স্মৃতি কথা

মা আমার মা

ছ ন্দা দা ম

আমরা সেই জেনারশনের নই যখন মাকে মাদার'স্ ডে শুভেচ্ছা জানানো হতো। মায়ের জন্মদিনে কেক কাটানো হতো। কিন্তু মায়ের ভালোবাসা আমাদের বুকটা জুড়ে থাকতো। আমাদের মুখের কালো ছায়া দেখে বুঝতে পারতেন কষ্টটা কোথায়, কখনো রাগ করে কিছু বলে দিলেও একটু পরে এসে আবার জিজ্ঞের করতেন কি হয়েছে।
 
ক্ষুদ্র রোজগারের টাকায় সাধারণ একটা সুতির শাড়ি এনে দিলে বলতেন, 'কি দরকার ছিল পয়সা নষ্ট করার।' কিন্তু লুকিয়ে শাড়িটাই গায়ে দিয়ে খুশিতে মুখটা ভরে যেত। তার জন্য কোন প্রিয় খাবার কিনে আনলে প্রথমেই বলতেন, 'তোদের জন্য কি এনেছিস?' যেই মাকে কোনদিন জড়িয়ে ধরিনি কোন বিশেষ দিনে কোন গভীর আবেগ প্রকাশ করিনি সেই মা ছাড়া তবু চলতো না একমুহূর্ত। মা-ই ছিলেন গুগুল, ইউটিউব, ফেইসবুক--- সব জ্ঞান সব মনোরঞ্জনের পীঠস্থান। উনি ছিলেন সন্তানের জন্য সমর্পিত প্রাণ। আজকাল আমরা নিজের জন্য স্পেস খুঁজি, কিন্তু কোন দিন মাকে বলতে শুনি নি "আমাকে একটু একা থাকতে দে।"
 
মায়ের সারাদিনের পরিশ্রমের পর ঐ বিছানায় মায়ের সাথে গাদাগাদি করে বোনেরা শুয়ে থেকেছি। কাজে দেরি হলে জানতাম মা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন, কোন দুঃস্বপ্নে রাতে কেঁদে উঠলে মুহুর্তে দৌড়ে আসতেন। নিজে অসুস্থ হলেও আমাদের কোন কিছুতে অভাব হতো না। জীবনের প্রতিটি ব্যাথা বেদনাকে যেন শুষে নিতেন ব্লটিং পেপারের মতো।

আসলে মা কোন সম্পর্ক নয়, মা হলেন আমাদের হৃদয়, আমাদের প্রাণ, সম্পূর্ণ অস্তিত্ব। নিজের অস্তিত্বের জয়গানের কোন দিন লাগে না। তবু আজকের এই দিনটি থাকায় আমাদের হৃদয়ে মায়ের প্রতি থাকা ছড়ানো ছিটানো অনুভূতি গুলোকে একত্র করে প্রকাশ করতে পারছি।
 
অনেক কিছুই করার স্বপ্ন ছিল মায়ের জন্য, কিছুই করতে পারিনি। আসলে মায়েদের ঋণ কখনো শোধ করা যায় না।আজকের এই দিনে প্রতিটা মাকে স্যালুট জানাই যাদের কাছ থেকে আমি প্রতি মুহূর্ত শিখি। সন্তান সবসময়ই মায়ের কাছে শিশু।।মায়েরা ছাড়া এই পৃথিবীটাই প্রাণ-হীন।





স্মৃতির ঘরে জলতরঙ্গ

কৌ শি কী 

বছর দেড়েক পর আবার রাইপুর। "রাইপুর" কি, কেনো, কি বৃত্তান্ত, কোথায়? বুঝেছি- অনেক, অনেক প্রশ্ন। করছি করছি সব খোলসা করছি। বোলপুর শান্তিনিকেতন থেকে মাইল পাঁচেক দূরে অজয় নদীর ধারের একটা গ্রাম রাইপুর।
গ্রাম বাংলার সাধারণ গ্রামগুলোর তুলনায় রাইপুরকে সমৃদ্ধ গ্রাম বলা যায়। এখানে প্রায় শত বছরের পুরনো একটা উচ্চ বিদ্যালয়, একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়, গ্রামীন ব্যাঙ্ক, ভারত সেবাশ্রম, একটা ছোটো অনাথ আশ্রম, ছোটোদের একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আছে। আর আছে গ্রামের একদিক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সিংহ রাজবাড়ীর ভগ্নাবশেষ। রাইপুরের সমৃদ্ধির পেছনে এই জমিদার বাড়ি। এই সিংহরাই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শান্তিনিকেতনের জমি দান করেছিলেন। তবে এ লেখা সিংহ বাড়ির মহিমা, বা রাইপুরের সমৃদ্ধির ইতিহাস নয়। এ লেখা নিতান্তই আমার নিজস্ব কিছু অনুভূতির মানচিত্র। তবে কিছু কিছু লেখায় কিছু গৌরচন্দ্রিকার প্রয়োজন হয়, এক্ষেত্রেও তাই। এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরি। এটা আমার গ্রাম। না, এ গ্রামে আমার জন্ম, কর্ম কোনটাই নয়। আমার বাবারও নয়, আমার দাদু পড়াশুনো করতে গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন। সেই থেকে আমারা কলকাতাবাসী।কিন্তু ঐ যে বলে নাড়ির টান, সেই টানে আমার দাদু ঘুরে ঘুরে এসেছেন, কাজ কর্মের ব্যস্ততার মাঝে কিছু ছুটি জোগাড় করে কাটিয়ে গেছেন গ্রামে। গ্রামের কারুর কোনো প্রয়োজনে দ্বার অবারিত রেখেছেন কলকাতার ছোট্ট বাসার।

বাবা, কাকা রাইপুর, কলকাতার সেই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের অনুভূতি নিয়েই বড়ো হয়েছে। তাই তারাও কর্মব্যস্ততার মাঝে কিছু বিরতি খুঁজে গ্রামে কাটিয়ে যেতো। আরো একটা কারণ ছিলো এ গ্রামের সঙ্গে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক থেকে যাওয়ার। তা হলো আমাদের বাড়ির সাবেকি দুর্গাপূজা। আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন কলকাতার ভূ কৈলাস বর্তমান খিদিরপুরের বাসিন্দা। আমাদের বাড়ি ছিলো পন্ডিতদের বাড়ি, কোনো সূত্রে রাইপুরের জমিদারদের কানে এই পন্ডিতদের কথা পৌঁছয়, তাঁরাই টোলের পন্ডিত করে তাঁদের জমি, বাড়ি দিয়ে রাইপুরে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই মোটামুটি ইতিহাস।

এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। ক্রমশ জ্ঞাতিগুষ্টি বিভিন্ন শাখায় ভাগ হয়েছে।
তবু দুর্গাপূজার সময় গুষ্টির সবচেয়ে যিনি বড়ো বহুবছর তিনিই দায়িত্ব নিয়ে পূজো চালিয়েছেন। অন্যরা তার কথামত যে যতটা পেরেছে আর্থিক অনুদান বা কায়িক শ্রম দিয়েছে। এই নিয়মে আমরা ছোটো থেকে আমার দাদুকেই দায়িত্ব নিয়ে পূজোর কাজ করতে দেখেছি।

জীবনের প্রথম বারো তেরো বছর আমি কলকাতায় কোনো দুর্গাপুজোই কাটাইনি, প্রতিবারই দুর্গাপুজোয় রাইপুর চলে যেতাম, মহালয়া থেকে দিন গুনতে শুরু করতাম যাওয়ার দিনের। সেই দুর্গাপূজার সময়ের অনুভূতি যে কি অপূর্ব...!! আমাদের বাড়িটা ছিলো দোতলা মাটির বাড়ি, খড়ের চাল, ছোটো ছোটো জানলা পাশাপাশি দুটো টানা লম্বা ঘর, এরই একটা লম্বা ঘরে, পরপর বিছানা পাতা হতো আমাদের, পিসিদের, কাকাদের, শুয়ে শুয়ে এদিক ওদিক টুকটাক গল্প চলতো। আমরা শহরের আলো, পাখার স্বাচ্ছন্দ্যে অভ্যস্ত ছিলাম। গ্রামে তখন বিজলীবাতি ছিলো না। অথচ একটুও অসুবিধা বোধ হতো না।সকালে আলোর পাট ভাঙা ভোরে ঘুম ভাঙতো, ঘরের পায়ের দিকের জানলায় চোখ চলে যেতো। একটা অদ্ভুত শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধে সমস্ত ঘরটা ভরে থাকতো, কত রকম পাখির মিশ্র ডাক....!! অত সকালে উঠেও কিন্তু মা, কাকী, পিসিদের পাশে দেখতে পেতাম না, তারা তখন চান শেষ করে পুজোর নৈবেদ্য সাজানোর কাজে লেগে গেছে। আরো জ্ঞাতি কাকী জেঠিরাও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতেন। নীচ থেকে তখন মৃদু কথা, হাসি তামাশার শব্দ আসতো। এগারোটা সাড়ে এগারোটায় জলখাবার মুড়ি, বোঁদে, একটা লাবড়া। বাড়ির রান্নার দিকটা ঠাকুমা সামলাতেন, তাই ছোটোদের জলখাবারের পাট অনেক আগেই শেষ হয়ে যেতো।তবু আমরাও সকলের সঙ্গে একবার পাতে বসতাম। কত লোক যে খেতে আসতো তার ইয়ত্তা নেই। আবার দুটো আড়াইটেয় দুপুরের খাবারের লাইন বসতো। খুব সামান্য নিরামিষ খাবার তাই মানুষজন কত তৃপ্তির সঙ্গে খেতো। বাড়ির জ্ঞাতি দাদা, কাকারাই পরিবেশন করতো।

ক্রমশ সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পূজোর পরিবর্তন হলো। দাদু, ঠাকুমা চলে যাবার পর, পুজোর রাশ একজনের হাতে থাকবে সে বিষয়টা শেষ হয়ে গেলো। চারজন জ্ঞাতির মধ্যে পুজোর পালা ভাগ হয়ে গেলো, যার যে বছর পুজো সেইই পুরো দায়িত্ব পালন করতো। পূজোর জৌলুশ কমতে শুরু করলো।লোক খাওয়ানোর ধুমও ক্রমশ কমতে লাগলো।

এখন গ্রামে যারা থাকেন তারাই দায়িত্ব নিয়ে পূজোটা মোটামুটি চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা লোকবলের অভাবে আমাদের পালায়, টাকা দিয়ে দায়িত্ব ছাড়ছি।

আটানব্বই সালের বন্যায় আমাদের মাটির বাড়ি ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। বাবা, কাকা পরে পাশাপাশি দুটো ছোটো ছোটো বাড়ি করেন। কিন্তু আমাদের শহুরে ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে দেখাশোনার অভাবে সে বাড়িদুটোরও জীর্ণ দশা। তবু আমার টানে আমি যতটা পারি দেখে রাখার চেষ্টা করি। সেই দেখাশোনার পরিমাণ হলো দেড়বছর পর একদিন সময় বের করে যাওয়া। প্রবল গরমে সারাদিন অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম, সন্ধ্যের আগে আগে মেঘ জমলো, সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ বৃষ্টি শুরু হলো, সঙ্গে লোডশেডিং, তার মধ্যেই কোনোক্রমে রান্না, খাওয়া। সারাদিনের গরম ক্লান্তির পর ঠান্ডা জলো হাওয়া, শরীরে যেনো ঘুমপাড়ানি গান গাইছিলো। মিনিট পনেরোর মধ্যে পাশের ঘরে মা, আর আমার পাশে মেয়ে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেলো। আমি টুকটাক ফোন দেখে যখন শুলাম তখন মাঝে মাঝে বাজের, গর্জন আর বারান্দায় টিনের চালে বৃষ্টির জলতরঙ্গে চারদিকে ভরে আছে।কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম যখন বুঝলাম আমার ঘুম বিদায় নিয়েছে, তার বদলে আমি নিজের অজান্তে পেছনের দিকে হেঁটে চলেছি।

কেমন করে প্রায় একবেলা ট্রেন জার্ণি করে বোলপুরে এসে পৌঁছতাম, তারপর রিক্সায় প্রচুর লটবহর চাপিয়ে ঘুনুর ঘুনুর করে প্রায় ঘন্টাখানেক কি তারও বেশি সময় ধরে বোলপুর থেকে রাইপুরের যাত্রাটুকু শেষ করতাম।দালানে পা রাখতে রাখতে কতজন ছুটে আসতো আমাদের অভ্যর্থনায়, আজকাল দালান পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছেই, চারদিক শুনশান। দোলা, যমুনা আমার গ্রামের বন্ধুরা আজ কে কোথায়?কতবছর হয়ে গেছে মুখগুলো স্মৃতির পাতায়ও ঝাপসা। আমাদের চিরপরিচিত সহযোগী, অতীকদা, রেখাদি আমাদের বাড়ির লাগোয়া জ্ঞাতি জ্যাঠতুতো দাদা, দিদিরা অনেকেই সময়ের আগে পৌঁছে গেছে নক্ষত্রলোকে।

পুজোর বিসর্জনের দিন সকালে সকলে মিলে অজয় নদীতে যাওয়া অপরাজিতার মালা ভাসানো, রাতে নাচতে নাচতে ঠাকুর বিসর্জনে যাওয়া--- বড়ো বড়ো হ্যাজাকের আলোয় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা সিংহবাড়ির দেওয়ালে ফুটে ওঠা ছায়ার আলপনা... সবই যেন বড়ো জীবন্ত হয়ে উঠছে এই ঘন বৃষ্টির রাতে। মাথার এক একটা প্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসছে এক একটা ছবি। মনের কোণগুলো হারানোর ব্যথায় টনটন করে উঠছে, এ জীবনের কতো গল্প... সবই হারিয়ে গেছে একরাশ শূন্যতা ছড়িয়ে।






সেই রাতে

সু নৃ তা রা য় চৌ ধু রী

এমন একটা ঘটনা, চার দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও তার কথা মনে পড়লে শিউরে উঠি। আমি তখনও টিন এজার, সবে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছি। আমরা তো বর্ধমানে থাকতাম। আমার দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে অনেক আগেই, বড়দি কলকাতায় আর ছোড়দি দুর্গাপুরে। আমাদের বাড়ির পরে তখন বেশ কয়েকটি খালি জমি, বিক্রি হয়ে গেছে, কিন্তু বাড়িঘর কিছু ওঠেনি। ফলে জায়গাটা ঝোপ জঙ্গলে ভরা আর নিকষ অন্ধকার। বাড়িতে তখন বাবা, মা, দুই দাদা আর আমি।

সে বার কালী পূজার দুই দিন পরে ভাই ফোঁটা। ঠিক হয়েছিল বড়দা যাবে ফোঁটা নিতে ছোড়দির কাছে, আর আমি ও ছোড়দা কলকাতায় আসবো বড়দির বাড়িতে। এদিকে আমার মামা, মাসীকে নিয়ে আসবেন মায়ের হাতে ফোঁটা নিতে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী বড়দা চলে গেছে দুর্গাপুরে। পাড়ার কালী পূজা শেষ হয়ে গেলেও প্রতিমা বিসর্জন হয়নি বলে ছোড়দা সেখানে ব্যস্ত। আমি আর বাবা মা আছি। পরদিন কলকাতা যাব, মনে খুব স্ফূর্তি। একটা ছোট্ট স্যুটকেসে আমাদের জামা কাপড় গোছানো হয়ে গেছে। সবে পুজো শেষ হয়েছে, তাই নতুন জামা আর দিদির উপহারের জন্য নতুন শাড়ি। মা ভাইফোঁটার জন্য ঘরে মিষ্টি বানাচ্ছেন আর আমি বসে বসে দেখছি, মাকে টুকটাক সাহায্য করছি আর বাবা বর্ধমানের কুখ্যাত মশার ভয়ে মশারীর মধ্যে শুয়ে রেডিওতে খবর ইত্যাদি কিছু শুনছেন। মায়ের কাজ শেষ হয়েছে, এবার রাতের খাবার ব্যবস্থা করা হবে, আমরা তখন টেবিল চেয়ারে না, রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে বসে কাঁসার থালায় ভাত খেতাম। 

 আমি রান্নাঘর ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে থালা বাটি ধুয়ে রেখে গ্লাসে জল ভরতে ভরতে তাকিয়ে দেখি, রান্নাঘরের পিছনের দরজা দিয়ে মুশকো চেহারার জনা দশেক লোক ঘরে ঢুকে আসছে। সামনের জনের হাতে বন্দুক, তার পেছনে যারা, তাদের সবার হাতে ছুরি, ছোরা, ভোজালী ইত্যাদি ধারালো অস্ত্র। আচমকা এমন দৃশ্যে স্তম্ভিত হয়ে ভাবছি আমি স্বপ্ন দেখছি কিনা! তারা মুহূর্তে মা আর আমাকে ঘিরে ধরলো, মায়ের হাতে কয়েক গাছা সোনার চুড়ি ছিল, একটা যন্ত্র দিয়ে কটাং কটাং করে কেটে নিয়ে নিলো, আর কয়েক জন বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করছে, ”আলমারির চাবি কোথায়?” অন্ধকার ঘরে বাবাও কিছু দেখতে না পেয়ে কেমন হকচকিয়ে গিয়েছেন। ততক্ষণে তারা বাবার হাতঘড়ি এবং আংটি, রেডিও, টর্চ হস্তগত করে ফেলেছে, গলায় ছুরি ধরে আলমারির চাবি নিয়ে আলমারি খুলে সোনাদানা, পশমী শাল নিয়ে জড়ো করেছে, একটা ভালো লেদারের ব্যাগে বাড়ির যাবতীয় কাঁসা পিতলের বাসন গুছিয়ে নিয়েছে। আমার গলায়, কোমরে ছুরি ধরে বাড়ির যত বাক্স, দেরাজ খুলিয়ে সব ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। আরও কি করতো কে জানে? এমন সময় নজর পড়েছে আমার কানে রিং দুটোর ওপর। সেদিকে হাত বাড়াতেই বাবা বলেছেন, “আমার মেয়ের গায়ে হাত দেবে না, আমি খুলে দিচ্ছি।” অনভ্যস্ত হাতে বাবা এক কানের দুল খুলতে খুলতে আমি নিজে আরেকটি খুলে ছুঁড়ে দিয়েছি ওদের দিকে। সেটা গড়িয়ে চলে গেছে আলমারির তলায়, আর সবাই মিলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ওটার জন্য। এই সুযোগে আমি ওদের ওপর দিয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বেরিয়ে এসে ঠাকুর ঘরে ঢুকে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। একজন তাড়া করে এসেও ছিল, কিন্তু তার আগেই আমি চেঁচিয়ে পাশের বাড়ির দাদাকে ডেকেছি। সঙ্গে সঙ্গে বাবাও সুযোগ পেয়ে হাঁক দিয়েছেন। ওরা দুই ভাই সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে একজন পাড়ার সবাইকে জড়ো করেছে, আরেকজন দৌড়ে গিয়ে ছোড়দাদের ক্লাবে খবর দিয়েছে।

ইতিমধ্যে ডাকাতরা বিপদের ইঙ্গিত পেয়ে পালাতে উদ্যত হওয়ায় বাবা একটাকে চেপে ধরেছেন, কিন্তু ওই দশাসই চেহারার যুবকের সঙ্গে পারবেন কেন? এক ধাক্কায় বাবাকে ধরাশায়ী করে আমাদের চোখের সামনে সবাই পালিয়ে গেল। এদিকে একদিকে পাড়ার ছেলেরা, অন্য দিকে ক্লাবের ছেলেরা দুই দিক থেকে তাড়া করায় বাসন ভর্তি ব্যাগ, গুছিয়ে রাখা স্যুটকেস, একটা পশমী চাদর ফেলে রেখে বাকি সব, অর্থাৎ সোনাদানা, দামী শাল ইত্যাদি নিয়ে চম্পট দিয়েছে। 

এরপর তো পুলিশে খবর দেওয়া, তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি হয়েছে, কিন্তু লাভ হয়নি কিছুই। আশেপাশে যে ধানক্ষেত ছিল, তার মধ্যে পাওয়া গেছে নষ্ট হয়ে যাওয়া রেডিও এবং টর্চটা আর ওদের ছেড়ে যাওয়া কয়েক জোড়া চটি। 

সব মিলিয়ে হয়তো মিনিট দশেক, এর মধ্যে আমার মধ্যবিত্ত বাবার, সারা জীবন কৃচ্ছ্র সাধন করে যাওয়া মা ও বাবার, সবার প্রতি কর্তব্য পালন করার পর, দুটি মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর যেটুকু সামান্য শখ অথবা সঞ্চয় ছিল, সব নিয়ে চলে গেল। অনেকে প্রশ্ন করেছেন যে ব্যাঙ্কে না রেখে সোনাদানা ঘরে রাখা ছিল কেন? কিন্তু এতই অকিঞ্চিৎকর সেই সম্পদ, যে তার জন্য লকার রাখাও তখন সম্ভব ছিল না। এই রকম যে কখনও হতে পারে, তাই আমার বাবা মায়ের ধারণার বাইরে ছিল। আমার গলায় কোমরে ছুরির আঁচড় লেগেছিল। বাবাও মাথায় ব্যথা পেয়েছিলেন। সেই সামান্য ক্ষত অচিরেই মিলিয়ে গেছে, কিন্তু এই ঘটনা জীবনে একটা স্থায়ী ছাপ ফেলে গেছে।





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪