পতনের সাক্ষী এই শহর। জানতাম একদিন ছেড়ে চলে যেতে হবে কিন্তু কখনো ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারিনি। জানতাম না, কিভাবে থাকতে হয় পরিবার ছাড়া, জানতাম না কিভাবে বাঁচতে হয় বন্ধুদের ছাড়া। কিন্তু স্বপ্ন যে দেখেছি আকাশ ছোঁয়ার। সেই স্বপ্ন তো জয় করতেই হবে। আমাদের প্রথম গন্তব্য কলকাতা। আমি অনেক করে চেয়েছিলাম পুরো রাস্তা ট্রেনে যেতে। দুঃখজনকভাবে যাওয়ার দিন ঢাকাতে চলছিলো আন্দোলন । টিকিট কাটা সত্ত্বেও ঢাকা যাওয়ার সাহস পেলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম মাওয়া গিয়ে বেনাপোলের বাসে উঠবো। সেখানে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করা সত্ত্বেও বাস পেলাম না ভালো। শেষে লোকাল বাসে উঠে ভেঙে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তারপর সেখানে প্রায় ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর বাস পেলাম। যাত্রার এই অংশটুকু একটু সুস্থির ছিলো। তারপর তেমন কোন ঝামেলা ছাড়াই বেনাপোল- পেট্রোপোল border দিয়ে ভারতে প্রবেশ করলাম। সেখান থেকে রেলস্টেশনে, তারপর ভারতে আমার প্রথম ট্রেনযাত্রা। থাকলাম বিমান বন্দরের পাশে একটি হোটেলে। পরদিন বের হলাম কোলকাতা শহরের উদ্দেশে।
কলকাতা শহরে এটাই আমার প্রথমবার। এখনো পর্যন্ত আমার শহরটাকে বেশ গুছানো মনে হলো। মানুষ-জন ট্রাফিক আইন মেনে চলে। ট্রাফিক লাইটগুলোও বেশ সচল। বাস শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় থামে। ভাড়াও বেশ অল্প। খাবারের দামও বেশী নয়, মানও ভালো। রাস্তাঘাট বেশ প্রশস্ত। ধর্মতলার ঐদিকে আর্কিটেক্টচার বেশ সুন্দর। ইংরেজ আমলের একটা ছোঁয়া আছে। রাস্তায় ঢাকার তুলনায় ধুলোবালি অনেক কম। কিছু বাসে মেয়েদের জন্য আলাদা সিট আছে এবং সেটা মেনে চলে মানুষ। এই শহরের vibe ই অন্যরকম। এক কথায় কিছু জিনিস বাদে সবই ভালো লেগেছে। কলকাতা সুন্দর
আমার এই ছোট্ট জীবনে আমি অনেক শহরই দেখেছি। BUT Kolakata is unlike any other city I’ve ever seen। সময় পেলে আলাদা ভিডিও বানাবো কলকাতার কোন এক দুর্গা পূজার উৎসবে।
তারপরের যাত্রার গল্পটা নিতান্তই সাধারণ। কোলকাতায় হলুদ ট্যাক্সি তে ওঠা। A simple Journey by plane. কিন্তু জার্নিটা আমার কাছে মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল আমি আমার জন্মস্থান থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে চলে যাচ্ছি।তিন ঘণ্টার ব্যবধানে পোঁছে গেলাম চণ্ডীগড়। কিন্তু এইখানে এসে আর কিছুই পরিচিত লাগছিলো না। মনে হচ্ছিলো না ভারতে আছি। এই শহরটা french Architect দ্বারা নির্মিত। এতো গুছানো শহর আগে দেখিনি আমি। এই শহরে নেওয়া প্রতিটা নিঃশ্বাস যেন আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে This is going to be your home for the next couple of years। ভয়কে আমি বাংলাদেশেই রেখে এসেছি কিন্তু আবেগ? সেটা এখন আমাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছে আজ থেকে আর তোর মায়ের হাতের খাবার হবে না। তোর বারান্দায় বসে আর আকাশ দেখা হবে না। ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে আমি পরিচিত হতে লাগলাম আমার নতুন ঠিকানার সাথে। মনকে বুঝাতে লাগলাম “একই আকাশের নীচেইতো আছি হোকনা অন্য শহর।
But Munshiganj
So close yet too far. Close to my heart far from my hostel.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন