ভ্রমণ কাহিনী
একজন দীনবন্ধু মিত্র'র খোঁজে
সি রা জু ল ই স লা ম
১৮০০ সালের গোড়ার দিকে, যৌবনাদীপ্ত উন্মত্ত যমুনার তখন সে কি ভয়াল রুদ্রপ্রলয়। আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে রুদ্র-রোষানলে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে একের পর এক ভাঙনের উন্মাদনায় মেতে উঠেছে অত্যাচারিত প্রভু ইংরেজ নীলকরদের মতন। কার ওপর তার এই আক্রোশ, কিম্বা অভিমান কে জানে? কি জানি এক অজ্ঞাত কারণে মায়ের কোলের শিশুর মত বিস্তীর্ণ একটা জনপদকে মাতৃক্রোড়ে আগলে রেখে তার চারিধারে ভাঙ্গনের রুদ্রমূর্তিতে বাঁক খেয়ে ঘুরে এসেছে খোটায় বাঁধা দুরন্ত ষাঁড়ের মতন বৃত্তাকারে।
প্রবঞ্চিত নির্যাতিত অবহেলিত আর অসহায় মানুষগুলো একসময় এতদাঞ্চলের যমুনার বিধ্বংসী ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পাওয়া এই ভূ-খন্ডের নাম রেখেছিলো চৌবেড়ে (চৈবেড়িয়া)। অর্থাৎ চারিধারে যার বেড় বা বেড়া। কালের গর্ভে হয়তো একদিন এই অখ্যাত নামটাও মুছে যেতো পৃথিবীর মানচিত্র থেকে, নদী ভাঙনের করাল গ্রাসে। কিন্তু বিধাতাপুরুষের ইচ্ছে বুঝি অন্য।
শোষন নিপীড়ন আর অত্যাচারী নীলকরদের ক্রীতদাস হয়ে এই জনপদের মানুষেরা অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে। নীলকর ইংরেজ প্রভুদের এ যাতনার আমৃত্যু বৈষম্যের শিকার শ্রেনীপেশার মানুষের কথা তুলে ধরে সভ্য সমাজের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন মূল্যবোধের এক অসাধারণ সাহিত্যিক "দীনবন্ধু মিত্র(১৮২৯-১৮৭৩)" আশৈশব অভাবের সাথে লড়াই করেছেন। অদম্য সেই কিশোর গ্রাম্য পাঠশালায় (টোলে) চতুর্থ শ্রেনী অবধি পড়াশোনা করেছেন। বিদ্যোৎসাহী বাবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতে কোন ত্রুটা ছিলো না সন্তানের শিক্ষার ভূমিকায়। তাই তো ছেলেকে পাঠালেন কোলকাতায় এক খুড়তুতো ভাইয়ের কাছে পড়াশোনার জন্য।
কোলকাতার "বিডন স্ট্রীট" থেকে অনেক প্রতিকুলতার মাঝখানে যুবক দীনবন্ধু মিত্র পড়াশোনা চালিয়েছেন মাধ্যমিক অবধি। তারপর বাবার অভাবী সংসারের হাল ধরতে গিয়ে জমিদারী সেঁরেস্তায় কাজ খুঁজে নিয়েছেন।
ততদিনের মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছে তাঁর সাহিত্য সাধনার সকরুণ এক সুর। রাগে অনুরাগে তাই তো কলমের খোঁচায় তুলে এনেছেন যাপিতজীবনের চাওয়া পাওয়ার কথা। পাওয়া না পাওয়ার আনন্দ বেদনার কষ্টগাথা। প্রায় আঠারোটারও অধিক তাঁর সেই বেদনায় ভরানো সাহিত্যগ্রন্থ। আর সে সমস্ত সাহিত্যগ্রন্থের মাঝ থেকে রাতারাতি তাঁকে প্রখ্যাত করে দিয়েছে অমর গ্রন্থ "নীলদর্পন" নাট্যগ্রন্থ।
ততদিনে সাহিত্যবোদ্ধাগণের কাতারে নাম লিখিয়েছেন "দীনবন্ধু মিত্র!" নামযশ ছড়িয়ে পড়েছে দিকেদিকে চারিদিকে। তাঁর বন্ধুদের কাতারে সামিল হয়েছেন, কথা সাহিত্যিক "শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়", বঙ্কিমচন্দ্র"র মতন অসাধারণ নামীগুনী জনেরা।
ছা-পোষা কেরানীগিরি থেকে পদোন্নতি পেয়ে ডেপুটি পোষ্ট মাষ্টার। এবং তারওপরে জমিদার বাবুদের মাথার মনি নীল রক্তের ইংরেজ প্রভূরা যখন তাঁকে "রায় বাহাদুর" খেতাব দেওয়ার জন্য সম্পূর্ণভাবেই প্রস্তুত হয়ে রয়েছেন, ঠিক সেই সময়ে বিধ্বংসাত্মক জ্বালাময়ী নাটক, "নীলদর্পন" প্রকাশিত হলো। আর সাথে সাথেই রায় "বাহাদুর" খরতাবের গুড়ে বালি পড়লো। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কাজ থেকে বহিস্কার করা হলো ; করা হলো চাকুরীচ্যূত।
অদম্য "দীনবন্ধু!" ইংরেজ প্রভূদের কাছে মাথা নত না করে বীরদর্পে এগিয়ে চললেন সেই বীরযোদ্ধা "দীনবন্ধু মিত্র।' বীরযোদ্ধা, লড়াকু সৈনিক। কলমযোদ্ধা সাহিত্যিক দীনবন্ধু মিত্র। শোষিত প্রবঞ্চিত বাঙালী সমাজের এক অদম্য পুরুষ।
সেদিন সকাল থেকেই শ্রাবণের আকাশে অঝর-ঝরায় ঝরছে শ্রাবণ-বৃষ্টি। থামাথামির কোন লক্ষণ নেই তার। গতকাল রাতেই ঠিক করা প্রোগ্রাম আমাদের। আমার শৈশব-কৈশোরের উন্মাদনায় ভরানো নাটক, "নীল দর্পন" নাটকের নাট্যকার "দীনবন্ধু মিত্র'র জন্মভিটাটা স্বচোখে দেখবো। সেজন্যই মনেমনে পুলকিত রোমাঞ্চিত, শিহরিত আমি।
সকালে বৃষ্টির ধারাটা একটু কমে এলে আমার সম্বন্ধী(মেয়ের মামা) "মাসুদ করিম ধনী", তাঁর শখের মারুতী গাড়ীটা নিয়ে প্রস্তুত। সাথে ক্যামেরা চালানোয় পারদর্শী তদীয়পুত্র স্নেহভাজন, "ইমতাজ ধনী।" আর সূচারু সুদক্ষ তরুণ, উদ্দীপনায় ভরানো মনেপ্রাণের এক উচ্ছ্বল যুবক, টোটন ভাই।" ঝরো ঝরো বৃষ্টি মাথায় আমরা চললাম, উত্তর চব্বিশ পরগনার "শিমুলীয়া থেকে নদীয়া জেলার চৈবেড়িয়া"র পথে।
জল থইথই সবুজ মাঠের বুক চিরে এগিয়ে চলা পাকা সড়কের পাশে, দু'ধারে গাছপালাগুলো জল ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমাদেরকে জানাচ্ছে সাদর-সম্ভাষণ। ওরা যেন আমাদেরকে ডেকে ডেকে ফিসফিস করে বলছে, "সেই তো এলে, তবে এতদিন পরে!"
গন্তব্যে যখন পৌঁছুলাম মেঘ সরিয়ে আকাশের বুকে কাঁচারোদ ঝলমলিয়ে হাসছে।
সেই আদ্দ্যিকালের ইমারত সামগ্রী চুন-সুরকি দিয়ে গাঁথা বিশাল আকারের সিং দরজাটা এখন বুড়ো-ঘোড়ার মতন হাঁড়-জিরজিরে শরীরটা নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। মাংসলসদৃশ্য বুকের পলেস্তরা খসে গেছে তার সেই কবে! আগাছায় ছেয়ে গেছে পুরোনো ঐতিহ্য। মরে হেজে শুকিয়ে গেছে শান বাঁধনো জমিদারীর খিড়কী পুকুর। যেখানে নায়েবী আমলের ঘর আলো করা বউ-ঝি'দের উচ্ছ্বাস আর অনুপ্রেরণায় ছলাৎ ছলাৎ জল-তরঙ্গ তুলে লুটোপুটি খেতো পায়ের নূপুর পুকুরের খাঁড়ুজল।
রাজা আসে রাজা যায়! সময় পরিক্রমায় অনেক কিছুই বদল হয়। বদলায়নি তবু প্রচন্ড প্রভাবশালী দোর্দন্ডপ্রতাপশালী নাট্যকার "দীনবন্ধু মিত্র'র" জন্মভিটেটা। তাঁর আঁতুড়-ঘরটা এখন ভাঁটগাছ আর বুনো আঁশশ্যাওড়া গাছের জঙ্গলে বিলীন হয়ে গেছে সঘন-ঘন গহন অন্ধকারে। সংস্কারের মনোভাবে কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ না।
কথা হচ্ছিলো "দীনবন্ধু মিত্র''র উত্তরসূরীদের চতুর্থ পুরুষ, "শ্রী সঞ্জিৎ মিত্র''র সাথে ; তিনি এখন কোলকাতা রাজ্য সরকারের পূূর্ত দপ্তরে কর্মরত আছেন। ক্ষোভে দুঃখে জানালেন, পাওয়া না পাওয়ার বেদনা। দু'হাজার এগারো-তে সরকারী সহায়তা দেয়ার কথা থাকলেও তা অদ্যাবধি কার্য্যকরী হয়নি। দীনবন্ধু মিত্র'র জন্মভিটায় একটা শ্বেত-পাথরের আবক্ষ মূরাল গড়ে দিয়ে দায় সেরেছেন তৎকালীন সরকারের হেরিটেজ মিনিষ্ট্রী যদিও নামফলকে মূর্তির নীচে খোদাই করা আছে,
"সৌজন্যঃ, "রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের"নাম।
আমাদের স্নেহপ্রতীম "ইমতাজ ধনী" ছবি তুলতে শুরু করলো। বারান্দায় বসা ছিলেন "সঞ্জিৎ মিত্র'র মমতাময়ী মা; দীনবন্ধু মিত্র'র নাতবৌ। বয়স তা প্রায় সত্তর পেরিয়ে গেছে কবেই। ইমতাজ ধনী তার ক্যামেরাটা তাক করে ধরে ছবি ক্লিক করতে চাইলে সঞ্জিৎ মিত্র'র বড়দা যিনি ঘরের ভেতরে চেয়ার টেবিল পেতে আয়েশ করে সকালের ফলাহার করছিলেন ; হা হা করে উঠলেন। বললেন, "মা তাঁর শাড়ীটা বদল করে আসুক।"
অপেক্ষার প্রহর কেটে গেলো। মা আর এলেন না। সঞ্জিৎ মিত্র জানালেন, "দীনবন্ধুর নাতবৌ হিসাবে যদিও মায়ের ছবিটা সংগ্রহে রাখা উচিৎ কিন্তু পারিবারিক রেওয়াজ অনুযায়ী ছবি তোলাতে তাদের একটু আপত্তি।" আমরাও আর ওই ব্যাপারে অহেতুক বিড়ম্বনার সৃষ্টি করলাম না। তবে সঞ্জিৎ মিত্র তাদের শয়নকক্ষের মূল ঘরটাতে নিয়ে চললেন। যেখানে দীনবন্ধু মিত্র'র বিশাল সাইজের একখানা ছবি বাঁধানো আছে সযতনে।
এপার বাংলা থেকে গিয়েছি তাই সঞ্জিৎ মিত্র আগ্রহভরে সবকিছু দেখালেন। লেখালিখির অভ্যাস আছে আমার শুনে তিনি আমাকে দীনবন্ধু মিত্র'র ব্যাপারে লিখবার জন্য তথ্য উপাত্ত দিয়ে সাহায্য করবেন আশ্বাস দিলেন।
এর আগেও অনেক লেখক বুদ্ধিজীবিগণ এখানে এসেছেন, তাদের লিখনী কি বলেছে তা আজও জানা হয়নি সঞ্জিৎ মিত্রদের। ঢাকা খুলনা তথা বাংলাদেশের অনেক নামীগুণী লেখক ওখানে যান। ব্যস ওই পর্যন্তই।
কথায় কথায় সঞ্জিৎ মিত্র।জানালেন, তাদের বর্তমান।সরকারের (মমতা ব্যানার্জি)র শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় থেকে এখানে "হেরিটেজ মিউজিয়াম" করবার কথা ছিলো। তবে সেখানে বাঁধ সেধেছেন সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব, "প্রসুন বন্দোপাধ্যায়", "শুভ প্রসন্ন'রা।"
তাদের দাবী, "চৈবেড়িয়াতে নয়, দীনবন্ধু মিত্র হেরিটেজ মিউজিয়ামটা হবে মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে দীনবন্ধু মিত্র কোলকাতা বিডন স্ট্রিটে যে বাড়ীটা কিনেছিলেন, সেখানটায়।"
"তা কেন? একজন প্রখ্যাত মানুষ, যে মাটিতে জন্মেছেন, যে মাটিতে তাঁর নাড়ী পোঁতা, আশৈশব যে প্রকৃতির রীপরসে তিনি বেড়ে উঠেছেন, যেটা আঁকড়ে ধরে বসে আছেন তাঁর উত্তরসূরীগণ বংশপরম্পরায়। সেখানে কেন নয়?"
বর্তমান মূখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা ব্যানার্জী নিঃসন্দেহে একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ। তাঁর সদিচ্ছায় গড়ে উঠতে পারে এই চৈবেড়িয়াতেই "দীনবন্ধু মিত্র হেরিটেজ মিউজিয়াম!"
প্রাপ্তিপূরণ প্রত্যাশায় তাই মূখ্যমন্ত্রীর সুদৃষ্টির দিকে উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছেন সঞ্জিৎ মিত্র'দের বংশলতিকা। নিশ্চয়ই একদিন উদ্ভাসিত আলোয় ভরে উঠবে অবহেলিত চৈবেড়িয়ার প্রত্যন্তাঞ্চলের মানুষের হৃদয়টা।
আর তখন অজন্তা ইলোরা, হরপ্পা, মহেন-জো-দাঁড়ো সভ্যতায় খুঁজে দেখার মত একদিন আমরাও খুঁজে পাবো অত্যাচারী নীলকরদের নীলকুঠির অন্ধকারাচ্ছন্ন ইতিহাস--- কালের গর্ভে যা হারিয়ে গেছে।
দীনবন্ধু মিত্র'র অনেক মূল্যবান সংগ্রহ, লেখা পান্ডুলিপি জমা হয়ে পড়ে আছে কোলকাতা বেঙ্গল সাহিত্য কেন্দ্রে স্তুপাকারে।
অন্তহীন অনন্ত জীবনের পথে স্বল্প সময়ের জন্য আমরা ক'জন এসেছিলাম একজন দীনবন্ধু মিত্র'র খোঁজে!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন