গল্প

পুতুল বাড়ি

শা শ্ব ত বো স

বাড়িটা বেশ পুরোনো। কতকাল ধরে একলা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে, ঘুন ধরা কঙ্কালের গোড়ায় গিয়ে ঠেকেছে, তার ইয়ত্তা নেই। বাড়িটার সব থেকে বড় সমস্যা ঠিক কি? বাড়িটা পুরোনো? নাকি বাড়িটা ভীষণ একলা? কোনটা? প্রায় প্রাগৈতিহাসিক কালের থেকে নরম রোদ, বাড়িটার গায়ে এসে পরে পোড়া ইঁটের রং লাল করে দেয়। যেন ইরানী শরাব, ঊর্ণজালে কস্তুরী হয়ে যাওয়া কোন এক কুলীন সময়ে, বেলোয়ারী কাঁচের গ্লাসে টলটল করতে করতে কত মেহফিল রঙ্গীন করে গেছে, এ বাড়ির প্রতিটা ইঁটকে সাক্ষী করে। এখন আর এ বাড়িটায় বিশেষ কেউ থাকে না। শুধু একতলায় এক দু ঘর ভাড়াটে। সদর দরজার উপর বাইরের দিক থেকে, দুপাশ দিয়ে বেশ অদ্ভুত দেখতে, দুটো পুতুল ঝুলছে। ঠিক কবে থেকে ঝুলছে, এর আগে ওরা ঠিক কোথায় ছিল, কেউ জানে না। দু হাত জড়ো করে ওরা আসা যাওয়ার পথে, সবাইকে নমস্কার জানায়। ওদের দেখেই হয়তো ভাঙা দরজাটার দিকে চোখ যায় পথ চলতি মানুষের। দরজাটাও ওদের সাথে আধখাওয়া পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে ঝুলতে থাকে, শুধু দুটো কব্জায় শরীর এলিয়ে দিয়ে। হয়তো ওই দুটো পুতুলের জন্যই কেউ কোনোদিন বাড়িটার নাম রেখেছিল, ‘পুতুল বাড়ি’। বাড়িটার উত্তরের কান ঘেঁষে চলে গিয়েছে, শিয়ালদাহ-মাঝেরহাট রেললাইন। সামনের রাস্তা পেরোলেই গঙ্গা। জল আর বাড়িটার মাঝে ক্রোধ-ঘৃণা-রক্ত-মাংসের তফাৎ এঁকে দিয়েছে এই সাপের মতো রেল লাইনটাই। ঝমাঝম ঝাঁপিয়ে যখন ফুল স্পীডে আপ কিংবা ডাউনের দিকে ট্রেন চলে যায়, নাগরিক ব্যস্ততাকে ঘুমের ঘন্টি ছুঁড়ে দিয়ে, তালে তালে বাড়িটাও দুলে ওঠে আর সেই দুলুনি এসে চুঁইয়ে পড়ে বাড়িটার ঠিক মাথায় বাঁধা পরীটার গা বেয়ে। ওই পরীটার গা বেয়েই সন্ধ্যে নামে শোভাবাজারের মোড়ে। অনিত্য গলিঘুঁচিতে আবির্ভাব হয় ময়না, চাঁদনী অনন্যাদের। সুতোর মত কুন্ডলী পাঁকিয়ে পিচ রাস্তাটা, ওদের শরীর বেয়ে চলে আসতে চায় বাড়িটার কোলে। এমনই কোন এক সন্ধ্যেবেলায় বাড়িটার সামনের ঝুলতে থাকা আটপৌরে বারান্দাটায় এসে দাঁড়ায় দুলালী, হাতে তেলের প্রদীপ নিয়ে। তার হাতের ধূপের গন্ধটা গড়িয়ে এসে একতলার ভিক্টরিয়ান কার্নিশে জমা হয়। পোষা বেড়ালটা রাতের মাছ-ভাতের লোভে, এখন থেকেই জমা হয়েছে সেখানটায়। দুলালীর মাথার চুলগুলো সাদা পাটের গাদার মত দুদিকে ফাঁক করা, মাঝের সরু সিঁথিতে উঁকি দিচ্ছে রক্তের মত টকটকে এক চিলতে সিঁদুর। বারান্দা থেকে গলির মুখটা অবধি দেখা যায়। সেখানে তখন লাল বাতির ইস্তাহার। ঠিক যেমন মজলিশ অনেক আগে বসত এ বাড়িটায়। ব্রিটিশ সাহেব আর বানিয়াদের ফুর্তি করার সময় লাল রঙের বাড়িটা কেঁপে উঠত টপ্পা-ঠুমরী-দাদরা সাথে ভারী নূপুরের চড়া কম্পাঙ্কে। তারপর সারারাত এ বাড়ির কোন এক চোর কুঠুরীতে কুমারীর সর্বনাশের শুরু, যৌনপিপাসু হায়নার উল্লাস, নারীকন্ঠের গগনভেদী আর্তনাদ, ভোরের দিকে একটি করে বিবস্ত্র প্রতিমার মুখ ভেসে উঠত চাঁপাতলার ঘাটের পাশের নরম মাটিতে। অনেক পরে এই বাড়িটা বাঈজী বাড়ী হয়ে যায়।


সকাল-দুপুর-বিকেল খদ্দেরের আনাগোনা লেগে থাকত বাড়িটায়। আজ বাড়িটা একেবারে একা। এমনই কোন এক পতিতাগর্ভে জন্ম হয়েছিল এই বুড়ি দুলালীর। কৈশোর যৌবনের অনেকগুলো আত্মঘাতী সন্ধ্যে পেরিয়ে, দুলালী রানীর জীবনে এখন ‘বুড়াপা’ এসেছে| এই পুরো বাড়িটার দোতলা জুড়ে একা একা হেঁটে বেড়ায় সে, খুঁজে বেড়ায় তার অন্ধ অতীত। গঙ্গার ঘাটের দিক থেকে বয়ে আসা হাওয়াটার অনিবার্য্য ধূলিকণা, তাকে মনে করায় তার হারানো ‘জওয়ানি’। ঠিক তখনই বি কে পালের দিক থেকে একটা গন্ধ ভেসে আসে বাড়িটার দিকে। খোলায় ভাজা চীনাবাদাম আর গণিকার স্বেদ মিলে মিশে থাকে গন্ধটায়। দূরের চাঁপাতলার ঘাট থেকে একটা আলো, শোভাবাজার স্টেশনের দিকে যায়, প্ল্যাটফর্মের বাতিগুলোর সাথে ফিসফিস করে কথা বলে। আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠলে নিভে যেতে হবে ওদের। নাহলে মধ্যরাতের চাঁদের নীল জ্যোৎস্না, কি করে খোলা ছাতের পাঁচিল টপকে ঢুকে সারা রাত পুরো ছাতময় গোল্লাছুট খেলবে? আজ এই জ্যোৎস্নার পথ ধরেই কেউ আসবে, তাকে যে আসতেই হবে। তার আসার জন্য সকাম বাসনায় রাত জাগবে পুরো বাড়িটা। এ যে যুগের নিয়ম, সেই নিয়মের অন্যথা হবার উপায় নেই। সেই নিয়ম মেনেই তো এতকাল ধরে সব টিকে আছে। এই টিকে থাকার একটা মুখবন্ধ নিয়ম আছে। গঙ্গার দিকের হাওয়াটা আবার বইতে শুরু করে। একটা হালকা শিরশিরে ভালো লাগা আছে হাওয়াটায়। যত রাত বাড়ে, ভালো লাগাটা আরো গাঢ় হয় দুলালীর। ঘরের পেন্ডুলাম ক্লকটায় রাত আটটার ঘন্টা পড়ে।

শোভাবাজার মোড় থেকে বড় গাড়িটা, এক নিঃশ্বাসে এসে থামে গলির মুখটায়। এরপরে এদিকটায় আর গাড়ি ঢুকবেনা। গাড়িটা থেকে নেমে পড়ে এক সুবেশী অ্যাংলো যুবক। সাথে ববি প্রিন্টের টপ আর জিন্স পরিহিতা এক তন্বী। চোখদুটো টানা টানা, নিজের একঢাল চুলে হাত বুলিয়ে সে, হাত ধরে অ্যাংলো যুবকটিকে নিয়ে, বাড়িটার ভেতর ঢোকে। সদর দরজাটা তার মাখনের মত তালুর চাপেই খুলে যায়। ভিতরে ঢুকে সশব্দে সেটাকে বন্ধও করে দেয় মেয়েটি। ভিতরটায় কালো মুখোশের অন্ধকার, ঘিরে আছে চারিদিক। পুরোনো কালের কাঠের সিঁড়িটা বেয়ে খট খট শব্দ করে, উপরের তলায় উঠে যায় ওরা। পুরো তলাটাই সন্ধ্যের সদ্যঃপাতী অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়ে আছে। অ্যাংলো যুবকটি মেয়েটিকে অনুসরণ করছে শুধু, মন্ত্রমুগ্ধ দাসের মত। বাবুকে মেয়েটি পাকড়েছে বড় রাস্তা থেকে। তার শরীরের জেল্লা দেখে যে কেউই তার কুহকে আটক পড়তে বাধ্য। তবু এই বাবুটিকেই সে বেছে নিয়েছে আজকে রাতের জন্য। এই মুহূর্তে ছেলেটির মন ও মস্তিষ্ক জুড়ে আসন্ন রতিকালে, একটি উজ্জ্বল পেলব শরীর সম্ভোগের প্রসন্নতা কাজ করছে, নাকি এই মায়াপুরীর দায়বদ্ধ মন্ত্রযাপনকে নিজের নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে সে, সেটা বলা মুশকিল। ক্রমশঃ তারা ঢুকে আসে দোতলার একটি ঘরে। অদ্ভুত ভাবে এই ঘরের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ নয়। এই ঘর মেয়েটির বহু পরিচিত। দীর্ঘকালের একান্নবর্তী সম্পর্ক তার এই বাড়িটার সাথে। বোঝাই যায় ঘরটি প্রায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের। পুরোনো পালঙ্ক, বিশাল কারুকাজ করা কাঠের দেরাজ, দেওয়ালে বিশাল বিলিতি চিত্রকরের আঁকা ছবি, সব কিছু ছাপিয়ে চোখ চলে যায় দেওয়াল থেকে ঝুলতে থাকা, ভিক্টরিয়ান যুগের সাজের আয়নাটার দিকে। বাহারি ফ্রেমে বাঁধানো সেটা। সামনের টেবিলে রাখা জিনিসগুলো কোনো রমণীর নিত্য ব্যবহৃত, দেখলেই বোঝা যায়। একটা হাতির দাঁতের চিরুনী, কিছু কাঠের বাক্স, গায়ে সুচারু শিল্পকর্ম এবং একটি রুপোর সিঁদুর কৌটো, ঢাকনাটা পাশে পরে আছে পরশ্রীকাতর নির্লজ্জ মেয়েলীপনায়। সেই রমনীই হয়তো সন্ধ্যায় বড় করে কপালে টিপ দিয়েছে সিঁদুরের, দিতে গিয়ে ছড়িয়েছে টেবিলটা জুড়ে কিংবা হয়তো সেটা নিয়ে কোনো সভ্য খেলা খেলেছে। ছেলেটাকে এবার চিৎ করে বিছানায় ফেলে তার ওপর চড়ে বসে মেয়েটি। ক্রমশঃ নিজের উর্ধাঙ্গ উন্মুক্ত করে, মেদোক্ত মাদকতায় খুলে ফেলে নিজের ব্রেসিয়ার। পাকা পেঁপের মত সুডৌল আপিন দোল দোল দুলুনি হতে থাকে। এরই মধ্যে অ্যাংলো সাহেবের উদ্যাপিত শিশ্ন, নিজের ময়াল যোনিগহ্বরে প্রবেশ করিয়েছে সে। ক্রমে দোলের মাত্রা বাড়তে থাকে, ছেলেটির চোখ বুজে আসে মনোক্রমী যৌনসুখে। হঠাৎ স্খলনের ঠিক আগে সে অনুভব করে, তার ঘাড়ের কাছে এক তীব্র শকুন দংশন। চোখ মেলে সে দেখে মেয়েটি নিজের তীক্ষ্ণ শ্বাদন্ত দিয়ে তার টুটি কামড়ে ধরেছে। কালো প্লাজমার মত ঘনীভূত রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। কোনভাবে ছেলেটি তাকে ছাড়াতে চেষ্টা করে। মেয়েটির হাতে তখন জেগে উঠেছে ক্ষুধাতুর হিংস্র নখ। এতক্ষণ যে নখে ছিল কামদেবীর প্রলোভন, এখন তা তাজা রক্তের স্বাদে পৈশাচিক কাব্যে পর্য্যবসিত হয়েছে। দেখতে দেখতে মেয়েটি তার হাতের নখগুলো দিয়ে, ছেলেটির বুক চিরে দেয়। নিদাঘী চাবুকের মত ফিনকি দিয়ে রক্তের ধারা, ঘরটার নিভু কর্পূর গন্ধকে ফুঁড়ে, ফেনা তুলে, ছড়িয়ে পরে চারপাশে। মেয়েটি তার লোলজিহ্বা দিয়ে চেটে, আকণ্ঠ পান করতে থাকে, সেই সাদা চামড়ার তাজা লাশের রক্ত। ছেলেটির হৃৎপিণ্ডে তখনও লাব-ডুব আওয়াজটা চলছে। তার বক্ষদেশের চামড়ার নীচে থেকে, কাঁচা মাংস খুবলে খেতে থাকে মেয়েটি। একটা তীব্র চিৎকার, তারপরে অপার নিস্তব্ধতা, ঠিক যেমনটা আজ সন্ধ্যেয় ছিল। মেয়েটি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে, আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়ায়। আয়নাটার সারা গা বেয়ে তখন, চুঁয়ে পড়ছে পুরু রক্তের ধারা। মৃত্যুর ছায়া তখন বাড়িময় ছড়িয়ে গিয়েছে। মেয়েটির শরীর ক্রমশঃ পরিবর্তিত হতে থাকে। তার উন্নত বক্ষযুগল শুকিয়ে আসে ক্রমশঃ, স্তনবৃন্ত অপরিণত হয়, সুনিপুণ কটিদেশে মেদ এসে জমা হয়, চামড়া কুঁচকোতে থাকে, পরিপুষ্ট নিতম্ব যুগল ইস্ট্রোজেনের অভাবে কাষ্ঠল হয়ে আসে। মেয়েটি আস্তে আস্তে দুলালী হতে থাকে। এই মেটামরফোসিস শেষ হলে, আয়নার গা থেকে রক্ত আঙুলে মেখে, কপালে টিপ দেয় দুলালী। বাগানের দক্ষিণের কামিনী গাছটায়, ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল এসেছে। এতক্ষণ ওদিকে হাওয়া বন্ধ ছিল, দমকা হাওয়ায় কুন্ডলী পাকিয়ে একটা তুরীয় গন্ধ ভেসে আসে সেদিক থেকে, চাপা দিয়ে দেয় কাঁচা মাংসের তীব্র গন্ধটাকে। আজ ভোররাতে আবার চাঁপাতলা ঘাটের দক্ষিণে, ভেসে উঠবে এক অ্যাংলো সাহেবের লাশ। এভাবেই দুলালী বেঁচে থাকবে, কালনিদ্রার ঈশ্বরী অতৃপ্তি নিয়ে। পুতুল বাড়ির বাতাসে বারবার বাজবে, মৃত্যুর ঠিক আগের সঞ্চারী বিষন্নতা। ঠিক যেমন পরীটার গা বেয়ে, পূর্ণিমার চাঁদটা গোলাপি জামা গায়ে দিয়ে, নেমে আসে অলৌকিক হিম জ্যোৎস্নার হাত ধরে।






 আঞ্জুম

সি রা জু ল  ই স লা ম 

পাহাড়ের হাতছানিতে আমি পাগল। পাহাড় ডাকে আমায়।  তাই ছুটে চলে যাই পাহাড়ের কাছে। সাগর আমার বড্ড অপছন্দের। সাগরের লোনাজলে মিশে আছে আমার দুচোখের তপ্ত লোনাজল। সত্যি বলতে কি ওই রাক্ষুসে সমুদ্রের লোনাজল একদিন কেড়ে নিয়েছে আমার আদরের ভাইটাকে। সেই থেকে আমি ঘৃণা করি সাগরকে। 

পাহাড়ের গা ঘেঁষে ছোট একটা গ্রাম গাবরা। গারোদের বসবাস। এখানে থেকে দূরের কালচে-সবুজ অনিন্দ্য সুন্দর  গারো-পাহাড়টাকে দেখি আমি অনিমেষ দুনয়নে। তাই মন উতলা হলে ছুটে আসি। এলোমেলো জীবনে ছুটে চলার গতিতে বেঁচে অক্সিজেন নিতে।

ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন থেকে নেত্রকোণা হয়ে বিরিসিরি যাবো। বিরিসিরির গারো-পাহাড়ের আদিবাসী গারোদের গ্রাম গোবরা। আপাতত কদিন থাকবো। 

নির্দ্ধারিত সময় থেকে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে ডাউন লোকাল ট্রেনের। এখানে ক্রসিং হবে আপ মেন লাইনের যমুনা এক্সপ্রেস। 

আন্তঃনগর এক্সপ্রেসের চেয়ে আমার পছন্দ ঢিমেতালে দীর্ঘ বরষ মাস রজনী ধরে ধুকপুক করে চলা লোকাল ট্রেন। 
লোকাল ট্রেনে চলার মজাটাই আলাদা। কত রকম স্টেশনে দাঁড়ায়। কত নিম্নবর্গের মানুষের যাওয়া আসা। কতরকম খিস্তিখেউড় শোনা যায়। শুধু টিকেট কেটে সুবিধাজনক জানালার পাশে একটা সিট হলেই ব্যাস। জম্পেশ যাত্রা। বলে রাখা ভালো, আমার বেকার জীবন। ভবঘুরে মানুষ আমি। ভোজনাং যত্রতত্র শয়নাং হট্টমন্দির গোছের একটা জীবন আমার। পেট ভরানোর জন্য কোন নির্জনস্থানে গিয়ে ছবি আঁকি। সেগুলো বিক্রি করে চলে যায় কিছুদিন। ফুরিয়ে গেলে নতুন করে আঁকি। তাই নো চিন্তা। 

স্টেশনে টি-স্টল থেকে চা-বিস্কুট খাওয়ায় পর একটা সিগারেটে আগুন লাগিয়ে বুনকা-ধোঁয়া ছেড়ে দূরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিতেই প্লাটফর্মের ওদিকটায় দুচোখ আটকে গেলো। 
কেউ একজন অনিন্দ্যসুন্দর ডাগরকালো হরিণচোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। না কি আমার ভুল! অন্য কারো দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি! দেখলেই বোঝার অসুবিধে হয় না, তিনি সত্যি অনিন্দ্যসুন্দর। দামী জড়োয়া গহনায় সুসজ্জিতা। বেশভূষায় কৌলিন্যের ছাপ।সুডৌল হাতের কব্জিতে সোনার কঙ্কন সুশোভিত হচ্ছে। ঠিক যতোটা না হলেই নয়, ঠিক ততোটাই মানানসই। একেবারে একে অন্যের পরিপূরক। কে কার অলঙ্কার!  

ধ্বক করে উঠলো বুকের ভেতর। "আঞ্জুম!" এতদিন পরে হঠাৎ এভাবে দেখা হবে ভাবতে পারিনি। আর ভেবেই বা কি লাভ? 

আমি গ্রাম থেকে উঠে এসেছি চারুকলায় পড়াশোনা করতে। ফাইনআর্টস এ। ময়মনসিংহ চারুকলায় ভর্তি হয়েছি। আর আঞ্জুম ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাগ্রো-টেকনোলজিতে। 

শহরের শিল্পকলা একাডেমির আর্টগ্যালারীতে আমার ছবির প্রদর্শনী চলছে সে সময়। বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়ে একদিন সে গ্যালারীতে এলো আঞ্জুম। 
আমার একটা ছবি দেখে সে ভীষণ মুগ্ধ। কিনে নেবার প্রচন্ড আগ্রহ প্রকাশ করলো। কিন্ত অতগুলো টাকা না থাকায় নিরাশ হলো। বললাম, ওটা আপনার জন্য রেখে দিচ্ছি! দয়া করে ঠিকানা রেখে যান। পরে এসে নিয়ে যাবেন। আঞ্জুমের সামনেই ছবিটাতে স্টিকার লাগিয়ে রাখলাম, "NOT FOR SELL! "

আমার প্রদর্শনীর সময় পার হয়েছে। সবগুলো ছবি বিক্রিও হয়ে গেছে শুধু ওই "নৈসর্গিক!" ছবিটি বাদে। ছবিটা এতোটাই চমৎকার সুন্দর অনেক গুণমুগ্ধ ক্রেতা অ নে ক মূল্য দিয়ে নিতে চেয়েছেন। তবু বিক্রি করা হয়নি। কারণ ওটা আঞ্জুম চয়েস করে রেখে গেছে। 

ফাগুনের এক অলস বিকেলে "নৈসর্গিক!"-কে রেপিং পেপারে মুড়িয়ে নিয়ে চললাম আঞ্জুম এর রেখে যাওয়া ঠিকানা ধরে। 
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোলোভা দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাসে একজন সুস্থ মানুষকে ভাবুক দার্শনিক বানিয়ে দেবে নিঃসন্দেহে। 

আঞ্জুমকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে আসছি। দেখি ক্যাম্পাসের ফুলেফুলে সাজানো রাস্তাটা ধরে শ্লথ গতিতে এলোচুলে একাকী ফিরে আসছে তার রুমের দিকে। 
অপসৃয়মান গোধুলির আলোয় অপরূপ এক ছবির স্কেচ এঁকে নিলাম মনের জানালায়। 
কাছাকাছি চলে এসেছি। বললাম, আপনার ছবিটা নিয়ে এসেছি। 
লজ্জায় তার ফর্সা মুখটা আরও লাল হয়ে উঠলো তাৎক্ষণিকভাবে। অস্ফুটস্বরে জানালো, "সত্যি আমি লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। আসলে আমরা গরীব। সামর্থ নেই অত টাকা দিয়ে মূল্যবান পেইন্টিং কেনার। লজ্জায় তাই আর এক্সজিবিশনে যাওয়া হয়নি। ক্ষমা করবেন।"
কথাগুলো শুনে বুকের ভেতর ধ্বস নামলো। বিনাবাক্য ব্যয়ে "নৈসর্গিক!" কে আঞ্জুমের হাতে তুলে দিয়ে বললাম, এটা আপনার জন্য রেখেছিলাম, আপনারই পাওনা এটা। 
---না না! এতো দামী পেইন্টিং কেন দেবেন? আমি তো দাম দিতে পারবো না। নিজেকে কায়ক্লেশের মধ্যে থেকে পড়াশোনা করতে হয়।গরীবের জন্য পেইন্টিং মানায় না। যাদের একবেলা খাবার জোগাড়ে হিমসিম খেতে হচ্ছে। 
---মনে করুন এটা আমার কাছ থেকে আপনার জন্য উপহার! 

অযথা অকারণ কথা বলতে বলতে সময় ফুরিয়ে এলো। পরে দেখা হবে প্রতিশ্রুতিতে যে যার গন্তব্য পথে পা বাড়ালাম। 

এরপর সময়গুলো দুরন্তপনায় কেটে গেছে। আমার পেইন্টিং বিক্রির টাকা খরচ চলে যায় আঞ্জুমের হাতে। মোটামুটি আনন্দময় জীবনের গতিতে পড়াশোনা করতে লাগলো। সময়ে অসময়ে দুজনে চলে যাই পাহাড়ের কাছে। আদিবাসীদের গাঁয়ে। মাটির গন্ধ বুকে মেখে ফিরে আসি দু'জন। 

আঞ্জুমের বিসিএস পরীক্ষা। তাই আগের মতন করে দেখা করা হয়ে ওঠে না আর। মেধাবী ছাত্রী। এই মূহুর্তে ডিস্টার্ব করার কোন মানেই হয় না। তাই বুকের কষ্ট বুকে রেখেই দূরে সরে থাকি। 

আঞ্জুমের বিসিএস পরীক্ষা শেষ হলো কয়েক দফায়। দেখা করতে গেলে পাগলের মতন বুকে টেনে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কেন এমন করে কষ্ট দিই। এক্সাম শেষ চলো বিয়ে করে ফেলি। 
সেসব শুনে হাসি। বলি তোমার তো ক্যাডারের জব হবে। বেকার ছেলের সঙ্গে কি তোমার বাবা-মা বিয়ে দেবেন। দু'ঠোঁট ফুলিয়ে তখন তার সে কি অভিমান! ছলছল দুচোখের ভাষা পড়তে কষ্ট হয় আমার। বুকের ভেতর জড়িয়ে রেখে আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিয়ে বলি, একটা চাকরি খুঁজে পেলেই তোমার বাবা-মাকে--- 

আমার গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধা মা। কাকাদের দেখভালে চলে। পৈত্রিক কিছু ফসলী জমি পুকুরের মাছ চাষের বদান্যতায় কাকারা মায়ের সেবাযত্ন করেন।
মায়ের শরীর সংকটজনক। খবর পেয়ে গ্রামে গিয়ে দেখি ততক্ষণে বেঁচে থাকার অদম্য প্রচেষ্টা মায়ের শুধু আমাকে দেখার জন্য। আমার কোলে মাথা রেখে মা চলে গেলেন। 

ছন্দবিহীন জীবনে আরও একবার ছন্দপতন হলো আমার।         তিনমাস পর আমার পৈত্রিক সম্পদের বিলিবন্টন ব্যবস্থা করে যখন আঞ্জুমের হোষ্টেলে খোঁজ নিতে এলাম। শুনলাম সে তাঁর গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। 
বেশ কদিন আগে তার বান্ধবীর ঠিকানায় দু'টো চিঠি এসেছে আমার। কেয়ার অফ সেই বান্ধবী। 

চিঠি খুলে পড়তেই আমার দুচোখের কার্ণিশে তপ্ত লোনাজল টের পেলাম। 
ভাষাটা মোটামুটি এরকম,
আমার জন্য অপেক্ষা করে শেষে গ্রামে গিয়েছে। গ্রামে প্রান্তিক কৃষক বাবা-মায়ের ঘরে আরও ক'জন পড়ুয়া সন্তান আছে। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছল পরিবারে যেটা চরম দুর্ভোগ। গ্রামের বিত্তবান পরিবারের সুশিক্ষিত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ছেলে (লন্ডনের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার) দেশে ফিরে এসেছে। তাকে দেখে মূহুর্ত দেরি না করে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছে। 
বাবা-মা তার কোন ওজর-আপত্তি শোনেনি। ছোট বোনগুলো আর অসহায় পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে শেষাবধি তাকে সম্মতি দিতে হয়েছে। আমি যেন তাকে ক্ষমা করে দিই। 

হাহাহা 
কী আনন্দ!! 
যাক, আঞ্জুম ফিরে পেয়েছে তার প্রিয় প্রাঙ্গণ। 
ভালোই তো। চালচুলোহীন সংসারে অশান্তির মধ্যে আছি। সেখানে তোমাকে কোন রাজসুখে রাখতাম বলো?? 

খোলা প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে বহুদিন পর বুকের ভেতর আড়মোড়া ভেঙে দেয় কষ্টগুলো। টের পাচ্ছি দুচোখের শিরশিরানি। 

কাঁধে কারো কোমল স্পর্শ পেতেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি বেদনাহত মুখে পাশে দাঁড়িয়ে আঞ্জুম। সাথে তার ছোট এক পুতুলসোনা। ঠিক যেন নিপুণ কারিগরের তৈরি একটা মাটির প্রতিমা। 
বললো 
---এটা আমার মেয়ে। কি করছো আজকাল?  জব করছো কোথাও?  বিয়ে করেছো?  ছেলেমেয়ে ক'জন? 

কি জবাব আছে দেবার মতো! 
জবাব না পেয়ে বললো,। 
---বিয়ে করে আমাকে নিয়ে দুবাই, লন্ডন দৌড়ের ওপরে কেটেছে দিন। আমার বিসিএস জব জয়েনিং অফার লেটার এলেও জব করতে দিলো না। মেয়ের দেখভাল করে সময় পার হয়েছে। চার বছর পর দেশে ফিরেছি। আগামীকাল ভোরে ফিরে যাবো তাই আজ গ্রাম থেকে চলে যাচ্ছি। 

নির্বাক হয়ে শুনলাম। 
বললাম 
---সুখী হয়েছো! 
নাগো, আমার আর জব করা হয় নি। কার জন্য কিসের জন্য জব করবো? 

বিয়ে? 
সে তো তোমার সাথে বিরিসিরি গাঁয়ের মন্দিরে আঙটিবদল করে করেছিলাম। 
নাহ্, 
সামাজিকভাবে বিয়ে করিনি আর। 
ভবঘুরে মানুষ। সময় পেলে চলে যাই বিরিসিরির সেই গোবরা গাঁয়ের মাটিতে। তোমার আমার স্মৃতির বুনিয়াদি সেই ঘরে। দুচারদিন সেখানে থেকে তোমাকে খুঁজি নির্জন পাহাড়ের কাছে। করজোড়ে মিনতি করতে থাকি তোমাকে ফিরে পেতে। 

কি যেন কি হয় আঞ্জুমের চোখে। জলের ক্ষীণকায় দুফোঁটা গড়িয়ে গেলো। 
সমালে নিয়ে মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে সে। 
ওদিকে তখন আপ ট্রেনের সাড়া পড়েছে। 
আঞ্জুম লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যায় তাঁর ট্রেন ধরার ব্যতিব্যস্ততায়। 
জলভরা চোখে আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি। 
তপ্ত লোনাজলের প্রতিবিম্বয় একজনা আঞ্জুম অ নে ক আঞ্জুম হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আমার দৃষ্টি-সীমানায়।  

আহা!  
বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি! 
এক জনমে মেটে না সাধ ভালোবাসিয়া! 

আঞ্জুম!
প্রিয় আঞ্জুম আমার! 
আমি যে সত্যি তোমাকে আজও ভালোবাসি!






আবার এসেছে

ম ধু মি তা  ধ র

জানালায় দাঁড়িয়ে পত্রালী আকাশ  দেখছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল তার। কালো মেঘে একেবারে ঢেকে গেছে আকাশটা। আবার নামল বলে, আজ তিনদিন হল জল ঝরিয়েই চলেছে। ঠিক যেন  একটা ছিঁচকাদুনে বাচ্চা, ইনিয়ে বিনিয়ে তারস্বরে কেঁদে চলেছে।

পত্রালী একবার পিছন ফিরে তাকাল। দেবরাজ বেডরুমের লাগোয়া কলঘরে দাঁড়ি কামাচ্ছে।বাবু রেডি হচ্ছেন অপিসে যাবার জন্য। পত্রালীর হঠাৎ মনে হল আজ দেবরাজকে আটকে দিলে কেমন হয়! সেও আজ ইস্কুলে যাবে না। পরীক্ষার খাতা জমা দেওয়া হয়ে গেছে। আজ না গেলে তেমন অসুবিধা হবে না। পত্রালী দেবরাজ কে ডাকল...
---রাজ, একটু শুনে যাও
দেবরাজ কাছে আসে। পত্রালী আদুরে গলায় বলে,
----একটা কথা রাখবে রাজ ?
দেবরাজ পত্রালীর গালটা টিপে দেয়।
----কি কথা গো?
----আজ তুমি আপিসে যেও না, প্লিজ---
দেবরাজ  অবাক  হয় না। কারণ তার বউটা মাঝে মাঝেই এমন আব্দার করে। দেবরাজ রসিকতা করে...
----কেন গো? আজ তো তোমার  জন্মদিন নয়, তবে কী আজ আমার শাশুড়ী মায়ের জন্মদিন  নাকি?
পত্রালী ঠোঁট ফোলায়।
----যাও, তোমার সব তাতেই  ইয়ার্কি---
পত্রালী বলে, আজ আমরা ভিজব।
দেবরাজ  আকাশ  থেকে পড়ে...
----ভিজব? অপিস না গিয়ে ভিজব? বস জানতে পারলে চাকরীটা নট হতে বেশী সময় লাগবে না।
এবার পত্রালী দেবরাজের গলা জড়িয়ে বলে...
----বসকে ফোন করে বলে দাও যে আমার শরীর টা ভাল নেই। তুমি আজ অপিস যেতে পারবে না।
দেবরাজের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। নতুন প্রোজেক্টের কাজ সবে শুরু হয়েছে। এখন একদিন  না যাওয়া মানে কাজে পিছিয়ে পড়া। দেবরাজ একবার করুণ চোখে বউ এর দিকে তাকায়।পত্রালী অনুনয় করে...
----প্লিজ, রাজ---
পত্রালীর ভঙ্গিমা দেখে চোখ ফেরাতে পারে না সে। সবে একমাস হল তাদের বিয়ে হয়েছে।নববধূ তায় সুন্দরী। পত্রালী যখন কথা বলে তখন তার সর্ব শরীর  নেচে ওঠে। দেবরাজেরও রক্তে দোলা লাগে। বউ এর বায়নায় রাজী হয়ে যায় সে। মোবাইল  নিয়ে বসের নম্বরে ফোন করে সে।
----স্যার, আমার মিসেসের শরীরটা হঠাৎ খুব খারাপ  হয়েছে। আজ আমি অপিসে যেতে পারব না।
ছুটি মঞ্জুর হয়েছে বুঝতে পেরে পত্রালী নেচে ওঠে।
----চলোনা রাজ, আমরা ছাতে যাই...
দেবরাজ কে হাত ধরে টেনে নিয়ে ছাতে যায়। ততক্ষণে বেশ বৃষ্টি নেমেছে। পত্রালী বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নাচতে থাকে। সেই সঙ্গে গান 'রিম ঝিম ঘন ঘন রে'.... দেবরাজ  মুগ্ধ দৃষ্টিতে বউকে দেখতে থাকে। নৃত্যরতা বউকে দেখে তার সত্যি সত্যিই একটা ময়ূরী বলে মনে হয়। পত্রালীকে পাঁজাকোলা করে তুলে দেবরাজ ও বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। দুই কপোত কপোতী যেন ভাললাগা, ভালবাসার জোয়ারে ভাসতে থাকে। সাক্ষী থাকে শুধু চারপাশের গাছপালা, বৃষ্টি আর আকাশ।

----পলা
পাশের ঘর থেকে দেবরাজের  ডাক শোনা যায়। পত্রালীর সম্বিৎ ফেরে। ছুটে যায় সে পাশের ঘরে।বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট্ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে দেবরাজের  বিছানা। পত্রালী দেখে, দেবরাজ  বালিশ থেকে মাথা তুলে হাত বাড়িয়ে জানালা বন্ধ করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। পত্রালী মরমে মরে যায়। আগেই খেয়াল করা উচিত ছিল তার। তাড়াতাড়ি জানালাটা বন্ধ করে দেয় সে।স্বামীর ভেজা শরীরটা যত্ন করে মুছিয়ে দেয় পত্রালী। খাটে বসে দেবরাজের  গায়ে হাত  বুলিয়ে দিতে থাকে।

টগবগে, চনমনে দেবরাজ আজ অসহায়,পঙ্গু। কোমর থেকে অসাড়। ডাক্তারেরা আশ্বাস  দিয়েছেন সে হয়ত আবার হাঁটতে পারবে। তবে আগের স্বাভাবিকতা কোনদিনই  ফিরে পাবে না।
 
আজ থেকে মাস দেড়েক আগের সেই ভয়ঙ্কর দিনটার কথা পত্রালীর থেকে থেকেই মনে পড়ে যায়। সেদিনটা ছিল শুক্রবার। শনি রবি ছুটি। কথা ছিল অপিস থেকে ফিরেই বউকে নিয়ে গাড়ীতে করে বেরিয়ে পড়বে শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে। ব্যাগ গুছিয়ে পত্রালী একেবারে রেডি।ফিরতে দেরী হচ্ছে দেখে ফোন করেছিল স্বামীকে। মোটরবাইকে থাকলে দেবরাজ সাধারণত  ফোন ধরেনা। পরে সুযোগ বুঝে রিং ব্যাক করে। তাই ফোন বেজে যাওয়াতে পত্রালী অবাক হয়নি।বেশ অনেকক্ষণ কেটে যাবার পর ফোন বেজে ওঠে। দেবরাজের নম্বর থেকেই ফোন আসে, তবে অচেনা গলা......
----আচ্ছা, আপনি কি পত্রালী বলছেন?
----বলছি, বলুন
----এই ফোনটা যাঁর, তিনি আপনার  কে হন?
----আমার স্বামী, কেন কী হয়েছে?
পত্রালীর গলা কেঁপে ওঠে।
----আমি কলকাতা পুলিশ থেকে বলছি। আপনার স্বামীর একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আমরা ওঁকে রুবি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।আপনি দেরী না করে রুবিতে চলে আসুন। পত্রালীর চোখের সামনে জগৎ সংসার দুলে ওঠে। পায়ের তলার মাটি সরে যায়। এবার কী করবে পত্রালী! কাকে খবর দেবে!
শ্বশুর, শাশুড়ী দুর্গাপুরে। মা আর দাদা থাকেন গড়িয়ায়। দাদাকে রুবিতে আসতে বলে সে তড়িঘড়ি হাসপাতালে ছুটে যায়। দেবরাজ  প্রাণে বেঁচে গেছে ঠিকই তবে কোমরের নীচ থেকে ভয়ঙ্কর  ভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে।একমাস হাসপাতালে কাটিয়ে দিন পনেরো হল সে সবে বাড়ী ফিরেছে। লাগাম ছাড়া ঘোড়ার  মত ছুটে চলা দেবরাজের  এখন বিছানাই একমাত্র ভরসা।

প্রকৃতির নিয়ম  মেনে ঋতুর পর ঋতু আসে, যায়। এক বছর পরে আবার ঘুরে এসেছে শ্রাবণ মাস।আবার জল ডুবডুব কলকাতা শহর। তবে পত্রালীর জীবন কোন নিয়ম মেনে এগোয়নি। অদৃশ্য  ভাগ্য নিয়ন্তা তার জীবন নিয়ে বেনিয়মের খেলায় মেতেছেন।আজ সকাল থেকে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। স্বামীর সব কাজ গুছিয়ে রেখে পত্রালীকে ইস্কুলে বেরোতে হবে। হঠাৎই দেবরাজ বউ এর হাত টেনে ধরে।
---- পলা, আজ তুমি স্কুলে যেও না প্লিজ
পত্রালী দেখে তার স্বামীর  চোখে শিশুর অনুনয়। সে বলে...
---- না রাজ, আমি আজ স্কুলে যাব না। আজ আমি সারাদিন  তোমার পাশটিতে থাকব।দেবরাজের পাশ থেকে উঠে পত্রালী জানালার ধারে যায়।ভেজা কাঁচের মধ্যে দিয়ে জানালার বাইরে তাকায়। বাইরেটা একেবারে অস্পষ্ট, ঠিক  তার ভবিষ্যতের  মত। এবার সে জানালাটা খুলে দেয়। আকাশের  দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে যায় রবি ঠাকুরের একটা গানের কলি...
'একী গভীর বাণী এল, ঘন মেঘের আড়াল ধরে,
সকল আকাশ আকুল করে...

পত্রালী ভাবে, মেঘের আড়ালে ঢাকা কোন গভীর বাণীর কথা কবি বলেছেন? সে কী প্রাণের  বাণী? পত্রালীর মনে হয়, বৃষ্টির  জলেই তো নতুন প্রাণের সৃষ্টি হয়।পরম মমতায় পত্রালী নিজের পেটে হাত রাখে। তার শরীরেও যে রিন্ রিন্ করে বাজছে নতুন  প্রাণের আগমনী গান।







শ্রাবনের এক বৃষ্টি স্নাত ভোরে

রু মা না  সো ব হা ন  প রা গ

আজ ভোরে বিদ্যুত চমকানোর আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল চপলের। ভেঙ্গে গেল স্বপ্নটাও। আষাঢ়ের তুমুল বারিধারাকে অনুসরণ করে চলেছে এই শ্রাবণ মাসও। শ্রাবণের অঝোর ধারায় বৃষ্টি ভোরের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে যেন নূপুরের রিনিঝিনি আওয়াজ তুলেছে প্রকৃতির বুকে। ভাঙ্গা জানালা ভেদ করে ঠাণ্ডা হাওয়ার সাথে ভেসে আসা এরোমেটিক জুঁই ফুলের সুঘ্রাণে মোহিত হয়ে আছে চপলের মন। কিন্তু তবুও কেমন যেন এক শূন্যতা ভর করেছে ওর মনে। ঘোর লাগা এই সকালে বিড়ালের মতো কুন্ডলী পাকিয়ে বিছানাতেই পড়ে রয় চপল। ওর কিছুতেই বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চাইছেনা। ইচ্ছে করছেনা স্বপ্নের ঘোর কাটাতে। স্বপ্নে দেখেছে  অচেনা এক শ্যামলা সুন্দরী ওদের বাড়ির গেটে হাসনাহেনা গাছের  নীচে এসে দাঁড়িয়েছে। কারো প্রতীক্ষায় সে নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে আছে। না হলে এই ঝুম বৃষ্টিতে দৌড়ে রিক্সা না খুঁজে অবিরাম কেউ ভিজে যেতে পারেনা; ঘুমের ভেতরেই ভাবনায় পড়ে যায় চপল। সে যদি অন্য কারও অপেক্ষায় থাকত তাহলে গেটের উল্টো দিকে রাস্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাতো। কিন্তু সেতো অপলক নয়নে চপলের দিকেই তাকিয়ে ছিল। চপল ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়েটির কাছে একটা ছাতা নিয়ে যাবে কিনা ভাবছে। আর এই ভাবনাতেই খড়গহস্ত চালালো বেরসিক বিজলি। স্বপ্নটা শুরুতেই শেষ করে দিয়ে গেল এই আচমকা বিজলি। শুধু অনুভূতিতে রয়ে গেল শ্যামলা বরণের ছিপছিপে গড়নের সেই মেয়েটি। 

চপল পেশায় একজন সদ্য পাশ করা চিকিৎসক। বাড়ির কাছে একটা ক্লিনিকে পার্ট টাইম কাজ করে আর বাকিটা সময় সে এমআরসিপি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যায় করে। নিজের বলে কেউ নেই তার। বাবা মা কে হারিয়েছে সেই ছাত্র অবস্থাতেই। হাসপাতালে আট ঘন্টা ডিউটি শেষে শূন্য বাড়িতে ফিরে বুয়ার রান্না করা ভয়ানক অখাদ্য গুলো গলা দিয়ে নামিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বিকেলে গোল পাহাড়ের মোড়ে গিয়ে বন্ধুদের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘন্টা খানেক আড্ডা দিয়ে আর চা সিঙ্গাড়া খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরে আসে সে। এরপর টিভির সামনে বসে কাটিয়ে দেয় আরও দুই তিন ঘন্টা তারপর আবার বুয়ার রান্না করা সেই ভয়ানক অখাদ্যগুলো দিয়ে রাতের খাবার সেরে সুনীল বা বুদ্ধদেব বসুর একটা বই ঘুম না আসা পর্যন্ত পড়তে থাকে। কোনো কোনো দিন পড়ার বইয়ের বদলে গল্পের বই পড়তে গিয়ে দেখে রাত ভোর হয়ে গিয়েছে। এভাবেই পালা বদল করে চলে যায় চপলের সকাল, সন্ধ‍্যা আর রাতগুলো।  ছন্দহীন জীবনে ছন্দপতনও নেই আবার  আনন্দের কোনো অনুসঙ্গও নেই চপলের। 

কিন্তু আজ ভোর থেকে কি এক বিষণ্নতা ছেয়ে ফেলেছে ওকে। আজকের মতো এমন নিঃসঙ্গ আর একাকিত্বের সকাল কখনও অনুভব করেনি চপল। জেগে থেকে সে স্বপ্নের মাঝেই ডুবে রয়। কেয়া আর এরোমেটিক জুঁইয়ের সুঘ্রাণে মেয়েটিকে অনুভবে পেতে চায়। তার এই সাতাশ বছরের জীবনে কোনো মেয়ে ভাবনায় এতোটা জায়গা নেয়নি যতোটা না নিয়েছে স্বপ্নে দেখা এই শ‍্যামলা সুন্দরী । 

মেয়েটির জন‍্য বুকের ভেতর অবিরত শ্রাবনের বারিধারা বয়ে চলেছে। তার হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ তার ভিজে যাওয়া এলো চুল, তার কানের রূপোর ঝুমকা, লাল ওড়নার লেসের কারুকাজ, পায়ের  আঙুলের আঙ্গোটা, কোল্হাপুরী চটি, হাতে ধরে রাখা ছোট্ট পার্স সবই যেন ওর বড্ড বেশী আপন মনে হয়। অনুভূতিতে একদম জীবন্ত হয়ে আছে মেয়েটি। 

 আচ্ছা মানুষ তো স্বপ্নে এমন কিছু দেখেনা যা সে বাস্তবে দেখেনি। তাহলে কি কোনোক্রমে এই মেয়েটি তার সম্মুখে এসেছিল! নিশ্চয়ই এসেছিল। হয়তো রোগী কিম্বা তার অ্যাটেনডেন্ট কিম্বা ছেলেবেলার কোনো বান্ধবী কিংবা বুক শপে বা কফি শপে দেখা অজানা কোনো মেয়ে, যে কিনা বহু আগেই অবচেতন মনে জায়গা করে নিয়েছিল। আজকে সে শ্রাবনের এই বারিধারায় নতুনভাবে মানসপটে জেগে উঠেছে। ক্ষণিকের জন্য এসে বুকে একটা হাহাকার তৈরী করে গেল। চপলের চোখ ছলছল করে ওঠে সেই অজানা অচেনা মেয়েটির জন্য। তাকে সে হারাতে চায়না।

 চপল চোখ বন্ধ করে মেয়েটির কাছে মিনতি করে বলে

“আরেক বার স্বপ্নে বা বাস্তবে ফিরে এসো।

আমার শুষ্ক তপ্ত মনে বারিধারা হয়ে এসো।

কেয়া আর জুঁইয়ের সুঘ্রাণ মেখে এসো।

আমার প্রতিটি ভোর রিনিঝিনি চুড়ির আওয়াজে ভেঙ্গে দিতে এসো।

স্বপ্ন থেকে তুমি রক্ত মাংসের শরীরে ফিরে এসো।

এই নিস্তরঙ্গ জীবনে ঝংকার তুলতে তুমিই এসো।"






প্রফেসর বক্সী

সা হা না

প্রফেসর বক্সী বেশ অবাক হলেন! এই জঙ্গুলে পাহাড়ি এলাকাটা একদম সৃষ্টিছাড়া! দেশে বিদেশে অসংখ্যবার বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর-এ গিয়েছেন... সঙ্গে বিশ্বস্ত সঙ্গীরা। সরকারি চাকরির পাশাপাশি প্রফেসর একটি বিশেষ গবেষণায় নিযুক্ত হয়েছেন কয়েকবছর। এই জায়গাটা একদম নতুন! ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন বারো জনের টিম। আজ ভোরে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। ঘুম ভেঙে গ্যাছে তখনই। গাছের ডালে ডালে টুপটাপ, ঝুপঝাপ জলের শব্দ... শুনতে শুনতে বর্ষার কথা মনে পড়লো। অধ্যাপনার লম্বা জীবনে কতশত ছাত্র-ছাত্রীর সান্নিধ্যে এসেছেন! তাঁর সুপুরুষ চেহারার আকর্ষণে অনেক তন্বীই ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছে! কিন্তু,  তিনি তো অকৃতদার থাকবেন, এমনটাই ব্রত তাঁর। নারীসঙ্গ? নাহ্!

বর্ষা কিন্তু অন্যরকম। এই হঠাৎ বৃষ্টিটার মত আনপ্রেডিক্টেবেল। ভালো ছাত্রী, সুন্দরী। সবকিছু ছাপিয়ে তার ভালো গুণ হলো অসাধারণ কন্ঠ! গান এবং আবৃত্তি বড়ো মধুর! এমন কন্যার অমোঘ আকর্ষণ ছাড়িয়ে আসে, সাধ্য কার! তিনি তো সামান্য মানুষ!

মাস ছয়েক হলো এই সম্পর্কটাতে ব্রেক-আপ এনেছে বর্ষা নিজেই। হঠাৎই উত্তরবঙ্গের কোনো স্কুলে চাকরি নিয়ে ছেড়ে গিয়েছে পরিচিত শহর, সম্পর্কের উষ্ণতা। একটু হকচকিয়ে গেলেও প্রফেসর আগবাড়িয়ে কিছু বলেন নি। তাঁদের সম্পর্কের তো কোনো নাম ছিল না, কোন্ অধিকারে... উষ্ণতার অভাব আজকাল যেন একটু বেশিই বোধ করছেন!

চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বাইরে আসেন প্রফেসর বক্সী। জঙ্গলের এই দিকটা ক্যাম্পের জন্য ফাঁকা করা হয়েছে, ওপাশে ঘন জঙ্গল! একটু দূরে আগুন জ্বালিয়ে কফি করছে রাম বাহাদুর। তাঁকে দেখে হাতটা নাড়ে। মিশুকে স্বভাব এবং দরাজ মেজাজের অধিকারী প্রফেসর সব মহলে সমান জনপ্রিয়।

কিছু রক স্যাম্পেল কালেকশন করবেন। পূর্ব নির্ধারিত সূচী অনুযায়ী টিম রেডি। পাঁচজনের ছোট্ট দলটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়লো জঙ্গলে। সঙ্গে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, কম্পাস এবং মাপজোকের কিছু ডিভাইস। ম্যাপ অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হয়ে সকলেই কাজে লেগে পড়েন। পাথরের ঢিবি খুঁড়ে মূল্যবান সংগ্রহ বেশ পরিশ্রমের! কাজের ফাঁকে প্রফেসর বক্সী একটু এগিয়ে একটা অর্জুন গাছের তলায় বসলেন। বেশ ঘাম ঝরছে! গাছের তলাটা ঠান্ডা! ওদিকে কাজ থেকে মুখ তুলে সুপ্রকাশ বলে, "স্যার একটু জিরিয়ে নিন্।"

গাছ থেকে টুপ্ করে কি একটা পড়লো কোলে! চমকে উঠলেন... একটা সাদা, নিখুঁত গোলাকৃতি মসৃণ পাথর! কি এটা? স্ফটিকের মত স্বচ্ছ! পকেটে ভরে রাখলেন।

সেদিন রাতে...
খেয়েদেয়ে সারাদিনের রিপোর্ট তৈরিতে বসেছেন ছোট্ট ডেস্কে। হঠাৎ একটা ধাতব বিপ্ বিপ্। এ সিগন্যাল কিসের! এদিক ওদিক দেখতেই পকেটটিতে নজর পড়ে। সাদা-নীল দ্যুতি! কি ওটা? হাত ঢোকাতে পাথরটায় হাত ঠেকে... কি অদ্ভুত আলো! তাকিয়ে থাকেন এক দৃষ্টিতে!

"প্রফেসর! প্রফেসর!"
কে যেন একটানা... ধড়ফড় করে উঠে বসেন। "আহা! অত তাড়া কিসের!" ধমকান নার্স। এটা তাহলে হসপিটাল! কিন্তু....
উত্তরটা পেলেন। সহকর্মী প্রফেসর সেন এলেন। "কি বাঁধালেন, এক্সকারশনে গিয়ে? টানা সাতদিন জ্বরে একদম আউট?"

গলায় সহানুভূতি থাকলেও, স্পষ্ট শুনলেন মাথার ভেতরে রিনরিন "বেশ হয়েছে! ব্যাটার বিখ্যাত হবার শখ খুব!"

হাঁ করে থাকলেন, কিছুক্ষণ!
আরও কিছু এটা সেটার পর বিদায় নিলেন তাঁর সবথেকে বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বী! 

কিন্তু, সেই শুরু। তারপর একে একে অনেকে... মুখে একরকম, অথচ কাছে এলেই মস্তিষ্কের ভেতরে রিনরিন আওয়াজ অন্য কথা বলে। এসব কি হচ্ছে! মাথা চেপে ধরেন! সবার মনের কথা বুঝতে পারছেন, তিনি? চোখ বুজে বালিশে মাথা হেলান।

পাথরটা? সব ওটার জন্য নয়তো!  চোখ খোলার আগেই কপালে নরম স্পর্শ!

---কে?
সাদা নীল চুড়িদারে অপরূপা বর্ষা ঠিক সামনেই এসে বসেছে! চোখের দিকে তাকাতেই গাঢ় অভিমানের ছোঁয়া পেলেন! আর, এই প্রথম! কোনো রিনরিনে শব্দ নেই!

পাথরটা এখনও আছে। বিভিন্ন সংগ্রহের আলমারিতে। শুধু একটু ছোটো হয়ে গিয়েছে!
প্রফেসর বক্সীর সুখী দাম্পত্য জীবন দুই পেরিয়ে তিনের দিকে।






স্বপ্নফেরি

ম ধু মি তা  ভ ট্টা চা র্য

মঙ্গলবারের ভোরে পা বাড়ালো  বিধু বাসস্ট্যান্ডের দিকে। টিনের বাক্সটা একটু ভারী, তাতে আপত্তি  নেই বিধুর। লক্ষীর খুব আপত্তি ছিল টিনের বাক্স নিয়ে বেড়াতে যেতে। "টুলি ব্যাগ" না হলেও একটা ভিআইপি ব্যাগের ব্যাবস্থা করেছিল কদিনের জন্য টিয়া দিদিমনির থেকে। কিন্তু বিধু রাজী হয়নি। যা নিজের আছে তাই নিয়েই চলবে সে।
  
বিয়ের দীর্ঘ আট মাস পরে নতুন বউকে নিয়ে হানিমুন আর ফুলশয্যে দুইই পালন হবে। তাই এই বেড়াতে যাওয়া।

হ্যাঁ ফুলশয্যে ও। একটা দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরে মা বাবা ছোট ছোট তিন ভাই এক বোন আর নতুন এক বউ নিয়ে বিধুর ঘর সংসার। 
পেশা জিজ্ঞেস করলে বিধু বলে "রঙ্গিল রঙ্গিল স্বইপনো উড়াই  দি আইকাশে" 
" কি?  সেটা আবার কি? এইরকম কোনো পেশা হয় নাকি?
বিধু গর্বের সাথে উত্তর দেয়" হ হ হয় গো হয়। " 
মুখে আধ পোড়া বিড়িটা আবার জ্বালাতে জ্বালাতে  বলে "কত্ত স্বইপনো, সুতায় বান্ধে ছাইড়া দি, হুই আইকাশ পানে"।
বিধু বেলুনওয়ালা। বেলুন বিক্রি করে। এছাড়া নিজের বাড়ির ছোট্ট উঠোনে লঙ্কা চারা, শাক, লাউ বোনে। মাঝে মাঝে রাস্তায় বসে বিক্রি করে।

স্বপ্ন বেচতে বেচতে, বিধু ও স্বপ্ন দেখে বউ এর। বউ এসে ঘরের কাজ করবে। তাকে সাহায্য করবে কাজে। বাবা মা ভাই বোনের যত্ন করবে। ছেলে পুলে দেবে। ছেলেকে পড়িয়ে বিধু চাকরি করতে পাঠাবে...  আরো আরো অনেক স্বপ্ন...

দশ ফুট বাই দশ ফুটের হিসাব সে করেনি। ফুরসৎ ও পায়নি সেই হিসাব করতে। বউ "মূখ্য" হলেও এই হিসাব সে জানে। গন্ধ সাবান মাখতে চায় স্নানের সময়। পান্তা ভাতে পিঁয়াজ না পেলে মুখ কালো হয়ে যায়। ঘন কালো চুলে সর্ষের তেল মাখতে চায়। লঙ্কা চারার পাশে একটা বেলফুলের চারাও লাগিয়েছে বউ।

তাই বিয়ের আট মাস পরেও বিধুর ফুলশয্যে হয়নি।

বিধু বেলুনওয়ালা স্বপ্ন নিয়ে টিনের বাক্স দোলাতে দোলাতে চলেছে নতুন বউ লক্ষ্মীকে নিয়ে দুই তিন দিনের জন্য বেড়াতে। লক্ষ্মীর জেদের কাছে হার মেনে
বেড়াতে গিয়েও বেলুনের প্যাকেট নিতে সে ভোলেনি। সুযোগ মতো স্বপ্নর ডালি নিয়ে দাঁড়াবে। ওড়াবে, বেচবে।
 "তাইরাতারী পা ফেল দেহি,"
"ওকি! দাঁইড়ি গেলি কেন রে লুখখি" "অই দেখো" লক্ষ্মী আঙ্গুল তুলে দেখালো।

 " কি?" বিধু বুঝতে পারছে না।

 লক্ষ্মী খিলখিল করে  হেসে উঠলো।

হাসির বুঝি রং হয়, হাসিও উইড়া যাতি পারে হুই আইকাশে, ভাসি থাইকতে পারে আইকাশে, বেলুনের মতো হাসি হয়?
 হাসি স্বইপনো হোতি পাইরে কি কইরা?
 
 আবার কান পেতে স্বইপনো।
 কানেও স্বইপনো?
 
 বিধু আকাশের দিকে তাকায় স্থবিরের মতো,
উড়ছে অনেক বেলুন শব্দ নিয়ে, খিলখিল হাসি সারা আকাশ জুড়ে শুধু "স্বইপনো "।






উড়ান

ক বি তা  চ ক্র ব র্ত্তী

চারটে বেজে গেল। আর একবার ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো বাবাই-এর মা। স্কুল থেকে ফেরার সময় তো  অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছে। তবুও বাবাই এখনও ফিরছে না। অস্থির লাগছে কেমন। কিছু হলো না তো ছেলেটার? কোনোদিন তো দেরী হয়না আসতে। তাহলে আজ কি হলো? ওর মা রাস্তার দিকে  তাকিয়ে আছে অধীর হয়ে ওর ফেরার অপেক্ষায়। 

একটু পরেই আবার আঁকার ক্লাসে যেতে হবে। সেখান থেকে এসেই টিউশন। রাতের  টিউশনে অবশ্য ওর বাবা নিয়ে যায়। রাতে বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে আবার একটু পড়তে বসতে হয় পরদিন স্কুলের পড়া করতে। সারাদিনই ছেলেটাকে ছুটোছুটি করতে হয়। কিন্তু কি আর করা। ক্লাস নাইনে উঠবে এবার। সেকেন্ড হয় ক্লাসে।এত প্রতিযোগিতা ক্লাসের বন্ধুদের সাথে। যেকোনো সময় যে কেউ টপকে যেতে পারে ওকে। একটু সময়ও নষ্ট করা যাবেনা। একটু ঢিলে দিলেই পিছিয়ে পড়বে। তাই না চাইতেও এই প্রতিযোগিতার জীবন ওকে দিতে হয়েছে। আমাদের জীবন তো এরকম ছিলনা। আমরা পড়াশুনা খেলাধুলা সব করেছি। কিন্তু এখনকার পড়াশুনা একদম আলাদা। সব জায়গায় প্রতিযোগিতা। বাবাই এর জন্য সত্যিই এক এক সময় খুব কষ্ট হয় ওর মার।

কিন্তু বাবাই আসছে না কেন এখনও? বাড়ি থেকে স্কুল তো মিনিট পনেরো লাগে সাইকেলে। স্কুল থেকে বেরোতে না হয় পাঁচ দশ মিনিট দেরী হতে পারে কোনো কোনো দিন। কিন্তু তাই বলে এত দেরী?

তিনটে-তে ফেরার কথা, এখন তো  চারটে  বেজে গেছে। এখনও ফিরছে না কেন ছেলেটা। বাবাই এর মা এবার  অস্থির হয়ে ওর বাবার অফিসে ফোন করলো। ফোন করা হলো স্কুলের বন্ধুদেরকেও। সবাই বললো বাবাইকে দেখেছে সাইকেল নিয়ে স্কুল থেকে বেরোতে ছুটির সময়। বাবাই এর বাবাও তাড়াতাড়ি ফিরে এলো অফিস থেকে। সবাই মিলে আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী সবার বাড়ি খোঁজ নেওয়া হলো। কোথাও নেই বাবাই। কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারলো না বাবাই-এর। মা ঠাকুমা তো কান্নাকাটি শুরু করলো। প্রতিবেশীরা বাড়িতে জড়ো হলো। সবাই এক কথাই বললো, পুলিশে খবর দিতে। 

এরকম যখন পরিস্থিতি, সবাই থানায় যাবে জন্য ঠিক করলো, তখন পাড়ার একটা মেয়ে বললো, বাবাইকে আজ স্কুলে যাওয়ার সময় সান্টুর সাথে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছে। যদিও তার সাথে বাবাই এর নিখোঁজের কোনো সম্পর্ক হয়তো নেই। কিন্তু সে দেখেছে জন্য বললো।

সান্টু হচ্ছে বাবাইদের বাড়িতে যে সুধা কাজ করে, তার ছেলে। বাবাই-এর থেকে একটু বড়ো। সুধা পাশের পাড়ায় থাকে। এই পাড়ার অনেক বাড়িতেই সুধা কাজ করে। বিধবা সুধা একমাত্র ছেলে সান্টুকে নিয়ে বাপের বাড়িতেই থাকে। লোকের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালায়। সান্টু যখন ছোটো ছিল, তখন ওকে সাথে করে নিয়েই সুধা প্রত্যেকের বাড়িতে কাজ করতো। এক জায়গায় ওকে বসিয়ে রেখে সুধা সব কাজ করতো। সান্টু নিজের মনেই খেলা করতো। ছোটবেলায়  সুধা  বাবাইদের  বাড়িতে সান্টুকে নিয়ে এলে, দুজনে একসাথে খেলাও করতো।  দুজনের বেশ বন্ধুত্ব ছিল। একটু বড় হলে সান্টুকে পাড়ার স্কুলে ভর্তি করলে ও আর মায়ের সাথে আসতো না। কিন্তু অনেক দিন রাস্তায় দেখা হলেই বাবাই নিজেই ওর সাথে কথা বলতো। তবে অনেক দিন আর কথা হয়না দুজনের। সান্টুতো পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছে সেই কবে। আর বাবাই-এর তো সারাদিন পড়াশুনার পেছনে ছোটাছুটি করেই কাটে। সময় কোথায় কারুর সাথে গল্প করার? অন্যদিকে সান্টু লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে সারাদিন খালি খেলে বেড়ায়। সকাল থেকে রাত অবধি বাইরে। শুধু  খাবার সময় সে বাড়িতে ঢোকে। পাড়ার যত বখাটে ছেলের সাথে তার বন্ধুত্ব। বলা যায় ও তাদের লিডার। তারা সবাই গুরু বলে ডাকে ওকে। কার বাড়ির গাছে কোন ফল পেকেছে সব ওই দলের নখদর্পণে।  কারুর গাছে কিছু থাকেনা ওই দলের জন্য। সুধা অনেক বকাবকি করেও ছেলেকে ঠিক করতে পারেনি। বাড়িতে এসে লোকে অনেক কথা শুনিয়ে গেছে সুধাকে। কিন্তু ওই ছেলের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আজকাল নাকি নেশাও করে। বিড়ি সিগারেট তো অনেক ছোটবেলা থেকে খেতে দেখেছে সবাই। অন্য নেশাও নাকি ধরেছে। যদিও লোকমুখে শোনা। সুধা বাবাই এর মায়ের কাছে এসে দুঃখের কথা বলে আর চোখের জল ফেলে। 
তবে, গুলি খেলা হোক কি ঘুড়ি ওড়ানো, সান্টুর সাথে কেউ পেরে ওঠেনা। যে কোনো খেলাতে ওকে কেউ হারাতে পারেনা। ফুটবল খেলাতে তো অন্য পাড়ার ছেলেরা ওকে নিয়ে যায় খেলানোর জন্য। কিছু টাকাও নাকি পায়। ছেলেটার পায়ে নাকি জাদু আছে সবাই বলে। কিন্তু হলে কি হবে, বদসঙ্গে মিশে ছেলেটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার মনটাও কিন্তু খুব ভালো। কেউ বিপদে পড়লে, সান্টু এক কথাতেই হাজির। রাতবিরেতে কেউ মারা গেলে, শ্মশানে কেউ নিয়ে যাবার না থাকলে, এক ডাকেই সান্টু হাজির হয়ে যায়। কেউ খেতে না পেলে বাড়ি থেকে নিজের খাবারটা এনে তাকে দেয় সান্টু। খেলে যেটুকু টাকা পায়, সব বন্ধুদের দিয়ে দেয়। যে কোনো দরকারেই ওকে পাওয়া যায়। অথচ দরকার ফুরিয়ে গেলেই সেই মানুষ গুলোই ওকে খারাপ ছেলে বলে।

একটা ক্লু পাওয়ায় সবাই ঠিক করল, আগে সান্টুর সাথে কথা বলা যাক। ওর সাথে সকালে কি কথা বলেছে সেটা শোনা যাক। ওকে হয়তো কিছু বলে থাকতেও পারে। সান্টুর সাথে দেখা করার জন্য সবাই মিলে সুধার বাড়ি যাওয়া হলো। কিন্তু ওই ছেলেকে  কি আর ঘরে পাওয়া যায়? কোথায় খেলে বেড়াচ্ছে বা আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছে কে জানে। খোঁজ করতে, কেউ একজন  বললো, সান্টু তো মাঠে আছে। ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। 

বাড়ির থেকে একটু দূরে স্কুলের  বড়ো মাঠ। যে মাঠেই দিনের বেশিরভাগ সময় সান্টুর কাটে একদল বখাটে ছেলেদের সাথে। ওই মাঠটাই ওদের আড্ডার জায়গা। সব বদমায়েশির জায়গা। 

সুধাকে নিয়ে সবাই সেই মাঠের দিকে চললো। দূর থেকে দেখা গেল, সান্টু তার বন্ধুদের সাথে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। আর ওদের সাথে স্কুলের পোশাকে আছে বাবাই। সান্টু  ঘুড়ি ওড়াচ্ছে আর লাটাই বাবাই এর হাতে। সুতো ধরে ঘুড়িটাকে আকাশের ওই দূরে উড়িয়ে দিয়ে সান্টু বাবাইকে শেখাচ্ছে কেমন করে ঘুড়ি ওড়াতে হয়। সান্টু চিৎকার করছে, 
-- ঢিল দে, ঢিল দে বাবাই
বাবাই কি উৎসাহে চিৎকার করে যাচ্ছে আনন্দে। লাটাইটা ধরে সান্টুর পিছনে দাঁড়িয়ে কি উত্তেজিত বাবাই। একটু করে ঘুড়িটা  আকাশে উঠছে, আর বাবাই  এর চিৎকার দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।
কোনো সময় সান্টু চিৎকার করে উঠলো,
-- ভো কাট্টা

সবাই চিৎকার করে উঠলো। সান্টু আবার একটা ঘুড়ি কেটে দিলো।
কি ভীষণ খুশি বাবাই। সাইকেল, বইয়ের ব্যাগ সব পাশে পড়ে আছে। আজ আর কোনো টিউশন বা বইপত্রের কথা মনে নেই বাবাই এর। আজ বাবাই শুধুই সান্টুর মত এক কিশোর। এই জীবনটা তো ওরও পেতে ইচ্ছে করে। এই আনন্দটাও যে তারও  চাই। শুধু লেখাপড়া না, খেলাধুলাও তার প্রয়োজন। মনের আনন্দটা আগে দরকার। 

বাবাই মনের আনন্দে কেমন ঘুড়ি ওড়ানো শিখছে সান্টুর কাছে।  এই শেখার আনন্দের সাথে অন্য কোনো আনন্দের তুলনা হয়না। এত আনন্দ  বাবাই কোনোদিন পায়নি। সারাটা দিন শুধু পড়া, টিউশন, আঁকা, কম্পিউটার, আবৃত্তি ক্লাস... ছেলেটার জীবন থেকে খেলাটাই হারিয়ে গেছে। শুধুই পড়াশুনা।

বাবাই এর মা ডাকতে যাচ্ছিল বাবাইকে। কিন্তু ওর বাবা থামিয়ে দিয়ে বললো, না থাক। ওকে আজ আর ডেকোনা। ওর নিজের আনন্দ ও নিজেই খুঁজে নিয়েছে। এই আনন্দটাও জীবনে দরকার। শুধু লেখাপড়া না, ওদেরকেও বাঁচতে দিতে হবে ওদের মতো করে। আমরাই ভুল করে নিজেদের ইচ্ছেগুলো ওদের ওপর চাপিয়ে দিই। ওরা কি চায় বোঝার চেষ্টা করিনা। আমাদের তো জীবন এমন ছিলনা। এত পড়ার চাপ ছিলনা। ওকেও এই আনন্দটা দিতে হবে আমাদের।

সন্ধ্যে গড়িয়ে যাওয়ার পর অপরাধীর মত মুখ করে ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ঢুকলো বাবাই। কত দেরী হয়ে গেল। রোজ স্কুল থেকে ফেরার সময় মাঠে সান্টুদের ঘুড়ি ওড়াতে দেখে খুব ইচ্ছে করতো ওদের সাথে ঘুড়ি ওড়াতে। কি করে ঘুড়ি যে ওই আকাশে উড়ে যায়, সেটা দেখার, জানার ইচ্ছে হচ্ছিল খুব কদিন ধরে। কিন্তু এত পড়ার চাপে সেই ইচ্ছেটাকে পূরণ করতে পারতো না। আজ সকালে হঠাৎ করেই সান্টুর সাথে দেখা স্কুলে যাবার সময়। নিজেই ওকে ডেকে ঘুড়ি ওড়ানোর ইচ্ছেটা জানিয়েছিল বাবাই। সান্টু তখন ওকে বলেছিল স্কুল থেকে ফেরার পথে মাঠে আসতে। সে শিখিয়ে দেবে কেমন করে ঘুড়ি ওড়াতে হয়। সেটা শিখতে গিয়েই এত দেরী হয়ে গেল। আজ কপালে কি আছে কে জানে ।

ভয়ে ভয়ে সাইকেলটা বারান্দায় রাখতে গিয়ে দেখলো মা রান্নাঘরে কি করছে, আর বাবা ড্রয়িং রুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছে।ঠাকুমা পুজোর ঘরে। তাকে দেখেও কেউ কিছু বললো না দেখে একটু অবাকই হলো বাবাই। আজ আঁকার ক্লাসে যাওয়া হলনা। অথচ কেউ কিছু বলছে না তাকে। হয়তো সবাই তার ওপর এত রেগে আছে যে কেউ কোনো কথা বলছে না তার সঙ্গে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঘুড়ি ওড়াতে না গেলেই বোধহয় ভালো হতো। সবাই তাহলে রেগে যেত না।
পড়ার ঘরে ঢুকে ব্যাগটা টেবিলে  রাখতে গিয়ে অবাক হয়ে গেল বাবাই। বিস্ময়ে  দেখলো, ওর পড়ার টেবিলে অনেকগুলো ঘুড়ি আর দুটো লাটাই রাখা। তাতে মাঞ্জা দেওয়া সুতোও আছে। ঘুড়ি লাটাইগুলোকে স্পর্শ করতেই কেমন যেন মনটা আনন্দে ভরে উঠলো বাবাই-এর। মনে হলো এক্ষুনি আর একবার মাঠে চলে গিয়ে ঘুড়ি ওড়ায় সে।

কাঁধে হাতের স্পর্শে চমকে পিছন ফিরলো বাবাই। দেখলো পিছনে কখন বাবা মা ঠাকুমা এসে  দাঁড়িয়েছে। ওদের হাসি হাসি মুখ দেখে আরো অবাক হলো বাবাই। বাবা এসে একটা লাটাই ওর হাতে দিয়ে বললো, 
-- কি ভাবছিস? এগুলো কোথা থেকে এলো? এগুলো আমি এনেছি। এগুলো সব তোর আর আমার জন্য এনেছি। কাল বিশ্বকর্মা পুজো জানিস তো। আর এইদিন কিন্তু  ঘুড়ি ওড়াতে হয়। ঠাকুমার কাছে শুনে দেখিস , ছোটবেলায় আমি কত ঘুড়ি উড়িয়েছি। স্কুল থেকে এসেই দৌড়াতাম মাঠে ঘুড়ি ওড়াতে। সারাদিন আকাশের দিকে চোখ থাকতো। একটা করে ঘুড়ি কাটত, আর আমিও পিছন পিছন দৌড়াতাম সেটাকে ধরার জন্য। সেইজন্য অবশ্যি মারও কম খাইনি বাবার হাতে। তাও সারাদিন ওই ঘুড়ি আর ঘুড়ি। জানিসতো বড়ো হয়ে আর কোনোদিন ঘুড়ি ওড়ানো হয়নি। আজ তোকে খুঁজতে খুঁজতে মাঠে গিয়ে দেখলাম তোরা কি সুন্দর ঘুড়ি ওড়াচ্ছিস। খুব ইচ্ছে করছিল ছুটে তোদের কাছে চলে যাই। আমিও সেই ছোটবেলার মত আবার তোদের সাথে ঘুড়ি ওড়াই। কিন্তু পারলাম না রে। অনেকটা বেশি বড়ো হয়ে গেছি তো তাই। কিন্তু বাড়ি ফিরে ঠিক করলাম আমি আবার ঘুড়ি ওড়াব। তোর সাথে। সব কিনে আনলাম সাথে সাথেই। কাল আমি আর তুই দুজন মাঠে যাব। একদিকে আমি আর তুই, আর একদিকে সান্টু আর ওর বন্ধুরা। দেখি কে কার ঘুড়ি কাটতে পারে। অবশ্য অনেকদিন ঘুড়ি ওড়াই না, হয়তো আমার ঘুড়ি সান্টু কেটে দেবে, কিন্তু তাও আমরা একসাথেই কাল সারাদিন ঘুড়ি ওড়াবো। কাল আর কোনো পড়াশুনা না। এবার থেকে সপ্তাহে একদিন পড়াশুনার ছুটি। শুধু খেলা। তাতে ক্লাসে বন্ধুদের থেকে একটু পিছিয়ে পড়লেও আমি জানি সেটা আমার বাবাই ঠিক মেকাপ করে নিতে পারবে।

অবাক হয়ে বাবার কথাগুলো শুনে গেল বাবাই। মা ঠাকুমাও বাবার কথাকে সমর্থন করলো। 
বাবাই এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। মা ঠাকুমাও এসে বাবাইকে জড়িয়ে ধরলো।






স্বাতী

অ গ্নি মি ত্র (ডাঃ  সা য় ন  ভ ট্টা চা র্য)

অনেক সময়েই যা দেখা যায় তা হয়না। আবার অনেক সময়েই হয়...।

স্বাতী সুন্দরী, ফর্সা।... একটু বয়স হয়েছে। ছেলেদের তো অল্প দীর্ঘ লাইন থাকার কথা স্বাতীর পিছনে।
  
তবে অনেক সময়েই যা দেখা যায় বা মনে হয়, তা হয়না। স্বাতীর বিয়ে হয়েছিল। তার পুরুষ বন্ধুর সংখ্যাও ছিল অনেক। তার স্বামী অনিমেষ তা ভালো চোখে দেখেনি। তাই ওদের ডিভোর্স হয়েছে সহজেই। স্বাতী চৌধুরী আবার স্বাতী সেন হয়েছে।... অনিমেষ কি শুধু স্বাতীর শরীরটাই ভালোবাসতো?... ওর মনটা পড়তে চায়নি সে। শরীর নিয়ে যদিও খেলতো । মন বুঝতে চাইতো যদি, তাহলে বুঝতো যে সেই সব পুরুষ বন্ধুরা নিছক বন্ধুই, আর কিছু নয়।...
   
স্বাতী নক্ষত্রের কথা শুনেছে স্বাতী। খুব একা ঐ নক্ষত্রটা।... তবে ওরই নিঃসৃত জল যখন ঝিনুকে গিয়ে মেশে তখন...। চয়ন স্বাতীর অফিসেই কাজ করে। বিবাহিত সে। তবে ওর মধ্যে কিছু একটা ব্যাপার আছে যা মেয়েদের আকর্ষণ করে। স্বাতীও চয়নের কাছে আসতে চায়।... তবে চয়ন খুব ভালোবাসে তার স্ত্রীকে। সে অন্য মেয়েদের দিকে বেশি তাকায় না। এটাও অদ্ভুত লাগে স্বাতীর। অনিমেষের কথা মনে হলেই খুব রাগ হয়। তখন আক্রোশ থেকেই স্বাতী কমলদা বা বিমলদার সাথে শারীরিক ভাবে চরম ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এই এদের নিয়েই অনিমেষের প্রবলেম হতো। কই, সেই অন্তরঙ্গতায় এখন তো কমলদা বা বিমলদার কোনো সমস্যাই হয়না।... আজকাল সবাই এসব ক্ষেত্রে যা সাবধানতা অবলম্বন করে, ওরাও তাই করে।... 

এই চয়নই কোথা থেকে সতী-সাবিত্রীর পুরুষ সংস্করণ হয়ে চলে এসেছে।... স্বাতীর মতো মেয়ে ওকে শারীরিক আনন্দ দিতে চায়, আর ও তা পেতে চায় না। অথচ এমন তো না যে কিছুই বোঝেনা!... হয়তো স্বাতী কয়েক বছরের বড়ো বয়সে, কিন্তু কী হয়েছে তাতে? ঠিক ভুল বলে কিছু আছে আজ?!... কে মানে এসব আজকাল?!... ইদানিং চয়ন দু- একদিনের ছুটি নিলেই স্বাতীর কেমন অস্থির অস্থির লাগে। কেন এরকম হচ্ছে কে জানে? কমলদা বা বিমলদা ছুটি নিলে তো এমনটা হয়না।...

কয়েক দিন পর ছুটি কাটিয়ে চয়ন এলো আবার। স্বাতীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো- ' আরে, কোথায় ছিলেন আপনি?' চয়ন বললো- 'একটু দূরে অন্য এক জায়গায় প্রোমোট হয়ে চলে যাচ্ছি। ভালো থাকবেন স্বাতী...।'

স্বাতীর মনে হলো যেন ওর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে...। ভিতর থেকে যেন একটা চাপা কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে! স্বাতী আজ প্রথম বুঝলো, ওর মনও আছে!






উড়নচন্ডী মন

কা বে রী  রা য়  চৌ ধু রী 

অহনা স্বচ্ছল পরিবারের গিন্নী, দুটি পুত্র সন্তানের মা। সুরজিৎ এর কাছে উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান বিষয় টিউশনি করার সুবাদে উভয়ের ভাললাগা থেকে ভালবাসার সোপান পেরিয়ে বিবাহবন্ধন।

 নববিবাহিত জীবন পরিবারের সবাইকে নিয়ে একত্রে বসবাস। প্রথম সন্তান প্রসব করার পর নিকটবর্তী বাবার বাড়িতে লাগাতার থাকার বায়না, একমাত্র মেয়ে কুটোটি নাড়তে পরিশ্রম। বাবা মায়ের আহ্লাদে সাজগোজ, আমোদ প্রমোদে কেটেছে এতোদিন। সুরজিৎ রূপের আগুনে মজেছিল, একবার আগুনে ঝাঁপ দিলে তাকে দগ্ধাতে হবে সারাজীবন। অতঃপর নিজে ফ্ল্যাট কিনে বাবা মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যায়। বউয়ের বাবা মা আদুরে মেয়ের সংসার সামলায়। সুরজিৎ নিজের বাবা মায়ের প্রতি কর্তব্য পালন করে চলে, রোজই খোঁজ খবর যাতায়াত, সবটাই বউয়ের অজান্তে চলছিল। দু বছর না ঘুরতেই আরেকটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সুরজিৎ বউঅন্ত প্রাণ, বউকে চোখে হারায়। এর পরিণতি বউ একাধিপত্য নায়িকা সংসারের, ছেলেদের নিয়ে স্কুলে যাওয়া এবং বাইরে সারাদিন কাটিয়ে একেবারে বাচ্চাদের সাথে নিয়ে বাড়ি ফেরা। 

সুরজিৎ যেদিন থেকে বউয়ের চালচলনে বাধা দেয়, এতোটা সময় বাইরে থাকা চলবে না, সেইদিনই কুরুক্ষেত্র বাঁধে। অহনা জেদী একগুয়ে প্রকৃতির, don't care করে স্বাধীনচেতা আচরণ। 

সুরজিৎ - শান্ত মানুষ রেগে গেলে যা হয় প্রতিদিন তর্কাতর্কি, ঝগড়া বিবাদ, নিজের গাড়িতে ড্রাইভ করে ছেলেদের পৌঁছে দিতো আবার নিজের বিশ্বস্ত ড্রাইভার দিয়ে নিয়ে আসতো। বাড়িতে ফিরে ছেলেরা দিদা দাদুর কাছে থাকতো, মা বন্ধু বান্ধবী নিয়ে ফূর্তি করতে বেড়িয়ে যায় আবার স্বামী আসার আগে ফিরে আসে। এমন লুকোচুরি খেলা বেশিদিন ধোপে টিকলো না। সুরজিৎ একদিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে নিজে ছেলেদের নিয়ে বাড়ি ফিরে খাবারের প্যাকেট অহনার হাতে দেওয়ার জন্য হাঁকডাক শুরু করে, কোথায় পাখি ডানা মেলে উড়ছে হাওয়ায়। 

মায়ের কাছ থেকে ফোন পেয়ে একগাদা শপিং হাতে নিয়ে ছুটে আসে, মুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই, ইনিয়েবিনিয়ে গাঁজাখুড়ি গপ্পো বাঁধে। সামনেই বান্ধবীর ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি পার্টি হবে সেজন্য পার্লারে গিয়ে ম্যাসাজ, ফেসিয়্যাল আর ড্রেস ও উপহার সামগ্রী কিনতে মলে যেতে হলো। সুরজিৎ বউএর উড়নচন্ডী চেহারা ও সাজপোষাক দেখে ওর হাবভাব ধরে ফেলতে সময় লাগল না। এইভাবেই ব্যভিচারিতা দিনের পর দিন বাড়তে থাকায় একদিন চরম পর্যায়ে তিক্ত হয়ে সুরজিৎ বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজের বাবা মায়ের কাছে ফিরে যায়। 

একবার নিজের কবর খুঁড়লে রেহাই নেই, বউকে বেশি ভালবাসার ফল তো ভুগতে হবেই, এছাড়া ছেলেদের প্রতি মায়ায় আবার ফিরে আসে। বউকে সংশোধন করার সাধ্য ওর নেই, নিজের অঢেল অর্থ উপার্জন তবু মনে সুখ নেই, রূপের আগুনে ঝলসে দিয়েছে ওর সংসারটা। বিউটিসিয়ান কোর্স শেখার অজুহাতে নিত্য বেড়োনো চাই।চেহারার জৌলুসে পুরুষের মন রাঙিয়ে খুশিতে আত্মহারা, চরিত্রবান স্বামী না ঘরকা না বাহার কা, নিজের কাজ আর উপার্জনে মনোনিবেশ করা ছাড়া উপায় নেই। 

এভাবে চলতে থাকলে একদিন সুরজিৎ গর্জে ওঠে - এ বাড়িতে থেকে এসব বেলেল্লাপনা চলবে না, সেইদিন বড় ছেলে বাবার কাছে থাকে, ছোট ছেলে মায়ের সঙ্গে দাদু দিদার বাড়িতে চলে যায়। খুব কাছাকাছি দুই বাড়ি হওয়ায় ছোট ছেলে মা ও বাবা দুজনের কাছেই আসাযাওয়া করে। বাবা ছেলেদের ও স্ত্রীর সবরকম দায়িত্ব পালন করে চলেছে। মাঝখান থেকে বড় ছেলেটি বাবা মায়ের মধ্যে বৈপরীত্য মনোভাবে বেড়ে ওঠার জন্য ড্রাগ অ্যাডিকটেড হয়ে রিহ্যাবে ভর্তি। বাবা ওকে সুস্থ করার জন্য উদার হস্তে চিকিৎসা করিয়ে চলেছে। 

আজ রিহ্যাব থেকে ছুটি, বাবা আনতে যাচ্ছে, ডাক্তারা বারবার করে বলে দিয়েছেন মায়ের সম্পর্কে কোন কথা উচ্চারণ করবেন না, মা ওর জীবনে এই অবস্থার জন্য দায়ী, আমরা কাউন্সেলিং করে সব জেনেছি, বাবা ওর আদর্শ। 

গাড়িতে করে আসার সময় ছেলে বাবাকে দেখে জড়িয়ে ধরে, একমুখ চওড়া হাসিতে যেন সেই শৈশবের খোকাটি বাবার কাছে আব্দার করে - বাবা আমাকে কিন্তু আজ আমার পছন্দের মেনু রান্না করে খাওয়াতে হবে আর তুমি আমি ভাই সেই ছোটবেলার মতো ক্যারাম খেলবো। আজ থেকে তুমি আমার ফ্রেন্ড, ফিলোজাফার অ্যান্ড গাইড।।






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চতুর্থ বর্ষ || প্রথম ওয়েব সংস্করণ || শারদ সংখ্যা || ১২ আশ্বিন ১৪৩১ || ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || দ্বিতীয় ওয়েব সংস্করণ || হিমেল সংখ্যা || ৪ ফাল্গুন ১৪৩০ || ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

তৃতীয় বর্ষ || তৃতীয় ওয়েব সংস্করণ || বাসন্তী সংখ্যা || ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ || ১০ মে ২০২৪